ছাত্র গড়ার নিপুণ কারিগর ছিলেন শাইখুল হাদীস রহ. -মুফতি দিলাওয়ার হুসাইন
জুলাই'আগস্ট ১৪
রাহমানী পয়গাম : শাইখুল হাদীস রহ. কে প্রথম কবে দেখেছেন? মুফতি দিলাওয়ার হুসাইন : শাইখুল হাদীস রহ. কে প্রথম দেখার স্মৃতি আমার হুবহু মনে আছে। ১৯৮০ সালের কথা। আমি তখন চাঁদপুর জেলা শাহরাস্তি থানার জামিয়া ইসলামিয়া খেড়িহর মাদরাসায় শরহেজামি পড়ি। সেখান থেকে উজানির বার্ষিক মাহফিলে এসেছিলাম বুযুর্গদের বয়ান শুনতে। মাহফিলে তখন বয়ান করছিলেন খতিবে আযম মাওলানা সিদ্দিকুর রহমান সাহেব রহ.। তখন হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. ও হযরত শাইখুল হাদীস রহ. দুইজন এক সাথে স্টেজে উঠলেন। রাহমানী পয়গাম : শাইখুল হাদীস রহ. কী বিষয়ে বয়ান করেছিলেন? মুফতি দিলাওয়ার হুসাইন : হুজুর প্রথমে মাসনুন খুতবা পাঠ করলেন। এরপরেই কয়েকটি আরবি ও ফার্সি শের-কবিতা পড়লেন। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে হুজুর পড়লেন- ‘আমুররু আলাদ্দিয়ারি দিয়ারি লাইলা-উকাব্বিলু যাল যিদারা ওয়া যাল যিদারা। ওয়ামা হুব্বুদ্দিয়ারি শাগাফনা কালবি-ওয়ালাকিন হুব্বু মান সাকানাদ্দিয়ারা।’ একটি ফার্সি শের পড়লেন। ‘পায়ে সাগ বুসিদা মজনু খালকে গুফতা ইচে বুদ-গুফতে আসাগ গাহে গাহে কোয়ে লাইলা রাফতা বুদ।’ কবিতায় মজনু বলছে, ‘আমি লায়লার গলিতে ঘুরাঘুরি করি। তার বসতভিটায় চুমু খাই। তোমরা কেবল এটাই দেখ, আসলে আমি বসতভিটায় চুমু খাই না। এগুলোতে আমার লায়লার বাতাস লাগে তাই এগুলোতে চুমু খাই। কুকুরের পায়ে চুমু খাই, লোকেরা জানতে চায় কুকুরের পায়ে কেন চুমু দাও। আরে আমি তো কুকুরের পায়ে চুমু খাই না। লায়লা যেই মাটি দিয়ে হাঁটে এই কুকুরও সেই মাটি দিয়ে হেঁটেছে। আমার লায়লার পায়ের বালি কুকুরের পায়ে আছে। আমি লায়লার পায়ের বালিকে চুমু দেই। কুকুরের পাকে চুমু দেই না।’ শেরগুলোর অনুবাদ করে হুজুর বললেন, আমি হযরত ক্বারী ইব্রাহীম রহ.কে দেখিনি। আমি এখানে এসেছি ওই চক্ষুগুলোকে দেখতে, যেই চক্ষুগুলো ক্বারী ইব্রাহীম রহ.কে দেখেছে। এই কথা বলার পর খৈ যেভাবে ফুটে তেমনি পুরা ময়দানে যেন খৈ ফুটতে শুরু করলো। উজানির মাহফিলে এমনিতেই মুরিদানরা ক্বারী ইব্রাহীম রহ. এর আশেক। আবার সেখানে মাজযুব আশেকদের লাফালাফিরও প্রচলন আছে। সেখানে যখন হুজুর অদ্ভুত ভঙ্গিতে ক্বারী ইব্রাহীম রহ. এর ভালোবাসায় এমন একটি দামি কথা বললেন, তখন পুরা মাহফিলে নড়াচড়া পড়ে গেল। মাতোয়ারা হয়ে গেল সবাই। কেউ যেন আর বসা নেই। সবাই যেন লাফালাফি শুরু করেছে। হুজুর মাত্র একটা কথা বলেছেন। তাতেই এই অবস্থা। সবাই তো হয়রান, একি। সেদিনই প্রথম আমি হুজুরকে দেখলাম। ওই এক দেখাতেই হুজুরের প্রতি মুহাব্বত আমার অন্তরের মধ্যে বসে যায়। রাহমানী পয়গাম : শাইখুল হাদীস রহ. এর কাছে কী কী কিতাব পড়েছেন? মুফতি দিলাওয়ার হুসাইন : হুজুরকে প্রথম দেখার পরেই সংকল্প করেছিলাম যেকোনো মূল্যে হুজুরের কাছে পড়বো, এক বছর হলেও পড়বো । সে অনুযায়ী ১৯৮৩ ইং সনে আমি লালবাগে জালালাইন জামাতে ভর্তি হই। আমাদের জালালাইনের বছর হুজুরের কোনো ক্লাস ছিল না। তবে সুল্লামুল উলুমের পরীক্ষা হুজুর নিতেন। সেই পরীক্ষা হুজুরের কাছে দিয়েছি। মেশকাতের বছর হুজুরের দরসে বসার সুযোগ হলো। হুজুর মেশকাত সানি পড়াতেন। আর মেশকাত আউয়াল পড়াতেন মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ সাহেব রহ.। হুজুর আমাদেরকে কিতাবুর রিকাক থেকে আগে পড়িয়েছেন। শুরু থেকে আগে পড়াননি। হুজুর বলতেন, এর আগ পর্যন্ত আহকামাত সম্পর্কে আলোচনা। আর আহকামাত সম্পর্কে আলোচনা তোমরা অন্য জায়গায় পাবে। কিন্তু এখানে আছে প্রত্যেক জামানার সাথে মিল দেয়ার হাদিস। যদি ব্যাখ্যাগ্রন্থ দেখ তাহলে যেই জামানার শরাহ ওই জামানার সাথে মিল পাবে। এই জামানার সাথে মিল পাবে না। মিল পেতে হলে দরসে পড়া লাগবে। তাকরির শুনতে হবে। হুজুর এই জামানার সাথে দারুনভাবে মিল দিয়ে আমাদেরকে হাদিসগুলো পড়িয়েছেন। রাহমানী পয়গাম : আপনার দৃষ্টিতে শাইখুল হাদীস রহ. এর দরসের বৈশিষ্ট্য কী ছিল? মুফতি দিলাওয়ার হুসাইন : হুজুরের দরসের তো অসংখ্য বৈশিষ্ট্য ছিল। তার মধ্যে কয়েকটি বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। এক. সাধারণ-অসাধারণ সবাই হুজুরের দরস বুঝতো। একথা কেউ বলতে পারতো না যে, আমি বুঝি নাই। দুই. হুজুর দরসের মধ্যে নির্দিষ্ট ভাষা ব্যবহার করতেন না। যেখানে যে ভাষায় বললে ছাত্রদের বুঝতে সুবিধা হবে সেটা বলতেন। কখনো আরবি বলতেন, প্রয়োজনে ফার্সি বলতেন। মূল তাকরির হতো উর্দূতে। আর বাংলাতো আছেই। সেটা আবার কখনো বিক্রমপুরের কথ্য ভাষায়। আবার কখনো ব্রাক্ষণবাড়িয়ার ভাষায়। আমি হুজুরের মেশকাত সানির তাকরির লিখেছিলাম। বুখারি সানির তাকরিরও লিখেছি, প্রায় ১২০০ পৃষ্টার মতো হবে। ওই তাকরিরের মধ্যে দেখা যায় আরবিও আছে, ফার্সিও আছে, উর্দূও আছে, বাংলাও আছে। তিন. হুজুরের দরসের একটা বৈশিষ্ট্য ছিল কোনো তারাহুড়া নেই। বছরের শুরুতে যেভাবে তাকরির হতো, বছরের শেষেও তেমন। অনেকে শুরুতে অনেক তাকরির করলেও শেষে গিয়ে তাড়াহুড়া করে। হুজুর কখনোই এমন করতেন না। চার. হুজুরের দরসের মধ্যে প্রশ্নের প্রয়োজন থাকতো না। কারণ পড়াতে পড়াতে হুজুরের এই পরিমাণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল যে, ছাত্রদের কোন জায়গায় কী প্রশ্ন হতে পারে সেটা হুজুরের আগেই জানা থাকতো। তিনি তাকরির এমনভাবে করতেন যাতে প্রশ্ন না আসে। প্রশ্নের সমাধান আগেই হয়ে যায়। রাহমানী পয়গাম : এর কোনো দৃষ্টান্ত? মুফতি দিলাওয়ার হুসাইন : মেশকাত পড়ার সময় যখন এই হাদিসটি আসলো- ‘ইন্নাল্লাহা লা য়ানযুরু ইলা সুয়ারিকুম ওয়ালা ইলা আমওয়ালিকুম, ওয়ালাকিন য়ানযুরু ইলা কুলুবিকুম ওয়া নিয়্যাতিকুম।’ এখানে সাধারণভাবেই প্রশ্ন হয় যে, আল্লাহ পাক যখন আমাদের আমল দেখবেন না, শুধু নিয়ত দেখবেন, তাহলে আর আমল করার দরকার কী। ভণ্ডরা তো তাহলে ঠিকই বলে, আমাদের অন্তর ঠিক আছে। এখানে এই প্রশ্নটা তো হয়েই থাকে। কিন্তু হুজুর পড়ানোর সময় অনুবাদ করলেন, আল্লাহ তায়লা শুধু মাত্র তোমাদের আমল ও সুরুত দেখবেন না, বরং তোমাদের অন্তর ও নিয়তও দেখবেন। এরপর প্রশ্ন হয় ‘শুধু মাত্র’ কিসের অর্থ। হুজুর বলেন, এখানে ইন্না আনা হয়েছে। না আনলেও চলতো। ইন্নার কারণে এখানে হসরের অর্থ পাওয়া গেছে। এখান থেকেই অর্থ হয়েছে ‘শুধু মাত্র’। সুবহানাল্লাহ। তিনি যে কত বড় মুহাদ্দেস ছিলেন এখান থেকেই অনুমান করা যায়। একটি মাত্র শব্দ দিয়ে তিনি সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিলেন। পাঁচ. হুজুরের দরসের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি কখনো সবক মিস করতেন না। এত ব্যস্ততা, রাজনীতি, মাহফিল, লেখালেখি, সংসার এতকিছুর পরও তিনি দরস মিস দিতেন না। চাই সুস্থ থাকুন বা অসুস্থ। মাঝে মাঝে এমন হতো যে, কোমরের ব্যাথায় হুজুর ভালো করে বসতে পারতেন না। চেহারায় ফুটে উঠতো ব্যাথার চিহ্ন। আমরা কখনো বলতাম হুজুর, আপনার কমরে মনে হয় ব্যাথা, আজকে থাকুক। হুজুর বলতেন, ‘আরে তোমরা কী বলো, কোমর ভেঙে যাক আর সোজা থাকুক, জবান ঠিক থাকলেই তোমাদের পড়া ঠিক থাকবে।’ ছয়. হুজুরের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল, ছাত্র গড়া। অনেক সময় ছাত্র নিজেও বুঝতো যে হুজুরের এত খেয়াল ছাত্রদের দিকে। রাহমানী পয়গাম : এ সংক্রান্ত কোনো স্মৃতি কি মনে করতে পারেন? মুফতি দিলাওয়ার হুসাইন : একবার পরীক্ষার ছুটি চলছে। তখন আমার উত্তরবঙ্গে মাহফিল ছিল। ঘটনাক্রমে আমি এক সপ্তাহ মাদরাসায় আসতে পারিনি। আমাকে না দেখে হুজুর একদিন ছাত্রদের জিজ্ঞাসা করলেন, দেলোয়ার কোথায়? কেউ একজন বলে দিল, ওয়াজ করতে গেছে। এ কথা শুনে হুজুরের চেহারা কালো হয়ে গেল। মনে হলো তিনি অসন্তুষ্ট হলেন। সেদিন আসার পর হুজুর আমাকে কিছুই বলেননি। এর কিছুদিন পর হাফেজ মুসা সাহেব লালবাগের হেফজখানার ওস্তাদ আমাকে তাদের গ্রামের বাড়ির মাহফিলে দাওয়াত দিলেন। একই মাহফিলে যে হযরত শাইখুল হাদীস রহ.কেও দাওয়াত দিবেন সেটা আমাকে বলেননি। আমিও জানি না। এলাকায় গিয়ে দেখি পোস্টারে হুজুরের নাম। হুজুর যাবেন শুনলে তো আর আমি দাওয়াত নিতাম না। আমার অবস্থা তো খারাপ হয়ে গেল। মহা চিন্তায় পড়ে গেলাম। হুজুর যদি জানতে পারেন আমি এখানে ওয়াজ করতে এসেছি তাহলে কী করবেন, আল্লাহই ভালো জানেন। যাক আমি গিয়ে মুসা সাহেবকে বললাম, আমাকে আসরের পরে বয়ান দিন। যাতে শাইখুল হাদীস সাহেব পৌঁছার আগে আগে আমি বয়ান করে চলে যেতে পারি। হুজুর যাতে টের না পান আমি এখানে এসেছিলাম। তাদের যতই অনুরোধ করলাম, তারা আমার কথা শুনলো না। আমাকে তারা মাগরিবের পরে বয়ান করতে দিল। আমি বয়ান শুরু করার কিছুক্ষণ পর হুজুরের আগমন উপলক্ষে মিছিলের আওয়াজ পেলাম। আমার তো ভয়ে কলিজায় আর পানি নাই। কিন্তু যেহেতু ওয়াজ করতে বসেছি কিছুতো বলতেই হবে। তাই কিছু কথা বললাম। বয়ান শেষ করে ভয়ে আমি আর কোনো দিকে যাচ্ছি না। স্টেজেই বসে আছি। একটু পরে একজন এসে বললো, আপনাকে শাইখুুল হাদীস সাহেব ডেকেছেন। এবার তো ভয়ে আমার মধ্যে কম্পন শুরু হয়ে গেল। হুজুরের কাছে যাওয়ার সাহস কোনোভাবেই হলো না। একটু পরে আরেকজন এসে খবর দিল, তখনও আমার একই অবস্থা। একটু পরে আরেকজন, এখন দেখি না গেলে আর নিস্তার নাই। গেলাম। গিয়ে দেখি হুজুর শুয়ে আছেন। চোখ দুটো বন্ধ। একজন মাথায় তেল দিচ্ছে। আমি নিচু স্বরে সালাম দিলাম। হুজুর বললেন, ভয় পাইছো না? ভয় পাইছো? দেখো তোমার মতো আমিও একদিন ওয়াজ করতে গিয়েছিলাম। আমার উস্তাদ হযরত শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. জানতে পেরে আমাকে খবর দিলেন, তোমার মতো আমিও প্রথমে ভয়ে আসি নাই। তখন হুজুর আমাকে যেই কথাটা বলেছিলেন, তোমাকেও সেই কথাটাই বলছি- ‘তোমার বয়ান ভালো লেগেছে। আমি খুশি হয়েছি। তবে তুমি এই এই ভুল করেছো। এটা এভাবে না, ওভাবে...’ বলে কয়েকটি জায়গা তিনি শুধরে দিলেন। এরপর বললেন, ওয়াজ করবে। এই ময়দান ছাড়বে না। এটা জরুরি। তবে আমার পদ্ধতিতে। এক নম্বরে থাকবে দরস-তাদরিস। আর দুই নম্বরে থাকবে ওয়াজ মাহফিল। এটাকে কখনো এক নম্বর বানাবে না। রাহমানী পয়গাম : ছাত্র গড়ার প্রতি শাইখুল হাদীসের দৃষ্টি কেমন ছিল সেটা বুঝা যায় এমন কোনো ঘটনা যদি বলতেন? মুফতি দিলাওয়ার হুসাইন : হুজুর দরসের মধ্যে খুব বেশি প্রশ্ন করলে বিরক্ত হতেন। কারণ এর পিছনে বেশি সময় গেলে তো অন্য ছাত্রদের ক্ষতি হয়। এ কারণে আমি হুজুরের কাছে লিখিত প্রশ্ন পেশ করতাম। যেমন, যাবতে ওয়েলাদাত তথা পরিবার পরিকল্পনার মাসআলা নিয়ে হুজুর তাকরির পেশ করলেন। আমার বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন জাগলো। আমি প্রায় নয় পৃষ্ঠাব্যাপি প্রশ্নসমূহ লিখলাম বিভিন্ন কিতাবের হাওয়ালা দিয়ে। লিখিতভাবে প্রশ্নটি হুজুরের কাছে পেশ করলাম। হুজুর লেখাটা হাতে করে বাসায় নিয়ে গেলেন। পরবর্তীতে হুজুর আমার সকল প্রশ্নের জবাব দিলেন। কিন্তু ক্লাসে নয়, ক্লাসের বাইরে। এতে বুঝা যায় হুজুর সম্পূর্ণ লেখা পড়েছেন। যদি ছাত্র গড়ার খেয়াল না থাকতো তাহলে কষ্ট করে এত বড় লেখা পড়তেন না। কিন্তু তিনি পড়েছেন। এবং যেসব বিষয়ে জবাব দেয়া দরকার সে সব বিষয়ে জবাবও দিয়েছেন। আবার জবাব ক্লাসে দেননি, কারণ ক্লাসে জবাব দিলে অন্য ছাত্রদের সময় নষ্ট হবে। রাহমানী পয়গাম : শাইখুল হাদীস রহ. ছাত্রদের কীভাবে শাসন করতেন? মুফতি দিলাওয়ার হুসাইন : দুই একটা ঘটনা বলি তাহলে হয়তো বুঝে আসবে হুজুরের শাসনের পদ্ধতি কেমন ছিল। হুজুর তখন রাজনীতির ময়দানে খুব তৎপর। হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর খেলাফত আন্দোলনের তখন যৌবন। একবার হাফেজ্জী হুজুর রহ. বাইতুল মুকাররমে সমাবেশ ডাকলেন। এরশাদ সাহেব তখন ক্ষমতায়। সরকার সমাবেশ করার অনুমতি দিল না। তখন এটা দোয়ার মাহফিল নাম দিয়ে স্থানান্তরিত হলো। বিশাল আয়োজন চলছে। আমরা সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করলাম। ওদিকে হুজুরের ক্লাসও তো বাদ দেয়া যায় না। একদিন আমাদের সাথি গোলাম মাওলা সাহেব (রাহমানিয়ার ওস্তাদ ছিলেন, এখন আছেন গাজিপুর।) হুজুরকে গিয়ে বললেন, কালকে তো সমাবেশ হবে। আমাদের যাওয়ার সুযোগ আছে কি না? বা ক্লাস হবে কি না? শাইখুল হাদীস রহ. বললেন, এই প্রশ্ন কেন? সমাবেশ কি তোমাদের? তোমাদের কাজকি সমাবেশ করা? তোমাদের কাজ হলো লেখাপড়া করা। সবক একদিনও বন্ধ হবে না। গোলাম মাওলা সাহেব বললেন, হুজুর অনুষ্ঠানে আমাদের কিছু কাজ দেয়া হয়েছে। কি কাজ দেয়া হয়েছে? কে দিয়েছে? কিল্লার মোড় অফিস থেকে দিয়েছে? তিনি রাগ হয়ে গেলেন। আমাদের দাওরার বছর হুজুরের পড়ানোর নিয়ম ছিল, বুখারি আউয়াল হুজুর আসরের আগে একবার পড়াতেন, মাগরিব থেকে এশা পর্যন্ত আবার পড়াতেন। এরপর প্রতি শুক্রবার সকাল সাতটা থেকে দশটা পর্যন্ত তিন ঘণ্টা পড়াতেন। শুক্রবারের সবক আর মাগরিবের পরের সবকে কামরাঙ্গীরচরে ছাত্ররা এসে অংশগ্রহণ করতো। হুজুর সেখানেও বুখারি আউয়াল পড়াতেন। আর আসরের আগেরটা আমাদেরকে আলাদা পড়াতেন। সেখানে গিয়েও তাদেরকে আলাদা একটা ঘণ্টা করাতেন। একবার হুজুর আসরের আগে ঘণ্টা করতে এসেছেন। এমন সময় হাফেজ্জী হুজুরের এক সমাবেশ চকবাজারে, মিছিল যাচ্ছে। আমাদের সাথিরা দুই একজন হয়ত গেছে। বাকিরা তামাশা দেখছে। মিছিল লালবাগের সামনে দিয়েই যাচ্ছিল। এমন সময় হুজুর আসলেন ক্লাসে। ওই সময় ক্লাসে৭২ জনের মধ্যে উপস্থিত ছিল মাত্র ৮/১০জন। হুজুরের চেহারর রঙ বদলে গেল। একটু বসলেন, বললেন,বাকিরা কোথায়? হুজুর আসছে। আসছে মানে? কেউ হয়তো মিছিলে গেছে। মিছিল বের করেছে কে? মিছিল বের করেছে মুফতি মনসুর সাহেব। মনসুরকে ডাকো। একজন গেলো ডাকতে। হুজুর বললেন হাজিরা খাতা নাও। হাজিরা ডাকলেন। এরপর বললেন যারা যারা নাই এরা যদি কালকে সবকের আগে সমস্যা সমাধান না করে তাহলে আমি আর পড়াবো না। তোমাদেরকেও আর পড়ালাম না। একথা বলে চলে গেলেন। ওদিকে মনসুর সাহেব আসলেন, হুজুর বললেন তোমাকে এই সময় মিছিলে ছাত্র পাঠাতে কে বলছে? হুজুর সেদিন খুব ধমক দিলেন। আর ছাত্ররা গিয়ে মাফ চাইলে তারপর তিনি আবার সবক পড়ানো শুরু করেন। রাহমানী পয়গাম : ছাত্রদের মধ্যে শাইখুল হাদীস রহ. এর জনপ্রিয়তা কেমন ছিল? মুফতি দিলাওয়ার হুসাইন : মাদরাসা কমিটির সেক্রেটারি হাজি আব্দুল ওয়াহহাব সাহেব শাইখুল হাদীস রহ.