জুন'১৪ আল্লাহর রাসুল সা. পৃথিবীতে হেদায়েতের আলো ছড়িয়ে দিতে বিশ্বনবীর দায়িত্ব নিয়ে এসেছিলেন। নবীজির শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ব প্রমাণে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর হাবিবকে দান করলেন সর্বজনীন মুজিযা। এ সকল মুজিযার অন্যতম ছিল- সরাসরি আল্লাহর সাক্ষাত পেতে পবিত্র মেরাজ গমন। এই মেরাজের সৌভাগ্য অর্জনে ধন্য পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তিত্ব হযরত নবীয়ে কারিম সা.। মেরাজের প্রতি দ্বিধাহীন বিশ্বাস বিশুদ্ধ ঈমানের পূর্বশর্ত। হাদিস শরিফে মেরাজ সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা এসেছে। হযরত আনাস রাযি. থেকে বর্ণিত রাসুল সা. বর্ণনা করেছেন- ‘আমার কাছে বোরাক উপস্থিত করা হলো। বোরাক একটি শ্বেত বর্ণের পশু, গাধা অপেক্ষা বড় এবং খ"চর অপেক্ষা ছোট। সে এত দ্রুতগামী যে এক লাফে তার দৃষ্টির শেষ সীমানায় পৌঁছতে সক্ষম।’ রাসুল সা. বলেন, আমি বোরাকের ওপর আরোহণ করলাম। এবং বাইতুল মোকাদ্দাসে পৌঁছলাম। অতঃপর আমি বোরাককে ওই কড়ার সঙ্গে বাঁধলাম যে কড়ার সঙ্গে পূর্ববর্তী নবীগণ বাইতুল মোকাদ্দেসে এসে তাদের বাহন বেঁধে রাখতেন। তারপর মসজিদে প্রবেশ করে দুই রাকাত নামজ পড়লাম। অতঃপর বাইরে চলে আসলাম। তখন জিবরাইল আ. আমার কাছে মদের ও দুধের পাত্র নিয়ে আসলেন। আমি শুধু দুধের পাত্রটি গ্রহণ করলাম। জিবরাইল আ. বললেন, আপনি সৃষ্টিগত স্বভাবসম্মত বস্তু অবলম্বন করেছেন। (যার প্রতিক্রিয়ায় আপনার উম্মত স্বভাবের ধর্ম ইসলামের অনুরাগী অপেক্ষাকৃত অধিক হবে।) তারপর জিবরাইল আ. আমাকে নিয়ে আকাশপাণে উর্ধ্বগামী হলেন। সেখানে পৌঁছে জিবরাইল আ. দরজা খোলার আহ্বান জানালেন। জিজ্ঞাসা করা হলো কে আপনি? তিনি বললেন আমি জিবরাইল। জিজ্ঞাসা করা হলো আপনার সঙ্গে কে আছেন? জিবরাইল আ. বললেন, (আমার সঙ্গে আছেন) মুহাম্মদ সা.। বলা হলো তার কাছে (আপনাকে) পাঠানো হয়েছিল কি? তিনি বললেন তার কাছেই আমাকে পাঠানো হয়েছিল। তখন আমাদের জন্য দরজা খোলা হলো। আমি প্রবেশ করে আদম আ. এর সাক্ষাত পেলাম। তিনি আমাকে স্বাগত জানালেন এবং আমার জন্য কল্যাণ ও মঙ্গলের দোয়া করলেন। তারপর আমাকে নিয়ে দ্বিতীয় আকাশে আরোহণ করলেন। জিবরাইল আ. দরজা খোলার জন্য আহ্বান করলে জিজ্ঞাসা করা হলো কে আপনি? তিনি বললেন, আমি জিবরাইল। জিজ্ঞাসা করা হলো আপনার সঙ্গে কে আছেন? জিবরাইল আ. বললেন, (আমার সঙ্গে আছেন) মুহাম্মদ সা.। বলা হলো তার কাছে (আপনাকে) পাঠানো হয়েছিল কি? তিনি বললেন তার কাছেই আমাকে পাঠানো হয়েছিল। তখন আমাদের জন্য দরজা খোলা হলো সেখানে মরয়ম পুত্র ঈসা ও যাকারিয়া পুত্র ইয়াহইয়ার আ. এর সাক্ষাত পেলাম। তারা উভয়ে একে অপরের খালার ঔরসজাত। (হযরত ঈসা আ. এর মায়ের মা এবং হযরত ইয়াহইয়া আ. এর মা দুই সহোদর ছিলেন। ) তারা উভয়ে আমাকে স্বাগত জানালেন এবং আমার জন্য কল্যাণ ও মঙ্গলের দোয়া করলেন। তারপর আমাকে নিয়ে তৃতীয় আকাশের দিকে আরোহণ করলেন। জিবরাইল আ. দরজা খোলার জন্য বললেন। জিজ্ঞাসা করা হলো কে আপনি? তিনি