রাহমানী পয়গাম : আপনার শিক্ষা জীবনের সূচনা কোথায়? মাও. পাহাড়পুরী দা.বা. : আমার শিক্ষা জীবনের সূচনা আমাদের গ্রামেই হয়েছে। পাহাড়পুর এমদাদুল উলুম মাদরাসায় আমি প্রথম দিকের জামাতগুলো পড়েছি। রাহমানী পয়গাম : ঢাকায় কবে কিভাবে আসলেন? মাও. পাহাড়পুরী দা.বা. : ঢাকায় এসেছি ১৯৬৭/৬৮ সালের দিকে। লালবাগ জামিয়া কুরআনিয়ায় তখন দেশের শীর্ষস্থানীয় অনেক আলেমে দ্বীন ছিলেন। হযরত হাফেজ্জি হুজুর রহ. শাইখুল হাদীস রহ. সহ আরও অনেকে। আমি আমার আব্বাজানকে বললাম, আমি মিশকাত দাওরা লালবাগে পড়তে চাই। আব্বা তখন আমাকে অনেকগুলো শর্ত দিলেন, বললেন, লালবাগে অনেক মুরুব্বিরা আছেন, হযরত হাফেজ্জি হুজুরকে মুরুব্বি বানিয়ে চলতে হবে। সমস্ত উস্তাদদের সাথে সুসস্পর্ক রেখে চলতে হবে। এ জাতীয় অনেকগুলো শর্ত দিলেন। আমি বললাম ইনশাআল্লাহ আমি পারবো। অনুমতি পেলাম। তার পর আমি ঢাকায় এসে মেশকাত জামাতে ভর্তি হলাম। মেশকাত আউয়াল হযরত শাইখুল হাদীস রহ. এর কাছে পড়লাম। রাহমানী পয়গাম : সেই সময়ের কোনো স্মৃতি কি মনে পড়ে? মাও. পাহাড়পুরী দা.বা. : হুজুরের দরসে আমি নিয়মিত এবারত পড়তাম। মাওলানা রফিকুল ইসলাম বাইতুল মুকাররমের যিনি ইমাম ছিলেন, তিনিও পড়তেন। আমরা দুজন এক সঙ্গেই বসতাম। ক্লাসে প্রথম দ্বিতীয় আমরা দুজনই হতাম। কখনো তিনি আউয়াল হতেন আবার কখনো আমি আউয়াল হতাম, এভাবেই চলতো। শাইখুল হাদীস রহ. চাইতেন দরসে আমিই যেন এবারত পড়ি। হুজুরের চাওয়া হিসেবে আমিই বেশি এবারত পড়তাম। এভাবে মেশকাত জামাতটা কেটেছে। রাহমানী পয়গাম : শাইখুল হাদীস রহ. এর ঘনিষ্ট হওয়ার সুযোগ হলো কী করে? মাও. পাহাড়পুরী দা.বা. : মিশকাত জামাত শেষ করার পর হুজুর আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, রমজানে কোথায় থাকবে? আমি বললাম, রমজানে মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. এর কাছে থাকার ইচ্ছা করেছি। হুজুর বললেন, না যেও না। আগামী বছর দাওরা পড়বে। বুখারি শরিফ পড়বে। আমার কাছেই তো পড়বে। আমি কয়েক বছর যাবত বুখারি পড়াচ্ছি না। রমজানের পর থেকে ইনশাআল্লাহ আবার বুখারি পড়াবো। তুমি রমজানে আমার কাছে থাকো। সদর সাহেব হুজুরের কাছে অন্য সময় থেকো। হুজুরের কথায় আমি রাজি হয়ে গেলাম। ওই বছর রমজানে আর কোথাও গেলাম না, হুজুরের খেদমতে লালবাগ মাদরাসায় থেকে গেলাম। রাহমানী পয়গাম : রমজানের সময়টা কিভাবে কাটলো? মাও. পাহাড়পুরী দা.বা. : হুজুর প্রতিদিন সকালে মাদরাসায় এসে দফতরে বাংলা বুখারির কাজ করতেন। হুজুর আমাকে বললেন তুমি রমজানে কী করবে? আমি বললাম, হুজুর আমাকে যা করতে বলবেন তাই করবো। হুজুর বললেন, আমার বাংলা বুখারির তো প্র“ফ দেখতে হয়, তুমি তো আগামী বছর বুখারি পড়বে, যদি বুখারির প্র“ফ দেখো তাহলে তোমার জন্য উপকার হবে। আমি তোমাকে প্রতিদিন প্র“ফ দেখার জন্য লেখা এনে দিবো। তুমি দেখে আমাকে দিয়ে দিবে। পরের দিন আবার দিবো। সেমতে হুজুর আমাকে বুখারির বঙ্গানুবাদের প্র“ফ দিতেন, আমি সারাদিন রাত দেখে কাজ শেষ করে রাখতাম। পরের দিন হুজুরকে দিয়ে দিতাম, হুজুর তখন আমাকে আরও নতুন কতগুলো দিতেন। এভাবেই আমার বাংলা বুখারির কাজে শরিক হওয়ার সুযোগ হলো। এরই মধ্যে একদিন হুজুর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আর কী করবে? আমি বললাম, আপনি যা করতে বলবেন তাই করবো। তবে আমার ইচ্ছা ছিল, কাশশাফের শরাহ আল ওয়াসসাফ আলাল কাশশাফ, যেটা মাওলানা ইদ্রীস কান্দলভি রহ. এর ছেলে