এর রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণকে ইস্যু বানিয়ে শাইখুল হাদীস রহ. কে মাদরাসা থেকে বের করে দেয়ার উদ্যোগ নিলো। ছাত্রদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো। তার কাছে খবর গেল যে, ছাত্ররা এই সিদ্ধান্ত মানছে না। ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। তখন সে অনির্দিষ্ট কালের জন্য মাদরাসা বন্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিল। পরের দিন সে ২০/২৫ মাস্তান সাথে নিয়ে মাদরাসায় আসলো। এসে বললো সব ছাত্ররা বের হও, তালা লাগাও। তাদের সবার হাতে ছিল তালা। কিন্তু উত্তেজিত ছাত্ররা বের হবে তো দূরের কথা উল্টো তাকে ধাওয়া দিল । সে দৌড়ে কোনো রকম অফিসে গিয়ে ঢুকলো। অফিসে গিয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে দিল। অনেক্ষণ পর হাফেজ্জী হুজুর রহ., মাওলানা আলি আসগর রহ., মাওলানা আব্দুল গাফফার রহ., আসলেন। তারা এসে হাজি আব্দুল ওয়াহহাব সাহেবকে বের করে নিয়ে গেলেন। শাইখুল হাদীস রহ. কে বের করবে তো দূরের কথা, বরং সে নিজেই বের হয়ে গেছে। এই ঘটনার পর আর কোন দিন সে মাদরাসায় আসতে পারেনি। রাহমানী পয়গাম : শাইখুল হাদীস রহ. এর বিশেষ কোনো নসিহতের কথা কি মনে পড়ে? মুফতি দিলাওয়ার হুসাইন : লালবাগের পড়া শেষ করে যখন আমার যাবার পালা। এমন সময় একদিন হুজুর বাসায় ফিরছেন, আমিও হুজুরের সঙ্গে আসলাম। গোর এ শহিদ মাজারের কাছে এসে হুজুর থামলেন, আমাকে নসিহত করলেন। বললেন, হযরত থানবী রহ. এর মাওয়ায়েজ মুতাআলা করবে। থানবি রহ. এর মাওয়ায়েজের ভান্ডার হলো আল ইবকা। প্রতি মাসে পত্রিকা আকারে এটা বের হতো কলকাতা থেকে। আমি ছোট বেলা থেকেই আল ইবকার কথা আব্বার কাছে শুনতাম। তখন থেকেই আল ইবকার প্রতি একটা আন্তরিক টান ছিল। আল্লাহপাকের ইচ্ছা। আমার শরহেজামির বছর, ২১ বছরের আল ইবকা আমার হাতে আসে। আমি তখন চাঁদপুর খেরিহরে শরহেজামি পড়ি। ক্লাস চলছে কুতবির, মুফতি আব্দুল্লাহ সাহেবের আব্বা দরস দিচ্ছেন। এই সময় একজন বুড়োলোক মাদরাসায় আসলো। বললো, হুজুর আমি কলকাতা আলিয়ার ফারেগ। আসার সময় বহু কিতাবাদি এনেছিলাম। কিন্তু আমার পরিবার জেনারেল শিক্ষিত, এই কিতাব পড়ার কেউ নেই। আমিও বৃদ্ধ হয়ে গেছি। দরকার ছিল, কিতাবগুলো এমনি মাদরাসায় দিয়ে দেয়ার। কিন্তু আমার কিছু টাকারও প্রয়োজন। এজন্য একেবারেই কম দামে দিয়ে দিবো আপনি নিবেন কি না? হুজুর জানতে চাইলেন কী কী কিতাব আছে? প্রথমেই বললো আল ইবকার কথা। মুতাওয়াল, তাফসিরের বিভিন্ন কিতাবসহ অনেক কিতাবের নাম বললো। আমি তখন মনে মনে দোয়া করছি হুজুর যাতে না কিনে, আমি যাতে কিনতে পারি। হুজুর বললেন, না এসব কিতাব লাগবে না। আমি খুশি হলাম। পরের দিন শুক্রবার তিন মাইল দূরে সেই লোকের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। গিয়ে বললাম আমি আপনার কিতাব কিনবো। সব কিতাবের মূল্য হলো ১৪০০ টাকা। সেই সময়ের ১৪০০ টাকাও কিন্তু অনেক। আল ইবকা আমি তখনি মুতাআলা শুরু করেছি। যেখানে বুঝতাম না আব্বাজানের কাছে চলে যেতাম। তো হযরত শাইখুল হাদীস রহ. যখন বললেন, থানবি সাহেবের মাওয়ায়েজ মুতায়ালা করবে। তখন আমি বললাম, আমার কাছে ২১ বছরের আল ইবকা আছে। এটা শুনে হুজুর আশ্চর্য হলেন, জানতে চাইলেন আমি কিভাবে সংগ্রহ করেছি। আমি বললাম। তিনি বললেন মাশাআল্লাহ। সেটা মুতাআলা করবে। দেখবে উলূম ও মারেফাতের সমুদ্র কিভাবে প্রবাহিত হয়।
হাদিসে রাসুলের বাস্তব নমুনা
ছিলেন শাইখুল হাদীস রহ.
একান্ত সাক্ষাৎকারে মাওলানা নেজামুদ্দীন দা. বা.
মে'১৪ ইসলামি অঙ্গনে প্রবীণ ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদদের মধ্যে অন্যতম একজন মাওলানা নেজামুদ্দীন। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির। এক সময়ের মহাসচিব। কাজির বাজার মাদরাসার প্রাক্তন মুহাদ্দিস ও নাজেমে তালিমাত। বর্তমানে গওহরপুর মাদরাসার শাইখুল হাদিস। শিক্ষকতার দীর্ঘ জীবনে প্রায় ত্রিশ বছর যাবৎ বুখারির দরস দিচ্ছেন। এছাড়াও বিভিন্ন দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের সাথে নানাভাবে যুক্ত আছেন। বয়সের ভারে নুজ্য না হলেও শারীরিক জটিল ব্যাধি তাকে অনেকটাই কাবু করে ফেলেছে। শাইখুল হাদীস রহ. এর দীর্ঘ দিনের সহকর্মী হিসেবে তাকে কাছ থেকে দেখেছেন। বুঝেছেন। অনেক ঘটনার সাক্ষীও তিনি। সেই সব অজানা কথা শুনতে শাহজালালের পুণ্যভূমি সিলেটে হাজির হয়েছিলেন রাহমানী পয়গামের বিভাগীয় সম্পাদক মুহাম্মদ এহসানুল হক। পাঠকদের জন্য আলোচনার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।
রাহমানী পয়গাম : শাইখুল হাদীস রহ. এর সাথে পরিচয়ের সময়টা কি স্মরণ করতে পারেন? মাওলানা নেজামুদ্দীন দা.বা. : বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছুদিন ইসলামি রাজনীতি বন্ধ ছিল। কিছুদিন বন্ধ থাকার পর শাইখুল হাদীস রহ. কে সভাপতি করে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম গঠন করা হয় অরাজনৈতিকভাবে। শাইখুল হাদীস রহ. সভাপতি আর মাওলানা মুহিউদ্দীন খানকে সেক্রেটারি করা হয়েছিল। ঐ সময় থেকেই মূলত শায়েখের সাথে আমার পরিচয়। সনটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছি না। সম্ভবত ৭৫/৭৬ এর দিকে হবে। রাহমানী পয়গাম : আপনি বললেন অরাজনৈতিকভাবে গঠন হয়েছিল। এ কথাটির ব্যাখ্যা জানতে চাই। মাওলানা নেজামুদ্দীন দা.বা. : মূলত কিছু দ্বীনি কাজ করার জন্য জমিয়ত গঠন করা হয়েছিল। যেমন মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা, তখন মাদরাসার সংকট ছিল, কোনো মাদরাসায় সমস্যা আসলে সেটা সমাধান করা। ওলামাদের ঐক্যবদ্ধ করা, বিচ্ছিন্নতা দূর করা, ওয়াজ মাহফিল করা, মানুষের সেবা করা, মানুষদেরকে দ্বীনের দিকে দাওয়াত দেয়া। এ জাতীয় অরাজনৈতিক চিন্তা নিয়ে জমিয়ত তখন গঠন করা হয়েছিল। পরর্বতীতে এটাকে রাজনৈতিক রূপ দেয়া হয়েছে। সূচনা হয়েছিল অরাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই। এরপর খেলাফত আন্দোলন গঠিত হলো। ‘শায়েস্তা খান’ হলে যার গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যে সংগঠনটি দাঁড়িয়ে ছিল তিনি হলেন শাইখুল হাদীস রহ.। প্রথমে প্রস্তাব ছিল নাম হবে তাহরিকে খেলাফত। কিন্তু মাঠ থেকে সবাই বললো না, তাহরিকে খেলাফত না, নাম হবে খেলাফত আন্দোলন। হাফেজ্জী হুজুর ছিলেন আমির। আর হুজুর যেহেতু অনেক বয়স্ক, এবং বৃদ্ধ ছিলেন তাই খুব চিন্তা ভাবনা করে শাইখুল হাদীস রহ. কে নায়েবে আমিরে আমেল করা হয়। আরো অনেকেই নায়েবে আমির ছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে প্রথম এবং নায়েবে আমিরে আমেল ছিলেন শাইখুল হাদীস রহ.। হাফেজ্জী হুজুরের সমস্ত কাজ তিনি চালিয়ে যাবেন এ হিসেবে তাকে এই পদ দেয়া হয়েছিল। রাহমানী পয়গাম : আপনি বললেন, শাইখুল হাদীসের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে খেলাফত আন্দোলন গঠন করা হয়েছে। এই কথাটার ব্যাখ্যা কী? মাওলানা নেজামুদ্দীন দা.বা. : শাইখুল হাদীস রহ. তার বক্তব্যের শুরুতে একটি কথা এনেছিলেন, হুবহু স্মরণ হচ্ছে না। তবে কথাটা হলো, বিলায়েতের সর্বোচ্চ মাকাম হচ্ছে খেলাফত। এই জন্য সব নবী খলিফা ছিলেন। কারণ খেলাফত হচ্ছে সর্বোচ্চ মাকাম। আবদিয়েতের উপরে খেলাফত। যেহেতু এটা সর্বোচ্চ মাকাম এজন্য আমাদের মাঝ থেকে একজন সর্বোচ্চ ব্যক্তি পেয়েছি হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. তাই আমাদের এই মাকামকে ধরে রাখতে হবে। শুধু রাজনীতির জন্য নয় বরং আল্লাহর নৈকট্যতা লাভ এবং ইবাদতের জন্য এই খেলাফতকে ধরে রাখা আমাদের উপর কর্তব্য। একথাটা তিনি তার ভাষায় খুব সুন্দর করে তুলে ধরে ছিলেন। রাহমানী পয়গাম : খেলাফতের সাথে শিয়াদের সম্পর্কের একটা অভিযোগ এক কালে করা হতো, এ ব্যাপারে কী বলবেন? মাওলানা নেজামুদ্দীন দা.বা. : অনেকেই অনেক সময় অভিযোগ করেছেন যে, শিয়াদের সাথে আমাদের সম্পর্ক। বা খেলাফত আন্দোলনের সম্পর্ক শিয়াদের সাথে। এই কথা মৌলিকভাবে ভুল । কারণ শিয়ারা খেলাফত মানে না। খেলাফতে রাশেদাকে মানে না। এই শিয়াইয়্যত ও খেলাফত একটা আরেকটার পরিপন্থি। কোনো অবস্থাতেই এই দুইটার মধ্যে সমন্বয় হতে পারে না। হাফেজ্জী হুজুরের ইরান সফরের পর থেকে এই অভিযোগটা উঠানো হয়। তখন ইরান সফর নিয়ে দ্বিমত দেখা দিল। এবং খেলাফত আন্দোলনের মধ্যে একটা ভাঙনের সৃষ্টি হলো। রাহমানী পয়গাম : আপনি খেলাফত আন্দোলনের কী দায়িত্বে ছিলেন? মাওলানা নেজামুদ্দীন দা.বা. : তখন খেলাফত আন্দোলনের সাংগঠনিক কাঠামো ভিন্ন ধরনের ছিল। আমি কেন্দ্রীয় শুরা কমিটির সদস্য ছিলাম। আর বৃহত্তর সিলেট জেলার প্রশিক্ষণ সম্পাদক ছিলাম। এরপর খেলাফত আন্দোলন দুই ভাগ হয়ে গেল। আমরা শাইখুল হাদীসের নেতৃত্বে চলে আসলাম। রাহমানী পয়গাম : আপনারা কী পরিমাণ সদস্য শাইখুল হাদীস কে সমর্থন করলেন? মাওলানা নেজামুদ্দীন দা.বা. : যথেষ্ট পরিমাণ। হাফেজ্জী হুজুরের মতো ব্যক্তি হওয়ার পরেও দেশের অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম শাইখুল হাদীস রহ. কে সমর্থন করেছেন। তবে আমাদের তখনও উদ্দেশ্য ছিল এক হয়ে যাওয়ার। এজন্য আমাদের অংশে যিনি প্রধান ছিলেন তাকে আমির ঘোষণা করা হলো না। তাকে সভাপতি ঘোষণা করা হলো। আমির ঘোষণা না করার কারণ হলো, আমির কখনো একসাথে দুইজন হতে পারে না। এ জন্য সভাপতি ঘোষণা দেয়া হলো। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল আবার ইত্তেফাক। আমির ঘোষণা দিলো তো আর ঐক্যের পথ খোলা থাকে না। কিন্তু সেটা আর হলো না। এর পর আমরা খেলাফত মজলিস গঠন করলাম। রাহমানী পয়গাম : খেলাফত মজলিস গঠনের প্রেক্ষাপট জানতে চাই? মাওলানা নেজামুদ্দীন দা.বা. : হাফেজ্জী হুজুরের নেতৃত্বে অনেকগুলো সংগঠনের একটা জোট গঠন করা হয়েছিল। এই জোটের মধ্যে যুব শিবিরও ছিল। ঐ সময় তাদের সাথে একটা সম্পর্ক স্থাপন হলো। পরিচিতিও বাড়লো। এদিকে আমাদের মধ্যে দ্বিমত দেখা দিলো। এমন সময় আলোচনা হলো যে, কি করা যায়। তখন নিজেদের মধ্যে আলোচনা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলো। অনেক আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হলো, আমরা এক সাথে কাজ করবো। তখন তিনটা মূলনীতি ঠিক করা হলো। যার ভিত্তিতে আমরা যুব শিবিরের সাথে ঐক্য করেছিলাম। ১. সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে খেলাফতে রাশেদার দৃষ্টান্তের অনুসরণ করতে হবে। ২. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকায়েদ ও মাসায়েলের অনুসরণ। ৩. শাহ ওলিউল্লাহ থেকে এ পর্যন্ত চলে আসা ইসলামের অনুকরণ। এই তিনটা বিষয়ের মধ্যে সবাই একমত হলো। আমরা এক সাথে মিলে খেলাফতের রাজনীতি শুরু করলাম। রাহমানী পয়গাম : এই মূলনীতি কারা প্রণয়ন করলেন? মাওলানা নেজামুদ্দীন দা.বা. : মাওলানা আখতার ফারুক ছিলেন। অধ্যক্ষ মাসুদ খান, মাসুদ মজুমদার, হুমায়ুন ভাইসহ শাইখুল হাদীস রহ. ও মাওলানা আব্দুল গাফফার রহ. মুরুব্বি হিসেবে ছিলেন। রাহমানী পয়গাম : জামাতের আকিদা সম্পর্কে আপনার কী বক্তব্য? মাওলানা নেজামুদ্দীন দা.বা. : জামাতের সাথে আমাদের দূরত্ব মাত্র একটা পয়েন্টে। জামাতের গঠনতন্ত্রের ৬ নম্বর ধারাটাই হলো সমস্যা। তাতে রয়েছে, আল্লাহর রাসুল ব্যতিত কাউকে সমালোচনার উর্দ্ধে মনে করা যাবে না। কারো অন্ধ অনুকরণ করা যাবে না। এর ভিত্তিতেই সব কিছু। মওদুদি সাহেব যা কিছু উল্টাপাল্টা লিখেছে তা এই মূল নীতির কারণেই। রাহমানী পয়গাম : ইসলামি রাজনীতির এই ভাঙা গড়া সম্পর্কে কি বলবেন? মানুষ তো হতাশ হচ্ছে? মাওলানা নেজামুদ্দীন দা.