বললেন, আমি জিবরাইল। জিজ্ঞাসা করা হলো আপনার সঙ্গে কে আছেন? জিবরাইল আ. বললেন, (আমার সঙ্গে আছেন) মুহাম্মদ সা.। বলা হলো তার কাছে (আপনাকে) পাঠানো হয়েছিল কি? তিনি বললেন তার কাছেই আমাকে পাঠানো হয়েছিল। তখন আমাদের জন্য দরজা খোলা হলো। সেখানে আমি ইউসুফ আ. এর সাক্ষাত পেলাম। তাকিয়ে দেখলাম সৌর্ন্দয গুণের পূর্ণ অর্ধেকই একা তাকে দান করা হয়েছে। তিনি আমাকে স্বগত জানালেন এবং আমার জন্য দোয়া করলেন। তারপর তিনি আমাকে নিয়ে চতুর্থ আকাশে আরোহণ করে দরজা খোলতে আহ্বান করলেন। জিজ্ঞাসা করা হলো আগন্তুক কে? তিনি বললেন আমি জিবরাইল। জিজ্ঞাসা করা হলো আপনার সঙ্গে কে আছেন? জিবরাইল আ. বললেন, (আমার সঙ্গে আছেন) মুহাম্মদ সা.। বলা হলো তার কাছে (আপনাকে) পাঠানো হয়েছিল কি? তিনি বললেন তার কাছেই আমাকে পাঠানো হয়েছিল। তখন আমাদের জন্য দরজা খোলা হলো। সেখানে আমি ইদ্রিস আ. এর সাক্ষাত পেলাম। তিনি আমাকে স্বাগত জানালেন এবং আমার জন্য মঙ্গলের দোয়া করলেন। তার সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন আমি তাকে উর্ধ্বের আসনে সমাসীন করেছি। তারপর তিনি আমাকে নিয়ে পঞ্চম আকাশে আরোহণ করনে। জিবরাইল আ. দরজা খোলতে আহ্বান করলেন। জিজ্ঞাসা করা হলো আগন্তুক কে? তিনি বললেন আমি জিবরাইল। জিজ্ঞাসা করা হলো আপনার সঙ্গে কে আছেন? জিবরাইল আ. বললেন, (আমার সঙ্গে আছেন) মুহাম্মদ সা.। বলা হলো তার কাছে (আপনাকে) পাঠানো হয়েছিল কি? তিনি বললেন তার কাছেই আমাকে পাঠানো হয়েছিল। তখন আমাদের জন্য দরজা খোলা হলো। সেখানে আমি হারুন আ. এর সাক্ষাত পেয়েছি। তিনি আমাকে স্বাগত জানালেন এবং আমার জন্য দোয়া করলেন। তারপর তিনি আমাকে নিয়ে ষষ্ঠ আকাশে আরোহণ করনে। জিবরাইল আ. দরজা খোলতে আহ্বান করলেন। জিজ্ঞাসা করা হলো আগন্তুক কে? তিনি বললেন আমি জিবরাইল। জিজ্ঞাসা করা হলো আপনার সঙ্গে কে আছেন? জিবরাইল আ. বললেন, (আমার সঙ্গে আছেন) মুহাম্মদ সা.। বলা হলো তার কাছে (আপনাকে) পাঠানো হয়েছিল কি? তিনি বললেন তার কাছেই আমাকে পাঠানো হয়েছিল। তখন আমাদের জন্য দরজা খোলা হলো। সেখানে মুসা আ. এর সঙ্গে আমার সাক্ষাত হলো । তিনি আমাকে স্বাগত জানালেন এবং আমার জন্য মঙ্গলের দোয়া করলেন। তারপর আমাকে নিয়ে সপ্তম আকাশে আরোহণ করলেন। জিবরাইল আ. দরজা খোলতে আহ্বান করলেন। জিজ্ঞাসা করা হলো আগন্তুক কে? তিনি বললেন আমি জিবরাইল। জিজ্ঞাসা করা হলো আপনার সঙ্গে কে আছেন? জিবরাইল আ. বললেন, (আমার সঙ্গে আছেন) মুহাম্মদ সা.। বলা হলো তার কাছে (আপনাকে) পাঠানো হয়েছিল কি? তিনি বললেন তার কাছেই আমাকে পাঠানো হয়েছিল। তখন আমাদের জন্য দরজা খোলা হলো। সেখানে ইবরাহীম আ. এস সঙ্গে আমার সাক্ষাত হয়েছে। তিনি বাইতুল মামুরের সঙ্গে পিঠ হেলান দিয়ে বসা ছিলেন। ওই বাইতুল মামুরে প্রতিদিন (ইবাদতের জন্য) সত্তর হাজার ফেরেশতা এসে থাকেন। একবারের পর তারা দ্বিতীয় বার আসার স্থান পান না। (প্রতিদিন নতুন নতুন সত্তর হাজার ফেরেশতা এসে থাকেন। এদৃষ্টিতে ফেরেশতার সংখ্যা বিশেষ লক্ষ্যণীয়) তারপর তিনি আমাকে সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছালেন। দেখি কী- (ওটা একটা কুল-বৃক্ষ) তার পাতা হাতির কানের আকারে এবং তার ফল (বড়) মটকার ন্যায়। নবী সা. বলেন, যখন তাকে ঘিরে ফেলল আল্লাহর সৃষ্ট বস্তুনিচয় হতে বিশেষ ঘেরাওকারী বস্তু তখন তার (রঙ-রূপের) এমন পরিবর্তন আসল যে, আল্লাহর কোনো সৃষ্টি তার রূপ ও সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে সক্ষম হবে না। তখন (আল্লাহ তায়ালা) আমার প্রতি ওহী অবর্তীণ করলেন যে সব বিষয়ের ওহী তার ই"ছা হয়েছিল। তখনই আমার (উম্মতের) ওপর প্রতি দিনে রাতে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ তিনি ফরজ করলেন। অতঃপর (ফিরার পথে) মুসা আ. এর কাছে পৌঁছলে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার পরওয়ারদেগার আপনার উম্মতের ওপর কী ফরজ করেছেন? আমি বললাম, পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ। মুসা আ. বললেন আপনার পরওয়ারদেগারের নিকট গিয়ে তা কমানোর আবেদন করুন। কারণ, আপনার উম্মত প্রতিদিন পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে সক্ষম হবে না। আমি বনী ইসরাইলদের থেকে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা লাভ করেছি এবং তাদের পরীক্ষা করেছি। নবী সা. বলেন, সেমতে আমি পরওয়ারদেগারের কাছে ফিরে গেলাম এবং বললাম, হে পরওয়ারদেগার! আমার উম্মতের ওপর (নামাজের পরিমাণ) কম করে দিন। পরওয়ারদেগার আমার (উম্মতের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত কমিয়ে দিলেন। আমি পুনরায় মুসা আ. এর নিকট পৌঁছলাম এবং বললাম, পাঁচ ওয়াক্ত কমিয়ে দিয়েছেন। তিনি বললেন আপনার উম্মত তাতেও সক্ষম হবে না। আপনি পরওয়ারদেগারের কাছে পুনরায় ফিরে যান এবং কম করার আবেদন করুন। নবী সা. বলেন, আমি আমার পরওয়ারদেগার এবং মুসা আ. এর মধ্যে বারবার আসা যাওয়া করলাম। এমনকি (প্রতিবার পাঁচ পাঁচ কমিয়ে শেষ বার) বললেন দিনে রাতে শুধু পাঁচ ওয়াক্তই থাকল। এর প্রতিটি নামাজ দশ নামাজ গণ্য হবে- এভাবে তা পঞ্চাশ নামাজই থাকল। পরওয়ারদেগার আরও বললেন, আরও (আপনার উম্মতের সুযোগ) যে ব্যক্তি কোনো নেক কাজের ই"ছা করেছে এখনও তা কার্যে পরিণত করেনি; আমি তার জন্য একটি নেকী লিখে দিবো। আর তা কাজে পরিণত করলে তার জন্য দশটি নেকী লিখবো। পক্ষান্তরে কোনো গুনাহের কাজের যদি মামুলী ই"ছা করে কিন্তু কার্যে পরিণত করে না, তবে কিছুই লেখা হবে না। আর তা কাজে পরিণত করলে একটি গোনাহ লিখবো। নবী সা. বলেন, অতঃপর আমি (উর্ধ্ব থেকে) অবতরণ করলাম। এবং মুসা আ. এর কাছে পৌঁছে তাকে (ওই সব বিষয়) অবগত করলাম। তিনি আবার বললেন, পরওয়ারদেগারের কাছে ফিরে যান এবং কম করার আবেদন জানান। রাসুল সা. বলেন, আমি হযরত মুসাকে বললাম, পরওয়ারদেগারের কাছে বারবার গিয়েছি। এখন আবার তার কাছে যেতে আমার লজ্জাবোধ হয়। মেরাজের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো পাঁচওয়াক্ত নামাজ সঠিকভাবে আদায় করা। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন। আমিন।
হাদিসের আয়নায় মহানবী সা.
শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এপ্রিল'১৪
মহানবী সা. সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের ঘোষণা ‘নিশ্চয় আপনি চরিত্রের চরম উতকর্ষের অধিকারী। (সুরা কলম) হযরত আলী রাযি. বর্ণনা করেন- নবীজি সা. অত্যন্ত প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। কথাবার্তায় সর্বদা সত্যবাদি ছিলেন। অত্যাধিক কোমল স্বভাবের ছিলেন। প্রথম দর্শনে দর্শকের ওপর তার প্রভাব পড়তো। কিন্তু তার বৈশিষ্ট্যাবলীর পূর্ণ উপলব্ধির সাথে তার সাথে মেলামেশায় মানুষ তাকে ভালোবাসতে বাধ্য হতো। তার গুণে মুগ্ধ হয়ে বলতে বাধ্য হতো- তার পূর্বে বা পরে তার তুলনা দেখি নাই। (তিরমিজি) জাবের ইবনে ছামুরাহ রাযি. বর্ণনা করেন, জোহরের নামাজ পড়ে আমি রাসুল সা. এর সঙ্গে চললাম। তিনি ঘরে ফিরছিলেন। কচি কাচারা তার প্রতি ছুটে আসতে লাগল। তিনি প্রত্যেককে তার গণ্ডদ্বয় ধরে øেহের ছোঁয়া দিচ্ছিলেন। øেহ ভরা হাতে আমার গণ্ডদ্বয়ও স্পর্শ করলেন। তার হাত মোবারক সুশীতল ছিল। এরূপ সুগন্ধময় ছিল- যেন এটা এখনই আতরের ডিব্বা থেকে বের করা হয়েছে। (মুসলিম শরিফ) আবু হুরায়রা রাযি. বর্ণনা করেন একদা রাসুল সা. কে অনুরোধ করা হলো, মুশরিকদের প্রতি বদ দোয়া করুন। তিনি বললেন আমি তো বদ দোয়ার জন্য আসিনি। আমি রহমত ও মঙ্গলরূপে এসেছি। (মুসলিম শরিফ) আনাস রাযি. বর্ণনা করেন রাসুল সা. এর সাথে কেহ মোসাফা-করদর্মন করলে সেই ব্যক্তি হাত না ছাড়া পর্যন্ত নবীজি সা. হাত ছাড়তেন না। ওই ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে নেয়ার আগ পর্যন্ত তিনিও মুখ ফিরিয়ে নিতেন না। (তিরমিজি শরিফ) আনাছ রাযি. বর্ণনা করেন, রাসুল সা. ফজর নামাজ থেকে অবসর হওয়ার পর মদিনার গৃহ-ভৃত্যরা পানি নিয়ে তার নিকট উপস্থিত হতো। (তার দ্বারা পানি বরকতময় করে নেয়ার জন্য)। রাসুল সা. তাদের প্রত্যেকের পানিতে আঙ্গুল ডুবাতেন। এমনকি প্রবল শীতের সময়ও নবীজি সা. তাদের পানিতে হাত দিয়ে থাকতেন। (মুসলিম শরিফ) আয়েশা রাযি. বলেনÑ নবীজি সা. কখনো কাউকে প্রহার করেননি। এমনকি খাদেম, ভৃত্য বা কোনো স্ত্রীকেও না। (মুসলিম শরিফ) এমনই ছিল নবীজির জীবন চরিত।
ধৈর্য ও সহিষ্ণুতায় মূর্তপ্রতীক আলী রাযি. বর্ণনা করেন, এক ইহুদি পণ্ডিত রাসুল সা. এর নিকট কিছু টাকার পাওনাদার ছিল। সে লোক একবার টাকার তাগাদায় রাসুল সা. এর নিকট আসল। তখন রাসুল সা. এর কাছে টাকা ছিল না। তাই তিনি টাকা পরিশোধ করতে অক্ষমতা প্রকাশ করলেন। ইহুদি বলল, টাকা উসুল না করে আমি যাবো না এবং আপনাকে ছাড়বো না। রাসুল সা. বললেন আচ্ছা, টাকার ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত আমি তোমার কাছ থেকে দূরে কোথাও যাবো না। সে মতে রাসুল সা. দুপুর থেকে এশা পর্যন্ত ওই ইহুদি পণ্ডিতের ধারে কাছেই থাকলেন। এমনকি রাতেও লোকটি সেখানে থাকল। রাসুল সা.ও বাড়ি ছেড়ে কোথাও গেলেন না। এই অবস্থায় ফজর নামাজ পড়া হলে সাহাবাগণ ওই ইহুদিকে ভীতি প্রদর্শন করতে লাগলেন। এবং তার উপর চাটাচাটি করতে লাগলেন। রাসুল সা. এটা টের পেয়ে সাহাবাদেরকে বাধা দিলে তারা বললেন, এক ইহুদি আপনাকে এভাবে আবদ্ধ করে রাখতে পারে? উত্তরে রাসুল সা. বললেন- আমার আল্লাহ তায়ালা নিষেধ করেছেন কারও প্রতি এমনকি কোনো অমুসলিমের প্রতিও অন্যায় আচরণ করতে। বেলা একটু বেশি হলে ইহুদি ইসলামের কালিমা পড়ে নিল এবং তার সমুদয় সম্পত্তির অর্ধেক আল্লাহর রাস্তায় দান করে দিল। সে অনেক বড় ধনাট্য ব্যক্তি ছিল। (মেশকাত