তাবলিগ আন্দোলন জিহাদ-৬
মুহাম্মদ মামুনুল হক
জুন'১৪
পূর্ব প্রকাশের পর
চলমান ধারাবাহিক এই আলোচনায় আমরা ইতোপূর্বে জিহাদ ও তাবলিগ সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করেছি। এপর্যায়ে আন্দোলন কিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।
আন্দোলন বলতে আমরা এখানে ইসলামি আন্দোলনকেই উদ্দেশ্য করছি। ইসলামি আন্দোলন একটি ব্যাপক উদ্দেশ্যবোধক শব্দ হলেও প্রধানত রাজনৈতিক নিরস্ত্র কর্মকান্ডই এর প্রধান পরিচয়। এক কথায় ইসলামি যে সকল লক্ষ্য উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য জিহাদের বিধান আরোপ করেছে, সেই সকল লক্ষ্য উদ্দেশ্য অর্জনের জন্যই জিহাদ করতে না পারার ক্ষেত্রে অস্ত্র ছাড়া যে কর্মকান্ড পরিচালনা করা হয় তাই হলো ইসলামি আন্দোলন। বিষয়টি আরও সুনির্দিষ্টরূপে বলতে চাইলে ইসলামি শরিয়ার কিছু বিধান উল্লেখ করে বলা যেতে পারে। যেমন ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান হলো আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার। তথা বিধিসম্মত উত্তম কাজের আদেধশ প্রদান ও অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করা। এটি কুরআন সুন্নায় বর্ণিথ ইসলামের সুনির্দিষ্ট একটি বিধান। এবং এমন একটি বিধান যা পালন করা শক্তি ও সামর্থের সাথে সংশ্লিষ্ট। নবীজির সেই প্রসিদ্ধ হাদিসটিই এখানে প্রণিধানযোগ্য। নবীজি সা. বলেনেÑ ‘তোমাদের মধ্যে যে বা যারা কোনো অন্যায় দেখবে তা যেন হাত দিয়ে তথা শক্তি বল প্রয়োগ করে পরিবর্তন করে দেয়। যদি তা না পারে তবে যেন মুখের কথার দ্বারা করে। যদি তাও না পারে তবে যেন মনের দ্বারা করে।’ হাতের দ্বারা অর্থাৎ বল প্রয়োগ করে অন্যায় বন্ধ করতে বলা হয়েছে। এটাই সর্বোত্তম ঈমানের লক্ষণ বলে উক্ত হাদিসে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আর সেটা না পারলে মুখের কথার দ্বারা শুধু বুঝাতে বলা হয়নি, শুধু দাওয়াত দেয়ার কথা বলা হয়নি। কেননা দাওয়াত প্রদান ও বুঝানো এগলো হলো নম্্র কোমল পন্থার কাজ। কিন্তু উল্লেখিত হাদিসে বলা হয়েছেÑ যদি বলপ্রয়োগ করার সামর্থ্য না থাকে তবে বলবে। যদি মুখে বলার সামর্থ্যও না থাকে তবে অন্তরের দায়িত্ব। মুখে বলার সামর্থ্য থাকা না থাকার প্রশ্নটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে
প্রতীয়মান হয় যে এটি কেবল দাওয়াত প্রদান নয়; বরং এর চেয়েও আরও একটু বেশি মাত্রার ব্যাপার। আর সেটি হলে প্রতিবাদ। যার মধ্যে এক পর্যায়ের শক্তি প্রয়োগ হয়। কুরআন সুন্নায় বর্ণিত ‘আমর’ ও ‘নাহি’ শব্দ দুটিও তাৎপর্যপূর্ণ নয়। কেননা আমর অর্থ আদেশ করা। অনুরোধ করাকে আমর বলা হয় না। অনুরোধ হলো দাওয়াতের মেজাজ। তদ্রুপ ‘নাহি’ অর্থ নিষেধ, আদেশ নয়। আদেশ আর নিষেধ এক ধরনের বল প্রয়োগের বিষয়। ইসলামে দাওয়াত ও তাবগিল যেমন একটি অতীত গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক কাজ। ‘আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার ও একটি ভিন্ন কাজ। দাওয়াতের মেজাজ হলো অনুরোধ করা। হাতে পায়ে ধরে মানুষকে বাজি কারানো। আর আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকারের মেজাজ হলো বাধ্য করা। এবং শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটানো।
মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় যখন কোনো জালিম শাসক ক্ষমতা আকড়ে থাকে এবং জনসাধারণের উপর জুলুম নির্যাতন চালায়। তখন সেই জুলুমের প্রতিবাদ প্রতিরোধ এবং এক পর্যায়ে শাসক পরিবর্র্তনের চেষ্টা করা- এটিও ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। থাকে বলা হয় ‘খরূজ আল আইম্মাহিল জাওল।’
এভাবে রাষ্টীয় ও সামাজিক পর্যালের নানা অন্যয় অবিচার জুলুম নির্যাতন ইসলাম নিষিদ্ধ গহির্ত কার্যকলাপ ইত্যাদির প্রতিবিধানে যা করণীয় তার সমন্বিত রূপটিই হলো ইসলামি আন্দোলন। বরং এর চেয়েও আরো অগ্রসর হয়ে বলা যায়। পূর্বযুগে তো মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে শাসক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সমস্যা শুরু এতটুকু ছিল যে, তারা জালুম নির্যাতন করতো। কিন্তু জনগণ ও দেশের উপর তারা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা চাপিয়ে দিত না। বিচার ও শাসন ব্যবস্থার মৌলিক বিধি বিধানগুলো ইসলামের আলোকেই পরিচালিত হত। কিন্তু বর্তমানকালে মুসলিম অঞ্চলগুলো উপর সব চেয়ে বড় বিপদ হলো খোদদ্রোহী কুফরি সংবিধান ও শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। বিচার ও শাসন ব্যবস্থা যে থেকে ইসলামকে শুধু নির্বাসনেই পাঠায়নি।
বিরং বহু জায়গায় ইসলামি শাসনতন্ত্র রাষ্টীয় এই অন্যায় যেটা কুফরীর অর্ন্তভুক্ত এই অন্যায়ের প্রতিবিধানের প্রচেষ্টার গুরুত্ব কতটা বেশি তা মনে হয় বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এই ধরনের চেষ্টাগুলোই হলো ইসলামি আন্দোলন।
উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা মৌলিক কিছু কর্মসূচি পেলাম, যেগুলো কুরআন সুন্নাহর আলোকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যেমন
ক. আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকার
খ. খুরুজ আলা আইম্মাতিল জাওর
গ. তাগুতি শাসন ব্যবস্থা প্রতিবিধান
ইসলামের এই সকল কর্মসূচিসহ নানা মুখি কার্যকলাপের সমন্বিত একটি অপকাটামো আমরা ‘ইসলামি আন্দোলন’ বলে আখ্যায়িত করতে পারি।
আমরা আমাদের বক্ষমান আলোচনার এই পর্যায়ে একটি সুন্দর ও সফল ইসলামি আন্দোলনের কার্যকলাপ কী ও কেমন হওয়া উচিৎ সে বিষয়ে কিছু আলোকপাত করতে চাই। আলোচনার সুবিধার্তে প্রথমেই ইসলামি আন্দোলনের কার্যক্রমকে আমরা তিনটি ভাগে বিভক্ত করতে পারি।
১. শক্তি সঞ্চয় ও প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম
২. সামাজিক ও রাষ্টিয় অন্যায়-জুলুমের প্রতিবাধ ও প্রতিরোধ মূলক কার্যক্রম
৩. পূর্ণাঙ্গ ইসলাম কায়েমের লক্ষ্যে ইসলামি রাষ্ট প্রতিষ্ঠা ও রাষ্টিয় পর্যায়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা মূলক কার্যক্রম।
আমাদের দেশে প্রেক্ষাপট ও আমাদের দেশের ইসলামি আন্দোলনের প্রচেষ্টারত দল, সংগঠন ও কার্যকালাপ নিয়ে পরবর্তী পর্বগুলোতে আলোচনা করবো। ইনশাআল্লাহ!
চলমান...
