ঈদুল ফিতরের তাতপর্য ও শিক্ষা
মাওলানা লিয়াকত আলী
জুলাই আগস্ট/১৪
মাহে রমজানুল মোবারকের পর মুসলিম মিল্লাতের বার্ষিক প্রধান দুটি আনন্দ উৎসবের একটি হলো ঈদুল ফিতর। ঈদ অর্থ আনন্দ। আর ফিতর বলতে রোজার সমাপ্তি কিংবা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া উদ্দেশ্য।
দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনায় নিয়োজিত থাকার পর তাতে সমাপ্তি ঘটানো ও দিনের বেলায় পানাহারের স্বাভাবিক নিয়মে ফিরে যাওয়া উপলক্ষ্যে আনন্দ উপভোগের ব্যবস্থা দিয়েছে ইসলামি শরিয়ত। এটা শুধু অনুমতি নয়, বরং অনেকটা বাধ্যতামূলক নির্দেশ। কেননা শাওয়ালের প্রথম দিনে রোজা রাখাই নিষিদ্ধ। দুই ঈদের দিনে পানাহার করা ও আল্লাহর নেয়ামতের স্বাদ গ্রহণ করা অবশ্য পালনীয়।
হাদিসের গ্রন্থগুলোয় বর্ণিত আছে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম হিজরত করে মদিনায় এসে দেখলেন এখানকার বাসিন্দারা বছরের দু’টি দিন আনন্দ উৎসবে কাটায়। যদিও এর আগে এখানকার অনেকে মুসলমান হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু প্রথাটি চালু ছিল। যেহেতু এতে পৌত্তলিকতার ছাপ ছিল এজন্য মুসলমানদের তাতে যোগ দেয়ার ব্যাপারে দ্বিধা সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে জানালেন, আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের আরো উন্নত ও উত্তম দু’টি উপলক্ষ্য দান করেছেন আনন্দ উৎসবের জন্য। একটি রমজান মাসের শেষে শাওয়ালের প্রথম তারিখে। আরেকটি জিলহজ মাসের দশম তারিখে বা হজের পরের দিন। দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারার জন্য দু’টি ঈদ নির্ধারিত হয়েছে। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনায় আত্মনিয়োগের মাধ্যমে তাকওয়ার স্তর উন্নত করা এবং তার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার একান্ত সান্নিধ্য ও অসাধারণ অনুগ্রহের উপযোগী হতে পারা নিঃসন্দেহে খুশির বিষয়। তেমনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করে ও শ্রম দিয়ে দীর্ঘ সফরের পর সম্পন্ন হয় হজ। ৯ তারিখ আরাফার ময়দানে অবস্থানের মাধ্যমে হজের সবচেয়ে কঠিন ও কষ্টকর রোকনটি সম্পন্ন হয়, যা আল্লাহতায়ালার মেহেরবাণীতেই সম্ভব হয়। তাই পরের দিন আনন্দ প্রকাশ যুক্তিসঙ্গত। আর যারা হজে যান না, তারা হাজীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করার জন্য তাদের পক্ষে বাড়িতে থেকেও খুশি উদযাপন করেন, যার নাম ঈদুল আজহা।
ঈদ যদিও আনন্দ উদযাপনের নাম, কিন্তু ইসলামি শরিয়তে আনন্দ বিনোদনের রূপরেখা ও মূলনীতি দুই ঈদের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। খুশি প্রকাশের প্রধান উপায় সাব্যস্ত করা হয়েছে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। তা যেমন শারীরিক ইবাদত, তেমনি অর্থ ব্যয়ের সাহায্যও। ঈদুল ফিতরে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতে হয়। পাশাপাশি দিতে হয় সদকাতুল ফিতর। আর ঈদুল আজহার নামাজ আদায়ের পাশাপাশি পশু কুরবানি করতে হয়। দুই ঈদেই অপরিহার্য অনুষঙ্গ রাখা হয়েছে নামাজ। এতে এ বিষয়টি পরিষ্কার করা হয় যে, পৃথিবীতে মানুষের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য মহান স্রষ্টার ইবাদত করা। এখানে তার লাগামহীন আচরণ ও ক্রিয়াকলাপের সুযোগ নেই। আনন্দ বিনোদনের সময়ও তাকে স্মরণ রাখতে হবে মহান প্রভুর প্রতি আনুগত্যের কথা। তাঁর প্রতি নিজেকে সমর্পিত করার চেতনা কখনোই অনুপস্থিত থাকতে পারবে না মুমিনের জীবনে। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির সাথে মুসলিম উম্মাহর পার্থক্য এখানেই। ইবাদত মিশ্রিত আনন্দই মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য। অনিয়ন্ত্রিত আনন্দ উপভোগের কোনো সুযোগ নেই তাদের। এক মাস আগে শরিয়তের নির্দেশ অনুযায়ী পানাহার বর্জনের কঠোর সাধনা শুরু হয়েছিল। তারই পরিসমাপ্তিতে শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেলে আল্লাহর মহিমা ঘোষণা, তাঁর উদ্দেশ্যে সদকা দিয়ে অভাবি ও অসহায়দের আনন্দে শরিক করে নেয়া এবং তাকবির পাঠ করতে করতে ঈদগাহে গিয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায়ের মাধ্যমে মুমিন বান্দারা খুশি উদযাপন করবেন। আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদÑ ধ্বনিতে পরিবেশ মুখরিত করতে করতে মুসলমানরা যখন ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে রওনা দেন এবং ঈদের নামাজ আদায়ের পর দোয়া করতে থাকেন, তখন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দয়ার সাগরে ঢেউ ওঠে । তিনি ফেরেশতাদের সামনে এসব মানুষের জন্য খুশি প্রকাশ করেন এবং তাদের অতীত পাপরাশি শুধু ক্ষমা নয় বরং পরিবর্তে সেই পরিমাণে সওয়াব বরাদ্দেরও ঘোষণা দেন। বলার অপেক্ষা রাখে না এই সুসংবাদ ও পুরস্কার তাদের জন্য, যারা পবিত্র রমজান মাসে সিয়াম সাধনায় যতœবান ছিল। পক্ষান্তরে যারা এমাসের কর্তব্য পালনে উদাসীন ছিল, তাদের জন্য কোনো সুসংবাদ নেই। আছে কঠিন শাস্তির হুমকি। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে তাঁর সুসংবাদের অধিকারী করুন। প্রকৃত খুশি ও উভয় জগতের কল্যাণ আমাদের নসিব করুন।
কিন্তু সিয়াম সাধনা শেষ হবে না রমজানের পরেও। বরং রমজানের পর থেকে শুরু হবে আরো দীর্ঘকালীন সিয়াম। বলা যেতে পারে শাওয়ালের প্রথম তারিখ থেকে দিনব্যাপী নয়, সার্বক্ষণিক সিয়াম শুরু হবে।
রমজান মাসে প্রতিদিন সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত জৈবিক চাহিদা পূরণ থেকে নিজেকে সংযত রাখতে হয়। কিন্তু সংযমের নির্দেশ মুমিনের প্রতি সারা জীবনের জন্য। একজন ব্যক্তি যখন কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করে মুসলমান হয়, তখনই তার কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় পানাহারসহ সব ভোগ আস্বাদন নিয়ন্ত্রিত রাখা। এটাই তো ইসলামের বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীতে মানুষের বসবাস যেমন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, তেমনি তার দায়িত্ব নির্ধারিত। কুরআন মজীদে আল্লাহতায়ালা জানিয়ে দিয়েছেনÑ আমি মানুষ ও জিন জাতিকে শুধু আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি। অতএব দুনিয়াতে মানুষের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য আল্লাহর আদেশ ও অভিপ্রায়ের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা। বস্তুত এরই নাম ঈমান ও ইসলাম। যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্যের শপথ করে নিজেদেরকে মুমিন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে, তাদেরকে কিছু নিয়ম কানুন মাথা পেতে নিতে হয়। জীবন নির্বাহের সুনির্দিষ্ট পথ বেয়ে তাকে চলতে হয়। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনে তাকে অনুসরণ করতে হয় শরিয়ত নির্দেশিত নীতিমালা। ভোগ-আস্বাদন-বিনোদনেও তাকে সীমারেখা মেনে চলতে হয়। এভাবে নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখার সাধনা তাকে করে যেতে হয় সব সময়ের জন্য। এ ক্ষেত্রে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্তের মেয়াদ সীমাবদ্ধ নেই। এমনকি পার্থিব জীবনে এ সিয়ামের ইফতারও নেই। যেদিন আহকামুল হাকেমিনের দরবারে হাজির হতে হবে, দুনিয়াবি জীবনের প্রতিটি কথা, কাজ ও আচরণের হিসেব দিতে হবে, সেদিন সেই হিসেব নিকেশে যদি উৎরে যাওয়া যায়, তাহলে রহমাতুল্লিল আলামিন হাউজে কাওছারের শরবত দিয়ে এসব রোজাদারকে ইফতার করাবেন। তারপর তাদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হবে জান্নাতে, যেখানে তাদের উপভোগের জন্য তৈরি রাখা হয়েছে এমন নেয়ামতরাজি, যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শোনেনি, এমনকি কোনো মানুষের কল্পনায়ও আসেনি। সেটাই তো প্রত্যেক মুমিনের কাম্য।
অতএব নিজের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ,কামনা বাসনা ও ঝোঁক প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে রাখা যদি সিয়াম বলে আখ্যায়িত হতে পারে, তাহলে রমজান মাস পার হলেও সেই সিয়ামের হুকুম বহাল থাকবে, থাকতে হবে মুমিনের জীবনে।
নিয়ন্ত্রিত ও নিয়মতান্ত্রিক জীবন নির্বাহ করা ইসলামের অন্যতম মৌলিক শিক্ষা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানাহার, নিছক উদরপূর্তি কিংবা রসনা তৃপ্তির জন্য আহার মুমিনের আদর্শ নয়। মুমিনের প্রতিটি কাজ হতে হবে উদ্দেশ্য ও ফলাফল বিবেচনায় রেখে। পার্থিব স্বার্থ ও সুবিধার চেয়ে আখেরাতের কল্যাণকে প্রধান্য দিতে হবে। মুমিনের আহারের বস্তু যেমন হালাল হওয়া জরুরি, তেমনি তা লাভ করার পদ্ধতিও বৈধ হওয়া অপরিহার্য। আহার গ্রহণের সময় অবলম্বন করতে হবে উন্নত শিষ্টাচার। একজন মুসলমানের জীবনে কোনো অহেতুক আচরণ হওয়া উচিত নয়। হজরত আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ইসলাম গ্রহণের ফলে একজন ব্যক্তির জীবনে অন্যতম সৌন্দর্য আসে এই যে, সে অহেতুক কাজ পরিহার করে।
মোটকথা, অপরিহার্যতা থেকে নান্দনিকতা পর্যন্ত সব ক্ষেত্র ও পর্যায়ের জন্য ইসলামের শিক্ষা ও নির্দেশনা রয়েছে। রমজানের তিরিশ বা উনত্রিশ দিনের পর পানাহার ও কামাচার নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ রহিত হবে না। সব ক্ষেত্রেই তাকে আল্লাহর নির্দেশ ও রাসুলুল্লাহর নির্দেশনা মেনে চলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সেই দীর্ঘ অনন্ত সিয়ামের জন্য প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকারই রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাসের শেষভাগে মুমিন বান্দাদের একান্ত কর্তব্য।
সিয়াম সাধনার মাস বিদায় নেয়ার পর আমাদের জীবনে স্বাভাবিকতা আসার পরেও যদি রমজানের বিশেষ নেক আমলগুলো চালু রাখা যায়, তাহলেই রমজানের সিয়াম সাধনা সার্থক হবে। প্রথমেই আসে রোজার কথা। রমজানের বাইরে রোজা রাখা ফরজ নয়। কিন্তু নফল রোজার জন্য কোনো মাস বা দিনের সীমাবদ্ধতা নেই। বছরের পাঁচটি দিন ছাড়া সব দিন রোজা রাখা যাবে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম রোজা না রেখে কোনো মাস যেতে দিতেন না বলে সাহাবায়ে কেরাম বর্ণনা করেছেন। তিনি প্রত্যেক মাসে কমপক্ষে তিনটি রোজা রাখতেন বলে জানা যায়। অবশ্য এই দিনগুলো তিনি নির্দিষ্ট করতেন না। কখনো মাসের শুরুতে, কখনো মাঝখানে, কখনো শেষভাগে, কখনো একসাথে, আবার কখনো বিচ্ছিন্নভাবে তিনটি রোজা রাখতেন।
এরপর নফল নামাজের প্রসঙ্গ আসে। রমজানে দীর্ঘক্ষণ ধরে তারাবিহ নামাজ আদায় করা হয়। রমজানের বাইরে এ নামাজ নেই। কিন্তু তাহাজ্জুদ আছে সারা বছরের জন্য। এ নামাজের মাহাত্ম্য ও পুরস্কার আনেক বেশি। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এত দীর্ঘক্ষণ তাহাজ্জুদ আদায় করতেন যে, তার দুই পা ফুলে যেত। তাকে এ নামাজ আদায়ে বিশেষ আদেশ করা হয়েছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে। নবুওয়াত লাভের প্রথম দিনগুলোতেই নাজিল হয়েছিল সুরা মুযযাম্মিল। তাতে রাত জেগে ইবাদত করার জন্য তার প্রতি বিশেষ আদেশ করা হয়েছে। তাই যখন দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হয়নি তখনো তিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার পরেও তাতে শৈথিল্য করেননি। এ জন্য সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে কোনো পর্যায়েই মুসলিম মনীষীরা তাহাজ্জুদ আদায়ে আলসেমি করেননি। এমনকি অনেক মুসলিম শাসকের জীবনে অন্য অনেক গুণের সাথে তাহাজ্জুদ আদায়ের নিয়মিত অভ্যাস ছিল।
রমজানের আরেকটি কাজ কুরআন মজিদ তেলাওয়াত ও অধ্যয়ন। এটাও রমজানের সাথে নির্দিষ্ট নয়। কিন্তু রমজান মাসে নাজিল হওয়ার কারণে এ মাসের সাথে কুরআন মজিদের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। তাই রমজান মাসে অন্য সময়ের তুলনায় বেশি কুরআন মজিদ তেলাওয়াত ও চর্চার ওপর জোর দেয়া হয়। রমজানের বাইরেও এ অভ্যাস ও নিয়ম চালু রাখা উচিত। আল্লাহর কালামের সাথে সম্পর্ক যতই ঘনিষ্ঠ হবে, আল্লাহর বিশেষ রহমতের ততই আশা করা যাবে। রমজানে এ কিতাবের প্রতি যে মনোযোগ বাড়ে, সেটাকে আল্লাহর রহমত হিসেবেই গণ্য করা উচিত এবং তা ধরে রাখা প্রয়োজন। কুরআন তেলাওয়াত, অধ্যয়ন ও গবেষণায় মুসলমানদের আরো আগ্রহী হওয়া প্রয়োজন।
তাসবিহ তাহলিল ও ইস্তেগফার মুমিনের প্রাত্যহিক কর্তব্য। রমজানে তা বেড়ে যাওয়া খুবই শুভ আলামত। কিন্তু তা রমজান পর্যন্ত সীমিত রাখা উচিত নয়।
রমজানে মুমিন বান্দাদের মধ্যে দান খয়রাতের আগ্রহ বেড়ে যায়। এটাও আল্লাহর অনুগ্রহ। সম্পদের মালিক আল্লাহ। বান্দা নিছক আমানতদার। আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী সম্পদ ব্যয় করা মুমিনের কর্তব্য। ধনীর সম্পদে অভাবী ও বঞ্চিতদের প্রাপ্য রয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়েছে কুরআন মজিদে। রমজানে মুমিন বান্দারা আল্লাহর এ বিশেষ হুকুমটি পালনে আরো আগ্রহী হয় অন্য মাসের তুলনায় আনেক বেশি ছওয়াব লাভের আশায়। এ কারণেই রমজান মাসে জাকাত আদায়ের রেওয়াজ চালু হয়েছে। তাছাড়া সদকাতুল ফিতর এ মাসের সাথে জড়িত। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের কাছে কখনো সম্পদ জমা থাকত না। এজন্য তার ওপর কখনো জাকাত ফরজ হয়নি। সদকাতুল ফিতর ওয়জিব হওয়ার মতো সম্পদও তার কাছে থাকেনি। কিন্তু তিনি সবসময় দানের হাত সম্প্রসারিত রাখতেন। আর রমজান এলে তার দানের মাত্রা অত্যন্ত বেড়ে যেত বলে সাহাবায়ে কেরাম বর্ণনা করেছেন। অতএব রমজান শেষ হলেও এসব ইবাদত অব্যাহত রাখা উচিত। আমাদের জীবনে সারা বছর যদি রমজানের শিক্ষা ধরে রাখতে পারি তাহলেই আমাদের জীবন সার্থক হবে।
০০০০০০০০০০০০০০০
মহিমান্বিত রাত শবেকদর
মাওলানা শিব্বীর আহমদ
মানব-ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম মানুষের নিকট শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থটি অবতীর্ণ হওয়ার বরকতময় সময়টি অন্যান্য সময়ের তুলনায় মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ হবে এটাই স্বাভাবিক। হ্যাঁ, কুরআনে কারিমের কথাই বলছি। পৃথিবীর ইতিহাসে এ এক অদ্বিতীয় গ্রন্থ, যা সম্পূর্ণ নির্ভুল এবং হাজার বছরের পরিক্রমায়ও তা সম্পূর্ণ অবিকৃত। যখন এ গ্রন্থের অবতারণ শুরু হয়, তখন থেকে অনেকেই তা আল্লাহর কালাম হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে! তাদেরকে কুরআনে কারিম চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে বিভিন্ন ভাষায়। ‘যদি বিশ্বাস না করো তাহলে এর মতো একটি আয়াত বানিয়ে নিয়ে এসো’। কোথাও বলা হয়েছে- ‘একটি সুরা রচনা করে নিয়ে এসো।’ সেই চ্যালেঞ্জ তারা গ্রহণ করার সাহসও দেখিয়েছে। কিন্তু নিজেরাই নিজেদের ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি দিয়েছে। এই হচ্ছে আমাদের গর্বের ধন মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। এ পবিত্র গ্রন্থটি অবতীর্ণ হওয়ার অনন্য বৈশিষ্ট্য বুকে ধারণ করে আছে এই শবেকদর।
ইমাম বায়হাকি রহ. তাঁর সুবিখ্যাত হাদিসগ্রন্থ ‘শুআবুল ঈমান’-এ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি ভাষণ সংকলন করেছেন। একবার পবিত্র রমজান মাস শুরুর আগের দিন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই ভাষণ প্রদান করেন। রমজান মাসের ফজিলত ও গুরুত্ব তিনি সবিস্তারে সেখানে তুলে ধরেন। ভাষণের শুরুটা ছিল এমন- ‘এক মহান ও বরকতময় মাস তোমাদের সামনে আসন্ন। এ মাসে একটি রাত এমন রয়েছে, যা হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।’
বছরের বার মাসের মধ্যে রমজান মাস অনন্য মর্যাদায় ভাস্বর। সে মাসটি আগমনের পূর্বমুহূর্তে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সাহাবায়ে কেরামকে সতর্ক ও অবহিত করছেন এর ফজিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে, তখন প্রথমেই বলছেন শবেকদরের কথা। রাতটিকে তিনি বলেছেন হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। হুবহু একই ভাষ্য পবিত্র কুরআনেও রয়েছে। এই রাতটি এমনই এক রাত, যে রাত নিয়ে কুরআনে কারিমে একটি স্বতন্ত্র সুরা নাজিল হয়েছে। পুরো সুরাটিতে এ রাতের মাহাত্ম্য ও ফজিলতের কথাই বলা হয়েছে। শবেকদরের ফজিলত বোঝার জন্যে এই একটি বিষয়ই যথেষ্ট।
পবিত্র কুরআনের উপস্থাপন দেখুন, ‘আমি এ কুরআন অবতীর্ণ করেছি লায়লাতুল কদরে। আপনি কি জানেন, লায়লাতুল কদর কী? লায়লাতুল কদর হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।’ [সুরা কদর, আয়াত : ১-৩] যেন শবেকদরের প্রথম পরিচয়ই হচ্ছে, তা হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।
ইমাম মালিক রহ. তাঁর সংকলিত হাদিসগ্রন্থ ‘মুআত্তা’য় বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একবার পূর্ববর্তী উম্মতের বয়সের বিষয়টি অবহিত করা হলো। তাঁর উম্মতের বয়স তখন তাঁর কাছে খুব কম মনে হলো। অন্যরা দীর্ঘ জীবন লাভ করার কারণে যে নেকি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, তারা তো তা পারবে না। এ পরিপ্রেক্ষিতেই আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এ লায়লাতুল কদর দান করেন, যা হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এ হাদিস থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এ মর্যাদাপূর্ণ রাতটি এ উম্মতের জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এক বিশেষ উপহার। এমন হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনো রাত পূর্ববর্তী কোনো উম্মতেরই ছিল না।
একটি রাত হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। বিষয়টি অবশ্যই বিশ্লেষণসাপেক্ষ। এক হাজার মাসে প্রায় ত্রিশ হাজার রাত। বছরের হিসেবে তা তিরাশি বছর চার মাস। হযরত মাওলানা মনযূর নুমানী রহ. এ শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে- আল্লাহ তায়ালার যে বান্দারা তাঁর সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলে এবং তাঁর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য প্রত্যাশা করে, তারা এই এক রাতে এতদূর এগিয়ে যেতে পারে, যা অন্য হাজার হাজার রাতেও সম্ভব নয়। এই পার্থিব জগতেও আমরা দেখি, দ্রুতগামী উড়োজাহাজ কিংবা রকেটের মাধ্যমে একদিন বা একঘণ্টায় যতদূর অতিক্রম করা যায়, প্রাচীনকালে কয়েক বছরেও ততটুকু দূরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব হতো না। একইভাবে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্যের অন্বেষায় থাকে, তারা এ শবেকদরে দ্রুততার সাথে এত অধিক পথ পাড়ি দেয়, যা তাদের পক্ষে অন্য অনেক মাসেও অতিক্রম করা সম্ভব নয়। আল্লামা শাব্বীর আহমদ উসমানী রহ. বলেছেন, ‘এ রাত যে ইবাদতে কাটায় সে যেন এক হাজার মাস ইবাদতে কাটাল, বরং তার চেয়েও বেশি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস-২০১৭)
আরবি ভাষায় সাধারণত এক হাজারই সর্বোচ্চ সংখ্যানির্দেশক শব্দ। আরবিতে বলা হয় ‘আলফ্’। এক লক্ষ বলতে হলে আরবিতে ‘মিআতু আলফ’ বা একশ হাজার বলে বোঝানো হয়। এজন্যে কোনো কোনো মুফাসসির এক হাজার মাসকে বাস্তবিক অর্থের পরিবর্তে রূপক অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের মতে, এখানে এক হাজার মাস নয়, বরং হাজার হাজার মাস তথা মহাকাল উদ্দেশ্য। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। বলা হচ্ছে- শবেকদর হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। হাজার মাসের মূল অর্থ হোক কিংবা রূপক অর্থ হোক, এ রাতটি হাজার মাসের তুলনায় কতগুণ শ্রেষ্ঠ তা কিন্তু এ আয়াতে বলা হয়নি। দ্বিগুণ, চারগুণ, দশগুণ, একশগুণ, সবকিছুই তো হতে পারে।
আরবিতে ‘কদর’ শব্দটি মর্যাদা ও সম্মান অর্থে ব্যবহৃত হয়। আবার ‘ভাগ্য’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। সে হিসেবে শবেকদর অর্থ মর্যাদার রাত কিংবা ভাগ্যের রাত। রাতটি যেহেতু অতুলনীয় মর্যাদার অধিকারী, সেই অর্থেই ‘মর্যাদার রাত শবেকদর’। কেউ কেউ এমনও বলেছেন, এ রাতে ইবাদত ও তওবা-ইস্তেগফারের মাধ্যমে যে কোনো সাধারণ বান্দা মহান প্রভুর দরবারে প্রভূত মর্যাদার অধিকারী হতে পারে। তাই এ রাতটি মর্যাদার রাত। আর যারা একে ‘ভাগ্যরজনী’ বলেছেন তাদের ব্যাখ্যা হচ্ছে, পরবর্তী এক বছরে যা কিছু আল্লাহ তায়ালা পুরো সৃষ্টিজগতের জন্যে নির্ধারিত করে রেখেছেন, তা ফেরেশতাদেরকে এ রাতে বুঝিয়ে দেন। সেই অর্থেই রাতটি ভাগ্যের রাত।
শবেকদরে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার এক অর্থ আমরা শুরুতেই বলে এসেছি। এ রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর কুরআন অবতরণের বরকতময় ধারা শুরু হয়। তবে কেউ কেউ বলেছেন, এ রাতে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার অর্থ হচ্ছে, পুরো কুরআন একসাথে এ রাতে লাওহে মাহফুজ থেকে প্রথম আকাশে অবতীর্ণ হয়। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে পুরো কুরআন সুদীর্ঘ তেইশ বছরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর অবতীর্ণ হয়।
এত মর্যাদা ও ফজিলতের রাতটি অবশ্য পুরোপুরি নির্দিষ্ট নয়। কুরআনে কারিমের ভাষ্য থেকে এতটুকু বোঝা যায়, শবেকদর রমজানের কোনো এক রাতেই হবে। সুরা বাকারায় বলা হয়েছে, ‘রমজান মাসে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে।’ আবার সুরা কদরে বলা হয়েছে, ‘আমি তা শবে কদরে অবতীর্ণ করেছি।’ কিন্তু রমজান মাসের কোন রাতটি শবেকদর তা আর নির্দিষ্ট করা হয়নি। হাদিস শরিফে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে শবেকদর তালাশ করো (মুসলিম, হাদিস- ১৫২৩)। এ হাদিস অনুযায়ী ২১, ২৩, ২৫, ২৭, ২৯ রমজানের এ পাঁচ রাতের যে কোনো এক রাতে শবেকদর হতে পারে। আরেক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত উবাদা ইবনে সামেত রা. বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন শবেকদরের খবর দেয়ার জন্যে (তা কোন দিন হবে) বের হয়ে এলেন। কিন্তু তখন দুজন মুসলমান ঝগড়া-কলহে লিপ্ত হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, আমি তোমাদেরকে শবেকদরের খবর দেয়ার জন্যে বের হয়েছিলাম। কিন্তু অমুক অমুক তখন ঝগড়া করছিল। ফলে তা তুলে নেওয়া হয়। হয়তো তা-ই তোমাদের জন্যে কল্যাণকর হবে। এখন তোমরা নবম, সপ্তম ও পঞ্চম (২৯, ২৭ ও ২৫ তারিখের) রাতে তা তালাশ করো। তবে ব্যাপকভাবে রমজানের ২৬ তারিখ দিবাগত রাত (২৭ রমজানের রাত) টিকেই শবেকদর হিসেবে পালন করা হয়। হাদিসের কিতাবে শবেকদর হিসেবে এ রাতটির কথা বিশেষভাবে আলোচিতও হয়েছে। যেমন, বুখারি শরিফেরই বর্ণনা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুয়াজ্জিন হযরত বিলাল রা. শুনেছেন, শবেকদর ২৭ রমজানের রাতে। হাদিসের এ ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যের কারণে হাদিসবিশারদ উলামায়ে কেরাম বলেছেন, রমজানের শেষ দশকের প্রতিটি বেজোড় রাতেই শবেকদর তালাশ করা উচিত।
আহলে দিল বুজুর্গগণ অনেক সময় বুঝতে পারেন কোন রাতটি শবেকদর। এটা অবশ্য সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। কেউ কেউ শবেকদরের বিভিন্ন আলামতের কথাও বলেছেন। যেমন, রাত প্রস্ফুটিত উজ্জ্বল পরিচ্ছন্ন হবে। নিঝুম-নিথর হবে, অতি গরমও হবে না, অতি ঠাণ্ডাও হবে না। রাত শেষে সকালে সতেজ আলো ছাড়া সূর্য উদিত হবে, ইত্যাদি। তবে এসব আলামত প্রকাশিত হওয়া শবেকদরের কোনো অপরিহার্য বিষয় নয়। তাই যদি এসব কোনো আলামত প্রকাশ না-ও পায়, তবু আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রত্যাশী যারা, তারা যেন শেষ দশকের প্রতিটি বেজোড় রাতই ইবাদত-বন্দেগিতে কাটায়।
যে একটি রাতের ইবাদত একজন বান্দাকে হাজার মাসের দূরত্ব এগিয়ে দিতে পারে, সে রাতের ইবাদতের গুরুত্ব ও ফজিলত তো ভিন্নভাবে বলার অপেক্ষা রাখে না। তা সত্ত্বেও হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের আশায় শবেকদরের রাতে নামাজে দণ্ডায়মান থাকে, তার সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়।’
পক্ষান্তরে এত এত ফজিলত ও মর্যাদা সত্ত্বেও যদি কেউ এ রাতটি গাফিলতির সাথে কাটিয়ে দেয়, তাহলে তার চেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত আর কে হতে পারে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্টই বলেছেন, ‘এই রাত থেকে যে মাহরুম ও বঞ্চিত হলো, সে অবশ্যই সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো। আর প্রকৃত মাহরুম ও বঞ্চিত যারা, তারাই কেবল এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকতে পারে।’
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমি যদি জানতে পারি এই রাতটি শবেকদর, তাহলে আমি কোন দোয়াটি পড়ব?’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তখন দোয়া শিখিয়ে দিলেনÑ হে আল্লাহ! তুমি তো ক্ষমাশীল, সম্মানিত, ক্ষমা করে দেয়াকে তুমি খুবই পছন্দ কর, তাই তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।
বলাবাহুল্য, দোয়াটি অতি ব্যাপক অর্থবোধক। আল্লাহ তায়ালা যদি নিজ দয়া ও অনুগ্রহে কোনো বান্দাকে ক্ষমা করে দিয়ে পরকালের হিসাব-নিকাশ ও জবাবদিহি থেকে রেহাই দেন, তাহলে আখেরাতে বিশ্বাসী বান্দার জন্যে এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!
যে কোনো নফল ইবাদত, বিশেষত নামাজ, তেলাওয়াত, তওবা-ইস্তেগফার ইত্যাদির মাধ্যমে এ রাতটি কাটানো যেতে পারে। এ রাতের কোনো বিশেষ পদ্ধতির নামাজ নেই। বিশেষ বিশেষ সুরা মিলিয়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক রাকাত নামাজের কথারও কোনো ভিত্তি নেই। যার যত রাকাত ইচ্ছা, যে কোনো সুরা দিয়ে ইচ্ছা নামাজ পড়তে পারে। যতক্ষণ ইচ্ছা, যখন ইচ্ছা, যে কোনো নফল ইবাদত করতে পারে। শবেকদরের পুরো রাতটিতেই কল্যাণ বিস্তৃত। কুরআনে কারিমে তাই বলা হয়েছে, ‘তা (এর কল্যাণ ও বরকত) ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।’ [সুরা কদর, আয়াত : ৫]
তবে নফল ইবাদত যেন ফরজ ইবাদতে ব্যাঘাত না ঘটায়। এমন যেন না হয়, সারা রাত নফল ইবাদত করে কেউ ফজরের জামাতে উপস্থিত হতে পারল না। মুসলিম শরিফের হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ইশার নামাজ জামাতের সাথে আদায় করল, সে যেন অর্ধেক রাত নফল নামাজ পড়ল, আর যে ফজরের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করল, সে যেন পুরো রাতই নফল নামাজ পড়ল।’ তাই শবেকদরে যে এ দুটি নামাজ জামাতের সাথে আদায় করবে, সে পুরো রাত নফল নামাজ পড়ার সওয়াব পেয়ে যাবে। এর অতিরিক্ত যতটুকু ইবাদত-বন্দেগি করবে, ততটুকু অতিরিক্ত সওয়াবও সে পাবে।
শবেবরাতের ব্যাপারে ইসলাম কী বলে?