শরিফ-৫২০) আব্দুল্লাহ ইবনে আবু হাছমা রাযি. বর্ণনা করেন- নবীজি সা. নবী হওয়ার পূর্বে তাঁর সাথে আমার একটি লেনদেন হলো। লেনদেনের কিছু অংশ বাকি রইল। আমি তাকে বললাম অবশিষ্ট প্রাপ্য আমি নিয়ে আসছি। এ স্থানেই তা আপনাকে অর্পণ করবো। তিনি সেখানে অপেক্ষায় থাকলেন যেন আমি সেখানে এসে বিব্রত না হই। ঘটনাক্রমে আমি সেখানে আসবার কথা ভুলে গেলাম। তিনদিন পর হঠাত আমার ওই কথা স্মরণ হলে আমি ওই স্থানে উপস্থিত হয়ে দেখলাম রাসুল সা. সেখানে আমার জন্য অপেক্ষমান আছেন। আমাকে তিনি শুধু এতটুকু বললেন, তুকি আমাকে কষ্টে ফেলে রেখেছ। তিনদিন যাবত (নির্ধারিত সময়ে) আমাকে এস্থানে আসতে হচ্ছে। ( শুধু এ জন্য যে, তুমি আমাকে না পেলে বিব্রত হবে) (আবু দাউদ শরিফ) আয়েশা রাযি. বর্ণনা করেন- একবার একদল ইহুদি নবী সা. এর সাথে সাক্ষাতে এসে সালাম করার স্বরে আসসালামু আলাইকুম এর পরিবর্তে আস সামু আলাইকুম বলল। যার অর্থ আপনার মৃত্যু হোক। নবী সা. তাদেরকে আলাইকুম- তোমাদের ওপরও, বলে উত্তর দিলেন। আর কিছুই বললেন না। আয়েশা রাযি. বললেন, আমি (রাগ সামলাতে না পেরে পর্দার ভেতর থেকেই) বললাম, তোমাদের ওপর মৃত্যু, আল্লাহর অভিশাপ ও আল্লাহর গজব পড়–ক। নবী সা. আমাকে বাধা দিয়ে বললেন- দেখ আয়েশা! সব কাজেই নম্রতাকে আল্লাহ ভালোবাসেন। আমি বললাম আপনি শুনেননি তারা কি বলল? নবী সা. বললেন- আমি শুনেছি এবং আলাইকমু- তোমাদের ওপর বলে দিয়েছি। দেখ আয়েশা! সদা নম্রতা অবলম্বনে যতœবান থাক। কুবাক্য, কটূক্তি, কঠোরতা পরিহার করে চলো। আল্লাহ তায়ালা কুবাক্য কটূক্তিকে ভালোবাসেন না। ( মুসলিম শরিফ) আনাস রাযি. বর্ণনা করেন- একদা এক অশিক্ষিত গ্রাম্য ব্যক্তি নবী সা. এর নিকট এসে হঠাত মসজিদের ভেতরেই এক জায়গায় প্রস্রাব করতে লাগল। সাহাবিগণ তার প্রতি তিরস্কার বর্ষণ ও তাকে বাধা দিতে উদ্যত হলো। নবী সা. তাদের বাধা দিয়ে বললেন- তার প্রস্রাব বন্ধ করো না। (হঠাত প্রস্রাব বন্ধ করায় রোগের আশঙ্কা থাকে)। অতঃপর ওই ব্যক্তিকে ডেকে নবী সা. নিকটে আনলেন। লোকটির নিজের বর্ণনা- আল্লাহর কসম নবী সা. আমাকে একটুও ধমকালেন না, মন্দ বললেন না, কোনো প্রকার কঠোরতা দেখালেন না। তিনি মুলায়েমভাবে আমাকে বোঝালেন, মসজিদ আল্লাহর ইবাদতের ঘর। মল-মুত্র ইত্যাদি অপবিত্র ও ঘৃণার বস্তুর স্থান এটা নয়। অতঃপর ওই স্থানে পানি ঢেলে দিলেন। (মুসলিম শরিফ) আবু হুরায়রা রাযি. বর্ণনা করেন- একদা এক ব্যক্তি নবী সা. এর কাছে তার প্রাপ্যের তাগাদায় আসল এবং কঠোর ভাষায় কথা বলল। সাহাবিগণ ওই ব্যক্তির ওপর ক্ষেপে উঠলেন। নবীজি সা. তাদেরকে বললেন- তাকে মন্দ বল না; পাওনাদারের কথা বলার অধিকার থাকে। (বুখারি শরিফ) আনাস রাযি. বর্ণনা করেন- একদা আমি নবীজি সা. এর সঙ্গে পথ চলতে ছিলাম। নবীজি সা. এর গায়ে একটা চাদর ছিল। যার পাড় মোটা, শক্ত, ও পুরু ছিল। হঠাত এক গ্রাম্য ব্যক্তি এসে নবীজি সা. কে ওই চাদরে জড়িয়ে জোরে টান দিল এবং বলল, জনসাধারণকে দেয়ার যে মাল আপনার হাতে রয়েছে তা হতে আমাকে কিছু দেয়ার ব্যবস্থা করুন। তার টানের চোটে নবীজি সা. এর গ্রীবার ওপর ওই চাদরের রেখা পড়ে গেল। নবীজি সা. তার প্রতি তাকিয়ে হাসলেন। এবং তাকে সাহায্য দেয়ার আদেশ করলেন।