মে' ১৪
তাবলিগ আন্দোলন জিহাদ শিরোনামের বক্ষমান আলোচনার প্রথম পর্বে আমরা জিহাদের কিছু বিধান ও বর্তমান যুগে জিহাদের কর্ম কৌশল বিষয়ে আলোকপাত করেছি। এবার আমরা আলোচনার দ্বিতীয় পর্বে তাবলিগ বিষয়ে কিছু আলোচন করতে চাই।
শুরুতেই আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, তাবলিগ আন্দোলন ও জিহাদ তিনটি কাজই ইসলামের অপরিহার্য তিনটি বিভাগ। কাজ তিনটি যেমন ইসলামের বিভাগ বা অধ্যায়, তেমনি প্রতিটি কাজের উদ্দেশ্য ও কর্মপন্থা ভিন্ন ভিন্ন। জিহাদ যেমন শত্র“র বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করার প্রক্রিয়া, তাবলিগ তার সম্পূর্ণ বিপরিত বিনীতভাবে মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করার প্রক্রিয়া। আর ইসলামি আন্দোলন মূলত ‘আমর বিল মারুফ’ ‘নাহি আনিল মুনকার’ ও মুসলিম সমাজে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমন্বিত একটি প্রক্রিয়া। সুতরাং জিহাদ ও ইসলামি আন্দোলন হলো শক্তি সংগ্রহ করা ও শক্তি প্রয়োগ করার ক্ষেত্র। জিহাদ হলো অমুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র শক্তি আর ইসলামি আন্দোলন হচ্ছে নামধারী মুসলিমদের বিরুদ্ধে জনতার শক্তি ব্যবাহার করার ময়দান। পক্ষান্তরে দাওয়াত ও তাবলিগ হলো শক্তিকে পরিহার করে বিনয়কে সঙ্গী করে কাজ করার ময়দান।
ইসলামের প্রথম যুগে দাওয়াত ও তাবলিগ বলতে অমুসলিম, কাফের, মুশরিক, বেঈমানদের নিকট ইসলাম গ্রহণের আহ্বানকে বোঝাতো। তবে কালক্রমে মুসলমানদের মধ্যে অবনতি আসতে আসতে পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, তা তুলনা করাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলামের প্রথম যুগে শতকরা একশ’ভাগ মুসলমানই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি ছিল। বে-নামাজি কোনো মুসলমানের কল্পনাই তখন করা যেত না। সে যুগে মুসলিম আর অমুসলিমের পার্থক্য করা হতো নামাজ দিয়ে। মুসলিম ব্যক্তি নামাজ পড়তো আর যে নামাজ পড়তো না সে হতো অমুসলিম। কিন্তু পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে ঘটতে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, শতকরা এক ভাগ মুসলিমও নিয়মিত নামাজ পড়ে না। পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলিম ঈমান কাকে বলে তা জানে না। ইসলামি জীবনাচর থেকে তারা সম্পূর্ণ বেখবর। একদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত ইসলামি শাসনব্যবস্থার পতন ঘটতে থাকে অপর দিকে মুসলমানদের ঈমানি, আমলি, আখলাকি অধঃপতন তরান্বিত হতে থাকে। ইতিহাসের এমনই ক্রান্তিকালে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে মুসলিম জাতির পতন ঠেকাতে কিছু কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তার মধ্যে অন্যতম সফল ও সর্বাধিক বিস্তৃত পরিসরের কাজটি শুরু হয় হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ. এর হাত ধরে। দাওয়াত ও তাবলিগের নামে আজ সারা পৃথিবী জুড়ে চলছে যে কাজ। সারা দুনিয়া ব্যাপী চলমান দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ বর্তমান যুগে মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিরাট রহমত হিসাবে আবির্ভূত। বেশ কয়েকটি কারণে এ কাজ আজ মুসলিমউম্মাহর এক বিশাল আশ্রয়স্থলে পরিণত।