জুন'১৪ কামরুল হাসান রাহমানী
ইসলামের বহুল আলোচিত বিষয়ের একটি শবেবরাত। একদল মানুষ মনে করেন- ফজিলতপূর্ণ দিন ও রাতগুলোর মধ্যে অন্যতম শবেবরাত। এবং তারা এ রাতের নানাবিধ ফজিলত ও পরের দিন রোজা পালনের উৎসাহব্যঞ্জক নানা দলিল-প্রমাণ পেশ করতে প্রয়াস পান। আরেকদল লোকের মতে শবেবরাত সম্পর্কে যে সকল দলিল-দস্তাবেজ পেশ করা হয় তার সিংহভাগই শবেকদরের সাথে সংশ্লিষ্ট। এগুলোকে জোর করে শবেবরাতের সঙ্গে যুক্ত করা দ্বীনকে বিকৃত করার শামিল। আর অন্যান্য দলিলগুলোর কিছু তো খুবই দুর্বল, আর বাকিগুলো দ্বারা সর্বো"চ একটি সময়ের ফজিলত প্রমাণিত হয়। কিন্তু ফজিলত প্রমাণিত হওয়ার দ্বারাই সে সময়ে বিভিন্ন আমলে লিপ্ত হওয়ার কোনো
সুযোগ নেই, যদি না শরিয়ত প্রবক্তার পক্ষ থেকে আমলের জন্য স্পষ্ট বক্তব্য না থাকে। শবেবরাতের ক্ষেত্রে আমলের ব্যাপারে কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। তাই এ রাতে বিভিন্ন আমলে লিপ্ত হওয়া বিদআতের শামিল। এমন প্রেক্ষাপটে দুই পক্ষের দলিল-প্রমাণ সামনে রেখে কিছু আলোচনা সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রথমপক্ষ যে সকল দলিল-প্রমাণ পেশ করে থাকেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, হযরত মুয়াজ বিন জাবাল রাযি. এর বর্ণনা। তিনি বলেন, রাসুল সা. বলেছেন- ‘আল্লাহ পাক মধ্য শাবানের রাতে তার বান্দাদের দিকে মনোনিবেশ করেন এবং মুশরিক ও পরস্পর বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতিত সকলকে ক্ষমা করে দেন।’
হযরত আবুবকর সিদ্দিক রাযি. বর্ণনা করেন, রাসুল সা. ইরশাদ করেছেন- ‘মধ্য শাবানের রাতে আল্লাহ পাক প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং পরশ্রীকাতর ও মুশরিক ব্যতিত সকলকে ক্ষমা করে দেন।’
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযি. হতে বর্ণিত নবীজি সা. বলেছেন ১৫ শাবানের রাতে আল্লাহ পাক পরশ্রীকাতর ও অন্যায়ভাবে হত্যাকারী ছাড়া সকলকে ক্ষমা করে দেন।
হযরত আতা ইবনে ইয়াসার রাযি. থেকে বর্ণিত- ‘শবেকদরের পর শাবানের ১৫ তম রাত্রের চেয়ে উত্তম কোনো রাত নেই। এ রাতে আল্লাহ পাক প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং মুশরিক, হিংসুক ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী ছাড়া সকলকে ক্ষমা করে দেন।’
হযরত আয়েশা রাযি. থেবে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘এক রাতে
আমি নবীজি কে (শয্যাপাশে) না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম। জান্নাতুল বাকিতে তাকে খুঁজে পেলাম। নবীজি সা. আমাকে দেখে বললেন, ‘তুমি কি এই আশঙ্কা করছো যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তোমার ওপর
জুলুম করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর নবী! আমি ভেবেছিলাম আপনি অন্য কোনো স্ত্রীর গৃহে গমন করেছেন। নবীজি সা. বললেন ১৫ শাবানের রাতে আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং বনু কালব গোত্রের ছাগল পালের পশম পরিমাণ বান্দাদের ক্ষমা করে দেন।’’
উল্লিখিত সবগুলো হাদিসই সনদের দিক দিয়ে আমলযোগ্য। এগুলো ছাড়াও কাছাকাছি বিষয়বস্তুর আরও অনেকগুলো হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যার কোনো কোনোটার সনদ মজবুত আবার কোনো কোনোটার সনদ দুর্বল।
যে সকল আলেমগণ শবেবরাত পালনের বিপক্ষে- তাদের বক্তব্য হলো, শেষোক্ত হাদিসটি ছাড়া বাকি হাদিসগুলোর সনদ গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের। কিন্তু এসব হাদিসের কোথাও কোনো আমলের কথা বলা হয়নি বা কোনো আমলের জন্য উৎসাহ প্রদানও করা হয়নি। এসব হাদিস দ্বারা সবো"র্চ কোনো স্থান বা সময়ের ফজিলত প্রমাণিত হয়। আর কোনো স্থানের ফজিলত প্রমাণিত হওয়ার অর্থ এই নয় যে- সে সময়ের মধ্যে নিজেদের পক্ষ থেকে কোনো আমল চালু করে দেয়া হবে। বরং আমলের জন্য অবশ্যই শরিয়তের পক্ষ থেকে অনুমোদন থাকতে হবে। উদারহণস্বরূপ বলা যেতে পারে, জুমার দিন সম্পর্কে হাদিস শরিফে এসেছে- ‘জুমার দিনের কোনো একটি সময় এমন রয়েছে, যখন বান্দা আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে আল্লাহ তাকে ফিরিয়ে দেন না। তোমরা সেই সময়টাকে আসরের পরের অংশে অন্বেষণ কর।’ এই হাদিস দ্বারা জুমার দিনের আসরের পরের সময়ের বিশেষ ফজিলত প্রমাণিত হয়। কিন্তু নবীজি সা. এর পক্ষ থেকে এ সময়ে কোনো আমল বর্ণিত হয়নি। তাই কেউ যদি এসময়ে বিশেষ কোনো আমলের প্রচলন ঘটায় এবং লোকদেরকে সে আমলের দিকে আহ্বান করে তাহলে তা বিদআত বলে গণ্য হবে।
এমনিভাবে সোমবার ও বৃহস্পতিবারের ফজিলতের ব্যাপারেও হাদিস রয়েছে- হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে
বর্ণিত, রাসুল সা. বলেন’ ‘সোম ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। শিরককারী ব্যতিত সকলকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। আর ওই দুই ব্যক্তি যারা পরস্পর দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত,
তাদের ব্যাপারে বলা হয়- তাদেরকে সময় দাও যাতে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে মিলে যায়। তাদেরকে সময় দাও যাতে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে মিলে যায়। তাদেরকে সময় দাও যাতে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে মিলে যায়।’ এ হাদিস দ্বারা সোমবার ও বৃহস্পতিবারের ফজিলত প্রমাণিত হয়। এ জাতীয় আরও হাদিস রয়েছে। যেমন- সোমবার ও বৃহস্পতিবার আল্লাহর দরবারে আমলনামা পেশ করা হয়। এখন এ সকল হাদিসের আলোকে কেউ যদি নিজের পক্ষ থেকে এ দিনে কোনো আমলের প্রচলন ঘটায়- তাহলে তা কি জায়েয হবে? এটা কি বিদআতের অন্তর্ভুক্ত হবে না? তাই এ সকল দিনে কোনো আমল করতে চাইলে অবশ্যই তা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে।
তদ্রুপ উল্লিখিত হাদিসগুলো দ্বারাও শবেবরাতের ফজিলত প্রমাণিত হয়। কিন্তু নবীজি সা. কোনো আমলের জন্য বলেছেন তা প্রমাণিত হয় না। অথচ রমজানের শেষ দশকের রাতগুলোতে নবীজি সা. পরিবারস্থ সকলকে রাত্রের ঘুম থেকে ইবাদতের জন্য জাগিয়ে দিতেন। আর শেষোক্ত হাদিসের ব্যাপারে ইমাম তিরমিজি রহ. বলেন, আয়েশা রাযি.র এই হাদিস আমি হাজ্জাজের বর্ণিত সনদ ছাড়া অন্য
কোনোভাবে চিনি না। আমি মুহাম্মদকে (ইমাম বুখারি) বলতে শুনেছি তিনি হাদিসটিকে দুবর্ল বলতেন। (ইমাম তিরমিজি) বলেন, ইয়াহইয়া ইবনে কাসির উরওয়াহ থেকে হাদিস শুনেন নি এবং মুহাম্মদ (ইমাম বুখারি) বলেছেন, হাজ্জাজ ইয়াহইয়া ইবনে কাসির থেকে শুনেননি। এ হাদিস সম্পর্কে ইমাম বুখারি ও ইমাম তিরমিজির মন্তব্য দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হাদিসটি দুই দিক থেকেই মুনকাতি অর্থাৎ সূত্র থেকে বি"িছন্ন। পাশাপাশি এ হাদিসের একজন রাবি হাজ্জাজ ইবনে আরতাহ ; তিনি মুহাদ্দিসিনের নিকট দুর্বল বলে পরিচিত। শবে-বরাতের ফজিলত সম্পর্কে বহুল উ"চারিত এই হাদিসের ব্যাপারে বর্ণনাকারী ইমামদের মন্তব্য আমলে নিলে এই হাদিস দ্বারা আর দলিল দেয়া চলে না। আর যদি হাদিসটি সহিহও ধরে নেয়া হয়
তাহলেও বর্তমান যেভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে সকল মানুষ জমা করে শবেবরাত উদযাপন করা হয় তার বৈধতা পাওয়া যাবে না।
সাহাবায়ে কেরামের যুগে বিশেষ গুরুত্বের সাথে শবেবরাত পালনের কোনো বর্ণনা বা নজির পাওয়া যায় না। তাবে তাবেয়ীদের যুগে সিরিয়ার খালিদ ইবনে মাদান, মাকহুল, লুকমান ইবনে আমের প্রমুখ আলেমগণ এ রাতকে মর্যাদার সঙ্গে পালন করতেন। এ রাতে তারা অধিকহারে ইবাদত-বন্দেগি করতেন। অন্যরাও যখন তাদেরকে অনুসরণ করতে আরম্ভ করলো তখন ইখতেলাফ দেখা দিল। মৌলিকভাবে বসরা অঞ্চলের আলেম ও আবেদগণ এ রাতকে গুরুত্বের সাথে পালন করতেন। কিন্তু মক্কা-মদিনার সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমগণ এভাবে শবেবরাত পালনকে বিদআত সাব্যস্ত করে তা প্রত্যাখ্যান করেন। সিরিয়ার আলেমগণ শবেবরাত পালনকে কেন্দ্র করে দুই ভাগ হয়ে পড়েন। পালনকারীদের দলে খালিদ ইবনে মাদান, মাকহুল, লুকমান ইবনে আমের, ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহি প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ছিলেন। পক্ষান্তরে তাবেয়িদের একটি বিরাট দল বলেন, এ ধরনের আমল যেমন নবীজি সা. এর
যুগে ছিল না, তদ্রুপ ছিল না সাহাবিদের যুগেও। এ রাতে ইবাদত-বন্দেগি সওয়াবের কাজ হলে নবীজি সা. উম্মতকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত ও সতর্ক করতে কার্পণ্য করতেন না।
যেমন তিনি কার্পণ্য করেননি শবেকদর ও রমজানের শেষ দশকের ইবাদতের ব্যাপারে। আর নবীজির দিক-নির্দেশনা থাকলে সাহাবায়ে কেরামও তা ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রসার করে উম্মতের কাছে নবীজির হাদিস ও আমলসমূহ পৌঁছে দিতেন। কারণ নবীজির সা. থেকে জেনেছেন আর সেগুলো গোপন করেছেন এমনটি তাদের ব্যাপারে কল্পনাও করা যায় না।
কোনো একটা আমল বিদআত হওয়ার একটা বড় আলামত হলো, সে ব্যাপারে উম্মতের এখতেলাফে লিপ্ত হয়ে পড়া। যদি এ আমল সুন্নাহসম্মত হতো- তাহলে উম্মত পালন করুক আর নাই করুক কমপক্ষে সুন্নাত হওয়ার ব্যাপারে মতানৈক্য সৃষ্টি হতো না। এ মতের স্বপক্ষের লোকেরা আরো দাবি করেন যে, শবেবরাতের ফজিলত প্রমাণ করতে গিয়ে অনেকে তো কোরআনের মনগড়া তাফসির পর্যন্ত শুরু করেন। তারা সুরা-দুখানের শুরুর আয়াতগুলো তেলাওয়াত করে থাকেন। যেখানে বলা হয়েছে, ‘হা-মিম, শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। আমি এ কিতাব এক বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি। আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়।’ অথচ এই বরকতপূর্ণ রাত দ্বারা শবেকদর উদ্দেশ্য হওয়াটা উম্মতের সর্বসম্মত মত। এ আয়াতগুলোকে শবেবরাতের সাথে মিলিয়ে ফেলাতে সমাজের শতকরা ৯৯ জন মানুষ জানে যে- এ রাতে সৃষ্টিকূলের হায়াত-মউত, রিজিক-দৌলত ইত্যাদি নির্ধারিত হয়। এ কারণে শবেকদর থেকেও সমাজে শবেবরাতকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে পালন করা হয়। তাছাড়া যে সকল হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে তাতেও প্রমাণিত হয় না যে-
ক. ১৫ শাবানের রাতে আল্লাহ তায়ালা আগামী এক বছরের হায়াত-মউত, রিজিক-দৌলত ইত্যাদি নির্ধারণ করেন।
খ. আল্লাহর রাসুল সা. এ রাতে গোসল করেছেন বা করতে বলেছেন। অথবা মসজিদে সকলকে নিয়ে ইবাদতে লিপ্ত হয়েছেন। জিকির তেলাওয়াত ইত্যাদির
মাধ্যমে এ রাত উদযাপন করেছেন।
গ. আল্লাহ তায়ালার নবী বা সাহাবায়ে কেরাম এ রাতে সাহরি খেয়ে পরদিন সিয়াম পালন করেছেন।
ঘ. ভালো খানা বা হালুয়া-রুটি পাকিয়ে
বাড়িতে বাড়িতে বিলি করেছেন। এবং ঘরে-ঘরে মিলাদ পড়েছেন।
ঙ. নবীজি সা. সাহাবাদের সঙ্গে নিয়ে দলবদ্ধভাবে কবরস্থানে গিয়ে কবর জিয়ারত করেছেন।
সতর্কতা : মিশকাত শরিফে ‘রমজান মাসের রাতের সালাত’ অধ্যায়ে বর্ণিত একটি হাদিস দ্বারা কেউ কেউ দলিল পেশ করে থাকেন যে, সেখানে ১৫ ই শাবানের রাতে হায়াত-মউত, রিজিক-দৌলত নির্ধারিত হওয়ার কথা এসেছে। এই দলিল দুই কারণে সঠিক নয়। এক. হাদিস যে শাবান মাস সংক্রান্ত নয় তা গ্রন্থকার কর্তৃক ‘রমজান মাসের রাতের সালাত’ অধ্যায়ে উল্লেখ করার দ্বারাই পরিষ্কার হয়ে যায়।
দুই. যাকে সম্বোধন করে নবীজি সা. জিজ্ঞাসা করলেন ‘তুমি জান কি আজ কোন রাত?’ সেই আয়েশা রাযি. কোনো অজ্ঞ মহিলা ছিলেন না যে ‘অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত’ বলে তার ব্যাখ্যার প্রয়োজন হবে। আর কোনো কথা স্পষ্ট করার ক্ষেত্রে নবীজি সা. কথাটিকে কয়েকবার বলতেন। তাই ‘অর্থাৎ’ বলে যে কথা জুড়ে দেয়া হয়েছে সেটা পরবর্তী কোনো বর্ণনাকারীর শব্দ, নবীজির নয়। এবং এটা হযরত আয়েশা রাযি. এর বক্তব্যও না। কারণ, তার বক্তব্য শুরু হয়েছে ‘তিনি জিজ্ঞেস করলেন’ এর পর থেকে। আসল কথা হলো এই হাদিসের সম্পর্কও শবেকদরের সাথে।
এই আলোচনার সারকথা হলো-
ক্স শবেবরাতের ফজিলত ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে এমন সহিহ হাদিস রয়েছে। যেমন রয়েছে জুমার দিন, সোমবার দিন, বৃহস্পতিবার ইত্যাদি সময়ের ব্যাপারে।
ক্স ঘটা করে আনুষ্ঠানিকভাবে এ রাতকে পালন করার কোনো হাদিস বা সাহাবাদের আমল প্রমাণিত নয়।
ক্স কারো ধারাবাহিক আমলের মধ্যে যদি এ রাতও পড়ে যায়, তার জন্য অথবা কেউ একান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইবাদত করতে চাইলে তার জন্য এ রাতের ইবাদত-বন্দেগির সুযোগ রয়েছে।
ক্স শবেবরাতের আমল নফল পর্যায়ের
আমল। তাই শরিয়তে তার অবস্থান যেমন ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতের পরে; সমাজ জীবনেও তার অবস্থান সেখানেই রাখতে হবে। হেরফের হলেই এটা আর ইবাদতের পর্যায়ে থাকবে না।
বিদআতের পর্যায়ে চলে যাবে।
আমাদের সমাজে এ রাত পালনের ক্ষেত্রে বর্তমান যে খানিকটা বাড়াবাড়ি হয়েই যাচ্ছে- তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মনে রাখতে হবে কেনো নফল ইবাদত ছুটে যাওয়া ততোটা ক্ষতিকর নয়, তাকে ফরজ ওয়াজিবের ওপর গুরুত্ব দেয়া যতোটা ক্ষতিকর। তাই শবেবরাত পালনের ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই মধ্যমপন্থা আর সতকর্তা অবলম্বন করতে হবে। অন্যথায় লাভের চেয়ে ক্ষতিটাই বেশি হবে। আল্লাহ আমাদের হক বুঝে তার ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন।#
শাপলার ভয়াল স্মৃতি :
বছর শেষে প্রাপ্তির হিসাব
কামরুল হাসান রাহমানী
মে'১৪
দৃশ্যপট এক.
কষাই কাদেরের ফাঁসি না হয়ে হলো যাবজ্জীবন। কেন? বিচারকরা কি সন্দিহান ছিলেন এই লোকটিই কষাই কাদের কি না? নাকি এটা ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক স্ট্যান্ডবাজি ছিল? কারণ আওয়ামী লীগের ব্যাপারে পুরনো অভিযোগ- তারা স্বাধীনতার চেতনাকে ফেরি করে দিন গুজরান করে থাকে। রাজনৈতিক স্ট্যান্ডবাজির যথেষ্ট কারণ ছিল। যেমন- ধ্বজভঙ্গ বিরোধীদলের আন্দোলনে চরম ব্যর্থতা সত্ত্বেও শেয়ারবাজার ধ্বস, হলমার্ক কেলেঙ্কারী, পদ্মাসেতু দুর্নীতি, সর্বোগ্রাসী লুটপাট, দুর্নীতিা মহোৎসব, ছাত্রলীগের লাগামহীন তাণ্ডব, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডসহ অসংখ্য ইস্যুতে সরকার যখন জনগণের স্বত:স্ফূর্ত প্রতিরোধের মুখে খেই হারিয়ে ফেলার অবস্থা, ঠিক তখনই জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্নদিকে সরিয়ে দিতে তরুণদের এই পিকনিক স্টাইলের আন্দোলনকে লুফে নেয় সরকার। যেখানে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য এক দুই ঘণ্টা রাজপথ অবরোধ করার অপরাধে পুলিশ বাহিনী প্রতিবাদীদের ঠেঙ্গানোকেই তাদের বড় দায়িত্ব বলে মনে করে, সেখানে শাহবাগের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা অনির্দিষ্ট কালের জন্য অবরোধের ঘোষণা দেয় আন্দোলনকারীরা। এক্ষেত্রে তাদেরকে রাস্তা বন্ধ করার অপরাধে লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করা তো দূরের কথা, সরকার সর্বপ্রকার সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে অবস্থান যাতে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় সে ব্যবস্থাই করে দেয়।
দৃশ্যপট দুই.
জয়বাংলা, বিচার নয় ফাঁসি চাই, ওমুককে ধরো জবাই করো। বিবেকবানরা এসব শ্লোগানে আতঙ্কিত হলেন। চিন্তার রেখা তাদের ললাটে ভেসে ওঠলো। সরকারিভাবে হালুয়া-রুটি, পোলাও-বিরিয়ানি থেকে শুরু করে ভ্রাম্যমান টয়লেটেরও ব্যবস্থা করা হলো। দিন যায় রাত আসেÑ যুবক যুবতিদের ভীড়ও বাড়তে থাকে। নিশিকন্যাদের আদলে শাহবাগিরাও একত্রে নিশিযাপন শুরু করে। এতোকিছুর পরও শাহবাগিদের প্রকৃতি উদ্দেশ্যের ব্যাপারে খানিকটা ধোঁয়াশা কাজ করছিল। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়া, রাম ও বামপন্থিদের এতো মাতামাতির কারণও অস্পষ্ট ছিলো। নাস্তিক ও বাম নিয়ন্ত্রিত মহাজোট সরকারের শাহবাগিদের নিয়ে অতি উল্লাসিত হওয়ার কারণও রহস্যাবৃত ছিলো। এরই মধ্যে ধীরে ধীরে
ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি, আল্লাহ, রাসুল, টুপি, দাড়িকে ব্যঙ্গ করে রাত দিন চব্বিশ ঘণ্টা খিস্তিখেওড় শুরু হলোÑ ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে শাহবাগি রাজিবসহ আরও কয়েক কুলাঙ্গারের ইসলাম ধর্মের চরম অবমাননা করে লেখা সাইটগুলোও প্রকাশ পেতে আরম্ব করলো। এতক্ষণে শাহবাগিদের লক্ষ-উদ্দেশ্য খানিকটা পরিস্কার হলো। পরিস্কার হলো রাম ও বাম নিয়ন্ত্রিত সরকারকর্তৃক তাদেরকে জামাই আদরের হেতুও। শাহবাগের এসব কুলাঙ্গাররা দেড় হাজার বছরের ইতিহাসকে ভীষণ লজ্জায় ফেলে দেয়। কারণ ইসলামের বিগত ইতিহাসে ইসলাম ও ইসলামের নবীকে নিয়ে এমন কদর্য ও নোংরা মন্তব্য ইহুদি, খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, এমনকি নাস্তিক-মুরতাদরাও করতে সাহস পায়নি। ভ্রান্ত রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে বিলুপ্তপ্রায় গুটিকয়েক বাম ছাত্র সংগঠন শুরুতে ক্ষমাতাসীনদের পাহাড়সম ব্যর্থতাকে ঢেকে দেয়ার অভিলাসে রাজপথ দখলে নিয়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালকে তাদের মর্জি মোতাবেক রায় প্রদানে বাধ্য করার জন্য নামলেও তাদের টার্গেট যে, ইসলাম ও মুসলমান তা দ্রুতই তারা পরিস্কার করতে সক্ষম হয়।
দৃশ্যপট তিন.
বিক্ষুব্ধ জনতার হৃদয়ে এমনিতেই ক্ষোভের আগুন জ্বলছিল। পাশাপাশি ‘বৃটিশ খেদাও’ আন্দোলনের সূর্যসন্তান আল্লামা হুসাইন আহমাদ মাদানির একান্ত শিষ্য আল্লামা শাহ আহমাদ শাফী দা. বা. জাতির এই ক্রান্তিকালে সকল ঈমানদারদের ঈমানি দাবি পূরণে রাজপথে নেমে প্রতিবাদ জানাতে আহবান জানান। সমুদ্রে ভাসমান আশ্রয়হীন যাত্রীরা যেন শেষ আশ্রয় খুঁজে পেলেন। তারা কালবিলম্ব না করে ঈমান রক্ষার তাকিদে রাজপথে নেমে আসলেন। মিছিল মিটিং আর শ্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ। অজ-পাড়াগাঁয়েও এই ঢেউ আছড়ে পড়ে। ৬ এপ্রিল ঢাকামুখী লংমার্চ ও লংমার্চ পরবর্তী শাপলাচত্বরে মহাসমাবেশের ডাক দেয়া হয়। ব্যথিত বিক্ষুব্ধ জনতা লংমার্চ ও সমাবেশ সফল করতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। নরকের কীটতুল্য নাস্তিক মুরতাদ ও তাদের দোসররা এই প্রোগ্রাম বাঞ্চালের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। লংমার্চ ও সমাবেশকে হুমকি হিসেবে দেখে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার। ইতিহাসের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার কতিপয় লোলা, লেংড়া, বামপন্থি সংগঠন দিয়ে হরতাল আহবান করায় ক্ষমতাসীনরা। তারা মূল ক্রীড়ানক হলেও নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ও ইমরান এইচ সরকার থাকে ব্যানার হিসাবে।
দৃশ্যপট চার.
সম্পূর্ণ উস্কানীমূলক নজিরবিহীন এই হরতালকে কেন্দ্রকরে শেখ হাসিনার সরকার যে সীমাহীন নোংরামী প্রকাশ করে তা যুগের পর যুগ নবীপ্রেমিক জনতা ভুলতে পারবে না। তৌহিদি জনতাকে প্রতিহত করতে সরকার পুলিশ বাহিনীকে পিকেটার হিসেবে রাস্তায় নামায়। শাহবাগে গুটিকয়েক ভাড়াটিয়া জমা করে লোক দেখানো দুএকটি মিছিল ছাড়া সারা দেশের কোথাও তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। অথচ সরকার নিজ উদ্যোগে সারা দেশের গাড়ি ঘোড়া বন্ধ করে দেয়। বন্ধ করে দেয় লঞ্চ স্টিমার। রেল চলাচলেও পালিত হয় নজিরবিহীন হরতাল। রচিত হয় নতুন ইতিহাস। ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক জনগণের বিরুদ্ধে হরতাল
দৃশ্যপট পাঁচ.
হরতালের এই সীমাহীন দুর্ভোগ উপেক্ষা করেই ঈমানদার জনতা সমাবেশ সফল করতে ঢাকামুখী লংমার্চে অংশ নেয়। পালন করে তাদের ঈমানি দায়িত্ব। সুবহানাল্লাহ! দেড় হাজার বছরের ব্যবধানেও দুনিয়াতে নবী প্রেমিকরা বেঁচে আছে, তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রচিত হয় ৬ এপ্রিল বাংলার জমিনে। সাহবায়ে কেরাম কর্তৃক শত শত মাইল ঘোড়া, উট আর পায়ে হেঁটে নবীজীর সঙ্গে পাড়ি দেওয়ার যেসব ইতিহাস এতোদিন শুধু বইÑপুস্তকে পাওয়া যেত, সে ইতিহাস পুনর্জীবন লাভ করলো বাংলার জমিনে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে কেরাণীগঞ্জের আটিবাজার থেকে কদমতলী হয়ে মতিঝিল পৌঁছি। যা দীর্ঘ ৩০-৩৫ কি: মি: রাস্তা। আমরা যে কাফেলায় শরিক হয়েছিলাম তারা এসেছিল আটিবাজার থেকে ১৫-২০ কি: মি: দূর থেকে। তাহলে তারা এসেছে মতিঝিলের ৫০ কি:মি: দূরত্ব থেকে। আসা-যাওয়া ১০০ কি: মি:। ঢাকার দূরÑদূরান্তের অঞ্চল গাজীপুর, সফিপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, দাউদকান্দি, কুমিল্লা ও এর আশপাশের জেলাগুলো থেকে পায়ে হেঁটে পঙ্গোপালের মতো মানুষ ছুটে এসেছে ঢাকার মতিঝিলে। যার ফলে রচিত হয় বাংলার ইতিহাসে নজিরবিহীন লংমার্চ ও সর্ববৃহৎ মহাসমাবেশ। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার পদচারণা আর শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে রাজধানী ঢাকা। হরতাল আহবানকারী শাহবাগি ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের মুখে শুধু চুনকালি নয়- যেন ঝামা ঘষে দেয় এই জাগরণ
দৃশ্যপট ছয়.
সমাবেশ থেকে দেশ ও ঈমান রক্ষার স্বার্থে ঐতিহাসিক ১৩ দফা ঘোষিত হয়। অপরাধী ব্লগারদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিসহ ঘোষিত দাবি দাওয়া মেনে নিতে সরকারকে ১ মাস সময় দেওয়া হয়। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মাসব্যাপী কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। হরতাল, বিভাগীয় মহাসমাবেশ, শানে রেসালাত সম্মেলন ইত্যাদি। এবং এসবে সরকারের কানে পানি না ঢুকলে ১ মাস পর ৫ মে ঢাকা অবরোধের কর্মসূচি দেওয়া হয়। ৮ এপ্রিল হেফাজত ঘোষিত হরতালও সারাদেশে স্বত:স্ফূর্তভাবে পালিত হয়। ঢাকার কেরাণীগঞ্জের যে অঞ্চলে আমার বসবাস, সেখানে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। অথচ এ লাকার বয়স্ক লোকদের ভাষ্যমতে, স্বাধীনতার পর খুব কম হরতালে এ অঞ্চলে গাড়ি-ঘোড়া, দোকান-পাট বন্ধ থাকতে দেখেছেন তারা। কিন্তু ৮ তারিখের হরতালে সবকিছুই বন্ধ থাকে। এই হরতালের মাধ্যমে ১৩ দফার প্রতি জনগণ তাদের অকুন্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেন। এরপর দেশের বিভাগীয় শহর ও বড় বড় জেলাগুলোতে অনুষ্ঠিত হয় শানে রেসালত সম্মেলন। এই সম্মেলনগুলোতে জনতার অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। লক্ষ লক্ষ জনতার ঢল নামে এসব সম্মেলনে।
দৃশ্যপট সাত.
৫ মে ভোরের সূর্য উকি দেওয়ার আগেই লক্ষ লক্ষ তৌহিদী জনতা ঢাকার রাজপথে নেমে আসে। রাজধানীতে প্রবেশের গুরুত্বপূর্ণ ৬টি পয়েন্টে অবস্থান নেয় ঈমানদার জনতা। গাবতলী পয়েন্টের অবস্থা তো ইতিহাসের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সুদূর সাভার পর্যন্ত মানুষ আর মানুষ। এ অবস্থা প্রতিটি পয়েন্টে। আমি যখন কেরাণীগঞ্জের কদমতলীতে পৌঁছলাম তখন সেখানে প্রবল বর্ষণ উপেক্ষা করে লক্ষাধিক মানুষ ভাষণ শুনছে। বৃষ্টি থেমে গেলে যেন মানুষের ঢল নামলো রাজপথে।
সিদ্ধান্ত ছিলো, ৬টি পয়েন্ট থেকে শাপলাচত্বরে জমা হয়ে মহাসমাবেশ করা হবে। সেমতে জোহরের নামাজ পড়ে মতিঝিলের উদ্দেশ্যে রওনা হই। আমরা কয়েকজন মাইক বহনকারী একটি মিনি ট্রাকে ছিলাম। আমাদের ট্রাক যখন নবাবপুর রোডের মোড়ে পৌঁছলো, তখন সামনে-পিছে তাকিয়ে যে দৃশ্য অবলোকন করলাম, তা এক কথায় অকল্পনীয়। সামনে গোলাপশাহ মাজার আর পেছনে কদমতলী পর্যন্ত জনতার এক মহাসমুদ্র। নিস্তরঙ্গ প্রশান্ত মহাসাগর। অথৈ জলরাশি যেন নিরবধি বয়ে চলছে দূর অজানার উদ্দেশ্যে। রাস্তার দু’পাশের বাড়িঘর থেকে অপেক্ষমান আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা হাত নেড়ে মিছিল কারীদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। হঠাৎ শান্ত নদীতে যেন তরঙ্গ অনুভব হলো। মিছিলের গতি থেমে গেল। আমরা হর্ন বাজিয়ে গাড়ি নিয়ে সামনে অগ্রসর হলাম। গুলিস্তান পর্যন্ত যাওয়ার পর গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে অগ্রসর হলাম। গোলাপশাহ মোড়ে গিয়ে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখতে পেলাম। বৃষ্টির মতো টিয়ার শেল আর রাবার বুলেট ছুড়ছে পুলিশ। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বীর পুরুষরা পুলিশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইট পাটকেল, বোমা ও কাঁচের বোতল নিক্ষেপ করছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুহূর্তের মধ্যে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হলো। মিছিল কারীরাও পাল্টা ইট পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করলো। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। আমি বুঝতে পারলাম নাÑ নবীকে গালিদাতা নাস্তিক মুরতাদদের শাস্তি দাবি করায় এদের এতো গা জ্বালা কেন? এই বিশৃঙ্খখলা ছড়িয়ে পড়লো জিরোপয়েন্ট, মুক্তাঙ্গন, পুরোনাপল্টন হয়ে বাইতুল মোকাররম পর্যন্ত। সংঘর্ষ চলতে থাকে সন্ধা অবধি। আওয়ামী বাহিনীর যেন অনেক রক্তের দরকার। সেই রক্তের পিপাসা মেটাতে অরাজনৈতিক এই সংগঠনের নিরীহ কর্মীদের ওপর আক্রামনের এই নিষ্ঠুরতা। এরই মধ্যে সরকার তার রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য পবিত্র কুরআন পোড়ানোর নাটকও সমাপ্ত করে ফেললো। সন্ধা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ও এর আশপাশে কয়েকজন ভাই শহীদ হলেন। ছাত্রলীগ যুবলীগকে সাহসীই বলতে হবে, নিরস্ত্র নবীপ্রেমিকদের ওপর তারা যেভাবে ক্ষুধার্ত হায়েনার মতো ঝাপিয়ে পড়ে তাদের শহীদ করলো তার নজির ইতিহাসে বিরল।
দৃশ্যপট সাত.
বাংলাদেশের ইতিহাসের বিশালতম সমাবেশটি কেন্দ্র করে প্রচার মাধ্যমগুলো যুগপৎ ছুটি দৃশ্য প্রচার করছিল। একটি চিত্রে মতিঝিল ও তার আশপাশ জুড়ে দিগন্তবিস্তৃত বিশাল জনসমুদ্র। যা ছিল বদ্ধ জলরাশির ন্যায় সম্পূর্ণ শান্ত, তরঙ্গহীন। অন্যটি ছিল, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও ছাত্রলীগ যুবলীগের সঙ্গে দৃশ্যত হেফাজত কর্মীদের সংঘর্ষের চিত্র। আদতে এরা আসলেই হেফাজত কর্মী না হেফাজতের ইমেজ নষ্ট করতে ষড়যন্তকারীর ভূমিকায় তৃতীয় শক্তি, এ ব্যাপারে বিরাট প্রশ্ন আজও রয়ে গেছে। কারণ, নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে কড়া নির্দেশ ছিলো, কোনো অবস্থাতেই সংঘর্ষে জড়িয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না। একথা সত্য যে, গায়ে পড়ে নাস্তিক মুরতাদ ও তাদের দোসর সরকারের পোষ্যদের ঝগড়া পাকানোর পর বিচ্ছিন্নভাবে কিছু হেফাজত কর্মীও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। যাদেরকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে সরকারের পেটোয়া বাহিনী।
দৃশ্যপট আট.
গণতন্ত্রের লেবাসধারী এ সরকার লক্ষ লক্ষ মানুষের অভূতপূর্ব সমাবেশ ও কোটি কোটি মানুষের মনের আকুতি ক্ষমতার গরমে শুধু যে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলো- তাই নয়, বরং তারা নানা উস্কানীমূলক বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে সমাবেশকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টাও করে। ঘোষণা করা হয়Ñ হেফাজতের আমীর আল্লামা আহমদ শফী সাহেব এসে কর্মসূচি ঘোষণা করে মুনাজাতের মাধ্যমে সমাবেশের সমাপ্তি টানবেন।
সেমতে বারবার চেষ্টা করেও তিনি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বাধার মুখে সমাবেশে আসতে ব্যর্থ হন। সূর্য অস্ত যায় যায় অবস্থা। দূর দূরান্ত থেকে আগত জনতার মাঝে বাড়তে থাকে উদ্বেগ উৎকন্ঠা। একে তো আহমদ শফীর ঘোষণা ছাড়া সমাবেশস্থল ত্যাগ না করার অনমানীয় মনোভাব, আবার রাতের আঁধারে এই লক্ষ লক্ষ মানুষ বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লে প্রতিপক্ষের হাতে ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হওয়ার আশঙ্কা। এমন এক প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্ত হয়, অন্যায়ভাবে নিরীহ হেফাজত কর্মীদের শহীদ করার প্রতিবাদ স্বরূপ রাতটি এখানেই কাটিয়ে সকাল বেলা সমাবেশের সমাপ্তি ঘোষণা করা হবে। সিদ্ধান্তের কথা সরকারের পক্ষ থেকে নিয়োজিত আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েও দেওয়া হয়।
দৃশ্যপট নয়.
সারাদিনের ক্লান্ত-শ্রান্ত বনিআদম যারা ৫০-৬০ মাইল হেঁটে হেঁটে এসেছেন। অনাহারে অর্ধহারে অধিকাংশ দ্রুতই পিচ ঢালা রাজপথে গা এলিয়ে ঘুমের কোলে ঢলে পড়লেন। বাকিরা জিকিরÑআজগার, ইবাদত-বন্দেগি, তাহাজ্জুদ-তিলাওয়াতে লিপ্ত হলেন। আমাদের দেশে ১০-৪ টা মূল রাতের মধ্যে পড়ে। সে হিসাবে রাত আড়াইটা মানে শেষ রাত। দুই তৃতীয়াংশ কেটে গেছে। আর দেড় থেকে সর্বোচ্চ দু’ঘণ্টা সময় বাকি। স্বভাবতই ঘুমের প্রকোপ অনেক বেশি। যারা ইবাদত বন্দেগিতে ছিলেন তারাও প্রায় ঘুমের কোলে মাথা রেখেছেন। এই গভীর রাতে কি কোনো অভিযান বা আক্রমন হতে পারে? ইতিহাসে কি এমন কোনো নজির আছে? পাক বাহিনী? না না, পাক বাহিনীর কী ঠেকা পড়ছে নিরীহ বাঙ্গালীদের ওপর হায়োনার মতো ঝাপিয়ে পড়তে ঘুম কামাই করে শেষ রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে? তাহলে এর কোনো নজির নেই। কোত্থাও নাই। তাছাড়া লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশে তাদের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী একটি অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠনের নিরীহ কর্মীদের ওপর গোলা বারুদ নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিবেন তাকি কল্পনা করা যায়? যায় না। এমনটা কি কল্পনা করা উচিত? না উচিত না। কিন্তু . . .কিন্তু কি? কিন্তু তাই ঘটেছিলো যা কল্পনা করা যায় না। তাই ঘটেছিল যা যুদ্ধের ময়দানেও অনুমোদিত নয়। আকাশ-বাতাস তাই প্রত্যক্ষ করেছিলো যা ইতোপূর্বে হয়তো আর কখনো প্রত্যক্ষ করেনি।
দৃশ্যপট দশ.
সকল বাতিগুলো নিভে গেলো। নেমে এলো কিয়ামতসম অন্ধকার। হাজার হাজার র্যাব, পুলিশ, বিজিবি রণসাজে সজ্জিত। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে ওঠলো আকাশ-বাতাস। কেঁপে ওঠলো আকাশ চুম্বি প্রাসাদ, পিচঢালা রাজপথ সবকিছু। যেন যুদ্ধকবলিত জনপদে জালিমের বজ্রনিনাদ। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ঘুমন্ত জনতা চোখ মেলেই দেখে পর্বতসম অন্ধকার। কী হচ্ছে! কী হতে যাচ্ছে! আপনজনকে বুকে জড়িয়ে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সব তাকিয়ে আছে। চতুর্দিক থেকে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে গুলি, টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড আর কলিজা শুকিয়ে দেওয়ার মতো শব্দতরঙ্গ। যেন কিয়ামতের বিভীষিকা। গ্রাম থেকে আসা লক্ষ লক্ষ বনিআদম, নিস্পাপ শিশুÑকিশোর আর তাদের আপনজনরা হতবিহবল। স্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই। টিয়ারশেল আর ঝাঁক ঝাঁক বুলেট ছুটে আসছে। জীবন যে কতো অনিশ্চিত একটি ব্যাপার তা সবার সামনে ভেসে ওঠলো। খোদার কাছে নিজেদের গোনাহ খাতার জন্য সকলে তাওবা করছেন। বিড়বিড় করে দোয়া দুরুদ পড়ছেন। মৃত্যু যেন খুব কাছ থেকে দেখা যাচ্ছে। চিৎকার চেঁচামিচি আর কান্নার রোল পড়ে গেল। সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। যার ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য কোনো ভাষাই যথেষ্ট নয়। শাপলাচত্বর যেন কারবালার প্রান্তর। মোবাইলের কল্যাণে অপারেশনের খবর পৌঁছে গেল সর্বত্র। রাতের এই শেষ প্রহরে যেন আজ সারা দেশটাই একটা কারবালা। হুসাইনের উত্তরসূরিরা আজ বিশ্বনবীর ইজ্জত রক্ষায় জীবনবাজি রেখে বাংলার কারবালায়। ইয়াজিদের ভূমিকায় নবীর উম্মত দাবিদার আওয়ামীলীগ সরকার।
দৃশ্যপট এগার.