মাওলানা মালেক কান্দলভি সাহেব লিখেছেন- সেটা প্রতিদিন একটু করে মুতালাআ করা। হুজুর শুনে খুব খুশি হলেন, বললেন তুমি তো ছাত্র, মাদরাসা থেকে তোমাকে কিতাব দিবে না। ঠিক আছে কিতাব আমি আমার নামে তুলে তোমাকে দিবো। হুজুর মাদরাসা থেকে কিতাব তুলে আমাকে মুতায়ালার জন্য দিলেন। আমি সারা রমজান সেটা পড়লাম। রমজান শেষ করার পর আবার হুজুরকে দিয়ে দিলাম। বুখারির প্র“ফ দেখলাম, ওয়াসসাফ মুতালাআ করলাম, হুজুরের খেদমতে থাকলাম এভাবে রমজানটা কাটলো। রাহমানী পয়গাম : রমজানে কি পরিমাণ সময় শাইখুল হাদীস রহ. মাদরাসায় থাকতেন? মাও. পাহাড়পুরী দা.বা. : হুজুর সকাল সকাল মাদরাসায় চলে আসতেন। লেখার কাজ করতেন। প্র“ফও দেখতেন। কয়েক ঘণ্টা মাদরাসায় অবস্থান করতেন। রাহমানী পয়গাম : হুজুরের ¯েœহের কোনো উদাহরণ যদি দিতেন? মাও. পাহাড়পুরী দা.বা. : দাওরায়ে হাদিসের বছর প্রায় সময় আমি এবারত পড়তাম। অন্য কেউ এবারত পড়লে তিনি খুশি হতেন না। সবকের মধ্যেই বলতেন, আব্দুল হাই তুমি পড়। অন্য কেউ যদি পড়তো তাহলে সে কিছুক্ষণ পড়ার পর হুজুর বলতেন এবার আব্দুল হাই পড়–ক। হুজুরের কাছে সারা সপ্তাহ বুখারি পড়তাম। আর শুক্রবার আসলে ছাত্রদের নিয়ে লালবাগের বিভিন্ন মসজিদে তাকরার করতাম। হুজুর সারা সপ্তাহ যা পড়াতেন সেগুলো তাকরার করতাম। রাহমানী পয়গাম : তাকরার করতে মসজিদে যাওয়ার কী কারণ ছিল? মাও. পাহাড়পুরী দা.বা. : মসজিদ নিরিবিলি হওয়ার কারণে তাকরার করতে সুবিধা হত। সঙ্গী সাথিদের নিয়ে তাকরার করতাম। লালবাগে এমন মসজিদ কম ছিল যেখানে গিয়ে আমরা তাকরার করিনি। হুজুরের তাকরির ক্লাসে লিখতাম। আর তাকরারে আমি সেগুলো আলোচনা করতাম। এভাবে বছরটা শেষ করলাম। রাহমানী পয়গাম : সেই সময়ের বিশেষ কোনো ঘটনা কি মনে পড়ে? মাও. পাহাড়পুরী দা.বা. : আমি যেই বছর দাওরায়ে হাদিস পড়ছি সেই বছরেরই মাঝমাঝি সময়ে একবার আমার আব্বা ঢাকায় আসলেন। বললেন শাইখুল হাদীস সাহেবকে আমাদের মাদরাসায় দাওয়াত করবো। আব্বা আমাকে নিয়ে হুজুরের আজিমপুরের বাসায় গেলেন। আজিমপুরের বাসায় তখনও বিল্ডিং হয়নি। টিনের ঘর ছিল। আব্বা বাসার ভিতরে খবর পাঠালেন। আমাদের ভিতরে যেতে বলা হলো। আমরা ঘরে প্রবেশ করলাম। হুজুর তখনও বাংলা বুখারির কাজ করছিলেন। আব্বা হুজুরকে পাহাড়পুর মাহফিলের জন্য দাওয়াত দিলেন। হুজুর বললেন আলহামদুলিল্লাহ আমি তো দাওয়াত কবুল করলাম, কিন্তু আমি তো পাহাড়পুর চিনি না আমি যাব কী করে। তখন আব্বা আমাকে দেখিয়ে বললেন, আমার ছেলে আপনাকে নিয়ে যাবে। ও আপনার সাথে যাবে। হুজুর আশ্বস্ত হলেন। মাহফিলের দিন আসলো। হুজুরকে নিয়ে আমি রওনা হলাম। নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত টেক্সি দিয়ে গেলাম। আমরা যখন ফরিদাবাদ মাদরাসার পাশ দিয়ে যাচ্ছি, তখন সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন ফরিদাবাদ মাদরাসার একজন মুহাদ্দিস, তারও পাহাড়পুর যাওয়ার কথা। হুজুর তার প্রতি লক্ষ করেন নি। আমি তাকে দেখেছি, কিন্তু শাইখুল হাদীস সাহেবের সাথে যেহেতু আর কাউকে নিবো না তাই তাকে আমাদের টেক্সিতে উঠালাম না। তিনি এতে মনে কষ্ট পেলেন। আমি নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত হুজুরকে নিয়ে গেলাম। তিনিও নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত অন্য গাড়ি দিয়ে গেলেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত স্টিমার চলতো। ওই ইস্টিমারে আমি হুজুরকে নিয়ে উঠলাম। মাওলানা