পাপের স্রোতে ভাসছে সমাজ রোজাদারগণ সতর্ক থাকুন খন্দকার মনসুর আহমদ জুলাই, আগস্ট ১৪ আলহামদুলিল্লাহ, আমরা আরও একটি মাহে রমজান আমাদের জীবনে বরণ করলাম। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনা এ মাসের প্রধান ইবাদত। প্রতিটি কর্মের একটি লক্ষ্য থাকে। লক্ষ্যটি অর্জিত না হলে কর্মটি বৃথা যায় এবং বিবেকবান মানুষ তাতে মর্মযাতনা ভোগ করেন। যেমন চিকিৎসার পর রোগী যদি সুস্থ না হয় তাহলে চিকিৎসা এবং ওষুধ সেবন সবই বৃথা যায়। তখন শারীরিক অসুস্থতার পাশাপাশি মানসিক যাতনাও অনুভূত হয়। তাই সিয়াম সাধনার লক্ষ্য কী- এ প্রশ্ন আমাদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাই পবিত্র কুরআনে এ-প্রশ্নের জবাব দিয়ে রেখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমাদের ওপর সিয়াম ফরজ করা হলো যেমন ফরজ করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারো।’ মহান আল্লাহর একথা থেকে বোঝা যায় তাকওয়া অর্জনই হচ্ছে সিয়াম সাধনার মূল লক্ষ্য। আর তাকওয়ার মূল কথা হচ্ছে পাপাচার পরিত্যাগ করা এবং মহান আল্লাহ ও রাসুল সা.-এর বিধি-বিধান মেনে চলা। দুর্ভাগ্যক্রমে কোনো মুসলিম যদি সিয়ামের এই লক্ষ্যের কথা ভুলে যায় এবং উপবাসব্রত পালনের পাশাপাশি পাপাচারও চালিয়ে যায় মহান আল্লাহর কাছে তার রোজার কোনো মূল্য নেই। বিষয়টি হাদিস শরিফে স্পষ্টভাবেই এসেছে। রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি রোজা রাখে এবং মিথ্যা বলা ও মিথ্যাচার থেকে বিরত থাকে না, তার উপবাসব্রত পালনে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ [সহিহুল বুখারি] রোজার সঙ্গে যারা পাপাচারও চালিয়ে যায় তাদের সম্পর্কে রাসুল সা. আরও ইরশাদ করেন, ‘অনেক রোজাদার এমন রয়েছে যাদের রোজায় ক্ষুধার্ত থাকা ছাড়া অন্যকিছু অর্জিত হয় না এবং অনেক রাত্রি জাগরণকারী এমন রয়েছে যাদের রাত্রী জাগরণের কষ্ট ব্যতীত আর কিছুই অর্জিত হয় না। [ইবনে মাজাহ] মাহে রমজনের প্রথমেই আমরা এ লেখার মাধ্যমে আমাদের দেশের মুসলিম ভাইদের কাছে রোজা ও মাহে রমজানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গটি তুলে ধরলাম। আশা করি বিষয়টি বিবেকবান প্রতিটি মুসলিমের হৃদয় স্পর্শ করবে এবং তারা বিনাশের পথ পরিহার করে সত্য ও তাকওয়ার পথের অধিযাত্রী হবেন। বলতে দ্বিধা নেইÑ আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমি এখন পাপের স্রোতে ভাসছে। পাপাচার এখানে স্বাভাবিক ও প্রাত্যহিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্র এখানে নির্বিকার। সুতরাং প্রত্যেককে তার ঈমান ও পরকাল নিয়ে এবং জাহান্নামের অগ্নি থেকে আত্মরক্ষার পথ অবশ্যই খুঁজে নিতে হবে। এতে যদি সমাজ সংসার ত্যাগ করতে হয় তবুও পরকালীন কষ্টের তুলনায় তা খুবই সামন্য। এখন আমরা প্রিয় রোজাদার ভাইদের ত্যাগময় সিয়াম সাধনার সার্থকতার জন্য বিশেষ বিশেষ কয়েকটি পাপাচারের বিষয়ে সাবধানতার পরামর্শ দিচ্ছি। ১. টেলিভিশন ও দৈনিক পত্রিকা থেকে দূরে থাকুন দীনদার মুসলিম সমাজ, টেলিভিশন ও দৈনিক পত্রিকার অশ্লীল বিষয়গুলো থেকে দূরে থাকুন। কারণ এদুটো জিনিস আপনার দৃষ্টিকে অপবিত্র করবে, হৃদয়কে কলুষিত করবে এবং আপনার দৃষ্টি ও আত্মার সিয়াম ধ্বংস করবে। এদুটো হচ্ছে নির্লজ্জতা ও অশ্লীলতার সাধারণ বাহন। মানে সমাজের মানুষের কাছে এদুটো জিনিস স্বাভাবিকভাবে অনুমোদিত। এদুটো দেখলে সাধারণত কাউকে তেমন অভিযুক্তও করা হয় না। অথচ এদুটো জিনিস অশ্লীলতার ভয়াবহ ও বিষাক্ত বাহন। দেশের মানুষ খুন-খারাবি, চুরি-ডাকাতি এবং অর্থ আত্মাসাৎকে অপরাধ বলে জানে। কিন্তু অশ্লীলতার প্রসারকে সেভাবে অপরাধ বলে বোঝে না। অথচ একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়, অশ্লীলতার ও নগ্ন ছবির ফেরিওয়ালারা চোর-ডাকাত ও খুনিদের চেয়েও বড় অপরাধী। কারণ, চোর-ডাকাত মানুষের সম্পদ হরণ করে এবং খুনিরা মানুষের দৈহিক সত্তাকে ধ্বংস করে। আর টেলিভিশন, ডিশ-এন্টিনা, সিনেমা ও দৈনিক পত্রিকার নগ্ন ছবি মানুষের ঈমান ও চরিত্রকে ধ্বংস করে। এগুলো হচ্ছে ঈমান ও চরিত্রের ঘাতক। রমজানে দৈনিক পত্রিকা যদি একান্ত পড়তেই হয় তাহলে নগ্ন ছবির পৃথক পাতাগুলো ছিঁড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিন এবং অবশিষ্ট অশ্লীল ছবিগুলো সতর্কতার সঙ্গে কাগজ লাগিয়ে ঢেকে নিন। কোনো অফিস বা প্রতিষ্ঠানের রাখা পত্রিকার ক্ষেত্রে এটা খুবই জরুরি। মূলত নগ্ন ছবির ফেরিওয়ালারা তাদের অপরিণামদর্শী বাণিজ্যিক নেশায় জাতির নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে। এবং এটা দেখার কেউ আছে বলেও মনে হয় না। আর এখন তো চলছে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা। নগ্নতার যে প্রাত্যহিক মাত্রা ছিলো সেটাই ছিলো ভয়াবহ। বিশ্বকাপ তথা বিশ্ব বেহায়া কাপকে কেন্দ্র করে পাপাচার ও নির্লজ্জতা অনেকগুণ বেড়েছে। দৈনিক ইত্তেফাক ও বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ প্রায় প্রতিটি দৈনিক অত্যন্ত নির্ভয়ে নারীদের অশালীন ছবির হারাম বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ এদের হেদায়েত করুন। ২. গাফলতি পরিহার করুন রহমতের এই মহান মাস, যার প্রতিটি মুহূর্ত মহান আল্লাহর অপার অনুগ্রহের পবিত্র বারিধারায় স্নিগ্ধ। এতে সর্বপ্রকার গাফলতি পরিহার করে একান্তভাবে নিজের অনন্ত জীবনের কথা ভাবা প্রতিটি মুমিনের একান্ত কর্তব্য। পার্থিব কর্মকাণ্ডের গতি কিছুটা কমিয়ে নিজের সময়ের বেশির ভাগ আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে কাটানো উচিত। অনুসন্ধিৎসু, প্রত্যাশী মুমিনের জন্য এই মাস যেমন অফুরন্ত কল্যাণের বার্তা বয়ে আনে তেমন গাফেল-উদাসীনদের জন্য এ মান নিয়ে আসে সর্বনাশের ভয়াবহ বার্তা। প্রিয়নবী সা.-এর কঠিন বাণী বোধ করি আমাদের সবার জানা। প্রসিদ্ধ সাহাবি হযরত কা’ব বিন উজরাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি ইরশাদ করেন, একবার প্রিয়নবী সা. আমাদের লক্ষ করে বললেন, তোমরা মিম্বরের কাছে সমবেত হও। তারপর আমরা উপস্থিত হলাম। তিনি মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে কদম রেখে বললেন, আমিন! তারপর দ্বিতীয় সিঁড়িতে কদম রেখে বললেন, আমিন! তৃতীয় সিঁড়িতেও কদম রেখে বললেন, আমিন! হযরত কা’ব রা. বললেন, আজ আপনি এমন কিছু কথা বললেন, যা ইতোপূর্বে আমরা কখনো শুনিনি। নবীজি বললেন, মূলত প্রথম সিঁড়িতে আরোহণের সময় জিবরিল আমিন আমার সম্মুখে উপস্থিত হন এবং দু’আ করেন, যে ব্যক্তি রমজান মাস পেলে কিন্তু ক্ষমাপ্রাপ্ত হলো না [অর্থাৎ নিজের গুনাসমূহ মাফ করিয়ে নিলো না] সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হোক। সে দু’আর সঙ্গে একাত্ম হয়ে আমি বলেছি, আমিন। [তিরমিজি] মানবতার প্রিয়তম নবী রাসুলে কারিম সা. যে দু’আর সঙ্গে আমিন বলেছেন তা কবুল হওয়ার বিষয় কতটা সন্দেহাতীত তা সহজে অনুমেয়। স্বভাবত প্রশ্ন জাগতে পারে হযরত জিবরিল আমিনের এহেন কঠিন দু’আ এবং সে দু’আর সঙ্গে দয়াল নবীর একাত্মতার রহস্য কী? একটি উদাহরণের মাধ্যমে এর রহস্য আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে উঠবে। কোনো মনিব যদি তার গোলামের কাছে গিয়ে সমূহ কল্যাণের উপকরণ দিতে তাকে বারবার কাছে ডাকেন, আর যদি ওই গোলাম সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে তার কাছে না যায় তাহলে এটা একটা কঠিন বেয়াদবি বলে গণ্য হবে তা বুঝতে বোধ হয় কারোরই কষ্ট হয় না। ঠিক তেমনিভাবে মহান দাতা, দয়ালু মালিক, আসমান-জমিনের অধিপতি মহান আল্লাহ তা’আলা এ মাসে তার রহমতের সকল দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়ে বান্দাকে ডাকেন। জীবনের সকল পাপ-পঙ্কিলতার গ্লানি ধুয়ে মুছে অফুরন্ত কল্যাণ হাসিল করে নিতে আহ্বান জানান। এ মহান সুযোগেও যে ব্যক্তি তার গুনাসমূহ মাফ করিয়ে নিলো না, এজন্য উদ্গ্রীব হলো না, সে ব্যক্তি তো মূলত আল্লাহবিমুখ। সে নিজেকে আল্লাহর মুখাপেক্ষী ভাবেনি। তো এহেন উদ্ধত ব্যক্তি তো কঠিন সত্যের মুখোমুখি হওয়ারই উপযুক্ত। এ কারণেই দয়াল নবীর মতো মহান হৃদয় এ বদদু’আর সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন। সুতরাং সর্বপ্রকার গাফলতি পরিহার করে আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে হবে, আমরা পবিত্র রমজানের হক কতটুকু আদায় করছি। ৩. মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ থেকে বিরত থাকুন রোজাদারদের জন্য বিশেষ বর্জনীয় আরেকটি বিষয় হলো গীবত ও পরচর্চা। গীবত এমন একটি মারাত্মক পাপ যা রোজাকে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করি। তাছাড়া সার্বিক বিবেচনায় আমাদের সমাজকে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তা হচ্ছে গীবত। গীবত এমন একটি ব্যাধি যা আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনকে মারাত্মকভাবে কর্দমাক্ত করছে। জীবনের সর্বস্তরে গীবতের অপকারিতা অত্যন্ত দুঃখপ্রদ ও শোকাবহ। গীবতে রোজাদার ব্যক্তির মানসিক পরিচ্ছন্নতা নষ্ট হয়। সমালোচনাকারী ব্যক্তি অনুভূতিবান হলে তিনি নিজের ভেতর এক ধরনের শূন্যতা ও অস্বস্তি অনুভব করতে পারেন। পবিত্র কুরআনে গীবত ও পরনিন্দাকে মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘এবং কেউ কারোর গীবত করবে না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা তো তা ঘৃণাই করো। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তওবা কবুলকারী মেহেরবান। গীবত হলো কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত কোনো বিষয়কে এমনভাবে উপস্থাপন করা যা শুনলে সে নির্ঘাত কষ্ট পাবে অথবা যা প্রকাশিত হওয়া তার কাছে অস্বস্তিকর। যদিও সেই ত্র“টি সমালোচিতের মধ্যে বিদ্যমান থাকে। মুসলিম শরিফে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল সা. ইরশাদ করেন, জানো, গীবত কাকে বলে? লোকজন জবাব দিলো আল্লাহ ও তার রাসুলই ভালো জানেন। রাসুলে করীম সা. উত্তরে বলেন, [গীবত হলো] তোমার ভাইয়ের আলোচনা এভাবে করা যে সে অপছন্দ করে। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, হুজুর, যদি সে ত্র“টি তার মধ্যে বাস্তবে থাকে তবুও কি গীবত হবে? নবী করীম সা. উত্তর দিলেন হ্যাঁ, যদি বাস্তবে থাকে তবেই তো তা গীবত হবে, অন্যথায় তা তো হবে অপবাদ। গীবতের ব্যাপারে কতটা সতর্ক থাকা জরুরি তা পবিত্র হাদিসের একটি ঘটনা থেকে আমরা অনুমান করতে পারি। একবার হযরত আয়েশা রা. হযরত সাফিয়্যা সম্পর্কে আরজ করলেন যে উনি খুব বেশি লম্বা। রাসুল সা. এ কথার প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, আয়েশা, তুমি এমন একটি কথা বলেছো যা সমুদ্রের পানিতে মিশিয়ে দেয়া হলে তাও দুর্গন্ধ হয়ে যাবে। এখানে লক্ষ্যণীয় হলো, একটু অসতর্কতাবশত হযরত আয়েশা রা.-এর মুখ থেকে বেরিয়ে যাওয়া একটি বাক্যের জন্য হুজুর পাক সা. কত কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। গীবতের ভয়াবহতা অনুমানের জন্য এ ঘটনাটিই যথেষ্ট। গীবত করা এবং শোনা উভয়ই অবৈধ। তাই কোথাও গীবতের আসর জমে উঠলে তা বন্ধ করে দেয়া চাই। আর তা সম্ভব না হলে অন্তত নিজের সে আসর পরিত্যাগ করা জরুরি। উল্লেখ্য যে, দীন ইসলামের স্বার্থে অথবা মানুষকে সম্ভাব্য কোনো ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য অনেক সময় কোনো ব্যক্তি, মত ও পথের বিরুদ্ধে সমালোচনা অনিবার্য হয়ে পড়ে। সমালোচনা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এহেন ক্ষেত্রে ওলামায়ে কেরাম সমালোচনার বিষয়টিকে যদিও বৈধ বলেছেন, তবে সে ক্ষেত্রেও সাবধানতা অবলম্বন জরুরি। যাতে কোনো ব্যক্তিগত বা অপ্রাসঙ্গিক বিষয় সমালোচিত না হয়। ৪. অর্থহীন কথা ও কর্ম থেকে বেঁচে থাকুন পবিত্র রমজান মাসে অনর্থক কথাবার্তা ও কাজকর্ম একান্তভাবে পরিহার করা কর্তব্য। এ মহান মাসে নিছক লৌকিকতাপূর্ণ সারহীন অনুষ্ঠানাদিও বর্জনীয়। কুরআন ও হাদিসে যেসব আমলের নির্দেশ একান্তই প্রত্যক্ষ ও সুস্পষ্ট, যেসবের মাধ্যমে বান্দা ও আল্লাহর মাঝে সুনিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে, হৃদয়ে পরকালের ভাবনা জাগ্রত হয়, সেসব কাজকর্ম ও আমলকে প্রাধান্য দেয়া দরকার। যেমন ইলমে দীন চর্চা, বেশি বেশি নফল নামাজ আদায়, কুরআন শরিফ তেলাওয়াত, অধিক পরিমাণে দরুদ পাঠ, আল্লাহর পথে দান-খয়রাত, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, ইত্যাদি। এছাড়া দীনি বইপুস্তক পাঠ, খোদাভীরু মুত্তাকি আলেম ওলামাদের কাছে গিয়ে দীনি কথাবার্তা শ্রবণ ইত্যাদি কাজেও পবিত্র রমজানের সময় ব্যয়িত হওয়া উচিত। ৫. অপচয় থেকে বিরত থাকুন রোজাদারের জন্য সর্বপ্রকার অপচয় বর্জনীয়। পবিত্র কুরআনে অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই অভিহিত করা হয়েছে। আমাদের সমাজে ঈদের প্রস্তুতি রীতিমত একটি ফেতনার রূপ ধারণ করেছে। ঈদুল ফিতরের দিনে সাধ্যানুযায়ী ভালো কাপড় পরিধান এবং আনন্দ-ফুর্তি করার নির্দেশ ইসলামে রয়েছে। কিন্তু এ সুযোগে যেসকল অপচয়কে অনিবার্য ধরে নেয়া হচ্ছে ইসলামি শরিয়তের সঙ্গে তার আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। পারিবারিক অবস্থা যেমনই থাকুক, ঈদের জন্য