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাই বলি। ছোট ভাইদের খুঁজতে যেইনা পেছন ফিরলাম, সঙ্গে সঙ্গে একঝাক ছরাগুলি চেহারায় এসে বিদ্ধ হলো। ছরাগুলি জানতাম রাবারের হয়, কিন্তু এগুলো ছিল ধাতবগুলি। চোখে চশমা না থাকলে হয়তো জীবনের তরে চোখের আলো হারাতে হতো। নাকে মুখে বিদ্ধ হলো অনেকগুলো। চশমার কাঁচ ফেটে গেল। কিন্তু এতোকিছু দেখার সময় কই। এখনো তো জীবনটা বাকি আছে। সেটা বাঁচানোর জন্য শেষ চেষ্টা চালাতে হবে। নিকষকালো অন্ধকার, প্রচণ্ড ভীড়। একবার পড়ে গেলে তার আর উঠে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। ওহ্ খোদা! তুমি এ কী দেখালে। স্বাধীনতার ৪২ বছর পর একটি মুসলিম প্রধান দেশে তোমার নবীর ইজ্জত সম্মান রক্ষার দাবিতে আন্দোলন করা কি এতোই বড় অপরাধ? জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটছি। এক সময় সঙ্গিদের দু’একজন হারিয়ে ফেললাম। এখানে হারানো জনকে খোঁজা আর সমুদ্রের তলদেশের নুড়িপাথর খোঁজা এক কথা। সামনে এগুনোর চেষ্টা করলাম। এক জায়গায় গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। মনে হলো কোনো কিছুর স্তুপ পড়ে আছে। খোদা জানে কোন হতভাগা জননীর সন্তান এরা। সঙ্গে থাকা অন্য দুজনকে তখনো শক্ত করে ধরে রেখেছি। মুখে অনবরত তওবা ইস্তেগফার পড়ে যাচ্ছি। হয়তো আল্লাহকে ডাকার এই শেষ সময়। সময় যেন দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। চতুর্দিক থেকে যৌথবাহিনী প্রতি নি:শ্বাসে নিকট থেকে নিকটতর হচ্ছে। গ্রেনেড, সাউন্ডগ্রেনেড, টিয়ারশেল, চিৎকার, চেঁচামিচি সবকিছুর সাথে মৃত্যুও যেন পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে।
দৃশ্যপট বার.
আমি খোদাকে ডাকছি। মাবুদ! হায়াত শেষ হয়ে থাকলে তোমার কাছে তুলে নাও। দয়া করে, অন্ধ, লোলা, লেংড়া, অবস্থায় বাঁচিয়ে রেখে অন্যের বোঝা বানিও না। অন্ধের মতো হাতড়ে হাতড়ে আগাচ্ছি। আগাচ্ছি বললে ভুল হবে। কারণ জনস্রোতে ভেসে ভেসে এগিয়ে যাচ্ছি। নটরডেম থেকে শাপলাচত্বর পৌঁছলাম। এরপর পল্টনের দিকে আগানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। কিছুদূর আগানোর পর যৌথবাহিনীর আক্রমনের মুখে বামে দিলকুশার দিকে মোড় নিলাম। সেখানে অবছা আলো আধাঁরিতে যেদিকে চোখ যায়, যতদূর চোখ যায়Ñ শুধু মানুষ আর মানুষ। পা টিপে টিপে রাজউকের পেছনের গলিতে আসার পর প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হলাম।
রাতের আঁধার ভেদ করে উল্কার ন্যায় ছুটে আসছে শত শত টিয়ারশেল আর সাউন্ড গ্রেনেড। তীব্র গ্যাসের ধোঁয়ায় পুরো এলাকা ধোঁয়াচ্ছন্ন। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কয়েকজনকে দেখলাম গ্যাসের তীব্রতা সইতে না পেরে রাস্তায় লুটিয়ে পড়লো। ভীত বিহবল জনতা একবার এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছে, আবার ওদিক থেকে এদিকে আসছে। সে যে কী করুণ দৃশ্য তা ভাষায় প্রকাশ করা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। আইন শৃঙ্খখলা বাহিনীর পোশাকে যারা ছিলো তারা যেন বার বার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যেতে। এভাবে প্রায় রাত শেষ হয়ে এলো। টিয়ারশেল, গ্রেনেড আর ছরাগুলিতে অসংখ্য মানুষ রাস্তায় পড়ে আছে। কেউ পরপারের যাত্রী আর বাকিরা সে পথের পথিক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ভাষায়- এরাই শরীরে রঙ মেখে রাস্তায় শুয়ে আছে! মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর রস-বোধের জন্য ধন্যবাদ!
তবুও সান্ত্বনা পেলাম, বর্ণচোরাদের রঙ খোদা তুলে দিয়ে তাদের স্বরূপ জাতির সামনে উন্মোচিত করে দেয়ার জন্য।
দৃশ্যপট তের.
১৮২ বছর পূর্বে বালাকোটের ঐতিহাসিক প্রান্তরে দ্বীন ও আজাদির সৈনিকদের ওপর বৃটিশের পোষ্য লাল কুকুররা শহীদ সায়্যেদ আহমাদ বেরলবি, হাজি ইসমাঈল শহীদ ও তার সঙ্গীদের ওপর ৬ মের রাতের আঁধারে যেভাবে ঝাপিয়ে পড়েছিল, ঠিক একই কায়দায় ৬ মের শাপলাচত্বরে সত্য-সন্ধানীদের ওপর ঝাপিয়ে পড়লো আওয়ামী সরকার। পার্থক্য শুধু ১৮২ বছরের ব্যবধানে বৃটিশের ভূমিকায় আওয়ামীলীগ। তাই ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতির অপেক্ষায় আমরা থাকতেই পারি।
দৃশ্যপট চৌদ্দ.
সারাজীবন যা দেখলাম, যা শুনলাম সব পাল্টে গেল শাপলাচত্বরে। জানতাম রাতের আঁধারে সাধারণভাবে চলতে গিয়েও মানুষ আহত হয়, এমনকি নিহতও হয়। এক দেড় হাজার মানুষও কোনো বিল্ডিং থেকে হুড়াহুড়ি করে নামতে গিয়ে অসংখ্যজন নিহত পর্যন্ত হয়। অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মুখে হার্ট এটাকেও মারা যায় বহু মানুষ। প্রচণ্ড ভীড়ে দিনেÑদুপুরেও পদপৃষ্ঠ হয়ে মারা যায় শত শত বনিআদম। বুলেট, বোমা, গ্রেনেড, গুলির কথা নয় বাদই দিলাম। যদিও মহাজোট সরকারের মালিকানাধীন পত্রÑপত্রিকার রিপোর্ট মতে দেড় লক্ষাধিক গোলা-বারুদ ব্যবহৃত হয়েছে ওই রাতের অভিযানে। অথচ আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আর তার বিজ্ঞ মন্ত্রীপরিষদের বয়ান মোতাবেক সে রাতের অভিযানে একজন মানুষও আহত-নিহত হলো না।
কতো ভয়ানক সত্য কথা! কতো নির্মম রসিকতা! কতো জঘণœ মানসিকতা! কতো নোংরা চিন্তা ভাবনা। জানতাম, মানুষ পাগল হয়, বাচাল হয়, বিবেকহীন হয় কিন্তু মানুষ যে এমনও হয় তা জানতাম না। এবার জানলাম, বড় নির্মমভাবে জানলাম। যাক এ আলোচনায় আজ আর যাব না।
দৃশ্যপট পনের.
ফজরের প্রায় পূর্বমুহূর্তে যৌথ বাহিনীকে কিছুটা ক্লান্ত মনে হলো। আমরা বললাম, যদি আপনাদের সিদ্ধান্ত হয় সব শেষ করে দেয়া, তাহলে তাই করুন। আর যদি উদ্দেশ্য হয় আমাদের উচ্ছেদ করা, তাহলে তার জন্য তো আমাদের যাওয়ার রাস্তা দিতে হবে। কথাগুলো শোনোার সাথে সাথে আইনের পোশাক পরিহিত কিছু মানুষ এমন বিশ্রী গালাগাল শুরু করলো- সত্য কথা বলতে কি মানুষ যে এমন নোংরা ও বিশ্রী শব্দ মুখে আনতে পারে তা কল্পনারও অতীত ছিল। আমরা সব মুখ বুজে সহ্য করলাম। দশ পনের মিনিট মনের ঝাল মিটিয়ে গালিগালাজ করার পর এমন কাজ শুরু করলো যা আগে জানলে তাদের কাছে কিছুতেই যেতাম না। বুড়ো বুড়ো দাড়িপাকা বাবার বয়সি আলেম-ওলামা, ছাত্র-শিক্ষক আর ঈমানদার মানুষগুলোকে দুই হাতে কান ধরিয়ে ছবি তুলতে বাধ্য করলো। এরপর এভাবেই কান ধরা অবস্থায় সকলকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করালো। মনে হচ্ছিল, সদ্য যুদ্ধ সমাপ্ত পরাজিত শত্র“দের ওপর বিজয়ীদের মনের সব ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে শেখ হাসিনার বীর পুরুষ যৌথবাহিনী। মনে মনে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম খা আলমগীরের প্রতিশোধ গ্রহণের অভাবনীয় কলা-কৌশলের প্রশংসা করছিলাম আর খোদার কাছে কায়মনো ফরিয়াদ জানাচ্ছিলাম- ও খোদা! তুমি এতো দয়াবান কেন! তোমাকে যারা গালি দিলো, তোমার নবীর সম্মান যারা ধূলোয় মেশালো- আর যারা তা সইতে না পেরে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসলো- তাদের বুকে অস্ত্রধারণকারী ফিরআউন, হামান, নমরুদ, সাদ্দাদ, আবু জাহেল আর আবু লাহাবদের তুমি যুগে যুগে কেন এতো ছাড় দাও মাবুদ! ওদের কেন এতো বাড়তে দাও!
দৃশ্যপট পনের.
১৮২ বছর পূর্বে ঈমান ও আজাদি রক্ষার তাড়নায় আমিরুল মু’মিনিন সাইয়েদ আহমাদ বেরলবি রহ. ও তাঁর সাথীরা বালাকোটের প্রান্তরে উপস্থিত। আর আজ উপস্থিত সেই চেতনার উত্তরসূরি একদল মরণজয়ী বীর মুজাহিদ মতিঝিলের শাপলা চত্বরে। উদ্দেশ্যের ভিন্নতা নেই, আছে স্থান আর প্রতিপক্ষের ভিন্নতা। মৌলিকত্বে কোনো ভিন্নতা না থাকায় আমরা আশা করতেই পাবি, জালিম যতো দাপুটে আর ভয়ঙ্কর হোক না কেন তাদের পতন অনিবার্য। আর সত্যের সৈনিকরা বাহ্যত যতো দুর্বল আর নিরীহ হোক না কেন তাদের বিজয় অবসম্ভাবি। শহীদের রক্তের ঋণ শোধদিতে আমরা সফল না ব্যর্থ- তার চেয়ে বড় কথা হলো, মাজলুমের প্রতিশোধ গ্রহণের দায়িত্ব আরশের মালিক নিজে গ্রহণ করেছেন। যে সব মিডিয়া এই জঘন্য কর্মকাণ্ডকে তুলে ধরে নবীপ্রেমের ঈমানি দায়িত্ব পালন করেছে, সে সকল মিডিয়ার টুটি চেপে ধরা হয়েছে। কিন্তু সরকারকে আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- ৯০ ভাগ মুসলমানদের এই দেশে নবীর দুশমনদের পক্ষ অবলম্বন করায় হয়তো সাময়িকভাবে বিদেশী প্রভুদের বাহবা পাওয়া যাবে, হয়তো নিজেদের পিঠ বাঁচানোর জন্য কুরআন পুড়িয়ে তার দায় দালাল মিডিয়ার কল্যাণে কুরআনপ্রেমিকদের ঘাড়ে চাপিয়ে ময়িকভাবে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরানো যাবে। কিন্তু নবীর প্রতি শত্র“তার কলঙ্কতিলক কপালে পরার কারণে স্থায়ী পতন ঠেকানো সম্ভব হবে না। যার আলামত ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হচ্ছে। যে সকল মিডিয়া দাজ্জালের একচোখা নীতির নির্লজ্জ প্রতিযোগতায় শিরোপা অর্জনে মরিয়া তাদের পতনও অনিবার্য। শাহবাগ চত্বর নিয়ে অতি উৎসাহীদের আশার বেলুন চুপসে যেতে আরম্ভ করেছে। সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন খোদাদ্রোহী নবীর দুশমনদের ললাটে চরম লাঞ্ছনার তিলক অঙ্কিত হবে। জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যত হয়ে তারা ইতিহাসের আস্তকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। তাই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে, আমাদের ভালোবাসা কার জন্য নিবেদিত হবে। নবীর জন্য না নবীর দুশমন নাস্তিক মুরতাদ ও তাদের দোসরদের জন্য? আমাদের কেবলা মক্কা হবে না মস্কো হবে? আমাদের বন্ধু আম বাম আর রামরা হবে, না আল্লাহ রাসুল ও মুমিনরা হবে? অবশেষে আল্লাহর ঘোষণাকে স্মরণ করে লেখার ইতি টানতে যাচ্ছি। ‘মনোবল হারিও না, চিন্তিত হয়ো না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা মুমিন হও।’
ইসলামি বিশ্বের বিদ্যমান পরিস্থিতি এবং
পাশ্চাত্যের স্ববিরোধী অবস্থান
মাওলানা সাইয়েদ ওয়াজিহ রশিদ নদভী
বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে ইসলামি বিশ্বের সেই দেশগুলোতে জাগরণের নিদর্শন প্রকাশ পায় যারা পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। কিন্তু মানসিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে পাশ্চাত্যের অধীন ও তাবেদার হয়ে রয়েছিল। সেই সব স্বাধীনদেশের জনগণ অনুভব করেছিল যে, তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব জাতীয় জীবনের সমস্যাবলী সমাধানে ব্যর্থ। এই অনুভূতি আরও বেড়ে গিয়েছিল যখন পাশ্চাত্যতোষক শাসকের আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও জাতীয় ঐক্য সংরক্ষণে ব্যর্থ হলো। অতঃপর ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে বিপ্লবী ও সেনা নেতৃবৃন্দের ব্যর্থতা এই অনুভূতিকে বিশ্বাসে পরিণত করেছিল। ক্ষমতাকালে তারা শুধু নিজ বিরোধীদেরকে নিমূল এবং পশ্চিমা ভাবধারা বিশেষ করে ইসলামি বিশ্বে সমাজতন্ত্র বাস্তবায়ন করার চেষ্টাই করে ছিল। ইসলামপন্থী প্রচারক ও সংস্কারকদেরকে হয়তো কারাগারে বন্দী করা হয়। কিংবা তাদেরকে নিমূল করা হয়।
তারা অর্থনীতি, রাজনীতি ও শিক্ষা দীক্ষায় পশ্চিমাদের অনুকরণ করে। এবং পশ্চিমা পরিকল্পনা অনুযায়ী মুসলিম জাতিগুলোর ইসলামি পরিচয়, তাদের ধর্মীয় স্বকীয়তা, ধর্মের প্রতি ভালোবাসা, ধর্মীয় গর্ব ও মর্যাদাবোধ এবং ইসলামি নির্দশন ও পবিত্র স্থানসমূহ সংরক্ষণের প্রেরণা নিঃশেষ করার কোনো চেষ্টাই অবশিষ্ট রাখেনি। মুসলমানদের এই জাগরণ ছিল স্বাভাবিক। প্রসিদ্ধ প্রাচ্যবিদ উইলফ্রেড ক্যান্ট ওয়েল স্মিথও (১৯১৬-২০০০) স্বীকার করছিলেন যে, মুসলিম বিশ্বে প্রচলিত শাসনব্যবস্থা ব্যর্থতার পরিণামে ইসলামি জাগরণ এসেছে। উইলফ্রেড স্মিথ তার বইতে লিখেছেন, আরব ও ইসলামি বিশ্বের জাগরণ ১৯৬৭ সালের পরাজয়ের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল। সুতরাং সেই ব্যর্থতার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় ইসলামি সংগঠন ও আন্দোলনগুলো পূর্ণ শক্তিতে মাঠে নামে। যুবকেরা এই পরাজয়ের প্রতিক্রিয়া দূর করার জন্য ধর্মের আশ্রয় নেয়। সেই যুবকেরা আক্কাদ ত্বহা হোসাইন, আহমাদ আমীন, হাইকেল, উমর ফারুক প্রমুখের আত্মরক্ষামূলক অবস্থানকে গ্রহণ করল না, বরং ইসলামের পক্ষে জোরালো অবস্থানকে নিজেদের পরিচয় বানিয়ে নিল। তারা ঘোষণা করলো যে, এই সব বুদ্ধিজীবীর ধারণা ঠিক নয় যে, মুসলমানদের অবনতির কারণ ইসলম। বরং ইসলাম এক বিশ্বজনীন, পূর্ণাঙ্গ ও শাশ্বত ধর্ম। যা সভ্যতা সংস্কৃতি ও মানব জাতির উন্নতির অগ্রদূত। ইসলামি আন্দোলনগুলো আত্মরক্ষামূলক অবস্থান ছেড়ে দিয়ে আক্রমনাত্মক অবস্থান গ্রহণ করে। তারা ইসলামি ভিত্তির ওপর এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেÑ যাতে সাম্য, সুবিচার ও মানবিকতার বিকাশ ঘটবে। এই আন্দোলনের মৌলিক প্রভাবক ছিল সফলতা। যা তারা অর্জন করেছিল সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন বন্ধ করে দিতে। এবং সমাজকে নৈতিক বিপথগামিতা ও দূর্নীতি থেকে পবিত্র রাখতে। এই আন্দোলনের মতো বিদ্যমান জীবনব্যবস্থা সুযোগ সন্ধানী ও উপকরণভোগ নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। আর তার লাগাম দুষ্কৃতিকারীদের হাতে। এই জন্য জীবনব্যবস্থার সংস্কারের জন্য এমন একটি সমন্বিত কর্মসূচির প্রয়োজন যা ইসলামি ভাবধারায় আধুনিক, যাদের প্রশ্নসমূহ ও সমস্যাগুলোর সমাধান উপস্থাপন করতে এবং গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এটা ছিল সেই চিন্তা, বিভিন্ন দেশে পশ্চিমা চিন্তা চেতনা ও জড়বাদী জীবনব্যবস্থার সাথে যার প্রত্যক্ষ বিরোধ রয়েছে। কিছু প্রসিদ্ধ লেখক বর্তমান যুগকে বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়্যাত বলে আখ্যায়িত করছেন। এবং দলিল প্রমাণাদী ও ঘটনাবলীর আলোকে পশ্চিমা সভ্যতার প্রতারণা, ষড়যন্ত্র ও অসারতা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, পশ্চিমা দেশগুলো ইসলামি বিশ্বের সম্পদ শোষণ করছে। নতুন প্রজন্মের এই অনুভূতি ও উপলব্ধি সেই বইগুলোর অধ্যায়ন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। যেগুলোর লেখকগণ পশ্চিমা সভ্যতার ওপর দুঃসাহসিকতা ও পূূর্ণ আস্থার আলোকে সমালোচনা করেছেন। এবং সাম্রাজ্যবাদী চিন্তার ওপর থেকে পর্দা উন্মোচন করেছেন। সেই সব সমালোচক ও বুদ্ধিজীবী পশ্চিমা সভ্যতাকে কাছ থেকে দেখেছেন, নীরক্ষণ করেছেন। এবং ইসলামি বিশ্বের সমস্যাবলীর ব্যাপারে পাশ্চাত্যের দ্বিমুখী নীতির সাহসিকতা পূর্ণ পর্যালোচনা করেছেন। পাশ্চাত্যে ইসলাম ও ইসলামের পবিত্র স্থান সমূহের অবমাননা, আল্লাহর রাসুল সা. এর শানে বেয়াদবীর ঘটনাসমূহ, মুসলিম ক্ষমতাসীনদের নির্লিপ্ততা ও তাবেদারির মানসিকতা এই উপলব্ধিকে শক্তিশালী করেছে। এ থেকে ইসলামের দিকে পত্যাবর্তনের প্রবণতা বেড়েছে। ইসলামি শরিয়তের আলোকে সমস্যাবলীর সমাধান অনুসন্ধান করতে গিয়ে ইসলামি চিন্তার বাহকগণ পশ্চিমা চিন্তার সুস্পষ্ট সমালোচনা করেছেন। সেটির অসারতা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। পাশ্চাত্যের অনুসরণের ক্ষতিসমূহ বর্ণনা করেছেন। জাতির মধ্যে এই অনুভূতির আগুন সৃষ্টি করে দিয়েছেন যে, পশ্চিমারা এই ভাবে মুসলিম বিশ্বকে নির্বোধ বানিয়ে রাখে। বিপদে-আপদে ইসলামি দেশগুলোকে বন্ধুহীন ও অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেয়। মুসলিম বিশ্বের উদ্ভূত ঘটনাবলীর প্রতি যাদেরে দৃষ্টি রয়েছে তারা জানেন, ইউরোপ এখন পর্যন্ত মধ্যযুগের ক্রুসেডি মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসেনি। ইউরোপ আজও ইহুদিদের জোরালো রক্ষক। মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব সত্ত্বেও তারা ইয়াহুদিদের স্বার্থকে মুসলিম স্বার্থের ওপর প্রাধান্য দেয়। মানুষ জানে যে ইউরোপের সাথে এই সম্পর্ক ইউরোপীয় স্বার্থ রক্ষায় এক তরফা। অবস্থা ও ঘটনালীর সাথে পরিচিত মহোদয়গণ জানেন মুসলমানদের উন্নতি এবং তাদের সমস্যাবলীর ব্যাপারে ইউরোপের কোনো আগ্রহ নেই। বরং ইউরোপতো চেষ্টা করে চলছে মুসলিম বিশ্বকে সমস্যাবলী ও জটিলতায় পেঁচিয়ে রাখাতে এবং তার অর্থনীতির কোমর ভেঙে দিতে। এজন্যই মুসলিম বিশ্বে অর্থনৈতিক সমস্যাবলী সৃষ্টি হয়ে থাকে। ইউরোপের এজেন্টরা ইসলামি দেশগুলোতে নিত্য নতুন সমস্যাবলী, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, চিন্তাগত দ্বন্দ্ব এবং সেনা অভ্যুত্থান ঘটায়। ফলে ইসলামি দেশগুলো তাদের সমস্যাবলী সমাধানের জন্য ইউরোপের দিকে হাত বাড়ায়। ইউরোপের মিশন ইসলামি বিশ্বকে তার প্রকৃত উৎস এবং মানবীয় নেতৃত্ব থেকে দূরে রাখা। এ জন্য ইসলামি বিশ্বের সরকারগুলোকে বশীভূত করে রাখে, যেন ইসলামি জাগরণের প্রত্যেক আন্দোলনকে দমন করা যায়। ইসলামি দেশগুলোতে পশ্চিমা তোষক শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতার অনুভূতি জনগণের মধ্যে নতুন বিকল্প অনুসন্ধানের প্রেরণা সৃষ্টি করে। এবং এই মানোভাব এতই শক্তিশালী ছিল যে তা দমিয়ে রাখা যায়নি। স্বয়ং পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদের ধারণা হয়ে ছিল, এই অনুভূতি খুব জোরালো ভাবে বেড়ে চলেছে। ক্ষতি কিংবা অপমান ও অবনতির অনুভূতি মানুষকে এর কারণসমূহ দূর করতে উতসাহিত করে। যদি পাশ্চাত্যের অনুসারী ও তাবেদার দেশগুলো শিক্ষার ক্ষেত্রে উন্নতি, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ও মজবুতি এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অর্জন করে এবং প্রযুক্তি ও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে উন্নতি অর্জন করে উন্নত দেশসমূহের সারিতে এসে যায় এবং নিজ সমস্যাবলী সমাধান করার যোগ্যতা অর্জন করে স্বনির্ভর হয়ে যায়, তবেই পাশ্চাত্যের এই অনুসরণের বৈধতা আছে। কিন্তু এ রকম কিছুই হয়নি, বরং তারা অবনতি, অমর্যাদা এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থার শিকার হয়েছে। যে দেশগুলো পশ্চিমা সভ্যতা ও পশ্চিমা অর্থ ব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছে তারাই সবচেয়ে বেশি ঋণী। তাদের অর্থনীতি অন্যদের ওপর নির্ভরশীল। সবচে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, পাশ্চাত্যের ওপর বেশি ভরসাকারী ও তার ইশারায় পরিচালিত ইসলামি দেশগুলোর এই সব সমস্যাবলী সবচেয়ে জটিল। আর সেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব, নাগরিক অধিকার পদদলিত এবং অর্থনীতির অবনতি হয়ে চলছে। এই তিক্ত বাস্তবতা মুসলিম বিশ্বে নতুন ব্যবস্থা অনুসন্ধানের আগ্রহ এবং নতুন প্রবণতা সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থায় ইসলামপন্থীদের দায়িত্ব ছিল এই অনুভূতিকে জোরদার করা। এর পরিধি প্রশস্ত করা। এই অনুভূতিকে ব্যাপক করার জন্য মন-মস্তিষ্কে এ কথা বসাতে হবে যে, পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ-অনুসরণ নিছক ক্ষতিকর এবং অবনতি ও পশ্চাদপদতার কারণ। এতে শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং আইনবিদকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। পাশ্চাত্য থেকে আমদানী করা আইন ও শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা ও দুর্বলতাকে স্পষ্ট করা এবং এই বিশ্বাস করানো যে, পশ্চিমা রাজনীতি, অর্থনীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা অপর দেশগুলোর সমস্যা সমাধান করতে পারে না। কেননা তা তাদের স্বভাব, মানসিকতা, ইতিহাস, পরিবেশ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক। ইসলামপন্থীদের আরও দায়িত্ব ছিল সমস্যাবলীর ইসলামি সমাধান ও পশ্চিমা সভ্যতার সঠিক বিকল্প উপস্থাপন করা। এবং প্রমাণ করা যে, ইসলামি বিশ্বের অধিকাংশ সমস্যা উপনিবেশিক শাসনের উত্তারাধিকার ও পাশ্চাত্যবাদের অনুসরণের পরিণতি। এগুলো ইসলামি বিশ্বের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এজন্য ইউরোপীয় অভিজ্ঞতার আলোকে এগুলোর সমাধান হয় না। এই জাগরণ সৃষ্টির অগ্রাধিকারের মধ্যে ছিল, ইসলামি সমাজের সংস্কার ও নির্মাণের পথে জনগণকে চিন্তাগত ও সংস্কৃতিগতভাবে সজাগ করা। ইসলামি শিক্ষা-দীক্ষার প্রতিষ্ঠান এবং স্কুল প্রতিষ্ঠা করে মুসলিম জাতির শ্রেণিসমূহের মাঝে ধর্মীয়, জাতীয় ও সাংস্কৃতিক ঐক্য সৃষ্টি করা। ইসলামিজীবন ব্যবস্থার আলোকে জীবনের সমস্যাবলীর সমাধান করা এবং পশ্চিমা ওই সব কেন্দ্র ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করা। যারা ইসলামি দেশের সম্পদ শোষণ করছে। এই ইসলামি জাগরণের ফলে বিদ্যমান শাসনব্যবস্থাকে পরিবর্তনের জন্য সেই সব জনতার বিল্পব হয়েছে যেখানে দীর্ঘদিন ধরে স্বৈরতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল। এবং অত্যাচারী একনায়কতন্ত্রীরা ইসলামি জাগরণকে পিষ্ট করার কোনো চেষ্টাই অবশিষ্ট রাখেনি। এবং নাগরিক স্বাধীনতা হরণ করেছিল। সেই দেশগুলোতে গণবিপ্লবের ফলে স্বৈরব্যবস্থার পতনের পর যখন অবাধ নির্বাচন হলো তখন সেই নির্বাচন প্রমাণ করে দিল যে, এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ইসলামি শরিয়তকেই পছন্দ করে। এবং এর আলোকে নিজেদের সব সমস্যার সম্যাধান করতে চায়। এই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিল, নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর তাকে শাসন করার সুযোগ দেওয়া। কিন্তু ইসলামের শত্র“রা এই সফলতা থেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং পশ্চিমা ও ধর্মবিদ্বেষী চক্রগুলোর সহায়তায় নির্বাচিত বেসামরিক সরকারকে উতখাত করে। আলজিরিয়া ও তুরস্কে এমনই হয়েছিল। এবং সেই সব দেশে সেনাশাসন পুনরায় ফিরে আসে। মিশরে আজ এই পরিকল্পনার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। এখানে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারকে উতখাত করা হয়েছে। এবং সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে। ইসলামপন্থীদের ঢালাও ভাবে বন্দি করা হচ্ছে। তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। তাদের সংগঠন ও দলসমূহের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে, সম্পদ জব্দ করা হচ্ছে। আর এ সবই হচ্ছে আর্ন্তজাতিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর তত্ত্বাবধানে।
আল জাজিরা ওয়েবসাইটের ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ করেছে যে, এ মর্মে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদি রয়েছে যে, মিশরে ড. মুরসিকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ এবং সেনা অভ্যুত্থান করানোর জন্য বিরোধীদের মোটা অংকের তহবিল সরবরাহ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিভিন্ন নথিপত্র থেকে প্রমাণিত হয় আমেরিকা মিশরে প্রতিষ্ঠিত নিজস্ব বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেনা অভ্যুত্থানের পথ সুগম করার জন্য নয়শত মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে এবং মুরসি বিরোধীদের মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছে। (আল মুজতামা: ২০৬২)
সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা অনুযায়ী মিশরে পূর্ববর্তী ব্যবস্থা থেকেও কঠোর স্বৈরাচারী সেনা শাসনব্যবস্থা কার্যকর করা হয়েছে। অর্ন্তবর্তী সেনা সমর্থিত সরকার মুরসির সমর্থকদের ওপর নির্মম দমন অভিযান চালায়। ফলে হাজর হাজার বিক্ষোভকারী নিহত হয়। এই বর্বর আচরণ ও নির্মমতার ওপর সমস্ত ইউরোপ এবং গণতন্ত্রের দাবিদার দেশগুলোর নেতাগণ নীরব থেকেছেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলো পদক্ষেপ নেয়নি। এই জন্য এই মানুষগুলো এবং ইসলামকে সন্ত্রাসবাদের সাথে মিলিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের কাজকে অগণতান্ত্রিক ও সন্ত্রাসবাদ বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। অপরদিকে অর্ন্তবর্তী সেনা সমর্থিত সরকার তাদের সাথে পশু সুলভ ও নির্মম আচরণ করছে। কারাগারে বন্দি ইখওয়ান সমর্থকদেরকে কঠোর নির্যাতন করেছে। বিক্ষোভকারীদের ও সেনাদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। ফলে শতশত বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছে।
পশ্চিমা দেশগুলোর স্ববিরোধী অবস্থানের একটি স্পষ্ট প্রমাণ এই যে, এশিয়া, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন ইরান, ফ্রান্স, পাকিস্তানের নির্বাচন হয়েছে এবং যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে তাদেরকে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছে এবং তাদের সরকার গঠিত হয়েছে। এতে কারও কোনো আপত্তি হয়নি। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। পশ্চিমা সভ্যতার বর্তমান নিয়ম অনুযায়ীই এগুলো হয়েছে। বিজয়ী দলকে ক্ষমতা হস্তান্তর করা একটি স্বাভাবিক বিষয়। মিশরের ব্যাপারেও এই দাবি ছিল যে, পাশ্চাত্য গণতন্ত্রবিরোধী অবস্থানের কঠোর সমালোচনা করবে এবং বিজয়ী দলকে ক্ষমতায় বহাল থাকার সুযোগ দিবে। কিন্তু ইসলামপন্থীদের হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ার ভয় তাদেরকে অস্থির করে দেয়। সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে মিশরে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা থেতে অপসারণ করে সেনা সমর্থিত সরকার বসায়। সর্বক্ষেত্রে সহায়তার ঘোষণা দিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ১৭ আগস্ট ২০১৩ সালে জোরালোভাবে বলেছেন যে, তিনি মিশরের সেনা সরকারকে সব ক্ষেত্রে সাহায্য করতে প্রস্তুত আছেন। সূত্র অনুযায়ী রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চান। এবং এজন্য তিনি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করছেন। অপরদিকে মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে শক্তিশালী নেতা হিসাবে অবির্ভূত হতে চেয়েছেন। এই জন্য পুতিন মিশর ও সিরিয়ার ইসলামপন্থীদেরকে সন্ত্রাসবাদী বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং সিরিয়াতে বাসার আল আসাদকে খোলাখুলি সমর্থন করেছেন। অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরশাসন ব্যবস্থার সমর্থন করা অগণতান্ত্রিক কাজ। কিন্তু যারা গণতন্ত্র, নাগরিক স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষমতার সমর্থনকারী এবং নির্বাচিত শাসনব্যবস্থার সমর্থক- তাদের আচরণ অত্যান্ত দুঃখজনক। এ থেকে স্পষ্ট যে, বিশ্বে চলমান ঘটনাবলী ও পরিবর্তনের ব্যাপারে পাশ্চাত্য দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করেছে।
(উর্দু পাক্ষিক ‘তামীরে হায়াত’ থেকে ভাষান্তর- মাওলানা আসআদুজ্জামান)
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম : ওলামায়ে কেরামের দিকে কেন অশুভ ইঙ্গিত?
জহির উদ্দিন বাবর
আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীনতা। একদিন আমরা ছিলাম পরাধীন, শাসন করতো ভিনদেশীরা। অনেক সংগ্রাম-সাধনা, ত্যাগ-তিতিক্ষার পর ‘স্বাধীনতা’ নামক সূর্যটি আমরা ছিনিয়ে এনেছি। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আমাদের জাতীয় সম্পদ। বিশ্বের বুকে আমরা আজ স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের নাগরিক-এটাই আমাদের গর্ব। নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠী বা শ্রেণি-পেশার নয়, মুক্তিযুদ্ধ এদেশের প্রতিটি নাগরিকের অহঙ্কার। যেকোনো দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং প্রয়াসের দরকার পড়ে। আমাদের মুক্তিসংগ্রামে যে চড়ামূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে এতে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ না থাকলে সফল হওয়া সম্ভব ছিল না।
অন্য সবার কথা আলোচিত হলেও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে আলেমসমাজের অংশগ্রহণের কথা তেমন আলোচিত হয় না। এ প্রসঙ্গটি আমাদের কাছে ধূসর কিংবা স্পর্শকাতর বলে অনালোচিত ও অনুক্ত থেকে যায়। আলেম বলতেই মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা নিয়ে সংশয় ও সন্দেহ প্রকাশ করা সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এই মনোভাবের কারণে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে তাদের প্রতি আমাদের ব্যক্ত ও অব্যক্ত কিছু ঘৃণা প্রকাশ পায়। পুরো আলেমসমাজকেই স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের প্রতি অযাচিত আচরণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে আলেমসমাজের নাম এলে অনেকেই নাক সিটকায়। ধর্মীয়ভাবে সর্বজনবিদিত আলেমসমাজের প্রতি জাতীয় পর্যায়ের এই ধ্যান-ধারণা প্রকৃত বিচারে কতটুকু বাস্তব তা যথেষ্ট বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ অপরাধের দায় এবং তুচ্ছতার গ্লানি একতরফাভাবে তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়াটা অন্যায়। সংশ্লিষ্টতাহীন কোনো অনাচারের দায় যাচাই-বাছাই ছাড়া যে কারো কাঁধে চাপিয়ে দেয়ার পরিণাম শুভ হয় না। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী আলেম প্রজন্ম, যাদের জন্মই মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে, তাদের প্রতি অবাঞ্ছিত ইঙ্গিত করা কি অন্যায় নয়?