সাহেবও ওই স্টিমারে গিয়ে উঠলেন। তার মনে একটু কষ্ট, তাই সে হুজুরের সাথে দেখা করলেন না। কাছেও আসলেন না। দূরে গিয়ে বসলেন। ব্যাপারটা শাইখুল হাদীস রহ. এর নজরে পড়লো। হুজুর বললেন, ওই মাওলানা সাহেব সেখানে কেন বসেছে? আমাকে বললেন, ওই যে মাওলানা সাহেব বসা সে আমার ছাত্র, তাকে আমার কাছে নিয়ে আসো। আমি গিয়ে তাকে বললাম, শাইখুল হাদীস সাহেব হুজুর আপনাকে স্মরণ করছেন। তিনি নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলেন। বললেন হুজুর কোথায়? আমি বললাম ওইখানে, তিনি এসে হুজুরের সাথে মুসাফাহা করলেন। বসলেন ও পুরো রাস্তা হুজুরের সাথে আসলেন। দাউদকান্দি পর্যন্ত আমারা পৌঁছলাম। সেখানে পাহাড়পুরের অনেক ছাত্র এসেছিল হুজুরকে নেয়ার জন্য। দাউদকান্দি থেকে পাহাড়পুরে যাতায়াতের ভাল কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তখন রাস্তাও হয় নি। সেখান থেকে রিকশায় যেতে হতো। হুজুরকে একটি রিকশায় বসানো হলো। হুজুর রওনা হলেন। আর আমরা পিছনে পিছনে হাঁটছিলাম। কিছুদূর গিয়ে হুজুর রিকশা থামিয়ে পিছনের দিকে তাকালেন। বললেন আব্দুল হাই! তুমি হেঁটে গেলে আমি আর রিকশায় যাব না। আমি হুজুরকে অনেক করে না করলাম। কিন্তু হুজুরের এক কথা আমার সাথে রিকশায় বসতে হবে আর না হলে আমি নেমে যাব। এক পর্যায়ে হুজুর রিকশা থেকে নেমে যেতে উদ্যত হলেন। তখন আমি বাধ্য হয়ে হুজুরের সাথে রিকশায় উঠলাম। মাদরাসা পর্যন্ত গেলাম। মাহফিলে হুজুর বয়ান করলেন। বয়ান শেষ করে রাত্রে মাদরাসায় ঘুমালেন। সকালে হুজুর ঢাকায় আসবেন। হুজুর আমাকে বললেন, তোমার বাসা কোথায়? আমি বললাম মাদরাসা থেকে একটু দূরে। হুজুর বললেন, তোমার বাসায় আমাকে নিয়ে চল। আমি তোমার বাড়িতে যাব। মাদরাসা থেকে আমাদের বাসায় হেঁটে যেতে হয়। রিকশাও যায় না। হুজুর হেঁটেই আমাদের বাসা পর্যন্ত গেলেন। আম্মা হুজুরের জন্য বিভিন্ন পদের খাবার রান্না করে রেখেছিলেন। হুজুরের সামনে খাবার পরিবেশন করা হলো। খাবার দেখে বললেন, আমি এই খাবার খাব না। শহরের খাবার পোলাও কোরমা আমি খাব না। এগুলোতো সব সময়ই খাওয়া হয়। আমি গ্রামের খাবার খাব। আমি দৌঁড়ে আম্মার কাছে গেলাম। বললাম, আম্মা হুজুরতো এই খানা খাবেন না, হুজুর গ্রামের খানা খেতে চাচ্ছেন। আম্মা বললেন আমি হুজুরের জন্য গ্রামের খানাও তৈরি করে রেখেছি। লাও চিংড়ি মাছ, দেশি চালের ভাত, এগুলোও আম্মা তৈরি করে রেখেছিলেন। হুজুর খুব খুশি হলেন। বললেন, এ গুলিই না আমার খানা। শহরের থেকে আমি গ্রামে আসছি শহরের খানা খাওয়াার জন্য? হুজুর খাবারা খেয়ে আবার মাদরাসায় গেলেন। হুজুর যখন রওনা হবেন তখন আব্বা হুজুরের হাতে গাড়ি ভাড়ার কথা বলে কিছু টাকা দিলেন। হুজুর টাকা গুলো গুণলেন। এরপর বললেন, এত টাকা তো গাড়ির ভাড়া হয় না। এখানে তো অনেক টাকা। এই কথা বলে ভাড়ার জন্য অল্প যে কয় টাকা লাগে সেটা রেখে বাকি টাকা আব্বার হাতে দিয়ে দিলেন। আর বললেন, ভাড়ার জন্য যতটুকু লাগে সেটা আমরা রেখেছি। বাকি টাকা আপনি মাদরাসার কাজে লাগাবেন। আমরা হুজুরকে এগিয়ে দিলাম। এবার হুজুর আমাকে আর আনলেন না। আমাকে বললেন, তুমি তোমার বাবা মার খেদমতে থাকো। আমি একা যাব। তোমাকে আর কষ্ট দিবো না। রাহমানী পয়গাম : পড়া শেষ করে শিক্ষক হিসেবে কোথায় যোগ দিলেন? মাও. পাহাড়পুরী দা.