বা. : এ প্রসঙ্গে শাইখুল হাদীস রহ. একটা কথা স্মরণ করতে চাই। তিনি সব সময় বলতেন, প্রবাহমান নদীর জোয়ার ভাটার মতো ইসলামি আন্দোলনের মধ্যেও কখনো কখনো জোয়ার ভাটা আসে। কিছু মানুষ জোয়ার দেখলে খুব খুশি হয়। আবার ভাটা দেখলে খুব হতাশ হয়। হুজুর বলতেন, যদি হতাশার কারণে ইসলামি আন্দোলন বাদ দেয়া জায়েজ হতো তাহলে আমি আজিজুল হক সর্বপ্রথম ইসলামি আন্দোলন বাদ দিতাম। কিন্তু এই কারণে ইসলামি আন্দোলন বাদ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ এটা হারাম। লা তাকনাতু মির রাহমাতিল্লাহ। এজন্য হতাশার কারণে কোনো অবস্থাতেই ইসলামি আন্দোলন ত্যগ করা যায়েজ নেই। নিজেদের আলোচনার মধ্যে হুজুর প্রায়ই এই কথাটা নিয়ে আসতেন। রাহমানী পয়গাম : হুজুরের মধ্যে নেতৃত্বে বৈশিষ্ট্য কী ছিল? মাওলানা নেজামুদ্দীন দা.বা. : হুজুরের অন্যতম একটা বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তিনি কখনো কথার মধ্যে আমি শব্দ ব্যবহার করতেন না। আমি বলেছি, আমি উমুককে বলেছি, আমি করেছি, এই কথাটা হুজুরের মুখে কোনোদিন শুনি নাই। হুজুর বলতেন, আমরা বলেছিলাম, আমরা করেছি। আমাদের সাংগঠনিক জীবনের জন্য এটা অত্যন্ত শিক্ষনীয় একটা ব্যাপার। এরপর আরেকটা বিষয় হলো, বড় সভা দেখলে বেশি খুশি হওয়া, আর ছোট সভা, লোকবল নেই এমন দেখলে হতাশ হওয়া একটা স্বাভাবিক চরিত্র। কিন্তু হুজুরকে কখনোই দেখিনি যে তিনি বড় সভা দেখে খুশি হয়েছেন, আর ছোট সভা দেখে নিরুৎসাহিত হয়েছেন। বরং ছোট মাহফিলেও প্রাণভরে আলোচনা করতেন। এমনভাবে খুশি প্রকাশ করতেন যে, আয়োজকরাও কষ্ট ভুলে যেত। এতে করে ইসলামি আন্দোলনের কর্মীরা উৎসাহিত হত। হুজুরের প্রতি আস্থাশীল থাকতো। তারা ভাবতো আমরা তো মনে করেছিলাম হুজুর মন খারাপ করবে কিন্তু না হুজুর তো খুশির সাথে প্রোগ্রাম করলেন। রাহমানী পয়গাম : সাধারণ কর্মিদের হুজুরের আচরণ কেমন ছিল? মাওলানা নেজামুদ্দীন দা.বা. : হুজুর ছিলেন হাদিসের বাস্তব নমুনা। হাদিসের মধ্যে আছে, তোমার ভাইকে দেখে তুমি মুচকি হাসি দাও। আগন্তুককে দেখে মুচকি হাসি দেয়া সুন্নত, সদকার সওয়াব। এর বাস্তব নমুনা ছিলেন হুজুর। হুজুরের সাথে কেউ দেখা করলে এমনভাবে একটা হাসি দিতেন যে, মনে হত কত কালের পরিচয়। কারো মুখে এমন কথা কোনো দিন শুনিনি যে, হুজুরের কাছে গেলাম, আর হুজুর মুখ কালো করে রাখলেন, কথা বললেন না। রাহমানী পয়গাম : যতদূর জানি আপনি হুজুরের সাথে লন্ডন সফরে ছিলেন, ওই সফরের ঘটনাবলি একটু জানতে চাই? মাওলানা নেজামুদ্দীন দা.বা. : আমি হুজুরের সাথে লন্ডন সফর করেছি। হুজুর প্রথমত যেতেই রাজি হচ্ছিলেন না। তিনি চাচ্ছিলেন ওমরায় যেতে। মাহবুব ভাই বললেন, আব্বা এক সপ্তাহের জন্য চলেন, সেখান থেকে আপনি ওমরায় যাবেন। এভাবে অনেক বুঝিয়ে হুজুরকে রাজি করানো হয়। হুজুর লন্ডন সফরে শুধু দুটি বিষয়ের উপরেই বয়ান করলেন। ঈমানিয়াতের প্রতি জোর দেয়া, সন্তানদের ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা দেয়া । আর লন্ডনের জন্য এ দুটি বিষয় অপরিহার্য। হুজুর এ দিকটা বিবেচনা করেই লন্ডন সফর করেছেন। এরপর সারা লন্ডনের উলামায়ে কেরাম হুজুরের কাছে বুখারি শরিফ পড়ার জন্য আবদার করলেন। লন্ডন সিটিতে অবস্থিত খিদমাহ একাডেমিতে হুজুর বুখারির দরস দিলেন। সেখানে প্রায় তিনশ থেকে আড়াইশ ওলামায়ে কেরাম উপস্থিতি ছিলেন এবং তাদের সকলকে তিনি হাদিসের ইজাজতও দিয়ে দেন। এরপর বার্মিংহাম এ একটা আন্তর্জাতিক কনফারেন্স ছিল খতমে নবুয়াতের উপর। বিশাল এক সম্মেলন। সারা দুনিয়ার শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ সেখানে ছিলেন। পাকিস্তানের অনেক আলেমগণ ছিলেন। হুজুরেরও দাওয়াত ছিল। হুজুর সেখানে খতমে নবুয়াতের উপর বয়ান করেন। দেশি-বিদেশি ওলামায়ে কেরাম হুজুরকে অত্যন্ত শ্রদ্ধ করেন। বিশেষভাবে সম্মান করার কারণ ছিল বাবরি মসজিদ লংমার্চের কারণে তিনি সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। এছাড়াও হুজুরের ইলমি একটা মাকাম ভারত, পাকিস্তানে এমতিিেই ছিল। এবং একটা কথা যদিও বাংলাদেশি উলামাদের মুখে খুব কম শোনোা যায় কিন্তু পাকিস্তানি ওলামদেও মুখে এই কথাটা আমি শুনেছি যে, ফজলুল বারি এটা শাইখুল হাদীসের লেখা। এর পর বর্তমান খেলাফত মজলিস বৃটেনের সভাপতি জামিয়া ইসলামিয়া বার্মিংহাম এই মাদারসার প্রিন্সিúাল মাওলানা রেজাউল হক। তার মাদরাসায় হুজুরকে প্রধান অতিথি হিসেবে দাওয়াত করেছেন। অথচ সেই সভায় পাকিস্তানের মাওলানা ফজলুর রহমান সাহেবের মতো ব্যক্তিও উপস্থিত ছিলেন, মাওলানা সলিমুল্লাহ খান সাহেব উপস্থিত ছিলেন, আরো অনেক বড় বড় আলেম উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু হুজুর ছিলেন সেখানে প্রধান আতিথি। হুজুর সেখানে উদুর্তে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করেন। রাহমানী পয়গাম : হুজুরের সাথে দেশেও তো অনেক সফর করেছেন, সেসব সফরের কোনো স্মৃতি? মাওলানা নেজামুদ্দীন দা.বা. : একবার হুজুর সিলেটের জগন্নাথপুর আসলেন। হুজুরের আসার ইচ্ছা ছিল না। আমারও আসার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু অন্যরা আমাকে হুজুরের সঙ্গী বানিয়ে দিল। রাস্তা খুব খারাপ ছিল। হুজুর খুব রাগ হয়ে গেলেন। পথে হুজুরের রাগ শুনতে শুনতে আমিও অস্থির হয়ে গেলাম। বুদ্ধি বের করলাম কি করা যায়। হুজুরের রাগ থামানোর দুইটা পথ ছিল, আমি আকাবেরদের কথা তুলতাম, বলতাম হুজুর শাইখুল ইসলাম মাদানি রহ. তো অনেক দিন জেল খেটেছেন। এই তো শুরু হয়ে গেল হুজুরের আলোচনা। এভাবে কিছুক্ষণ চলতো। এরপর আবার মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানি রহ. এর কথা তুলে দিতাম। আরও কিছু সময় পার হয়ে যেত। এ সমস্ত বুযুর্গানে দ্বীনের আলোচনা তার সামনে তুলে ধরা হলে রাগ আর থাকতো না। আরেকটা বিষয় ছিল হুজুর যখন আওয়ামী লীগের আমলে জেল খাটলেন, এরপর বলতাম হুজুর আপনি যখন জেলে ছিলেন আপনার জন্য দেশে-বিদেশে হাজার হাজার মানুষ দোয়া করেছে। এই কথা বললেই হুজুর কান্না শুরু করে দিতেন। হুজুর বলতেন আমি কয়দিন জেলে থাকছি এটা কি কোনো কষ্ট হলো? হুজুর তখন রাগটাগ সব ভুলে যেতেন। রাহমানী পয়গাম : শাইখুল হাদীসের বিশেষ কোনো স্মৃতি যা এখানে মনে পড়ে? মাওলানা নেজামুদ্দীন দা.বা. : একবার হুজুর সিলেটে একটা প্রোগ্রাম করে ঢাকায় ফিরছিলেন। সিলেট বিমানবন্দরে হুজুরের সাথে মাওলানা দেলওয়ার হোসেন সাঈদী সাহেবের দেখা। তিনি আসছিলেন। সাঈদী সাহেব বললেন, হুজুর এখন তো আমরা আর আপনারা এক হয়ে গেছি। এই কথা বলার কারণ ছিল তখন চারদলীয় জোটে জামাত এবং ইসলামি ঐক্যজোট অংশীদার ছিল। হুজুর তার এই কথার জবাবে বললেন, আমরা এক হইনি। আপনাদের সাথে আমাদের আত্মীয়তা হয়েছে। দোয়া করেন। দেখি কয় দিন এই আত্মীয়তা থাকে। এই কথা বলে হুজুর তাকে বুঝিয়ে দিলেন যে, আপনারা আমাদের গোষ্ঠির নয়। এই এক কথার মাধ্যমে অনেক প্রশ্নের উত্তর হয়ে গেছে। রাহমানী পয়গাম : উপস্থিত এমন সুন্দর উত্তর প্রদানের আর কোনো ঘটনা কি মনে পড়ে? মাওলানা নেজামুদ্দীন দা.বা. : হ্যাঁ। প্রায় সময় হুজুর উপস্থিত খুব সুন্দর উত্তর দিয়ে দিতেন যেমন তসলিমা নাসরিন বিরোধী আন্দোলনের সময় সাংবাদিক সম্মেলনে এক সাংবাদিক বললো, হুজুর আপনারা এই মহিলার কথা বারবার বলেন, এতে করে এই মহিলার তো পরিচিতি হচ্ছে। হুজুর সাথে সাথে এর জবাবে বলেন, তসলিমা নাসরিন শয়তান থেকে বড় নয়, শয়তান তার চেয়ে বড় কিন্তু তারপরও আল্লাহ তায়ালা শয়তানের কথা বারবার বলেছেন। বারবার বললে প্রশংসা হয় না। বারবার বললে মানুষ সতর্ক হবে। এই সতর্ক করার জন্য বারবার বলা প্রয়োজন। এভাবেই কোনো চিন্তা ভাবনা ছাড়াই সাথে সাথে সুন্দর উত্তর দিয়ে দিতেন। রাহমানী পয়গাম : আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য শুকরিয়া। মাওলানা নেজামুদ্দীন দা.বা. : আমার শরীরের অবস্থা ভালো নয়। মনের অবস্থা ভালো থাকলে আরো কথা বলতে পারতাম। তোমরা অনেক কষ্ট করে এসেছো সে জন্য তোমাদের সাথে কথা বলছি। হুজুরের জীবনির কাজ অনেক বড় একটা কাজ। কোনো কথার দ্বারা কার হোদায়াতের রাস্তা হয়ে যাবে।
শাইখুল হাদীসের শুন্যস্থান কখনোই পুরণ হবে না
প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমান। দেশব্যাপী আলোচিত একটি নাম। আন্দোলন সংগ্রামের উত্তাল মিছিলে প্রথম কাতারে থাকা সাহসী যোদ্ধাদের একজন। মানুষ সিলেটের হলেও খ্যাতির সীমা ছড়িয়ে আছে দেশ-বিদেশে। হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর তাওবার রাজনীতি থেকে আন্দোলনের সূচনা। তসলিমা নাসরিন বিরোধী আন্দোলন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম করণ আন্দোলনের মাধ্যমে চলে আসেন লাইম লাইটে। খেলাফত মজলিসের সঙ্গে যুক্ত আছেন জন্মলগ্ন থেকেই। দীর্ঘকাল নায়েবে আমির হিসেবে ছিলেন। শাইখুল হাদীস রহ. এর পরবর্তী আমির হিসেবে তিনিই দায়িত্ব পালন করছেন। জামিয়া মাদানিয়া কাজীর বাজারের প্রিন্সিপাল। এই মাদরাসার প্রতিষ্ঠাও তার হাত ধরে। বুখারির দরস দিচ্ছেন কয়েক যুগ। অনলবর্ষি বক্তা হিসেবেও তার পরিচিতি আছে। সারা দেশে মাহফিল করে বেড়ান এখনো । লন্ডনেও একটা সময় দিতে হয়। দীর্ঘ জীবন পরিক্রমায় প্রায় ত্রিশ বছর তিনি হযরত শাইখুল হাদীসের সহযোদ্ধা হিসেবে আন্দোলন সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। সেই সব সোনালি দিনের কথা শুনতে এক দুপুরে কাজীরবাজার মাদরাসায় হাজির হয়েছিলেন রাহমানী পয়গামের বিভাগীয় সম্পাদক- মুহাম্মদ এহসানুল হক। পাঠকদের জন্য সেই আলোচনার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো। শাইখুল হাদীস রহ. এর শূন্যতা পূরণ করা সম্ভব নয় -প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমান
রাহমানী পয়গাম: শাইখুল হাদীস রহ. এর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কতদিন যাবৎ? প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান: শাইখুল হাদীস রহ. এর সাথে আমার পরিচয় হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর খেলাফত আন্দোলনের সময় থেকে। সে আন্দোলনে শাইখুল হাদীস রহ. ছিলেন হাফেজ্জী হুজুরের ডানহাত। তখন থেকেই ঘনিষ্ঠ পরিচয়। হাফেজ্জী হুজুরের পরের ব্যক্তি ছিলেন শাইখুল হাদীস রহ.। মানিক মিয়া এভিনিউতে যে বিশাল সম্মেলন হয়েছিল সেখানে হাফেজ্জী হুজুর ছিলেন সভাপতি। বিশাল জুমার ইমামতি করলেন শাইখুল হাদীস রহ.। সেই সময় থেকেই ঘনিষ্টতা। রাহমানী পয়গাম: ওই সময় আপনার সাংগঠনিক অবস্থান কী ছিল? প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান: আমি তখন বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম। রাহমানী পয়গাম: হাফেজ্জী হুজুরের পরে নেতা হিসেবে শাইখুল হাদীসকে গ্রহণ করার কারণ কি ছিল? প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান: ওই সময় হাফেজ্জী হুজুর রহ. শায়েখকে তার দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে সারা দেশে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। যেমন মানিক মিয়া এভিনিউতে হুজুরেই ঘোষণা করলেন যে, আমার পরবর্তী ব্যক্তি শাইখুল হাদীস সাহেব এখন জুমার নামাজ পড়াবেন। তাছাড়া তখন হুজুরের সমকক্ষ আর কেউ ছিলেনও না। আলেম তো অনেকেই ছিলেন কিন্তু নেতৃত্বের জন্য যোগ্য আর কেউ ছিলেন না। তাছাড়া হুজুরের একটা পরিচিতি ছিল সারা দেশে। হাফেজ্জী হুজুরের সাথে সারা দেশ সফর করেছেন। সবাই হাফেজ্জী হুজুরের পরে শাইখুল হাদীসকেই চিনতো। রাহমানী পয়গাম: আপনাকে সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত করেছিলেন কে? প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান: হযরত হাফেজ্জী হজুর রহ. আমাকে খেলাফত আন্দোলনের সাথে যুক্ত করেছিলেন। হুজুর একবার সিলেটে এসে সাতদিন ছিলেন। সিলেটে হাফেজ্জী হুজুর নামে আমার একটা বইও ছিল। হুজুরের সফর সম্পর্কে বিস্তারিত আমি বইটির মধ্যে লিখেছিলাম। হুজুর প্রায়ই উদুর্তে কথা বলতেন। তখন দোভাষির কাজ করতাম আমি। হুজুরের বয়ান কে খোলাসা করে আমি বলতাম। রাহমানী পয়গাম: ওই সময়ের কোনো স্মৃতি যদি বলতেন? প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান: আসলে হুজুরের সাথে তো আমার স্মৃতির কোনো শেষ নেই। কত স্মৃতি, কত কথা। বিশেষভাবে হুজুর সিলেট আসলে এখানে উঠতেন, এখানেই থাকতেন। আমরা খেদমত করার সুযোগ পেতাম। আমি হুজুরের অবস্থানের সুবিধার্থে একটি কামরা রেডি করেছিলাম। হুজুরের হাটুতে ব্যাথা ছিল। নিচু কমোটে বসতে পারতেন না। এজন্য আমি এখানে হাই কমোটের ব্যবস্থা করেছিলাম। হুজুর এখানে আসলে স্বস্থিবোধ করতেন। আমরাও আনন্দ পেতাম। বিপদে আপদে সুখে দুখে সব সময় হুজুর আমাদের পাশে থাকতেন। মাদরাসার ব্যাপারে কোনো সমস্যা দেখলে হুজুর চলে আসতেন। আমাকে নিয়ে যখন কিছু মিডিয়া উল্টাপাল্টা লিখেছে তখনও হুজুর আমার পক্ষে কথা বলেছেন। রাহমানী পয়গাম: এমন কোনো ঘটনা কি আছে যার জন্য হুজুর ঢাকা থেকে এখানে চলে এসেছেন? প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান: হ্যাঁ, এমন ঘটনা আছে। আমরা মাদরাসার পাশেই একটা জায়গা কিনেছিলাম। মাদরাসা সম্প্রসারণের জন্য। সেই জায়গাটা আমরা কোর্টের মাধ্যমে বায়না করে কিনেছিলাম। কিন্তু একজন প্রভাবশালী প্রতিবেশী থানায় টাকা পয়সা ঢেলে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমরা জায়গা কেনার পর দখলে গিয়েছিলাম। আমাদের সাবেক এমপি মাওলানা উবায়দুল হক সাহেব তখন আমাদের সঙ্গে ছিলেন। সে জন্য অনেক তিলাওয়াত হয়েছে। দোয়া দুরুদ হয়েছে। ফজরের নামাজের পরে হঠাৎ আমাদের উপর সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমাদের প্রায় একশত ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়। এই খবর শোনোর পর হুজুর ঢাকা থেকে সিলেট ছুটে আসেন। সে সময় আমাদের বার্ষিক মাহফিলও ছিল। হুজুর তখন চারদলীয় জোটের শীর্ষনেতা। তিনি বললেন, চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় থাকতে মাদরাসার জমি আত্মসাৎ মেনে নেয়া যায় না। যতদিন পর্যন্ত মাদরাসার জমি মুক্ত না হবে আমি সিলেট থেকে যাব না। তখন পরিস্থিতি আরও গরম হয়ে উঠলো। আমরা এক পর্যায়ে হুজুরকে বললাম, হুজুর আপনি তো আপনার দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন যদি আবার গোলাগুলি শুরু হয় সেটা আমাদের মাদরাসার জন্যই অকল্যাণ হবে। আপনি এখন ঢাকায় ফিরে যান। প্রয়োজন হলে আমরা আবার আপনাকে আনবো। হুজুর এভাবে আমাদের এবং মাদরাসার জন্য ঝুঁকি নিয়েছিলেন। আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। আগেই তো বললাম, স্মৃতির কোনো শেষ নাই। রাহমানী পয়গাম: শাইখুল হাদীস রহ. এর তসলিমা বিরোধী আন্দোলনে আপনার বেশ অবদান ছিল বলে শুনেছি। তসলিমা বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে একটু জানতে চাই। প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান: তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে হুজুরের আন্দোলন ইতিহাস হয়ে থাকবে। তসলিমা নাসরিন যখন আল্লাহ, রাসুল এবং কোরআনে পাক সম্পর্কে অশ্লীল ভাষায় সমালোচনা শুরু করল আমি তখন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় অনেক আলেমের সাথে মতবিনিময় করেছি। তাদের নাম বলবো না। আলেম ওলামারা আমাকে তেমন পাত্তা দেননি। অনেকে বলেছেন সে একজন মহিলা। আলেমরা একটা মহিলার বিরুদ্ধে লাগবে কেন। আমি বললাম একজন মহিলার বিরুদ্ধে না। ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে নামা দরকার। কিন্তু কেউ আমাকে পাত্তা দিতে চায়নি। তখন আমি ঢাকায় গেলাম হুজুরের মাদরাসায়। গিয়ে বললাম, হুজুর! এদেশে এত আলেম ওলামা, এত মুসলামন থাকতে আল্লাহ, এবং আল্লাহর রাসুল ও কোরআনকে এ ভাবে গালি দিবে, এটা তো সহ্য করা যায় না। আমি সিলেট থেকে আন্দোলন শুরু করেছি। এখন আমি চাই আপনার নেতৃত্বে এই আন্দোলনকে দেশব্যাপী বেগবান করতে। হুজুর তৎক্ষনাৎ নিজের হাতে আলেম ওলামাদের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখলেন। ঢাকার সমস্ত মাদরাসার প্রিন্সিপালদের তিনি ডাকলেন। দাওয়াত পেয়ে ওলামায়ে কেরাম ও মুহতামিম সাহেবরা আসলেন। সবাই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করলেন। তখন আলেমদের পক্ষ থেকে একটা বিবৃতি দেয়া হলো। বায়তুল মুকাররমের দক্ষিণগেটে বিশাল এক প্রতিবাদ সমাবেশ আহ্বান করা হলো। সেখানে হুজুর থাকলেন, আমরাও ছিলাম। বিশাল সমাবেশ হয়েছিল। মানুষ ছিল হাজার হাজার। রাহমানী পয়গাম: সিলেটের মাটিতে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ নিয়ে বিশাল আন্দোলন হয়েছিল ওই আন্দোলন সম্পর্কে একটু জানতে চাই। প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান: সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ নিয়ে যে আন্দোলন হয়েছে সেখানে বাইরের আলেমদের তেমন সম্পৃক্ততা ছিল না। এটা সিলেটের আঞ্চলিক ব্যাপার ছিল। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়টা সিলেটে। এজন্য এ আন্দোলনে আমরা পুরো দেশকে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন মনে করিনি। আমরা সিলেটের সব ইসলামি দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনটা করেছি। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, এ জন্য আমরা বলেছিলাম বিতর্কিত কোনো মানুষের নামে কোনো হলের নাম করণ করা যাবে না। হযরত শাহজালালের সাথে ৩৬০ অলি আউলিয়া ছিলেন তাদের কারো নামে হলের নাম হতে হবে। এই আন্দোলনে সিলেটবাসীর একচেটিয়া সমর্থন থাকায় আমরা সহজেই বিজয় লাভ করেছি। এবং তারা শেষ পর্যন্ত তাদের পথ থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছে। জাহানারা ইমাম-টিমাম বিভিন্ন নাম দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সেটা আর হয়নি। এই আন্দোলনেও হুজুরের নৈতিক সমর্থন ছিল এবং সিলেটে আসলে আমাদের এই আন্দোলনের পক্ষেই কথা বলতেন। রাহমানী পয়গাম: শাইখুল হাদীস রহ. এর দীর্ঘজীবনের আন্দোলন সংগ্রামে আমরা দেখেছি সিলেটবাসী সবসময় পাশে থেকেছে। দেশের অন্য অঞ্চলের তুলনায় সিলেটবাসীর মধ্যে শাইখুল হাদীসের জনপ্রিয়তা একটু বেশি ছিল বলে মনে হয়। এটা কিভাবে তৈরি হলো? প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান: আসলে এটা হযরত শাইখুল হাদীস রহ. এর যোগ্যতা এবং আল্লাহ তায়ালার কাছে তার মাকবুলিয়াতের কারণেই হয়েছে। আর বাহ্যিক দৃষ্টিতে আমাদের সম্পৃক্ততার কারণে এটা আরও জোরদার হয়েছে। যেহেতু পুরো সিলেট অঞ্চলে আমাদের একটা প্রভাব ছিল। সিলেটের আন্দোলন সংগ্রাম সাধারণত আমরাই করতাম। এরপর আমরা যখন হুজুরকে আমাদের নেতা হিসেবে উপস্থাপন করেছি। তখন এই মুহাব্বতটা হুজুরের প্রতিও হয়েছে। হুজুরকে দেখে মানুষের কাছে এটা প্রমাণ হয়েছে যে, তিনি একজন হক্কানি আলেম। তিনি হক কথা বলেন। কারও সাথে আপোষ করেন না। আমরাও এ বিষয়টা সিলেটবাসীর সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছি। এভাবেই এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। তবে হুজুরের যোগ্যতা আর মাকবুলিয়াতই এর মূল কারণ। রাহমানী পয়গাম: হুজুরের সাথে আপনার সফর সম্পর্কে জানতে চাই। প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান: হুজুরের সাথে দেশের বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় সফর করেছি। মক্কা শরিফে, লন্ডনে। এই সমস্ত সফরে সবসময় হুজুরকে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেই দেখেছি। যেমন লন্ডন শহর থেকে ত্রিশ মাইল দূরে একটা মাহফিল ছিল। সেখানে হুজুরের সাথে আমিও গেলাম। এই ত্রিশ মাইল পথে হুজুর একটিও কথা বললেন না, শুধু সুরায়ে ইখলাস পড়তে থাকলেন। কত শত বার যে এই সুরা পড়লেন তার কোনো হিসেব নেই। এগুলো শিক্ষনীয় বিষয়। হুজুর মানুষের সাথে কথা বলতেন খুব আন্তরিকতার সাথে। অবসর সময় আল্লহর জিকির করে করে কাটাতেন। এটা হুজুরের জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। রাহমানী পয়গাম: লন্ডন সফরটা কোন সালে হয়েছিল? প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান: আসলে লন্ডনে তো আমার প্রতি বছরেই যাওয়া হয়। এই জন্য সালটা আমার সঠিক মনে পড়ছে না। তবে সম্ভবত ২০০০ সালের দিকে হবে। তখন আমার ফ্যামেলিও লন্ডন ছিল। হুজুর আমার বাসাতেই ছিলেন। রাহমানী পয়গাম: হুজুর যখন কারাগারে, আপনি তখনও তো লন্ডনে। শুনেছি সেখানে আন্দোলন হয়েছিল? প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান: সেখানে এমন আন্দোলন হয়েছে যে, সেটা হয়তো দেশেও সম্ভব হতো না। লন্ডনে জামাতসহ যত ইসলামি দল ছিল, সবাইকে নিয়ে আমরা বিশাল আন্দোলন করেছি। প্রায় তিন কিলোমিটার লম্বা মিছিল করেছি লন্ডনের বিশাল রাস্তাজুড়ে। যেটা লন্ডনের ইতিহাসে বিরল। যার কোনো নজীর নাই। সেখানে আমি সভাপতি ছিলাম। রাহমানী পয়গাম: হুজুরের সাথে পাকিস্তান সফর করেছেন বলে শুনেছি। ওই সফর সর্ম্পকে একটু জানতে চাই প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান: হ্যাঁ, হুজুরের সাথে আমি পাকিস্তান সফরে গিয়েছি। তিন দিনের সফর ছিল। সেখানকার বিভিন্ন মাহফিলে হুজুর বয়ান করেছেন। লাহোরের নীলাগুম্বুজ মসজিদের মাহফিলের কথা মনে পড়ে। হুজুর উদুর্তে এমন এক ভাষণ দিয়েছিলেন যে, পাকিস্তানের আলেমরা বলেছিলেন র্উদুতে আমাদের পক্ষেও এত সুন্দর ভাষণ দেয়া সম্ভব না। হুজুর যেভাবে ভাষণ দিয়েছেন তা এক কথায় অতুলনীয়। সেখানে আমি ছিলাম। সফরসঙ্গী আরো ছিলেন মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ., মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিসবাহ রহ., মাওলানা আব্দুল মান্নান কাশিয়ানি হুজুর রহ.। রাহমানী পয়গাম: হুজুরের সাথে ঘটে যাওয়া এমন কী ঘটনা আছে যেটা আপনি এখনো ভুলতে পারেন না, মাঝে মধ্যেই মনে পড়ে? প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান: একটি ঘটনা খুব মনে পরে। বৃটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী যখন সিলেটের মাটিতে হযরত শাহজালালের মাজার জিয়ারত করতে আসলেন। তিনি যে আসছেন সেটা আমি জানতামও না। তিনি আসছেন এমন কোনো প্রচার প্রচারণাও ছিল না। দিনটি ছিল শুক্রবার। আমি এর আগে সপ্তাহ দশদিন কাতারে ছিলাম। দুই জুমা অথবা এক জুমা আমার পড়ানো হয়নি। আমি যে জুমার দিন আসছি। ওই দিনই আনোয়ার চৌধুরী আসছেন। আমার মসজিদে সেদিন এত লোক হয়েছিল যে, মসজিদের ভীতরে বাইরে কোনোও জায়গা ছিল না। যেহেতু আগের জুমায় মুসল্লিরা আমাকে মিস করেছিল তাই এত ভিড় ছিল। আমি বয়ানে কাতারের কিছু বিষয় আলোচনাও করলাম। বয়ান একটু লম্বা হলো। একটা দশ বা পনের মিনিটের দিকে জনাব আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা হয়। হামলায় আনোয়ার চৌধুরীসহ অনেকেই আহত হয়। একজন মনে হয় নিহতও হয়েছিল। জুমার নামাজ শেষ করে পৌনে দুইটায় আমি আমার রুমে ফিরে আসি। তখন পর্যন্ত আমি কিছু জানিও না। এরই মধ্যে কিছুলোক দরগা মসজিদে নামাজ পড়ে এসে বলল, হুজুর শুনছেন, দরগায় আনোয়ার চৌধুরীর উপর বোমা হামলা হয়েছে। আমি বললাম, ইন্নালিল্লাহ। আমি পরের দিনই এই ন্যাক্কার জনক হামলার প্রতিবাদে শক্ত বিবৃতি দিলাম। আমি বললাম, আনোয়ার চৌধুরী সিলেটের সন্তান। যদিও সে বৃটিশ। তারপরও তার প্রতি আমাদের মুহাব্বত এবং হাইকমিশনার হিসেবে তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ভক্তি থাকা দরকার। যে বা যারাই এই কাণ্ড ঘটিয়েছে তারা দেশ জাতি ও সমাজের শত্র“। ইসলাম কোনো মানুষকেই বোমা মেরে হত্যা করার নির্দেশ দেয়নি। আমি প্রতিবাদ জানিয়ে আমার দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কয়েক দিন পরেই দেখা গেল সব পত্রিকার হেড লাইন, আনোয়ার চৌধুরীর উপর হামলায় প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান জড়িত। তিনি নিজে উপস্থিত থেকে হামলা করেছেন। আমি বললাম হাজার হাজার মানুষ আমার পিছনে জুমার নামাজ পড়লো। সবাই জানে যে, ঘটনা ঘটেছে কয়টায় আর আমার জুমা শেষ হয়েছে কয়টায়। তখন পত্র-পত্রিকায় এমনভাবে লেখালেখি শুরু হলো যে, আমাকে তারা শেষ করে দিবে। হুজুর এই অপপ্রচার দেখে অস্থির হয়ে উঠলেন। আমাকে বললেন, আপনি সমাবেশ ডাকেন আমি সিলেট আসছি। আমরা তখন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের উদ্যোগে সমাবেশ ডাকলাম। সমাবেশে প্রায় ৫০ হাজার লোক হয়েছিল। বিমানের ফ্লাইট দেরি করায় হুজুর আসতে দেরি করলেন। হুজুর সমাবেশের একে বারে শেষ সময়ে আসলেন। স্টেজের মধ্যেই হুজুর আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিলেন। সাংবাদিকরা হতবাক হয়ে গেল। একি!। তিনি বক্তব্যে কঠোর ভাষায় বললেন, মাওলানা হাবিবুর রহমান সন্ত্রাসী হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তিনি শুধু সিলেট নয় বাংলার সিংহপুরুষ। তার বিরুদ্ধে কিছু করা হলে এটা মেনে নেয়া হবে না। আমি আজিজুল হক সেটা প্রতিহত করবো। এধরনের কথাবার্তা শুনে সাংবাদিক গোয়েন্দা সবাই হতবাক হয়ে গেল। এর পরেই আমার বিরুদ্ধে এই চাক্রান্ত ধুলিসাৎ হয়ে যায়। রাহমানী পয়গাম: কিছু দিন পরপর আপনার বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদ নিয়ে রির্পোট করা হয় এর কারণ কী? প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান: এটাই তো হাতিয়ার মানুষকে ঘায়েল করার জন্য। এটা বাতিলের সিস্টেম। যেই আল্লাহর কথা বলবেন, ইসলামের কথা বলবেনÑ তাকেই এগুলো বলা হবে। আমি যেহেতু কথা বলতাম এজন্য আমাকে বেশি বলা হয়েছে। রাহমানী পয়গাম: শাইখুল হাদীস রহ. তো সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তি ছিলেন। হুজুরের নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য কী ছিল? প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান: হুজুরের মধ্যে কোনো লোভ লালসা ছিল না। ভয় ভীতি ছিল না। আল্লাহ ছাড়া কাউকে তিনি ভয় করতেন না। কারও বিরুদ্ধে কথা বলতে কোনো পরওয়া করতেন না। কারো কাছে হুজুরের কোনো স্বার্থ ছিল না। মানুষ স্বার্থপর হলে কথা বলতে পারে না। তাছাড়া বিশেষভাবে হুজুরের উস্তাদ ছিলেন যারা, আল্লামা শিব্বির আহমদ উসমানী রহ., হুসাইন আহমদ মাদানী রহ., আল্লামা জফর আহমদ উসমানী রহ., শামসুল হক ফরিদপুরী রহ., হাফেজ্জী হুজুর রহ.। সেই সব উস্তাদদের খুব প্রভাব পড়েছিল হুজুরের মধ্যে। শায়েখ বলতেন আমাদের আকাবেররা ঝাঁড়–পেটা করে বৃটিশদের উৎখাত করেছে। এসব ঘটনা তো তিনি নিজ চোখে দেখেছেন। এ সবের প্রভাব খুব বেশি ছিল তার মধ্যে। মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. এর কথা প্রায়ই বলতেন। তিনি কাউকে ভয় করতেন না। আইয়ুব খানকেও ভয় করেননি। সত্য কথা বলতে কোনো পরওয়া করেননি। রাহমানী পয়গাম: শাইখুল হাদীসের সাথে কবে আপনার শেষ দেখা হয়েছিল? প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান: শায়েখের ইন্তেকালের কিছু দিন আগে বাসায় গিয়ে আমি দেখা করেছি। তখন একরকম অচেতন ছিলেন তিনি। আমাকে দেখে হুজুর একটু হাসলেন। মাহমুদ ভাই ছিলেন, মাহমুদ ভাই বললেন, আব্বা ওনাকে চিনছেন? ইনি সিলেটের মাওলানা হাবিবুর রহমান। মনে হলো হুজুর আমাকে চিনলেন। সেদিন আব্দুর রব ইউসুফি সাহেব, শহীদ সাহেবসহ অনেকেই ছিলেন আমার সাথে। আমি বললাম ‘হযরত মায় সিলহেট যা রাহা হু।’ হুজুর বললেন, ‘দোয়ামে ইয়াদ কারনা।’ এরপর হুজুর মুফতি শহীদকে বললেন, আপনিও সিলেটে যাচ্ছেন? আব্দুর রব ইউসুফিকে বললেন আপনিও কি সিলেট যাচ্ছেন? সেদিন আমাকে সহজেই চিনেছিলেন। সেটাই ছিল হুজুরের সাথে আমার শেষ দেখা। রাহমানী পয়গাম: এখন দেশের ইসলামি আন্দোলনের ময়দানে যে শূন্যতা বিরাজমান এর কী কারণ মনে করেন? প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান: শূন্যতা বলা যাবে না। আন্দোলন তো হচ্ছে যেভাবেই হোক। যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী আন্দোলন করছেন। কিন্তু বিশ্ব পরিস্থিতি , সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ এর কারণে বিভিন্ন সময়ে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। মনে করেন আগে কাবা শরিফের ইমাম সাহেব খুতবার মধ্যে পরিষ্কার ভাষায় আমেরিকার বিরুদ্ধে আফগানিস্তানের পক্ষে দোয়া করতেন। দোয়ার মধ্যে ইয়াহুদি নাসাদের বিরুদ্ধে শক্ত কথা বলেতেন। কিন্তু এখন মক্কা মদিনার খুতবার মধ্যেও চেঞ্জ এসে গেছে। ইহুদি নাসারা শব্দ উচ্চারণ করা নিষেধ হয়ে গেছে। আফগানিস্তানের নাম উচ্চারণ করাও নিষেধ হয়ে গেছে। এই পরির্বতন যখন হেড অফিস থেকেই শুরু হয়েছে তখন আমরা আর কি। তাছাড়া আমাদের ওলামাদের দূরদর্শিতারও অভাব রয়েছে। আমরা হুজুগে চলি। এবং কোনো কোনো আলেমকে বড় বড় রাজনৈতিক দল নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। তারা ইচ্ছায় অনিচ্ছায় ব্যবহার হয়ে যাচ্ছেন। এর কারণেই মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না। রাহমানী পয়গাম: হুজুরের অনুপস্থিতি কেমন অনুভব করেন। প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান: সেটা তো আর বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু কথা হচ্ছে অনুপস্থিত তো হবেই। আল্লাহর রাসুলও তো বিদায় নিয়েছেন। কিন্তুু হুজুরের ইন্তেকালে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে এটা অপূরণীয়। এটা পূরণ করা সম্ভব নয়।
শাইখুল হাদীসের গ্রেফতার ছিল শেখ হাসিনার পতনের অনিবার্য কারণ
একান্ত সাক্ষাতকারে মাসুদ মজুমদার
রাহমানী পয়গাম: হযরত শাইখুল হাদীস রহ. এর সাথে আপনার পরিচয়ের সময়টা জানতে চাই। মাসুদ মজুমদার: বাংলাদেশের অনেক আলেম বুজুর্গকে আমি কাছ থেকে দেখেছি। এজন্য নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। আমার জানা মতে চল্লিশের দশক থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি, দ্বীনচর্চা এবং শিক্ষা আন্দোলনে যারা ভূমিকা রেখেছেন তাদেরকে আমার খুব কাছ থেকে পাওয়ার সুযোগ হয়েছে। অনেকের কাছেই গিয়েছি। আমি হযরত হাফেজ্জি হুজুরের একান্ত সান্নিধ্য পেয়েছি। তাঁর জীবনের সর্ববৃহৎ সাক্ষাৎকারটি আমিই নিয়েছিলাম। আমি তখন পল্লীবাংলা নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করতাম। সেই পত্রিকায় হুজুরের সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়। মুশতারেকা মজলিসের ব্যানারে মানিকমিয়া এভিনিউতে যে ঐতিহাসিক মহাসমাবেশ হয়েছিল সেখানে পত্রিকাটির হাজার হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। সাক্ষাৎকারটি ছিল এক অসামান্য দলিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমি সেই কপিটা সংরক্ষণ করতে পারিনি। আমার হাতছাড়া হয়ে গেছে। হযরত হাফেজ্জি হুজুর রহ. স্বাধীন বাংলাদেশে আলেমদের মধ্যে বৃহৎ পরিসরে প্রথম রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং নেতৃত্ব দেন। এরপর হুজুরের পরবর্তীতে বাংলাদেশের দ্বীনি আন্দোলন, ইসলামের খেদমত এবং শিক্ষা আন্দোলন এই তিনটি কাজের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য সামনে এসে যান শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.। যিনি আমাদের মুরব্বি ও আমির ছিলেন। তাঁকে আমি বাবার মতো সম্মান করতাম। তাঁর সঙ্গে আমার সরাসরি সম্পর্ক হওয়ার বেশ আগে থেকেই আমি তাকে জানতাম। যেহেতু তাঁর বুখারির অনুবাদের সাথে পরিচিত ছিলাম। রাহমানী পয়গাম: শাইখুল হাদীস রহ. কে প্রথম দেখার অনুভূতি কি মনে পড়ে? মাসুদ মজুমদার: মনে পড়ে বাইতুল মুকাররম বা পল্টনের কোনো এক সিরাত মাহফিলের কথা। সময়টা পাকিস্তান আমলের একেবারে শেষ দিকে হবে। সভায় তিনি আলোচক ছিলেন। তিনি সেদিন ইসলামি অর্থব্যবস্থার ওপর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করলেন। আমি তন্ময় হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম। আমি তখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। একজন ইংরেজি শিক্ষিত মানুষ হিসেবে তখন আমি অর্থনীতি পৌরনীতি এগুলো পড়ছি। সেই মুহূর্তে ইসলামি অর্থব্যবস্থার ওপর এমন প্রাঞ্জল ভাষায় সারগর্ভ আলোচনা শুনে আমি মুগ্ধ হই। কিভাবে বেচাকেনা হবে, কিভাবে চুক্তি হবে, কিভাবে সুদবিহীন চলবে। ইত্যাদি বিষয়ের ওপর তাঁর বক্তব্য শুনে আমি মনে খুব প্রশান্তি অনুভব করলাম। এবং এই লোকটার প্রতি আমার আর্কষণ বাড়তে থাকলো। আমি সুযোগ খুঁজতাম, যদি কখনো তাকে কাছে পাই, তাহলে তাঁর কাছে যাব, তাকে সালাম করবো, দোয়া নিবো। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি যে বক্তব্য দিতেন, সেগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। রাহমানী পয়গাম: তাঁর প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হওয়ার কারণ কী ছিল? মাসুদ মজুমদার: তিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞ পণ্ডিত মানুষ। তাঁর পাণ্ডিত্য এভাবে বুঝা যেত যে, তিনি উদ্ধৃতি কম দিতেন। তাঁর অসংখ্য উদ্ধৃতি মুখুস্থ ছিল, কুরআন হাদিস সম্পর্কে এত জ্ঞান ছিল যে, তিনি সেগুলো আত্মস্থ করে নিজের ভাষায় বলতেন। এই বলাটা অন্য অনেকে পারতেন না। এই পারাটাই হচ্ছে একজন যোগ্য লোকের পরিচয়। তাঁর জ্ঞানের গভীরতা এর মাধ্যমেই মাপা যায়। নজরুলের একটা কবিতা যে কেউ মুখস্ত করে লিখতে পারে বা বলতে পারে, কিন্তু নজরুলের কবিতা পড়ে, আত্মস্থ করে, নজরুলের কবিতার নির্যাস তুলে ধরা কিন্তু সহজ ব্যাপার নয়, অনেক কঠিন। শাইখুল হাদীস রহ, ছিলেন হাদীস শাস্ত্রের পণ্ডিত, আমি যতদূর জানি, মদিনা থেকে হাদিস শাস্ত্রের যে মহান সিলসিলা চলে এসেছে, তিনি আমাদের বাংলাদেশে সেই সিলসিলার অধস্তন পুরুষ ছিলেন। অন্য আটÑদশজন শাইখুল হাদিস আর তিনি এক কথা নয়। রাহমানী পয়গাম: শাইখুল হাদীস রহ. এর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ আসলো কি করে? মাসুদ মজুমদার: হুজুরের কাছাকাছি বসে কথা বলার সুযোগ হলো হযরত হাফেজ্জি হুজুরের দরবার থেকে। হাফেজ্জি হুজুর তখন তাওবার রাজনীতি শুরু করেছেন। আমাদেরকেও ডাকলেন, আমরা তাঁর সান্নিধ্যে গেলাম। সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক বৈঠকে আমরা বসতাম। তৎকালীন দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ সেখানে উপস্থিত থাকতেন। যাদের মধ্যে, মাওলানা আব্দুর রহীম সাহেব, মুফতি ফজলুল হক আমিনী সাহেব, অধ্যাপক আখতার ফারুক সাহেব, মেজর জলিল সাহেব, ইয়ার ভাইস মার্শাল ড. সদরুদ্দীন, প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম, অধ্যাপক শাহেদ আলী, হুজুরের ছেলে হামিদুল্লাহ ভাই অন্যতম ছিলেন। এমনকি লেখক আহমদ সফাসহ কিছু লোক হাফেজ্জি হুজুরের এই উদ্যোগকে এতটা পছন্দ করেছিলেন যে তারা হযরতের দরবারে আসতেন। তখন আমরা এক সাথে মিটিং করতাম। শাইখুল হাদীস সাহেব সাধারণত হাফেজ্জি হুজুরের খুব কাছাকাছি ডানে বা বায়ে বসতেন। আমরা তখন বুঝতাম যে হুজুরের পরে তিনিই আমাদের কছে সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি। সেখানে অনেক কথাবার্তা হত, বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, আন্দোলন সব কিছু নিয়ে আমরা কথাবার্তা বলতাম। সে কথাবার্তার মধ্যে একদিন আমি কি যেন একটা বিষয়ে কথা বলার পর হুজুর আমার দিকে দৃষ্টি দিলেন। আমার বক্তব্যকে সমর্থনও করলেন। এই প্রথম হুজুরের সাথে আমার মুখোমুখি কথা বলা এবং সমর্থন ও তাঁর দোয়া পাওয়া। এরপর তিনি আমাকে বললেন মজুমদার সাহেব! শুনেছি আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন, তাহলে আপনি এগুলো কিভাবে জানলেন...। সেটাই প্রথম হুজুরের সঙ্গে আমার হার্ড টু হার্ড কথা বলা। এরপরে হাফেজ্জি হুজুরের মুভমেন্টের কাজে হুজুরের সঙ্গে কিছু সফরও আমি করেছি। ফরিদপুর, মোমেনশাহী, সিলেট একসাথে সফর করেছি। পরবর্তীতে যখন তিনি খেলাফত মজলিস করলেন তখন থেকে তো হুজুরের সাথেই ছিলাম। রাহমানী পয়গাম: আপনি খেলাফত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলেন কী করে? মাসুদ মজুমদার: আমরা তখন হুজুরের খেলাফত আন্দোলনে ছিলাম না। বরং হুজুর যে বক্তব্যটা নিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন, আমরা সেটা জাতির সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে সহায়তা করতাম। তখন আমার একটা রাজনৈতিক পরিচয় ছিল, আমি যুব ইসলামি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সেই হিসেবে ওই সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা সেখানে প্রতিনিধিত্ব করতাম। এরপরে যখন খেলাফত মজলিস গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। নতুন একটা আন্দোলনের কথা চিন্তা করা হয়। তখন আমরা প্রতিনিয়ত এক সঙ্গে বসতাম। কিভাবে দুইটা সংগঠন এক করে সামনের দিকে আগানো যায় সেটা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতাম। আর সম্পূর্ণ অর্গানাইজেশনটা দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে হুজুর আমাদের কাছে আমিরের জায়গায় ছিলেন। আর আমরা পেছন থেকে কিছু লোক কাজ করে এক পর্যায়ে সেটা সামনে নিয়ে আসলাম এবং ঘোষণা হলো আমরা এক সঙ্গে কাজ করবো এবং সেদিন থেকে হুজুর আমাদের আমির হলেন। রাহমানী পয়গাম : আপনারা সবাই ভিন্ন ধারার লোক ছিলেন। সবাই ইংরেজি শিক্ষিত, সবাই জেনারেল ছিলেন, তো আপনারা কেন শাইখুল হাদীসের নেতৃত্বে কাজ করতে আগ্রহী হলেন? মাসুদ মজুমদার : আসলে সেই মুহূর্তে তিনিই বাংলাদেশে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। বাংলাদেশে ইসলামের পক্ষে নেতৃত¦ দেয়ার মতো, প্রতিনিধিত্ব করার মতো যোগ্যতা তাঁর ছিল। সে মুহূর্তে ইসলামকে রাজনৈতিকভাবে উপস্থাপন করার এবং ইসলামের সার্বজনীন আবেদন তুলে ধরার যে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল আমরা এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার জন্য তাঁর চেয়ে যোগ্য লোক তখন কাউকে মনে করিনি। তাছাড়া ইংরেজি শিক্ষিত হলেও আমরা যেহেতু ইসলামি সাহিত্য পড়ে ইসলামকে বুঝার চেষ্টা করেছিলাম সেক্ষেত্রে একজন আলেমে দ্বীনকে চেনার মতো সৌভাগ্য আমাদের হয়েছিল। রাহমানী পয়গাম : শাইখুল হাদীসের মাঝে ভিন্ন মাত্রার কী পেয়েছিলেন? মাসুদ মজুমদার : আমরা অতীতে বহু ইসলামি স্কলারের লেখা পড়েছি। সেখান থেকে শাইখুল হাদীসের ভেতরে আলাদা একটা মেজাজ পেয়েছিলাম। একটা দ্বীনি মেজাজ। আখলাকের একটা সমন্বয় আমরা তাঁর মাঝে দেখেছিলাম। সেটা দেখে আমরা নির্ধারণ করলাম যে তিনি আমাদের আমির হওয়ার যোগ্য। তাকে আমরা আমির মেনে কাজ করলাম। তাছাড়া হুজুরের ভেতরে একটা কেটালিস্ট পাওয়ার ছিল। অন্যকে প্রভাবিত করার যোগ্যতা ছিল। নিজে প্রভাবিত না হয়ে অন্যকে প্রভাবিত করার যে যোগ্যতা লিডারশিপের জন্য লাগেÑ আমাদের দেশের অনেক আলেমের মধ্যেই এটা পাওয়া যায় না। কিন্তু এদের মতো ব্যক্তিরা ব্যতিক্রম। তাদের সামনে গেলেই আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুলের কথা মনে হয়। আমাকে একজন বলেছিল, সম্ভবত সেটা শেখ সাদি রহ. এর কথা। কোনো মানুষকে