আমাদের মুক্তিসংগ্রামে সবার অবদান সমান ছিল না এ কথা ধ্র“ব সত্য। এ ক্ষেত্রে আলেমসমাজের অবদান কিংবা অংশগ্রহণ আশানুরূপ ছিল না-এটা স্বীকার করে নিতেও কারো কুন্ঠিত হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এই সীমিত অবদানকে তুচ্ছ করা এবং তাদের সংশ্লিষ্টতাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বসা বড় ধরনের অবিচার। এটা জলজ্যান্ত কোনো সত্যকে গলা টিপে হত্যা করারই নামান্তর। এদেশের খ্যাতিমান অনেক বুদ্ধিজীবী-পণ্ডিতও স্বাধীনতাকে সমর্থন করেননি, পাকিস্তান সরকারের আনুগত্য করে চাকরি করেছেন। পরবর্তী সময়ে তারা স্বাধীন বাংলাদেশে চলে এসেছেন, এদেশের পক্ষে কাজ করেছেন। কেউ তো তাদের প্রতি বাঁকা চোখে তাকায় না! স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে তারা তো চিহ্নিত হন না। শুধু লেবাস-পোশাকের কারণে আলেমরা কেন স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে পরিচিত হবেন? আলেম মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বিশাল না হলেও নগণ্য নয়। এদেশের আনাচে-কানাচে এখনো অনেক আলেম খুঁজে পাওয়া যায় যারা নিজেদের জীবনবাজি রেখে সরাসরি সম্মুখসমরে অংশগ্রহণ করেছেন। দেশমাতৃকার টানে মুক্তিসেনাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে।
‘রাত তখন পৌনে একটা। শুরু হলো প্রচণ্ড গোলাগুলি। আকাশ রক্ত বর্ণ হয়ে উঠছে আগুনের লেলিহার শিখায়। ঘন ঘন ফাটছে কামানের শেল। পাকিস্তানি ফৌজ অতর্কিত হানা দিয়েছে আমাদের ক্যাম্পে। মাথার ওপর দিয়ে সাঁই সাঁই ছুটছে গুলি। আমরা টিলার গর্তে ঢুকে, গাছের আড়ালে থেকে গড়ে তুললাম তুমুল প্রতিরোধ। ঘণ্টা দেড়েকের শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে আমরা সফল হলাম। ইতোমধ্যে তাদের কয়েকজন খতমও হয়ে গেলো।’ একজন আলেমের স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে উদ্ধৃতাংশটি। তিনি সম্মুখসমরে যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন নয় মাস। তার সহযোগী হিসেবে ছিলেন একাধিক আলেম।
মুক্তিযুদ্ধে শাহাদত বরণ করেছেন জানা-অজানা এমন আলেমের সংখ্যা কম নয়। ডা. মাওলানা অলিউর রহমানের কথা আমরা জানি। তিনি ছিলেন একজন বুদ্ধিজীবী আলেম। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রথমসারির বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাকেও হত্যা করা হয়। পটিয়া মাদরাসার প্রবীণ উস্তাদ ছিলেন আল্লামা দানেশ রহ.। পটিয়া মাদরাসায় পাক সেনাদের গোলা বর্ষণে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী, তার ভাই মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী, মাওলানা আব্দুর রহমান, মাওলানা মুস্তাফিজ (হাতিয়া), মাওলানা আব্দুস সোবহান (মুহাদ্দিস), মাওলানা আবু ইসহাক (রাঙ্গুনিয়া), মাওলানা ইমদাদুল হক আড়াইহাজারী, মাওলানা দলিলুর রহমান (চন্দ্রঘোনা), মাওলানা মতিউর রহমান (রানীরহাট), মাওলানা আব্দুল মতিন কাজী, মাওলানা আমজাদ হোসেন (নাগেশ্বর), মাওলানা কামরুজ্জামান (নরসিংদী), মাওলানা বজলুর রহমান, মাওলানা বশির উদ্দীন, মাওলানা মুখলিস (চান্দিনা) প্রমুখ আলেম সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন। তাদের অনেক গৌরবগাঁথার কথা মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র এবং তাদের নিজেদের স্মৃতিকথায় পাই। উদাহরণ হিসেবে এখানে অল্প কয়েকজন আলেম মুক্তিযোদ্ধার নাম উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছেন অনেক আলেম মুক্তিযোদ্ধা। তাদের অনেকের নামও আমরা জানি না, অনেকেই ইতোমধ্যে দুনিয়া থেকে বিদায়ও নিয়ে গেছেন। আলেম মুক্তিযোদ্ধাদের স্বতন্ত্র কোনো তালিকা কোথাও সংরক্ষিত নেই। এজন্য প্রকৃত বাস্তবতাটা আমাদের সামনে আসে না।
সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়া আলেমদের বাইরেও একটি বিশাল শ্রেণি আছেন যারা নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। সারাদেশে মসজিদ, মাদরাসা ও খানকায় ছড়িয়ে থাকা আলেমরা সাধ্যানুযায়ী মুক্তি সংগ্রামে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। নানা সমস্যা ও প্রতিকূলতার কারণে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ না পেলেও স্ব স্ব অবস্থান থেকে মুক্তিসংগ্রামকে সাফল্যের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে তাদের আকুলতার কোনো কমতি ছিল না। প্রত্যন্ত অঞ্চলের ইমাম সাহেবের হুজরা কিংবা পীর সাহেবের খানকায় আশ্রয়ে থেকে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন অনেক যোদ্ধা। অনেক আলেম নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুরক্ষিত রেখেছেন মুক্তি-ফৌজদের। প্রয়োজনে পাকসেনাদের সঙ্গে ভাব গড়ে তুলে ফায়দা লুটেছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। আর কিছু না হোক, জোরালো সমর্থন, ঐকান্তিক কামনা এবং আন্তরিক দোয়ার দ্বারা প্রত্যেক আলেমই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। সাধারণ মানুষের মনোবল চাঙ্গা করা, ব্যাপক জনমত গড়ে তোলা, যুদ্ধরত সৈনিকদের সেবা-শুশ্রƒষা, তাদের পারিবারিক খোঁজ-খবর নেয়া মুক্তিযুদ্ধসংশ্লিষ্ট এসব অধ্যায় থেকে কোনো আলেমই বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। এ হিসেবে আলেমদের সিংহভাগই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস শুধুই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নয়। বৃটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে প্রায় দুইশ বছরের যে সংগ্রাম এর পরতে পরতে রয়েছে ওলামায়ে কেরামের অভূতপূর্ব ভূমিকা। উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পূর্ণতা পাবে না বালাকোট, রেশমি রুমাল, সিপাহী বিদ্রোহ, দারুল উলূম দেওবন্দ আন্দোলন প্রভৃতি ছাড়া। আর এর সবগুলোতেই রয়েছে ওলামায়ে কেরামের স্বর্ণোজ্জ্বল ভূমিকা। ইংরেজবিরোধী ভূমিকার জন্য খুদিরাম যদি ইতিহাসে বীরসেনানী হিসেবে অমর হয়ে থাকেন তবে এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখা শত শত ওলামায়ে কেরামের নাম কেন অনালোচিত থাকে। ‘অমুক-তমুকের’ জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না যেমন সত্য, তেমনি ইংরেজদের বিতাড়িত না করলেও এদেশ স্বাধীন হতো না- এটাও সত্য। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ না হলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের যে জন্ম হতো না সেটাও তো ধ্র“ব সত্য। সুতরাং স্বাধীনতা সংগ্রামের খণ্ডিত ইতিহাস দিয়ে আলেম-ওলামার অবদান মূল্যায়ন করা তাদের প্রতি অবিচার।
উপনিবেশমুক্ত নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের নেতৃত্বে যারা ছিলেন, যারা ইসলামি রাষ্ট্রের টোপ দিয়ে জনগণকে উদ্দীপ্ত করেছিলেন, তাদের মধ্যে ইসলামের কোনো বালাই ছিল না। ইসলামের লেভেল এঁটে ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদনই ছিল তাদের প্রধান মনোবাঞ্ছা। তাদের মোহাচ্ছন্ন জালে আটকা পড়ে যায় ওলামায়ে কেরামের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ। আলেমদের যে অংশটি তখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভাজন সমর্থন করেননি, তারাও মুক্তিযোদ্ধা কিংবা সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেননি। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়টা অনেকের কেটেছে সিদ্ধান্তহীনতা ও ইতস্ততার ঘোরের মধ্যে। বিবেক ও পারিপার্শ্বিকতার টানাপোড়েন তাদের স্বতঃস্ফূর্ততার সুযোগ করে দেয়নি। যারা সব আড়ষ্টতা কেটে বিবেকের ডাকে সাড়া দিতে পেরেছেন তারাই ছুটে গেছেন রণাঙ্গনে, জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইয়ে। তাছাড়া বাস্তবতা হলো, সব বাধা-বিঘন্ন এড়িয়ে সবার একসঙ্গে রণাঙ্গণে চলে যাওয়াটাও অসম্ভব। আর এটা যুদ্ধকৌশলেরও পরিপন্থী। এজন্যই দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রায় সাত কোটি জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র কয়েক লাখ ছিলেন মাঠ পর্যায়ের সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা। তবে বাকিরা মুক্তিযুদ্ধ প্রক্রিয়ার বাইরে ছিলেন না। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপক্ষে কিংবা দেশের স্বাধীনতার অনুকূলে কোনো না কোনো ভূমিকা মোটামুটি সবারই ছিল।
সাধারণ এ বিশ্লেষণপ্রক্রিয়া আলেমদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তারাও সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন। এ দৃষ্টিকোণে মুক্তিসংগ্রামে ওলামায়ে কেরামের উজ্জ্বল ভূমিকার কথা ভাস্বর হয়ে ওঠে। অবাঞ্ছিত কিছু অপরাধমূলক কার্যক্রমের যে অভিযোগের তীর আলেমদের ওপর বিদ্ধ করা হয় এটা সত্যিকার কোনো আলেমের কাজ নয়। সুযোগসন্ধানী একটি শ্রেণি আলেমের লেবাস গায়ে ঝুলিয়ে কিংবা জোর করে আলেম উপাধি ধারণ করে নানা অন্যায়-অনাচার ও অপকর্ম চালিয়েছে। অনেক আলেমও সুবিধাভোগী হিংস্র এ শ্রেণিটির শিকারে পরিণত হয়েছেন। সীমিত আয়তনের জনবসতিপূর্ণ এ ভূখণ্ডে কারো অপরিচিত কেউ নন। সুতরাং কারা তখন আলেম বেশ ধারণ করে এসব অপকর্ম চালিয়েছিল তা কারো জানার বাইরে নয়। সে শ্রেণিটির অস্তিত্ব¡ এখনও আছে। তাদের সঙ্গে কোনো প্রকৃত আলেমের যোগসূত্রতা তখন যেমন ছিল না, এখনও নেই। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হিসেবে সে সময় তারা যেমন ধিকৃত ও ঘৃণিত হয়েছিল এখনও হচ্ছে। এজন্য তাদের দায় নিষ্কলুষ ইমেজ ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী, জাতীয় ও ধর্মীয় অভিভাবক ওলামায়ে কেরামের ওপর চাপিয়ে দেয়ার অশুভ প্রবণতা থেকে আমাদের সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে কোনো আলেম দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরোধী হতে পারেন না। কারণ, যে ইসলামের দীক্ষায় তারা দীক্ষিত, সে ইসলাম মাতৃভূমি রক্ষার জোর তাগিদ দিয়েছে। ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ ও চরিত্রে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল নজির চিরভাস্বর হয়ে আছে। তিনি যখন স্বজাতিকর্তৃক বিতাড়িত হয়ে মদিনার পথে হিজরত করেন, তখন বার বার মক্কার দিকে তাকাচ্ছিলেন আর কাতর কণ্ঠে আফসোস করে বলছিলেন, ‘হে আমার স্বদেশ, তুমি কতই না সুন্দর! আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার আপন জাতি যদি ষড়যন্ত্র না করতো আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’ মদিনায় হিজরত করার পর রাসুল সা. মদিনাকেই নিজের মাতৃভূমি হিসেবে গণ্য করেন। এর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
ইসলামি চেতনায় যারা বলীয়ান, বিবেকের দায়বোধে যারা দগ্ধ, তারা দেশ ও জাতির জন্য সবচেয়ে বেশি নিবেদিত। মুক্তিসংগ্রামে আলেমসমাজের স্বতঃস্ফূর্ত ও ব্যাপক অংশগ্রহণ না থাকলেও দেশগড়া এবং দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য তাদের চেষ্টা, শ্রম ও আকুলতা কোনো অংশে কম নয়। যেকোনো দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ যত না গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়েও বেশি গুরুত্ব রাখে দেশ গঠনে অংশিদারিত্ব। আর এক্ষেত্রে আলেমদের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। তারা নিজেদের অবস্থান থেকে দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য সাধ্যানুযায়ী ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। সত, আদর্শিক ও নৈতিক শিক্ষায় পুষ্ট জাতি গঠনে তাদের অবদানই সর্বাগ্রে। আলেম-ওলামা স্বদেশ প্রেম ও দেশের প্রতি আন্তরিকতা প্রশ্ননাতীত। সুতরাং আলেম-ওলামা প্রতি স্বাধীনতাবিরোধী ইঙ্গিত অশুভ পাঁয়তারারই অংশ। সচেতন ও দেশপ্রেমিক নাগরিকদের উচিত, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এসব অপপ্রচার থেকে বেঁচে থাকা।
ইতিহাসের আয়নায় রক্তাক্ত আমাদের বর্তমান
খন্দকার মনসুর আহমদ
আত্মসচেতন জাতি ইতিহাসকে তার পরম শিক্ষক হিসেবে গ্রহণ করে এবং ইতিহাসের সত্যকে জীবনচলার পথে আলোকবর্তিকারূপে গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে আত্মভোলা জাতি তাদের ইতিহাস ভুলে যায়। এবং জাতীয় সংকটময় মুহূর্তে যথাযথ কর্তব্য নির্ধারণে দিশেহারা হয়ে পড়ে। তাই আমরা আমাদের বিগত ইতিহাসের একটি দগদগে অধ্যায়ের কথা মনে করিয়ে দিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনের বর্তমান সংকটকালকে খানিকটা মূল্যায়নের প্রয়াস পাব।
আমি ইতিহাসের যে অধ্যায়টির প্রতি ইঙ্গিত করতে চাই তা হলো আমাদের ভারত উপমহাদেশে আগ্রাসী ইংরেজদের দখল প্রতিষ্ঠা ও সুদীর্ঘ দুঃশাসন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, সাম্রাজ্যবাদী ধুরন্ধর ইংরেজগোষ্ঠী বাণিজ্যের কৌশলগত পথে একদা আমাদের এই উপমহাদেশ দখল করে নিয়েছিলো এবং এদেশকে মানবতার বদ্ধভূমিতে পরিণত করেছিলো। হাজার হাজার আলেম উলামাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়েছিলো। হাজার হাজার মাদরাসা বন্ধ করে দিয়েছিলো এবং উপমহাদেশকে খ্রিস্টান রাজ্যে পরিণত করার গভীর ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিলো। গোটা উপমহাদেশেই নেমে এসেছিলো ভয়াল অন্ধকার। অত্যাচারী সেই আগ্রাসীদের মোকাবেলায় কোনো বিপ্লব গড়ে তোলাও ছিলো কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের দখল প্রতিষ্ঠার মাত্র ছয় বছর পর ওদের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে একটি বিপ্লব গড়ে তোলার চেষ্টা চালানো হলে ইংরেজ কমান্ডার মুলারের নির্দেশে চৌদ্দজন বিপ্লবী দেশীয় সৈনিককে কামানের মুখে উড়িয়ে দেয়। তবে বিপ্লবীদের কর্মসূচি চলতে থাকে এবং সময়ের ব্যবধানে তার গতি বাড়তে থাকে। তারপর সুদীর্ঘ ৯৩ বছর পর ১৮৫৭ সালে তা একটি জ্বলন্ত ভিসুবিয়াসের রূপ পরিগ্রহ করে। যা সিপাহীবিপ্লব নামে পরিচিত। কিন্ত নানা কারণে শেষ পর্যন্ত সেই বিপ্লবও ব্যর্থ হলে ইংরেজদের উৎখাত করতে আরও ৯০ বছর লেগে যায়। অবশেষে ১৯৪৭ সালে এই আগ্রাসী শক্তিকে বহু রক্তের বিনিময়ে বিতাড়িত করা হয়। এখানে শুধু সে রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের দিকে ইশারা করে বর্তমান সংকটময় মুহূর্তে আমরা আমাদের জাতিকে একটি বার্তা দিতে চাই। এবং সকলকে আমরা সেই অধ্যায়টির প্রতি একটু মনোযোগী হবার আহ্বান জানাই। এতে সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র সম্পর্কে যেমন একটি ধারণা লাভ করা যাবে তেমনি আমাদের মহান পূর্বসূরিদের সীমাহীন ত্যাগের আয়নায় আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিরূপণ করা সহজ হবে।
ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশেষভাবে উলামায়ে দেওবন্দ-এর বিপ্লবের ভূমিকার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। উলামায়ে দেওবন্দ-এর আন্দোলনের একটি বড় হাতিয়ার ছিলো ফতোয়া। মুসলিম জনজীবনে ফতোয়ার প্রভাব অত্যন্ত গভীর। শাহ আবদুল আযিয মুহাদ্দিসে দেহলবি রহ.-এর একটি বিপ্লবী ফতোয়া সাম্রাজ্যবাদীদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। তার সুযোগ্য শিষ্য মাওলানা ফজলে হক খায়রাবাদি রহ.-ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ ওয়াজিব বলে ফতোয়া প্রচার করেন এবং বিভিন্ন স্থানে অনলবর্ষী বক্তৃতা দিয়ে জাতিকে জাগিয়ে তোলেন। পরে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী তাকে আন্দামান দ্বীপে নির্বাসিত করে। সীমাহীন নির্যাতন ভোগ করে তিনি এক পর্যায়ে সেই দ্বীপেই শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি রহ., হুজ্জাতুল ইসলাম আল্লামা কাসেম নানুতবি রহ., শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি রহ. প্রমুখ মহান ব্যক্তিও ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামে সীমাহীন ত্যাগ শিকার করেন।
আজকে বাংলাদেশে আমাদের পবিত্র ধর্ম ইসলাম ও স্বাধীনতা নাস্তিক্যবাদী শক্তির যে-হামলার মুখে পতিত হয়েছে সেই প্রেক্ষাপটে এই দেশের মুসলমানদের কর্তব্য কী হতে পারে সে সম্পর্কেও বিজ্ঞ আলেম সমাজের সম্মিলিত ফতোয়ার প্রয়োজনীয় বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য আমরা সচেতন মহলের প্রতি আহ্বান জানাই। শাহ আবদুল আযিয মুহাদ্দিসে দেহলবি রহ.-এর বিপ্লবী ফতোয়া প্রমাণ করেছিলো যে ফতোয়া শুধু ইসলাম রক্ষার হাতিয়ার নয়, বরং ফতোয়া দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষারও অত্যন্ত শক্তিশালী হাতিয়ার। আজকের প্রেক্ষাপটে কোনো একক ব্যক্তির ফতোয়ার ফলপ্রসূতার ব্যাপারে সংশয় থাকলেও জাতীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে উলামায়ে কেরামের সম্মিলিত ফতোয়া আগের মতোই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস। অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনগণকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে আরেকটি শক্তিশালী মাধ্যম হলো যুক্তিপূর্ণ ও তথ্যবহুল বক্তৃতা। আদর্শিক জাগরণের পক্ষে ভাষা ও ভাষণের প্রয়োজনীয়তা এতখানি যে মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রেরিত নবী-রসূলগণকেও এর মুখাপেক্ষী করেছেন। বিখ্যাত মুসলিম বীর তারিক বিন যিয়াদের একটি ভাষণ স্পেন জয়ের প্রেক্ষাপট রচনা করেছিলো। যা আজও সাহিত্য ও ইতিহাসে অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। আফগানিস্তানের নরশার্দুল মোল্লা মোহাম্মদ উমরের একটি ভাষণ আফগান জাতিকে আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে নতুনভাবে জগিয়ে তুলেছিলো। ইংরেজ-বিরোধী সংগ্রামেও উলামায়ে দেওবন্দ-এর ভাষণসমূহ এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিলো। সে কারণেই দেখা যায় যে ভোগবাদী শক্তি সর্বদা ভাষা ও ভাষণকে ভয় পায়। অনেক ক্ষেত্রেই তারা ভাষা ও ভাষণ বন্দি বা গৃহবন্দি রাখতে চায় অথবা নির্বাসনে পাঠায়। অতীত ও বর্তমানে এর অনেক নজির রয়েছে। ভাষা ও ভাষণের এই শক্তির কথা বিবেচনায় রেখে আজকের শ্রদ্ধেয় আলেম সমাজকেও এই হাতিয়ারটি দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে। বিশেষত তরুণ আলেম শ্রেণিকে বক্তৃতার শাণিত ও সাবলীল ভাষা এবং কলাকৌশল রপ্ত করতে হবে। বক্তৃতায় অশুদ্ধ বা আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার হলে বক্তৃতা কাক্সিক্ষত পর্যায়ে প্রভাবশালী হতে পারে না। বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখার জন্য আমরা শ্রদ্ধেয় আলেম সমাজের মনোযোগ আকর্ষণ করছি। ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বার বার ব্যর্থতা ও পরাজয় বরণের পরও সামনের পথে এগিয়ে চলা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি, কারণ সংগ্রাম ও বিপ্লব সর্বদা একই মাত্রায় গতিশীল থাকে না। বিপর্যয় ও ব্যর্থতা এ-পথের একটি স্বাভাবিক বাস্তবতা। সফলতার সূর্যোদয়ের জন্য ধৈর্য ও সাহসিকতার সঙ্গে সংগ্রামের সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। এক্ষেত্রে অনেক সময় কয়েক যুগও পার হয়ে যায়। এ-বাস্তবতার আলোকে আমাদের চলমান নাস্তিক্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের সাময়িক বিপর্যয়কে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। একথা তো অস্বীকারের উপায় নেই যে শাপলাচত্বরের বিপর্যয়ের পর আলেমসমাজের নাস্তিক্যবাদবিরোধী সংগ্রাম একটি প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছে এবং সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় লেগে যাচ্ছে। কিন্তু ইতিহাসের আয়নায় বিচার করলে এটা তেমন বড়ো কিছু নয়। কারণ সংগ্রামের পথটাই হচ্ছে চড়াই-উৎরাইয়ের পথ। সুতরাং আলেমসমাজ নাস্তিক্যবাদের বিরুদ্ধে নতুন রূপরেখায় এগিয়ে যাবেন এটাই ইতিহাসের দাবি। উগ্র নাস্তিক্যবাদ এখন শুধু ব্লগ আর মিডিয়ায় সীমাবদ্ধ নয়। বরং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ছত্রছায়ায় যথেষ্ট পরিপুষ্টি লাভ করে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদেও অধিষ্ঠিত। ফলে উগ্র-নাস্তিক্যবাদ রাষ্ট্রশক্তিরও যথেষ্ট প্রশ্রয় পাচ্ছে। নাস্তিক্যবাদ যে নোংরা মূর্তিতে ফণা তুলে দাঁড়িয়েছে এর প্রতিরোধ সফলভাবে করা সম্ভব না হলে এক সময়ে এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করাও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। কারণ উগ্র দাম্ভিক শক্তি নিজেদের দম্ভ ও দাপট রক্ষার জন্য দেশের বহিঃশক্তিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকে। এটা ইতিহাসের এক নির্মম সত্য। উপমহাদেশে একটি বৃহৎ হিন্দু জনগোষ্ঠী এবং নামধারী এক শ্রেণীর মুনাফিক মুসলমান ইংরেজদেরকে যেভাবে সহায়তা করেছিলো তা আমাদের একথার জ্বলন্ত প্রমাণ। দাম্ভিক শক্তি যখন স্বদেশের জনগণকে আর নিজেদেও পক্ষে ব্যবহার করতে সক্ষম হয় না তখনই তারা তাদের সতীর্থ শক্তিকে স্বদেশে আমন্ত্রণ জানায় এবং আধিপত্য বিস্তারে প্ররোচনা দেয়। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন মুসলিম দেশে তার প্রমাণ স্পষ্ট হয়েছে।
প্রিয় পাঠক, আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে এবার একটু ভেবে দেখা যাক। একটু ভেবে দেখলে আমাদের দেশে ইংরেজদের দখল প্রতিষ্ঠার পূর্বপ্রেক্ষাপটের সঙ্গে বর্তমান প্রেক্ষাপটের অনেক মিল পাওয়া যায়। ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমিকায় কাজ করে যাচ্ছে অসংখ্য এনজিও এবং ইংরেজ সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করছে দেশের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষাপ্রাপ্তদের একটি বড় অংশ। দেশে শীর্ষ রাজনৈতিক মেধাগুলো আধিপত্যকামী শক্তির কাছে বিক্রি হয়ে আছে। কঠিনভাবে জাতীয়তাবোধসম্পন্ন দীনি মাদরাসাসমূহের ওপর চলছে নজরদারি। প্রতিবাদী সাহসী কণ্ঠগুলোকে স্তব্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বড় আকারে কোনো শক্তি প্রদর্শনের সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। বিদেশি দখলদারদের মতই শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ঈমানি দাবিসমূহকে পদদলিত করা হচ্ছে। সর্বাত্মকভাবে দেশে একটি আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উত্তরসূরিদের আত্মীয়স্বজনরাও এদেশে সদম্ভে বিচরণশীল। ইংরেজ সভ্যতার অসংখ্য দাস এদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অত্যন্ত প্রভাবশালী। এরা ক্ষমতার প্রয়োজনে জনগণকে পাশ কাটিয়ে যেকোনো নিকৃষ্ট পথে পা বাড়াতেও দ্বিধা করবে না বলে দেশের জাতীয়তাবোধসম্পন্ন মানুষ আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও ঈমানি আবেগকে এরা থোড়াই কেয়ার করে। ইংরেজ সভ্যতায় প্রশিক্ষিত ডিজিটাল দালালরাও মাদরাসা বন্ধ করার হুমকি দিচ্ছেন। কখনো মাদরাসাকে জঙ্গি তৈরির কারখানা বলে অভিহিত করছেন। এই পরিস্থিতিতে আমাদেরকে ইতিহাসের পরীক্ষিত পথে এগোতে হবে। ইসলাম ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারেও গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। যে দেশে মানবতার হৃদয়ের টুকরো হযরত মুহাম্মদ সা.-কে একের পর এক কটূক্তি করেও বেঁচে থাকা যায় এবং শহীদ বলে মর্যাদা লাভ করা যায় (নাউযুবিল্লাহ), যে দেশে রাতের আঁধারে বাতি নিভিয়ে শত শত মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, সে দেশে ইসলাম ও স্বাধীনতা কতটুকু নিরাপদ তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। সম্প্রসারণবাদী কোনো অপশক্তির ইঙ্গিতে স্বজাতির বিরুদ্ধে এহেন নির্মমতা প্রদর্শন করা হচ্ছে কি না তা ভেবে দেখা দরকার এবং দেশে ইসলাম ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য পূর্বাহ্নেই সদূরপ্রসারী সতর্ক পরিকল্পনা নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। মহান আল্লাহ আমাদের সহায়।
নববর্ষের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা
খন্দকার মনসুর আহমদ
আমাদের জীবন থেকে আরও একটি বছর হারিয়ে গেল। আমরা একটি নতুন বছরকে বরণ করলাম। স্বভাবতই আমরা নববর্ষে নতুন স্বপ্ন ও প্রত্যাশা বুকে নিয়ে সামনের পথে এগিয়ে যেতে চাই। সে হিসেবে একটি নববর্ষ আমাদের জীবনে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা দেখছি যে সময় স্রোতের মতো ধাবমান। আমরা একটি নববর্ষকে গ্রহণ করি, আবার দেখতে না দেখতেই বর্ষটি আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যায়। নতুন বর্ষ এসে দুয়ারে করাঘাত করে। অতএব সময়ের এ ধাবমানতার মধ্যেই আমাদেরকে অনন্তের কথা ভাবতে হবে এবং অনন্ত জীবনের পাথেয় সঞ্চয় করতে হবে। নববর্ষে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে যে, পৃথিবী আখেরাতের শস্যক্ষেত। আখেরাতের ফসল ফলাবার জন্যই মহান আল্লাহ আমাদেরকে পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছেন। যেদিন আর পৃথিবীতে আখেরাতের ফসল ফলানো যাবে না, সেদিন পৃথিবীরও আর কোনো মূল্য থাকবে না। সেদিন মহাপ্রলয়ের দিকে এগিয়ে যাবে পৃথিবী। কিছুকাল পূর্বে আমি এ বিষয়ে ছোট্ট একটি কবিতা লিখেছিলাম। প্রিয় পাঠকদের কাছে কবিতাটি তুলে ধরলাম।
বেঁচে থাকতে চাই আরও কিছুকাল
ফলাতে চাই অনন্তে’র আরও কিছু ফসল,
পৃথিবীইতো আখেরাতের শস্যক্ষেত।
এখানে এখনও আখেরাতের ফসল
ফলানো যায় দিন-রাত।
সওয়াবের সবুজ ফসলে ভরে যায় মাঠ।
যেদিন পৃথিবীতে আর ফলবে না সওয়াবের ফসল
সেদিন বিধাতা ধ্বংস করে দিবেন
পৃথিবী নামের এ গ্রহটিকে।
তাই এসো আমরা এ গ্রহে বাস করে প্রতিনিয়ত
আখেরাতের ফসল ফলাই।
আখেরাতের জীবনে অতুলনীয় সুখ-সমৃদ্ধি লাভের জন্য আমাদেরকে বহুবিধ শুভস্বপ্নের পথে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে হবে। শুভস্বপ্ন মহান আল্লাহর বড় প্রিয়। হাদিস শরিফে বিষয়টি এভাবে বলা হয়েছে, ‘মুমিনের নিয়ত তার কর্মের চেয়ে উত্তম’। কর্মের চেয়ে নিয়ত উত্তম হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে কর্মের একটি সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্তু নিয়ত বা স্বপ্নের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। স্বপ্ন হতে পারে অসীম ও অনন্তের। সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়তো পার্থিব জীবনে নাও ঘটতে পারে, কিন্তু অন্তরের সত্যিকার ভালোবাসা ও আকাক্সক্ষার কারণে, মহান আল্লাহ তার প্রতিদান দিয়ে দিবেন। কারণ তিনি অসীম করুণার অধিকারী। তাঁর করুণার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। বান্দা তাঁর করুণার পরিধি কল্পনাও করতে পারে না। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ নিজেকে বলেছেন ‘মহান করুণার আধার’। আরও বলেছেন, ‘আমার রহমত সকল কিছুতে পরিব্যাপ্ত’।
স্বপ্ন সকলেই দেখতে পারেন। তবে কৈশোর ও তারুণ্যই স্বপ্ন দেখার সর্বোত্তম সময়। তাই কিশোর ও তরুণ বন্ধুদেরকে আমি নিরন্তর স্বপ্ন দেখার আহ্বান জানাই। সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভি রহ. তার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন ‘মানুষ শৈশবে যা কিছু চিন্তা করে ঠিক তাই মহান আল্লাহ কোনো না কোনো অবস্থায় তার জীবনে বাস্তবায়িত করে দেন। অতএব যা কিছু চিন্তা করবে, যা কিছু আকাক্সক্ষা করবে, অনেক ভেবে চিন্তে করবে’। আমাদের কাজ হচ্ছে স্বপ্ন দেখা এবং স্বপ্নের পথে অবিরাম হেঁটে চলা। আমরা দেখবো রেজায়ে এলাহি’র স্বপ্ন, আলোকিত জীবনের স্বপ্ন, শুদ্ধি ও সৎকর্মের স্বপ্ন, জীবনের সর্বত্র সুন্নতে নববীর অনুগামী হবার স্বপ্ন, উত্তম আমলের স্বপ্ন, প্রাণবন্ত নামাজের স্বপ্ন, প্রাণবন্ত রোজার স্বপ্ন, জিহাদের স্বপ্ন, বিজ্ঞ আলিম হবার স্বপ্ন, আলোকিত দেশ-জাতি ও সমাজ গড়ার স্বপ্ন, স্বদেশে ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, মিথ্যাকে পরাভূত করার স্বপ্ন, নবীজির অবমাননা প্রতিরোধের স্বপ্ন, পবিত্র কা’বা জিয়ারতের স্বপ্ন, মদিনা শরিফের স্বপ্ন, রওযা শরিফের স্বপ্ন, বাবার হজের স্বপ্ন, মায়ের হজের স্বপ্ন এবং আরও হাজারো স্বপ্ন। হৃদয়ের গহীনে আরও হাজারো স্বপ্নের বীজ রোপিত হতে পারে আমাদের। আর আমরা স্বপ্ন দেখবো না বিত্তবৈভবের এবং স্বার্থান্ধ ক্ষমতার। দেখবো না কোনো অবৈধ প্রেমের বা অন্য কোনো পাপকর্মের স্বপ্ন। এমন কোনো স্বপ্নের মোহ যদি আমাদের অন্তরে আসে, তাহলে আমরা আমাদের হৃদয়কে অবশ্যই সেই মোহ থেকে মুক্ত করবো।