এক. ইসলাম সম্পর্কে মুসলামানদের ব্যাপক অজ্ঞতা। ইসলামি আমল আখলাকের বিষয়ে নিদারুণ উদাসীনতা আর ইসলামের ব্যাপারে আগ্রহের কমতির এই নাজুক সময়ে একজন গণ্ডমুর্খ পাপিষ্ঠ মানুষকে দীনের পথে নিয়ে আসার এক চমৎকার উপায়। মানুষকে তার বদদীনি পরিবেশ থেকে সরিয়ে নিয়ে মনের মধ্যে হেদায়াতের আলো জ্বালাবার এক অসাধারণ ব্যবস্থা এটি। প্রতিটি মানুষের দুয়ারে দুয়ারে দীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার চমৎকার এক পদ্ধতি হলো দাওয়াত ও তাবলিগের এই কাজ। কোনো একজন বদদীন মানুষকে দীনের উপর তুলতে এই কাজের কোনো জুড়ি নেই। তাকে ধরে তাবলিগ জামাতে সোর্পদ করে দিলেই ইনশাআল্লাহ! সে ধীরে ধীরে দীনদার হয়ে ওঠে।
দুই. শতধা বিভক্ত মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে বিভেদের পরিবেশ দূর করে ঐক্যের পরিবেশ দূর করার এক অসাধারণ ব্যবস্থা এটি। এখানকার কর্মপদ্ধতি এমন যে, এর উসূল মেনে কাজ করলে কোনো বিভেদ তৈরি হয় না। বরং নানা রকম বিভেদ খুব সহজেই সমাধান হয়ে যায়।
তিন. সারা দুনিয়া ব্যাপী এক নিয়মে এক পদ্ধতিতে কাজ চালাবার এক ইলহামি ব্যবস্থা এটি। দুনিয়াতে এর নজির খুঁজে পাওয়া কঠিন।
উপরোক্ত কারণসমূহ ছাড়াও আরও নানাবিধ কারণে তাবলিগ জামাতের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ অসাধারণ উপায়ে আঞ্জাম পাচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে আরও দুটি বিষয়ের প্রতি এখানে গুরুত্ব আরোপ করতে চাই।
প্রথম বিষয়টি হলো, তাবলিগ জামাতের কাজ এখনো কিন্তু এক শতাব্দি অতিক্রম করেনি। শতাব্দি পেরিয়ে আরও বহুদূর পথ চলতে হবে এ কাজকে। আল্লাহ চাহেন তো কেয়ামত পর্যন্ত চলবে এ কাজ। আর এজন্যই কাজের মধ্যে বিচ্যুতিকে প্রশ্রয় দেয়া চলবে না। ভুল-ত্র“টি শোধরানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিশেষ দুটি পরামর্শ এ ক্ষেত্রে প্রনিধানযোগ্য। প্রথম পরামর্শ হচ্ছে হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ. এর সময়ে নিযামুদ্দীন সাহারানপুরসহ তাবলিগের গুরুত্বপূর্ণ ইজতেমা ও মজমাগুলোতে হযরত হোসাইন আহমদ মাদানি রহ., হাকীমুল ইসলাম কারী তৈয়ব রহ.- এই জাতীয় নন তাবলিগ জামাত ওলামায়ে কেরামদেরও গুরুত্বের সাথে বয়ান হতো। কাজের জিম্মদারগণ যদি মনে করেন তখন তো কাজের সূচনাকাল ছিল তাই তাদের প্রয়োজন ছিল। এখন আর নন তাবলিগ জামাত আলেমদের প্রয়োজন নাই, তাহলে মস্তবড় ভুল করা হবে। এভাবে নন তাবলিগ জামাত আলেম ওলামাদের যদি তাবলিগ জামাতের মধ্যে গুরুত্ব থাকে তবেই ওলামায়ে কেরামের প্রতি তাবলিগের সাথীদের আযমত ও সম্মান টিকে থাকবে। অন্যথায় যে সকল ওলামায়ে কেরাম তাবলিগ জামাতের সাথে নিয়মিত সময় দেন না, তাদের ব্যপারে তাবলিগের সাথীদের মধ্যে অবজ্ঞা ভাব তৈরি হবে। যেটা এই কাজের নুর ও ফজিলত কে ধ্বংস করে দিবে। ইদানীং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই ধরনের কিছু বিষয় প্রকাশও পাচ্ছে।
দ্বিতীয় পরামর্শ হচ্ছে, কোনো কিছুর ভেতরে ঢুকে পড়লে তার সকল দিক আর নজরে পরে না। যেমন ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়লে ঘরের ভেতরটা উপলব্ধি করা যায় কিন্তু বাইরে থেকে ঘরটা কেমন তা কিন্তু উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। নিজের সকল ত্র“টি কিন্তু নিজের দৃষ্টি গোচর হয় না। অনেক ত্র“টি অন্যের চোখে ধরা পড়ে। তেমনি যারা তাবলিগ জামাতের কাজের সাথে জড়িত তাদের দৃষ্টিতে কাজের অনেক দুর্বলতা বা ত্র“টি ধরা না পড়াই স্বাভাবিক। তাই হক্কানী ওলামায়ে কেরামের সাথে এজন্য সমন্বয় রাখতে হবে। বাছাইকৃত কিছু নন তাবলিগ জামাত ওলামায়ে কেরাম যারা তাবলিগ জামাতের কাজকে ভালোবাসেন আবার এই কাজকে পর্যবেক্ষণ করে বাইরে থেকে এর ত্র“টি বিচ্যুতি নির্দেশ করতে পারেন এমন কিছু আলেম থাকতে হবে। এবং তাদের সাথে মাঝে মধ্যে জিম্মাদার হযরতগণ আলোচনা করে বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত হতে হবে। শুধু তাবলিগ জামাত নয় বরং প্রতিটি ইসলামি তৎপরতার মধ্যেই এই ব্যবস্থা থাকা চাই। এতে করে কাজের মধ্যে বিচ্যুতি আসার সম্ভাবনা কম থাকবে ইনশাআল্লাহ।