(বুখারি শরিফ) ইতিহাস প্রসিদ্ধ দানবীর হাতেম তাঈ এর পুত্র ‘আদি’। তারা ছিল খৃষ্টান। তাদের ‘তাইগোত্র’ প্রভাবশালী ও প্রতাপশালী ছিল। আদি ছিল গোত্রপতি। মুসলমানগণ তাদের বস্তির উপর আক্রমণ করলে আদি স্বপরিবারে পলায়ন করে সিরিয়া চলে যায়। তার এক বৃদ্ধা ভগ্নি ছিল। সে বন্দি হয়ে মদিনায় উপণিত হয়ে নবী সা. এর করুণা ভিক্ষা চায়। রাসুল সা. তার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তাকে শুধু মুক্তিই দিলেন না; বরং তার ভ্রাতার নিকট সিরিয়ায় পৌঁছবার জন্য সমুদয় ব্যবস্থাও করে দিলেন। সে গিয়ে ভ্রাতা আদিকে নবী সা. এর অসাধারণ অমায়িকতার কথা শুনালে আদি নবী সা. এর চরনে আশ্রয় গ্রহণে সদলবলে মদিনায় চলে আসলো। উক্ত আদির বর্ণনা- সর্বত্র বিজয়ের অধিকারী, মুসলিম জাতির প্রধান, মদিনার রাষ্ট্রপ্রতি সম্পর্কে তিনি অন্যরকম ধারণা পোষন করছিলেন। তিনি মদিনায় উপণীত হয়ে দেখতে পেলেন- ভক্ত অনুরক্তদের পরিবেশে নবীজি সা. বসে আছেন। এমন সময় একজন অতি সাধারণ মহিলা এসে নবী সা. কে অনুরোধ করল- দরবার থেকে উঠে গোপনে ও নীরবে তার কথা শোনবার জন্য। তার আবেদনের সঙ্গে সঙ্গে রাসুল সা. তার সাথে দূরে গিয়ে তার কথা শুনতে লাগলেন। মহিলাটির কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত রাসুল সা. ধৈর্যের সাথে তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকলেন। হাতেম পুত্র আদি বলেন, উদারতার এই দৃষ্টান্ত দেখে আমি অভিভূত হলাম। আমার দৃঢ় প্রত্যয় জন্মাল যে তিনি আল্লাহর প্রেরিত রাসুল সা.। ( সিরাতুনন্নবী) রাসুল সা. কারও অসুস্থতার সংবাদ পেলে তাকে দেখতে যেতেন। প্রতিবেশী অমুসলিমকেও রোগশয্যায় দেখতে গেছেন। রোগীর পাশে বসে তার কপাল ও শিরায় হাত রাখতেন। সান্ত্বনা দিয়ে বলতেন- ভয় নাই, কষ্টের বিনিময়ে গোনাহ মাফ হবে। রোগীর শরীর বা যাতণা স্থানে হাত বুলিয়ে দোয়া পড়তেন। এই ছিলেন দুজাহানের সরদার, পিয়ারা নবী হযরত মুহাম্মদ সা.।
নারীদের উপযুক্ত মর্যাদা দিয়েছেন রাসুল সা.
শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.
নারীজাতি সমাজের অর্ধাংশ এবং অর্ধাঙ্গিনী। তাদের প্রতি ঘৃণা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও উপেক্ষা এবং অন্যায়-অত্যাচার সমাজকে পুঙ্গ করে রাখে। অন্ধকার যুগে তো সমাজ নারীদের প্রতি এতই হিংস্র, নির্দয়-নিষ্ঠুর ও নির্মম ছিল যে, মেয়ে সন্তানকে ভালোবাসত না কেউই। তাদেরকে অনেকে জীবিত কবর দিয়ে দিত। বর্তমান যুগ যাকে নারীদের রাজত্বের যুগ বলা যেতে পারে, এই যুগেও মেয়ে সন্তান জন্মের প্রতি অনেক কম লোকই আনন্দিত হয়। এ কি নারীদের প্রতি বৈরীভাবের লক্ষণ নয়? রাসুল সা. মেয়েদের প্রতিপালন হতে সর্বস্তরে তাদের মান-মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অতুলনীয় শিক্ষা ও আদর্শ রেখেছেন। রাসুল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি দুইটি মাত্র মেয়েকে সুন্দররূপে ভরণ-পোষণ ও প্রতিপালন করবে, সে বেহেশতে আমার এত নিকটবর্তী হবে যেরূপ হাতের আঙ্গুলসমূহ পরস্পর নিকটবর্তী থাকে। (মুসলিম শরিফ)। রাসুল সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি তিনটি মেয়ে বা তিনজন ভগ্নির প্রতিপালন ও শিক্ষাদান সুচারুরূপে করবে- যাব না তাদের নিজ নিজ ব্যবস্থা হয়; তার জন্য বেহশত অবধারিত হবে। দুইজন সম্পর্কে জিজ্ঞাসায় রাসুল সা. বলেছেন, দুই জনের প্রতিপালনেও তাই। এক জনের প্রতিপালন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা কারা হলে রাসুল সা. তদুত্তরে তাই বলেছেন। মেশকাত শরিফ ৪২৩) রাসুল সা. বলেছেন, যার নিকট কোনো মেয়ে থাকে এবং সে মেয়েকে তুচ্ছ না করে, ছেলেকে অগ্রগণ্য না করে আল্লাহ তাকে বেহেশত দান করবেন। (আবু দাউদ) রাসুল সা. বলেছেন, তোমার কোনো মেয়ে