মহান দয়ালু তাঁর করুণায় বান্দার অনেক স্বপ্নই বাস্তবায়িত করে দেন। আমি মহান আল্লাহর এক নগণ্য বান্দা। আমি আমার জীবনে যে সকল স্বপ্ন দেখেছিলাম তার অনেকগুলোই মহান আল্লাহ বাস্তবতার পুষ্পোদ্যানে প্রস্ফুটিত করে দিয়েছেন। তিনি দয়া করে সম্প্রতি আমার যে স্বপ্নটি বাস্তবায়ন করলেন, তা হলো আমার মায়ের হজের স্বপ্ন। আমি দীর্ঘদিন ধরে আমার বুকে এ স্বপ্ন লালন করে আসছিলাম এবং এর জন্য মহান বিধাতার সাহায্য প্রার্থনা করে আসছিলাম। মহান আল্লাহ আমার সেই স্বপ্ন আমার কল্পনার চেয়েও সুন্দর রূপরেখায় বাস্তবায়িত করলেন। সেই বেহেশতি সফরে মায়ের সহযাত্রী বানালেন এ নগণ্যকেই। মাতৃস্নেহের কোমল পরশে এমন পবিত্র সফরের কী যে আনন্দ ও প্রশান্তি তা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। এই নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা আদায় করে কোনোদিনই শেষ করা যাবে না। আমার মনে হয় ঈমানের পরে এটিই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। সুদীর্ঘ বেদনার পর আমার জীবনে যখন এই সৌভাগ্য এলো, তখন তা আমার সমগ্র সত্তাকেই নতুন ভাবে স্পর্শ করলো। আমি আমার জীবনে এক নতুন আলোর সন্ধান পেলাম। পবিত্র কা’বা ও রওজা শরিফের জিয়ারত আমার হৃদয়ে এনেছে নতুন সজীবতা, জীবনে এনেছে নতুন আনন্দ, বুকে এনেছে নতুন স্বপ্ন এবং সত্তায় এনেছে নতুন উদ্যম। প্রত্যাশী সকল মুমিনের জন্যই আমি এই সৌভাগ্য কামনা করি ।
অবশেষে প্রার্থনা করি নববর্ষে আমাদের জীবন কল্যাণের প্রাচুর্যে ভরে উঠুক। শান্তিময় হয়ে উঠুক আমাদের জীবন ও পৃথিবী। মহান আল্লাহর রহমতে পূর্ণ হোক আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। তিনিই সর্বত্র আমাদের সহায়। আমরা তার কাছেই আমাদের সকল স্বপ্নের শুভ পরিণতি কামনা করি ।
মাওলানা লিয়াকত আলী
জুলাই আগস্ট/১৪
মাহে রমজানুল মোবারকের পর মুসলিম মিল্লাতের বার্ষিক প্রধান দুটি আনন্দ উৎসবের একটি হলো ঈদুল ফিতর। ঈদ অর্থ আনন্দ। আর ফিতর বলতে রোজার সমাপ্তি কিংবা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া উদ্দেশ্য।
দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনায় নিয়োজিত থাকার পর তাতে সমাপ্তি ঘটানো ও দিনের বেলায় পানাহারের স্বাভাবিক নিয়মে ফিরে যাওয়া উপলক্ষ্যে আনন্দ উপভোগের ব্যবস্থা দিয়েছে ইসলামি শরিয়ত। এটা শুধু অনুমতি নয়, বরং অনেকটা বাধ্যতামূলক নির্দেশ। কেননা শাওয়ালের প্রথম দিনে রোজা রাখাই নিষিদ্ধ। দুই ঈদের দিনে পানাহার করা ও আল্লাহর নেয়ামতের স্বাদ গ্রহণ করা অবশ্য পালনীয়।
হাদিসের গ্রন্থগুলোয় বর্ণিত আছে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম হিজরত করে মদিনায় এসে দেখলেন এখানকার বাসিন্দারা বছরের দু’টি দিন আনন্দ উৎসবে কাটায়। যদিও এর আগে এখানকার অনেকে মুসলমান হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু প্রথাটি চালু ছিল। যেহেতু এতে পৌত্তলিকতার ছাপ ছিল এজন্য মুসলমানদের তাতে যোগ দেয়ার ব্যাপারে দ্বিধা সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে জানালেন, আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের আরো উন্নত ও উত্তম দু’টি উপলক্ষ্য দান করেছেন আনন্দ উৎসবের জন্য। একটি রমজান মাসের শেষে শাওয়ালের প্রথম তারিখে। আরেকটি জিলহজ মাসের দশম তারিখে বা হজের পরের দিন। দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারার জন্য দু’টি ঈদ নির্ধারিত হয়েছে। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনায় আত্মনিয়োগের মাধ্যমে তাকওয়ার স্তর উন্নত করা এবং তার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার একান্ত সান্নিধ্য ও অসাধারণ অনুগ্রহের উপযোগী হতে পারা নিঃসন্দেহে খুশির বিষয়। তেমনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করে ও শ্রম দিয়ে দীর্ঘ সফরের পর সম্পন্ন হয় হজ। ৯ তারিখ আরাফার ময়দানে অবস্থানের মাধ্যমে হজের সবচেয়ে কঠিন ও কষ্টকর রোকনটি সম্পন্ন হয়, যা আল্লাহতায়ালার মেহেরবাণীতেই সম্ভব হয়। তাই পরের দিন আনন্দ প্রকাশ যুক্তিসঙ্গত। আর যারা হজে যান না, তারা হাজীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করার জন্য তাদের পক্ষে বাড়িতে থেকেও খুশি উদযাপন করেন, যার নাম ঈদুল আজহা।
ঈদ যদিও আনন্দ উদযাপনের নাম, কিন্তু ইসলামি শরিয়তে আনন্দ বিনোদনের রূপরেখা ও মূলনীতি দুই ঈদের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। খুশি প্রকাশের প্রধান উপায় সাব্যস্ত করা হয়েছে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। তা যেমন শারীরিক ইবাদত, তেমনি অর্থ ব্যয়ের সাহায্যও। ঈদুল ফিতরে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতে হয়। পাশাপাশি দিতে হয় সদকাতুল ফিতর। আর ঈদুল আজহার নামাজ আদায়ের পাশাপাশি পশু কুরবানি করতে হয়। দুই ঈদেই অপরিহার্য অনুষঙ্গ রাখা হয়েছে নামাজ। এতে এ বিষয়টি পরিষ্কার করা হয় যে, পৃথিবীতে মানুষের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য মহান স্রষ্টার ইবাদত করা। এখানে তার লাগামহীন আচরণ ও ক্রিয়াকলাপের সুযোগ নেই। আনন্দ বিনোদনের সময়ও তাকে স্মরণ রাখতে হবে মহান প্রভুর প্রতি আনুগত্যের কথা। তাঁর প্রতি নিজেকে সমর্পিত করার চেতনা কখনোই অনুপস্থিত থাকতে পারবে না মুমিনের জীবনে। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠির সাথে মুসলিম উম্মাহর পার্থক্য এখানেই। ইবাদত মিশ্রিত আনন্দই মুসলমানদের বৈশিষ্ট্য। অনিয়ন্ত্রিত আনন্দ উপভোগের কোনো সুযোগ নেই তাদের। এক মাস আগে শরিয়তের নির্দেশ অনুযায়ী পানাহার বর্জনের কঠোর সাধনা শুরু হয়েছিল। তারই পরিসমাপ্তিতে শাওয়ালের চাঁদ দেখা গেলে আল্লাহর মহিমা ঘোষণা, তাঁর উদ্দেশ্যে সদকা দিয়ে অভাবি ও অসহায়দের আনন্দে শরিক করে নেয়া এবং তাকবির পাঠ করতে করতে ঈদগাহে গিয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায়ের মাধ্যমে মুমিন বান্দারা খুশি উদযাপন করবেন। আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদÑ ধ্বনিতে পরিবেশ মুখরিত করতে করতে মুসলমানরা যখন ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে রওনা দেন এবং ঈদের নামাজ আদায়ের পর দোয়া করতে থাকেন, তখন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দয়ার সাগরে ঢেউ ওঠে । তিনি ফেরেশতাদের সামনে এসব মানুষের জন্য খুশি প্রকাশ করেন এবং তাদের অতীত পাপরাশি শুধু ক্ষমা নয় বরং পরিবর্তে সেই পরিমাণে সওয়াব বরাদ্দেরও ঘোষণা দেন। বলার অপেক্ষা রাখে না এই সুসংবাদ ও পুরস্কার তাদের জন্য, যারা পবিত্র রমজান মাসে সিয়াম সাধনায় যতœবান ছিল। পক্ষান্তরে যারা এমাসের কর্তব্য পালনে উদাসীন ছিল, তাদের জন্য কোনো সুসংবাদ নেই। আছে কঠিন শাস্তির হুমকি। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে তাঁর সুসংবাদের অধিকারী করুন। প্রকৃত খুশি ও উভয় জগতের কল্যাণ আমাদের নসিব করুন।
কিন্তু সিয়াম সাধনা শেষ হবে না রমজানের পরেও। বরং রমজানের পর থেকে শুরু হবে আরো দীর্ঘকালীন সিয়াম। বলা যেতে পারে শাওয়ালের প্রথম তারিখ থেকে দিনব্যাপী নয়, সার্বক্ষণিক সিয়াম শুরু হবে।
রমজান মাসে প্রতিদিন সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত জৈবিক চাহিদা পূরণ থেকে নিজেকে সংযত রাখতে হয়। কিন্তু সংযমের নির্দেশ মুমিনের প্রতি সারা জীবনের জন্য। একজন ব্যক্তি যখন কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করে মুসলমান হয়, তখনই তার কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় পানাহারসহ সব ভোগ আস্বাদন নিয়ন্ত্রিত রাখা। এটাই তো ইসলামের বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীতে মানুষের বসবাস যেমন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, তেমনি তার দায়িত্ব নির্ধারিত। কুরআন মজীদে আল্লাহতায়ালা জানিয়ে দিয়েছেনÑ আমি মানুষ ও জিন জাতিকে শুধু আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি। অতএব দুনিয়াতে মানুষের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য আল্লাহর আদেশ ও অভিপ্রায়ের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা। বস্তুত এরই নাম ঈমান ও ইসলাম। যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্যের শপথ করে নিজেদেরকে মুমিন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে, তাদেরকে কিছু নিয়ম কানুন মাথা পেতে নিতে হয়। জীবন নির্বাহের সুনির্দিষ্ট পথ বেয়ে তাকে চলতে হয়। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনে তাকে অনুসরণ করতে হয় শরিয়ত নির্দেশিত নীতিমালা। ভোগ-আস্বাদন-বিনোদনেও তাকে সীমারেখা মেনে চলতে হয়। এভাবে নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখার সাধনা তাকে করে যেতে হয় সব সময়ের জন্য। এ ক্ষেত্রে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্তের মেয়াদ সীমাবদ্ধ নেই। এমনকি পার্থিব জীবনে এ সিয়ামের ইফতারও নেই। যেদিন আহকামুল হাকেমিনের দরবারে হাজির হতে হবে, দুনিয়াবি জীবনের প্রতিটি কথা, কাজ ও আচরণের হিসেব দিতে হবে, সেদিন সেই হিসেব নিকেশে যদি উৎরে যাওয়া যায়, তাহলে রহমাতুল্লিল আলামিন হাউজে কাওছারের শরবত দিয়ে এসব রোজাদারকে ইফতার করাবেন। তারপর তাদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হবে জান্নাতে, যেখানে তাদের উপভোগের জন্য তৈরি রাখা হয়েছে এমন নেয়ামতরাজি, যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শোনেনি, এমনকি কোনো মানুষের কল্পনায়ও আসেনি। সেটাই তো প্রত্যেক মুমিনের কাম্য।
অতএব নিজের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ,কামনা বাসনা ও ঝোঁক প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে রাখা যদি সিয়াম বলে আখ্যায়িত হতে পারে, তাহলে রমজান মাস পার হলেও সেই সিয়ামের হুকুম বহাল থাকবে, থাকতে হবে মুমিনের জীবনে।
নিয়ন্ত্রিত ও নিয়মতান্ত্রিক জীবন নির্বাহ করা ইসলামের অন্যতম মৌলিক শিক্ষা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানাহার, নিছক উদরপূর্তি কিংবা রসনা তৃপ্তির জন্য আহার মুমিনের আদর্শ নয়। মুমিনের প্রতিটি কাজ হতে হবে উদ্দেশ্য ও ফলাফল বিবেচনায় রেখে। পার্থিব স্বার্থ ও সুবিধার চেয়ে আখেরাতের কল্যাণকে প্রধান্য দিতে হবে। মুমিনের আহারের বস্তু যেমন হালাল হওয়া জরুরি, তেমনি তা লাভ করার পদ্ধতিও বৈধ হওয়া অপরিহার্য। আহার গ্রহণের সময় অবলম্বন করতে হবে উন্নত শিষ্টাচার। একজন মুসলমানের জীবনে কোনো অহেতুক আচরণ হওয়া উচিত নয়। হজরত আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ইসলাম গ্রহণের ফলে একজন ব্যক্তির জীবনে অন্যতম সৌন্দর্য আসে এই যে, সে অহেতুক কাজ পরিহার করে।
মোটকথা, অপরিহার্যতা থেকে নান্দনিকতা পর্যন্ত সব ক্ষেত্র ও পর্যায়ের জন্য ইসলামের শিক্ষা ও নির্দেশনা রয়েছে। রমজানের তিরিশ বা উনত্রিশ দিনের পর পানাহার ও কামাচার নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ রহিত হবে না। সব ক্ষেত্রেই তাকে আল্লাহর নির্দেশ ও রাসুলুল্লাহর নির্দেশনা মেনে চলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সেই দীর্ঘ অনন্ত সিয়ামের জন্য প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকারই রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাসের শেষভাগে মুমিন বান্দাদের একান্ত কর্তব্য।
সিয়াম সাধনার মাস বিদায় নেয়ার পর আমাদের জীবনে স্বাভাবিকতা আসার পরেও যদি রমজানের বিশেষ নেক আমলগুলো চালু রাখা যায়, তাহলেই রমজানের সিয়াম সাধনা সার্থক হবে। প্রথমেই আসে রোজার কথা। রমজানের বাইরে রোজা রাখা ফরজ নয়। কিন্তু নফল রোজার জন্য কোনো মাস বা দিনের সীমাবদ্ধতা নেই। বছরের পাঁচটি দিন ছাড়া সব দিন রোজা রাখা যাবে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম রোজা না রেখে কোনো মাস যেতে দিতেন না বলে সাহাবায়ে কেরাম বর্ণনা করেছেন। তিনি প্রত্যেক মাসে কমপক্ষে তিনটি রোজা রাখতেন বলে জানা যায়। অবশ্য এই দিনগুলো তিনি নির্দিষ্ট করতেন না। কখনো মাসের শুরুতে, কখনো মাঝখানে, কখনো শেষভাগে, কখনো একসাথে, আবার কখনো বিচ্ছিন্নভাবে তিনটি রোজা রাখতেন।
এরপর নফল নামাজের প্রসঙ্গ আসে। রমজানে দীর্ঘক্ষণ ধরে তারাবিহ নামাজ আদায় করা হয়। রমজানের বাইরে এ নামাজ নেই। কিন্তু তাহাজ্জুদ আছে সারা বছরের জন্য। এ নামাজের মাহাত্ম্য ও পুরস্কার আনেক বেশি। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এত দীর্ঘক্ষণ তাহাজ্জুদ আদায় করতেন যে, তার দুই পা ফুলে যেত। তাকে এ নামাজ আদায়ে বিশেষ আদেশ করা হয়েছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে। নবুওয়াত লাভের প্রথম দিনগুলোতেই নাজিল হয়েছিল সুরা মুযযাম্মিল। তাতে রাত জেগে ইবাদত করার জন্য তার প্রতি বিশেষ আদেশ করা হয়েছে। তাই যখন দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হয়নি তখনো তিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার পরেও তাতে শৈথিল্য করেননি। এ জন্য সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে কোনো পর্যায়েই মুসলিম মনীষীরা তাহাজ্জুদ আদায়ে আলসেমি করেননি। এমনকি অনেক মুসলিম শাসকের জীবনে অন্য অনেক গুণের সাথে তাহাজ্জুদ আদায়ের নিয়মিত অভ্যাস ছিল।
রমজানের আরেকটি কাজ কুরআন মজিদ তেলাওয়াত ও অধ্যয়ন। এটাও রমজানের সাথে নির্দিষ্ট নয়। কিন্তু রমজান মাসে নাজিল হওয়ার কারণে এ মাসের সাথে কুরআন মজিদের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। তাই রমজান মাসে অন্য সময়ের তুলনায় বেশি কুরআন মজিদ তেলাওয়াত ও চর্চার ওপর জোর দেয়া হয়। রমজানের বাইরেও এ অভ্যাস ও নিয়ম চালু রাখা উচিত। আল্লাহর কালামের সাথে সম্পর্ক যতই ঘনিষ্ঠ হবে, আল্লাহর বিশেষ রহমতের ততই আশা করা যাবে। রমজানে এ কিতাবের প্রতি যে মনোযোগ বাড়ে, সেটাকে আল্লাহর রহমত হিসেবেই গণ্য করা উচিত এবং তা ধরে রাখা প্রয়োজন। কুরআন তেলাওয়াত, অধ্যয়ন ও গবেষণায় মুসলমানদের আরো আগ্রহী হওয়া প্রয়োজন।
তাসবিহ তাহলিল ও ইস্তেগফার মুমিনের প্রাত্যহিক কর্তব্য। রমজানে তা বেড়ে যাওয়া খুবই শুভ আলামত। কিন্তু তা রমজান পর্যন্ত সীমিত রাখা উচিত নয়।
রমজানে মুমিন বান্দাদের মধ্যে দান খয়রাতের আগ্রহ বেড়ে যায়। এটাও আল্লাহর অনুগ্রহ। সম্পদের মালিক আল্লাহ। বান্দা নিছক আমানতদার। আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী সম্পদ ব্যয় করা মুমিনের কর্তব্য। ধনীর সম্পদে অভাবী ও বঞ্চিতদের প্রাপ্য রয়েছে বলে ঘোষণা করা হয়েছে কুরআন মজিদে। রমজানে মুমিন বান্দারা আল্লাহর এ বিশেষ হুকুমটি পালনে আরো আগ্রহী হয় অন্য মাসের তুলনায় আনেক বেশি ছওয়াব লাভের আশায়। এ কারণেই রমজান মাসে জাকাত আদায়ের রেওয়াজ চালু হয়েছে। তাছাড়া সদকাতুল ফিতর এ মাসের সাথে জড়িত। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের কাছে কখনো সম্পদ জমা থাকত না। এজন্য তার ওপর কখনো জাকাত ফরজ হয়নি। সদকাতুল ফিতর ওয়জিব হওয়ার মতো সম্পদও তার কাছে থাকেনি। কিন্তু তিনি সবসময় দানের হাত সম্প্রসারিত রাখতেন। আর রমজান এলে তার দানের মাত্রা অত্যন্ত বেড়ে যেত বলে সাহাবায়ে কেরাম বর্ণনা করেছেন। অতএব রমজান শেষ হলেও এসব ইবাদত অব্যাহত রাখা উচিত। আমাদের জীবনে সারা বছর যদি রমজানের শিক্ষা ধরে রাখতে পারি তাহলেই আমাদের জীবন সার্থক হবে।
০০০০০০০০০০০০০০০
মহিমান্বিত রাত শবেকদর
মাওলানা শিব্বীর আহমদ
মানব-ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম মানুষের নিকট শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থটি অবতীর্ণ হওয়ার বরকতময় সময়টি অন্যান্য সময়ের তুলনায় মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ হবে এটাই স্বাভাবিক। হ্যাঁ, কুরআনে কারিমের কথাই বলছি। পৃথিবীর ইতিহাসে এ এক অদ্বিতীয় গ্রন্থ, যা সম্পূর্ণ নির্ভুল এবং হাজার বছরের পরিক্রমায়ও তা সম্পূর্ণ অবিকৃত। যখন এ গ্রন্থের অবতারণ শুরু হয়, তখন থেকে অনেকেই তা আল্লাহর কালাম হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে! তাদেরকে কুরআনে কারিম চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে বিভিন্ন ভাষায়। ‘যদি বিশ্বাস না করো তাহলে এর মতো একটি আয়াত বানিয়ে নিয়ে এসো’। কোথাও বলা হয়েছে- ‘একটি সুরা রচনা করে নিয়ে এসো।’ সেই চ্যালেঞ্জ তারা গ্রহণ করার সাহসও দেখিয়েছে। কিন্তু নিজেরাই নিজেদের ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি দিয়েছে। এই হচ্ছে আমাদের গর্বের ধন মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। এ পবিত্র গ্রন্থটি অবতীর্ণ হওয়ার অনন্য বৈশিষ্ট্য বুকে ধারণ করে আছে এই শবেকদর।
ইমাম বায়হাকি রহ. তাঁর সুবিখ্যাত হাদিসগ্রন্থ ‘শুআবুল ঈমান’-এ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি ভাষণ সংকলন করেছেন। একবার পবিত্র রমজান মাস শুরুর আগের দিন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই ভাষণ প্রদান করেন। রমজান মাসের ফজিলত ও গুরুত্ব তিনি সবিস্তারে সেখানে তুলে ধরেন। ভাষণের শুরুটা ছিল এমন- ‘এক মহান ও বরকতময় মাস তোমাদের সামনে আসন্ন। এ মাসে একটি রাত এমন রয়েছে, যা হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।’
বছরের বার মাসের মধ্যে রমজান মাস অনন্য মর্যাদায় ভাস্বর। সে মাসটি আগমনের পূর্বমুহূর্তে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সাহাবায়ে কেরামকে সতর্ক ও অবহিত করছেন এর ফজিলত ও মর্যাদা সম্পর্কে, তখন প্রথমেই বলছেন শবেকদরের কথা। রাতটিকে তিনি বলেছেন হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। হুবহু একই ভাষ্য পবিত্র কুরআনেও রয়েছে। এই রাতটি এমনই এক রাত, যে রাত নিয়ে কুরআনে কারিমে একটি স্বতন্ত্র সুরা নাজিল হয়েছে। পুরো সুরাটিতে এ রাতের মাহাত্ম্য ও ফজিলতের কথাই বলা হয়েছে। শবেকদরের ফজিলত বোঝার জন্যে এই একটি বিষয়ই যথেষ্ট।
পবিত্র কুরআনের উপস্থাপন দেখুন, ‘আমি এ কুরআন অবতীর্ণ করেছি লায়লাতুল কদরে। আপনি কি জানেন, লায়লাতুল কদর কী? লায়লাতুল কদর হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।’ [সুরা কদর, আয়াত : ১-৩] যেন শবেকদরের প্রথম পরিচয়ই হচ্ছে, তা হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।
ইমাম মালিক রহ. তাঁর সংকলিত হাদিসগ্রন্থ ‘মুআত্তা’য় বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একবার পূর্ববর্তী উম্মতের বয়সের বিষয়টি অবহিত করা হলো। তাঁর উম্মতের বয়স তখন তাঁর কাছে খুব কম মনে হলো। অন্যরা দীর্ঘ জীবন লাভ করার কারণে যে নেকি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, তারা তো তা পারবে না। এ পরিপ্রেক্ষিতেই আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এ লায়লাতুল কদর দান করেন, যা হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এ হাদিস থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, এ মর্যাদাপূর্ণ রাতটি এ উম্মতের জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এক বিশেষ উপহার। এমন হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কোনো রাত পূর্ববর্তী কোনো উম্মতেরই ছিল না।
একটি রাত হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। বিষয়টি অবশ্যই বিশ্লেষণসাপেক্ষ। এক হাজার মাসে প্রায় ত্রিশ হাজার রাত। বছরের হিসেবে তা তিরাশি বছর চার মাস। হযরত মাওলানা মনযূর নুমানী রহ. এ শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে- আল্লাহ তায়ালার যে বান্দারা তাঁর সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলে এবং তাঁর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য প্রত্যাশা করে, তারা এই এক রাতে এতদূর এগিয়ে যেতে পারে, যা অন্য হাজার হাজার রাতেও সম্ভব নয়। এই পার্থিব জগতেও আমরা দেখি, দ্রুতগামী উড়োজাহাজ কিংবা রকেটের মাধ্যমে একদিন বা একঘণ্টায় যতদূর অতিক্রম করা যায়, প্রাচীনকালে কয়েক বছরেও ততটুকু দূরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব হতো না। একইভাবে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্যের অন্বেষায় থাকে, তারা এ শবেকদরে দ্রুততার সাথে এত অধিক পথ পাড়ি দেয়, যা তাদের পক্ষে অন্য অনেক মাসেও অতিক্রম করা সম্ভব নয়। আল্লামা শাব্বীর আহমদ উসমানী রহ. বলেছেন, ‘এ রাত যে ইবাদতে কাটায় সে যেন এক হাজার মাস ইবাদতে কাটাল, বরং তার চেয়েও বেশি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস-২০১৭)
আরবি ভাষায় সাধারণত এক হাজারই সর্বোচ্চ সংখ্যানির্দেশক শব্দ। আরবিতে বলা হয় ‘আলফ্’। এক লক্ষ বলতে হলে আরবিতে ‘মিআতু আলফ’ বা একশ হাজার বলে বোঝানো হয়। এজন্যে কোনো কোনো মুফাসসির এক হাজার মাসকে বাস্তবিক অর্থের পরিবর্তে রূপক অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের মতে, এখানে এক হাজার মাস নয়, বরং হাজার হাজার মাস তথা মহাকাল উদ্দেশ্য। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। বলা হচ্ছে- শবেকদর হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। হাজার মাসের মূল অর্থ হোক কিংবা রূপক অর্থ হোক, এ রাতটি হাজার মাসের তুলনায় কতগুণ শ্রেষ্ঠ তা কিন্তু এ আয়াতে বলা হয়নি। দ্বিগুণ, চারগুণ, দশগুণ, একশগুণ, সবকিছুই তো হতে পারে।
আরবিতে ‘কদর’ শব্দটি মর্যাদা ও সম্মান অর্থে ব্যবহৃত হয়। আবার ‘ভাগ্য’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। সে হিসেবে শবেকদর অর্থ মর্যাদার রাত কিংবা ভাগ্যের রাত। রাতটি যেহেতু অতুলনীয় মর্যাদার অধিকারী, সেই অর্থেই ‘মর্যাদার রাত শবেকদর’। কেউ কেউ এমনও বলেছেন, এ রাতে ইবাদত ও তওবা-ইস্তেগফারের মাধ্যমে যে কোনো সাধারণ বান্দা মহান প্রভুর দরবারে প্রভূত মর্যাদার অধিকারী হতে পারে। তাই এ রাতটি মর্যাদার রাত। আর যারা একে ‘ভাগ্যরজনী’ বলেছেন তাদের ব্যাখ্যা হচ্ছে, পরবর্তী এক বছরে যা কিছু আল্লাহ তায়ালা পুরো সৃষ্টিজগতের জন্যে নির্ধারিত করে রেখেছেন, তা ফেরেশতাদেরকে এ রাতে বুঝিয়ে দেন। সেই অর্থেই রাতটি ভাগ্যের রাত।
শবেকদরে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার এক অর্থ আমরা শুরুতেই বলে এসেছি। এ রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর কুরআন অবতরণের বরকতময় ধারা শুরু হয়। তবে কেউ কেউ বলেছেন, এ রাতে কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার অর্থ হচ্ছে, পুরো কুরআন একসাথে এ রাতে লাওহে মাহফুজ থেকে প্রথম আকাশে অবতীর্ণ হয়। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে পুরো কুরআন সুদীর্ঘ তেইশ বছরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর অবতীর্ণ হয়।
এত মর্যাদা ও ফজিলতের রাতটি অবশ্য পুরোপুরি নির্দিষ্ট নয়। কুরআনে কারিমের ভাষ্য থেকে এতটুকু বোঝা যায়, শবেকদর রমজানের কোনো এক রাতেই হবে। সুরা বাকারায় বলা হয়েছে, ‘রমজান মাসে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে।’ আবার সুরা কদরে বলা হয়েছে, ‘আমি তা শবে কদরে অবতীর্ণ করেছি।’ কিন্তু রমজান মাসের কোন রাতটি শবেকদর তা আর নির্দিষ্ট করা হয়নি। হাদিস শরিফে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে শবেকদর তালাশ করো (মুসলিম, হাদিস- ১৫২৩)। এ হাদিস অনুযায়ী ২১, ২৩, ২৫, ২৭, ২৯ রমজানের এ পাঁচ রাতের যে কোনো এক রাতে শবেকদর হতে পারে। আরেক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত উবাদা ইবনে সামেত রা. বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন শবেকদরের খবর দেয়ার জন্যে (তা কোন দিন হবে) বের হয়ে এলেন। কিন্তু তখন দুজন মুসলমান ঝগড়া-কলহে লিপ্ত হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, আমি তোমাদেরকে শবেকদরের খবর দেয়ার জন্যে বের হয়েছিলাম। কিন্তু অমুক অমুক তখন ঝগড়া করছিল। ফলে তা তুলে নেওয়া হয়। হয়তো তা-ই তোমাদের জন্যে কল্যাণকর হবে। এখন তোমরা নবম, সপ্তম ও পঞ্চম (২৯, ২৭ ও ২৫ তারিখের) রাতে তা তালাশ করো। তবে ব্যাপকভাবে রমজানের ২৬ তারিখ দিবাগত রাত (২৭ রমজানের রাত) টিকেই শবেকদর হিসেবে পালন করা হয়। হাদিসের কিতাবে শবেকদর হিসেবে এ রাতটির কথা বিশেষভাবে আলোচিতও হয়েছে। যেমন, বুখারি শরিফেরই বর্ণনা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুয়াজ্জিন হযরত বিলাল রা. শুনেছেন, শবেকদর ২৭ রমজানের রাতে। হাদিসের এ ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যের কারণে হাদিসবিশারদ উলামায়ে কেরাম বলেছেন, রমজানের শেষ দশকের প্রতিটি বেজোড় রাতেই শবেকদর তালাশ করা উচিত।
আহলে দিল বুজুর্গগণ অনেক সময় বুঝতে পারেন কোন রাতটি শবেকদর। এটা অবশ্য সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। কেউ কেউ শবেকদরের বিভিন্ন আলামতের কথাও বলেছেন। যেমন, রাত প্রস্ফুটিত উজ্জ্বল পরিচ্ছন্ন হবে। নিঝুম-নিথর হবে, অতি গরমও হবে না, অতি ঠাণ্ডাও হবে না। রাত শেষে সকালে সতেজ আলো ছাড়া সূর্য উদিত হবে, ইত্যাদি। তবে এসব আলামত প্রকাশিত হওয়া শবেকদরের কোনো অপরিহার্য বিষয় নয়। তাই যদি এসব কোনো আলামত প্রকাশ না-ও পায়, তবু আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রত্যাশী যারা, তারা যেন শেষ দশকের প্রতিটি বেজোড় রাতই ইবাদত-বন্দেগিতে কাটায়।
যে একটি রাতের ইবাদত একজন বান্দাকে হাজার মাসের দূরত্ব এগিয়ে দিতে পারে, সে রাতের ইবাদতের গুরুত্ব ও ফজিলত তো ভিন্নভাবে বলার অপেক্ষা রাখে না। তা সত্ত্বেও হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের আশায় শবেকদরের রাতে নামাজে দণ্ডায়মান থাকে, তার সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়।’
পক্ষান্তরে এত এত ফজিলত ও মর্যাদা সত্ত্বেও যদি কেউ এ রাতটি গাফিলতির সাথে কাটিয়ে দেয়, তাহলে তার চেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত আর কে হতে পারে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্টই বলেছেন, ‘এই রাত থেকে যে মাহরুম ও বঞ্চিত হলো, সে অবশ্যই সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো। আর প্রকৃত মাহরুম ও বঞ্চিত যারা, তারাই কেবল এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত থাকতে পারে।’
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমি যদি জানতে পারি এই রাতটি শবেকদর, তাহলে আমি কোন দোয়াটি পড়ব?’ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তখন দোয়া শিখিয়ে দিলেনÑ হে আল্লাহ! তুমি তো ক্ষমাশীল, সম্মানিত, ক্ষমা করে দেয়াকে তুমি খুবই পছন্দ কর, তাই তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও।
বলাবাহুল্য, দোয়াটি অতি ব্যাপক অর্থবোধক। আল্লাহ তায়ালা যদি নিজ দয়া ও অনুগ্রহে কোনো বান্দাকে ক্ষমা করে দিয়ে পরকালের হিসাব-নিকাশ ও জবাবদিহি থেকে রেহাই দেন, তাহলে আখেরাতে বিশ্বাসী বান্দার জন্যে এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে!
যে কোনো নফল ইবাদত, বিশেষত নামাজ, তেলাওয়াত, তওবা-ইস্তেগফার ইত্যাদির মাধ্যমে এ রাতটি কাটানো যেতে পারে। এ রাতের কোনো বিশেষ পদ্ধতির নামাজ নেই। বিশেষ বিশেষ সুরা মিলিয়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক রাকাত নামাজের কথারও কোনো ভিত্তি নেই। যার যত রাকাত ইচ্ছা, যে কোনো সুরা দিয়ে ইচ্ছা নামাজ পড়তে পারে। যতক্ষণ ইচ্ছা, যখন ইচ্ছা, যে কোনো নফল ইবাদত করতে পারে। শবেকদরের পুরো রাতটিতেই কল্যাণ বিস্তৃত। কুরআনে কারিমে তাই বলা হয়েছে, ‘তা (এর কল্যাণ ও বরকত) ফজর উদিত হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।’ [সুরা কদর, আয়াত : ৫]
তবে নফল ইবাদত যেন ফরজ ইবাদতে ব্যাঘাত না ঘটায়। এমন যেন না হয়, সারা রাত নফল ইবাদত করে কেউ ফজরের জামাতে উপস্থিত হতে পারল না। মুসলিম শরিফের হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ইশার নামাজ জামাতের সাথে আদায় করল, সে যেন অর্ধেক রাত নফল নামাজ পড়ল, আর যে ফজরের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করল, সে যেন পুরো রাতই নফল নামাজ পড়ল।’ তাই শবেকদরে যে এ দুটি নামাজ জামাতের সাথে আদায় করবে, সে পুরো রাত নফল নামাজ পড়ার সওয়াব পেয়ে যাবে। এর অতিরিক্ত যতটুকু ইবাদত-বন্দেগি করবে, ততটুকু অতিরিক্ত সওয়াবও সে পাবে।
শবেবরাতের ব্যাপারে ইসলাম কী বলে?