কাজকে দুই দিক থেকে মূল্যায়ন করতে হবে। ভেতর থেকে জিম্মদারগণের মূল্যায়ন থাকবে। আবার বাইরে থেকেও শুভাকাংখীদের মূল্যায়ন থাকতে হবে। তবেই কাজের ত্র“টি বিচ্যুতি যথাযথভাবে ধরা পড়বে এবং সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব হবে।
সংশ্লিষ্ট আলোচনায় দ্বিতীয় যে বিষয়টির উপর গুরুত্বারোপ করতে চাই সেটি হলো, তাবলিগ জামাতের কাজ ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এতে যেমন কোনো সন্দেহ নেই, তেমনি তাবলিগ ইসলামের একমাত্র কাজ নয় এতেও কোনো সন্দেহ নেই। এমন কি এই দাওয়াত ইসলামের পূর্ণাঙ্গ দাওয়াতও নয়। এক্ষেত্রে তাবলিগ জামাতের দাওয়াতের বাইরে গুরুত্বপূর্ণ আরো দু’টি দাওয়াতি মিশন রয়েছে। যার প্রথমটি হচ্ছে অমুসলিমদের নিকট দাওয়াত পৌঁছানোর মিশন। অপরটি হচ্ছে ইসলামি রাষ্ট্র ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্বের দাওয়াত। অমুসলিমদের নিকট দাওয়াত পৌঁছানোর গুরুত্বের বিষয়ে এতটুকু কথা বলাইতো যথেষ্ট যে, কোটি কোটি মুমিনের নিকট নামাজ আর কালেমার একিনের দাওয়াত পৌঁছানোর চেয়ে একজন বেঈমানের নিকট ঈমানের দাওয়াত পৌঁছানোর গুরুত্ব বেশি। কারণ, যে মুমিন, সে নামাজ না পড়লেও একদিন জান্নাতে যেতে পারবে। কিন্তু যে বেঈমান, হিন্দু, খৃষ্টান বা অন্য কোনো ধর্মাবলম্বী সে ঈমান গ্রহণ না করলে চিরস্থায়ী জাহান্নামি হবে। তাবলিগ জামাতের মেহনতের মাধ্যমে অমুসলিম দেশগুলোতে তাদের আমল দেখে কিছু অমুসলিম ইসলাম কবুল করে ঠিক, তবে তাবলিগ জামাতের তরতিবের মধ্যে অমুসলিমদের মাঝে ইসলাম প্রচারের কৌশল ও পদ্ধতি ততটা মজবুত নয়। বিশেষ হেকমতের কারণেই তাবলিগ জামাতের দাওয়াতের মধ্যে এ বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দেয়া হয় না। কিন্তু শায়খ আলী মিয়া নদভী রহ. এর বিশিষ্ট খলিফা মাওলানা কালিম সিদ্দীকি দা.বা. অমুসলিমদের মাঝে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানোর যে মেহনত করে যাচ্ছেন সেটা আরো অনেক শক্তিশালী। তাই এ কথা মনে রাখতে হবে ইসলাম ও মুসলিম মিল্লাতের প্রয়োজনে তাবলিগ জামাতের দাওয়াত যেমন চলতে হবে তেমনি ইসলামের অন্যান্য দাওয়াতগুলোও চলতে হবে। ইসালামের প্রতিটি হকদাওয়াত একটি অপরটির সহযোগী, বিরোধী নয়। একদল অপর দলের সমর্থক, প্রতিপক্ষ নয়।
চলমান...।
০০০০০০০০০০০০০০০০
এপ্রিল'১৪
বর্তমান বিশ্বপ্রেক্ষিতে জিহাদের কর্মকৌশল কী হতে পারে তা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচ্য বিষয়গুলো নিয়ে মৌলিক আলোচনা করার পর আমরা সাম্প্রতিক সময়ে জিহাদের নামে নেয়া কিছু পদক্ষেপ বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। বিগত কয়েক মাসে যখন পার্শ্ববর্তী দেশ বার্মার মিয়ানমারে বর্বর মুসলিম বিধনযজ্ঞ চালানো হয়। অগ্নিসংযোগ করা হয় মুসলমানদের বাড়ি ঘরগুলোতে। নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় শত শত মুসলিম শিশু ও নারী-পুরুষকে। উচ্ছেদ করা হয় মুসলিম পরিবারগুলোকে তাদের শতশত বছরের পুরোনো বসতভিটা থেকে। এক কথায় মুসলিম জনপদের উপর চালানো হয় নির্যাতনের স্ট্রিমরোলার। সেই ঘটনায় বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে স্বভাবতই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। আর পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মুসলমানদের উপর আরাকানের পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্বও ছিল সব চেয়ে বেশি। এহেন প্রেক্ষিতে রাজধানী ঢাকায় বসে একজন ব্যক্তি আমিরুল মুমিনিনের মতো জিহাদের