বা. : পড়া শেষ করার পর আমি নূরিয়ার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেই। আমি পড়াতাম বুখারি সানি। আর হুজুর পড়াতেন বুখারি আউয়াল। আমি তখন হুজুরের ক্লাসে নিয়মিত বসতাম। বুখারি সানি পড়িয়ে বুখারি আউয়ালের ঘণ্টায় গিয়ে বসতাম। আমি হুজুরের কাছে এভাবে পাঁচ বার বুখারি পড়েছি। তখনো আমি ছাত্রদের মতো এবারত পড়তাম। রাহমানী পয়গাম : হাফেজ্জি হুজুরের সাথে শাইখুল হাদীসের সম্পর্ক কেমন দেখেছেন? মাও. পাহাড়পুরী দা.বা. : হযরত হাফেজ্জি হুজুর রহ. শাইখুল হাদীস রহ. কে ‘ফখরে বাঙ্গাল’ বলতেন। একদিন আমাকে জিজ্ঞাস করলেন, তোমারা আজিজুল হক সাহেবকে কি বলে ডাকো? শাইখুল হাদীস? আমি বললাম জ্বি। হুজুর বললেন, কিন্তু আমি বলি- ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা আজিজুল হক সাহেব। শাইখুল হাদীস তো শুধুমাত্র যে ব্যক্তি হাদিসের খেদমত করেন তার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশে তার বহুমুখী খেদমত, কুরআনের খেদমত, হাদিসের খেদমত, সিয়াসাতের খেদমত এই সব গুলোর জন্য তাকেই সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত মনে করি। এজন্য তাকে আমি বলি ফখরে বাঙ্গাল। রাহমানী পয়গাম : রাহমানিয়ায় যোগদানের ঘটনা একটু জানতে চাই। মাও. পাহাড়পুরী দা.বা. : সেই ১৯৯৫ সালের কথা। আমি তখন মুহাম্মদপুর জামিয়া মুহাম্মাদিয়ায় পড়াই। সেদিন বাস ধর্মঘট ছিল। আমি পায়ে হেটে কিল্লার মোড়ের দিকে ফিরছিলাম। আর হুজুর আজিমপুর বাসা থেকে যাচ্ছিলেন মুহাম্মদপুর রাহমানিয়ার দিকে। পথে হুজুরের সাথে আমার দেখা হয়ে গেল। সালাম দিলাম। হুজুর জানতে চাইলেন কোথায় যাও? আমি বললাম, কিল্লার মোড় যাব। এবার জানতে চাইলেন কোথায় পড়াও? আমি বললাম আমি তো জামিয়া মুহাম্মাদিয়ায় পড়াই। হুজুর বললেন তোমার আর মুহাম্মাদিয়ায় পড়াতে হবে না। এখন থেকে তুমি রাহমানিয়ায় পড়াবে। আমি বললাম রাহমানিয়ায় এসে কী পড়াবো? হুজুর বললেন বুখারি পড়াবে। বললাম হুজুরের হুকুম পালন করতে আমি খুশি মনে রাজি আছি। যোগ্যতা তো আমার মধ্যে মোটেই নেই। তবে হুজুর দোয়া করলে আল্লাহ তাউফিক দিবেন ইনশাআল্লাহ। এই আমি মুহাম্মাদিয়া থেকে রাহমানিয়ায় এসে পড়লাম। আমাকে বুখারি সানি দেয়া হল। আমি খেদমত শুরু করলাম। আমি ক্লাস করাতাম মাগরিবের পরে, আর হুজুর পড়াতেন দিনে। একদিন মাগরিবের পরে হুজুর মাদরাসায় ছিলেন। আমি তখন ক্লাসে। হুজুর দাওরার রুমের সামনে বারান্দা দিয়ে হাঁটলেন। আমার ক্লাসের নমুনা দেখলেন। তারপর বললেন, আব্দুল হাই! তুমি পড়াতে থাকো। এতমিনানের সাথে পড়াতে থাকো। আমি আজকে তোমার দরস শুনেছি এবং দেখেছি। মাশাআল্লাহ তুমি পড়াও। হুজুর আমাকে সাহস দিলেন, হিম্মত দিলেন। রাহমানী পয়গাম : শাইখুল হাদীসের সাথে কখনো সফর করেছেন? মাও. পাহাড়পুরী দা.বা. : হুজুরের সাথে আমি অনেক সফর করেছি। দেশের বাইরেও গিয়েছি। লন্ডন সফরের কথা মনে পড়ে। ইস্ট লন্ডন মসজিদে হুজুর মাগরিবের পর থেকে এশা পর্যন্ত বয়ান করলেন। হাফেজ্জি হুজুর সেখানে ছিলেন। আমিও ছিলাম। হুজুর হৃদয়গ্রাহী বয়ান করলেন, খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। হুবহু স্মরণ ছিলো, এখন তো স্মরণ শক্তি চলে গেছে তাই আর হুবহু মনে করতে পারি না। সেখান থেকে আরও অনেক জায়গায় গেলেন, বার্মিংহাম গেলেন, সেখানে আর আমি যাই নি। সেখানে সফর করে হুজুর আবার ফিরে আসলেন। এটা ৮৪/৮৫ সালের কথা। রাহমানী পয়গাম : ব্যক্তিগত যোগাযোগ কি সব সময় ছিল? মাও. পাহাড়পুরী দা.