জুন'১৪ কামরুল হাসান রাহমানী
ইসলামের বহুল আলোচিত বিষয়ের একটি শবেবরাত। একদল মানুষ মনে করেন- ফজিলতপূর্ণ দিন ও রাতগুলোর মধ্যে অন্যতম শবেবরাত। এবং তারা এ রাতের নানাবিধ ফজিলত ও পরের দিন রোজা পালনের উৎসাহব্যঞ্জক নানা দলিল-প্রমাণ পেশ করতে প্রয়াস পান। আরেকদল লোকের মতে শবেবরাত সম্পর্কে যে সকল দলিল-দস্তাবেজ পেশ করা হয় তার সিংহভাগই শবেকদরের সাথে সংশ্লিষ্ট। এগুলোকে জোর করে শবেবরাতের সঙ্গে যুক্ত করা দ্বীনকে বিকৃত করার শামিল। আর অন্যান্য দলিলগুলোর কিছু তো খুবই দুর্বল, আর বাকিগুলো দ্বারা সর্বো"চ একটি সময়ের ফজিলত প্রমাণিত হয়। কিন্তু ফজিলত প্রমাণিত হওয়ার দ্বারাই সে সময়ে বিভিন্ন আমলে লিপ্ত হওয়ার কোনো
সুযোগ নেই, যদি না শরিয়ত প্রবক্তার পক্ষ থেকে আমলের জন্য স্পষ্ট বক্তব্য না থাকে। শবেবরাতের ক্ষেত্রে আমলের ব্যাপারে কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। তাই এ রাতে বিভিন্ন আমলে লিপ্ত হওয়া বিদআতের শামিল। এমন প্রেক্ষাপটে দুই পক্ষের দলিল-প্রমাণ সামনে রেখে কিছু আলোচনা সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রথমপক্ষ যে সকল দলিল-প্রমাণ পেশ করে থাকেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, হযরত মুয়াজ বিন জাবাল রাযি. এর বর্ণনা। তিনি বলেন, রাসুল সা. বলেছেন- ‘আল্লাহ পাক মধ্য শাবানের রাতে তার বান্দাদের দিকে মনোনিবেশ করেন এবং মুশরিক ও পরস্পর বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতিত সকলকে ক্ষমা করে দেন।’
হযরত আবুবকর সিদ্দিক রাযি. বর্ণনা করেন, রাসুল সা. ইরশাদ করেছেন- ‘মধ্য শাবানের রাতে আল্লাহ পাক প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং পরশ্রীকাতর ও মুশরিক ব্যতিত সকলকে ক্ষমা করে দেন।’
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযি. হতে বর্ণিত নবীজি সা. বলেছেন ১৫ শাবানের রাতে আল্লাহ পাক পরশ্রীকাতর ও অন্যায়ভাবে হত্যাকারী ছাড়া সকলকে ক্ষমা করে দেন।
হযরত আতা ইবনে ইয়াসার রাযি. থেকে বর্ণিত- ‘শবেকদরের পর শাবানের ১৫ তম রাত্রের চেয়ে উত্তম কোনো রাত নেই। এ রাতে আল্লাহ পাক প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং মুশরিক, হিংসুক ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী ছাড়া সকলকে ক্ষমা করে দেন।’
হযরত আয়েশা রাযি. থেবে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘এক রাতে
আমি নবীজি কে (শয্যাপাশে) না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম। জান্নাতুল বাকিতে তাকে খুঁজে পেলাম। নবীজি সা. আমাকে দেখে বললেন, ‘তুমি কি এই আশঙ্কা করছো যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তোমার ওপর
জুলুম করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর নবী! আমি ভেবেছিলাম আপনি অন্য কোনো স্ত্রীর গৃহে গমন করেছেন। নবীজি সা. বললেন ১৫ শাবানের রাতে আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং বনু কালব গোত্রের ছাগল পালের পশম পরিমাণ বান্দাদের ক্ষমা করে দেন।’’
উল্লিখিত সবগুলো হাদিসই সনদের দিক দিয়ে আমলযোগ্য। এগুলো ছাড়াও কাছাকাছি বিষয়বস্তুর আরও অনেকগুলো হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যার কোনো কোনোটার সনদ মজবুত আবার কোনো কোনোটার সনদ দুর্বল।
যে সকল আলেমগণ শবেবরাত পালনের বিপক্ষে- তাদের বক্তব্য হলো, শেষোক্ত হাদিসটি ছাড়া বাকি হাদিসগুলোর সনদ গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের। কিন্তু এসব হাদিসের কোথাও কোনো আমলের কথা বলা হয়নি বা কোনো আমলের জন্য উৎসাহ প্রদানও করা হয়নি। এসব হাদিস দ্বারা সবো"র্চ কোনো স্থান বা সময়ের ফজিলত প্রমাণিত হয়। আর কোনো স্থানের ফজিলত প্রমাণিত হওয়ার অর্থ এই নয় যে- সে সময়ের মধ্যে নিজেদের পক্ষ থেকে কোনো আমল চালু করে দেয়া হবে। বরং আমলের জন্য অবশ্যই শরিয়তের পক্ষ থেকে অনুমোদন থাকতে হবে। উদারহণস্বরূপ বলা যেতে পারে, জুমার দিন সম্পর্কে হাদিস শরিফে এসেছে- ‘জুমার দিনের কোনো একটি সময় এমন রয়েছে, যখন বান্দা আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে আল্লাহ তাকে ফিরিয়ে দেন না। তোমরা সেই সময়টাকে আসরের পরের অংশে অন্বেষণ কর।’ এই হাদিস দ্বারা জুমার দিনের আসরের পরের সময়ের বিশেষ ফজিলত প্রমাণিত হয়। কিন্তু নবীজি সা. এর পক্ষ থেকে এ সময়ে কোনো আমল বর্ণিত হয়নি। তাই কেউ যদি এসময়ে বিশেষ কোনো আমলের প্রচলন ঘটায় এবং লোকদেরকে সে আমলের দিকে আহ্বান করে তাহলে তা বিদআত বলে গণ্য হবে।
এমনিভাবে সোমবার ও বৃহস্পতিবারের ফজিলতের ব্যাপারেও হাদিস রয়েছে- হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে
বর্ণিত, রাসুল সা. বলেন’ ‘সোম ও বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়। শিরককারী ব্যতিত সকলকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। আর ওই দুই ব্যক্তি যারা পরস্পর দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত,
তাদের ব্যাপারে বলা হয়- তাদেরকে সময় দাও যাতে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে মিলে যায়। তাদেরকে সময় দাও যাতে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে মিলে যায়। তাদেরকে সময় দাও যাতে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে মিলে যায়।’ এ হাদিস দ্বারা সোমবার ও বৃহস্পতিবারের ফজিলত প্রমাণিত হয়। এ জাতীয় আরও হাদিস রয়েছে। যেমন- সোমবার ও বৃহস্পতিবার আল্লাহর দরবারে আমলনামা পেশ করা হয়। এখন এ সকল হাদিসের আলোকে কেউ যদি নিজের পক্ষ থেকে এ দিনে কোনো আমলের প্রচলন ঘটায়- তাহলে তা কি জায়েয হবে? এটা কি বিদআতের অন্তর্ভুক্ত হবে না? তাই এ সকল দিনে কোনো আমল করতে চাইলে অবশ্যই তা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে।
তদ্রুপ উল্লিখিত হাদিসগুলো দ্বারাও শবেবরাতের ফজিলত প্রমাণিত হয়। কিন্তু নবীজি সা. কোনো আমলের জন্য বলেছেন তা প্রমাণিত হয় না। অথচ রমজানের শেষ দশকের রাতগুলোতে নবীজি সা. পরিবারস্থ সকলকে রাত্রের ঘুম থেকে ইবাদতের জন্য জাগিয়ে দিতেন। আর শেষোক্ত হাদিসের ব্যাপারে ইমাম তিরমিজি রহ. বলেন, আয়েশা রাযি.র এই হাদিস আমি হাজ্জাজের বর্ণিত সনদ ছাড়া অন্য
কোনোভাবে চিনি না। আমি মুহাম্মদকে (ইমাম বুখারি) বলতে শুনেছি তিনি হাদিসটিকে দুবর্ল বলতেন। (ইমাম তিরমিজি) বলেন, ইয়াহইয়া ইবনে কাসির উরওয়াহ থেকে হাদিস শুনেন নি এবং মুহাম্মদ (ইমাম বুখারি) বলেছেন, হাজ্জাজ ইয়াহইয়া ইবনে কাসির থেকে শুনেননি। এ হাদিস সম্পর্কে ইমাম বুখারি ও ইমাম তিরমিজির মন্তব্য দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হাদিসটি দুই দিক থেকেই মুনকাতি অর্থাৎ সূত্র থেকে বি"িছন্ন। পাশাপাশি এ হাদিসের একজন রাবি হাজ্জাজ ইবনে আরতাহ ; তিনি মুহাদ্দিসিনের নিকট দুর্বল বলে পরিচিত। শবে-বরাতের ফজিলত সম্পর্কে বহুল উ"চারিত এই হাদিসের ব্যাপারে বর্ণনাকারী ইমামদের মন্তব্য আমলে নিলে এই হাদিস দ্বারা আর দলিল দেয়া চলে না। আর যদি হাদিসটি সহিহও ধরে নেয়া হয়
তাহলেও বর্তমান যেভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে সকল মানুষ জমা করে শবেবরাত উদযাপন করা হয় তার বৈধতা পাওয়া যাবে না।
সাহাবায়ে কেরামের যুগে বিশেষ গুরুত্বের সাথে শবেবরাত পালনের কোনো বর্ণনা বা নজির পাওয়া যায় না। তাবে তাবেয়ীদের যুগে সিরিয়ার খালিদ ইবনে মাদান, মাকহুল, লুকমান ইবনে আমের প্রমুখ আলেমগণ এ রাতকে মর্যাদার সঙ্গে পালন করতেন। এ রাতে তারা অধিকহারে ইবাদত-বন্দেগি করতেন। অন্যরাও যখন তাদেরকে অনুসরণ করতে আরম্ভ করলো তখন ইখতেলাফ দেখা দিল। মৌলিকভাবে বসরা অঞ্চলের আলেম ও আবেদগণ এ রাতকে গুরুত্বের সাথে পালন করতেন। কিন্তু মক্কা-মদিনার সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমগণ এভাবে শবেবরাত পালনকে বিদআত সাব্যস্ত করে তা প্রত্যাখ্যান করেন। সিরিয়ার আলেমগণ শবেবরাত পালনকে কেন্দ্র করে দুই ভাগ হয়ে পড়েন। পালনকারীদের দলে খালিদ ইবনে মাদান, মাকহুল, লুকমান ইবনে আমের, ইসহাক ইবনে রাহওয়াইহি প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ছিলেন। পক্ষান্তরে তাবেয়িদের একটি বিরাট দল বলেন, এ ধরনের আমল যেমন নবীজি সা. এর
যুগে ছিল না, তদ্রুপ ছিল না সাহাবিদের যুগেও। এ রাতে ইবাদত-বন্দেগি সওয়াবের কাজ হলে নবীজি সা. উম্মতকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত ও সতর্ক করতে কার্পণ্য করতেন না।
যেমন তিনি কার্পণ্য করেননি শবেকদর ও রমজানের শেষ দশকের ইবাদতের ব্যাপারে। আর নবীজির দিক-নির্দেশনা থাকলে সাহাবায়ে কেরামও তা ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রসার করে উম্মতের কাছে নবীজির হাদিস ও আমলসমূহ পৌঁছে দিতেন। কারণ নবীজির সা. থেকে জেনেছেন আর সেগুলো গোপন করেছেন এমনটি তাদের ব্যাপারে কল্পনাও করা যায় না।
কোনো একটা আমল বিদআত হওয়ার একটা বড় আলামত হলো, সে ব্যাপারে উম্মতের এখতেলাফে লিপ্ত হয়ে পড়া। যদি এ আমল সুন্নাহসম্মত হতো- তাহলে উম্মত পালন করুক আর নাই করুক কমপক্ষে সুন্নাত হওয়ার ব্যাপারে মতানৈক্য সৃষ্টি হতো না। এ মতের স্বপক্ষের লোকেরা আরো দাবি করেন যে, শবেবরাতের ফজিলত প্রমাণ করতে গিয়ে অনেকে তো কোরআনের মনগড়া তাফসির পর্যন্ত শুরু করেন। তারা সুরা-দুখানের শুরুর আয়াতগুলো তেলাওয়াত করে থাকেন। যেখানে বলা হয়েছে, ‘হা-মিম, শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। আমি এ কিতাব এক বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি। আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়।’ অথচ এই বরকতপূর্ণ রাত দ্বারা শবেকদর উদ্দেশ্য হওয়াটা উম্মতের সর্বসম্মত মত। এ আয়াতগুলোকে শবেবরাতের সাথে মিলিয়ে ফেলাতে সমাজের শতকরা ৯৯ জন মানুষ জানে যে- এ রাতে সৃষ্টিকূলের হায়াত-মউত, রিজিক-দৌলত ইত্যাদি নির্ধারিত হয়। এ কারণে শবেকদর থেকেও সমাজে শবেবরাতকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে পালন করা হয়। তাছাড়া যে সকল হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে তাতেও প্রমাণিত হয় না যে-
ক. ১৫ শাবানের রাতে আল্লাহ তায়ালা আগামী এক বছরের হায়াত-মউত, রিজিক-দৌলত ইত্যাদি নির্ধারণ করেন।
খ. আল্লাহর রাসুল সা. এ রাতে গোসল করেছেন বা করতে বলেছেন। অথবা মসজিদে সকলকে নিয়ে ইবাদতে লিপ্ত হয়েছেন। জিকির তেলাওয়াত ইত্যাদির
মাধ্যমে এ রাত উদযাপন করেছেন।
গ. আল্লাহ তায়ালার নবী বা সাহাবায়ে কেরাম এ রাতে সাহরি খেয়ে পরদিন সিয়াম পালন করেছেন।
ঘ. ভালো খানা বা হালুয়া-রুটি পাকিয়ে
বাড়িতে বাড়িতে বিলি করেছেন। এবং ঘরে-ঘরে মিলাদ পড়েছেন।
ঙ. নবীজি সা. সাহাবাদের সঙ্গে নিয়ে দলবদ্ধভাবে কবরস্থানে গিয়ে কবর জিয়ারত করেছেন।
সতর্কতা : মিশকাত শরিফে ‘রমজান মাসের রাতের সালাত’ অধ্যায়ে বর্ণিত একটি হাদিস দ্বারা কেউ কেউ দলিল পেশ করে থাকেন যে, সেখানে ১৫ ই শাবানের রাতে হায়াত-মউত, রিজিক-দৌলত নির্ধারিত হওয়ার কথা এসেছে। এই দলিল দুই কারণে সঠিক নয়। এক. হাদিস যে শাবান মাস সংক্রান্ত নয় তা গ্রন্থকার কর্তৃক ‘রমজান মাসের রাতের সালাত’ অধ্যায়ে উল্লেখ করার দ্বারাই পরিষ্কার হয়ে যায়।
দুই. যাকে সম্বোধন করে নবীজি সা. জিজ্ঞাসা করলেন ‘তুমি জান কি আজ কোন রাত?’ সেই আয়েশা রাযি. কোনো অজ্ঞ মহিলা ছিলেন না যে ‘অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত’ বলে তার ব্যাখ্যার প্রয়োজন হবে। আর কোনো কথা স্পষ্ট করার ক্ষেত্রে নবীজি সা. কথাটিকে কয়েকবার বলতেন। তাই ‘অর্থাৎ’ বলে যে কথা জুড়ে দেয়া হয়েছে সেটা পরবর্তী কোনো বর্ণনাকারীর শব্দ, নবীজির নয়। এবং এটা হযরত আয়েশা রাযি. এর বক্তব্যও না। কারণ, তার বক্তব্য শুরু হয়েছে ‘তিনি জিজ্ঞেস করলেন’ এর পর থেকে। আসল কথা হলো এই হাদিসের সম্পর্কও শবেকদরের সাথে।
এই আলোচনার সারকথা হলো-
ক্স শবেবরাতের ফজিলত ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে এমন সহিহ হাদিস রয়েছে। যেমন রয়েছে জুমার দিন, সোমবার দিন, বৃহস্পতিবার ইত্যাদি সময়ের ব্যাপারে।
ক্স ঘটা করে আনুষ্ঠানিকভাবে এ রাতকে পালন করার কোনো হাদিস বা সাহাবাদের আমল প্রমাণিত নয়।
ক্স কারো ধারাবাহিক আমলের মধ্যে যদি এ রাতও পড়ে যায়, তার জন্য অথবা কেউ একান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইবাদত করতে চাইলে তার জন্য এ রাতের ইবাদত-বন্দেগির সুযোগ রয়েছে।
ক্স শবেবরাতের আমল নফল পর্যায়ের
আমল। তাই শরিয়তে তার অবস্থান যেমন ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতের পরে; সমাজ জীবনেও তার অবস্থান সেখানেই রাখতে হবে। হেরফের হলেই এটা আর ইবাদতের পর্যায়ে থাকবে না।
বিদআতের পর্যায়ে চলে যাবে।
আমাদের সমাজে এ রাত পালনের ক্ষেত্রে বর্তমান যে খানিকটা বাড়াবাড়ি হয়েই যাচ্ছে- তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মনে রাখতে হবে কেনো নফল ইবাদত ছুটে যাওয়া ততোটা ক্ষতিকর নয়, তাকে ফরজ ওয়াজিবের ওপর গুরুত্ব দেয়া যতোটা ক্ষতিকর। তাই শবেবরাত পালনের ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই মধ্যমপন্থা আর সতকর্তা অবলম্বন করতে হবে। অন্যথায় লাভের চেয়ে ক্ষতিটাই বেশি হবে। আল্লাহ আমাদের হক বুঝে তার ওপর আমল করার তাওফিক দান করুন।#
শাপলার ভয়াল স্মৃতি :
বছর শেষে প্রাপ্তির হিসাব
কামরুল হাসান রাহমানী
মে'১৪
দৃশ্যপট এক.
কষাই কাদেরের ফাঁসি না হয়ে হলো যাবজ্জীবন। কেন? বিচারকরা কি সন্দিহান ছিলেন এই লোকটিই কষাই কাদের কি না? নাকি এটা ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক স্ট্যান্ডবাজি ছিল? কারণ আওয়ামী লীগের ব্যাপারে পুরনো অভিযোগ- তারা স্বাধীনতার চেতনাকে ফেরি করে দিন গুজরান করে থাকে। রাজনৈতিক স্ট্যান্ডবাজির যথেষ্ট কারণ ছিল। যেমন- ধ্বজভঙ্গ বিরোধীদলের আন্দোলনে চরম ব্যর্থতা সত্ত্বেও শেয়ারবাজার ধ্বস, হলমার্ক কেলেঙ্কারী, পদ্মাসেতু দুর্নীতি, সর্বোগ্রাসী লুটপাট, দুর্নীতিা মহোৎসব, ছাত্রলীগের লাগামহীন তাণ্ডব, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডসহ অসংখ্য ইস্যুতে সরকার যখন জনগণের স্বত:স্ফূর্ত প্রতিরোধের মুখে খেই হারিয়ে ফেলার অবস্থা, ঠিক তখনই জনগণের দৃষ্টিকে ভিন্নদিকে সরিয়ে দিতে তরুণদের এই পিকনিক স্টাইলের আন্দোলনকে লুফে নেয় সরকার। যেখানে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য এক দুই ঘণ্টা রাজপথ অবরোধ করার অপরাধে পুলিশ বাহিনী প্রতিবাদীদের ঠেঙ্গানোকেই তাদের বড় দায়িত্ব বলে মনে করে, সেখানে শাহবাগের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা অনির্দিষ্ট কালের জন্য অবরোধের ঘোষণা দেয় আন্দোলনকারীরা। এক্ষেত্রে তাদেরকে রাস্তা বন্ধ করার অপরাধে লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করা তো দূরের কথা, সরকার সর্বপ্রকার সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে অবস্থান যাতে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয় সে ব্যবস্থাই করে দেয়।
দৃশ্যপট দুই.
জয়বাংলা, বিচার নয় ফাঁসি চাই, ওমুককে ধরো জবাই করো। বিবেকবানরা এসব শ্লোগানে আতঙ্কিত হলেন। চিন্তার রেখা তাদের ললাটে ভেসে ওঠলো। সরকারিভাবে হালুয়া-রুটি, পোলাও-বিরিয়ানি থেকে শুরু করে ভ্রাম্যমান টয়লেটেরও ব্যবস্থা করা হলো। দিন যায় রাত আসেÑ যুবক যুবতিদের ভীড়ও বাড়তে থাকে। নিশিকন্যাদের আদলে শাহবাগিরাও একত্রে নিশিযাপন শুরু করে। এতোকিছুর পরও শাহবাগিদের প্রকৃতি উদ্দেশ্যের ব্যাপারে খানিকটা ধোঁয়াশা কাজ করছিল। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়া, রাম ও বামপন্থিদের এতো মাতামাতির কারণও অস্পষ্ট ছিলো। নাস্তিক ও বাম নিয়ন্ত্রিত মহাজোট সরকারের শাহবাগিদের নিয়ে অতি উল্লাসিত হওয়ার কারণও রহস্যাবৃত ছিলো। এরই মধ্যে ধীরে ধীরে
ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি, আল্লাহ, রাসুল, টুপি, দাড়িকে ব্যঙ্গ করে রাত দিন চব্বিশ ঘণ্টা খিস্তিখেওড় শুরু হলোÑ ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে শাহবাগি রাজিবসহ আরও কয়েক কুলাঙ্গারের ইসলাম ধর্মের চরম অবমাননা করে লেখা সাইটগুলোও প্রকাশ পেতে আরম্ব করলো। এতক্ষণে শাহবাগিদের লক্ষ-উদ্দেশ্য খানিকটা পরিস্কার হলো। পরিস্কার হলো রাম ও বাম নিয়ন্ত্রিত সরকারকর্তৃক তাদেরকে জামাই আদরের হেতুও। শাহবাগের এসব কুলাঙ্গাররা দেড় হাজার বছরের ইতিহাসকে ভীষণ লজ্জায় ফেলে দেয়। কারণ ইসলামের বিগত ইতিহাসে ইসলাম ও ইসলামের নবীকে নিয়ে এমন কদর্য ও নোংরা মন্তব্য ইহুদি, খ্রিস্টান, হিন্দু, বৌদ্ধ, এমনকি নাস্তিক-মুরতাদরাও করতে সাহস পায়নি। ভ্রান্ত রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে বিলুপ্তপ্রায় গুটিকয়েক বাম ছাত্র সংগঠন শুরুতে ক্ষমাতাসীনদের পাহাড়সম ব্যর্থতাকে ঢেকে দেয়ার অভিলাসে রাজপথ দখলে নিয়ে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালকে তাদের মর্জি মোতাবেক রায় প্রদানে বাধ্য করার জন্য নামলেও তাদের টার্গেট যে, ইসলাম ও মুসলমান তা দ্রুতই তারা পরিস্কার করতে সক্ষম হয়।
দৃশ্যপট তিন.
বিক্ষুব্ধ জনতার হৃদয়ে এমনিতেই ক্ষোভের আগুন জ্বলছিল। পাশাপাশি ‘বৃটিশ খেদাও’ আন্দোলনের সূর্যসন্তান আল্লামা হুসাইন আহমাদ মাদানির একান্ত শিষ্য আল্লামা শাহ আহমাদ শাফী দা. বা. জাতির এই ক্রান্তিকালে সকল ঈমানদারদের ঈমানি দাবি পূরণে রাজপথে নেমে প্রতিবাদ জানাতে আহবান জানান। সমুদ্রে ভাসমান আশ্রয়হীন যাত্রীরা যেন শেষ আশ্রয় খুঁজে পেলেন। তারা কালবিলম্ব না করে ঈমান রক্ষার তাকিদে রাজপথে নেমে আসলেন। মিছিল মিটিং আর শ্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ। অজ-পাড়াগাঁয়েও এই ঢেউ আছড়ে পড়ে। ৬ এপ্রিল ঢাকামুখী লংমার্চ ও লংমার্চ পরবর্তী শাপলাচত্বরে মহাসমাবেশের ডাক দেয়া হয়। ব্যথিত বিক্ষুব্ধ জনতা লংমার্চ ও সমাবেশ সফল করতে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। নরকের কীটতুল্য নাস্তিক মুরতাদ ও তাদের দোসররা এই প্রোগ্রাম বাঞ্চালের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। লংমার্চ ও সমাবেশকে হুমকি হিসেবে দেখে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার। ইতিহাসের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার কতিপয় লোলা, লেংড়া, বামপন্থি সংগঠন দিয়ে হরতাল আহবান করায় ক্ষমতাসীনরা। তারা মূল ক্রীড়ানক হলেও নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ও ইমরান এইচ সরকার থাকে ব্যানার হিসাবে।
দৃশ্যপট চার.
সম্পূর্ণ উস্কানীমূলক নজিরবিহীন এই হরতালকে কেন্দ্রকরে শেখ হাসিনার সরকার যে সীমাহীন নোংরামী প্রকাশ করে তা যুগের পর যুগ নবীপ্রেমিক জনতা ভুলতে পারবে না। তৌহিদি জনতাকে প্রতিহত করতে সরকার পুলিশ বাহিনীকে পিকেটার হিসেবে রাস্তায় নামায়। শাহবাগে গুটিকয়েক ভাড়াটিয়া জমা করে লোক দেখানো দুএকটি মিছিল ছাড়া সারা দেশের কোথাও তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। অথচ সরকার নিজ উদ্যোগে সারা দেশের গাড়ি ঘোড়া বন্ধ করে দেয়। বন্ধ করে দেয় লঞ্চ স্টিমার। রেল চলাচলেও পালিত হয় নজিরবিহীন হরতাল। রচিত হয় নতুন ইতিহাস। ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক জনগণের বিরুদ্ধে হরতাল
দৃশ্যপট পাঁচ.
হরতালের এই সীমাহীন দুর্ভোগ উপেক্ষা করেই ঈমানদার জনতা সমাবেশ সফল করতে ঢাকামুখী লংমার্চে অংশ নেয়। পালন করে তাদের ঈমানি দায়িত্ব। সুবহানাল্লাহ! দেড় হাজার বছরের ব্যবধানেও দুনিয়াতে নবী প্রেমিকরা বেঁচে আছে, তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রচিত হয় ৬ এপ্রিল বাংলার জমিনে। সাহবায়ে কেরাম কর্তৃক শত শত মাইল ঘোড়া, উট আর পায়ে হেঁটে নবীজীর সঙ্গে পাড়ি দেওয়ার যেসব ইতিহাস এতোদিন শুধু বইÑপুস্তকে পাওয়া যেত, সে ইতিহাস পুনর্জীবন লাভ করলো বাংলার জমিনে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে কেরাণীগঞ্জের আটিবাজার থেকে কদমতলী হয়ে মতিঝিল পৌঁছি। যা দীর্ঘ ৩০-৩৫ কি: মি: রাস্তা। আমরা যে কাফেলায় শরিক হয়েছিলাম তারা এসেছিল আটিবাজার থেকে ১৫-২০ কি: মি: দূর থেকে। তাহলে তারা এসেছে মতিঝিলের ৫০ কি:মি: দূরত্ব থেকে। আসা-যাওয়া ১০০ কি: মি:। ঢাকার দূরÑদূরান্তের অঞ্চল গাজীপুর, সফিপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, দাউদকান্দি, কুমিল্লা ও এর আশপাশের জেলাগুলো থেকে পায়ে হেঁটে পঙ্গোপালের মতো মানুষ ছুটে এসেছে ঢাকার মতিঝিলে। যার ফলে রচিত হয় বাংলার ইতিহাসে নজিরবিহীন লংমার্চ ও সর্ববৃহৎ মহাসমাবেশ। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার পদচারণা আর শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে রাজধানী ঢাকা। হরতাল আহবানকারী শাহবাগি ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের মুখে শুধু চুনকালি নয়- যেন ঝামা ঘষে দেয় এই জাগরণ
দৃশ্যপট ছয়.
সমাবেশ থেকে দেশ ও ঈমান রক্ষার স্বার্থে ঐতিহাসিক ১৩ দফা ঘোষিত হয়। অপরাধী ব্লগারদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিসহ ঘোষিত দাবি দাওয়া মেনে নিতে সরকারকে ১ মাস সময় দেওয়া হয়। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মাসব্যাপী কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়। হরতাল, বিভাগীয় মহাসমাবেশ, শানে রেসালাত সম্মেলন ইত্যাদি। এবং এসবে সরকারের কানে পানি না ঢুকলে ১ মাস পর ৫ মে ঢাকা অবরোধের কর্মসূচি দেওয়া হয়। ৮ এপ্রিল হেফাজত ঘোষিত হরতালও সারাদেশে স্বত:স্ফূর্তভাবে পালিত হয়। ঢাকার কেরাণীগঞ্জের যে অঞ্চলে আমার বসবাস, সেখানে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। অথচ এ লাকার বয়স্ক লোকদের ভাষ্যমতে, স্বাধীনতার পর খুব কম হরতালে এ অঞ্চলে গাড়ি-ঘোড়া, দোকান-পাট বন্ধ থাকতে দেখেছেন তারা। কিন্তু ৮ তারিখের হরতালে সবকিছুই বন্ধ থাকে। এই হরতালের মাধ্যমে ১৩ দফার প্রতি জনগণ তাদের অকুন্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করেন। এরপর দেশের বিভাগীয় শহর ও বড় বড় জেলাগুলোতে অনুষ্ঠিত হয় শানে রেসালত সম্মেলন। এই সম্মেলনগুলোতে জনতার অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। লক্ষ লক্ষ জনতার ঢল নামে এসব সম্মেলনে।
দৃশ্যপট সাত.
৫ মে ভোরের সূর্য উকি দেওয়ার আগেই লক্ষ লক্ষ তৌহিদী জনতা ঢাকার রাজপথে নেমে আসে। রাজধানীতে প্রবেশের গুরুত্বপূর্ণ ৬টি পয়েন্টে অবস্থান নেয় ঈমানদার জনতা। গাবতলী পয়েন্টের অবস্থা তো ইতিহাসের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সুদূর সাভার পর্যন্ত মানুষ আর মানুষ। এ অবস্থা প্রতিটি পয়েন্টে। আমি যখন কেরাণীগঞ্জের কদমতলীতে পৌঁছলাম তখন সেখানে প্রবল বর্ষণ উপেক্ষা করে লক্ষাধিক মানুষ ভাষণ শুনছে। বৃষ্টি থেমে গেলে যেন মানুষের ঢল নামলো রাজপথে।
সিদ্ধান্ত ছিলো, ৬টি পয়েন্ট থেকে শাপলাচত্বরে জমা হয়ে মহাসমাবেশ করা হবে। সেমতে জোহরের নামাজ পড়ে মতিঝিলের উদ্দেশ্যে রওনা হই। আমরা কয়েকজন মাইক বহনকারী একটি মিনি ট্রাকে ছিলাম। আমাদের ট্রাক যখন নবাবপুর রোডের মোড়ে পৌঁছলো, তখন সামনে-পিছে তাকিয়ে যে দৃশ্য অবলোকন করলাম, তা এক কথায় অকল্পনীয়। সামনে গোলাপশাহ মাজার আর পেছনে কদমতলী পর্যন্ত জনতার এক মহাসমুদ্র। নিস্তরঙ্গ প্রশান্ত মহাসাগর। অথৈ জলরাশি যেন নিরবধি বয়ে চলছে দূর অজানার উদ্দেশ্যে। রাস্তার দু’পাশের বাড়িঘর থেকে অপেক্ষমান আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা হাত নেড়ে মিছিল কারীদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। হঠাৎ শান্ত নদীতে যেন তরঙ্গ অনুভব হলো। মিছিলের গতি থেমে গেল। আমরা হর্ন বাজিয়ে গাড়ি নিয়ে সামনে অগ্রসর হলাম। গুলিস্তান পর্যন্ত যাওয়ার পর গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে অগ্রসর হলাম। গোলাপশাহ মোড়ে গিয়ে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখতে পেলাম। বৃষ্টির মতো টিয়ার শেল আর রাবার বুলেট ছুড়ছে পুলিশ। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বীর পুরুষরা পুলিশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইট পাটকেল, বোমা ও কাঁচের বোতল নিক্ষেপ করছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুহূর্তের মধ্যে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হলো। মিছিল কারীরাও পাল্টা ইট পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করলো। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। আমি বুঝতে পারলাম নাÑ নবীকে গালিদাতা নাস্তিক মুরতাদদের শাস্তি দাবি করায় এদের এতো গা জ্বালা কেন? এই বিশৃঙ্খখলা ছড়িয়ে পড়লো জিরোপয়েন্ট, মুক্তাঙ্গন, পুরোনাপল্টন হয়ে বাইতুল মোকাররম পর্যন্ত। সংঘর্ষ চলতে থাকে সন্ধা অবধি। আওয়ামী বাহিনীর যেন অনেক রক্তের দরকার। সেই রক্তের পিপাসা মেটাতে অরাজনৈতিক এই সংগঠনের নিরীহ কর্মীদের ওপর আক্রামনের এই নিষ্ঠুরতা। এরই মধ্যে সরকার তার রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য পবিত্র কুরআন পোড়ানোর নাটকও সমাপ্ত করে ফেললো। সন্ধা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ও এর আশপাশে কয়েকজন ভাই শহীদ হলেন। ছাত্রলীগ যুবলীগকে সাহসীই বলতে হবে, নিরস্ত্র নবীপ্রেমিকদের ওপর তারা যেভাবে ক্ষুধার্ত হায়েনার মতো ঝাপিয়ে পড়ে তাদের শহীদ করলো তার নজির ইতিহাসে বিরল।
দৃশ্যপট সাত.
বাংলাদেশের ইতিহাসের বিশালতম সমাবেশটি কেন্দ্র করে প্রচার মাধ্যমগুলো যুগপৎ ছুটি দৃশ্য প্রচার করছিল। একটি চিত্রে মতিঝিল ও তার আশপাশ জুড়ে দিগন্তবিস্তৃত বিশাল জনসমুদ্র। যা ছিল বদ্ধ জলরাশির ন্যায় সম্পূর্ণ শান্ত, তরঙ্গহীন। অন্যটি ছিল, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও ছাত্রলীগ যুবলীগের সঙ্গে দৃশ্যত হেফাজত কর্মীদের সংঘর্ষের চিত্র। আদতে এরা আসলেই হেফাজত কর্মী না হেফাজতের ইমেজ নষ্ট করতে ষড়যন্তকারীর ভূমিকায় তৃতীয় শক্তি, এ ব্যাপারে বিরাট প্রশ্ন আজও রয়ে গেছে। কারণ, নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে কড়া নির্দেশ ছিলো, কোনো অবস্থাতেই সংঘর্ষে জড়িয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না। একথা সত্য যে, গায়ে পড়ে নাস্তিক মুরতাদ ও তাদের দোসর সরকারের পোষ্যদের ঝগড়া পাকানোর পর বিচ্ছিন্নভাবে কিছু হেফাজত কর্মীও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। যাদেরকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে সরকারের পেটোয়া বাহিনী।
দৃশ্যপট আট.
গণতন্ত্রের লেবাসধারী এ সরকার লক্ষ লক্ষ মানুষের অভূতপূর্ব সমাবেশ ও কোটি কোটি মানুষের মনের আকুতি ক্ষমতার গরমে শুধু যে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলো- তাই নয়, বরং তারা নানা উস্কানীমূলক বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে সমাবেশকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টাও করে। ঘোষণা করা হয়Ñ হেফাজতের আমীর আল্লামা আহমদ শফী সাহেব এসে কর্মসূচি ঘোষণা করে মুনাজাতের মাধ্যমে সমাবেশের সমাপ্তি টানবেন।
সেমতে বারবার চেষ্টা করেও তিনি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বাধার মুখে সমাবেশে আসতে ব্যর্থ হন। সূর্য অস্ত যায় যায় অবস্থা। দূর দূরান্ত থেকে আগত জনতার মাঝে বাড়তে থাকে উদ্বেগ উৎকন্ঠা। একে তো আহমদ শফীর ঘোষণা ছাড়া সমাবেশস্থল ত্যাগ না করার অনমানীয় মনোভাব, আবার রাতের আঁধারে এই লক্ষ লক্ষ মানুষ বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লে প্রতিপক্ষের হাতে ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হওয়ার আশঙ্কা। এমন এক প্রেক্ষাপটে সিদ্ধান্ত হয়, অন্যায়ভাবে নিরীহ হেফাজত কর্মীদের শহীদ করার প্রতিবাদ স্বরূপ রাতটি এখানেই কাটিয়ে সকাল বেলা সমাবেশের সমাপ্তি ঘোষণা করা হবে। সিদ্ধান্তের কথা সরকারের পক্ষ থেকে নিয়োজিত আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানিয়েও দেওয়া হয়।
দৃশ্যপট নয়.
সারাদিনের ক্লান্ত-শ্রান্ত বনিআদম যারা ৫০-৬০ মাইল হেঁটে হেঁটে এসেছেন। অনাহারে অর্ধহারে অধিকাংশ দ্রুতই পিচ ঢালা রাজপথে গা এলিয়ে ঘুমের কোলে ঢলে পড়লেন। বাকিরা জিকিরÑআজগার, ইবাদত-বন্দেগি, তাহাজ্জুদ-তিলাওয়াতে লিপ্ত হলেন। আমাদের দেশে ১০-৪ টা মূল রাতের মধ্যে পড়ে। সে হিসাবে রাত আড়াইটা মানে শেষ রাত। দুই তৃতীয়াংশ কেটে গেছে। আর দেড় থেকে সর্বোচ্চ দু’ঘণ্টা সময় বাকি। স্বভাবতই ঘুমের প্রকোপ অনেক বেশি। যারা ইবাদত বন্দেগিতে ছিলেন তারাও প্রায় ঘুমের কোলে মাথা রেখেছেন। এই গভীর রাতে কি কোনো অভিযান বা আক্রমন হতে পারে? ইতিহাসে কি এমন কোনো নজির আছে? পাক বাহিনী? না না, পাক বাহিনীর কী ঠেকা পড়ছে নিরীহ বাঙ্গালীদের ওপর হায়োনার মতো ঝাপিয়ে পড়তে ঘুম কামাই করে শেষ রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে? তাহলে এর কোনো নজির নেই। কোত্থাও নাই। তাছাড়া লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশে তাদের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী একটি অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠনের নিরীহ কর্মীদের ওপর গোলা বারুদ নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিবেন তাকি কল্পনা করা যায়? যায় না। এমনটা কি কল্পনা করা উচিত? না উচিত না। কিন্তু . . .কিন্তু কি? কিন্তু তাই ঘটেছিলো যা কল্পনা করা যায় না। তাই ঘটেছিল যা যুদ্ধের ময়দানেও অনুমোদিত নয়। আকাশ-বাতাস তাই প্রত্যক্ষ করেছিলো যা ইতোপূর্বে হয়তো আর কখনো প্রত্যক্ষ করেনি।
দৃশ্যপট দশ.
সকল বাতিগুলো নিভে গেলো। নেমে এলো কিয়ামতসম অন্ধকার। হাজার হাজার র্যাব, পুলিশ, বিজিবি রণসাজে সজ্জিত। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে ওঠলো আকাশ-বাতাস। কেঁপে ওঠলো আকাশ চুম্বি প্রাসাদ, পিচঢালা রাজপথ সবকিছু। যেন যুদ্ধকবলিত জনপদে জালিমের বজ্রনিনাদ। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ঘুমন্ত জনতা চোখ মেলেই দেখে পর্বতসম অন্ধকার। কী হচ্ছে! কী হতে যাচ্ছে! আপনজনকে বুকে জড়িয়ে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সব তাকিয়ে আছে। চতুর্দিক থেকে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে গুলি, টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড আর কলিজা শুকিয়ে দেওয়ার মতো শব্দতরঙ্গ। যেন কিয়ামতের বিভীষিকা। গ্রাম থেকে আসা লক্ষ লক্ষ বনিআদম, নিস্পাপ শিশুÑকিশোর আর তাদের আপনজনরা হতবিহবল। স্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই। টিয়ারশেল আর ঝাঁক ঝাঁক বুলেট ছুটে আসছে। জীবন যে কতো অনিশ্চিত একটি ব্যাপার তা সবার সামনে ভেসে ওঠলো। খোদার কাছে নিজেদের গোনাহ খাতার জন্য সকলে তাওবা করছেন। বিড়বিড় করে দোয়া দুরুদ পড়ছেন। মৃত্যু যেন খুব কাছ থেকে দেখা যাচ্ছে। চিৎকার চেঁচামিচি আর কান্নার রোল পড়ে গেল। সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। যার ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য কোনো ভাষাই যথেষ্ট নয়। শাপলাচত্বর যেন কারবালার প্রান্তর। মোবাইলের কল্যাণে অপারেশনের খবর পৌঁছে গেল সর্বত্র। রাতের এই শেষ প্রহরে যেন আজ সারা দেশটাই একটা কারবালা। হুসাইনের উত্তরসূরিরা আজ বিশ্বনবীর ইজ্জত রক্ষায় জীবনবাজি রেখে বাংলার কারবালায়। ইয়াজিদের ভূমিকায় নবীর উম্মত দাবিদার আওয়ামীলীগ সরকার।
দৃশ্যপট এগার.