ডাক দিলেন। দিন ক্ষণ তারিখ নির্ধারণ করে বাস যোগে আরাকানে যাওয়ার উদ্দেশে ঢাকায় জড়ো হওয়ার জন্য সকল মুজাহিদদেরকে নির্দেশ দিলেন। এই ঈমানি নির্দেশ পেয়ে আবেগি তরুণ মুজাহিদ দল ঢাকায় এসে জড়ো হতে লাগলো। নির্ধারিত সময়ে দেখা গেল প্রশাসনের লোক এসে সকল বাস সরিয়ে নিয়ে গেল। অপর দিকে কারা কারা এমন জিহাদের ডাকে সাড়া দিতে পারে সেই আবেগি মুজাহিদদের পুর্ণাঙ্গ তালিকা গোয়েন্দাদের হাতে চলে গেল। এই ধরনের তৎপরতা দেখলে স্বাভাবিক ভাবেই সচেতন মানুষের মধ্যে প্রশ্ন জাগতে পারে, এটা আসলে আরাকানের মজলুম মুসলমানদের সাহায্যে মুজাহিদ প্রেরণের কোনো উদ্যোগ, নাকি সূক্ষ্ম কোনো ষড়যন্ত্রের ফাঁদ। জিহাদের নামে এভাবে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে মুজাহিদবাহিনী প্রেরণের কোনো বাস্তবতা কি বর্তমান প্রেক্ষাপটে আছে? এই সকল দায়িত্বজ্ঞানহীন মুজাহিদদের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয় কবে যেন এরা এমন ঘোষণা দিয়ে বসে যে, আমেরিকার ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউজে আক্রমণ করার উদ্দেশে একটি মুজাহিদ বাহিনী প্রেরণ করা হবে। যারা যারা এই জিহাদি কাফেলায় শরিক হতে আগ্রহী তারা অমুক দিন অমুক সময় হযরত শাহজালাল আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে উপস্থিত হবেন। সেখান থেকে আমেরিকার উদ্দেশে বিমান ছেড়ে যাবে!
আসলে ব্যাপারটা বুঝতে হবে যে, এখানে দুটি ধারা। একটি হলো সশস্ত্র জিহাদের ধারা। অপরটি হলো রাজনৈতিকভাবে চাপ প্রয়োগ করে জুলুম নির্যাতন বন্ধ করার ধারা। যদি আসলেই কারো মনে সশস্ত্র যুদ্ধের ইচ্ছা থাকে তাহলে তাকে অনেক বিপদসংকুল পথে পা বাড়াতে হবে। এবং খুবই দায়িত্বশীলতার সাথে সে পথে অগ্রসর হতে হবে। পৃথিবীর সকল শক্তি এখন তার পদে পদে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এসকল বাধা ডিঙিয়েই তাকে মঞ্জিলের দিকে যেতে হবে। আর যদি উদ্দেশ্য হয় সারা দুনিয়ার সকল প্রতিবাদী মুসলমানদের সাথে একাত্ব হয়ে প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হওয়া আর এভাবে একটি রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার মাধ্যমে জুলুম নির্যাতনের পথ বন্ধ করার পদক্ষেপ নেয়া, তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু জিহাদের ডাক দিয়ে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গলি প্রদর্শন করে এমন অপরিণত শিশুসুলভ কার্যক্রম পরিচালনা করা চরম হাস্যকর বৈ কিছুই না। জিহাদ জিহাদ খেলা আর প্রকৃত জিহাদের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ কখনই এক জিনিস হতে পারে না।
আমাদের অভিমত হচ্ছে বর্তমান বিশ্বপ্রেক্ষাপটে জিহাদের কার্যক্রম পরিচালনায় দুই পর্যায়ের পদক্ষেপ থাকতে হবে। মুজাহিদবাহিনী ও প্রকৃত জিহাদি কার্যক্রমের পক্ষে জনমত তৈরি করা। বিশ্বব্যাপী জুলুম নির্যাতন ও মুসলিম নিধনের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদের লক্ষ্যে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা। তবে মুসলিম বিশ্বের শাসকবর্গ, সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক দলগুলো পাশ্চাত্যের প্রতি এতটাই নতজানু যে সারা মুসলিম জাহান আজকে আমেরিকা ও পাশ্চাত্যের হাতে বন্দি ও সমর্পিত একটি জাতি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই আজকের বিশ্বপরিস্থিতিতে ইসলামি রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠির জন্য সরাসরি ও প্রত্যক্ষ জিহাদি কার্যক্রমের সাথে সম্পর্ক রাখা দুই দিকের জন্যই বিপদজনক। রাজনৈতিক অঙ্গনে কাজের জন্যও বিপদজনক। কারণÑ রাজনৈতিক ময়দানে যারা প্রতিপক্ষ, যারা ধর্মীয় রাজনীতি বিরোধী এবং ধর্মনিরপেক্ষ সাংবাদিক নামক ইসলাম বিদ্বেষীগোষ্ঠি তারা এটাকে কেন্দ্র করে ইসলামি রাজনৈতিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদসহ নানা রকম অভিযোগ উত্থাপন করে বিষোদাগারে লিপ্ত হবে। এবং এর মাধ্যমে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা চালাবে।