বা. : হ্যাঁ ছিল, হুজুর আমার মিরপুরের বাসায় গিয়েছিলেন। আমার দ্বিতীয় মেয়ের বিয়ের সময়। মাওলানা উবায়দুল্লাহ সাহেব এর ছেলে কাতারে থাকতো। সে দেশে আসলো, তাকে বিবাহ করাবে। পয়গাম দিলো। আমি রাজি হলাম। আমি হুজুরকে দাওয়াত দিলাম। মুফতি আমিনী সাহেবও গেলেন। আমার বৈঠকখানায় গিয়ে হুজুর বসলেন। হুজুরই বিবাহ পড়ালেন। রাহমানী পয়গাম : শেষ সাক্ষাত কবে করেছেন? মাও. পাহাড়পুরী দা.বা. : একবার রাহমানিয়ায় গেলাম, দোতলায় হুজুর যে কামরায় থাকতেন, সেখানে গেলাম। গিয়ে বসলাম। হুজুর তখন আমাকে আপনি আপনি করে বলছিলেন। আমি বললাম হুজুর আমাকে আপনি করে বলছেন কেন, আমি তো আপনার ছাত্র। আমাকে তুমি করে বলেন। আমাকে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞাস করলেন। আমাকে বসার জায়গা করে দিলেন। রাহমানী পয়গাম : অনেক কষ্ট করে আমাদেরকে সময় দিলেন, আমাদের জন্য দোয়া করবেন। মাও. পাহাড়পুরী দা.বা. : তোমরাও আমার জন্য দোয়া করবে। এখন তো আমার শেষ সময়। সকালে বিকেলের আশা করি না, বিকেলে সকালের আশা করি না। সকলের কাছে দোয়া চাই।
দিওয়ানুল আজিজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন শাইখুল হাদীস রহ. ছিলেন
নবী প্রেমের কবি
আমিন ইকবাল
মার্চ'১৪ নবী প্রেমের কবি শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.। জীবনের বাঁকে বাঁকে তিনি লিখেছেন অসংখ্য আরবি কবিতা। রাসুলের শানে গেয়েছেন প্রেমময় গান। তার কাসিদাগুচ্ছ প্রিয়তম নবীজি সা. এর শানে প্রেমগাথার এক অনন্য সংযোজন। নবীর তরে সালাম পেশ করতে তিনি আরবি কবিতায় ভিন্ন আবহ সৃষ্টি করেছেন। রচনা করেছেন অসাধারণ সব ছন্দ। তার কবিতা ইশকে রাসুলের খোশবু ছড়ায়। নবী প্রেমের সুবাস বিলায়। তিনি কবিতা লিখেছেন মনের মাধুরী মিশিয়ে। ছন্দের তালে সালাম করেছেন হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে। তার রচিত কাসিদায় স্বতন্ত্র একটা সুর আছে। সুর-ছন্দের তাল-লয়ে তিনি অপূর্ব। রাসুল নিবেদিত শাইখের অমর কাব্যমালা মুমিন হৃদয়ে ইশকের ঢেউ তোলে। নিবিড় পাঠে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ঘুরে আসা যায় নবীজির বাড়ি-ঘর। শায়েখের লেখা কয়েকটি আরবি কবিতার ভাষ্য- ‘১. মদিনার ঘরবাড়ি ও নিদর্শনসমূহ আজও স্মরণ করায় নবীজিকে। যাকে আজ সাধারণ চোখ দেখে না। ২. অন্তরে আমার আনন্দ-ফূর্তি, মদিনার উপত্যকার বাতাস বইছে আমার অন্তরে। ৩. মদিনার বাতাস আমার অন্তর-আত্মা। এই বাতাসেই সে উড়ে পৌঁছবে বেহেশতের বাড়িতে। ৪. মদিনার ধূলাবালি আমার চোখের সুরমা। আমার মাথায় মদিনার মাটি বড় সৌভাগ্যের।’ নবীদেশের বাতাস কতটা শীতল, সজীব, শায়েখের আত্মা তা অনুভব করেছিল। মদিনার বাতাসে জান্নাতে পৌঁছার আকুতিও অসাধারণ। তাছাড়া নবীজির পায়ের ধূলা হবে প্রেমিক চোখের সুরমা। প্রেম প্রকাশের কী অভিনব উপমা! তিনি বিরহের কবিতাও লিখেছেন সময়ে-অসময়ে। তার প্রিয় উস্তাদ মুজাহিদে আজম আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. ও প্রিয়তম স্ত্রীর ইন্তেকালের পর লিখেছেন ভালোবাসা ও বিরহের কবিতা। সেসব কবিতার অধিকাংশই পাঠকের হাত ছোঁয়নি। হারিয়ে গেছে কালের আবর্তে। অবশ্য যেটুকু সংরক্ষিত আছে, তাই বা কম কিসে। ‘দিওয়ানুল আজিজ’ তার লেখা কবিতাগ্রন্থ। গ্রন্থটি ইতোমধ্যেই জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়াসহ দেশের বিভিন্ন মাদরাসার পাঠ্যকিতাব হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। প্রশংসিত হয়েছে দেশ-বিদেশে আরবি সাহিত্যিকদের যথাযথ মূল্যায়নে। কয়েকদিন আগে গ্রন্থটির পাঠ উদ্বোধন হয়েছে ‘আরবি সাহিত্যে শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.’ র্শীষক সেমিনারে। পাঠ উদ্বোধন করেছেন হাফেজ্জি হুজুর রহ. এর বিশিষ্ট খলিফা মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী। ‘শাইখুল হাদীস ফাউন্ডেশন’ আয়োজিত সেমিনারটি ২০ ফেব্র“য়ারি’১৪ মুহাম্মদপুর জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুপুর তিনটা থেকে শুরু হওয়া সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য পেশ করেন, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহফুজুল হক। তিনি বলেন- ‘শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. জীবনের বাঁকে বাঁকে নানা কাজ করে গেছেন। মহান প্রভুর দীন প্রচারে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়িয়েছেন। দেশ-বিদেশ সফর করেছেন। রাজপথে সংগ্রাম করেছেন। এ জন্য জেলেও গিয়েছেন বেশ কয়েক বার। ফলে, লাখো মানুষের হৃদয়ে জায়গা হয়েছে তার। হাজারো মানুষের মুখে মুখে এখন তার বিপ্লবী নাম। তিনি আরবি সাহিত্যে বড় মাপের একজন পণ্ডিত ছিলেন। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার রেখে যাওয়া কর্ম আছে। দীপ্তিময় আদর্শ আছে। সে কর্ম ও আদর্শ জাতির কাছে পৌঁছে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। সে দায়িত্ববোধ থেকেই আজকের এই সেমিনারের আয়োজন। আজকের আয়োজন মূলত দুটি বিষয়কে সামনে রেখে। এক. শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. রচিত আরবি কবিতা গ্রন্থের পাঠ উদ্বোধন। দুই. আরবি সাহিত্যে শাইখুল হদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. শীর্ষক আলোচনা।’ কামরুল হাসান রাহমানী ও গাজী মুহাম্মদ সানাউল্লাহ’র উপস্থাপনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার সহ-সভাপতি শাইখুল হাদিস আল্লামা আশরাফ আলী বলেন, ‘উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ হাদিস বিশারদ শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এক অনন্য ব্যক্তি। তিনি একই সাথে শাইখুল হাদীস, শাইখুত তাফসির, শাইখুল ফিকহ ছিলেন। আরবি সাহিত্যে তিনি একজন বড় মাপের পণ্ডিত ছিলেন। নবী প্রেমের কবি ছিলেন তিনি। জীবনের বাঁকে বাঁকে রচনা করেছেন অসংখ্য আরবি কবিতা। সেসব কবিতা ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে প্রশংসা কুড়িয়েছে। উপমহাদেশে যারা আরবি সাহিত্যচর্চায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন, শাইখুল হাদীস তাদের অন্যতম।’ বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জাববার জাহানাবাদী বলেন- ‘শাইখুল হাদীস রহ. এর সঙ্গে আমার ছাত্র জমানা থেকে পরিচয়। তাকে তখন থেকেই আমি চিনি। কিন্তু আজকের এই সেমিনারে উপস্থিত ওলামায়ে কেরামের কাছ থেকে যা শুনলাম এর অনেক কথাই আমার অজানা। আসলে শায়েখ রহ. এমন এক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন যে, তার জীবন ও কর্ম সম্পর্কে পূর্ণভাবে অবগত হওয়া যে কোনো ব্যক্তির জন্য দুরহ ব্যাপার। তাই শাইখুল হাদীস ফাউন্ডেশনের কাছে আমার আবেদন থাকবে, তারা যেন প্রতি বছর শায়েখের জীবনের উপর আলোচনার ব্যবস্থা করেন। এতে আমরা শায়েখ সম্পর্কে অনেক অজানা কথা জানতে পারবো। তার আদর্শ ধারণ করতে পারবো।’ তিনি আরও বলেন, ‘শায়েখ রহ. রচিত ‘দিওয়ানুল আজিজ’ অত্যন্ত ভালো একটি কাব্যগ্রন্থ। এর সাহিত্য মান খুবই উঁচু। আমি চাই এটি যেন সব মাদরাসায় পড়ানো হয়। বেফাকের নেসাবভুক্ত হয়ে গেলে আলহামদুলিল্লাহ! তা না হলে প্রতিটি মাদরাসায় আমার সুপারিশ থাকবে তারা যেন আলাদা একটি কিতাব হিসেবে দিওয়ানুল আজিজ পড়ান।’ মারকাযুদ্দাওয়া আল ইসলামিয়ার শিক্ষসচিব মাওলানা আব্দুল মালেক বলেন, ‘শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. রচিত বুখারি শরিফের উর্দু ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফজলুল বারি’র ভূমিকা লেখার সুযোগ হয়েছে আমার। কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ানুল আজিজ’ এর আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, এ গ্রন্থ থেকে আমরা রাসুলের প্রতি ভালোবাসার বিরল দৃষ্টান্তের সবক নিতে পারি। তিনি যেভাবে নবীর প্রেমে কবিতা পাঠ করতেন, আমরাও সে রকম আবেগ-দরদ নিয়ে কাসিদা পাঠ করবো।’ দৈনিক ইনকিলাবের সহ-সম্পাদক উবায়দুর রহমান খান নদভী বলেন- ‘দারুল উলুম দেওবন্দের ছাত্রদের যে ধরনের দক্ষতা ও যোগ্যতা পৃথিবীর বুকে প্রমাণিত, তার একটা ঝলক হলো শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর কাব্যগ্রন্থ। তার কাব্য যদি আগে না পড়তাম তাহলে আমি ধারণাও করতে পারতাম না যে, তিনি এত বড় একজন সাহিত্যিক ছিলেন। মসজিদে নববীর ওপরে বর্তমানে যে সমস্ত কবিতা লিখিত রয়েছে তা পূর্বের কবিদের কবিতা। শায়েখের এ সমস্ত কবিতা যদি আরবদের কাছে থাকতো বা পাঠানো যেত তাহলে তারা শায়েখের কবিতা গ্রহণ করতেন। কারণ, তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার মতো উপাদান এতে রয়েছে। তাই শায়েখের কবিতা বাইরের প্রকাশনী থেকে বের করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। সে কাজটি শায়েখ পরিবারের লোকজন করতে পারে। সেজন্য সহযোগিতা করবে শায়েখের প্রতিষ্ঠান- জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া। বাইরের যোগাযোগটা বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সত্যিকারের একজন বড় আলেম মাওলানা আব্দুল মালেক সাহেবের মাধ্যমেও হতে পারে। এটা হলে অব্যশই ভালো হবে।’
মাওলানা মাহফুজুল হকের সভাপতিত্বে সেমিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন, আল মারকাযুল ইসলামির আরবি বিভাগের প্রধান মাওলানা শহীদুল্লাহ ফজলুল বারী, ঢালকানগরের পীর মাওলানা আব্দুল মতিন বিন হুসাইন, শাইখুল হাদীসের বড় জামাতা অধ্যাপক মাওলানা গিয়াসউদ্দিন আহমাদ, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা নোমান আহমাদ, কুষ্টিয়া ইসলামী ইউনিভার্সিটির আল কুরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর ড. এ বি এম হিজবুল্লাহ, বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার শিক্ষাসচিব মুফতি আশরাফুজ্জামান, জামিয়ার মুহাদ্দিস মাওলানা এনামুল হক নূর, এশিয়ান ইউনির্ভাসিটির এসি. প্রফেসর ড. মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ, জাতীয় মসজিদ বাইতুল মোকাররমের সিনিয়র পেশ ইমাম মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ আল বাকী নদভী, ইসলামিক ইউনির্ভাসিটি অব টেকনোলজীর প্রফেসর মুহাম্মদ শাহেদ হারুন, জামিয়া মুহম্মাদিয়ার প্রিন্সিপাল মাওলানা আবুল কালাম, জামিউল উলুম মিরপুর-১৪ এর প্রিন্সিপাল মাওলানা আবুল বাশার, দারুস্সালাম মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম, মাদরাসা আবু বকর এর প্রিন্সিপাল মাওলানা বুরহান উদ্দিনসহ দেশ বরেণ্য উলামায়ে কেরাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, ইসলামি চিন্তাবিদ ও লেখকবৃন্দ। সেমিনারে প্রবন্ধ পাঠ করেন, শাইখুল হাদীস রহ. এর দৌহিত্র, মাওলানা নাঈমুল হক। প্রবন্ধে শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ এর নবীর প্রেমে কাসিদা রচনার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, শাইখুল হাদীস রহ. বাইতুল্লাহ জিয়ারতের প্রথম সফর করেন ১৯৫০ সালে। ১৯৫৪ সালে দ্বিতীয় সফর। এই সফরেই প্রথমবারের মতো তার মনে প্রিয়নবী সা. ও তার পরশধন্য মদিনা মুনাওয়ারার প্রতি হৃদয়ের অব্যক্ত ভালোবাসার কথা কবিতার ছন্দে গাঁথার স্বপ্ন উকি দেয়। তৃতীয়বার তিনি হজে যান ১৯৬০ সালে। তখন জাহাজের সফর। স্বাভাবিকভাবেই সফর ছিল দীর্ঘ সময়ের। সেই সফরের মুবারক সময়টুকু তিনি কাসিদা রচনার কাজে লাগান এবং ‘আততাওয়াচ্ছুল বি মাদহি খাইরির রাসুল’ নামে ৮৩ ছন্দের কাব্যমালা রচনা করেন। সে সফরে দীর্ঘ সময় রওজায়ে আতহারের পাশে দাঁড়িয়ে গভীর প্রেম নিয়ে পাঠ করেন স্বরচিত কবিতামালা। সেসময়ের স্মৃতি শাইখুল হাদীস রহ. এভাবে বর্ণনা করতেন- ‘রওজা পাকের জিয়ারত ও প্রথমবার কাসিদা পাঠের উদ্দেশ্য যে সময় আমি অগ্রসর হই রওজাপাকের সামনে তখন প্রচণ্ড ভিড়। ভিড়ের কারণে দায়িত্বরত পুলিশরা সালাম পেশের পর কাউকে আর দাঁড়াতে দিচ্ছিল না। আমার যেহেতু দীর্ঘ সময় নিয়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছা তাই আমি একটু পেছন দিকে সরে এসে মোয়াজাহা শরিফ (হুজুর সা. এর মুবারক চেহারা অভিমুখী) দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সালাম পেশ করে কাসিদা পাঠ শুরু করি। কাসিদা পড়তে পড়তে আমি তন্ময়, আচমকা একজন পুলিশ ভাই এসে আমার হাত ধরে। সম্বিত ফিরে পেয়ে ঘাবড়ে যাই। এখানেও বুঝি দাঁড়ানোর ভাগ্য আমার জুটবে না। কিন্তু আমার ভাগ্য ছিলো আমার তামান্নার পক্ষে। সে পুলিশ ভাই আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে রওজা পাকের একেবারে কাছে দাঁড় করে দেয়। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে আমি আবার প্রেম বিরহের কবিতা পাঠ শুরু করি। কতক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, মনের অবস্থা কী হয়েছিল, পরে আর সেসব মনে করতে পারিনি। তবে এতটুকু মনে পড়ে, ফিরে আসার সময় আমি যখন কেঁদে জার জার, দায়িত্বরত পুলিশরা তখন অনেকেই আমাকে বেষ্টন করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চোখের পানিতে সৃৃষ্টি হয়েছে এক নুরানী পরিবেশ। পরে যতবার রওজা পাকে সালাম পেশ করতে গিয়েছি ততবারই পূর্ব পরিচিত পুলিশ ভাইদের কেউ দেখলে আমাকে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিত রওজা পাকের একেবারে সন্নিকটে। নবীজির শিয়রে দাঁড়িয়ে নীরবে বলে যেতাম হৃদয়ের সব ব্যথা বেদনার কথা। বেদনার সাথে আনন্দের অপূর্ব মিলন আমাকে বারবার নিয়ে যেত রওজা পাকের আঙ্গিনায়।’ সেমিনারের শুরুতে শায়েখকে নিয়ে লেখা মুহাম্মদ এহসানুল হকের ‘অন্তরঙ্গ আলোকে শাইখুল হাদীস রহ.’ বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। জামিয়া রহামানিয়া আরাবিয়ার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা মামুনুল হকের সঞ্চালনায় মোড়ক উন্মোচন করেন বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার মহাসচিব মাওলানা আব্দুল জাব্বার জাহানাবাদী। সব মিলিয়ে সেদিনের অনুষ্ঠানটি ছিল আনন্দঘন, প্রাণবন্ত ও স্মরণীয় একটি অনুষ্ঠান।