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাই বলি। ছোট ভাইদের খুঁজতে যেইনা পেছন ফিরলাম, সঙ্গে সঙ্গে একঝাক ছরাগুলি চেহারায় এসে বিদ্ধ হলো। ছরাগুলি জানতাম রাবারের হয়, কিন্তু এগুলো ছিল ধাতবগুলি। চোখে চশমা না থাকলে হয়তো জীবনের তরে চোখের আলো হারাতে হতো। নাকে মুখে বিদ্ধ হলো অনেকগুলো। চশমার কাঁচ ফেটে গেল। কিন্তু এতোকিছু দেখার সময় কই। এখনো তো জীবনটা বাকি আছে। সেটা বাঁচানোর জন্য শেষ চেষ্টা চালাতে হবে। নিকষকালো অন্ধকার, প্রচণ্ড ভীড়। একবার পড়ে গেলে তার আর উঠে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। ওহ্ খোদা! তুমি এ কী দেখালে। স্বাধীনতার ৪২ বছর পর একটি মুসলিম প্রধান দেশে তোমার নবীর ইজ্জত সম্মান রক্ষার দাবিতে আন্দোলন করা কি এতোই বড় অপরাধ? জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে ছুটছি। এক সময় সঙ্গিদের দু’একজন হারিয়ে ফেললাম। এখানে হারানো জনকে খোঁজা আর সমুদ্রের তলদেশের নুড়িপাথর খোঁজা এক কথা। সামনে এগুনোর চেষ্টা করলাম। এক জায়গায় গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। মনে হলো কোনো কিছুর স্তুপ পড়ে আছে। খোদা জানে কোন হতভাগা জননীর সন্তান এরা। সঙ্গে থাকা অন্য দুজনকে তখনো শক্ত করে ধরে রেখেছি। মুখে অনবরত তওবা ইস্তেগফার পড়ে যাচ্ছি। হয়তো আল্লাহকে ডাকার এই শেষ সময়। সময় যেন দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। চতুর্দিক থেকে যৌথবাহিনী প্রতি নি:শ্বাসে নিকট থেকে নিকটতর হচ্ছে। গ্রেনেড, সাউন্ডগ্রেনেড, টিয়ারশেল, চিৎকার, চেঁচামিচি সবকিছুর সাথে মৃত্যুও যেন পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে।
দৃশ্যপট বার.
আমি খোদাকে ডাকছি। মাবুদ! হায়াত শেষ হয়ে থাকলে তোমার কাছে তুলে নাও। দয়া করে, অন্ধ, লোলা, লেংড়া, অবস্থায় বাঁচিয়ে রেখে অন্যের বোঝা বানিও না। অন্ধের মতো হাতড়ে হাতড়ে আগাচ্ছি। আগাচ্ছি বললে ভুল হবে। কারণ জনস্রোতে ভেসে ভেসে এগিয়ে যাচ্ছি। নটরডেম থেকে শাপলাচত্বর পৌঁছলাম। এরপর পল্টনের দিকে আগানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। কিছুদূর আগানোর পর যৌথবাহিনীর আক্রমনের মুখে বামে দিলকুশার দিকে মোড় নিলাম। সেখানে অবছা আলো আধাঁরিতে যেদিকে চোখ যায়, যতদূর চোখ যায়Ñ শুধু মানুষ আর মানুষ। পা টিপে টিপে রাজউকের পেছনের গলিতে আসার পর প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হলাম।
রাতের আঁধার ভেদ করে উল্কার ন্যায় ছুটে আসছে শত শত টিয়ারশেল আর সাউন্ড গ্রেনেড। তীব্র গ্যাসের ধোঁয়ায় পুরো এলাকা ধোঁয়াচ্ছন্ন। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। কয়েকজনকে দেখলাম গ্যাসের তীব্রতা সইতে না পেরে রাস্তায় লুটিয়ে পড়লো। ভীত বিহবল জনতা একবার এদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছে, আবার ওদিক থেকে এদিকে আসছে। সে যে কী করুণ দৃশ্য তা ভাষায় প্রকাশ করা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। আইন শৃঙ্খখলা বাহিনীর পোশাকে যারা ছিলো তারা যেন বার বার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পরিস্থিতি খারাপ থেকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যেতে। এভাবে প্রায় রাত শেষ হয়ে এলো। টিয়ারশেল, গ্রেনেড আর ছরাগুলিতে অসংখ্য মানুষ রাস্তায় পড়ে আছে। কেউ পরপারের যাত্রী আর বাকিরা সে পথের পথিক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ভাষায়- এরাই শরীরে রঙ মেখে রাস্তায় শুয়ে আছে! মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর রস-বোধের জন্য ধন্যবাদ!
তবুও সান্ত্বনা পেলাম, বর্ণচোরাদের রঙ খোদা তুলে দিয়ে তাদের স্বরূপ জাতির সামনে উন্মোচিত করে দেয়ার জন্য।
দৃশ্যপট তের.
১৮২ বছর পূর্বে বালাকোটের ঐতিহাসিক প্রান্তরে দ্বীন ও আজাদির সৈনিকদের ওপর বৃটিশের পোষ্য লাল কুকুররা শহীদ সায়্যেদ আহমাদ বেরলবি, হাজি ইসমাঈল শহীদ ও তার সঙ্গীদের ওপর ৬ মের রাতের আঁধারে যেভাবে ঝাপিয়ে পড়েছিল, ঠিক একই কায়দায় ৬ মের শাপলাচত্বরে সত্য-সন্ধানীদের ওপর ঝাপিয়ে পড়লো আওয়ামী সরকার। পার্থক্য শুধু ১৮২ বছরের ব্যবধানে বৃটিশের ভূমিকায় আওয়ামীলীগ। তাই ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতির অপেক্ষায় আমরা থাকতেই পারি।
দৃশ্যপট চৌদ্দ.
সারাজীবন যা দেখলাম, যা শুনলাম সব পাল্টে গেল শাপলাচত্বরে। জানতাম রাতের আঁধারে সাধারণভাবে চলতে গিয়েও মানুষ আহত হয়, এমনকি নিহতও হয়। এক দেড় হাজার মানুষও কোনো বিল্ডিং থেকে হুড়াহুড়ি করে নামতে গিয়ে অসংখ্যজন নিহত পর্যন্ত হয়। অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মুখে হার্ট এটাকেও মারা যায় বহু মানুষ। প্রচণ্ড ভীড়ে দিনেÑদুপুরেও পদপৃষ্ঠ হয়ে মারা যায় শত শত বনিআদম। বুলেট, বোমা, গ্রেনেড, গুলির কথা নয় বাদই দিলাম। যদিও মহাজোট সরকারের মালিকানাধীন পত্রÑপত্রিকার রিপোর্ট মতে দেড় লক্ষাধিক গোলা-বারুদ ব্যবহৃত হয়েছে ওই রাতের অভিযানে। অথচ আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আর তার বিজ্ঞ মন্ত্রীপরিষদের বয়ান মোতাবেক সে রাতের অভিযানে একজন মানুষও আহত-নিহত হলো না।
কতো ভয়ানক সত্য কথা! কতো নির্মম রসিকতা! কতো জঘণœ মানসিকতা! কতো নোংরা চিন্তা ভাবনা। জানতাম, মানুষ পাগল হয়, বাচাল হয়, বিবেকহীন হয় কিন্তু মানুষ যে এমনও হয় তা জানতাম না। এবার জানলাম, বড় নির্মমভাবে জানলাম। যাক এ আলোচনায় আজ আর যাব না।
দৃশ্যপট পনের.
ফজরের প্রায় পূর্বমুহূর্তে যৌথ বাহিনীকে কিছুটা ক্লান্ত মনে হলো। আমরা বললাম, যদি আপনাদের সিদ্ধান্ত হয় সব শেষ করে দেয়া, তাহলে তাই করুন। আর যদি উদ্দেশ্য হয় আমাদের উচ্ছেদ করা, তাহলে তার জন্য তো আমাদের যাওয়ার রাস্তা দিতে হবে। কথাগুলো শোনোার সাথে সাথে আইনের পোশাক পরিহিত কিছু মানুষ এমন বিশ্রী গালাগাল শুরু করলো- সত্য কথা বলতে কি মানুষ যে এমন নোংরা ও বিশ্রী শব্দ মুখে আনতে পারে তা কল্পনারও অতীত ছিল। আমরা সব মুখ বুজে সহ্য করলাম। দশ পনের মিনিট মনের ঝাল মিটিয়ে গালিগালাজ করার পর এমন কাজ শুরু করলো যা আগে জানলে তাদের কাছে কিছুতেই যেতাম না। বুড়ো বুড়ো দাড়িপাকা বাবার বয়সি আলেম-ওলামা, ছাত্র-শিক্ষক আর ঈমানদার মানুষগুলোকে দুই হাতে কান ধরিয়ে ছবি তুলতে বাধ্য করলো। এরপর এভাবেই কান ধরা অবস্থায় সকলকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করালো। মনে হচ্ছিল, সদ্য যুদ্ধ সমাপ্ত পরাজিত শত্র“দের ওপর বিজয়ীদের মনের সব ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে শেখ হাসিনার বীর পুরুষ যৌথবাহিনী। মনে মনে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম খা আলমগীরের প্রতিশোধ গ্রহণের অভাবনীয় কলা-কৌশলের প্রশংসা করছিলাম আর খোদার কাছে কায়মনো ফরিয়াদ জানাচ্ছিলাম- ও খোদা! তুমি এতো দয়াবান কেন! তোমাকে যারা গালি দিলো, তোমার নবীর সম্মান যারা ধূলোয় মেশালো- আর যারা তা সইতে না পেরে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসলো- তাদের বুকে অস্ত্রধারণকারী ফিরআউন, হামান, নমরুদ, সাদ্দাদ, আবু জাহেল আর আবু লাহাবদের তুমি যুগে যুগে কেন এতো ছাড় দাও মাবুদ! ওদের কেন এতো বাড়তে দাও!
দৃশ্যপট পনের.
১৮২ বছর পূর্বে ঈমান ও আজাদি রক্ষার তাড়নায় আমিরুল মু’মিনিন সাইয়েদ আহমাদ বেরলবি রহ. ও তাঁর সাথীরা বালাকোটের প্রান্তরে উপস্থিত। আর আজ উপস্থিত সেই চেতনার উত্তরসূরি একদল মরণজয়ী বীর মুজাহিদ মতিঝিলের শাপলা চত্বরে। উদ্দেশ্যের ভিন্নতা নেই, আছে স্থান আর প্রতিপক্ষের ভিন্নতা। মৌলিকত্বে কোনো ভিন্নতা না থাকায় আমরা আশা করতেই পাবি, জালিম যতো দাপুটে আর ভয়ঙ্কর হোক না কেন তাদের পতন অনিবার্য। আর সত্যের সৈনিকরা বাহ্যত যতো দুর্বল আর নিরীহ হোক না কেন তাদের বিজয় অবসম্ভাবি। শহীদের রক্তের ঋণ শোধদিতে আমরা সফল না ব্যর্থ- তার চেয়ে বড় কথা হলো, মাজলুমের প্রতিশোধ গ্রহণের দায়িত্ব আরশের মালিক নিজে গ্রহণ করেছেন। যে সব মিডিয়া এই জঘন্য কর্মকাণ্ডকে তুলে ধরে নবীপ্রেমের ঈমানি দায়িত্ব পালন করেছে, সে সকল মিডিয়ার টুটি চেপে ধরা হয়েছে। কিন্তু সরকারকে আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- ৯০ ভাগ মুসলমানদের এই দেশে নবীর দুশমনদের পক্ষ অবলম্বন করায় হয়তো সাময়িকভাবে বিদেশী প্রভুদের বাহবা পাওয়া যাবে, হয়তো নিজেদের পিঠ বাঁচানোর জন্য কুরআন পুড়িয়ে তার দায় দালাল মিডিয়ার কল্যাণে কুরআনপ্রেমিকদের ঘাড়ে চাপিয়ে ময়িকভাবে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরানো যাবে। কিন্তু নবীর প্রতি শত্র“তার কলঙ্কতিলক কপালে পরার কারণে স্থায়ী পতন ঠেকানো সম্ভব হবে না। যার আলামত ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হচ্ছে। যে সকল মিডিয়া দাজ্জালের একচোখা নীতির নির্লজ্জ প্রতিযোগতায় শিরোপা অর্জনে মরিয়া তাদের পতনও অনিবার্য। শাহবাগ চত্বর নিয়ে অতি উৎসাহীদের আশার বেলুন চুপসে যেতে আরম্ভ করেছে। সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন খোদাদ্রোহী নবীর দুশমনদের ললাটে চরম লাঞ্ছনার তিলক অঙ্কিত হবে। জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যত হয়ে তারা ইতিহাসের আস্তকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। তাই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে, আমাদের ভালোবাসা কার জন্য নিবেদিত হবে। নবীর জন্য না নবীর দুশমন নাস্তিক মুরতাদ ও তাদের দোসরদের জন্য? আমাদের কেবলা মক্কা হবে না মস্কো হবে? আমাদের বন্ধু আম বাম আর রামরা হবে, না আল্লাহ রাসুল ও মুমিনরা হবে? অবশেষে আল্লাহর ঘোষণাকে স্মরণ করে লেখার ইতি টানতে যাচ্ছি। ‘মনোবল হারিও না, চিন্তিত হয়ো না, তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা মুমিন হও।’
ইসলামি বিশ্বের বিদ্যমান পরিস্থিতি এবং
পাশ্চাত্যের স্ববিরোধী অবস্থান
মাওলানা সাইয়েদ ওয়াজিহ রশিদ নদভী
বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে ইসলামি বিশ্বের সেই দেশগুলোতে জাগরণের নিদর্শন প্রকাশ পায় যারা পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। কিন্তু মানসিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে পাশ্চাত্যের অধীন ও তাবেদার হয়ে রয়েছিল। সেই সব স্বাধীনদেশের জনগণ অনুভব করেছিল যে, তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব জাতীয় জীবনের সমস্যাবলী সমাধানে ব্যর্থ। এই অনুভূতি আরও বেড়ে গিয়েছিল যখন পাশ্চাত্যতোষক শাসকের আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও জাতীয় ঐক্য সংরক্ষণে ব্যর্থ হলো। অতঃপর ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে বিপ্লবী ও সেনা নেতৃবৃন্দের ব্যর্থতা এই অনুভূতিকে বিশ্বাসে পরিণত করেছিল। ক্ষমতাকালে তারা শুধু নিজ বিরোধীদেরকে নিমূল এবং পশ্চিমা ভাবধারা বিশেষ করে ইসলামি বিশ্বে সমাজতন্ত্র বাস্তবায়ন করার চেষ্টাই করে ছিল। ইসলামপন্থী প্রচারক ও সংস্কারকদেরকে হয়তো কারাগারে বন্দী করা হয়। কিংবা তাদেরকে নিমূল করা হয়।
তারা অর্থনীতি, রাজনীতি ও শিক্ষা দীক্ষায় পশ্চিমাদের অনুকরণ করে। এবং পশ্চিমা পরিকল্পনা অনুযায়ী মুসলিম জাতিগুলোর ইসলামি পরিচয়, তাদের ধর্মীয় স্বকীয়তা, ধর্মের প্রতি ভালোবাসা, ধর্মীয় গর্ব ও মর্যাদাবোধ এবং ইসলামি নির্দশন ও পবিত্র স্থানসমূহ সংরক্ষণের প্রেরণা নিঃশেষ করার কোনো চেষ্টাই অবশিষ্ট রাখেনি। মুসলমানদের এই জাগরণ ছিল স্বাভাবিক। প্রসিদ্ধ প্রাচ্যবিদ উইলফ্রেড ক্যান্ট ওয়েল স্মিথও (১৯১৬-২০০০) স্বীকার করছিলেন যে, মুসলিম বিশ্বে প্রচলিত শাসনব্যবস্থা ব্যর্থতার পরিণামে ইসলামি জাগরণ এসেছে। উইলফ্রেড স্মিথ তার বইতে লিখেছেন, আরব ও ইসলামি বিশ্বের জাগরণ ১৯৬৭ সালের পরাজয়ের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল। সুতরাং সেই ব্যর্থতার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় ইসলামি সংগঠন ও আন্দোলনগুলো পূর্ণ শক্তিতে মাঠে নামে। যুবকেরা এই পরাজয়ের প্রতিক্রিয়া দূর করার জন্য ধর্মের আশ্রয় নেয়। সেই যুবকেরা আক্কাদ ত্বহা হোসাইন, আহমাদ আমীন, হাইকেল, উমর ফারুক প্রমুখের আত্মরক্ষামূলক অবস্থানকে গ্রহণ করল না, বরং ইসলামের পক্ষে জোরালো অবস্থানকে নিজেদের পরিচয় বানিয়ে নিল। তারা ঘোষণা করলো যে, এই সব বুদ্ধিজীবীর ধারণা ঠিক নয় যে, মুসলমানদের অবনতির কারণ ইসলম। বরং ইসলাম এক বিশ্বজনীন, পূর্ণাঙ্গ ও শাশ্বত ধর্ম। যা সভ্যতা সংস্কৃতি ও মানব জাতির উন্নতির অগ্রদূত। ইসলামি আন্দোলনগুলো আত্মরক্ষামূলক অবস্থান ছেড়ে দিয়ে আক্রমনাত্মক অবস্থান গ্রহণ করে। তারা ইসলামি ভিত্তির ওপর এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেÑ যাতে সাম্য, সুবিচার ও মানবিকতার বিকাশ ঘটবে। এই আন্দোলনের মৌলিক প্রভাবক ছিল সফলতা। যা তারা অর্জন করেছিল সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন বন্ধ করে দিতে। এবং সমাজকে নৈতিক বিপথগামিতা ও দূর্নীতি থেকে পবিত্র রাখতে। এই আন্দোলনের মতো বিদ্যমান জীবনব্যবস্থা সুযোগ সন্ধানী ও উপকরণভোগ নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। আর তার লাগাম দুষ্কৃতিকারীদের হাতে। এই জন্য জীবনব্যবস্থার সংস্কারের জন্য এমন একটি সমন্বিত কর্মসূচির প্রয়োজন যা ইসলামি ভাবধারায় আধুনিক, যাদের প্রশ্নসমূহ ও সমস্যাগুলোর সমাধান উপস্থাপন করতে এবং গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে সক্ষম। এটা ছিল সেই চিন্তা, বিভিন্ন দেশে পশ্চিমা চিন্তা চেতনা ও জড়বাদী জীবনব্যবস্থার সাথে যার প্রত্যক্ষ বিরোধ রয়েছে। কিছু প্রসিদ্ধ লেখক বর্তমান যুগকে বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়্যাত বলে আখ্যায়িত করছেন। এবং দলিল প্রমাণাদী ও ঘটনাবলীর আলোকে পশ্চিমা সভ্যতার প্রতারণা, ষড়যন্ত্র ও অসারতা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, পশ্চিমা দেশগুলো ইসলামি বিশ্বের সম্পদ শোষণ করছে। নতুন প্রজন্মের এই অনুভূতি ও উপলব্ধি সেই বইগুলোর অধ্যায়ন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। যেগুলোর লেখকগণ পশ্চিমা সভ্যতার ওপর দুঃসাহসিকতা ও পূূর্ণ আস্থার আলোকে সমালোচনা করেছেন। এবং সাম্রাজ্যবাদী চিন্তার ওপর থেকে পর্দা উন্মোচন করেছেন। সেই সব সমালোচক ও বুদ্ধিজীবী পশ্চিমা সভ্যতাকে কাছ থেকে দেখেছেন, নীরক্ষণ করেছেন। এবং ইসলামি বিশ্বের সমস্যাবলীর ব্যাপারে পাশ্চাত্যের দ্বিমুখী নীতির সাহসিকতা পূর্ণ পর্যালোচনা করেছেন। পাশ্চাত্যে ইসলাম ও ইসলামের পবিত্র স্থান সমূহের অবমাননা, আল্লাহর রাসুল সা. এর শানে বেয়াদবীর ঘটনাসমূহ, মুসলিম ক্ষমতাসীনদের নির্লিপ্ততা ও তাবেদারির মানসিকতা এই উপলব্ধিকে শক্তিশালী করেছে। এ থেকে ইসলামের দিকে পত্যাবর্তনের প্রবণতা বেড়েছে। ইসলামি শরিয়তের আলোকে সমস্যাবলীর সমাধান অনুসন্ধান করতে গিয়ে ইসলামি চিন্তার বাহকগণ পশ্চিমা চিন্তার সুস্পষ্ট সমালোচনা করেছেন। সেটির অসারতা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। পাশ্চাত্যের অনুসরণের ক্ষতিসমূহ বর্ণনা করেছেন। জাতির মধ্যে এই অনুভূতির আগুন সৃষ্টি করে দিয়েছেন যে, পশ্চিমারা এই ভাবে মুসলিম বিশ্বকে নির্বোধ বানিয়ে রাখে। বিপদে-আপদে ইসলামি দেশগুলোকে বন্ধুহীন ও অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দেয়। মুসলিম বিশ্বের উদ্ভূত ঘটনাবলীর প্রতি যাদেরে দৃষ্টি রয়েছে তারা জানেন, ইউরোপ এখন পর্যন্ত মধ্যযুগের ক্রুসেডি মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসেনি। ইউরোপ আজও ইহুদিদের জোরালো রক্ষক। মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব সত্ত্বেও তারা ইয়াহুদিদের স্বার্থকে মুসলিম স্বার্থের ওপর প্রাধান্য দেয়। মানুষ জানে যে ইউরোপের সাথে এই সম্পর্ক ইউরোপীয় স্বার্থ রক্ষায় এক তরফা। অবস্থা ও ঘটনালীর সাথে পরিচিত মহোদয়গণ জানেন মুসলমানদের উন্নতি এবং তাদের সমস্যাবলীর ব্যাপারে ইউরোপের কোনো আগ্রহ নেই। বরং ইউরোপতো চেষ্টা করে চলছে মুসলিম বিশ্বকে সমস্যাবলী ও জটিলতায় পেঁচিয়ে রাখাতে এবং তার অর্থনীতির কোমর ভেঙে দিতে। এজন্যই মুসলিম বিশ্বে অর্থনৈতিক সমস্যাবলী সৃষ্টি হয়ে থাকে। ইউরোপের এজেন্টরা ইসলামি দেশগুলোতে নিত্য নতুন সমস্যাবলী, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, চিন্তাগত দ্বন্দ্ব এবং সেনা অভ্যুত্থান ঘটায়। ফলে ইসলামি দেশগুলো তাদের সমস্যাবলী সমাধানের জন্য ইউরোপের দিকে হাত বাড়ায়। ইউরোপের মিশন ইসলামি বিশ্বকে তার প্রকৃত উৎস এবং মানবীয় নেতৃত্ব থেকে দূরে রাখা। এ জন্য ইসলামি বিশ্বের সরকারগুলোকে বশীভূত করে রাখে, যেন ইসলামি জাগরণের প্রত্যেক আন্দোলনকে দমন করা যায়। ইসলামি দেশগুলোতে পশ্চিমা তোষক শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতার অনুভূতি জনগণের মধ্যে নতুন বিকল্প অনুসন্ধানের প্রেরণা সৃষ্টি করে। এবং এই মানোভাব এতই শক্তিশালী ছিল যে তা দমিয়ে রাখা যায়নি। স্বয়ং পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীদের ধারণা হয়ে ছিল, এই অনুভূতি খুব জোরালো ভাবে বেড়ে চলেছে। ক্ষতি কিংবা অপমান ও অবনতির অনুভূতি মানুষকে এর কারণসমূহ দূর করতে উতসাহিত করে। যদি পাশ্চাত্যের অনুসারী ও তাবেদার দেশগুলো শিক্ষার ক্ষেত্রে উন্নতি, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ও মজবুতি এবং শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অর্জন করে এবং প্রযুক্তি ও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে উন্নতি অর্জন করে উন্নত দেশসমূহের সারিতে এসে যায় এবং নিজ সমস্যাবলী সমাধান করার যোগ্যতা অর্জন করে স্বনির্ভর হয়ে যায়, তবেই পাশ্চাত্যের এই অনুসরণের বৈধতা আছে। কিন্তু এ রকম কিছুই হয়নি, বরং তারা অবনতি, অমর্যাদা এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থার শিকার হয়েছে। যে দেশগুলো পশ্চিমা সভ্যতা ও পশ্চিমা অর্থ ব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছে তারাই সবচেয়ে বেশি ঋণী। তাদের অর্থনীতি অন্যদের ওপর নির্ভরশীল। সবচে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, পাশ্চাত্যের ওপর বেশি ভরসাকারী ও তার ইশারায় পরিচালিত ইসলামি দেশগুলোর এই সব সমস্যাবলী সবচেয়ে জটিল। আর সেখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাব, নাগরিক অধিকার পদদলিত এবং অর্থনীতির অবনতি হয়ে চলছে। এই তিক্ত বাস্তবতা মুসলিম বিশ্বে নতুন ব্যবস্থা অনুসন্ধানের আগ্রহ এবং নতুন প্রবণতা সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থায় ইসলামপন্থীদের দায়িত্ব ছিল এই অনুভূতিকে জোরদার করা। এর পরিধি প্রশস্ত করা। এই অনুভূতিকে ব্যাপক করার জন্য মন-মস্তিষ্কে এ কথা বসাতে হবে যে, পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ-অনুসরণ নিছক ক্ষতিকর এবং অবনতি ও পশ্চাদপদতার কারণ। এতে শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং আইনবিদকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। পাশ্চাত্য থেকে আমদানী করা আইন ও শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা ও দুর্বলতাকে স্পষ্ট করা এবং এই বিশ্বাস করানো যে, পশ্চিমা রাজনীতি, অর্থনীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা অপর দেশগুলোর সমস্যা সমাধান করতে পারে না। কেননা তা তাদের স্বভাব, মানসিকতা, ইতিহাস, পরিবেশ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক। ইসলামপন্থীদের আরও দায়িত্ব ছিল সমস্যাবলীর ইসলামি সমাধান ও পশ্চিমা সভ্যতার সঠিক বিকল্প উপস্থাপন করা। এবং প্রমাণ করা যে, ইসলামি বিশ্বের অধিকাংশ সমস্যা উপনিবেশিক শাসনের উত্তারাধিকার ও পাশ্চাত্যবাদের অনুসরণের পরিণতি। এগুলো ইসলামি বিশ্বের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এজন্য ইউরোপীয় অভিজ্ঞতার আলোকে এগুলোর সমাধান হয় না। এই জাগরণ সৃষ্টির অগ্রাধিকারের মধ্যে ছিল, ইসলামি সমাজের সংস্কার ও নির্মাণের পথে জনগণকে চিন্তাগত ও সংস্কৃতিগতভাবে সজাগ করা। ইসলামি শিক্ষা-দীক্ষার প্রতিষ্ঠান এবং স্কুল প্রতিষ্ঠা করে মুসলিম জাতির শ্রেণিসমূহের মাঝে ধর্মীয়, জাতীয় ও সাংস্কৃতিক ঐক্য সৃষ্টি করা। ইসলামিজীবন ব্যবস্থার আলোকে জীবনের সমস্যাবলীর সমাধান করা এবং পশ্চিমা ওই সব কেন্দ্র ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করা। যারা ইসলামি দেশের সম্পদ শোষণ করছে। এই ইসলামি জাগরণের ফলে বিদ্যমান শাসনব্যবস্থাকে পরিবর্তনের জন্য সেই সব জনতার বিল্পব হয়েছে যেখানে দীর্ঘদিন ধরে স্বৈরতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত ছিল। এবং অত্যাচারী একনায়কতন্ত্রীরা ইসলামি জাগরণকে পিষ্ট করার কোনো চেষ্টাই অবশিষ্ট রাখেনি। এবং নাগরিক স্বাধীনতা হরণ করেছিল। সেই দেশগুলোতে গণবিপ্লবের ফলে স্বৈরব্যবস্থার পতনের পর যখন অবাধ নির্বাচন হলো তখন সেই নির্বাচন প্রমাণ করে দিল যে, এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ইসলামি শরিয়তকেই পছন্দ করে। এবং এর আলোকে নিজেদের সব সমস্যার সম্যাধান করতে চায়। এই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিল, নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর তাকে শাসন করার সুযোগ দেওয়া। কিন্তু ইসলামের শত্র“রা এই সফলতা থেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং পশ্চিমা ও ধর্মবিদ্বেষী চক্রগুলোর সহায়তায় নির্বাচিত বেসামরিক সরকারকে উতখাত করে। আলজিরিয়া ও তুরস্কে এমনই হয়েছিল। এবং সেই সব দেশে সেনাশাসন পুনরায় ফিরে আসে। মিশরে আজ এই পরিকল্পনার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। এখানে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারকে উতখাত করা হয়েছে। এবং সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে। ইসলামপন্থীদের ঢালাও ভাবে বন্দি করা হচ্ছে। তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। তাদের সংগঠন ও দলসমূহের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে, সম্পদ জব্দ করা হচ্ছে। আর এ সবই হচ্ছে আর্ন্তজাতিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর তত্ত্বাবধানে।
আল জাজিরা ওয়েবসাইটের ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ করেছে যে, এ মর্মে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদি রয়েছে যে, মিশরে ড. মুরসিকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ এবং সেনা অভ্যুত্থান করানোর জন্য বিরোধীদের মোটা অংকের তহবিল সরবরাহ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিভিন্ন নথিপত্র থেকে প্রমাণিত হয় আমেরিকা মিশরে প্রতিষ্ঠিত নিজস্ব বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেনা অভ্যুত্থানের পথ সুগম করার জন্য নয়শত মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে এবং মুরসি বিরোধীদের মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছে। (আল মুজতামা: ২০৬২)
সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা অনুযায়ী মিশরে পূর্ববর্তী ব্যবস্থা থেকেও কঠোর স্বৈরাচারী সেনা শাসনব্যবস্থা কার্যকর করা হয়েছে। অর্ন্তবর্তী সেনা সমর্থিত সরকার মুরসির সমর্থকদের ওপর নির্মম দমন অভিযান চালায়। ফলে হাজর হাজার বিক্ষোভকারী নিহত হয়। এই বর্বর আচরণ ও নির্মমতার ওপর সমস্ত ইউরোপ এবং গণতন্ত্রের দাবিদার দেশগুলোর নেতাগণ নীরব থেকেছেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলো পদক্ষেপ নেয়নি। এই জন্য এই মানুষগুলো এবং ইসলামকে সন্ত্রাসবাদের সাথে মিলিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদের কাজকে অগণতান্ত্রিক ও সন্ত্রাসবাদ বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। অপরদিকে অর্ন্তবর্তী সেনা সমর্থিত সরকার তাদের সাথে পশু সুলভ ও নির্মম আচরণ করছে। কারাগারে বন্দি ইখওয়ান সমর্থকদেরকে কঠোর নির্যাতন করেছে। বিক্ষোভকারীদের ও সেনাদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। ফলে শতশত বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছে।
পশ্চিমা দেশগুলোর স্ববিরোধী অবস্থানের একটি স্পষ্ট প্রমাণ এই যে, এশিয়া, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন ইরান, ফ্রান্স, পাকিস্তানের নির্বাচন হয়েছে এবং যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে তাদেরকে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছে এবং তাদের সরকার গঠিত হয়েছে। এতে কারও কোনো আপত্তি হয়নি। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। পশ্চিমা সভ্যতার বর্তমান নিয়ম অনুযায়ীই এগুলো হয়েছে। বিজয়ী দলকে ক্ষমতা হস্তান্তর করা একটি স্বাভাবিক বিষয়। মিশরের ব্যাপারেও এই দাবি ছিল যে, পাশ্চাত্য গণতন্ত্রবিরোধী অবস্থানের কঠোর সমালোচনা করবে এবং বিজয়ী দলকে ক্ষমতায় বহাল থাকার সুযোগ দিবে। কিন্তু ইসলামপন্থীদের হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ার ভয় তাদেরকে অস্থির করে দেয়। সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে মিশরে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা থেতে অপসারণ করে সেনা সমর্থিত সরকার বসায়। সর্বক্ষেত্রে সহায়তার ঘোষণা দিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ১৭ আগস্ট ২০১৩ সালে জোরালোভাবে বলেছেন যে, তিনি মিশরের সেনা সরকারকে সব ক্ষেত্রে সাহায্য করতে প্রস্তুত আছেন। সূত্র অনুযায়ী রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চান। এবং এজন্য তিনি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করছেন। অপরদিকে মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে শক্তিশালী নেতা হিসাবে অবির্ভূত হতে চেয়েছেন। এই জন্য পুতিন মিশর ও সিরিয়ার ইসলামপন্থীদেরকে সন্ত্রাসবাদী বলে আখ্যা দিয়েছেন এবং সিরিয়াতে বাসার আল আসাদকে খোলাখুলি সমর্থন করেছেন। অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরশাসন ব্যবস্থার সমর্থন করা অগণতান্ত্রিক কাজ। কিন্তু যারা গণতন্ত্র, নাগরিক স্বাধীনতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষমতার সমর্থনকারী এবং নির্বাচিত শাসনব্যবস্থার সমর্থক- তাদের আচরণ অত্যান্ত দুঃখজনক। এ থেকে স্পষ্ট যে, বিশ্বে চলমান ঘটনাবলী ও পরিবর্তনের ব্যাপারে পাশ্চাত্য দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করেছে।
(উর্দু পাক্ষিক ‘তামীরে হায়াত’ থেকে ভাষান্তর- মাওলানা আসআদুজ্জামান)
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম : ওলামায়ে কেরামের দিকে কেন অশুভ ইঙ্গিত?
জহির উদ্দিন বাবর
আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন স্বাধীনতা। একদিন আমরা ছিলাম পরাধীন, শাসন করতো ভিনদেশীরা। অনেক সংগ্রাম-সাধনা, ত্যাগ-তিতিক্ষার পর ‘স্বাধীনতা’ নামক সূর্যটি আমরা ছিনিয়ে এনেছি। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আমাদের জাতীয় সম্পদ। বিশ্বের বুকে আমরা আজ স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের নাগরিক-এটাই আমাদের গর্ব। নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠী বা শ্রেণি-পেশার নয়, মুক্তিযুদ্ধ এদেশের প্রতিটি নাগরিকের অহঙ্কার। যেকোনো দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং প্রয়াসের দরকার পড়ে। আমাদের মুক্তিসংগ্রামে যে চড়ামূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে এতে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ না থাকলে সফল হওয়া সম্ভব ছিল না।
অন্য সবার কথা আলোচিত হলেও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে আলেমসমাজের অংশগ্রহণের কথা তেমন আলোচিত হয় না। এ প্রসঙ্গটি আমাদের কাছে ধূসর কিংবা স্পর্শকাতর বলে অনালোচিত ও অনুক্ত থেকে যায়। আলেম বলতেই মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা নিয়ে সংশয় ও সন্দেহ প্রকাশ করা সাধারণ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এই মনোভাবের কারণে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে তাদের প্রতি আমাদের ব্যক্ত ও অব্যক্ত কিছু ঘৃণা প্রকাশ পায়। পুরো আলেমসমাজকেই স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের প্রতি অযাচিত আচরণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে আলেমসমাজের নাম এলে অনেকেই নাক সিটকায়। ধর্মীয়ভাবে সর্বজনবিদিত আলেমসমাজের প্রতি জাতীয় পর্যায়ের এই ধ্যান-ধারণা প্রকৃত বিচারে কতটুকু বাস্তব তা যথেষ্ট বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ অপরাধের দায় এবং তুচ্ছতার গ্লানি একতরফাভাবে তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়াটা অন্যায়। সংশ্লিষ্টতাহীন কোনো অনাচারের দায় যাচাই-বাছাই ছাড়া যে কারো কাঁধে চাপিয়ে দেয়ার পরিণাম শুভ হয় না। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী আলেম প্রজন্ম, যাদের জন্মই মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে, তাদের প্রতি অবাঞ্ছিত ইঙ্গিত করা কি অন্যায় নয়?