নতুন জামা, জুতা-স্যান্ডেল ইত্যাদির আয়োজনকে আমাদের সমাজে জরুরি মনে করা হয়। ফলে একাধিক নতুন জামা-কাপড় প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও শুধু ঈদের জন্য আরেক প্রস্থ জামা-কাপড়ের ব্যবস্থা করা হয়। এ সবই অপচয়। এর অন্যতম ক্ষতি এই যে, মধ্যবিত্ত পরিবারের অভিভাবকগণ ঈদের প্রস্তুতি নিতে রীতিমত গলদঘর্ম হন। অনেকে অবৈধ উপার্জনের পথে এগুতেও পিছপা হন না। আর নিম্নবিত্তরা সমাজের সঙ্গে তাল মিলে চলতে না পারায় অস্বস্তিতে ভোগেন। পবিত্র রমজান মাসকে বলা হয়েছে ‘শাহরুস সাবরি ওয়াল মুয়াসাত’ Ñ ধৈর্য ও সহমর্মিতার মাস। সুতরাং অপচয় রোধ করে সে অর্থ গরিব-মিসকিনকে দেয়াই হলো ইসলামের শিক্ষা। তাছাড়া সিয়ামের উপবাসের মাধ্যমে আমরা ষড়রিপু দমনের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি লাভের প্রধান লক্ষ্য অর্জনের পাশাপাশি দুঃখী, দরিদ্র, বুভুক্ষু মানুষের দুঃখ-কষ্টও অনুভব করি। এ অনুভব তখনই স্বার্থক হবে, যখন আমরা সহমর্মী হয়ে তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাবো। ঈদের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণের আরেকটা বিশেষ ক্ষতিকর দিক হলো এতে রমজানের শেষ দশকের ইবাদত-বন্দেগিতে বিঘœ ঘটে। অথচ হাদিসে শেষ দশকের রজনীসমূহে বিশেষ ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং এ মর্মে বিশেষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। একান্তভাবে কল্যাণকামিতার চেতনায় আন্তরিকতা ও সহানুভূতির সঙ্গে আমরা রোজা ও রমজানের নানা দিক তুলে ধরলাম। আমরা যাতে সাবধান হয়ে পবিত্র রমজানের বরকত ও সমূহ কল্যাণ আমাদের জীবনে অর্জন করে ইহকাল ও পরকালে সফল হতে পারি সে আশা নিয়েই এ আলোকপাত। তাই, আসুন পবিত্র মাহে রমজানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা আল্লাহমুখী হই। সকল পাপাচার বর্জন করে ইবাদতের মাধ্যমে আমাদের সিয়াম সাধনাকে স্বার্থক করে তুলি। নতুন করে গড়ে তুলি আমাদের জীবন। আলোকিত হৃদয়ের সুন্দর মানুষের বসবাসে আবার হেসে উঠুক এই বসুন্ধরা। লাশের মিছিল থামবে কবে? আলী হাসান তৈয়ব জুন'১৪ অশান্তির আগুনে ঘেরা পৃথিবী। দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ভরা অবনী। এ পৃথিবীতে এখন মানবজীবনের চেয়ে সস্তা কিছু নেই। বিশেষত বাংলাদেশের মতো তৃতীয়বিশ্বের দেশগুলোয় মাত্র ১০ টাকার জন্যও মানুষ খুন হচ্ছে। মিডিয়ায় কান পাতলে কিংবা সংবাদপত্রের পাতায় চোখ রাখলে নিহতের স্বজনের আহাজারী আর মাতমের দৃশ্য থাকবেই। সন্তানের হাতে জন্মদাতা কিংবা জন্মদাতার হাতে সন্তান, স্বামীর হাতে স্ত্রী কিংবা স্ত্রীর হাতে স্বামী, শিক্ষকের হাতে ছাত্র কিংবা ছাত্রের হাতে শিক্ষক, কর্মচারীর হাতে মালিক কিংবা মালিকের হাতে কর্মচারী, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে সাধারণ নাগরিক কিংবা নাগরিকের হাতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য খুনÑ কোনোটাই যেন এখানে আর অস্বাভাবিক নয়! এদিকে কথিত উন্নত ও সভ্য দেশগুলো মোড়লিপনা দেখাতে গিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আগ্রাসন চালিয়ে খুন করছে হাজার হাজার নিরপরাধ বনি আদমকে। যারা মুসলিম দেশগুলোকে মানবাধিকারের সবক দেয়, তারাই আবার নিপীড়িত জনপদগুলোয় প্রতিদিন নিষ্পাপ শিশু, অসহায় নারী ও বৃদ্ধদের ওপর বোমা নিক্ষেপ করছে। পৃথিবীর মানচিত্রজুড়েই এখন মুসলমানের তপ্তখুনের ছোপছোপ দাগ। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে যোগ হয়েছে গুম নামের এক আতঙ্ক। সুস্থ-সবল মানুষকে চোখের সামনে পরিবার থেকে উঠিয়ে নিচ্ছে আর সে লোকটি ঘরে ফিরছে লাশ হয়ে। কখনো এ লাশটিও আর ফেরত পাচ্ছে না হতভাগা পরিবার। কে নিচ্ছে, কোথায় নিচ্ছে, কারা নিচ্ছেÑ কোনোটারই যেন হদিস নেই। পৃথিবীর তাবৎ মানুষের মতো বাংলাদেশের নাগরিকরাও এ হত্যা-নৈরাজ্য থেকে পরিত্রাণ খুঁজে ফিরছে। মুক্তির অন্বেষায় তারাও যত্রতত্র ধর্ণা দিচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। লাশের মিছিল কেবল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতরই হচ্ছে। এমতাবস্থায় আর সব সমস্যার মতো এর সমাধানেও ইসলামের আদর্শই হতে পারে হতাশার আলোকদিশা। উপায়হীনের অব্যর্থ উপায়। সেটি কাম্য হলে, আমাদেরকে অবশ্যই ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। নবীজির দেখানো পথে হাঁটতে হবে। তুলে ধরতে হবে ইসলামের অমল-ধবল আলোকশিখা। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহের অমূল্য বাণীগুলো মানব হত্যাকে হারাম ঘোষণা করেছে। অন্যায়ভাবে অপরের প্রাণ হরণকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে বড় গুনাহসমূহের। শুধু তাই নয় পৃথিবীতে যত রকমের গুনাহের কাজ রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় মহান আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা। এরপর সবচেয়ে বড় গুনাহ অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা। হত্যাকারীর জন্য মহান আল্লাহ দুনিয়ায় বড় শাস্তি এবং আখেরাতে তীব্র আজাবের ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘(হে নবী! আপনি আহলে কিতাবদের) বলুন, এসো, তোমাদের ওপর তোমাদের রব যা হারাম করেছেন, তা তিলাওয়াত করি যে, তোমরা তার সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করবে না এবং মা-বাবার প্রতি ইহসান করবে আর দারিদ্র্যের কারণে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না। আমিই তোমাদেরকে রিজিক দেই এবং তাদেরকেও। আর অশ্লীল কাজের নিকটবর্তী হবে না- তা থেকে যা প্রকাশ পায় এবং যা গোপন থাকে। আর বৈধ কারণ ছাড়া তোমরা সেই প্রাণকে হত্যা করো না, আল্লাহ যা হারাম করেছেন। এগুলো আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা বুঝতে পার।’ {সুরা আল-আনআম, আয়াত : ১৫১} আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য ইলাহকে ডাকে না এবং যারা আল্লাহ যে প্রাণকে হত্যা করা নিষেধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না। আর যারা ব্যভিচার করে না। আর যে তা করবে সে আজাবপ্রাপ্ত হবে। কিয়ামতের দিন তার আজাব বর্ধিত করা হবে এবং সেখানে সে অপমানিত অবস্থায় স্থায়ী হবে।’ {সুরা আল-ফুরকান, আয়াত : ৬৮-৬৯} কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হলে ইসলাম তার প্রতিকারের কার্যকর ব্যবস্থা নির্দেশ করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা সেই নাফসকে হত্যা করো না, যা আল্লাহ হারাম করেছেন, সঙ্গত কারণ ছাড়া। যে অন্যায়ভাবে নিহত হয় আমি অবশ্যই তার অভিভাবককে ক্ষমতা দিয়েছি। সুতরাং হত্যার ব্যাপারে সে সীমালঙ্ঘন করবে না; নিশ্চয় সে হবে সাহায্যপ্রাপ্ত। {সুরা বনী ইসরাইল, আয়াত : ৩৩} এ আয়াতে কিসাস তথা হত্যার বদলা হিসেবে হত্যার বিধানের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। অন্য সুরায় যেটি পরিষ্কার করে বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর আমি এতে তাদের ওপর অবধারিত করেছি যে, প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ, চোখের বিনিময়ে চোখ, নাকের বিনিময়ে নাক, কানের বিনিময়ে কান ও দাঁতের বিনিময়ে দাঁত এবং জখমের বিনিময়ে সমপরিমাণ জখম। অতঃপর যে তা ক্ষমা করে দেবে, তার জন্য তা কাফ্ফারা হবে। আর আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তার মাধ্যমে যারা ফয়সালা করবে না, তারাই জালিম।’ {সুরা আল-মায়িদা, আয়াত : ৪৫} বর্তমান অন্যায় অবিচারে ভরা জগতের অনেক মানুষ ইসলামের এ বিধানটিকে অমানবিক আবার কোনো কোনো অবিশ্বাসী একে বর্বর পর্যন্তও বলে বসেন। অথচ বর্তমান পৃথিবীর বাস্তবচিত্রও সাক্ষ্য দেয় আপাতদৃষ্টিতে কঠোর মনে হলেও এর মাধ্যমেই মানবজাতির মুক্তি ও শান্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা বুঝি না বলেই যত অমূলক সমালোচনা। কিসাসের আয়াতের শেষাংশে যেমন ‘বিবেকসম্পন্নগণ’ বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের ওপর ‘কিসাস’ ফরজ করা হয়েছে। স্বাধীনের বদলে স্বাধীন, দাসের বদলে দাস, নারীর বদলে নারী। তবে যাকে কিছুটা ক্ষমা করা হবে তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে, তাহলে সততার অনুসরণ করবে এবং সুন্দরভাবে তাকে আদায় করে দেবে। এটি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে হালকাকরণ ও রহমত। সুতরাং এরপর যে সীমালঙ্ঘন করবে, তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব। আর হে বিবেকসম্পন্নগণ, কিসাসে রয়েছে তোমাদের জন্য জীবন, আশা করা যায় তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে।’ {সুরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৭৮-১৭৯} পৃথিবীতে হত্যার পরিসংখ্যান দেখলে জানা যাবে, সৌদি আরব যেখানে একমাত্র এই কিসাস ব্যবস্থা এখনো বলবৎ রয়েছে, সবচেয়ে কম খুনোখুনির ঘটনা ঘটে। ইসলামকে যারা বর্বর বলে তারা শুধু জ্ঞানপাপীই নয়, মূর্খও বটে। কারণ, ইসলামই পৃথিবীর একমাত্র ধর্ম যেখানে যে কোনো নিরপরাধ মানুষের প্রাণসংহারকে মানবতাবিরোধী ও মানবজাতির হত্যার তুল্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এ কারণেই, আমি বনী ইসরাঈলের ওপর এই হুকুম দিলাম, যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করা কিংবা জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করা ছাড়া যে কাউকে হত্যা করল, সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল। আর যে তাকে বাঁচাল, সে যেন সব মানুষকে বাঁচাল। আর অবশ্যই তাদের কাছে আমার রাসুলগণ সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নিয়ে এসেছে। তা সত্ত্বেও এরপর জমিনে তাদের অনেকে অবশ্যই সীমালঙ্ঘনকারী।’ {সুরা মায়েদা, আয়াত : ৩২} তেমনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও হত্যাকা-কে গুরুতর অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আনাস বিন মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কবিরা গুনাহগুলোর মধ্যে সবচে বড় গুনাহ হলো আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা, পিতামাতার অবাধ্য হওয়া এবং মিথ্যা কথা বলা।’ (বুখারি : ৬৮৭১, মুসলিম : ৮৮) ইবন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মুমিন তার দীনের ব্যাপারে সর্বদা অবকাশের মধ্যেই থাকে যাবৎ না সে নিষিদ্ধ রক্তপাত ঘটায়।’ [বুখারি : ৬৮৬২] ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কিয়ামতের দিন নিহত ব্যক্তি হন্তারককে নিয়ে আসবে। হন্তারকের চুলের অগ্রভাগ ও মাথা নিহতের হাতের মুষ্ঠিতে থাকবে আর তার কণ্ঠনালী থেকে তখন রক্ত ঝরতে থাকবে। সে বলবে, হে রব, এ ব্যক্তি আমাকে হত্যা করেছে। এমনকি সে তাকে আরশের কাছে নিয়ে যাবে।’ [তিরমিজি : ২৯৫৫] আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : ‘জাহান্নাম থেকে একটি গলা বের হয়ে কথা বলতে শুরু করবে। সে বলবে, আজ আমি তিন ব্যক্তির প্রতি ন্যস্ত হয়েছি : প্রত্যেক অত্যাচারী, যে আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক স্থির করে এবং ওই ব্যক্তি যে অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে। অতঃপর সে তাদের থাবা দিয়ে কব্জা করবে এবং জাহান্নামের গহীনে তাদের নিক্ষেপ করবে।’ [মুসনাদ আহমদ : ১১৩৭২] এ তো গেল হত্যা ও খুনোখুনির আইনী প্রতিকারের দিক। সত্যিকারার্থে পরিত্রাণ চাইলে আমাদেরকে এর নৈতিক দিকগুলোও বিবেচনায় নিতে হবে। ক্রমবর্ধমান মূল্যবোধের অবক্ষয় ও মানবিক গুণাবলির অধঃপাতের কথাও চিন্তা করতে হবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও সমুদ্রে ফাসাদ প্রকাশ পায়। যার ফলে আল্লাহ তাদের কতিপয় কৃতকর্মের স্বাদ তাদেরকে আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ {সুরা আর-রূম, আয়াত : ৪১} সত্যিই তো আজ যেসব সামাজিক ব্যধি ও সমস্যায় আমরা নাকাল, এর দায় তো আমাদেরই। আমাদের ব্যক্তিগত আমল ও আচরণের দিকে তাকালেই সেটা পরিষ্কার দেখা যায়। কিয়ামত যত ঘনিয়ে আসছে অবস্থার যেন ততই অবনতি ঘটছে। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘কিয়ামত ততক্ষণ সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না হারাজ বেশি হবে। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হারাজ’ কী হে আল্লাহর রাসুল? তিনি বললেন হত্যা, হত্যা।’ [মুসলিম : ৫১৪৩] হত্যাকা-ের এ রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পেতে আমাদের যেমন আল্লাহর আইনের সুফল অনুধাবন জরুরি, আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা জরুরি, তেমনি প্রয়োজন নিজেদের সব ধরনের অন্যায়, অবিচার ও যাবতীয় পাপাচার থেকে একনিষ্ঠভাবে তাওবা করা। নিজেদের সন্তান তথা ভবিষ্যত প্রজন্মকে আল্লাহভীতি ও নৈতিকতার বলে বলীয়ান হিসেবে গড়ে তোলা। সব ধরনের অশ্লীলতা ও বেহায়পনা থেকে তাদেরকে যে কোনো মূল্যে দূরে রাখা। বলিউড হলিউডের সিনেমা আর স্যাটেলাইট কালচার আমাদের সন্তানদের মানবিক বিকাশকে শুধু বাধাগ্রস্তই করছে না, তাদেরকে হিং¯্র ও নরপশু বানিয়ে ছাড়ছে। পার্থিব ভোগ লালসা মানুষকে অন্ধ ও বধির বানিয়ে ছাড়ছে। এ সত্য যত তাড়াতাড়ি আমরা বুঝবো, ততই কল্যাণ। লেখক : সহসম্পাদক, দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ আসছে রমজান প্রস্তুতি নেয়ার এখনই সময় আবদুল্লাহ মুকাররম জুন'১৪ কয়েক দিন হলো, চান্দ্রবর্ষের অষ্টম মাস-শাবান শুরু হয়েছে। আগামী মাসটিই হচ্ছে বছরের শ্রেষ্ঠ মাস -মাহে রমজান। রমজানের শ্রেষ্ঠত্বের বহু কারণ রয়েছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়। রমজান কুরআনে কারিম নাজিলের মাস। ইরশাদ হয়েছে, ‘রমজান মাসই হলো সে মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে কুরআন।’ [বাকারা-১৮৫] এই মাসেই রয়েছে হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠরজনী- লাইলাতুল কদর। লাইলাতুল কদরের সুনির্দিষ্ট তারিখ বলা না গেলেও সিংহভাগ আলেমের মতে রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে তা হওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। রমজান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আসমান জমিনের নেজামে পরিবর্তন আসে। শয়তান এবং দুষ্টু জিনেরা সারাবছর মুক্ত থেকে মানুষের নেক কাজের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলেও রমজানে তারা থাকে বেড়িবদ্ধ। তাদের অপকর্মের সব রাস্তা থাকে বন্ধ। জান্নাতের সকল প্রবেশদ্বার খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের সব দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। হযরত আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী করিম সা. ইরশাদ করেন, রমজানের প্রথম রজনীর সূচনাতেই শয়তান এবং দুষ্টু জিনদের বেড়িবদ্ধ করা হয়। জাহান্নামের সব দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। তার একটিও খোলা থাকে না। জান্নাতের সকল প্রবেশদ্বার খুলে দেয়া হয়, তার একটিও বন্ধ থাকে না। প্রতি রাতেই একজন ঘোষক ঘোষণা করতে থাকে- হে সৎ পথের দিশারী! অগ্রসর হও, হে অকল্যাণের পথিক! সতর্ক হও। মহান রব্বুল আলামিন তার প্রিয় বান্দাদের ক্ষমা করার জন্য এতসব কিছুর আয়োজন করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় রোজা আমার জন্য, আর রোজার প্রতিদান আমিই দান করি।’ [বোখারি ও মুসলিম] অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের দাবিতে এবং সওয়াবের প্রত্যাশায় রমজানের রোজা রাখবে, তার অতীতের গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে।’ [বুখারি] রমজানে যে কোনো আমলের সওয়াবও ন্যূনতম সত্তরগুণ বৃদ্ধি করে দেয়া হয়। রমজান সহমর্মিতা এবং আত্মসংযমের মাস। রহমত, বরকত এবং মাগফিরাতের মাস। ইরশাদ হয়েছে, রমজানের প্রথম দশদিন- রহমতের। দ্বিতীয় দশদিন- মাগফিরাতের আর শেষ দশদিন- জাহান্নাম থেকে মুক্তির। [সহিহ ইবনে খুযায়মা] এইমাসে মহান রব্বুল আলামিন রহমত বরকতের বারিধারা বর্ষণ করেন। তার বান্দাদের ক্ষমা করার জন্য সব আয়োজন করে রাখেন। আর বান্দারা নিজেকে পাপ পঙ্কিলতামুক্ত করে তার নৈকট্য লাভের পথ খুঁজতে থাকেন। প্রতি রাতে একজন ঘোষক ঘোষণা করতে থাকে, হে সৎ পথের দিশারী! অগ্রসর হও। হে অকল্যাণের পথিক! সতর্ক হও। মহানবী সা. সঠিকভাবে রমজান নির্ণয়ের জন্য শাবানের চাঁদের হিসাব রাখতে বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নির্ভুলভাবে রমজান নির্ধারণের জন্য তোমরা শাবানের চাঁদের হিসাব রেখো।’ [তিরমিজি] নবী করিম সা. রজব মাস শুরু হতেই এই দোয়া পাঠ করতে আরম্ভ করতেন ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজাবা ওয়া শা’বানা, ওয়া বাল্লিগনা রমাজান’ ‘হে আল্লাহ! রজব এবং শাবান মাসকে আমাদের জন্য বরকতময় করুন এবং আমাদের হায়াতকে রমজান পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করুন।’ [মাজমাউয যাওয়ায়েদ] রমজানে কম বেশি সবারই পূর্ব প্রস্তুতি থাকে। অন্তত মানসিকভাবে সবারই একটা পরিকল্পনা থাকে। রমজানে যেহেতু সারাদিন না খেয়ে সিয়াম সাধনা করতে হয়, তাই খাবারের প্রতি সবারই মনযোগ থাকে ভিন্ন রমক। খাবারটা একটু মানসম্মত হওয়া, রুচিসম্মত হওয়া। তাছাড়া রমজান ব্যবসার মূল সিজন। সে হিসেবে ব্যবসায়ীদের আগে থেকেই পরিকল্পনা, প্রস্তুতি, ব্যস্ততা; সব মিলিয়ে গলদঘর্ম অবস্থা। উপরন্তু ঈদের উৎসবতো সবার জন্যই। সে জন্য সামান্য হলেও কেনাকাটা। এ সবের পরিকল্পনা কমন বিষয়। ব্যস্ততাও থাকে তথৈবচ। রমজান সমাগত। তাই রমজানকে কেন্দ্র করে মহান রব্বুল আলামিনের ক্ষমার ব্যবস্থা, আসমান জমিনের নেজামে পরিবর্তন এবং নবী করমি সা.-এর দিক-নির্দেশনার সঙ্গে আমাদের পরিকল্পনাটাও মিলিয়ে নেয়া প্রয়োজন। যেন রমজানটা আমার জন্য রহমত হয়েই আসে। জীবনকে স্বার্থক করে তবেই বিদায় নেয়। উপরন্তু আমি যেন নবী করিম সা. এবং হযরত জিবরিল আ.-এর সম্মিলিত বদ-দুআার টার্গেটেও পরিণত না হই। ‘যে রমজান পেল অথচ নিজের পাপ মোচন করাতে পারল না, সে ধ্বংস হয়ে যাক।’ অন্যথায়, রমজান আমার জন্য রহমত না হয়ে আজাব ডেকে আনবে। মহাক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। রমজান আসে মূলত আল্লাহর রহমত হিসেবে। ইবাদতের মাধ্যমে সামনে এগিয়ে যেতে। গোনাহমুক্ত সময় অতিবাহিত করে সামনের জীবনে গোনাহমুক্ত থাকার অঙ্গীকার গ্রহণের জন্য। সবশেষে মহান রব্বুল আলামিনের ক্ষমার যোগ্য হয়ে প্রকৃত সফলতা অর্জনের নিমিত্তে। রমজান হচ্ছে ইবাদতের বসন্তকাল। রমজান আসার সঙ্গে সঙ্গেই সবার মানসিকতায় পরিবর্তন আসে। মনে আমলের আগ্রহ পয়দা হয়। পরিবেশও থাকে ইবাদতের। ইবাদতের সব সুযোগ যেন সামনে এসে হাজির হয়। অন্যসময় একবেলা না খেলেই কষ্ট হয়। কিন্তু রমজানে সারাদিন না খেলেও তেমন কষ্ট অনুভব হয় না। রোজা না রাখলেই বরং ঝামেলা বেশি। না খেয়েও থাকা যায় না। আবার প্রকাশ্যে খাওয়াও যায় না। লুকোচুরি করতে হয় রীতিমত। চরম এক বিড়ম্বনা। এমন পরিবেশে রোজা রাখাই বরং সহজ। রোজা রাখতে হলে শেষরাতে ওঠে সেহরি খেতে হয়। অন্যসময় ফজরের জামাত ধরাই যেখানে কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। সেখানে সবাই খুব সহজেই ওঠে সেহরি খাচ্ছে। ঠিক তাহাজ্জুদের সময়। আল্লাহকে একান্তে ডাকার বিশেষ মুহূর্ত। ইচ্ছে করলেই তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে নেয়া যায়। নিজের জন্য, পরিবার ও আপনজনের জন্য এবং মুসলিম উম্মাহর কল্যাণের দোয়া করার বিশেষ সুযোগ। নিজের গোনাহ মাফ করানোর উত্তম সময়। তাছাড়া ফজরের জামাতেও শরিক হওয়া যায় অনায়াসেই। উপরন্তু সেহরিই সতন্ত্র একটি ইবাদত। মহান রব্বুল আলামিনের কী অপার দয়া! রমজানের রোজা রেখে দিনের বেলা না খেয়ে উপোস থাকাতে সওয়াব। রোজা রাখার জন্য সেহরি খাওয়া এবং রোজা রেখে ইফতার করাও সওয়াব। সারাদিরেন চলমান ইবাদত- রোজা অন্যান্য ইবাদতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। রোজা পরিপন্থী সব কাজ থেকে রোজাদারকে বাঁচিয়ে রাখে। অন্যান্য সময়ের অবস্থা যেমনই হোক না কেন, রমজানে নামাজের প্রতি সবারই স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। ফরজ নামাজ পাশাপাশি সুদীর্ঘ তারাবির নামাজের মুসল্লির সংখ্যা থাকে ঢের বেশি। কুরআন তিলাওয়াত, জিকির- আজকার ইত্যাদিতে সবাই মনযোগী থাকে। মনে ইবাদতের আগ্রহ পয়দা হয়। মনের এ অবস্থাকে পুঁজি করে রমজানকে ইবাদতে কাটানো এবং দীর্ঘ এক মাসের সংযমী জীবন-যাপন, ইবাদতের অভ্যাসকে ধারাবাহিক করার প্রয়াস চালানো বুদ্ধিমানের কাজ বৈ কি? রমজানের দাবিও অনুরূপ। রমজান প্রদান করা হয়েছে ইবাদতের মাধ্যমে মহান রব্বুল আলামিনের ক্ষমা লাভ করে তার নৈকট্য হাসিলের জন্য। রমজান পরকালের ব্যবসার মাধ্যমে নিজের পরকালকে সমৃদ্ধ করার মাস। ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা দুনিয়ার অন্যান্য কাজের জন্য নয়। ঈদের উতসবে মেতে ওঠার জন্যও নয়। তাই অত্যবশ্যকীয় সব কাজ আগেই সেরে নিয়ে রমজানকে ইবাদতের জন্য ফ্রি করে নেয়া বুদ্ধিমানের পরিচয়। ব্যবসার সিজন আসার আগেই তার প্রস্তুতি নিতে হয়। প্ররিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। ইবাদতের সিজনেও তার জন্য পূর্ব-পরিকল্পনা জরুরি বৈ কি? স্মর্তব্য : ঈদ হচ্ছে ইসলামি উতসব। ঈদুল ফিতর মানেই হচ্ছে, রোজা পরিসমাপ্তির উতসব। যারা যথাযথভাবে মাসব্যাপী সিয়াম সাধনা করতে পেরেছেন তাদের জন্য মহান রব্বুল আলামিনের হুকুম পালন করতে পারার আনন্দ এটা। তার শুকরিয়া। ঈদের দিন ঈদের নামাজান্তে তারা তাদের রবের ঘোষিত পুরস্কার নিয়ে খুশিতে মেতে ওঠবে। ঈদ করবে। আনন্দ প্রকাশ করবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘ঈদের দিন আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের ডেকে বলেন, হে আমার ফেরেশতারা! তোমরা বল, সে শ্রমিকদের প্রতিদান কি হতে পারে, যারা তাদের কর্ম যথাযথ আঞ্জাম দিয়েছে? তারা বলবেন, আল্লাহ! তাদের প্রতিদান হলো- তাদের পূর্ণ বিনিময় দিয়ে দেয়া। তখন আল্লাহ তাআলা তার পাঁচটি গুণের কসম খেয়ে ফেরেশতাদের সাক্ষী রেখে রোজাদারদের জন্য ক্ষমার ঘোষণা করেন।’ {মেশকাত} তাদের জন্য ক্ষমা প্রাপ্তির আনন্দই হচ্ছে ঈদ। ঈদ মূলত তাদের জন্য। অন্যদের ঈদের দিন আনন্দ নয়, কাঁদা উচিত। কুরআন ও হাদিসের আলোকে কবর-মাজারের বিধি-বিধান মে'১৪ মানুষ মাত্রই মরণশীল। আর মৃত ব্যক্তির প্রতি জগতবাসীর অন্যতম দায়িত্ব-কর্তব্য হলো, তার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা, তাকে কবরস্থ করা। লক্ষাধিক নবী-রাসুল, সাহাবি, তাবেয়ি, ইমাম, মুহাদ্দিস, ওলি-আবদাল কারো ক্ষেত্রেই এর ব্যত্যয় ঘটেনি। এটাই ইসলামের বিধান। নবীর সা. তরিকা। একজন মানুষ যখন কবরে চলে যায়- হাদিসের ভাষ্যমতে সে অসহায় এবং নিরুপায় হয়ে যায়। সে জগতবাসীর দিকে চাতকের ন্যায় তাকিয়ে থাকে। তাই নবীজি সা. উম্মতকে কবর জিয়ারত ও কবরের ব্যক্তির জন্য কিছু দুআ-কালাম করার জন্য উৎসাহিত করেছেন। কিন্তু একদল নির্বোধ মানুষ এই সহজ সত্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়ে কবরকে কেন্দ্রকরে অনেক ধরনের বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। সম্প্রতি মোহাম্মাদপুরের বাসিন্দা হায়দার পাগলা ওরফে হাঁটাবাবা নামে এক পাগল মারা যায়। যার জীবনের বড় কারামত (?) ছিল দীর্ঘদিন যাবত ওজু, গোসল, পাক-পবিত্রতা ও নামাজ রোজা থেকে দূরে থাকা। জনশ্র“তি আছে- দীর্ঘ ৩০ বছরে কেউ তাকে ওজু-গোসল তথা পবিত্রতা অর্জন করতে দেখেনি। অথচ এই সময়ে একাধিক সন্তান-সন্ততি তার মুখ উজ্জ্বল করেছে। এই কারামতের কারণেই এই সমাজের কথাকথিত শিক্ষিত মানুষগুলো তার পিছে পিছে ঘুরতো- কী করে পাক-পবিত্রতা আর নামাজ রোজা ছাড়া জান্নাত পাওয়া যায় সেই ধান্ধায়। সম্প্রতি হায়দার পাগলা মারা যাওয়ার পর ধান্ধাবাজদের মাথায় নতুন ধান্ধা শুরু হয় তার কবরকে কেন্দ্রকরে। এমন এক প্রেক্ষাপটে সময়ের গুরুত্ব বিবেচনায় প্রবন্ধটি উপাস্থাপিত হলো। কবর ও মাজার সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত জানতে কুরআন-সুন্নার দ্বারস্ত হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। কারণ মানুষ যদি স্ব স্ব খেয়ালখুশিতে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে থাকে তাহলে তা শরিয়ত হবে না, বরং তা হবে প্রবৃত্তির অনুসরণ ও গোমরাহি। কবর পাকা করা, কবরের পাশে অবস্থান করা, কবরের ওপর ছাদ বা সামিয়ানা টানানো এ সম্পর্কে মুসলিম শরিফের হাদিসে রাসুল সা. বলেন- আল্লাহ তাআলা ইহুদি ও খৃস্টানদের প্রতি অভিসম্পাত করেছেন এজন্য যে- তারা তাদের নবী-রাসুলদের কবরকে মসজিদ তথা ইবাদতের স্থান বানিয়ে নিয়েছে। (সহিহ বুখারি :২/৮৮) মুসলিম শরিফের এক হাদিসে এসেছে- রাসুল সা. কবরকে পাকা করতে, কবরের পাশে অবস্থান করতে ও কবরের ওপর ছাদ বা সামিয়ানা স্থাপন করতে নিষেধ করেছেন। (মুসলিম শরিফ : ২/৬৬৭) তিরমিজি শরিফের বর্ণনায় এসেছে- রাসুল সা. কবর পাকা করতে, তার ওপর লিখতে, তার ওপর ঘর নির্মাণ করতে ও কবরস্থানকে পদদলিত করতে নিষেধ করেছেন। (তিরমিজি শরিফ : ২/২৫৮) এ সকল হাদিস দ্বারা দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার হয়ে যায় যে, মৃত ব্যক্তির কবরকে মাজার বানানো তথা পাকা করা, এর ওপর ঘর নির্মাণ করা, তাতে বাতি জ্বালানো ইত্যাদি সম্পূর্ণ হারাম বা কবিরা গুনাহ। কবরকে সিজদা করা, সম্মান করা অনেক সময় দেখা যায়- কবরকে সিজদা পর্যন্ত করা হয়। যা পরিষ্কার শিরক। আর শিরকের গুনার কোনো ক্ষমা নাই। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আল্লাহর সঙ্গে শিরক করার গুনাহ তিনি ক্ষমা করবেন না, এ ছাড়া অন্যান্য গুনাহ যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করে দিবেন। ( সুরা ....... তোমরা চন্দ্র বা সূর্যকে সিজদা করো না। বরং তোমরা চন্দ্র-সূর্যের স্রষ্টাকে সিজদা কর। যদি তোমরা প্রকৃত ইবাদতকারী হও। ( সুরা ফুসসিলাত : আয়াত- ৩৭) একদা রাসুল সা. মুহাজির ও আনসার কর্তৃক পরিবেষ্টিত অবস্থায় ছিলেন, এমতাবস্থায় একটি উট এসে নবীজি সা. কে সিজদা করলো। সাহাবাগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! বৃক্ষরাজি ও প্রাণীকুল আপনাকে সিজদা করে- অথচ আমরা আপনাকে সিজদা করার অধিক হকদার। (তাই আমরাও আপনাকে সিজদার অনুমতি প্রার্থনা করছি) রাসুল সা. বললেন- তোমাদের রবের ইবাদত কর, আর তোমাদের ভাইকে সম্মান কর। মনে রেখ! যদি আমি কোনো মানুষকে সিজদার অনুমতি প্রদান করতাম তাহলে নারীদেরকে তাদের স্বামীদের সিজদা করার অনুমতি দিতাম। (মিশকাত শরিফ : ২, পৃষ্ঠা-৯৭৫) এই আয়াত ও হাদিস স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, কবরকে সিজদা করা চাই ইবাদাতের উদ্দেশ্যে হোক কিংবা সম্মানার্থে হোক সম্পূর্ণরূপে হারাম ও নাজায়েজ। বরং ইবাদাতের উদ্দেশ্যে সেজদা করা স্পষ্ট কুফুরি। আর তাজিমি সেজদা (সম¥ানার্থে সেজদা) করা হারাম ও গুনাহে কবিরা। সমস্ত ফুকাহায়ে কেরাম এর হারাম হওয়ার ওপর ঐকমত্য পোষণ করেছেন। কবর বা মাজারে ফুল দেয়া অনেক সময় দেখা যায় কবর বা মাজারে ফুল দেয়া হয় এ ব্যাপারে শরিয়ত কী বলে? হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত নবীজি সা. বলেন- যে আমাদের এই দ্বীন-ধর্মে নতুন কিছু সংযোজন করবে যা পূর্বে ছিল না তা ছুড়ে ফেলা হবে। ( বুখারি শরিফ : ২, পৃষ্ঠা- ১৮৪) অন্য হাদিসে নবীজি সা. বলেন, তোমরা ধর্মের মধ্যে নতুন আবিস্কৃত বিষয় থেকে বেঁচে থাক। কেননা প্রত্যেক নবআবিস্কৃত বিষয়ই বিদআত আর প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহি আর প্রত্যেক গোমরাহি-ই জাহান্নামে নিয়ে যাবে। (সুনানে আবু দাউদ: ৪, পৃষ্ঠা- ২০১) উল্লেখিত হাদিসদ্বয় থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কোনো কবর বা মাজারে ফুল দেয়া বিদআত। কেননা কোনো সাহাবি বা তাবেয়ি থেকে তা প্রমাণিত নয়। অতএব তা বর্জনীয়। মাজারে আতর গোলাপ দেয়া এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চয় অপচয়কারী শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের বড়ই অকৃতজ্ঞ। (সুরা বনি ইসরাঈল- ২৭) আল্লাহ আরো বলেন, আর তোমরা অপচয় করো না, কেননা তিনি অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না। (সুরা আনআম- ১৪১) এ ব্যাপারে রাসুলে কারিম সা. বলেন, আল্লাহর নিষিদ্ধ কোনো কথা বা কাজে মান্নত হয় না। আর এমনটি কেউ করলে তার কাফফারা হলো কসমের কাফফরা। (আল্লাহর নামে কসম খাওয়ার কারণে কসমের কাফফারা দিবে, কিন্তু গোনার কাজটি করবে না) (তিরমিজি শরিফ-৩ : ১৫৬) যেহেতু আতর, গোলাপ, মোমবাতি এগুলো কবরবাসীর কোনোই কাজে আসে না, তাই এগুলো অপচয়ের শামিল। অতএব আয়াত ও হাদিস দ্বারা পরিষ্কার বোঝা যায় যে, মাজারে মোমবাতি, আগরবাতি ও গোলাপজল দেয়া কিংবা মান্নত করা বৈধ নয়। কেননা এতে অন্যায় কাজে সহযোগিতা করা হয় এবং সম্পদের অপচয় হয়। মাজারে মোমবাতি দেয়া বর্তমানে মাজারগুলোতে সওয়াবের উদ্দেশ্যে অথবা মান্নত হিসাবে মোমবাতি, আগরবাতি বা এজাতীয় জিনিস দেয়ার যে প্রচলন রয়েছে তা হারাম ও বিদআত। রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, যেসকল নারীগণ মাজারে গমন করে এবং যারা মাজারকে মসজিদ তথা ইবাদতখানা বানিয়ে নেয় এবং মাজারে বাতি জ্বালায় তাদের প্রতি আল্লাহ অভিশাপ বর্ষণ করেছেন। (সুনানে আবু দাউদ : ৩/১৭৯) এবং এগুলো অপচয়ের শামিল হওয়ায় ওপরে বর্ণিত অপচয়ের বিধানও এখানে গণ্য হবে। সুতরাং এসকল কর্মকাণ্ড থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক। মাজারে মানসা বা মান্নত করা আল্লাহ রব্বুল আলামিন বলেন, তিনি তোমাদের ওপর হারাম করেছেন মৃত জীব-জন্তু, রক্ত, শুকরের মাংস এবং সে সব জিনিস যা আল্লাহ ব্যতিত অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয়। (সুরা বাকারা- ১৭৩) এ ব্যাপারে রাসুলে কারিম সা. বলেন, আল্লাহর নিষিদ্ধ কোনো কথা বা কাজে মান্নত হয় না। আর এমনটি কেউ করলে তার কাফফারা হলো কসমের কাফফরা। (তিরমিজি শরিফ-৩ : ১৫৬) পরিষ্কর বোঝা যাচ্ছে- মান্নত একমাত্র আল্লাহ তাআলার নামে হতে হবে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নামে বা অন্য কারো জন্য মান্নত করা জায়েজ নেই। সেমতে মাজারে কোনো কিছু দেয়ার মানসা (মান্নত করা) নাজায়েজ ও হারাম। অতএব, মাজারে মানসা (মান্নত) করা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। মাজারে গরু ছাগল জবাই করা, উরশ বা চল্লিশা করা এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- তোমাদের ওপর হারাম করা হয়েছে মৃতজীব, রক্ত, শুকরের গোশত এবং সেসব জন্তু যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয়। (সুরা মায়েদা : ৩) মূর্খ লোকেরা ওলি, শহীদ ও বুজুর্গদের কবর নিয়ে যা কিছু করে থাকে যেমন- সিজদা করা, তওয়াফ করা, বাতি জ্বালানো, কবরে নামাজ পড়া, বছর পূর্তিতে সেখানে জমা হয়ে ওরস করা এ সবই না জায়েয ও হারাম। (তাফসিরে মাজহারি-১২: ৬৫) অতএব, মাজারে কোনো পীর বা বুজুর্গের নামে উৎসর্গ করে গরু-ছাগল জবাই করা ও তা খাওয়া সম্পূর্ণ হারাম। এমনিভাবে মাজারে উরশ, মৃত্যুবার্ষিকী, চল্লিশা ইত্যাদি ইত্যাদি দিবস পালন করা ইসলামের দৃষ্টিতে নাজায়েয ও বিদআত । তাই এ থেকে বিরত থাকা সকল মুসলমানের কর্তব্য। মাজারে নারী-পুরুষের বেপর্দা গমন এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, (নারীসমাজ) তোমরা তোমাদের গৃহে অবস্থান করো এবং অন্ধকার যুগের নারীদের ন্যায় বাইরে ছোটাছুটি করো না। ( আহজাব : ৩৩) ইমাম তিরমিজি রহ. এ ব্যাপারে তার সুনানে তিরমিজিতে হাদিস উল্লেখ করেছেনÑ রাসুল সা. কবরস্থানে গমনকারী নারীদের প্রতি লা‘নত করেছেন। (তিরমিজি শরিফ : ৩/৩৭১) নারী-পুরুষের বেপর্দা অবস্থায় মাজারসহ যে কোনো স্থানে গমন, অবস্থান নাজায়েয ও হারাম। উপরন্তু কবর জিয়ারতকারী নারীদের উপর নবী সা. লানত করেছেন। অতএব এ থেকে অবশ্যই বিরত থাকা আবশ্যক। মাজারের জন্য চাঁদা নেয়া ও মান্নত, দান ইত্যাদি গ্রহণ করা শরিয়তের দৃষ্টিতে মান্নত, দান ইত্যাদি আল্লাহর নামে বা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হতে হবে। অথচ আজকাল অধিকাংশ লোক মাজারে দাফনকৃত ব্যক্তির নামে মান্নত, দানসহ নানা রকম শিরক-বিদআতি কর্মকাণ্ড করে থাকে। যা নাজায়েয ও হারাম। সেমতে মাজার কমিটি গঠন করে চাঁদা নেয়া ও মান্নত, দান ইত্যাদি গ্রহণের ব্যবস্থা করা নাজায়েয ও হারাম। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, তোমরা সৎকর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সহযোগিতা করো। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে সহযোগিতা করো না। (সুরা মায়েদা : ২) অতএব এসব কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকা আবশ্যক। কবর জিয়ারতের সঠিক ও সুন্নত তরীকা কী? সপ্তাহে একবার কবর জিয়ারত করা মুস্তাহাব। আর তা শুক্রবারে হওয়া উত্তম। এর সুন্নত তরিকা হলো, কবরস্থানে প্রবেশ করে প্রথমে সকল কবরবাসীকে নিন্মোক্ত বাক্যে সালাম করবে ‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর, ইয়াগফিরুল্লাহু লানা ওলাকুম, আনতুম সালাফুনা ও নাহনু বিল আছারি’ সালামের পর কেবলার দিকে পিঠ করে যথাসম্ভব কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত করে সওয়াব রেসানি করবে। বিষেশত সুরা বাকারার শুরু থেকে কিছু অংশ, সুরা বাকারার শেষ তিন আয়াত, সুরা ফাতেহা, সুরা তাকাছুর, সাত বা তদোর্ধ্ব সুরা ইখলাস পড়তে পারে। সম্ভব হলে সুরা ইয়াসিন, সুরা মুলক এবং দরূদ পড়ে কবরকে পেছনে রেখে কিবলামুখী হয়ে দোআ করবে। উল্লেখ্য, পুুরুষদের জন্য কবর জিয়ারত করা মুস্তাহাব। আর যুবতী মহিলাদের কবরে যাওয়া মাকরূহে তাহরিমি। (প্রবন্ধকার : মুফতি কামরুল হাসান রাহমানী। সহযোগিতায় : দারুল ইফতার ছাত্রবৃন্দ, জামিয়া রাহমানিয়া ঢাকা) ভারতের জাতীয় নির্বাচন ক্ষমতার নিয়ামক মুসলিম ভোট জহির উদ্দিন বাবর এপ্রিল'১৪ ভারতজুড়ে চলছে নির্বাচনী ডামাডোল। বর্তমান ক্ষমতাসীন কংগ্রেস আর প্রধান বিরোধীদল বিজেপির মধ্যেই লড়াই হবে আগামী মাসে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে। সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশের এই নির্বাচনে নজর গোটা বিশ্বের। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমাদের আগ্রহ ও কৌতূহলটা একটু বেশিই। ভারতের নির্বাচনে বরাবরই মুসলিম ভোট একটি বড় ফ্যাক্টর। এবারো এর ব্যতিক্রম নয়। তবে এবার মুসলিম ভোট ইস্যুতে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিজেপি এবার দিল্লির মসনদে আসীন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আর দলটি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছে এমন এক ব্যক্তিকে যিনি কট্টর হিন্দুত্ববাদ আর মুসলিম বিদ্বেষের জন্য প্রসিদ্ধ। বিশেষ করে ২০০২ সালে গুজরাটের ভয়াবহ দাঙ্গায় ইন্ধনদাতা হিসেবে তার বদনাম রয়েছে। কিন্তু এবারের নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে নরেন্দ্র মোদির মতো কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতাও মুসলিম ভোটারদের দ্বারস্থ হচ্ছেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে মুসলমানদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। তার দলের পক্ষ থেকেও ক্ষমা চাওয়া হয়েছে। বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদির এই ক্ষমা চাওয়ার উদ্দেশ্য হলো মুসলমানদের ভোট টানা। নরেন্দ মোদি লক্ষেèৗর এক নির্বাচনী সভায় মুসলমানদের উদ্দেশে বলেছেন, গুজরাট হিন্দুদের একক রাজত্ব, সেখানেও মুসলমানদের অবস্থা ভালো হয়ে যাচ্ছে। ৬৩ বছর বয়সি মোদির ব্যাপারে বিশ্লেষকদের মত হলো, এবারের নির্বাচনে মোদির দল জিততে পারে। তবে দিল্লির মসনদে আসীন হওয়ার জন্য তার মুসলমানদের ভোট লাগবে। লক্ষেèৗ যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে মোদির জনসভায় লাখখানেক লোক অংশ নেন। তবে মুসলিম বন্ধুত্বের টোপ দিলেও মোদির জনসভায় আসা কর্মীদের বেশির ভাগের গায়ে ছিল কমলা রঙের পোশাক, যাকে সাধারণত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পোশাক মনে করা হয়। এতে প্রমাণ হয়, মুখে বিজেপি যতই বলুক ধর্মনিরপেক্ষতা, কথা কাজে কর্মে কট্টর হিন্দুত্ববাদ ছাড়তে পারেনি দলটি। ভারতের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত স্যেকুলার দলগুলোই জয় পেয়েছে। আর বেশির ভাগ দলই স্যেকুলার হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিয়ে মুসলমানদের সঙ্গে ধোঁকাবাজির আচরণ করেছে। এখন বিজিপির লোলুপ দৃষ্টিও পড়েছে মুসলিম ভোটের ওপর। মুসলমানদের ভোট টানার জন্য তারা নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করছে। এজন্য মোদির পাশাপাশি বিজিবি প্রধান রাজনাথ সিংও মুসলমানদের সামনে মাথা ঝুঁকানোর নাটক করছেন। তিনি মুসলমানদের উদ্দেশে বলেছেন, আমরা কোনো ভুল করে থাকলে মাথা নত করে ক্ষমা চাইতে প্রস্তুত। বিজিপি প্রধান হয়ত এ কথা ভুলে গেছেন, ব্যক্তিগতভাবে কেউ কোনো অন্যায় কাজ করে ফেললে সেটাকে ভুল বলা যায়। কিন্তু যখন একটি বিশাল দল সমষ্টিগতভাবে একটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে দাঙ্গা উস্কে দেয়, এটাকে নিছক ভুল বলে ক্ষমা চেয়ে পার পাওয়া যায় না। ভুক্তভোগী মুসলমানরা মনে করেন, ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) কাজই হলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উস্কে দেয়া এবং মুসলমানদের পুড়ে ছারখার করে দেয়া। অতীতে দলটি মুসলমানদের সঙ্গে এমন অসংখ্য আচরণ করেছে। যার ফলে মুসলমানরা বিজেপি সম্পর্কে অত্যন্ত নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে রেখেছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিজেপির প্রথম বিদ্বেষমূলক কর্মকাণ্ড হলো ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা এবং এ ঘটনার পর মুসলমানদের কচুকাটা করা। আর দ্বিতীয় দফার সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি হলো ২০০২ সালে নরেন্দ্র মোদির তত্ত্বাবধানে মুসলিম নিধন। আজ যখন রাজনাথ সিং এসব কর্মকাণ্ডের জন্য সামান্য ‘সরি’ বলে পার পেয়ে যেতে চাচ্ছেন এর মানে হলো মুসলমানদের পাঁচশ বছরের ঐতিহ্যবাহী ইবাদতখানা গুড়িয়ে দেয়া তেমন কোনো বিষয় নয়। গুজরাটে মুসলমানদের রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়াও সামান্য বিষয়। নরেন্দ্র মোদির হাতে আজও লেগে আছে মুসলমানদের রক্তের দাগ। আর সেই নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনয়ন দিয়ে বিজেপি মুসলমানদের ভোট টানতে ব্যস্ত। সামান্য ক্ষমা চেয়েই তারা ভোটের বৈতরণী পার পেয়ে যেতে যাচ্ছেন। কারণ মুসলমানদের ভোটে ভাগ বসাতে পারলে বিজেপির ক্ষমতার স্বাদ পূরণ হওয়া অনেকটা নিশ্চিত। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিজেপির এই কৌশল তেমন কাজে আসবে না। মুসলমানরা বিজেপিকে বিশ্বাস করতে পারেন না। শেষ পর্যন্ত বেশির ভাগ মুসলমানের ভোট বিজেপির বাক্সে পড়বে না। এটা বিজেপিও ভালো করেই জানে। তবুও তাদের চেষ্টা হলো কোনো রকম মুসলিম ভোটে বিভাজন সৃষ্টি করতে পারলে মোদিবিরোধী ভোট তার জয়-পরাজয়ের জন্য ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াবে না। এজন্য বিজেপির নেতারা মুসলমানদের ভোট টানার নানা ফন্দি-ফিকির করে যাচ্ছেন। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোতে বিজেপি প্রচার-প্রচারণায় বেশি জোর দিচ্ছে। তুলনামূলক মুসলিম প্রার্থীও এবার বিজেপিতে বেশি রাখা হয়েছে। তবুও বিজেপি মুসলিম ভোট নিয়ে অস্বস্তিতে আছে। দলটির নেতারা এখনো আশ্বস্ত হতে পারছেন না, মুসলিম ভোট শেষ পর্যস্ত তাদের বাক্সে আসবে তো! তাদের আশঙ্কা, মুসলিম ইস্যু জোরালো করে কংগ্রেস মোদির সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে। দিন যত গড়াচ্ছে মুসলিম ভোট নিয়ে বিজেপিতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। বিজেপির আশঙ্কা, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর প্রদেশ ও বিহারের মতো প্রদেশগুলোতে তাদের ভরাডুবি হতে পারে। এসব এলাকায় মুসলিম ভোটের ব্যাপারে তাদের কৌশল হলো, নিজেদের অনুকূলে না আসুক, অন্তত মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে যেন অবস্থান না নেয়। তাদের ধারণা, মুসলিম ভোটে বিভাজন সৃষ্টি করতে পারলে আনুকূল্য তারাই পাবে। বিজেপি প্রধান রাজনাথ সিং মুসলমানদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার যে টোপ দিয়েছেন এর রহস্য উন্মোচন হয়ে গেছে বিজেপির আরেক নেতার বক্তব্যে। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ২০০২ সালে দাঙ্গায় মুসলিম হতাহতের যে ঘটনা ঘটেছে এর জন্য কি বিজেপি মুসলমানদের কাছে ক্ষমা চাইবে? তখন ওই নেতা বলেন, গুজরাটের দাঙ্গায় নরেন্দ্র মোদির কোনো অপরাধ নেই, সে সম্পর্কে তো আগেই সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে। রাজনাথ সিং মূলত মুসলমানদের আবেগকে প্রভাবিত করতে চেয়েছেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিজেপি যদি আসলেই মুসলমানদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে চাইত তবে নরেন্দ্র মোদির মতো একজন মুসলিমবিদ্বেষী নেতাকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নির্বাচন করতো না। তার ক্লেদাক্ত অতীত সম্পর্কে দলটি এমন নির্মোহ থাকতো না। বরং বাস্তবতা হলো, কট্টর হিন্দুত্ববাদী এবং মুসলিম বদ্বেষী হওয়ার কারণেই মোদিকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী করেছে বিজেপি। ২০০২ সালে যা হয়েছে তা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। খুব সহজেই এটা ভুলে যাওয়ারও নয়। মুসলমানদের মন থেকে সেই দাঙ্গার দগদগে ক্ষত এখনো শুকিয়ে যায়নি। বিজেপির আসল উদ্দেশ্য ২৭২টির বেশি সংসদীয় আসন। টার্গেটসংখ্যক আসন পেলেই দলটি নিজের মতো করে সরকার গঠন করতে পারবে। অথচ অটল বিহারি বাজপায়ীর নেতৃত্বেও এই টার্গেট পূরণ করতে পারেনি বিজেপি। এজন্য সব সম্প্রদায়ের ভোটের প্রয়োজন বলে মনে করে দলটি। তাই বিজেপি আজ তাদের ভাষায় মুসলমানদের মতো ‘অচ্ছুত’ একটি সম্প্রদায়ের ভোট পেতে মরিয়া। দিল্লির এক জনসভায় রাজনাথ সিং অত্যন্ত করুণ কণ্ঠে মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন বিজেপিকে একটি বারের জন্য সুযোগ দেন। তিনি কাতরকণ্ঠে বলেন, একবার আমাদের ভোট দিয়ে পরীক্ষা করুন। আমরা যদি অঙ্গীকার পূরণ না করি আর কখনো আমাদের দিকে ফিরে তাকাবেন না। ভারতের উত্তর প্রদেশের মন্ত্রী এবং সমাজবাদী পার্টির নেতা আজম খান বলেন, গুজরাটের মুসলমানরা অজানা আতঙ্কে মোদিকে ভোট দিতে অপারগ। আবার ভোট না দিলে হিন্দত্ববাদী সন্ত্রাসীরা মুসলমানদেরকে জীবিত পুড়িয়ে মারবে। তিনি বলেন, নরেন্দ্র মোদির দাবি, তিনি মুসলমানদের সঙ্গে আছেন এবং গত দশ বছরে গুজরাটে কোনো দাঙ্গা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী হতে পারলে তিনি পুরো ভারতকে গুজরাট বানিয়ে দেবেন। তবে মুসলমানরা মনে করেন, নরেন্দ্র মোদির মতো মানবতাবিরোধী অপরাধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন না। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতা আই কে সাইফ আলি বলেন, এটা স্বতঃসিদ্ধ বিষয় যে, বিজেপির রন্ধ্রে রন্ধ্রে মুসলিম বিদ্বেষ লুকিয়ে আছে। নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে দলটির মুসলিম ভোট প্রয়োজন। কারণ মুসলিম সম্প্রদায়ের ভোট ছাড়া বিজেপি পার পাবে না। তিনি প্রশ্ন রাখেন, রাজনাথ সিংয়ের সামান্য ক্ষমা প্রার্থনার প্রস্তাব কি মুসলমানদের দগদগে ঘা শুকিয়ে দিতে পারবে? মুসলমানরা কি গুজরাট দাঙ্গার মূল হোতা মানবতার শত্র“ নরেন্দ্র মোদিকে এত সহজেই ক্ষমা করে দেবেন? তার মতে, রাজনাথ সিং ও নরেন্দ্র মোদির মুসলমানদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা একটি রাজনৈতিক ভাওতাবাজি। মুসলমানরা এটা কখনো গ্রহণ করবে না। গুজরাট দাঙ্গাকে পশ্চিমা বিশ্বও ভয়াবহতম দাঙ্গা হিসেবে অভিহিত করেছে। সে দাঙ্গায় দুই হাজারের বেশি মুসলমান প্রাণ হারান। হাজার হাজার নারী সম্ভ্রম হারান। তৎকালীন প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ব্যাপারে সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে, তার ইশারাতেই এই রক্ত ও আগুনের খেলায় মেতেছিল কট্টর হিন্দুরা। সন্ত্রাসী সংগঠন আরএইচএইচ এর পৃষ্ঠপোষক নরেন্দ্র মোদি ভয়াবহ দাঙ্গা চলাকালে পুলিশকে ওই এলাকায় ঢুকতে দেননি। এই দাঙ্গা কারা ঘটিয়েছেন-এর প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের খুঁজে খুঁজে বের করে মোদির নির্দেশে হত্যা করা হয়। সেই ভয়ঙ্কর খুনি মোদি আজ বসতে যাচ্ছেন দিল্লির মসনদে। আর যাদের খুনে তার হাত রঞ্জিত সেই মুসলমানদের ভোটই তার সেই স্বপ্ন পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এবার ভারতীয় মুসলমানরাই সিদ্ধান্ত নেবেন তারা কার পক্ষে সমর্থন দেবেন। ভারতে সর্বমোট মুসলমান ১৮০ মিলিয়ন, যা মোট জনসংখ্যার ১৫ ভাগ। ছয়টি প্রদেশে মুসলিম ভোটার মোট ভোটারের ১১ ভাগ। রাজনৈতিকভাবে উত্তর প্রদেশে মুসলমানরা বেশি শক্তিশালী। এটি ভারতের সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ। ভারতের লোকসভায় সবচেয়ে বেশি ৮০ আসন এই প্রদেশের। উত্তর প্রদেশ ছাড়া আর কোনো প্রদেশ বিজেপির শাসন ক্ষমতায় যাওয়ার পেছনে এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে না। বরাবরই এখানে বিজেপি খুব ভালো করতে পারে না। গত নির্বাচনে বিজেপি উত্তর প্রদেশ থেকে মাত্র ১০টি আসন পেয়েছিল। দলীয় ভোট থেকেও সেই নির্বাচনে বিজেপি উত্তর প্রদেশে ৪.৭ ভাগ ভোট কম পেয়েছিল। পরবর্তী প্রাদেশিক নির্বাচনেও বিজেপি এখানে খুব ভালো কিছু করতে পারেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, উত্তর প্রদেশের রাজনীতিতে আজও সাম্প্রদায়িকতা বড় ফ্যাক্টর। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, মোদি যদি উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও অন্ধ্র প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেন তাহলে তার বিজয়ের সম্ভাবনা প্রচুর। আর এর জন্য অবশ্যই মুসলিম ভোট টানতে হবে। বিজেপি এখন মুসলিম ভোট টানতে মরিয়া। তবে কংগ্রেস এখনো পুরোদমে নির্বাচনী প্রচারে নামেনি। কংগ্রেস নির্বাচনী মাঠে নেমে গেলে তাদের রিজার্ভ ভোট হিসেবে খ্যাত মুসলিম ভোটারদের টানা বিজেপির জন্য খুবই কষ্টকর হবে। আরেকটি বিষয় হলো, মোদি ইতিপূর্বে গুজরাট দাঙ্গার জন্য অনুতপ্ত হননি এবং নিজের ভুলও স্বীকার করেননি। লোকসভা নির্বাচন সামনে রেখে হঠাৎ করে তিনি মুসলমানদের ক্ষতে মালিশ দেয়ার চেষ্টা করছেন। এটা তার রাজনৈতিক চাল বলেই মনে করেন সবাই। দাঙ্গার পর থেকে গুজরাটে বার বার মোদি বিপুল ভোটে পাস করেছেন। মুসলিম বিদ্বেষ পুঁজি করেই মোদির এই সফলতা। এমনকি প্রাদেশিক নির্বাচনে গুজরাটে বিজেপি থেকে কোনো মুসলমান প্রার্থীকে মনোনয়ন পর্যন্ত দেয়া হয়নি। মোদির মন্ত্রিসভায় কোনো মুসলিম সদস্য রাখা হয়নি। সঙ্গত কারণেই ভারতীয় মুসলমানরা এই প্রশ্ন করতে পারেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর কি মোদি পুরো দেশেই এমন হিন্দুত্ববাদ কায়েম করবেন, আর মুসলমানিত্বের বীজ ধ্বংস করে দেবেন? এক সাক্ষাৎকারে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এলকে আদভানি বলেছিলেন, সাম্প্রদায়িক কোনো দল ভারতের নির্দিষ্ট কোনো এলাকা শাসন করতে পারে; কিন্তু পুরো ভারত কখনো শাসন করতে পারবে না। কিন্তু সেই আদভানিই এক দশক পর ‘হিন্দুত্ববাদের’ ধারক হয়ে বিজেপির নেতৃত্ব দিয়েছেন। ভারতের রাজনীতির এসব বিষয় সামনে রেখে এই প্রশ্ন জাগে, এবার কি সত্যিই বিজেপি তাদের সম্পর্কে মুসলমানদের ধারণা পাল্টাতে সক্ষম হবে? নাকি মুসলমানদের কাছে টানার পেছনে তাদের কোনো অভিসন্ধি রয়েছে। ভারতের বেশ কিছু প্রদেশে বিজেপির শাসন চলছে দীর্ঘদিন ধরে। মুসলমানদের জন্য করেছে উল্লেখ করার মতো এখনো এমন কিছু বিজেপির ভাণ্ডারে নেই। তারপরও কি মুসলিম ভোটাররা এবার তাদের শাসক হিসেবে বিজেপিকে বেছে নেবে? উত্তর জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল পর্যন্ত। অশান্ত সময়ে মনুষ্যত্বের দাবি এনামুল করীম ইমাম মার্চ'১৪ ইলম মূলত মহান আল্লাহ তায়ালার সিফাত (গুণ-বিশেষণ)। এই অভিধায় সিক্ত হয়ে মানুষ জ্ঞনবান। যে ইলম মহান আল্লাহ তায়ালার সিফাত সেটাই হলো প্রকৃত ইলম (বিদ্যা)। এর বাইরে পৃথিবীতে জ্ঞানের যত ধারা আছে সবই মানুষের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত। মানুষের অভিজ্ঞতার আলোকে তৈরি এই ইলম মানুষের জীবন জীবিকাকে সহজতর করে। জীবন চলার পথকে গতিময় করে। জীবনকে ভোগের উপযোগী করে। আমোদ-প্রমোদে ভাসিয়ে দিয়ে জীবনকে শুধু বিনোদনবহুল করে তোলে। পক্ষান্তরে ওহির উতসধারা হতে প্রাপ্ত ইলম মানুষের নীতি নৈতিকতার উন্নতি সাধন করে। মানুষের আখলাককে পূর্ণতা দান করে। সমাজে শান্তি শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিটি জিনিসের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করে। মানবতাকে পৌঁছে দেয় পূর্ণতার চূড়ান্ত পর্যায়ে। আমরা যদি জাগতিক শিক্ষাধারা এবং ওহির ইলমের মধ্যে আরও সহজে ব্যবধান খোঁজার প্রয়াস পাই, তাহলে আমাদের সামনে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইলমে ওহি মানুষকে তার ইহকালীন সুখ সমৃদ্ধি ও পরকালীন মুক্তির পথ দেখায়। সর্বোপরি মানব সমাজে মনুষ্যত্বের উত্তরণ ঘটায়। আর জাগতিক শিক্ষা ভোগবাদকে উসকে দিয়ে মানুষকে বিলাসী ও লোভাতুর করে দেয়। সর্বপরি মানবিকতাকে চাপা দিয়ে পাষবিকতাকে সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রতিষ্ঠিত করে। মোটকথা, ইলমে ওহি মানুষকে জীবন ‘যাপন’ করতে নয়; ‘ধারণ’ করতে শেখায়। পক্ষান্তরে জাগতিক শিক্ষা জীবনকে ধারণ করার বিপরীতে জীবনকে যাপন করতে শেখায়। এর কারণ হলো, ইলমে ওহির ধারক বাহক তারাই হন যাদের অন্তর থাকে মহান আল্লাহ তায়ালার সমীপে সমর্পিত। তাঁর রহমত ও দয়ার জন্য আশান্বিত। আর তাঁর শাস্তির ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত। অপর দিকে জাগতিক শিক্ষার ধারক বাহকরা সাধারণত এসব কিছু তোয়াক্কা না করে বিলাসি জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে থাকে। কাজেই দীনের বিধিবিধান যতই উপকারী ও কল্যাণকর হোক না কেন এগুলো তাদের কাছে কষ্টকর মনে হয়। দ্বীনি বিধিবিধানের আলোকে জীবনব্যবস্থা পরিচালনা করা মানেই শৃংখলাবদ্ধ হয়ে বন্দি জীবন বলে তাদের কাছে মনে হয়ে থাকে। তাই মুক্ত জীবনের প্রত্যাশী হয়ে এ শ্রেণির মানুষেরা শুধু নিজেদের মন মতো জীবন যাপন করেই ক্ষান্ত হয় না; বরং তাদের কাছ থেকে অনেক সময় দীন ও শরিয়াতের মনগড়া ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়। কিন্তু ইলমে ওহি ওয়ালাদের কাছে এই মনগড়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের কোনো মূল্য তো নেই-ই বরং তা সর্বাংশে পরিত্যাজ্য। কিন্তু এক শ্রেণির সুবিধাবাদী মহলের কাছে এটা খুবই মনোমুগ্ধকর বলে প্রতিয়মান হয়। যে কারণে আমাদের সমাজে দ্বীনবিরোধী কথাবার্তার বিরোধী শক্তি থাকলেও সমর্থক শ্রেণিও কম নয়। এমনকি, সমর্থকের সংখ্যাই বেশি বললেও অত্যুক্তি হবে না। এতদিন এই ধর্মবিরোধী ও ইসলাম বিদ্বেষীরা কিছুটা গোপনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করলেও এখন প্রকাশ্যে কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। ফলশ্র“তিতে আমাদের দেশে দিন দিন আশঙ্কাজনকহারে নাস্তিক বেড়ে চলেছে। এর কারণ হিসেবে আমরা আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নাস্তিক প্রজননকেন্দ্র বলতাম। কেননা সেখানে রাশিয়া আমেরিকা ফেরত শিক্ষকরা উঠতি বয়সি ছেলে মেয়েদেরকে নাস্তিকতা শিক্ষা দিত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, এখন নাস্তিক হওয়ার জন্য আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। এখন প্রাইমারি স্কুল থেকেই একজন শিক্ষার্থী নাস্তিকতা শিখে ফেলবে। এখন ধর্ষণ শিখার জন্য জাগাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন নেই। এখন এগুলোর জন্য হাইস্কুলের ছেলে মেয়েরাই যথেষ্ট। প্রিয় পাঠক ! আপনারা যারা আমাদের দেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত বইয়ের সাথে পরিচিত, তারা সহজেই আমার এ দাবির সাথে একমত হতে পারবেন। অথবা যদি আপনি আমার এই দাবির যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে চান তাহলে আপনার প্রতি অনুরোধ রইল, আমাদের পাঠ্য বইগুলো মনোযোগ সহকারে পড়ে চিন্তা-ভাবনা করে দেখার । বন্ধুবর শুয়াইব ভাই একটি প্রতিষ্ঠানে নবম শ্রেণির