স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে নিরাশ্রয়রূপে তোমার আশ্রয়ে ফিরে আসলে তার জন্য তুমি যা ব্যয় করবে তা তোমার জন্য সর্বাধিক উত্তম দান এবং তা আল্লার সন্তুষ্টি উদ্দেশ্যের ব্যয় বলে গণ্য হবে। (ইবনে মাজাহ শরীফ) রাসুল সা. বলেছেন, নারী জাতি সৃষ্টিগতভাবেই একটু বক্র স্বভাবের; পূর্ণ সোজা করতে চাইলে ভেঙ্গে যাবে তথা বিচ্ছেদের পালায় এসে যাবে। সুতরাং তাকে বাঁকা থাকতে দিয়ে তার সঙ্গে তোমাদের জীবন নির্বাহ করতে হবে। তোমাদের প্রতি আমার বিশেষ উপদেশ- তোমরা নারীদের প্রতি উত্তম ও ভালো হয়ে থাকবে। (মুসলিম শরিফ) রাসুল সা. বলেছেন, নারীগণ নামাজ-রোজা, সতীত্ব রক্ষা ও স্বামীর আনুগত্য- এই সংক্ষিপ্ত আমল দ্বারা আল্লাহ তায়ালার নিকট এত বড় মর্যদা লাভ করবে যে, বেহেশতের যে কোনো শ্রেণিতে সে প্রবেশ করার অধিকার লাভ করবে। (মিশকাত শরিফ ২৮১) রাসুল সা. বলেছেন, পরিপূর্ণ ঈমানদার ওই ব্যক্তি যে তার সহধর্মিণীর সহিত সদ্ব্যবহার করে এবং তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়। (তিরমিজি শরিফ) একদা রাসুল সা. কড়া নির্দেশ দিলেন, গৃহিনীদেরকে কেউ প্রহার করতে পারবে না। অতঃপর একদিন ওমর রা. নবী সা. এর নিকট করলেন যে, নারীগণ অত্যন্ত বেপরোয়া হয়ে গেছে। সেমতে নবী সা. (প্রয়োজন স্থলে সংযমের সঙ্গে) প্রহারের অনুমতি দিলেন। এরপর বহুসংখ্যক মহিলা তাদের স্বামীর প্রতি অভিযোগ নিয়ে রাসুল সা. এর গৃহে ভিড় জমাল। তখন রাসুল সা. কঠোর ভাষায় বললেন, অনেক মহিলা তাদের স্বামীদের সম্পর্কে অভিযোগ করছে, ওইরূপ স্বামীগণ মোটেই ভালো মানুষ নয়। (আবু দাউদ শরিফ) রাসুল সা. বলেছেন, সহধর্মীনীর সঙ্গে যে উত্তম জীবন-যাপনকারী হয় সেই উত্তম মানুষ। আমি আমার সহধর্মীণীদের সঙ্গে উত্তম জীবনযাপন করি। (তিরমিজি শরিফ) সত্যই রাসুল সা. সহধর্মীণীর প্রতি অতি উত্তম ছিলেন। একবার সফর অবস্থায় বিবি সফিয়্যা রাজিয়াল্লাহু তায়ালা আনহার জন্য উটে আরোহণ কঠিন হলো। (তার পক্ষে উট উচু ছিল)। নবী সা. নিজ উরু পেতে দিলেন। সফিয়্যা রা. সিঁড়ির মতো নবীজির উরু মোবারকের উপর পা রেখে উটে চড়লেন। (বুখারি শরিফ) আর একবার রাসুল সা. এতেকাফে ছিলেন। সফিয়্যা রা. রাসুল সা. এর সঙ্গে সাক্ষা করতে আসলেন, তার প্রত্যাবর্তনের সময় রাসুল সা. তাকে মর্যাদার সঙ্গে বিদায় দানে তার সঙ্গে মসজিদের দরওয়াজা পর্যন্ত আসলেন। (বুখারি শরিফ) আয়েশা রা. কম বয়স্কা ছিলেন। রাসুল সা. এর গৃহে নয় বসর বয়সে এসেছিলেন। রাসুল সা. তার বাল্যবয়সের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখতেন। আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন, কতিপয় বান্ধবী ছিল যাদের সঙ্গে আমি খেলাধুলা করতাম। রাসুল সা. গৃহে আসলে ওরা লুকিয়ে যেত। রাসুল সা. ওদেরকে তালাশ করে আমার নিকট পাঠতেন। তারা পুনঃ আমার সহিত খেলা জুড়ে দিত। (বুখারি শরিফ) আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন- একবার ঈদের আনন্দে খঞ্জর চালনার জিহাদি খেলা মসজিদে হচ্ছিল। রাসুল সা. আমাকে গৃহদ্বারে তার পিছনে দাঁড় করিয়ে তার কাঁধের ফাঁক দিয়ে ওই খেলা দেখালেন। খেলা দেখায় আমার মন ভরে না যাওয়া পর্যন্ত তিনি দাঁড়িয়ে থাকলেন। আয়েশা রা. বলেন- খেলা দেখায় লালায়িতা যুবতী কত দীর্ঘসময় দেখবে তা সহজেই অনুমেয়। (বুখারি শরিফ) আয়েশা রা. বর্ণনা করেছেন, একদা রাসুল সা. আমার সঙ্গে দৌঁড়-প্রতিযোগিতা করলেন। তাতে আমি জয়ী হলাম। অনেক দিন পর যখন আমার শরীর ভারী হয়ে