আমাদের মুক্তিসংগ্রামে সবার অবদান সমান ছিল না এ কথা ধ্র“ব সত্য। এ ক্ষেত্রে আলেমসমাজের অবদান কিংবা অংশগ্রহণ আশানুরূপ ছিল না-এটা স্বীকার করে নিতেও কারো কুন্ঠিত হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এই সীমিত অবদানকে তুচ্ছ করা এবং তাদের সংশ্লিষ্টতাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বসা বড় ধরনের অবিচার। এটা জলজ্যান্ত কোনো সত্যকে গলা টিপে হত্যা করারই নামান্তর। এদেশের খ্যাতিমান অনেক বুদ্ধিজীবী-পণ্ডিতও স্বাধীনতাকে সমর্থন করেননি, পাকিস্তান সরকারের আনুগত্য করে চাকরি করেছেন। পরবর্তী সময়ে তারা স্বাধীন বাংলাদেশে চলে এসেছেন, এদেশের পক্ষে কাজ করেছেন। কেউ তো তাদের প্রতি বাঁকা চোখে তাকায় না! স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে তারা তো চিহ্নিত হন না। শুধু লেবাস-পোশাকের কারণে আলেমরা কেন স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে পরিচিত হবেন? আলেম মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বিশাল না হলেও নগণ্য নয়। এদেশের আনাচে-কানাচে এখনো অনেক আলেম খুঁজে পাওয়া যায় যারা নিজেদের জীবনবাজি রেখে সরাসরি সম্মুখসমরে অংশগ্রহণ করেছেন। দেশমাতৃকার টানে মুক্তিসেনাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছেন হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে।
‘রাত তখন পৌনে একটা। শুরু হলো প্রচণ্ড গোলাগুলি। আকাশ রক্ত বর্ণ হয়ে উঠছে আগুনের লেলিহার শিখায়। ঘন ঘন ফাটছে কামানের শেল। পাকিস্তানি ফৌজ অতর্কিত হানা দিয়েছে আমাদের ক্যাম্পে। মাথার ওপর দিয়ে সাঁই সাঁই ছুটছে গুলি। আমরা টিলার গর্তে ঢুকে, গাছের আড়ালে থেকে গড়ে তুললাম তুমুল প্রতিরোধ। ঘণ্টা দেড়েকের শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে আমরা সফল হলাম। ইতোমধ্যে তাদের কয়েকজন খতমও হয়ে গেলো।’ একজন আলেমের স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে উদ্ধৃতাংশটি। তিনি সম্মুখসমরে যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন নয় মাস। তার সহযোগী হিসেবে ছিলেন একাধিক আলেম।
মুক্তিযুদ্ধে শাহাদত বরণ করেছেন জানা-অজানা এমন আলেমের সংখ্যা কম নয়। ডা. মাওলানা অলিউর রহমানের কথা আমরা জানি। তিনি ছিলেন একজন বুদ্ধিজীবী আলেম। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর প্রথমসারির বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাকেও হত্যা করা হয়। পটিয়া মাদরাসার প্রবীণ উস্তাদ ছিলেন আল্লামা দানেশ রহ.। পটিয়া মাদরাসায় পাক সেনাদের গোলা বর্ষণে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। মাওলানা আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী, তার ভাই মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী, মাওলানা আব্দুর রহমান, মাওলানা মুস্তাফিজ (হাতিয়া), মাওলানা আব্দুস সোবহান (মুহাদ্দিস), মাওলানা আবু ইসহাক (রাঙ্গুনিয়া), মাওলানা ইমদাদুল হক আড়াইহাজারী, মাওলানা দলিলুর রহমান (চন্দ্রঘোনা), মাওলানা মতিউর রহমান (রানীরহাট), মাওলানা আব্দুল মতিন কাজী, মাওলানা আমজাদ হোসেন (নাগেশ্বর), মাওলানা কামরুজ্জামান (নরসিংদী), মাওলানা বজলুর রহমান, মাওলানা বশির উদ্দীন, মাওলানা মুখলিস (চান্দিনা) প্রমুখ আলেম সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন। তাদের অনেক গৌরবগাঁথার কথা মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র এবং তাদের নিজেদের স্মৃতিকথায় পাই। উদাহরণ হিসেবে এখানে অল্প কয়েকজন আলেম মুক্তিযোদ্ধার নাম উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র। দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছেন অনেক আলেম মুক্তিযোদ্ধা। তাদের অনেকের নামও আমরা জানি না, অনেকেই ইতোমধ্যে দুনিয়া থেকে বিদায়ও নিয়ে গেছেন। আলেম মুক্তিযোদ্ধাদের স্বতন্ত্র কোনো তালিকা কোথাও সংরক্ষিত নেই। এজন্য প্রকৃত বাস্তবতাটা আমাদের সামনে আসে না।
সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়া আলেমদের বাইরেও একটি বিশাল শ্রেণি আছেন যারা নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। সারাদেশে মসজিদ, মাদরাসা ও খানকায় ছড়িয়ে থাকা আলেমরা সাধ্যানুযায়ী মুক্তি সংগ্রামে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। নানা সমস্যা ও প্রতিকূলতার কারণে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ না পেলেও স্ব স্ব অবস্থান থেকে মুক্তিসংগ্রামকে সাফল্যের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে তাদের আকুলতার কোনো কমতি ছিল না। প্রত্যন্ত অঞ্চলের ইমাম সাহেবের হুজরা কিংবা পীর সাহেবের খানকায় আশ্রয়ে থেকে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন অনেক যোদ্ধা। অনেক আলেম নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুরক্ষিত রেখেছেন মুক্তি-ফৌজদের। প্রয়োজনে পাকসেনাদের সঙ্গে ভাব গড়ে তুলে ফায়দা লুটেছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। আর কিছু না হোক, জোরালো সমর্থন, ঐকান্তিক কামনা এবং আন্তরিক দোয়ার দ্বারা প্রত্যেক আলেমই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। সাধারণ মানুষের মনোবল চাঙ্গা করা, ব্যাপক জনমত গড়ে তোলা, যুদ্ধরত সৈনিকদের সেবা-শুশ্রƒষা, তাদের পারিবারিক খোঁজ-খবর নেয়া মুক্তিযুদ্ধসংশ্লিষ্ট এসব অধ্যায় থেকে কোনো আলেমই বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। এ হিসেবে আলেমদের সিংহভাগই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস শুধুই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নয়। বৃটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে প্রায় দুইশ বছরের যে সংগ্রাম এর পরতে পরতে রয়েছে ওলামায়ে কেরামের অভূতপূর্ব ভূমিকা। উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পূর্ণতা পাবে না বালাকোট, রেশমি রুমাল, সিপাহী বিদ্রোহ, দারুল উলূম দেওবন্দ আন্দোলন প্রভৃতি ছাড়া। আর এর সবগুলোতেই রয়েছে ওলামায়ে কেরামের স্বর্ণোজ্জ্বল ভূমিকা। ইংরেজবিরোধী ভূমিকার জন্য খুদিরাম যদি ইতিহাসে বীরসেনানী হিসেবে অমর হয়ে থাকেন তবে এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখা শত শত ওলামায়ে কেরামের নাম কেন অনালোচিত থাকে। ‘অমুক-তমুকের’ জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না যেমন সত্য, তেমনি ইংরেজদের বিতাড়িত না করলেও এদেশ স্বাধীন হতো না- এটাও সত্য। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ না হলে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের যে জন্ম হতো না সেটাও তো ধ্র“ব সত্য। সুতরাং স্বাধীনতা সংগ্রামের খণ্ডিত ইতিহাস দিয়ে আলেম-ওলামার অবদান মূল্যায়ন করা তাদের প্রতি অবিচার।
উপনিবেশমুক্ত নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের নেতৃত্বে যারা ছিলেন, যারা ইসলামি রাষ্ট্রের টোপ দিয়ে জনগণকে উদ্দীপ্ত করেছিলেন, তাদের মধ্যে ইসলামের কোনো বালাই ছিল না। ইসলামের লেভেল এঁটে ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদনই ছিল তাদের প্রধান মনোবাঞ্ছা। তাদের মোহাচ্ছন্ন জালে আটকা পড়ে যায় ওলামায়ে কেরামের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ। আলেমদের যে অংশটি তখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভাজন সমর্থন করেননি, তারাও মুক্তিযোদ্ধা কিংবা সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেননি। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়টা অনেকের কেটেছে সিদ্ধান্তহীনতা ও ইতস্ততার ঘোরের মধ্যে। বিবেক ও পারিপার্শ্বিকতার টানাপোড়েন তাদের স্বতঃস্ফূর্ততার সুযোগ করে দেয়নি। যারা সব আড়ষ্টতা কেটে বিবেকের ডাকে সাড়া দিতে পেরেছেন তারাই ছুটে গেছেন রণাঙ্গনে, জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াইয়ে। তাছাড়া বাস্তবতা হলো, সব বাধা-বিঘন্ন এড়িয়ে সবার একসঙ্গে রণাঙ্গণে চলে যাওয়াটাও অসম্ভব। আর এটা যুদ্ধকৌশলেরও পরিপন্থী। এজন্যই দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রায় সাত কোটি জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র কয়েক লাখ ছিলেন মাঠ পর্যায়ের সরাসরি মুক্তিযোদ্ধা। তবে বাকিরা মুক্তিযুদ্ধ প্রক্রিয়ার বাইরে ছিলেন না। মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপক্ষে কিংবা দেশের স্বাধীনতার অনুকূলে কোনো না কোনো ভূমিকা মোটামুটি সবারই ছিল।
সাধারণ এ বিশ্লেষণপ্রক্রিয়া আলেমদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তারাও সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন। এ দৃষ্টিকোণে মুক্তিসংগ্রামে ওলামায়ে কেরামের উজ্জ্বল ভূমিকার কথা ভাস্বর হয়ে ওঠে। অবাঞ্ছিত কিছু অপরাধমূলক কার্যক্রমের যে অভিযোগের তীর আলেমদের ওপর বিদ্ধ করা হয় এটা সত্যিকার কোনো আলেমের কাজ নয়। সুযোগসন্ধানী একটি শ্রেণি আলেমের লেবাস গায়ে ঝুলিয়ে কিংবা জোর করে আলেম উপাধি ধারণ করে নানা অন্যায়-অনাচার ও অপকর্ম চালিয়েছে। অনেক আলেমও সুবিধাভোগী হিংস্র এ শ্রেণিটির শিকারে পরিণত হয়েছেন। সীমিত আয়তনের জনবসতিপূর্ণ এ ভূখণ্ডে কারো অপরিচিত কেউ নন। সুতরাং কারা তখন আলেম বেশ ধারণ করে এসব অপকর্ম চালিয়েছিল তা কারো জানার বাইরে নয়। সে শ্রেণিটির অস্তিত্ব¡ এখনও আছে। তাদের সঙ্গে কোনো প্রকৃত আলেমের যোগসূত্রতা তখন যেমন ছিল না, এখনও নেই। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি হিসেবে সে সময় তারা যেমন ধিকৃত ও ঘৃণিত হয়েছিল এখনও হচ্ছে। এজন্য তাদের দায় নিষ্কলুষ ইমেজ ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী, জাতীয় ও ধর্মীয় অভিভাবক ওলামায়ে কেরামের ওপর চাপিয়ে দেয়ার অশুভ প্রবণতা থেকে আমাদের সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে কোনো আলেম দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরোধী হতে পারেন না। কারণ, যে ইসলামের দীক্ষায় তারা দীক্ষিত, সে ইসলাম মাতৃভূমি রক্ষার জোর তাগিদ দিয়েছে। ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ ও চরিত্রে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল নজির চিরভাস্বর হয়ে আছে। তিনি যখন স্বজাতিকর্তৃক বিতাড়িত হয়ে মদিনার পথে হিজরত করেন, তখন বার বার মক্কার দিকে তাকাচ্ছিলেন আর কাতর কণ্ঠে আফসোস করে বলছিলেন, ‘হে আমার স্বদেশ, তুমি কতই না সুন্দর! আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার আপন জাতি যদি ষড়যন্ত্র না করতো আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।’ মদিনায় হিজরত করার পর রাসুল সা. মদিনাকেই নিজের মাতৃভূমি হিসেবে গণ্য করেন। এর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
ইসলামি চেতনায় যারা বলীয়ান, বিবেকের দায়বোধে যারা দগ্ধ, তারা দেশ ও জাতির জন্য সবচেয়ে বেশি নিবেদিত। মুক্তিসংগ্রামে আলেমসমাজের স্বতঃস্ফূর্ত ও ব্যাপক অংশগ্রহণ না থাকলেও দেশগড়া এবং দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য তাদের চেষ্টা, শ্রম ও আকুলতা কোনো অংশে কম নয়। যেকোনো দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ যত না গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়েও বেশি গুরুত্ব রাখে দেশ গঠনে অংশিদারিত্ব। আর এক্ষেত্রে আলেমদের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। তারা নিজেদের অবস্থান থেকে দেশ, জাতি ও সমাজের জন্য সাধ্যানুযায়ী ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। সত, আদর্শিক ও নৈতিক শিক্ষায় পুষ্ট জাতি গঠনে তাদের অবদানই সর্বাগ্রে। আলেম-ওলামা স্বদেশ প্রেম ও দেশের প্রতি আন্তরিকতা প্রশ্ননাতীত। সুতরাং আলেম-ওলামা প্রতি স্বাধীনতাবিরোধী ইঙ্গিত অশুভ পাঁয়তারারই অংশ। সচেতন ও দেশপ্রেমিক নাগরিকদের উচিত, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এসব অপপ্রচার থেকে বেঁচে থাকা।
ইতিহাসের আয়নায় রক্তাক্ত আমাদের বর্তমান
খন্দকার মনসুর আহমদ
আত্মসচেতন জাতি ইতিহাসকে তার পরম শিক্ষক হিসেবে গ্রহণ করে এবং ইতিহাসের সত্যকে জীবনচলার পথে আলোকবর্তিকারূপে গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে আত্মভোলা জাতি তাদের ইতিহাস ভুলে যায়। এবং জাতীয় সংকটময় মুহূর্তে যথাযথ কর্তব্য নির্ধারণে দিশেহারা হয়ে পড়ে। তাই আমরা আমাদের বিগত ইতিহাসের একটি দগদগে অধ্যায়ের কথা মনে করিয়ে দিয়ে আমাদের জাতীয় জীবনের বর্তমান সংকটকালকে খানিকটা মূল্যায়নের প্রয়াস পাব।
আমি ইতিহাসের যে অধ্যায়টির প্রতি ইঙ্গিত করতে চাই তা হলো আমাদের ভারত উপমহাদেশে আগ্রাসী ইংরেজদের দখল প্রতিষ্ঠা ও সুদীর্ঘ দুঃশাসন। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, সাম্রাজ্যবাদী ধুরন্ধর ইংরেজগোষ্ঠী বাণিজ্যের কৌশলগত পথে একদা আমাদের এই উপমহাদেশ দখল করে নিয়েছিলো এবং এদেশকে মানবতার বদ্ধভূমিতে পরিণত করেছিলো। হাজার হাজার আলেম উলামাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়েছিলো। হাজার হাজার মাদরাসা বন্ধ করে দিয়েছিলো এবং উপমহাদেশকে খ্রিস্টান রাজ্যে পরিণত করার গভীর ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিলো। গোটা উপমহাদেশেই নেমে এসেছিলো ভয়াল অন্ধকার। অত্যাচারী সেই আগ্রাসীদের মোকাবেলায় কোনো বিপ্লব গড়ে তোলাও ছিলো কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ১৭৫৭ সালে ইংরেজদের দখল প্রতিষ্ঠার মাত্র ছয় বছর পর ওদের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে একটি বিপ্লব গড়ে তোলার চেষ্টা চালানো হলে ইংরেজ কমান্ডার মুলারের নির্দেশে চৌদ্দজন বিপ্লবী দেশীয় সৈনিককে কামানের মুখে উড়িয়ে দেয়। তবে বিপ্লবীদের কর্মসূচি চলতে থাকে এবং সময়ের ব্যবধানে তার গতি বাড়তে থাকে। তারপর সুদীর্ঘ ৯৩ বছর পর ১৮৫৭ সালে তা একটি জ্বলন্ত ভিসুবিয়াসের রূপ পরিগ্রহ করে। যা সিপাহীবিপ্লব নামে পরিচিত। কিন্ত নানা কারণে শেষ পর্যন্ত সেই বিপ্লবও ব্যর্থ হলে ইংরেজদের উৎখাত করতে আরও ৯০ বছর লেগে যায়। অবশেষে ১৯৪৭ সালে এই আগ্রাসী শক্তিকে বহু রক্তের বিনিময়ে বিতাড়িত করা হয়। এখানে শুধু সে রক্তক্ষয়ী অধ্যায়ের দিকে ইশারা করে বর্তমান সংকটময় মুহূর্তে আমরা আমাদের জাতিকে একটি বার্তা দিতে চাই। এবং সকলকে আমরা সেই অধ্যায়টির প্রতি একটু মনোযোগী হবার আহ্বান জানাই। এতে সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র সম্পর্কে যেমন একটি ধারণা লাভ করা যাবে তেমনি আমাদের মহান পূর্বসূরিদের সীমাহীন ত্যাগের আয়নায় আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিরূপণ করা সহজ হবে।
ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশেষভাবে উলামায়ে দেওবন্দ-এর বিপ্লবের ভূমিকার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। উলামায়ে দেওবন্দ-এর আন্দোলনের একটি বড় হাতিয়ার ছিলো ফতোয়া। মুসলিম জনজীবনে ফতোয়ার প্রভাব অত্যন্ত গভীর। শাহ আবদুল আযিয মুহাদ্দিসে দেহলবি রহ.-এর একটি বিপ্লবী ফতোয়া সাম্রাজ্যবাদীদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। তার সুযোগ্য শিষ্য মাওলানা ফজলে হক খায়রাবাদি রহ.-ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ ওয়াজিব বলে ফতোয়া প্রচার করেন এবং বিভিন্ন স্থানে অনলবর্ষী বক্তৃতা দিয়ে জাতিকে জাগিয়ে তোলেন। পরে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী তাকে আন্দামান দ্বীপে নির্বাসিত করে। সীমাহীন নির্যাতন ভোগ করে তিনি এক পর্যায়ে সেই দ্বীপেই শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি রহ., হুজ্জাতুল ইসলাম আল্লামা কাসেম নানুতবি রহ., শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানি রহ. প্রমুখ মহান ব্যক্তিও ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামে সীমাহীন ত্যাগ শিকার করেন।
আজকে বাংলাদেশে আমাদের পবিত্র ধর্ম ইসলাম ও স্বাধীনতা নাস্তিক্যবাদী শক্তির যে-হামলার মুখে পতিত হয়েছে সেই প্রেক্ষাপটে এই দেশের মুসলমানদের কর্তব্য কী হতে পারে সে সম্পর্কেও বিজ্ঞ আলেম সমাজের সম্মিলিত ফতোয়ার প্রয়োজনীয় বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য আমরা সচেতন মহলের প্রতি আহ্বান জানাই। শাহ আবদুল আযিয মুহাদ্দিসে দেহলবি রহ.-এর বিপ্লবী ফতোয়া প্রমাণ করেছিলো যে ফতোয়া শুধু ইসলাম রক্ষার হাতিয়ার নয়, বরং ফতোয়া দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষারও অত্যন্ত শক্তিশালী হাতিয়ার। আজকের প্রেক্ষাপটে কোনো একক ব্যক্তির ফতোয়ার ফলপ্রসূতার ব্যাপারে সংশয় থাকলেও জাতীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে উলামায়ে কেরামের সম্মিলিত ফতোয়া আগের মতোই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে বলে আমাদের বিশ্বাস। অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনগণকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে আরেকটি শক্তিশালী মাধ্যম হলো যুক্তিপূর্ণ ও তথ্যবহুল বক্তৃতা। আদর্শিক জাগরণের পক্ষে ভাষা ও ভাষণের প্রয়োজনীয়তা এতখানি যে মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রেরিত নবী-রসূলগণকেও এর মুখাপেক্ষী করেছেন। বিখ্যাত মুসলিম বীর তারিক বিন যিয়াদের একটি ভাষণ স্পেন জয়ের প্রেক্ষাপট রচনা করেছিলো। যা আজও সাহিত্য ও ইতিহাসে অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে। আফগানিস্তানের নরশার্দুল মোল্লা মোহাম্মদ উমরের একটি ভাষণ আফগান জাতিকে আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে নতুনভাবে জগিয়ে তুলেছিলো। ইংরেজ-বিরোধী সংগ্রামেও উলামায়ে দেওবন্দ-এর ভাষণসমূহ এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিলো। সে কারণেই দেখা যায় যে ভোগবাদী শক্তি সর্বদা ভাষা ও ভাষণকে ভয় পায়। অনেক ক্ষেত্রেই তারা ভাষা ও ভাষণ বন্দি বা গৃহবন্দি রাখতে চায় অথবা নির্বাসনে পাঠায়। অতীত ও বর্তমানে এর অনেক নজির রয়েছে। ভাষা ও ভাষণের এই শক্তির কথা বিবেচনায় রেখে আজকের শ্রদ্ধেয় আলেম সমাজকেও এই হাতিয়ারটি দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে। বিশেষত তরুণ আলেম শ্রেণিকে বক্তৃতার শাণিত ও সাবলীল ভাষা এবং কলাকৌশল রপ্ত করতে হবে। বক্তৃতায় অশুদ্ধ বা আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার হলে বক্তৃতা কাক্সিক্ষত পর্যায়ে প্রভাবশালী হতে পারে না। বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখার জন্য আমরা শ্রদ্ধেয় আলেম সমাজের মনোযোগ আকর্ষণ করছি। ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বার বার ব্যর্থতা ও পরাজয় বরণের পরও সামনের পথে এগিয়ে চলা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি, কারণ সংগ্রাম ও বিপ্লব সর্বদা একই মাত্রায় গতিশীল থাকে না। বিপর্যয় ও ব্যর্থতা এ-পথের একটি স্বাভাবিক বাস্তবতা। সফলতার সূর্যোদয়ের জন্য ধৈর্য ও সাহসিকতার সঙ্গে সংগ্রামের সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। এক্ষেত্রে অনেক সময় কয়েক যুগও পার হয়ে যায়। এ-বাস্তবতার আলোকে আমাদের চলমান নাস্তিক্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের সাময়িক বিপর্যয়কে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। একথা তো অস্বীকারের উপায় নেই যে শাপলাচত্বরের বিপর্যয়ের পর আলেমসমাজের নাস্তিক্যবাদবিরোধী সংগ্রাম একটি প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছে এবং সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে বেশ সময় লেগে যাচ্ছে। কিন্তু ইতিহাসের আয়নায় বিচার করলে এটা তেমন বড়ো কিছু নয়। কারণ সংগ্রামের পথটাই হচ্ছে চড়াই-উৎরাইয়ের পথ। সুতরাং আলেমসমাজ নাস্তিক্যবাদের বিরুদ্ধে নতুন রূপরেখায় এগিয়ে যাবেন এটাই ইতিহাসের দাবি। উগ্র নাস্তিক্যবাদ এখন শুধু ব্লগ আর মিডিয়ায় সীমাবদ্ধ নয়। বরং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ছত্রছায়ায় যথেষ্ট পরিপুষ্টি লাভ করে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদেও অধিষ্ঠিত। ফলে উগ্র-নাস্তিক্যবাদ রাষ্ট্রশক্তিরও যথেষ্ট প্রশ্রয় পাচ্ছে। নাস্তিক্যবাদ যে নোংরা মূর্তিতে ফণা তুলে দাঁড়িয়েছে এর প্রতিরোধ সফলভাবে করা সম্ভব না হলে এক সময়ে এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করাও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। কারণ উগ্র দাম্ভিক শক্তি নিজেদের দম্ভ ও দাপট রক্ষার জন্য দেশের বহিঃশক্তিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকে। এটা ইতিহাসের এক নির্মম সত্য। উপমহাদেশে একটি বৃহৎ হিন্দু জনগোষ্ঠী এবং নামধারী এক শ্রেণীর মুনাফিক মুসলমান ইংরেজদেরকে যেভাবে সহায়তা করেছিলো তা আমাদের একথার জ্বলন্ত প্রমাণ। দাম্ভিক শক্তি যখন স্বদেশের জনগণকে আর নিজেদেও পক্ষে ব্যবহার করতে সক্ষম হয় না তখনই তারা তাদের সতীর্থ শক্তিকে স্বদেশে আমন্ত্রণ জানায় এবং আধিপত্য বিস্তারে প্ররোচনা দেয়। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন মুসলিম দেশে তার প্রমাণ স্পষ্ট হয়েছে।
প্রিয় পাঠক, আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট নিয়ে এবার একটু ভেবে দেখা যাক। একটু ভেবে দেখলে আমাদের দেশে ইংরেজদের দখল প্রতিষ্ঠার পূর্বপ্রেক্ষাপটের সঙ্গে বর্তমান প্রেক্ষাপটের অনেক মিল পাওয়া যায়। ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমিকায় কাজ করে যাচ্ছে অসংখ্য এনজিও এবং ইংরেজ সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করছে দেশের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষাপ্রাপ্তদের একটি বড় অংশ। দেশে শীর্ষ রাজনৈতিক মেধাগুলো আধিপত্যকামী শক্তির কাছে বিক্রি হয়ে আছে। কঠিনভাবে জাতীয়তাবোধসম্পন্ন দীনি মাদরাসাসমূহের ওপর চলছে নজরদারি। প্রতিবাদী সাহসী কণ্ঠগুলোকে স্তব্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বড় আকারে কোনো শক্তি প্রদর্শনের সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। বিদেশি দখলদারদের মতই শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ঈমানি দাবিসমূহকে পদদলিত করা হচ্ছে। সর্বাত্মকভাবে দেশে একটি আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উত্তরসূরিদের আত্মীয়স্বজনরাও এদেশে সদম্ভে বিচরণশীল। ইংরেজ সভ্যতার অসংখ্য দাস এদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অত্যন্ত প্রভাবশালী। এরা ক্ষমতার প্রয়োজনে জনগণকে পাশ কাটিয়ে যেকোনো নিকৃষ্ট পথে পা বাড়াতেও দ্বিধা করবে না বলে দেশের জাতীয়তাবোধসম্পন্ন মানুষ আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় ও ঈমানি আবেগকে এরা থোড়াই কেয়ার করে। ইংরেজ সভ্যতায় প্রশিক্ষিত ডিজিটাল দালালরাও মাদরাসা বন্ধ করার হুমকি দিচ্ছেন। কখনো মাদরাসাকে জঙ্গি তৈরির কারখানা বলে অভিহিত করছেন। এই পরিস্থিতিতে আমাদেরকে ইতিহাসের পরীক্ষিত পথে এগোতে হবে। ইসলাম ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারেও গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। যে দেশে মানবতার হৃদয়ের টুকরো হযরত মুহাম্মদ সা.-কে একের পর এক কটূক্তি করেও বেঁচে থাকা যায় এবং শহীদ বলে মর্যাদা লাভ করা যায় (নাউযুবিল্লাহ), যে দেশে রাতের আঁধারে বাতি নিভিয়ে শত শত মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, সে দেশে ইসলাম ও স্বাধীনতা কতটুকু নিরাপদ তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। সম্প্রসারণবাদী কোনো অপশক্তির ইঙ্গিতে স্বজাতির বিরুদ্ধে এহেন নির্মমতা প্রদর্শন করা হচ্ছে কি না তা ভেবে দেখা দরকার এবং দেশে ইসলাম ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য পূর্বাহ্নেই সদূরপ্রসারী সতর্ক পরিকল্পনা নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। মহান আল্লাহ আমাদের সহায়।
নববর্ষের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা
খন্দকার মনসুর আহমদ
আমাদের জীবন থেকে আরও একটি বছর হারিয়ে গেল। আমরা একটি নতুন বছরকে বরণ করলাম। স্বভাবতই আমরা নববর্ষে নতুন স্বপ্ন ও প্রত্যাশা বুকে নিয়ে সামনের পথে এগিয়ে যেতে চাই। সে হিসেবে একটি নববর্ষ আমাদের জীবনে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা দেখছি যে সময় স্রোতের মতো ধাবমান। আমরা একটি নববর্ষকে গ্রহণ করি, আবার দেখতে না দেখতেই বর্ষটি আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যায়। নতুন বর্ষ এসে দুয়ারে করাঘাত করে। অতএব সময়ের এ ধাবমানতার মধ্যেই আমাদেরকে অনন্তের কথা ভাবতে হবে এবং অনন্ত জীবনের পাথেয় সঞ্চয় করতে হবে। নববর্ষে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে যে, পৃথিবী আখেরাতের শস্যক্ষেত। আখেরাতের ফসল ফলাবার জন্যই মহান আল্লাহ আমাদেরকে পৃথিবীতে সৃষ্টি করেছেন। যেদিন আর পৃথিবীতে আখেরাতের ফসল ফলানো যাবে না, সেদিন পৃথিবীরও আর কোনো মূল্য থাকবে না। সেদিন মহাপ্রলয়ের দিকে এগিয়ে যাবে পৃথিবী। কিছুকাল পূর্বে আমি এ বিষয়ে ছোট্ট একটি কবিতা লিখেছিলাম। প্রিয় পাঠকদের কাছে কবিতাটি তুলে ধরলাম।
বেঁচে থাকতে চাই আরও কিছুকাল
ফলাতে চাই অনন্তে’র আরও কিছু ফসল,
পৃথিবীইতো আখেরাতের শস্যক্ষেত।
এখানে এখনও আখেরাতের ফসল
ফলানো যায় দিন-রাত।
সওয়াবের সবুজ ফসলে ভরে যায় মাঠ।
যেদিন পৃথিবীতে আর ফলবে না সওয়াবের ফসল
সেদিন বিধাতা ধ্বংস করে দিবেন
পৃথিবী নামের এ গ্রহটিকে।
তাই এসো আমরা এ গ্রহে বাস করে প্রতিনিয়ত
আখেরাতের ফসল ফলাই।
আখেরাতের জীবনে অতুলনীয় সুখ-সমৃদ্ধি লাভের জন্য আমাদেরকে বহুবিধ শুভস্বপ্নের পথে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে হবে। শুভস্বপ্ন মহান আল্লাহর বড় প্রিয়। হাদিস শরিফে বিষয়টি এভাবে বলা হয়েছে, ‘মুমিনের নিয়ত তার কর্মের চেয়ে উত্তম’। কর্মের চেয়ে নিয়ত উত্তম হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে কর্মের একটি সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্তু নিয়ত বা স্বপ্নের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। স্বপ্ন হতে পারে অসীম ও অনন্তের। সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়তো পার্থিব জীবনে নাও ঘটতে পারে, কিন্তু অন্তরের সত্যিকার ভালোবাসা ও আকাক্সক্ষার কারণে, মহান আল্লাহ তার প্রতিদান দিয়ে দিবেন। কারণ তিনি অসীম করুণার অধিকারী। তাঁর করুণার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। বান্দা তাঁর করুণার পরিধি কল্পনাও করতে পারে না। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ নিজেকে বলেছেন ‘মহান করুণার আধার’। আরও বলেছেন, ‘আমার রহমত সকল কিছুতে পরিব্যাপ্ত’।
স্বপ্ন সকলেই দেখতে পারেন। তবে কৈশোর ও তারুণ্যই স্বপ্ন দেখার সর্বোত্তম সময়। তাই কিশোর ও তরুণ বন্ধুদেরকে আমি নিরন্তর স্বপ্ন দেখার আহ্বান জানাই। সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভি রহ. তার এক বক্তৃতায় বলেছিলেন ‘মানুষ শৈশবে যা কিছু চিন্তা করে ঠিক তাই মহান আল্লাহ কোনো না কোনো অবস্থায় তার জীবনে বাস্তবায়িত করে দেন। অতএব যা কিছু চিন্তা করবে, যা কিছু আকাক্সক্ষা করবে, অনেক ভেবে চিন্তে করবে’। আমাদের কাজ হচ্ছে স্বপ্ন দেখা এবং স্বপ্নের পথে অবিরাম হেঁটে চলা। আমরা দেখবো রেজায়ে এলাহি’র স্বপ্ন, আলোকিত জীবনের স্বপ্ন, শুদ্ধি ও সৎকর্মের স্বপ্ন, জীবনের সর্বত্র সুন্নতে নববীর অনুগামী হবার স্বপ্ন, উত্তম আমলের স্বপ্ন, প্রাণবন্ত নামাজের স্বপ্ন, প্রাণবন্ত রোজার স্বপ্ন, জিহাদের স্বপ্ন, বিজ্ঞ আলিম হবার স্বপ্ন, আলোকিত দেশ-জাতি ও সমাজ গড়ার স্বপ্ন, স্বদেশে ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, মিথ্যাকে পরাভূত করার স্বপ্ন, নবীজির অবমাননা প্রতিরোধের স্বপ্ন, পবিত্র কা’বা জিয়ারতের স্বপ্ন, মদিনা শরিফের স্বপ্ন, রওযা শরিফের স্বপ্ন, বাবার হজের স্বপ্ন, মায়ের হজের স্বপ্ন এবং আরও হাজারো স্বপ্ন। হৃদয়ের গহীনে আরও হাজারো স্বপ্নের বীজ রোপিত হতে পারে আমাদের। আর আমরা স্বপ্ন দেখবো না বিত্তবৈভবের এবং স্বার্থান্ধ ক্ষমতার। দেখবো না কোনো অবৈধ প্রেমের বা অন্য কোনো পাপকর্মের স্বপ্ন। এমন কোনো স্বপ্নের মোহ যদি আমাদের অন্তরে আসে, তাহলে আমরা আমাদের হৃদয়কে অবশ্যই সেই মোহ থেকে মুক্ত করবো।
মহান দয়ালু তাঁর করুণায় বান্দার অনেক স্বপ্নই বাস্তবায়িত করে দেন। আমি মহান আল্লাহর এক নগণ্য বান্দা। আমি আমার জীবনে যে সকল স্বপ্ন দেখেছিলাম তার অনেকগুলোই মহান আল্লাহ বাস্তবতার পুষ্পোদ্যানে প্রস্ফুটিত করে দিয়েছেন। তিনি দয়া করে সম্প্রতি আমার যে স্বপ্নটি বাস্তবায়ন করলেন, তা হলো আমার মায়ের হজের স্বপ্ন। আমি দীর্ঘদিন ধরে আমার বুকে এ স্বপ্ন লালন করে আসছিলাম এবং এর জন্য মহান বিধাতার সাহায্য প্রার্থনা করে আসছিলাম। মহান আল্লাহ আমার সেই স্বপ্ন আমার কল্পনার চেয়েও সুন্দর রূপরেখায় বাস্তবায়িত করলেন। সেই বেহেশতি সফরে মায়ের সহযাত্রী বানালেন এ নগণ্যকেই। মাতৃস্নেহের কোমল পরশে এমন পবিত্র সফরের কী যে আনন্দ ও প্রশান্তি তা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। এই নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা আদায় করে কোনোদিনই শেষ করা যাবে না। আমার মনে হয় ঈমানের পরে এটিই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। সুদীর্ঘ বেদনার পর আমার জীবনে যখন এই সৌভাগ্য এলো, তখন তা আমার সমগ্র সত্তাকেই নতুন ভাবে স্পর্শ করলো। আমি আমার জীবনে এক নতুন আলোর সন্ধান পেলাম। পবিত্র কা’বা ও রওজা শরিফের জিয়ারত আমার হৃদয়ে এনেছে নতুন সজীবতা, জীবনে এনেছে নতুন আনন্দ, বুকে এনেছে নতুন স্বপ্ন এবং সত্তায় এনেছে নতুন উদ্যম। প্রত্যাশী সকল মুমিনের জন্যই আমি এই সৌভাগ্য কামনা করি ।
অবশেষে প্রার্থনা করি নববর্ষে আমাদের জীবন কল্যাণের প্রাচুর্যে ভরে উঠুক। শান্তিময় হয়ে উঠুক আমাদের জীবন ও পৃথিবী। মহান আল্লাহর রহমতে পূর্ণ হোক আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। তিনিই সর্বত্র আমাদের সহায়। আমরা তার কাছেই আমাদের সকল স্বপ্নের শুভ পরিণতি কামনা করি ।