অপর দিকে, নীরবে নিভৃতে মানুষের চক্ষুর অন্তরালে চলা জিহাদি কার্যক্রমও ব্যাহত হবে। এই ধরনের লোকদের সম্পৃক্ততার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখেছি জিহাদি ততপরতার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ রাজনীতিতে সক্রিয় হলে তাকে নিয়ে মিডিয়ায় প্রচার-প্রচারণা, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত অনেক বেশি হয়। এতে রাজনৈতিক কার্যক্রমও ক্ষতিগ্রস্থ হয় আবার জিহাদি কাজও বাধাগ্রস্থ হয়। মোট কথা যারা রাজনৈতিক ততপরতার সঙ্গে জড়িত থাকবেন তারা জিহাদি ততপরতার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়াবেন না। তবে বিশ্বব্যাপী পরিচালিত জিহাদের স্বপক্ষের কুটনৈতিক ও রাজনৈতিক ততপরতা পরিচালনা করবেন। আর দ্বিতীয় পর্যায়ের এবং মূল পদক্ষেপ হচ্ছে প্রত্যক্ষ জিহাদের ততপরতা পরিচালনা করা। আর এই ততপরতাও চালাতে হবে অত্যন্ত নিষ্ঠা, বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশীলতার সাথে। শুধু আবেগি ভূমিকা বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোনোভাবেই কাম্য নয়।
বর্তমানে জিহাদি কার্যক্রমের দুটি লক্ষবস্তু থাকতে পরে। এক. পৃথিবীর দেশে দেশে যে সকল ইসলাম বিদ্বেষীগোষ্ঠি ইসলাম নির্মূল ও মুসলিম নিধনের উম্মত্ত খেলায় মেতে ওঠছে তাদেরকে লক্ষবস্তু নির্ধারণ করে জিহাদের কাজ পরিচালনা করা।
দুই. সারা দুনিয়াব্যাপী মুসলিম হত্যাযজ্ঞ ও ইসলাম নির্মূল অভিযানের নিয়ন্ত্রক বিশ্বশক্তিগুলোকে লক্ষবস্তু নির্ধারণ করে জিহাদের কাজ পরিচালনা করা।
উপরোক্ত উভয় লক্ষবস্তুতে আঘান হানতে হলে, মুজাহিদবাহিনীকে আপাতত গেরিলা ও সুকৌশলী পন্থায় এগোতে হবে। যেহেতু বর্তমানে কোনো মুসলিম ভূখণ্ডে এমন কোনো শাসক নেই যে জিহাদি কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে, আর থাকলেও তার পক্ষে ময়দানে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। আফগানিস্তানের তালেবান হুকুমতকে এজন্যই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। কারণ তারা দুনিয়াব্যাপী জিহাদের কার্যক্রম জোরদার করার পক্ষে ভূমিকা পালন করছিল। কাজেই মুজাহিদদের বর্তমান কার্যক্রমের একমাত্র কৌশল হতে হবে- গেরিলা ও গোপন আক্রমণের পথ। আর নিঃসন্দেহে এ পথ বড় বিপদসংকুল। বড় বিপদজনক। উভয় পক্ষের জন্যই বিপদজনক। যাদের বিরুদ্ধে এই অভিযান চলে তাদের জন্যও আর যারা চালায় তাদের জন্যও। তাই আজকে দুনিয়াব্যাপী মুজাহিদদের গেরিলা আক্রমণে ইঙ্গ-মার্কিন দানবীয় শক্তি যেমন দিশেহারা হয়ে গেছে, তেমনি মুজাহিদদের কার্যক্রমও ঝুঁকির মুখে পড়ছে। তাই এই যুদ্ধে কাক্সিক্ষত ফল লাভ করতে হলে সুচিন্তিতভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। শত্র“র আক্রমণ ও গোয়েন্দা ততপরতায় যেন মুজাহিদবাহিনী পর্যদুস্ত না হয়ে পড়ে। আর এ জন্য মুজাহিদদের নেটওয়ার্ক হতে হবে অত্যন্ত শক্তিশালী। দুর্বল নেটওয়ার্ক নিয়ে এই ময়দানে টিকে থাকা যাবে না। নেটওয়ার্কের পদ্ধতি এমন হওয়া চলবে না যে, একজন মুজাহিদ ধরা পড়ে গেলে তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী পুরো টিম ধরা পড়ে যাবে। এ জন্য দুটি মৌলিক কৌশল প্রয়োগ করতে হবে। জিহাদের প্রত্যক্ষ কর্মসূচিকে গণহারে ব্যাপক করা যাবে