দেখলে যদি আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুলের কথা মনে হয় তাহলে বুঝতে হবে সেই লোকটা বুজুর্গ। আল্লামা আজিজুল হককে দেখার পর আমার এমনি মনে হত। কখনো মনে হতো যে তিনি তাঁর ছেলে মাহমুদ ও মাহবুব ভাইকে যেমন ¯েœহ করতেন, আমাদেরকেও তেমন স্নেহ করেছেন। এটার আরও একটা কারণ ছিল, বাংলাদেশের আলেমদের ব্যাপারে আমার কিছু লেখালেখি ছিল আগে থেকেই, তিনি সম্ভবত আমার প্রায় লেখা পড়তেন, আমি যখন বিক্রমের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি তখনও পড়তেন এবং পরবর্তিতে অন্যান্য যত লেখা লেখেছি তিনি সুস্থ থাকা পর্যন্ত পড়ার চেষ্টা করতেন। রাহমানী পয়গাম: কোনো বিশেষ ঘটনা কি মনে পড়ে? মাসুদ মজুমদার: একবার রেশমি রুমাল আন্দোলন সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম। সম্ভবত জাগো মুজাহিদে লেখাটা ছাপা হয়েছিল। তখন আমি সমস্ত ইসলামি পত্রিকাতে লিখতাম। রেশমি রুমাল সম্পর্কে লিখার পর হুজুর একদিন আমাকে একান্তে জিজ্ঞাসা করলেন, মজুমদার সাহেব আপনি এই ইতিহাস কোথায় পেলেন? আমি বললামÑ হুজুর আমি জার্নালিজম নিয়ে পড়েছি। কিন্তু আমার মূল সাবজেক্ট হল ইতিহাস। ইসলামের ইতিহাস, ভারতবর্ষের ইতিহাস, ইউরোপের ইতিহাস এগুলো আমি ভালো করে পড়ার চেষ্টা করেছি। আমি আলেমদের ইতিহাসটা জানার কারণে শাব্বির আহমদ উসমানি, জাফর আহমদ উসমানি উবায়দুল্লাহ সিন্ধিসহ আমাদের উপমহাদেশের যত সম্ভ্রান্ত আলেম আছেন তাদের ইতিহাস পড়ে দেখেছি এবং আমার কাছে মনে হয়েছে আলেমরা শুধু সমাজটাকে টিকিয়ে রাখছেন না, ইসলামকে টিকিয়ে রাখার জন্যও কাজ করছেন। ইসলাম তো আল্লাহ তায়ালাই টিকিয়ে রাখবেন, কিন্তু উসিলা হলো এই আলেমগণ। এরা আছেন বিধায় দ্বীনের বাতিগুলো এখনো জ্বলছে। আর আমাদের সমাজে সবাই কিন্তু হাফেজ্জি হুজুরের কাতারে শামিল হননি। সবই কিন্তু শাইখুল হাদীসের সঙ্গে যোগ দেননি। সবাই কিন্তু মুফতি ফজলুল হক আমীনির সাথে এক কাতারে মিছিল করেননি। কিন্তু তাদের দ্বারা প্রভাবিত হননি এমন কোনো হক্কানি আলেম বাংলাদেশে আছে বলে আমি মনে করি না। রাহমানী পয়গাম: খুব কাছ থেকে শাইখুল হাদীসকে কেমন পেয়েছেন? মাসুদ মজুমদার: তাকে যখন দূর থেকে দেখেছি তখন তাঁর ব্যাপারে যে ধারণাটা ছিল, একান্তে যখন দেখেছি তখনও ধারণাটা পাল্টায়নি। অনেক ক্ষেত্রেই এমন হয় যে, একজন লোককে যখন সুটেড বুটেড অবস্থায় দেখা হয়, তখন তাঁর সম্পর্কে এক ধরণের ইমেজ তৈরি হয়। কাছে আসলে ধারণাটা পাল্টে যায়। আবার একান্তে গেলে সেটা উল্টে যায়। এ ক্ষেত্রে হুজুর ব্যতিক্রম ছিলেন। আমি তাকে দূর থেকে যেভাবে দেখেছি, যে সম্মোহনি ব্যক্তি এবং যে যোগ্যতাসম্পন্ন মনে হয়েছে, তাকে যখন আরলি ইস্টেজে দেখেছি ঠিক তেমনি মনে হয়েছে। এরপর একান্তে যখন তাঁর সঙ্গে উঠা বসা করেছি তখনও তাই দেখেছি। একজন মানুষকে কখন চেনা যায়? যখন তাকে নেতা হিসেবে পান, অভিভাবক হিসেবে পান, নির্দেশদাতা হিসেবে পান, ইনসাফ করার ক্ষেত্রে পান, বিচার শালিসের সময় পান, যখন তাকে ব্যক্তিগতভাবে পান, একান্তে যখন দেখার সুযোগ হয়, তখন তাকে চেনা যায়। আমি একান্তে হুজুরকে বহুবার পেয়েছি, তাঁর সয্যার পাশে বসে কথা বলেছি। বাসায় গিয়েছি। তিনি আদর করে দাওয়াত দিয়েছেন। খাইয়েছেন। কম খেলে ধমক দিয়েছেন। ‘আরে জোয়ান কালে আমরা এত এত খাইছি, আপনি খান’। এমনও বলেছেন। এই সবগুলো ছাপিয়ে উনি যে আমার রাহবার হলেন, সেটা শুধু আজিজুল হক সাহেব একজন হাদিসবেত্তা সেজন্য নয়, তিনি একজন বুজুর্গএ জন্য নয়, তিনি বাংলাদেশের একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি, তিনি বাবরি মসজিদ লংমাচের্র নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি ওয়াল্ড ওয়াইড একজন খ্যাতিসম্পন্ন আলেম, এসব কারণে নয়, আমি মনে করেছি ‘আতিউল্লাহা ওয়াআতিউর রাসুলা ওয়াউলিল আমরি মিনকুম’ এই অনুভূতি থেকে আমি তাকে সম্মান করেছি। আমি মনে করেছি আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য করাটা আর আমাদের মধ্য থেকে একজন কর্তৃত্বশালী উলিল আমরের আনুগত্য করা একই কথা। আমি সেই স্থানে তাকে পেয়েছি। রাহমানী পয়গাম : তাঁর চরিত্রের সবচেয়ে সুন্দর দিক আপনার কাছে কী মনে হয়েছে? মাসুদ মজুমদার : অন্য অনেকের মাঝ থেকে শাইখুল হাদীস আমার কাছে ভিন্ন মর্যাদার ছিলেন। তার কারণ হলো, আমি তাঁর মধ্যে একটা শিশুসুলভ সরলতা পেতাম। তিনি যা বলতেন সেটা নিজে মানতেন। তিনি যা মানতেন তাই বলতেন। তিনি যখন কোনো ব্যাপারে একমত হতেন না। তখনও তিনি এমনভাবে দ্বিমত পোষণ করতেন সেখানেও তাঁর সুন্নাহর খেলাফ দেখতাম না এবং তিনি যখন কোনো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না তখন একজন আমির, একজন রাহবার যেভাবে আল্লাহর ওপর সোপর্দ করে যে, আল্লাহ আমার কলবের ভেতরে এব্যাপারের সিদ্ধান্তটা জানিয়ে দাও। তিনি এমন করতেন। কঠিন কঠিন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মুহূর্তেও আমি এমনই দেখেছি। রাহমানী পয়গাম : হুজুরের কাছ থেকে আপনার সবচেয়ে বড় পাওয়া কী? মাসুদ মজুমদার : আমার ব্যাপারে হুজুরের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভিন্ন। মিটিংয়ের মধ্যে মাঝে মাঝে এমন হত যে, সকলের কথার মাঝে তিনি আমার দিকে তাকাতেন। আমি কথা না বললে বলতেন, মজুমদার সাহেব কিছু বলেন। আর আমি কথা বলার পর প্রায়-ই তিনি তাতে সমর্থন দিতেন। এমনকি কোনো একটা মিটিংএ যদি আমি না থাকতাম তাহলে সবাইকে জিজ্ঞাসা করতেন, মজুমদার সাহেব কোথায়। আমি পিছনে বসলে, আমাকে ডেকে সামনে বসাতেন। কোনো ব্যাপারে দায়িত্ব নেয়ার জন্য চাপ দিতেন। অন্যরা যখন বলতেন যে, তিনি সাংবাদিকতার পেশার সঙ্গে জড়িত। ব্যস্ততা আছে। তখন তিনি সেটা মেনেও নিতেন। কোনো একটা ড্রাফট করার পরে তিনি বলতেন, মজুমদার সাহেব কি এটা দেখেছে। আমি দেখলে তিনি ভরসা পেতেন, আস্থা পেতেন। এটা আমার জন্য বিরাট অর্জন। এটা আমার জন্য একটা বাড়তি দোয়া। এটা সবাই পায় না। তিনি যেসব বিবৃতি দিতেন, তাঁর নামে যেসব বিবৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হত, যেসব জায়গায় তিনি লিখিত বক্তব্য দিতেন। তিনি বলতেন লেখাটা মজুমদার সাহেবকে একটু দেখাও। এমনকি আখতার ফারুক সাহেবকেও বলতেন আমাকে দেখাতে। আখতার ফারুক সাহেব এক সময় আমার সম্পাদক ছিলেন। তাকে খুব কাছ থেকে জানতাম এবং বাংলা সাহিত্যের পণ্ডিত হিসেবে যিনি স্বীকৃত। আখতার ফারুক ভাইকেও তিনি মাঝে মাঝে বলতেন, মজুমদার সাহেব কি দেখেছে? এটা আমি উপভোগ করতাম না। এটা আমার উপভোগের বিষয় ছিল না। এটা বলার সাথে সাথে আমার দায়িত্বশীলতা আরও বেড়ে যেত। রাহমানী পয়গাম : তাঁর সরলতার কোনো উদাহারণ কি মনে পড়ে? মাসুদ মজুমদার : তিনি ছোট ছোট বিষয় নিয়েও আমাদের সাথে পরামর্শ করতেন। একটি ঘটনা মনে পড়েÑ একবার কোনো এক ব্যাংকের পক্ষ থেকে হুজুরকে দাওয়াত করা হলো। ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমের ক্ষেত্রে যেহেতু আলেমদের কথা আছে তাই তিনি ভাবছিলেন যাবেন কি না। তিনি আমার সঙ্গে পরামর্শ করলেন, বললেন মজুমদার সাহেব আমি কি সেখানে যাব? আমি বললাম হুজুর আপনি যাবেন, আপনি আপনার জায়গা থেকে আপনার কথা বলবেন। তারপর তিনি সেই প্রোগ্রামে গেলেন। প্রোগ্রাম থেকে এসে আমাকে আবার বললেন মজুমদার সাহেব আমি সেখানে গিয়েছিলাম। তারা ভালো করে আপ্যায়ন করেছে, আর আমি এই কথাগুলো সেখানে বলে এসেছি। এরপর এব্যাপারে তিনি আমার মত জানতে চাইলেন? আমি বললাম জ্বি হুজুর! আপনি যথার্থ কথাই বলে এসেছেন। আপনারা জানেন, হুজুর বুখারি শরিফের পরিশিষ্টে মাওলানা মওদুদি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। কেউ কেউ এ ব্যাপারে হুজুরকে বলতেন মওদুদি ও একজন ইসলামি স্কলার, আপনিও একজন ইসলামি স্কলার। তাঁর ব্যাপারে এই বক্তব্যগুলো রেখে যাবেন কি না। আপনিও তো এক সময় থাকবেন না। তারা বুখারি শরিফের পরিশিষ্টটা বাদ দেয়ার পরামর্শ দিতেন। হুজুর এব্যাপারেও আমার সাথে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেছেন, হুজুর মনে করতেন আমি মওদুদি সাহেবকে অসম্মান করলাম না, বরং তাঁর সম্পর্কে আলেমদের যে মূল্যায়ন, আমার যে মূল্যায়ন সেটা আমি রাখলাম। এটা বুখারিতে থাকুক। আমি হুজুরের কথাটাকে সমর্থন করেছি। শাইখুল হাদীস সাহেবকে ব্যক্তিগতভাবে আমি যেমন দেখেছি। তাত্ত্বিকভাবে তিনি খুব নিরেট ছিলেন, এক্ষেত্রে তিনি একচুলও ছাড় দেয়ার পক্ষপাতি ছিলেন না। রাহমানী পয়গাম : নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে তাঁর বৈশিষ্ট্য কী ছিল? মাসুদ মজুমদার : তিনি সকলকে সাথে নিয়ে কাজ করতে পারতেন। তাঁর সঙ্গে ৫০ভাগ একমত হয়েছে এমন লোকের সাথে তিনি কাজ করেছেন। তাঁর সঙ্গে ১০ভাগ একমত হয়েছে তাদের সঙ্গেও তিনি কাজ করেছেন। তাঁর সঙ্গে ১০০ভাগ একমত হয়েছে তাদের সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন। এটাই হচ্ছে একজন লিডারের বৈশিষ্ট্য। আমি দেখেছি, অনেক আলেমের সাথে তিনি বসতেন, সবার কথার সাথে একমত হতেন না। কিন্তু এই লোকগুলোকেও তিনি অপরিহার্য মনে করতেন, সম্মান করতেন। রাহমানী পয়গাম : উদাহারণ স্বরূপ কারো কথা কি বলা যায়? মাসুদ মজুমদার: মাওলানা আব্দুর রহিম সাহেবের কথাই বলা যায়। তিনি আব্দুর রহিম সাহেবকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন, অনেকে বলতো যে তিনি তো মাওলানা মওদুদির কিছু বইও অনুবাদ করেছেন। শাইখুল হাদীস সাহেব বলতেন, তাতে কী হয়েছে, তিনি তো বিতর্কিত কোনো বই অনুবাদ করেননি। তিনি তো কোনো ক্ষতি করেননি। হাফেজ্জি হুজুরের দরবারেও তিনি সবার সঙ্গে ছিলেন। রাহমানী পয়গাম: রাজনীতির কঠিন সংকটময় মুহূর্তে তাকে কেমন পেয়েছেন? মাসুদ মজুমদার: বাবরি মসজিদ লংমার্চের কথাই ধরুন, তাছাড়া হাফেজ্জি হুজুরের দরবার থেকে চলে আসা, খেলাফত মজলিস শুরু করা, এরপর রাহমানিয়ার বিরোধের মুহূর্তে নতুন করে জামিয়া গঠনের ব্যাপারটা, সরকার যখন তাকে গ্রেফতার করেছে তখনকার অবস্থাÑ প্রতিটি সঙ্কটময় মুহূর্তে রাজনৈতিক বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি বিচার করার চেষ্টা করেছেন কোনটা বৈধ আর কোনটা অবৈধ। আমাদের দেশে অনেকে ইসলামের জন্য কাজ করেন, তাদের চিন্তাটা হয় তারা রাজনৈতিকভাবে কতটা লাভবান হবেন সেটা। আর শাইখুল হাদীস রহ. এর চিন্তা ছিল তিনি দ্বীনিভাবে কতটুকু লাভবান হবেন। ইসলাম কতটুকু লাভবান হবে। তিনি ইসলাম দিয়ে রাজনীতিকে বিচার করতেন। রাজনীতি দিয়ে ইসলামকে বিচার করতেন না। যেমন আমাদের দেশে বর্তমানে অনেক আলেম আছেন যারা দরবারি হয়ে গেছেন, দরবারের কাছাকাছি অবস্থান করেন। শাইখুল হাদীস সাহেব কখনো দরবারি হননি। দরবারি হননি কেন, কারণ ঈমান তাকে প্রতিনিয়ত পাহারা দিত। অন্যদের ঈমান যেখানে তাদের আপোষ করতে দিয়েছে, সেই ঈমান তাকে পাহারা দিয়েছে। এজন্য যখন কঠিন কোনো সমস্যা আসতো, তখন তাঁর কাছে রাজনৈতিক কোনো বিবেচনা থাকতো না। তাঁর কাছে দ্বীনি বিবেচনাই থাকতো। এর মধ্যে আল্লাহ ও রাসুলের আদর্শের এবং এই সমাজের কী উপকার এগুলো তিনি বিবেচনায় রাখতেন। এই ব্যাপারগুলো ভেবে তিনি যখন মুতমায়িন হয়ে যেতেন এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতেন তখন আর সেখান থেকে তাকে একচুলও নড়ানো যেতো না। এমন অবস্থা যে কয়বারই হয়েছে তখন আমরা সবাই হুজুরের সাথে কাতারবন্দি হয়ে দাঁড়িয়েছি। রাহমানী পয়গাম : তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারাটা তাহলে কী ছিল? মাসুদ মজুমদার : আমি কখনো দেখিনি রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবেন এই চিন্তাটা তিনি করেছেন। একটা মিছিল করলে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবেন এটা তিনি কখনো দেখেননি। তিনি চিন্তা করতেন এটা করলে দ্বীনের কতটুকু লাভ হবে। ইসলামের কতটুকু লাভ হবে। আল্লাহর রেজামন্দি হাসিলে কতটা হবে। আমার আখেরাতে কতটুকু হবে। তিনি রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য দ্বীনকে ব্যবহার করেননি। তিনি দ্বীনের ফায়দার জন্য কাজ করেছেন। এর মধ্যে রাজনৈতিক ফায়দা যতটুকু হয়েছে সেটা এসে গেছে। অন্যরা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করেন তিনি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করেননি। তিনি ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান মানতেন এবং পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। সে ক্ষেত্রে তিনি বিশ্বাস করতেন, কাজটা ভালো, পদ্ধতিটা খারাপ এটা হতেই পারে না। অনেকে মনে করে পদ্ধতি খারাপ হলেও আমার নিয়ত তো ভালো। এটা তিনি বিশ্বাস করতেন না। তাঁর কাজের তরিকা ছিল ফায়সালা হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নির্দেশনা অনুসারে। সময় বিবেচনা করবো আমি, সেই বিবেচনা করে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বক্তব্য অনুসারে আমি উত্তম সিদ্ধান্ত নিব। আমার রাজনৈতিক লাভের দরকার নাই। শেখ হাসিনা সরকার তাকে গ্রেফতার করেছে বাদশাহ মিয়া হত্যার মামলা দিয়ে। নিন্দুকরা অট্টহাসি দিয়েছে। শয়তানও সম্ভবত মুচকি হেসেছে। তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ হত্যার তোহমত আনা হলো এবং তাকে শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিতে হল। আমার কাছে মনে হয় শেখ হাসিনার প্রথম আমলের পরাজয়ের ক্ষেত্রে শাইখুল হাদীসের গ্রেফতারটা অনিবার্য কারণ হিসেবে কাজ করেছে। কারণ দেশের একজন সম্মানিত আলেমকে বেইজ্জতি করার এখতিয়ার আল্লাহ কাউকে দেননি। তার প্রমাণ এখানে আছে। এখনো আমি মনে করি হাটহাজারির আল্লামা আহমদ শফি দা.