সাধারণ বিজ্ঞানের পাঠ দিতে গিয়ে আমাকে বইটি পড়ে দেখার অনুরোধ করলেন। একটি বই নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। পড়লাম, পড়ে অনেক কিছু বুঝলাম। আমাদের কোমলমনা ভবিষ্যত প্রজন্মকে বিপথে নিয়ে যাওয়ার কী সুদূরপ্রসারি পরিকল্পনা। কী সূক্ষ্ম তাদের কর্মধারা। তাদের বুদ্ধিতে কত চতুরতা। ধাপে ধাপে একটি জাতির বিশ্বাস নষ্ট করার কী মোহনীয় চমতকার কৌশল। সবকিছু আমাকে বিমূঢ় করে দিলো। আমি শঙ্কিত হয়ে পড়লাম এদের দূরভিসন্ধি দেখে। পাঠক! বলছিলাম নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ের কথা। ৬২ পৃষ্ঠায় শুরু হয়েছে বইয়ের চতুর্থ পাঠ। শিরোনাম- নবজীবনের সূচনা। আপনার প্রতি অনুরোধ আপনি বইটি পড়–ন, বয়:সন্ধিকাল সম্পর্কে কী লেখা হয়েছে এই অধ্যায়ে। আপনি যদি আশি বছরের বৃদ্ধ হন এবং আপনার পাশে আশি বছরের আরেক বৃদ্ধাকে বসিয়ে এই পাঠগুলো পড়েন। তখন আপনি নিজেই পরীক্ষা করলে দেখতে পারবেন যে, আপনার মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসে কি না ? যদি আশি বছর বয়সে আপনার মধ্যেই পরিবর্তন আসে তাহলে উঠতি বয়সি ছেলে মেয়েরা পাশাপাশি বসে যখন এসব পাঠ পড়বে তাদের অবস্থা কী হবে? আপনি একটু নীরবে চিন্তা করুন! আলোচ্য বইটিতে এরপরের পাঠেই বহু বিতর্কিত বিবর্তনবাদকে প্রমাণের অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। ডারউইনের মতবাদের ওপর সচিত্র বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে বইয়ের ৭৫ পৃষ্টায়। চিত্রে মানুষ যে বানর হতে জন্ম হয়েছে এবং কীভাবে বানরের লেজ অবলুপ্ত হয়েছে তা প্রমাণের ব্যর্থ চেষ্টা চালানো হয়েছে । সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো ডারউইন ১৮৭১ সালে তার বহুল সমালোচিত বই ‘উবপবহঃ ড়ভ সবহ’ (মানুষের আগমণ) গ্রন্থের মাধ্যমে তার মতামত প্রকাশ করার সাথে সাথেই বিশ্বব্যাপী এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা চলতে থাকে। তীব্র সমালোচনার কারণে স্বয়ং ডারউইনই তার মতামত প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন এবং তিনি আড়ালে চলে যান। কিন্তু আমাদের পাঠ্য বইতে ডারউইনবিরোধী মতগুলো স্থান পায়নি। এমনকি, জগতের উতপত্তি কীভাবে হলো এই বিষয়ে সদাসর্বদা আমরা যে দুটি মতবাদ দেখতে পাই- এক. সৃষ্টিতত্ত্ব। দুই. বিবর্তনবাদ। অর্থাত যারা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী, তাদের বিশ্বাস হলো ‘সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক কোনো একটা নির্দিষ্ট সময়ে জগত সৃষ্টি হয়েছে এবং তাঁরই নিয়ন্ত্রণে জগত ধাপে ধাপে এগিয়ে চলছে, পরিবর্তিত হচ্ছে। নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।’ বইটিতে এসবের কোনো কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। আমাদের প্রশ্ন হলো, যদি শিক্ষার্থীদেরকে বর্তমান সময়ে জগত উতপত্তির ওপর বিদ্যমান মতবাদগুলি জানানোই মূল উদ্দেশ্য হয় তাহলে কেন সৃষ্টিতত্ত্বকে এড়িয়ে যাওয়া হল? বিবর্তনবাদবিরোধী দলিল প্রমাণ কেন পেশ করা হলো না? বিবর্তনবাদের স্বপক্ষের যুক্তি ও প্রমাণাদী পেশ করার পরে লেখা হয়েছে যে, ‘ডারউইনের এ দাবি যদিও সর্বাংশে নির্ভুল নয়’ কিন্তু কী কী ভুল রয়েছে তা বলে দেয়া হয়নি । প্রশ্ন হলো, গ্রামের সাধারণ একজন শিক্ষক সে কীভাবে ছাত্রদেরকে এই ভুলগুলো ধরিয়ে দিবেন? তিনি কি পারবেন বিবর্তনবাদের বিপরীতে সৃষ্টিতত্ত্বকে সঠিক ও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে? গ্রামের একজন সাধারণ শিক্ষিত মাস্টার যে অনেক দিন আগে বিজ্ঞানের জঠিল-কঠিন পাঠগুলো পড়ে বইয়ের পাতা সুন্দরভাবে ভাঁজ করে রেখে দিয়েছেন, সে কীভাবে কোমলমনা শিক্ষার্থীদের সচেতন করে তুলবেন? এটা তার জন্য অসম্ভব নয় কী? এটা কী আমাদের দেশের কর্তা ব্যক্তিরা জানেন না? যদি তাদের উদ্দেশ্য তথ্য সম্পর্কে অবগত করানোই হয়, তাহলে ডারউইনের বিরোধী মতগুলোকে কেন প্রকাশ করা হলো না? আর সেগুলো উল্লেখ করার পরে একটি সিদ্ধান্তমূলক বক্তব্য (উপসংহার) আনা হল না কেন? তাহলে কি আমরা বুঝে নিতে পারি যে, তাদের উদ্দেশ্যই হলো বিবর্তনবাদকে প্রমাণ করা এবং আমাদের দেশের সরলমনের শিক্ষার্থীর মস্তিষ্কে এটা প্রতিষ্ঠিত করা? এই প্রবণতার হেতু কী? আমাদের পার্শ¦বর্তী কোনো এক দেশের কিছু বুদ্ধিজীবী স্পেনে গিয়ে সেখানকার কর্তা ব্যক্তিদেরকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনারা কীভাবে স্পেন থেকে মুসলমানদের উতখাত করলেন? জবাব শুনে তারা দেশে ফিরে এসে সেই পরামর্শ মোতাবেক আমল করা শুরু করল। মুসলমানদের মসজিদ মাদরাসায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারল হাজার হাজার মানুষ। এদিকে সংবাদ মাধ্যম এর সঠিক সংখ্যা প্রকাশ না করলেও দায় সারাভাবে যতটুকু প্রকাশ করল তাতেই সারা বিশ্বে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। যাহোক তারা তাদের এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে বাধ্য হলো। আবার স্পেন গেল সেই জ্ঞানপাপীদের দল। তারা তাদের মিশন সম্পর্কে আগাগোড়া জানালো। পরামর্শদাতারাও বুঝতে পারল যে, এই পুরাতন পদ্ধতিতে এখন আর মুসলমানেদের ধ্বংস করা সম্ভব না। তাদের নষ্ট মাথা থেকে বেরিয়ে এল দুষ্টুবুদ্ধি। মুসলমানদেরকে মারতেই হবে। প্রাণে মারা না গেলেও তাদের বুদ্ধিতে মারতে হবে। এই পদ্ধতিতে মারার কৌশল হল, মুসলমানদের শিক্ষা সংস্কৃতিকে পাল্টে দিতে হবে। শিক্ষা-সংস্কৃতি যদি পাল্টে দেয়া যায়, তাহলে ওরা নামমাত্র মুসলমান থাকলেও বিধর্মীদের স্বার্থেই কাজ করবে। তাদের এই পদ্ধতিটা আমাদের মতো নির্বোধ মুসলমানরা অতি সহজেই গ্রহণ করে নিল। টেনে টুনে এম এ পাশ করে রাশিয়া আমেরিকা থেকে পিএইচডি গ্রহণের হিড়িক পড়ে গেল। নাস্তিক্যবাদের অবৈধ সন্তানেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে কলুষিত করতে লাগল। কিন্তু লাভ তেমন হলো না। কারণ, দেশের সামান্য কয়জন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়, তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মোটামোটি পরিণত বয়সের হওয়ার কারণে তাদেরকে এসব নষ্টামী শিখানো এতটা সহজ হয় না। সুতারাং এবার তারা ধাপে ধাপে নিচের ক্লাসগুলোর দিকে হাত বাড়ানো শুরু করল। প্রথমে ইন্টারমিডিয়েট শ্রেণির বইগুলোকে নাস্তিক্যবাদের মোড়কে আচ্ছাদিত করা হলো। এরই ধারাবাহিকতায় এবার ধরা হয়েছে উচ্চবিদ্যালয়ের বইগুলোকে। প্রিয় পাঠক! এইষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন হওয়া দরকার। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা তৈরি করা দরকার। এসব বইয়ের প্রতিটি অধ্যায় প্রতিটি পৃষ্ঠা পড়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো দরকার। এসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানের সঠিক আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য স্কুলভিত্তিক কাজ করা দরকার । স্কুলের শিক্ষকরা যেই ধর্মের অনুসারী-ই হোক না কেন, তাদেরকে সত্য ও সুন্দর বিষয়গুলো বুঝানো দরকার। কারণ, তাদের হাতেই আমাদের আগামী দিনের ভবিষ্যত প্রজন্ম পরিচালিত হচ্ছে। অশান্ত সময়ে মনুষ্যত্বের দাবি এটাই। প্রেমময় আত্মীয়তা-বন্ধনে সামাজিক নিগ্রহ হাসনাইন হাফিজ মার্চ'১৪ আত্মীয়তা একটি প্রেমময় বন্ধন। সমাজ ও জীবন ঘনিষ্ঠ। সবচেয়ে সুখি, সমৃদ্ধ ও মধুর সম্পর্ক। এ সম্পর্ক ব্যক্তি জীবনের পাথেয়। পারিবারিক প্রণয়ের পথ। সামাজিক সফলতার শক্তি। এখানে হিংসা-বিদ্বেষ নয়। সামাজিক অনাচার ও নিপীড়নের মানসিকতা নয়। ষড়যন্ত্র ও আস্থাহীনতাও নয়। পারস্পরিক অংশগ্রহণমূলক উন্নতি-অগ্রগতির বাসনা। সুখ-দুঃখের ভাগাভাগি বাঞ্ছনীয়Ñ হোক না কাছের কিংবা দূরের আত্মীয়। অথচ আমাদের সমাজে হরহামেশাই ব্যতিক্রম চিত্র দেখে থাকি। আত্মীয়-স্বজনকে সম্মান করা হয় অর্থের মাপকাঠিতে। নানা ইস্যুতে দরিদ্র বিচক্ষণ আত্মীয়ের পরিবর্তে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে সচ্ছল মোড়লকে। স্বীয় পিতা ও ভাইয়েরাও উত্তরাধিকার-বঞ্চিত করছে কন্যা বা বোনকে। ঝগড়া ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হচ্ছে সর্বত্র। অনেক আত্মীয় স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে পশুর আচরণ করছে স্বজনদের সঙ্গে। সুযোগ গ্রহণ করছে আত্মীয়তা সম্পর্কের বরাত দিয়ে। জীবন থেকে নেয়া কয়েকটি বাস্তব ঘটনার কথাই বলছিÑ ‘অপরাজেয় বাংলাদেশ’ একটি আন্তর্জাতিক এনজিও সংস্থা। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের অর্থায়নে পরিচালিত। বাংলাদেশে প্রধান কার্যালয় মুহাম্মদপুরের হুমায়ূন রোডে। সংস্থাটির বহুবিধ কর্মকাণ্ড রয়েছে। প্রধান কাজ ছিন্নমূল ও পথশিশুকেন্দ্রিক। তাদেরকে অপরাধের পথ থেকে ফিরিয়ে আনা। একটি উপযোগী আশ্রয় দেয়া। প্রাথমিক পড়ালেখা শেখানো। মানসিক বিকাশ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। কর্মজীবী নিরক্ষর শিশুদের স্বাক্ষরজ্ঞান করাও তাদের লক্ষ্য। নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গড়তেও তারা দৃঢ় প্রত্যয়ী। কারওয়ান বাজারে সংস্থাটির একটি শাখা রয়েছে। এখানে প্রায়ই সেমিনার, মিটিং ও বিভিন্ন আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আমিও মাঝে-মধ্যেই দাওয়াত পাই। আলোচনার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বা এজেন্ডা থাকে। অথবা মৌলিক একটি ইস্যুর ওপর আলোচনা হয়। সেদিনের বিষয় ছিল ‘সমাজের কড়ালগ্রাসে আত্মীয়তা’। প্রথমেই সংস্থাটির একজন উর্ধতন কর্মকতা তার অনুভূতির কথা জানাচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘আজ আমি স্বাবলম্বি। একজন অফিসার। তিনবেলা চারটে খেতে পারছি। পরতে পারছি। মেয়েছেলে নিয়ে সুন্দর জীবনযাপন করছি। কিন্তু ভুলে যাইনি সেদিনের কথা। যেদিন অর্থনৈতিক দৈন্যের কারণেই আমার চাচাতো ভাইয়ের বিয়ের দাওয়াটি পর্যন্ত পাইনি। যদিও আমি বাড়িতে থাকতাম না। থাকতাম পাশের একটি থানায়। ছোটখাটো একটি চাকরি নিয়ে। আমার স্ত্রী-সন্তানের কাছে শুনেছি, আমাকে দাওয়াত দিলেই কী হবে! আমি তো বড় কোনো গিফট দিতে পারবো না। বড় কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন।’ আত্মীয়ের কাছ থেকে এমন নির্মম পরিহাস নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। অনুষ্ঠানের একজন অতিথি তার বক্তৃতায় বলেন, ‘সেই এক অকূল পাথার কাহিনী। পরমাত্মীয় শ্বশুরবাড়ির ঘটনা। আকস্মিক আকাশকুসুম কল্পনা। ঘুরে দাঁড়ালেন খোদ শ্বশুর সাহেবও। মেয়েকে উত্তরাধিকার দিবেন না। ‘যতো পারো খেয়ে যাও’ তার বক্তব্য। সম্পত্তি দেবেন না। একবিন্দুও না। বিষয়টি আমার পছন্দ হলো না। অর্থসম্পদ না দেন সমস্যা নেই। এজন্য কি উত্তরাধিকার অস্বীকার! পুরোটাই পুত্র পাবে, কন্যারা নয়। ইসলামে তো এমন দ্বিমুখী নীতি নেই। উত্তরাধিকারের দাবিতে আমি কাল হলাম। কলঙ্কিনী আমার স্ত্রীও। এরপর কোনোদিন যাইনি শ্বশুরবাড়ি। কেউ ডাকেও নি।’ ইসলামের উজ্জ্বল, সরলপথ ও অমীয় বাণী অস্বীকার করে কীভাবে মানুষ পথভ্রষ্ট হতে পারে, এটি তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রেমময় আত্মীয়তা-বন্ধনে সামাজিক নিগ্রহের একটি বাস্তব চিত্র। এখানে একটি শিশুও আলোচনার সুযোগ পায়। একটি মেয়েশিশু। সে স্টেজে উঠেই কেঁদে ফেলে। এক নির্মম ও করুণ কাহিনী। শোনা যাক তার জবান থেকেই। সে বলে, ‘ছোট্ট থেকেই ট্রেনে চড়ার খুব শখ ছিল। আমারই মামাতো ভাই ট্রেনে চড়ানোর আশ্বাস দেয়। বাড়ির সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমাকে নিয়ে আসে ঢাকায়। আমার বয়স তখন সাত কি আট। সে ঢাকায় একটি গার্মেন্টে কাজ করে। সেখানেই একটি কক্ষে নিয়ে উঠে। রাতে ধর্ষণচেষ্টা করে। তার হাত থেকে বাঁচতে রাতশেষে অজানা গন্তব্যে বেরিয়ে পড়ি। সেই ট্রেনের লাইন ধরেই একটি প্লাটফর্মে পৌঁছি। এখানে কয়েকটি পথশিশুর সঙ্গে পরিচয় হয়। ক্ষুধার জ্বালায় যখন অতিষ্ট হয়ে পড়ি, তখন তারা রুটি-কলা ও খাবার পানির ব্যবস্থা করে। পরে তাদের সঙ্গেই থাকতে থাকি। বিভিন্ন রকম অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ার আগেই অপরাজেয় বাংলাদেশে চলে আসা। এমন লোমহর্ষক ঘটনার পুনরাবৃত্তি চায় না কেউ। কেবল আত্মীয় নয়, সাধারণ মানুষের সঙ্গেও এমন আচরণ অন্যায়। এসব অনভিপ্রেত ঘটনাসহ তাবৎ অপরাধের সঙ্গে ইসলাম আপসহীন। আত্মীয়-স্বজনের অধিকার প্রসঙ্গে তৎপর। তাদের হক আদায়ে জোর তাকিদ দিয়েছে। বুখারি শরিফে এসেছে, সে ব্যক্তি আত্মীয়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহারকারী নয়, যে কেবল প্রতিদানের সমান সদ্ব্যবহার করে। বরং সে-ই সদ্ব্যবহারকারী, যে অপরপক্ষ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও সদ্ব্যবহার অব্যাহত রাখে। পবিত্র কোরআনে সরাসরি নির্দেশসূচক ইরশাদ হয়েছে, ‘আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় কর।