গিয়েছিল, তখন আর একদিন সেই প্রতিযোগিতা করলে আমি পরাজিত হলাম। রাসুল সা. তখন কৌতুক করে বললেন, আমার সেই পরাজয়ের বিনিময়ে তোমার এই পরাজয়। (আবু দাউদ শরিফ) রাসুল সা. এর কী মধুর সম্পর্ক ছিল সহধর্মীণীদের সঙ্গে। রাসুল সা. তাদের সঙ্গে সময়ে খোশ-গল্প জুড়ে দিতেন। ঙ্গুখারি শরিফে ‘হাদিছে উম্মেযারা’ নামে হাদিস উল্লেখ আছে- এক সময় আরবের এগারোজন সুসাহিত্যিক মহিলা একত্র হয়ে নিজ নিজ স্বামীর অবস্থা বর্ণনায় ভাষা জ্ঞানের বাহাদুরী দেখাল। তন্মধ্যে ‘উম্মেযারা’ নাম্নী মহিলা সুদীর্ঘ ও সুললিত ভাষায় নিজ স্বামীর সর্বাধিক বেশি প্রশংসা করল। রাসুল সা. আয়েশা রা. কে নিকটে সোহাগময় পরিবেশে বসিয়ে সেই একাদশ মহিলার প্রসিদ্ধ গল্পটি শুনালেন এবং বললেন, আয়েশা! উম্মেযারার স্বামী তার জন্য যেরূপ ছিল আমি তোমার জন্য সেরূপ। নারী সম্প্রদায়ের শিক্ষার প্রতিও রাসুল সা. অনুরাগী ছিলেন। রাসুল সা. এর আমলে দীন-শিক্ষার একমাত্র কেন্দ্র রাসুল সা.ই ছিলেন; রাসুল সা. এর ভাষণসমূহ বিশেষভাবে শরিয়তের বিশেষ বস্তু ছিল। তাই রাসুল সা. এর ভাষণে নর-নারী নির্বিশেষে সকলের উপস্থিতির আদেশ ছিল। জুমা ও ঈদের নামাজে রাসুল সা. খোতবা বিশেষ ভাষণরূপে দিতেন; সেই ভাষণ শোনার জন্য সকলেই উপস্থিত হতেন। তবে নারীগণ সকলের পেছনে থাকতেন। একবার ঈদের খোতবা সাধারণ নিয়মে প্রদানের পর রাসুল সা. লক্ষ্য করলেন, নারীদের পর্যন্ত তার কথা পূর্ণ রূপে পৌঁছেনি। তাই রাসুল সা. খোতবাস্থল হতে ফিরার পথে বেলাল রা. কে সঙ্গে করে নারীদের অবস্থান স্থলে পৌঁছে তথায় নারীদের লক্ষ্যে পুনঃভাষণ দিলেন। (বুখারি শরিফ) আরও একবারের ঘটনা-নারীগণ রাসুল সা. নিকট অভিযোগ করল, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের মজলিসে তারা পুরুষদের ভিড়ের কারণে পূর্ণ উপকৃত হতে পারে না; সেমতে তাদের অভিলাষ অনুযায়ী রাসুল সা. তাদের অনুরোধ রক্ষায় ভিন্ন মজলিসের ব্যবস্থা করলেন। নারীদের প্রতি রাসুল সা. কত অধিক সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং তাদের কত বেশি মর্যদা দিতেন! রাসুল সা. তার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ-বিদায় হজ্জের নীতি নির্ধারণী ঐতিহাসিক ভাষণে নারীদের মর্যদা দানের কর্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। সেই ভাষণে তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন- নারীদের উপর স্বামীদের যেরূপ হক্ব ও দাবি আছে তদ্রুপ স্বামীদের উপর স্ত্রীদেরও হক্ব এবং দাবি আছে। তিনি আরও বলেছেন-নারীদের সম্পর্কে আমার বিশেষ নির্দেশ যে, তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার ও সর্বপ্রকার কল্যাণকর ব্যবস্থা সর্বদা বজায় রাখা। তাদেরকে তোমরা লাভ করেছ আল্লাহর আমানতরূপে, তাদের সতীত্বকে ভোগ করছ আল্লাহর বিধানের অধীনে। সেই আল্লাহর রসুল আমি, অতএব তাদের সম্পর্কে আমার নির্দেশ পালনে তোমরা বাধ্য। একদা আবু বকর রা. রাসুলুল্লাহ সা. এর গৃহে আসছিলেন; বাহির থেকে বিবি আয়েশার উচ্চস্বর শুনতে পেলেন- তিনি রাসুল সা. এর সঙ্গে প্রতিউত্তর করছিলেন। আবু বকর রা. ক্রোধ ভরে ঘরে প্রবেশ করে আয়েশা রা. কে এই বলে শাসাতে লাগলেন, এত বড় স্পর্ধা! রাসুল সা. এর আওয়াজের উর্ধ্বে তোমার আওয়াজ! এই বলে আয়েশা রা. কে চড় মারতে উদ্যত হলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লাম আয়েশাকে প্রীতির ভাষা ও কন্ঠে বললেন, দেখলে তো মিঞা সাহেব হতে কত কষ্টে তোমাকে বাঁচিয়াছি? (আবু দাউদ শরিফ)