বা.সহ অন্যদেরকে যারা বর্তমানে খুব বেশি ত্চ্ছু তাচ্ছিল্য করছে, তাদেরকে বিভিন্ন নাম দিয়ে অবহেলা করছে, আমরা মনে করি দুনিয়াতেও তাদের জিল্লতি আমরা দেখে যাব। হুজুরের সিদ্ধান্তের প্রক্রিয়া ছিল সুন্নাহর প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়। তিনি ভুল করলেও ভুল করে ভুল করেছেন। ঠাণ্ডা মাথায়, রাজনৈতিক স্বার্থ নিয়ে, বা প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এটা আমার কাছে কখনো মনে হয়নি। একজন মানুষের ভুল হতেই পারে। আল্লাহর রাসুল এবং সাহাবাদের আদর্শ ছাড়া বহুলোকের বহু ভুল হয়। রাজনৈতিক ভুল হয়, অর্থনৈতিক ভুল হয়, সংসার জীবনে ভুল হয়, সন্তান লালনের ক্ষেত্রে ভুল হয়। হয়তো তারও হয়েছে। কিন্তু যতদিন দ্বীনের ওপর দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন তিনি ইচ্ছা করে কোনো ভুল করেননি। রাহমানী পয়গাম: অল্প শব্দে হুজুরকে মূল্যায়ন করতে গেলে কী বলবেন? মাসুদ মজুমদার: হুজুরকে আমার দেখার আর অন্য দুচারজন আলেমের দেখার মধ্যে পার্থক্য হল, আমি ব্যক্তি হুজুরকে দেখেছি, একজন আলেম হুজুরকে দেখেছি, একজন বুজুর্গকে দেখেছি, একজন হাদিস বেত্তাকে দেখেছি, একজন রাজপথের লড়াকু আমিরকে দেখেছি, আবার রাহবার হিসেবে দেখেছি, মজলুম অবস্থায় দেখেছি, তাঁর জেলের মুহূর্তে দেখেছি, জেল থেকে বের হতে দেখেছি, বিপদের মুহূর্তে দেখেছি। সকল অবস্থায় হুজুরকে দেখার কারণে ইতিহাসেরে ধারাবাহিকতায় মদিনা থেকে যে সিলসিলা চলছে, আমি সেই ধারার সঙ্গে মিলিয়ে তাকে বুঝতে চেষ্টা করেছি এবং আমার সৌভাগ্য যে, আমি মনে করি হুজুরকে কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছিলাম। তিনি ছিলেন আমার অভিভাবক, তাঁর জন্য মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি। তাঁর মত মহান ব্যক্তিত্বের ¯েœহ ভালবাসা আমি পেয়েছি এজন্য আমি ধন্য। তাঁর গাইডেন্স আমি পেয়েছি, এজন্য আমি ধন্য। তাঁর নির্দেশনা আমি পেয়েছি এজন্য আমি ধন্য। আমি বিশেষভাবে এ কথাটাই বলবো, বাড়িয়ে কিছু বলা দরকার নেই। আমি সরল বিশ্বাসে যে কথাগুলো বলেছি। এই কথাগুলোই শাইখুল হাদীস সম্পর্কে আমার অবজার্ভেশন। আমার দেখা, আমার জানা। আমি জানি না এমন কোনো কথা এখানে বলিনি। আর ব্যক্তিগত জীবনে হুজুরের সাথে আমার সম্পর্কটা এক ধরণের নেয়ামত। আমি এখনো মাঝে মাঝে তা স্মরণ করি। রাহমানী পয়গাম: শেষ কবে দেখা করেছেন? মাসুদ মজুমদার: হুজুরের কাছাকাছি আমি ছিলাম ৮২ থেকে তাঁর একেবারে মৃত্যু পর্যন্ত। তাঁর ইন্তেকালের কিছুদিন আগে তখন তিনি প্রায় বাকরুদ্ধ। আমি একবার দেখা করতে গিয়েছিলাম। রাহমানিয়ায় যে রুমটাতে তিনি থাকতেন সেখানে গিয়েছিলাম। মনে হলে আমাকে চিনতে পেরেছেন। এবং যারা ছিল তাদেরকে ইশারা করলেন আমাকে কিছু নাস্তা দেয়ার জন্য। আমি হুজুরের পায়ের কাছে গিয়ে বসলাম। দোয়া নিলাম। সেটাই ছিল হুজুরের সঙ্গে আমার শেষ দেখা।
********************
অধ্যাপক মাওলানা গিয়াসুদ্দীন আহমদ। সত্তোরোর্ধ এক আল্লাহওয়ালা সাধক। আকাবের ও আসলাফের নৈকট্যলাভে ধন্য। শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর বড় জামাতা এবং তার প্রবীন ছাত্রদের একজন। মুহিউসসুন্নাহ হযরত শাহ আবরারুল হক রহ.Ñএর খলিফা। হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর জীবনীগ্রন্থ ‘আশরাফ চরিত’ এর অনুবাদক। শিক্ষাজীবনে কওমি ও জেনারেল উভয় ধারায় তিনি পূর্ণ শিক্ষা লাভ করেন। কওমি পড়াশোনা লালবাগ জামেয়া কোরআনিয়ায়। আর পরবর্তীতে উস্তাদদের পরামর্শক্রমেই এক সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা মাড়িয়েছেন ইংরেজি বিভাগে অনার্স ও এম.এ.করে। কর্মজীবনে শিক্ষকতা করেছেন ঢাকা আলিয়া ও মিরপুর বাংলা কলেজে। বৈচিত্র্যময় জীবনের চক্ররথে পড়াশোনা আর শিক্ষকতার মোড় ঘুরলেও চিন্তা চেতনা কখনো আপন কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয়নি। যেই আলোর দেখা পেয়েছিলেন আকাবেরদের সান্নিধ্যে থেকে, সেই আলোর পথে চলেই কাটিয়েছেন সারা জীবন। চাকুরি থেকে অবসর নিয়েছেন এক যুগেরও আগে। বর্তমানে নিয়োজিত আছেন তাফসিরে উসমানীর অনুবাদের কাজে। কুরআনের লুগাত ও তারকীবসহ উক্ত তাফসীর গ্রন্থটি অতি শীঘ্রই প্রকাশিত হচ্ছে। এটাই এখন তার একমাত্র কাজ ও স্বপ্ন। এক বিকেলে হযরতের সাথে কথা বলেন রাহমানী পয়গামের বিভাগীয় সম্পাদক মুহাম্মদ এহসানুল হক। আলোচনায় উঠে আসে শাইখুল হাদীস রহ. এর জীবনের অজানা অনেক কথা, পাঠকদের জন্য অতিদীর্ঘ সেই সাক্ষাকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।
শাইখুল হাদীসকে যেমন দেখেছি
অধ্যাপক মাওলানা গিয়াসুদ্দীন আহমদ
রাহমানী পয়গাম: হযরত শাইখুল হাদীসের সাথে আপনার সম্পর্ক কতদিনের? মাওলানা গিয়াসুদ্দীন আহমদ: শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক সাহেব রহ. এর সঙ্গে অধমের সম্পর্ক অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে। অর্থাৎ লালবাগ জামেয়ার প্রতিষ্ঠা বছর ১৯৫০ সন থেকে তার ওফাতের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত। সে বছরেই আমি জামেয়ায় কাফিয়া জামাতে ভর্তি হই। রাহমানী পয়গাম: শাইখুল হাদীস রহ. এর কাছে কী কী কিতাব পড়েছেন? মাওলানা গিয়াসুদ্দীন আহমদ: ভর্তির প্রথম বছরেই হযরত শাইখুল হাদীস রহ. এর নিকট নাফহাতুল ইয়ামান নামক আরবি সাহিত্যের একটি কিতাব পড়ার সৌভাগ্য হয়। তিনি মাদরাসায় তার শিক্ষকতার প্রথম জীবনে মূলত হাদিস ও সাহিত্যের কিতাবাদিই পড়াতেন। সেই হিসাবেই দ্বিতীয় বছর আমি তার নিকট নাফহাতুল আরব নামক সাহিত্যের কিতাব পড়ি। আর আমার মাদরাসা জীবনের শেষ দুবছরে হযরত শাইখুল হাদীসের নিকট মেশকাত শরিফ ও বুখারি শরিফ পড়ার পরম সৌভাগ্য লাভ করি। রাহমানী পয়গাম: আপনার দেখায় শাইখুল হাদীস রহ. এর দরসের বৈশিষ্ট্য কী ছিল? মাওলানা গিয়াসুদ্দীন আহমদ: শাইখুল হাদীস রহ. এর দরসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, কিতাব শুরু করার আগেই ছাত্রদের তিনি বলে দিতেন, তোমরা দরসে কিতাব নিয়ে আসবে না। বরং আগামী দিন দরসে যতটুকু পড়ার সম্ভাবনা ততটুকু সুন্দর করে খাতায় লিখে নিয়ে আসবে। দরসে বসেই তিনি সবার খাতা এক নজর দেখতেন এবং সবার খাতাতেই দুএকটি বাক্য বা শব্দ আরবি টাইপের সুন্দর করে লিখে দিতেন। এতে করে বছর শেষ হতে না হতেই সকল ছাত্রের হাতের লেখা সুন্দর হয়ে যেত। সাহিত্যের দরসে আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, আজব ভঙ্গিতে আরবি কাব্য পাঠ। প্রথমে তিনি নিজেই কাব্যিক সুরে পড়ে যেতেন। আর ছাত্ররা নিঃশব্দে তার পাঠের অনুকরণ করত। গদ্য সাহিত্য অবশ্য আমরা নিজ নিজ ঢঙেই পড়তাম, কিন্তু কাব্য সাহিত্য তারই ভঙ্গিতে আমাদের পড়তে হত। শাইখুল হাদীস রহ. এর সাহিত্য ক্লাসে আভিধানিক ও ব্যাকরণগত তাহকিকাতের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তাতে অল্প দিনেই তার ক্লাসে ছাত্ররা সাহিত্যে পারদর্শী হয়ে উঠত। এতে করে অন্যান্য বিষয়েও নির্ভুলভাবে এবারত পড়ার যোগ্যতা হাসিল হত। হযরত শাইখুল হাদীস রহ. ক্লাসের আর একটি বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে, তিনি ছাত্রদের আরবি সাহিত্যের চর্চা করানোর সাথে সাথে আরবি ভাষায় বক্তৃতা করানোর চেষ্টাও করতেন। তিনি নিজে ছাত্রজীবনে কীভাবে আরবি বক্তৃতা করতে শিখেছিলেন, তা শুনিয়ে শুনিয়ে আমাদের উৎসাহিত করতেন। তার দরসের আরও একটি বৈশিষ্ট্য ছিল স্বভাবসুলভ রসিকতা। দরসের পরিবেশকে আনন্দমুখর করে তুলত তাঁর এই তরিকা। তাতে করে ছাত্ররা সাহিত্যরস উপভোগ করত পাঠ্য বিষয়টি অতি সহজে বুঝে নিত। অথচ হাদিসের দরসে ছিল তার পরম আদব ও চরম গাম্ভীর্য। ফলে হাদিস শাস্ত্রের প্রতি ছাত্ররা হয়ে উঠত শ্রদ্ধাশীল ও গাম্ভীর্য পূর্ণ। রাহমানী পয়গাম: শাইখুল হাদীস রহ, এর ছাত্রদের শাসনের ধরণ কী ছিল? মাওলানা গিয়াসুদ্দীন আহমদ: আমরা ছাত্রজীবনের শুরুতেই হযরত শাইখুল হাদীস রহ. এর মধ্যে যে বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম, তা হলো তার সীমাহীন দরদের সাথে ছাত্রদের গড়ে তোলা। ছাত্রদের তরবিয়ত ও চারিত্রিক বিষয়ের প্রতিও তার সতর্ক দৃষ্টি থাকত। একবার আমাদের ওপরের ক্লাসের কোনো এক ছাত্রের কোনো এক ঘটনায় অন্য সব ছাত্র তার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। এমনকি এক পর্যায়ে একদিন সকল ছাত্র সেই ছাত্রটির ওপর চড়াও হয় এবং একজনে সেই ছাত্রটিকে একটি থাপ্পর বা ঘুষি মারে। ছাত্রটি দৌঁড়ে বাইরে চলে এলে ছাত্র শিক্ষক সকলে ঘটনাটা জানতে পারেন। অমনি হযরত শাইখুল হাদীস রহ. শিক্ষকদের নিয়ে মিটিং ডাকেন। হযরত সদর সাহেব রহ. সম্ভবত গ্রামের বাড়ি ছিলেন। মিটিংয়ে হযরত শাইখুল হাদীস রহ. ই সর্বাগ্রে বক্তৃতা করেন। লালবাগ শাহী মসজিদের সেই সভায় দাঁড়িয়েই তিনি কাঁদতে লাগলেন এবং বললেন, জামিয়া কুরআনিয়া প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কী ছিল, আর আজ কী ঘটে গেল? এ তো মাদরাসা প্রতিষ্ঠার আদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। মোটকথা, তার আবেগঘন বক্তব্যে ছাত্র শিক্ষক সবাই অত্যন্ত প্রভাবিত হন এবং সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, মাদরাসার কিতাবাদি ফেরত নিয়ে তাদের সকলকে বহিষ্কার করা হোক। যেই সিদ্ধান্ত, সেই কাজ। অতঃপর ক্লাসের সেই সব ছাত্র অত্যন্ত অনুতপ্ত হয় এবং শিক্ষকদের হাত-পা ধরে ধরে দীর্ঘদিন ঘোরাঘুরির পর পুনরায় ভর্তির অনুমতি পায়। এভাবে ছাত্রদের শুধু তালিম নয়, তরবিয়তের প্রতিও হযরত শাইখুল হাদীসের ভূমিকা ভোলার মতো নয়। সেদিন শোকে দুঃখে মুহ্যমান হয়ে তার সে যে কান্না, অধমের স্মৃতি থেকে তা কখনো মুছে যাওয়ার নয়। ছাত্রদের কল্যাণ কামনায় আদর্শ শিক্ষক হিসেবে তার এ অবস্থা সত্যিই হৃদয়স্পর্শী এক বিরল ঘটনা। রাহমানী পয়গাম: আপনি হযরত শাইখুল হাদীস রহ. এর ঘনিষ্ঠ হলেন কী করে? মাওলানা গিয়াসুদ্দীন আহমদ: আমি অধম কীভাবে হযরত শাইখুল হাদীস রহ. এর ঘনিষ্ঠ হলাম সে ইতিহাস অতি দীর্ঘ। সবটা বলাও যায় না। কিছুটা না বললেও হয় না। একেতো আমি সাহিত্যের ছাত্র হিসাবেই ছিলাম তার অতি প্রিয়। ক্লাসে হাতের সুন্দর লেখায় ও কাব্য সাহিত্য ঠিক তার অনুকরণে পড়তে পারায় আমি ছিলাম সকল ছাত্রের অগ্রভাগে। ক্লাসে আমাকেই এবারত বেশি পড়তে হত। তদুপরি ক্লাসে ছিলাম আমি নম্বরে আওয়াল ছাত্র। সালানা জলসা কাছে আসলেই আরবি বক্তৃতার জন্য আমার ডাক পড়তো। একে তো ক্লাসে ছিলাম আমি সবার ছোট। ১৫/১৬ বছরের কিশোর। অন্য দিকে আরবি বক্তৃতা লেখায় আমি ছিলাম সবচেয়ে পারদর্শী। তাই ছোটদের মধ্যে আমাকেই আরবি বক্তৃতা লিখে শাইখুল হাদীস রহ. কে দেখাতে হত। তিনি তা পরিশুদ্ধ ও সাবলীল করে দিতেন। সালানা জলসার সপ্তাহ খানেক আগেই এ কাজ সারা হত। তারপর চলত হযরত প্রিন্সিপাল সাহেবের রুমে হযরত মাওলানা সালাহুদ্দীন সাহেব রহ. এর নিকট আমার ট্রায়াল। বক্তৃতার নিয়মনীতি অঙ্গভঙ্গি সব তিনিই শিখিয়ে দিতেন। অতঃপর হযরত আল্লামা জফর আহমদ উসমানির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় অধমের ডাক পড়ত। আমি সেই ভঙ্গিতে আরবিতে তাকরির করতাম। একটু একটু তাকিয়ে দেখতাম হযরত আল্লামা জফর আহমদ রহ. এর খুশির অবস্থা। মোটকথা এসবের মাধ্যমে শাইখুল হাদীস রহ. এর ঘনিষ্ঠতা লাভের সুযোগ হয়েছে। রাহমানী পয়গাম: ছাত্রদের মধ্যে হযরত শাইখুল হাদীস রহ.-এর কদর কেমন ছিল? মাওলানা গিয়াসুদ্দীন আহমদ: ছাত্রদের মধ্যে হযরত শাইখুল হাদীস রহ.-এর কদর ছিল বিস্ময়কর। তিনি তখন নওজোয়ান শিক্ষক। ৩০-৩৫ বছর বয়স। চলতেনও খুব দ্রুততার সাথে। খুব স্মার্ট ও একটিভ ছিলেন। সকল ছাত্র শিক্ষকদের মধ্যে তার সুনাম সুখ্যাতি ছিল অপরিসীম। ভরা যৌবনে দরস তাদরিসে শক্তি ও বল নিয়ে পড়াতেন। তিনি তখন তিনটি বিষয় পড়াতেন, কুরআন, হাদিস ও আরবি সাহিত্য। এই তিন বিষয়েই পাঠ দানে সকলের ঊর্ধ্বে ছিল তার অবস্থান। এজন্য সবাই খুব বেশি তার কদর করতো। রাহমানী পয়গাম: এমন কোনো ঘটনা কি মনে পড়ে যেখানে হযরত শাইখুল হাদীস রহ.