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৬) পৃথিবীর মানুষ জন্মসূত্রে ও বৈবাহিক সূত্রে পরস্পরের আত্মীয়। মাতাপিতার হক আদায় করার পর অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্প্রীতি ও সদ্ভাব বজায় রাখা প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য। এখানে পিতামাতার সম্পত্তিতেও সন্তান-সন্ততির হক রয়েছে। যাকে মিরাস বা উত্তরাধিকার বলে। ছেলে সন্তানের মতো মেয়ে সন্তানকেও তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়া জরুরি। উত্তরাধিকার আদায় না করা মারাত্মক গোনাহের কাজ। উত্তরাধিকারীর সঙ্গে অসদাচরণ তো দূরে থাক, তার প্রাপ্য প্রদানের পরও তার সঙ্গে আত্মীয়তা বজায় রাখার তাকিদ রয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘পিতামাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পুরুষদেরও অংশ আছে এবং পিতামাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে নারীদেরও অংশ আছে, তা অল্প হোক বা বেশি। এ অংশ নির্ধারিত।’ (সুরা নিসা : ৭) পাশাপাশি এসব বিধান লঙ্ঘন করলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। শাস্তি অত্যন্ত ভয়াবহ। যার পরিণাম জাহান্নাম। যদিও মিরাস আদায়কারী ও আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষাকারীর জন্য রয়েছে সুসংবাদ ও সফলতা। ইরশাদ হয়েছে, ‘এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। কেউ আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করলে আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, যেখানে তারা স্থায়ী হবেÑএটা মহাসাফল্য। আর কেউ আল্লাহ ও তার রাসুলের অবাধ্যতা বা সীমালঙ্ঘন করলে তিনি তাকে নিক্ষেপ করবেন আগুনে। যেখানে সে চিরকাল থাকবে। তার জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।’ (সুরা নিসা : ১৩, ১৪) আত্মীয়-স্বজন অভাবগ্রস্ত হলে সামর্থ্য অনুযায়ী তাদেরকে আর্থিক সাহায্য-সহযোগিতাও করতে হবে। পবিত্র কোরআনে আত্মীয়-স্বজনদের জন্য অর্থসম্পদ ব্যয় করার নির্দেশনা রয়েছে। হজরত ইমাম আবু হানিফা রহ. বলেন, বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধÑ এমন আত্মীয় যদি নারী বা শিশু হয়। নিঃস্ব কিংবা উপার্জনে অক্ষম হয়। এমনিভাবে সে যদি বিকলাঙ্গ বা অন্ধ হয়। কিংবা জীবনধারণের মতো ধন-সম্পদের অধিকারী না হয়, তবে তার ভরণপোষণ করা সক্ষম আত্মীয়দের ওপর বাধ্যতামূলক। রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, ‘সদকার মাল সাধারণ গরিব-মিসকিনকে দান করলে তো শুধু সদকার সওয়াবই পাওয়া যায়, অথচ তা যদি নিজের রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজনকে দান করা হয়, তাহলে তাতে দুটি সওয়াব পাওয়া যায়। একটি সদকার সওয়াব, অন্যটি আত্মীয়তার হক আদায় করার সওয়াব।’ (তিরমিজি ও নাসায়ি) অনেকে আত্মীয়-স্বজন দেখলেই নাক ছিটকায়। অতিথি এলে আনন্দ ও বন্ধুত্ব প্রকাশের পরিবর্তে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে। অথচ আত্মীয় এলে অভ্যর্থনাসহ কুশল বিনিময়ের মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানাতে হয়। কখনই অবহেলা, অন্যমনষ্কতা ও বিষণœতা প্রকাশ করা উচিত নয়। বুখারি ও মুসলিমের ভাষ্যমতে, মহানবী সা. বলেন, যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে তারা যেন তাদের অতিথির আতিথেয়তা যথোপযুক্তভাবে সম্পন্ন করে। মহানবী সা. আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি এ বিষয়টি পছন্দ করে যে, তার রিজিকে প্রশস্ততা আসুক এবং তার হায়াত দীর্ঘ হোক সে যেন নিজের আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে।’ (বুখারি ও মুসলিম) আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা মহাপাপ। এটি মুসলিম সমাজের জন্য চরম ক্ষতিকর। এ সম্পর্ক ছিন্ন করে পার্থিব সুখ অর্জন করাও সম্ভব নয়, পরকালীনও নয়। বরং পরকালীন কঠোর শাস্তিবিধানের হুশিয়ারি রয়েছে। রাসুল সা. ইরশাদ করেন, ‘আত্মীয়তা সম্পর্ক ছিন্নকারী বেহেশতে প্রবেশ করবে না।’ (মুসলিম) হাদিসে কুদসিতে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি আত্মীয়তা বজায় রাখবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে নৈকট্য দান করবেন এবং যে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে ছিন্ন করবেন।’ (বুখারি) আত্মীয়-স্বজনের হক পবিত্র কোরআন-সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। এ হক আদায়ের পাশাপাশি তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা। সুসম্পর্ক বজায় রাখা। সুখে-দুঃখে পাশে থাকা। হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় তাদের সঙ্গে মিলিত হওয়া। মনে কোনো রকম কুটিলতা-জটিলতা না রেখে প্রেমময় সম্পর্কের নজির স্থাপন করা ঈমানের দাবি। আলেমদের মাতৃভাষা চর্চা প্রত্যাশার দিগন্তে বর্ণিল ইশারা জহির উদ্দিন বাবর ‘আজ রক্তের জিহাদের যত না প্রয়োজন চিন্তার জিহাদের প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশি। ধারালো তলোয়ারের যত প্রয়োজন শাণিত কলমের প্রয়োজন আরো বেশি। কেননা নবুওয়াতে মুহাম্মদির ওপর আজ তলোয়ারের হামলা যতটা না চলছে, তার চেয়ে অধিক চলছে যুক্তি-প্রমাণের হামলা, চিন্তা ও দর্শনের মামলা।’ উপরোক্ত কথাগুলো বলেছেন বিংশ শতাব্দীর মহান সংস্কারক সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি রহ.। আল্লাহ তায়ালা এই মহান সাধককে জান্নাতে উচ্চ মাকাম দান করুন। তাঁর হৃদয়কাড়া আকুতি ও উদাত্ত আহ্বানে উদ্বুদ্ধ হয়েই বাংলার আলেমরা ব্যাপকভাবে কলম হাতে তুলে নেন। ১৯৮৪ এবং ১৯৯৪ সালে দু’বার তিনি বাংলাদেশে সফর করেন। বাংলাদেশের শিল্প ও সাহিত্যাঙ্গনে ওলামায়ে কেরামের নিদারুণ অনুপস্থিতি তাঁকে যুগপৎ ব্যথিত ও বিস্মিত করে। এজন্য দু’বারই তিনি বিভিন্ন স্থানে আলেমদের প্রতি কলম হাতে তুলে নেয়ার উদাত্ত আহ্বান জানান। যুগের মুজাদ্দিদ এই মহামনীষীর হৃদয়ের আকুতি ও আহ্বান এদেশের আলেমদের চেতনাকাশে নতুন দিগন্তের সূচনা করে। অলসতা ও নিস্পৃহতার চাদরে মুড়ি দিয়ে সুখনিদ্রায় বিভোর আলেম সমাজ জাগতে শুরু করে। নতুন দিনের নতুন জিহাদে শরিক হওয়ার স্পৃহা নিয়ে কলম হাতে তুলে নেয়। ক্ষীণ কালির দুর্বল খসখসে কাগজে আঁকাআঁকির মাধ্যমে শূন্য থেকে শুরু হয় তাদের পথচলা। প্রায় দুই দশকের বিক্ষিপ্ত প্রয়াসের ফলে বাংলা সাহিত্যের সুরভিত অঙ্গনে আলেম সমাজের অংশিদারত্ব আজ সিকি ভাগ বলা যায়। এটা আশানুরূপ না হলেও অন্তত হতাশাব্যঞ্জক নয়। সূচিত ধারা অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলা সাহিত্যের নেতৃত্বের ভার আদর্শিক ও বিশ্বাসদীপ্ত ধারার সাহিত্যিকদের হাতে ন্যস্ত হবে এ কথা বলা যায় জোর গলায়। আশার কথা হলো, শিল্প-সাহিত্যের শালীন, আদর্শিক, বাঞ্ছিত ও বিশ্বাসদীপ্ত অঙ্গনটা আজ আর সঙ্কুচিত নয়। দিগন্তপ্রসারী না হলেও এর বিস্তৃতি দৃষ্টিসীমা স্পর্শ করবে। নষ্টামী ও কুরুচিপূর্ণ কথ্য ও লেখ্য সাহিত্যের যেখানে ছড়াছড়ি সেখানে বোধ ও বিশ্বাসের ওপর নির্মিত সাহিত্যের স্থান করে নেয়াটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আমরা যারা আমাদের বিশ্বাস ও আদর্শের কাছে দায়বদ্ধ তারা এ চ্যালেঞ্জে সফল হয়েছি বলতেই হবে। আজ আমাদের অঙ্গনে আমাদের সদর্প পদচারণা চোখে পড়ার মতো। বাংলাবাজার ও বায়তুল মোকাররমকেন্দ্রিক ইসলামি বইয়ের বিশাল যে বাজার গড়ে উঠেছে তা মানের বিচারে না হলেও সংখ্যায় কোনোক্রমেই প্রচলিত ধারার তথাকথিত বস্তুবাদী সাহিত্যের চেয়ে কম নয়। ইসলামি প্রকাশনা জগতে প্রতিদিনই কিছু না কিছু সংযুক্তি ঘটছে, বিশ্বাসীদের পঠন-পাঠনের উপকরণে সমৃদ্ধি হচ্ছে। এর অধিকাংশই অনুবাদ ও সংকলননির্ভর হলেও এটাকে একদম তুচ্ছজ্ঞান করার সুযোগ নেই। সমৃদ্ধ ও সহজলভ্য কোনো ভাষার রূপান্তর যদি মানুষের প্রয়োজন পূরণে সহায়ক হয় তবে তাতে দোষের কী? বিষয়টিকে আমরা ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দৃষ্টিকোনেই বিশ্লেষণ করতে পারি। তবে আমাদের অতীত বিবেচনা করলে এর ইতিবাচক বিশ্লেষণই যুক্তিযুক্ত মনে হবে। কারণ এক যুগ আগেও ইসলামি প্রকাশনার এই বিশাল বাজার ও ব্যাপক চাহিদার কথা কল্পনা করা যেতো না। সংখ্যায় যেহেতু আমরা একটি সন্তোষজনক পর্যায়ে উপনীত হতে পেরেছি, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস মানের বিচারেও অদূর ভবিষ্যতে আমরা কাক্সিক্ষত মানে উন্নীত হতে পারবো ইনশাআল্লাহ। হতাশার অদৃশ্য চাদরে আচ্ছাদিত না থেকে এখন আমাদের উচিত প্রত্যাশার দিগন্তবিস্তৃত স্বপ্নিল ভুবনে বিচরণ করা। সাম্প্রতিক সময়ে বাঞ্ছিত ও আদর্শিক ধারার প্রকাশনার ব্যাপ্তির পাশাপাশি মিডিয়াক্ষেত্রেও এর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে। বিশেষত প্রিন্ট মিডিয়ায় ইসলামি ধারার একটি বলয় গড়ে উঠেছে। দৈনিক না হলেও সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক মিলিয়ে অর্ধশতাধিক ম্যাগাজিন-সাময়িকী নিয়মিত আদর্শ ও বিশ্বাসের বিভা ছড়িয়ে যাচ্ছে। তরুণদের একটি শ্রেণি শিল্প-সাহিত্যের বিস্তৃত অঙ্গনে কিছুটা জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছে। উপযুক্ত পরিচর্যা ও নির্দেশনা পেলে তরুণরা আগামীতে মাতৃভাষা চর্চায় অতীতের দায়বোধ থেকে আলেম সমাজকে কিছুটা হলেও মুক্ত করতে পারবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির চলমান ধারাটি বিশ্বাস ও আদর্শের ধারকদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়াটা কোনোক্রমেই উচিত হয়নি। সময়ের কার্যকর ও অতিপ্রভাবক এ অঙ্গনটি শালীন ও বাঞ্ছিত ধারার নিয়ন্ত্রণে থাকলে আমাদের এভাবে আদর্শিক দীনতায় ভুগতে হতো না। বাম, ব্রাক্ষ্মণ ও স্যেকুলারবাদীরা এ অঙ্গনটিকেই বিশ্বাস ও আদর্শের ধারক-বাহকদের নাজেহাল করার প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ অঙ্গনটির নিয়ন্ত্রণভার একতরফাভাবে তাদের হাতে। তারা যেভাবে খুশি সেভাবেই এ অস্ত্রটিকে ব্যবহার করছে। এর জবাব দেয়ার মতো উপযুক্ত অস্ত্র ও কৌশল আজ আমাদের হাতে নেই। আমরা শুধুই আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছি, প্রতিঘাতের কোনো শক্তি আমাদের নেই। আজ সময় এসেছে আমাদের এ দিকটির প্রতি নজর দেয়ার। আমাদের চেতনা ও বোধের চৈতন্য ফিরে আনার। বিবেকের দায়বোধ ও স্পৃহার জ্বলন সৃষ্টি করার। যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হওয়ার আগেই যেমন সৈন্যদলকে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও উপায়-উপকরণে সমৃদ্ধ হতে হয়, তেমনি আমাদের এ ময়দানের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব ছিনিয়ে আনতে হলে প্রয়োজন বলিষ্ঠ অস্ত্র ও নিপুণ কৌশল অবলম্বন। প্রতিযোগিতাময় এই বিশ্বে যেকোনো ক্ষেত্রে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে যেনতেন প্রস্তুতি কার্যকর নয়। শিল্প-সাহিত্যের বিস্তৃত এই ভুবনেও নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত ও প্রভাবক করতে হলে প্রয়োজন বলিষ্ঠ যোগ্যতা অর্জন করা। যথাযথ যোগ্যতাসমৃদ্ধ হয়ে এ ময়দানে অবতীর্ণ হলে ব্যর্থতা বা পরাজয়ের কোনো কারণ নেই। এখন প্রয়োজন এমন কিছু দক্ষ যোদ্ধার যারা এ ময়দানে সিপাহসালারের দায়িত্ব পালন করবেন। ইদানীং এ দায়িত্ব পালনের মতো বেশ কিছু যোদ্ধার কৌশল ও দক্ষতা আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ। আশার এই কিঞ্চিত ঝিলিকের ওপর ভর করেই আমরা আজ প্রত্যয়দীপ্ত অঙ্গীকারে আবদ্ধ হতে পারিএ যুদ্ধে আমাদের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। ........................ ........................ ..................... .............................. ইসলামের পাঠশালা বিশ্বইজতেমা আমিন ইকবাল বিশ্বইজতেমা লাখো মুমিনের মিলনমেলা। দ্বীন ইসলামের পাঠশালা। তিনদিনের মুমিন সংসার। তাবলিগ জামাতের বিশ্বইজতেমায় নবীপ্রেমিক মুসল্লিরা অংশ নেয় দলে দলে। মাথায় গাট্টি, হাতে পোটলা, মুখে জিকির, গন্তব্য টঙ্গীর তুরাগ তীর। কনকনে শীত উপেক্ষা করে অবস্থান করে ১৬০ একর এলাকাজুড়ে বিস্তৃর্ণ খোলা মাঠে টানানো শামিয়ানার নিচে। তাদের পদভারে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো টঙ্গী এলাকা। আকাশ-বাতাসে বয়ে চলে শান্তির সুবাতাস। চারদিকে গুঞ্জরিত হয় লা ইলাহা ইল্লাল্লাহর জয়ধ্বনী। দ্বীন ইসলামের পাঠশালায় প্রতি বছর অংশ নেয় দেশ-বিদেশের নানা পেশার লাখো মানুষ। এখানে ধনী-গরিবের ভেদাভেদ নেই। সাদা-কালোর পার্থক্য নেই। নেই পারস্পরিক কোনো দ্বন্দ্ব-বিবাদও। ইজতেমার মাঠে সবাই এক কাতারে নামাজ পড়ে। একসঙ্গে বসে খানা খায়। রাতে ঘুমায় একই বিছানায়। যেন একটি পরিবার থেকে আসা লাখো সদস্য। টঙ্গীর এ ইজতেমা মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় বৃহত্তর জমায়েত। হজের পর মুসলমানদের বড় জামায়েত এটিই। প্রতি বছরের মতো এবারের বিশ্ব ইজতেমার চিত্রও ছিলো উৎসব মুখর। দেশের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লির সঙ্গে সৌদি আরব, পাকিস্তান, ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, অস্ট্রোলিয়া, আমেরিকা, কুয়েত, ইন্দোনেশিয়াসহ ৭৯ টি দেশের প্রায় ২২ হাজার বিদেশি মুসলমান অংশ নিয়েছে ৪৯ তম বিশ্বইজতেমায়। প্রথম পর্বের ইজতেমা ২৪ জানুয়ারি শুক্রবার বাদ ফজর আম বয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ইজতেমা শুরু হয় ২৩ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার আসরের পর থেকে। মুসল্লিরা আসতে শুরু করে বুধবার বিকাল থেকেই। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা নামার আগেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় বিশ্বইজতেমার বিশাল মাঠ। যারা বযান করেছেন বিশ্ব ইজতেমার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তিনদিনের বয়ান। মুরব্বিদের বয়ান শুনতেই প্রতি বছর জড়ো হয় লাখো ধর্মপ্রাণ মানুষ। তিনদিনের বয়ানে আলোচনা হয় দাওয়াত ও তাবলিগের মেহনত, ইজতেমার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যসহ দ্বীন ইসলামের নানা বিষয়। তাই ইজতেমায় আসা মুসল্লিরা গুরুত্ব দিয়ে শোনেন সকাল-বিকালের আম-খাস বয়ানগুলো। এবারের ইজতেমায় প্রতিদিন ফজর এবং মাগরিবের পর হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ আম বয়ান। এ দুই সময়ের বয়ান হয়েছে উর্দু ভাষায়। বাংলায় অনুবাদও হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে। প্রথম পর্বে শুক্রবার বাদ ফজর বয়ান করেন গুজরাটের মাওলানা ইসমাঈল। বাদ মাগরিব ভারতের মাওলানা সাদ। জুমার নামাজের পর বয়ান করেন কাকরাইলের মুরব্বি মুহাম্মদ হুসাইন। আসর নামাজ শেষে বয়ান করেন দিল্লির মাওলানা যোবায়েরুল হাসান। শনিবার বাদ ফজর বয়ান করেন পাকিস্তানের হাজি আব্দুল ওয়াহহাব। সকাল দশটায় আলেমদের উদ্দেশে খাস বয়ান করেন দিল্লির মাওলানা আহমদ লাট। ছাত্রদের উদ্দেশে বিশেষ বয়ান করেন ভারতের ভাই মুহাম্মদ জামশেদ। তিনি শনিবার জোহরের পরও বয়ান করেন। আসর নামাজ শেষে ইসলামে বিয়ের বিধান নিয়ে আলোচনা করেন দিল্লির মাওলানা যোবায়েরুল হাসান। বাদ মাগরিব বয়ান করেন মাওলানা আহমদ লাট। রোববার বাদ ফজর আম বয়ান করেন বাংলাদেশের মাওলানা জমিরুদ্দীন। আর মোনাজাত পূর্ব হেদায়তি বয়ান করেন ভারতের মাওলানা সাদ। বৃহত্তর জুমার জামাত শুক্রবার সকাল থেকেই জনতার স্রোত নামে ইজতেমার পথ-ঘাটে। বৃহত্তর জামাতে জুমার নামাজ আদায় করতে মুসল্লিদের ঢল নামে টঙ্গীর তুরাগ তীরে। দুপুর বারটার মধ্যে টঙ্গীর আশপাশের সবকটি রাস্তা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। মুসল্লিদের স্রোতে বন্ধ হয়ে যায় ঢাকা-মোমেনশাহী মহাসড়ক। জায়নামাজ বিছিয়ে মুসল্লিরা মহাসড়কেই বসে পড়েন। পশ্চিমে আশুলিয়া ব্রিজ থেকে পূর্বে পুবাইল ব্রিজ, দক্ষিণে শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে উত্তরের চৌরাস্তা পর্যন্ত লোক সমাগমের মধ্য দিয়ে পালিত হয় স্মরণ কালের বৃহত্তর জুমার জামাত। জুমার নামাজের ইমামতি করেন কাকরাইল মসজিদের খতিব মাওলানা যুবায়ের। ১০৮ টি সুন্নতি বিয়ে যৌতুকমুক্ত সুন্নত তরিকায় বিয়ে! তা যদি হয় ইজতেমার মাঠে তাহলেতো কথাই নাই। লাখো মানুষের উপস্থিতিতে আনন্দঘন এমন ব্যতিক্রমী বিয়ের অনুষ্ঠান ইজতেমার অন্যতম আকর্ষণ। প্রতি বছর ইজতেমার দ্বিতীয় দিন আসরের নামাজের পর অনুষ্ঠিত হয় যৌতুকমুক্ত গণবিয়ে। এ বিয়ে ইতোমধ্যেই মানুষের মাঝে দারুণ প্রভাব ফেলেছে। প্রতি বছরই বাড়ছে এতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা। আলোচিত এ অনুষ্ঠানটি এবারও অনুষ্ঠিত হয়েছে শনিবার বাদ আসর। প্রথম পর্বে বিয়ে পড়ান তাবলিগের শীর্ষ মুরব্বি, দিল্লির মাওলানা যোবায়েরুল হাসান। ১০৮টি সুন্নতি বিয়ে শেষে মঞ্চের আশ পাশে খেজুর ছিটানো হয়। আখেরি মুনাজাত বিশ্বইজতেমার মূল আকর্ষণ আখেরি মোনাজাত। আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে পারা নিজের জন্য সৌভাগ্যময় মনে করেন ইজতেমায় আগত মুসল্লিসহ ঢাকা-গাজিপুর এবং এর আশপাশের লোকজন। তাইতো রবিবার ভোর থেকেই দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। কাক ডাকা ভোরেই টঙ্গীর পথে বের হয় মানুষের বিশাল মিছিল। মিছিলের অভিমুখ ইজতেমার মাঠ। আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে আশুলিয়া, বিমানবন্দর, পুবাইল, চৌরাস্তাসহ সব দিক থেকে ছোটে আসে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। সকাল নয়টার পর আর তিল ধারনেরই ঠাঁই থাকে না টঙ্গী-আব্দুল্লাহপুর এলাকায়। জায়নামাজ বা পেপার বিছিয়ে পিচ ঢালা রাস্তায় কিংবা রেল লাইনে বসে পড়েন তারা। অনেকে অবস্থান নেন মিল-কারখানা, বাড়ি-ঘরের ছাদেও। আখেরি মোনাজাতে শামিল হয় নানা পেশার মানুষ। কৃষক, মজুর, চাকুরে, ব্যবসায়ী সবাই শরিক হয় এ মোনাজাতে। শরিক হয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গও। এবারের ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাতে অর্ধকোটিরও বেশি মানুষ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর মোনাজাত শুরু হয় দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে। তাশকিল কামরায় বিশেষভাবে তৈরি মোনাজাত মঞ্চ থেকে আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন বিশ্ব তাবলিগ জামাতের সর্বোচ্চ শুরার অন্যতম সদস্য দিল্লি জামে মসজিদের খতিব মাওলানা যোবায়েরুল হাসান। ১ টা ১৬ মিনিট পর্যন্ত প্রায় বিশ মিনিটের মোনাজাতে তিনি উম্মতে মুহাম্মাদির মাগফিরাত, দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ, আখেরাতে মুক্তিলাভ, নবী ও সত্যবাদীদের সঙ্গে হাশর-নশর ও জান্নাত কামনা করেন। মোনাজাতে বিশ্ব ইজতেমা কবুল, দুনিয়া ও আখেরাতে যাবতীয় অকল্যাণ থেকে রক্ষাসহ সার্বিক কল্যাণ কামনা করা হয়। এ সময় মুসল্লিরা চোখের অশ্র“ ধরে রাখতে পারেননি। নিজের অজান্তেই চোখ বেয়ে নেমে আসে জলধারা। মুসল্লিদের বুকফাঁটা কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে টঙ্গীর আকাশ বাতাস। আমিন আমিন ধ্বনিতে প্রাণের সঞ্চার হয় মোনাজাতে শরিক হওয়া লাখো মুসল্লির। পরিশিষ্ট তাবলিগ জামাতের বিশ্বইজতেমা যুগ যুগ ধরে মুসলিম উম্মাহর জন্য শিক্ষণীয় বৈশিষ্ট্যকে লালন করে আসছে। আল্লাহ উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলেছেন। ইজতেমায় সে বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। ইসলামের আদর্শ সামনে রেখে এখানে কোনো মুসলমানকে ছোট করে দেখা হয় না। আল্লাহর কাছে প্রত্যেক মুসলমানের মূল্য আছে- ইজতেমায় এটা ভালোভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। মুসলমানদের কোনো ভাগে বিভক্ত করা হয় না। এক মুসলমান যেন আরেক মুসলমানকে সম্মান করে সে জন্য জোর তাগিদ দেয়া হয়। কোনো মাজহাবের মুসলমানকে খাটো করা হয় না। বরং সবাইকে ঈমান ও আমলের মেহনতের প্রতি আহ্বান করা হয়। তারা একই প্লেটে খাবার খান, একইসঙ্গে ঘুমান। কারও মধ্যে কোনো হিংসা, ঘৃণা থাকে না। সাদা-কালোর পার্থক্য থাকে না। সবার মধ্যে তৈরি হয় ভ্রাতৃত্ববোধ। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী সব মানুষের চাওয়া-পাওয়া এক হয়ে যায় বিশ্বইজতেমায়। আত্মার অস্থিরতায় অশান্ত পৃথিবী : মুক্তির পথ তামীম রায়হান আত্মা এবং শরীর এ দুয়ের সমন্বয়ে আমাদের অস্তিত্ব। দেহ ছাড়া আত্মার অস্তিত্ব এ পৃথিবীতে যেমন অকল্পনীয়, আত্মা ছাড়া শরীরও মূল্যহীন নিথর দেহ। মায়ের পেট থেকে এ দুয়ের যোগফল হিসেবেই আমাদের আগমন। তারপর ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা। আমাদের এ মাটির শরীর হৃষ্টপুষ্ট হয় মাটি থেকে উৎপন্ন খাবার খেয়ে খেয়ে। চাল ডাল থেকে নিয়ে ফাস্টফুডের পিৎজা বার্গার, সবই তো এ মাটি থেকে নির্গত বন্তুর বহুরূপ। সেসবের মাধ্যমেই আমাদের এ শরীর সামান্য পুচকে থেকে কত বড় হচ্ছে। আমাদের এ দেহ বা আত্মার বহিরাবরণ যেভাবে বাড়ছে, এর সুস্থতা ও বেড়ে ওঠা নিয়ে আমরা যেভাবে নানা রকম কলাকৌশল নিয়ে যতœবান, এর ব্যস্ততায় আমরা ভুলেই বসে আছি আমাদের অস্তিত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের কথা, সেটিই হচ্ছে আত্মা। শুধুই কি গুরুত্বপূর্ণ, আত্মা ছাড়া তো আমাদের অস্তিত্বই নেই। প্রাণপাখি উড়ে গেলেই তো আমরা মরহুম, কাছের স্বজন বন্ধুরাও তখন কাছে ভিড়তে ভয় পায়। এ আত্মা কিংবা রুহ বা প্রাণ- যাই বলি না কেন, এটি আল্লাহ পাকের দান। আল্লাহ পাকের এক অলংঘনীয় বিধান। তার ইশারায় এ প্রাণের সব স্পন্দন। আমরা যতই ভুলে থাকি না কেন, এ আত্মারও কিন্তু রয়েছে কিছু চাহিদা ও প্রয়োজন। শরীরের সবগুলো অঙ্গÑপ্রত্যঙ্গের মহারাজা এ আত্মাও কিন্তু ক্ষুধার্ত হয়, যদিও আমরা কোনোদিন তার আকুতি শোনার চেষ্টা করিনি, অনুধাবন করিনি এর মৌলিক প্রয়োজনের কথা। বুখারি ও মুসলিম শরিফে রাসুল সা. তাই বলেছেন, এ আত্মা যদি ঠিক থাকে তবে পুরো শরীর ও কাজকর্ম সঠিক, আর যদি তা ব্যধিগ্রস্ত হয় তবে গোটা শরীর এবং এর কাজকর্ম নষ্ট হয়ে পড়ে। মাটির তৈরি এ শরীরের যাবতীয় ক্ষুধা যেমনিভাবে মাটির ফসল দিয়েই নিবারণ হচ্ছে, এর রোগ বালাইও মাটির তৈরি নানাবিধ বস্তু থেকে সারছে, তেমনিভাবে উর্ধ্বজগত থেকে আগত বিরাজমান আমাদের আত্মার সব চাহিদা ও প্রয়োজন এবং তার সুস্থতা ও অসুস্থতা নিবারণের জন্য প্রয়োজন ঐ আসমানি আয়োজন। কী সেই আসমানি আয়োজন? আকাশ থেকে যে মহান স্রষ্টা এ বিশ্ব চরাচর নিয়ন্ত্রণ করছেন, তার দেওয়া ফরমান ও বিধানের নাম ‘আসমানি আয়োজন’। আমাদের দ্বীন ইসলাম, পবিত্র কুরআন, রাসুলের ফরমান এবং সব ঐশী বিধান এ আয়োজনের অন্তর্ভুক্ত। আমাদের আত্মা কিংবা প্রাণের আসল আহার সেটিই। যে সত্ত্বা এ আত্মার মহান স্রষ্টা, তার দেওয়া বিধানই এ আত্মার প্রধান বেঁচে থাকার অবলম্বন। আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনে এগারো বার পরপর কসম খেয়ে বলেছেন, আত্মাকে যে পরিশুদ্ধ করলো সেই একমাত্র সফল হলো। আর যে তা থেকে বঞ্চিত থাকলো সেই দুর্ভাগা হলো। এজন্যই ইসলামবিমুখ এবং আল্লাহভোলা আত্মাকে অসুস্থ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে ইসলাম। পরম আল্লাহকে যে চিনেনি সে যেন নিজের আত্মার সাথে জুলম করেছে, কারণ সে তাকে তার প্রাপ্য দেয়নি- নিজের স্রষ্টার সাথে মিলিত হতে দেয়নি তার আত্মাকে। প্রিয় পাঠক, কোনো যুক্তি-তর্ক কিংবা বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দিয়ে নয়, আপনি নিজেই যাচাই করুন। একান্ত অবসরে যখন আপনি দুরাকাত নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হয়ে আসেন, তখনকার সেই অনুভূতি আর সিনেমা হল থেকে বের হওয়ার অনুভূতি কি কখনও সমান? প্রথমটিতে আপনি অনুভব করবেন এক ধরণের তন্ময়তা আর প্রশান্তি, আর পরেরটিতে অনুভূত হবে ‘আরও চাই আরও চাই’ মূলক শুধুই ক্ষুধা আর লোভের অস্থিরতা। একজনকে নিঃস্বার্থ উপকারের প্রশান্তি আর আরেকজনকে ঠকিয়ে বিজয়ী হওয়ার অনুভূতি- এ দুয়ের মাঝে কোনটি আপনার আত্মার জন্য পরম অর্জন- কখনো ভেবে দেখেছেন কি? এভাবেই সারা বছরজুড়ে আমরা ব্যস্ত থাকি এ শরীরের চাহিদা মেটাতে। নিজেদের আহার ও বাসস্থানের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে হন্য হয়ে ছুটি উদয়াস্ত সারাদিন। তবুও মেটে না আমাদের চাহিদা। নিবারিত হয় না আমাদের ক্ষুধা। দিনদিন বাড়ে চাওয়ার তালিকা। আর এসবের নিচে চাপা পড়ে থাকে আত্মার আকুতি, পরম করুণাময়ের সাথে তার মিলিত হওয়ার সুপ্ত বাসনা। মানুষ তো বটেই, সাধারণ পশু পাখিরাও যেমন তার প্রয়োজনীয় আহার না পেলে হিংস্র হয়ে ওঠে, অস্বাভাবিক আচরণ করে, আহত করে আশেপাশের সবাইকে, তেমনিভাবে আমাদের আত্মাও। এইযে বিশ্বময় চারিত্রিক ও নৈতিক এমন অধঃপতন, হেন কোনো অন্যায় নেই যা আজ ঘটছে না এ পৃথিবীতে, এর সবইতো ক্ষুধার্ত আত্মার গোঙানি। অতৃপ্ত আত্মা ধীরে ধীরে তখন রূপ নেয় পশুর মতো প্রবৃত্তির। শুধুই ভোগ আর আমোদ ছাড়া চর্মচোখে আর কিছুই পড়ে না তখন। এভাবে ক্রমশ মানুষের অধঃপতন পশুকেও ছাড়িয়ে যায়। সুরা আরাফের ১৭৯ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন, এরা তো পশুর মতো বরং এর চেয়েও অধম, এরাই উদাসীন। শারীরিক শক্তি কিংবা দেহবলে আমরা অনেক জন্তু জানোয়ারের চেয়ে পিছিয়ে। কেবল এই আত্মার শক্তিতেই আমরা আজ সৃষ্টির সেরা জীব। তাই শারীরিক সুস্থতা নিয়ে যেভাবে আমরা ভাবি, এর চেয়েও বেশি ভাবা প্রয়োজন আত্মার সুস্থতা নিয়ে। যুগ যুগ ধরে তাই বুজুর্গরা আলাদা করেছেন আত্মার রোগগুলোকে। হিংসা, পরনিন্দা, লোভ, অহমিকা এসবের অন্যতম। কোনো কিছু চাষ না হলে বিরান ভূমি যেমন আগাছায় ছেয়ে যায়, আত্মার ভূমিতেও যদি সেভাবে তার চাহিদা মতো আল্লাহর যিকির এবং ইবাদতের চারা রোপিত না থাকে তবে সেখানেও আগাছায় ভরে উঠে। কলুষিত আত্মার কাছে তখন বিরক্তিকর অসহ্য মনে হয় সব ধরণের ন্যায়নীতির কথা। হিংসা হানাহানি ও স্বার্থপরতার এ সময়ে আমাদের আত্মা সত্যিই ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত এবং কলুষিত। হৃদয়ে হৃদয়ে যেদিন জেগে উঠবে আত্মার প্রকৃত পরিচয়, পৃথিবী সেদিন সত্যিই স্বর্গে পরিণত হবে। আমরা কি পারি না নীরব নিরালায় একাকী বসে মাত্র কয়েক মিনিট হলেও চোখ বুজে আত্মার এটুকু আকুতি শুনতে, তার চাহিদা ও প্রকৃত প্রয়োজনের ডাকে সাড়া দিতে? আর তাইতো আল্লাহ পাক সূরা রা’দে বলেছেন, ‘মনে রেখো, একমাত্র আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমেই অর্জিত হবে আত্মার প্রশান্তি।’ হায় অশান্ত বিশ্ববাসী, এবার কি একটু ফিরে তাকাবে তোমার স্রষ্টার দিকে, শান্তির মূলমন্ত্র তিনিই তো বলে দিয়েছেন, আর কে পেরেছে এমন সহজ সমাধান শোনাতে? |