-এর প্রতি ছাত্রদের মহব্বতের বহিঃপ্রকাশ সহজেই নজরে পড়ে? মাওলানা গিয়াসুদ্দীন আহমদ: শাইখুল হাদীস রহ. এর প্রতি ছাত্রদের ভালোবাসা ছিল অস্বাভাবিক পর্যায়ের। একটি ঘটনা মনে পড়ে: একবার কোনো এক কারণে হযরত শাইখুল হাদীস রহ. এর সাথে মাদরাসা কমিটির সেক্রেটারির দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছিল। সেই প্রেক্ষিতে সেক্রেটারি সাহেব শাইখুল হাদীস রহ. কে মাদরাসা থেকে বের করে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মাদরাসার সকল ছাত্র সেই উদ্যোগের মুকাবেলা করেন। সেক্রেটারির এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে উত্তেজিত ছাত্ররা সেদিন সেক্রেটারিকে প্রিন্সিপালের কক্ষে আবদ্ধ করে ফেলে। অবশেষে মাদরাসার শিক্ষক এবং পুলিশের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সেক্রেটারি সেদিন রক্ষা পান। রাহমানী পয়গাম: সদর সাহেব হুজুর রহ. এর সাথে হযরত শাইখুল হাদীস রহ. এর সম্পর্কের কথা তো আমরা মোটামুটি জানি, আপনার মুখে একটু শুনতে চাই। মাওলানা গিয়াসুদ্দীন আহমদ: সদর সাহেব হুযূরের কাছে শাইখুল হাদীস রহ. এর অবাধ যাতায়াত ছিল। তা ছাড়া যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে সদর সাহেব হুজুর তাকেই সর্বাগ্রে ডাকতেন। তারা যে একত্রিত হতেন সেসব দৃশ্য এখনো আমার চোখে ভাসে। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খান যখন ফ্যামিলি আইন পাশ করে তখন সদর সাহেব রহ. এই আইনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন। সরকার অনেক সময় সদর সাহেব হুজুর রহ. এর সাথে যোগাযোগ করত। তিনি তাদের সাথে বীরের মত বুকটান করে কথা বলতেন। আমি শাইখুল হাদীস রহ. থেকে শুনেছি, সদর সাহেব হুজুর একবার সরকারি লোকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, আপনারা এক সরকারের চাকুরি করেন, আর আমিও এক সরকারের গোলামি করি যিনি সমস্ত জাহানের স্রষ্টা ও মালিক। তার গোলামি করতে গিয়ে আপনাদের কারও কোনো ভীতি প্রদর্শনে আমি ভয় পাওয়ার নই। আমি যে কোনো সময় আমার জান দেওয়ার জন্যও তৈরি আছি। আমি একমাত্র ভয় করি আল্লাহ তালাকে। তিনি যখন ডাকবেন আমি তখন যাবো। এ ছাড়া আমি কাউকে আমার প্রাণের জন্য ভয় করি না। রাহমানী পয়গাম: হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর সাথে হযরত শাইখুল হাদীস রহ. কে কেমন দেখেছেন? মাওলানা গিয়াসুদ্দীন আহমদ: আল্লাহু আকবার, শাইখুল হাদীস রহ. ছিলেন সদর সাহেব হুজুর এবং হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর কলিজার টুকরা। কারণ এই দুজনের হাতে গড়া মানুষ ছিলেন শাইখুল হাদীস রহ.। ৭ বছর বয়সে তাকে বি বাড়িয়া মাদরাসায় সদর সাহেব হুযূরের হাতে এনে দেওয়া হয়। সদর সাহেব হুজুর তাকে কোরআন শরিফ, বেহেশতি জেওর ও অন্যান্য ছোট কিতাব পড়িয়েছেন। পরবর্তীতে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর আন্দোলন যখন দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে, তখন শাইখুল হাদীস রহ. কে ছাড়া তিনি যেন আর কিছুই চোখে দেখতেন না। এমনও শুনেছি শাইখুল হাদীস সাহেব যখন রাজনৈতিক মঞ্চে বক্তৃতা করতেন, তখন হাফেজ্জী হুজুর রহ বক্তৃতার কোনো কোনো পর্যায়ে এত খুশি হতেন যে, শাইখুল হাদীস রহ. এর পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতে থাকতেন এবং বলতেন, মাওলানা আজিজুল হক থাকতে আমার আর কোনো ভয় নেই। আর কারো প্রয়োজন নেই। সবাই যদি আমাকে ছেড়ে চলে যায়, তাহলে একমাত্র মাওলনা আজিজুল হককে নিয়ে আমি ময়দানে কাজ করে যাবো। শেষ জীবনের একটি কথা মনে পড়ে, হাফেজ্জী হুজুর রহ যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন, তার কয়েকদিন আগের কথা। আমাদের দাওয়াতুল হকের মাহফিল ছিল কামরাঙ্গিচর মাদরাসা নূরিয়ায়। সেই মাহফিলে হযরত বয়ান করেন। বয়ান শেষ করে যখন চলে যাচ্ছেন, কিছু দূর গিয়ে আমাকে ডাক দিয়ে বললেন, গিয়াসুদ্দিন এদিকে আস। আমি দৌঁড়ে গেলাম। হযরত তখন আমাকে একান্তে বললেন, তুমি মাওলনা আজিজুল হককে আমার কাছে এনে দাও। আমার সঙ্গে মিলিয়ে দাও। রাহমানী পয়গাম: এটা হযরতের ইন্তেকালের কতদিন আগের ঘটনা? মাওলানা গিয়াসুদ্দীন আহমদ: হযরতের ইন্তেকালের কয়েকদিন আগে আমাকে নুরিয়ায় ওই কথাটা বলেছিলেন। আমি বললাম, ইনশাআল্লাহ আমি অতি দ্রুত শাইখুল হাদীস সাহেবকে আপনার সঙ্গে মিলিয়ে দেব। আপনি দোয়া করতে থাকুন। কিন্তু তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ, এর কয়েকদিন পরেই তিনি হাসপাতালে চলে যান এবং সেখানেই তার ওফাত হয়। রাহমানী পয়গাম: এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। হযরত শায়েখের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে কিছু জানতে চাই। মাওলানা গিয়াসুদ্দীন আহমদ: হযরত শাইখুল হাদীস রহ. এর প্রায় ৫০ বছরের জীবন অতি কাছ থেকে আমার দেখার সুযোগ হয়েছে। হযরতের পারিবারিক জীবনের কথা বলতে গেলে বলব পারিবারিক জীবনের সব ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আদর্শ মানুষ। যেমন আম্মার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আদর্শ স্বামী, ছেলে মেয়েদের ক্ষেত্রে ছিলেন আদর্শ পিতা। আর আমাদের সামনে তিনি ছিলেন আদর্শ শশুর। তার শিক্ষা দীক্ষা, তরবিয়ত এবং আমাদের সকলের প্রতি তার যে নসিহত, এগুলো আমাদের কাছে চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার পারিবারিক যে ব্যাপারটা আমার সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে সেটা হলো, সন্তানদের কুরআনের হাফেজ বানানোর বিষয়। বিশেষ করে পরিবারের মেয়েদের ব্যাপারেও তার মতাদর্শ ছিল, তাদেরকে হাফেজা বানানো। সর্বপ্রথম তিনি তার তৃতীয় মেয়েকে পরীক্ষামূলক হেফজখানায় দেন। তো মাশাআল্লাহ সে অল্প সময়ের মধ্যে হাফেজা হয়ে যায়। এরপর তিনি তার আওলাদদের সবাইকে হেফজ করাতে শুরু করেন। তিনি অসিয়তও করতেন যে আমার ছেলেমেয়ে নাতিনাতনি সকলের কুরআনের হাফেজ হওয়া চাই। ছেলেরা হাফেজ হয়ে মাদরাসায় পড়ে আলেম হবে। আর মেয়েরা হাফেজা হওয়ার পর প্রয়োজনীয় দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করবে। এর পর তাদের হেফজ রক্ষা করার জন্য যতটুকু কুরআন তিলাওয়াত করা দরকার সেই পরিমাণ তিলাওয়াত যদি তারা জীবনভর করতে থাকে তাহলেই বিরাট সৌভাগ্য। আর তার আওলাদদের মধ্যে হেফজের এই ধারাকে উৎসাহিত করতে রমজানের শেষ সপ্তাহে ২৯ শে রমজান একটা ভিন্ন ধরনের মাহফিল হতো। আমরা জামাইগণসহ ছেলেরা এক রুমে বসতাম এবং অন্য রুমে সকল মেয়েরা বসতো, আর শাইখুল হাদীস রহ. কে এমন স্থানে বসানো হত যেন তিনি সবার চোখে পড়েন। তিনি আমাদের সকলের উদ্দেশ্যে নসিহত করতেন এবং অসিয়ত করতেন যে ছেলেমেয়েরা সকলেই যেন হেফজ করে, কেউ যেন অনৈসলামি শিক্ষার দিকে পা না বাড়ায়। এলমে দ্বীন নিয়েই জীবনভর যেন তারা থাকে। আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য কোরআন হাদিসের জ্ঞান অজর্ন করবে অন্যদিকে তাদের যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। সেদিকে যাওয়ার জন্য অনেক মানুষ আছে। আর তিনি সেই ২৯ তম রাতে ছেলেদের নিয়ে সর্বশেষ তারাবি পড়তেন। তার ছেলে ও নাতিরা সবাই কিছু কিছু করে নামাজ পড়াতো। নামাজ শেষে যারা সেই বছর হাফেজ হতো, ছেলে হলে তাদের পাগড়ি পরিয়ে দিতেন। আর মেয়ে হলে খেমার বা ওড়না পরিয়ে দিতেন। সর্বশেষে তিনি দোয়া করতেন। আর দোয়ায় শাইখুল হাদীস রহ. বলতে থাকতেনÑ ইয়া আল্লাহ এই যে বাগান তুমি দান করেছ, এ আমার হাতে গড়া নয়। তুমি এটি দান করেছ। এখানে আমার কোনো কৃতিত্ব নেই। তুমি দিয়েছ এবং তোমার কাছেই আমাদের প্রার্থনাÑ তুমি কেয়ামত পর্যন্ত এই ধারা এই বাগানকে রক্ষা কর। এই দোয়া সকলের মনে অত্যন্ত রেখাপাত করত। তার এই দোয়া আমাদের মধ্যে চিরজীবন্ত হয়ে থাকবে। আর আমরা এটি স্মরণ রাখবো চিরকাল। রাহমানী পয়গাম: শাইখুল হাদীস রহ. এর আদর্শ পরিবার গঠনের এই চেষ্টা কতটুকু সফল হয়েছে বলে মনে করেন? মাওলানা গিয়াসুদ্দীন আহমদ: এই চেষ্টায় তিনি অবশ্যই কামিয়াব হয়েছেন। তার আওলাদের সংখ্যা প্রায় দেড়শ। সবাই তার মনের আকাক্সক্ষা পূরণে ব্যস্ত আছে। এর মধ্যে কোনো রকম ব্যতিক্রম হচ্ছে না। একটি ছেলে বা একটি মেয়ে সন্তানও তিনি যা চাইতেন তার বাইরে আল্লাহর রহমতে যাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, তার আদর্শকে ধরে রাখার জন্য তার আওলাদরা মাসিক একটি মাহফিল করে থাকেন। সেখানে পরিবারের সকল সদস্যের দিকে লক্ষও রাখা হয়। বাস্তবিকই এর কোনো উদাহরণ আমি আর দেখি না। কারো স্বপ্নকে ধরে রাখার জন্য এ ধরনের ব্যবস্থা আমার জানা নেই। রাহমানী পয়গাম: আপনি তো হযরত আবরারুল হক সাহেব রহ. এর খলিফা, আমরা যতদুর জানি তিনি হযরত শাইখুল হাদীস রহ. কে অত্যন্ত মহব্বত করতেন। আপনার দেখা বা জানা কোনো ঘটনা যদি বলতেন? মাওলানা গিয়াসুদ্দীন আহমদ: আমার দেখা অনেক ঘটনা আছে। হযরত আবরারুল হক রহ. শাইখুল হাদীস রহ. কে খুবই মহব্বত করতেন। বাংলাদেশ থেকে যখন হযরতের মুরিদান বা মুতাআল্লেকিনের কেউ সেখানে যেতেন তাদের প্রথমেই তিনি শাইখুল হাদীস রহ. এর কুশল জিজ্ঞাসা করতেন। যেমন, একবারের ঘটনা আমার মনে আছে, সেই কাফেলাতে হাজি নাজিমুদ্দীন সাহেব, রাজা মিয়া এবং মুফতি মনসুরুল হকও ছিলেন। হাজি নাজিমুদ্দীন সাহেবের বণর্নাÑ তারা সেখানে যাওয়ার পর সর্বপ্রথম যখন তাদের সাথে হযরতের সাক্ষাৎ হয় তখন সালামের পর হযরত প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন শাইখুল হাদীস সাহেব ও খতিব (মাওলানা উবাইদুল হক) কেমন আছেন। আর রাজনীতির ব্যাপারে আমরা শাইখুল হাদীস রহ. এর কাছ থেকে শুনেছি যে, হযরত নিজে তাকে ইসলামি রাজনীতি করার জন্য পারমিশন দিয়েছিলেন। তিনি শাইখুল হাদীস রহ. কে বলেছেন,আপনি দ্বীনি রাজনীতি করুন। এই কথাটা তখন মাশহুর ছিল যে, শাইখুল হাদীস রহ. যে রাজনীতি করেন এটা হযরত দ্বারা উৎসাহিত হয়ে করেন। এই রাজনীতির প্রতি হযরতের সমর্থন, ইজাজত সবকিছুই ছিল। আর আমাদের প্রতি নিদের্শ ছিল আমরা যেন শুধু মাত্র সভা সমিতিতে গিয়ে মঞ্চে না বসি। কিন্তু শাইখুল হাদীস রহ. এর দীনি রাজনীতির সহায়তা যেন সর্বোতভাবে আমারা করি। আর্থিকভাবেও শারীরিকভাবেও। রাহমানী পয়গাম: শুনেছি শাইখুল হাদীস রহ. এক সময় জাতীয় ঈদগাহে ঈদের জামাত পড়াতেন। এ ব্যাপারে আপনার কোনো স্মৃতি...? মাওলানা গিয়াসুদ্দীন আহমদ: আমার স্পষ্ট মনে আছে। তখন ঈদগাহ ছিল বর্তমান ষ্টেডিয়ামের স্থানে। তখন সেখানে ষ্টেডিয়াম ছিল না। বিরাট ময়দান ছিল। অনেক বড় বড় মিটিং মাহফিল সেখানে হত। ঈদের জামাতও সেখানেই হত। সেই ঈদগাহেই দেশের প্রেসিডেন্টে নামাজ পড়তেন। ইমামতির জন্য সারাদেশের আলেমদের মধ্যে বিশিষ্টজনকেই নির্বাচিত করা হত। আমি দেখেছি ইমামতিতে হযরত শায়েখকে রাজি করানোর জন্য সরকারের প্রতিনিধিদল হযরতের বাসায় আসতেন। প্রথম দিকে তিনি রাজি হতেন না। কিন্তু তারা যখন নাছোড়বান্দা হয়ে ধরতেন তখন শেষ পযর্ন্ত তিনি রাজি হতেন। প্রেসিডেন্ট খন্দকার মুশতাক আহমাদ ও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে দেখেছি হযরতের পিছনে নামাজ পড়তে। রাহমানী পয়গাম: হযরত শাইখুল হাদীস রহ. কর্তৃক এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার কারণ কি কখনো জানতে পেরেছেন? মাওলানা গিয়াসুদ্দীন আহমদ: সরকারের এই প্রস্তাব যখন তিনি ফিরিয়ে দিলেন, তখন একদিন আমি এর কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলাম। এর উত্তরে তিনি বললেনÑ দেখো এসব জিনিসে যোগদান করার দ্বারা আত্মম্ভরিতা সৃষ্টি হতে পারে। নিজের আত্মম্ভরিতা বৃদ্ধি করার পথে এসব জিনিস খুব কাজ করে। যে কারণে আমি বার বার তাদের ফিরিয়ে দিয়েছি। রাহমানী পয়গাম: হযরত শাইখুল হাদীস রহ. এর জীবনবৃত্তান্ত আমাদের অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কি কোনো উদ্যোগ চলমান আছে? এব্যাপারে কতটুকু কাজ হয়েছে? মাওলানা গিয়াসুদ্দীন আহমদ: হযরতের ইন্তেকালের পর রাহমানী পয়গামে তার সম্পর্কে অনেকে অনেক স্মৃতি কথা লিখেছে। সেখানে হযরতের জীবন সম্পর্কে অনেক কথা এসেছে। মানুষের মধ্যে এর প্রতি ব্যাপক চাহিদা দেখা গেছে। এর থেকে আমরা প্রয়োজন বোধ করে আসছি যে, তার জীবনী লিখিত হওয়া নিতান্তই প্রয়োজন। এবং এ ব্যাপারে কয়েকটি মিটিংও হয়েছে। কিভাবে তার জীবনী লেখা যায় সে ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। হযরত শায়েখের নাতি এহসানুল হকও এই কাজে নিয়োজিত আছে। ইতোমধ্যে তার শাইখুল হাদীসের ছেলেবেলা এবং লংমার্চ নিয়ে দুটি বইও প্রকাশ পেয়েছে। উদ্যোগগুলো চলমান থাকলে আশাকরি সকলের সহযোগিতায় জীবনীটি তৈরি হয়ে যাবে। রাহমানী পয়গাম: বর্তমান সময়ে হযরত শাইখুল হাদীস রহ. এর শূন্যতা কেমন অনুভব করেন? মাওলানা গিয়াসুদ্দীন আহমদ: হযরত শাইখুল হাদীস রহ. চলে যাওয়ার মাধ্যমে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা কোনো দিন পূর্ণ হওয়ার নয়। হাজার বছরেও এই শূন্যতা পূর্ণ হবে না। এটা শুধু আমার আবেগের কথা নয়, বাস্তবতা। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি রোজ হাশরে আল্লাহ তায়ালা যেন আমাদের তার সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ দেন। তাকে জান্নাতুল ফেরদাউসের আলা মাকাম দান করেন। আমিন।