না। যাকে তাকে এই কাজের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়ানোও যাবে না। বরং প্রতিজন মুজাহিদকে হতে হবে খুব তীক্ষè ও বুদ্ধিমান। সরল-সহজ বোকা মানুষ এই ময়দানে নিজের জন্য ও সাথীদের জন্য বিপদ ডেকে আসে। তাই এখানে মুজাহিদসদস্য রিক্রুট করার আগে সবার আগে তার বুদ্ধি ও ইন্টেলিজেন্স এর পরীক্ষা হতে হবে। আরেকটি কৌশল হলো, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টিম তৈরি করে জিহাদের কাজ করতে হবে। এক গ্র“পের সদস্যদের সাথে অন্যগ্র“পের সদস্যদের কোনো জানা পরিচয়ও থাকতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে কোনো সাথী ধরা পড়ে গেলেও পুরো নেটওয়ার্ক নিয়ে টান পরবে না। এ ভাবে বুদ্ধিদীপ্ত পরিকল্পনা, নিখুঁত কার্যক্রম আর সঠিক লক্ষবস্তু , তিনটি বিষয় বান্দার পক্ষ থেকে নিশ্চিত হলে আল্লাহর রহমতের ওপর ভরসা করে বলা যায় বিশ্বব্যাপী চলমান জিহাদ আরো বেগবান হয়ে উঠবে। আবারও বলছি, এসকল কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যাতে সাধারণ মুসলমানদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। এবং এমন কোনো কাজও করা যাবে না যাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে ইসলামের ব্যাপারে বিতৃষ্ণা জন্ম নেয়।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
মার্চ'১৪
পূর্বের আলোচনার সার সংক্ষেপ
তাবলিগ, ইসলামি আন্দোলন ও জিহাদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের লক্ষ্যে বিগত দুই সংখ্যায় ভূমিকা স্বরূপ মৌলিক যে আলোচনা করা হয়েছিল তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ হলো এই জিহাদের মৌলিক উদ্দেশ্য দু’টি। এক. ইসলামের গৌরব প্রতিষ্ঠা। দুই. কুফুরির আধিপত্য খর্ব করা।
এই জিহাদের বিধান মুসলমানদের ওপর চারটি ধাপে ফরজ করা হয়েছিল। চূড়ান্ত ধাপে সারা পৃথিবীতে আল্লাহর দ্বীন কায়েম না হওয়া পর্যন্ত জিহাদ ফরজ হয়। এর পূর্বের তিন ধাপ রহিত না বলবত এ বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ বলেছেন বলবত আছে। যখন মুসলিম জাতির শক্তি সামর্থ্য যতটুকু থাকবে সেই আলোকে জিহাদ করতে হবে। আবার কেউ বলেছেন, পূর্বের তিন ধাপ রহিত হয়ে গেছে। এখন সারা দুনিয়ায় আল্লাহর দ্বীন কায়েম না হওয়া পর্যন্ত জিহাদ চালিয়ে যাওয়া সকল উম্মতের ওপর ফরজ।
চলমান সংখ্যার আলোচনা
বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় জিহাদের কার্যক্রম পরিচালনার কর্ম-কৌশল কী হতে পারে এ বিষয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনা করে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শধু আবেগ ও উত্তেজনা কিংবা শুধু ভয় ভীতির প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নিলে কার্যকর পথে চলা সম্ভব হবে না। জিহাদের কর্ম-কৌশল নির্ধারণে নিুোক্ত বিষয়গুলো অতি গুরুত্বের সাথে বিবচেনায় রাখতে হবে।
এক. সোভিয়েত ইউনিয়নের পরাশক্তির অবস্থান থেকে পতনের পর পৃথিবীতে একটা ভারসাম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আমেরিকা একক বিশ্ব নিয়ন্ত্রনকারী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। পৃথিবীতে এই ধরনের পরিস্থিতি অতিতে খুব কমই দেখা গিয়েছে। পৃথিবীতে সব সময় প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি পরাশক্তির অস্তিত্ব থাকে এবং তারা পরস্পর ক্ষমতা ও শক্তির প্রতিযোগিতায় নিমগ্ন থাকে। এতে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে দুর্বল দেশগুলো একটি বাড়তি সুবিধা ভোগ করে। কেননা দুই পরাশক্তি অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোকে যার যার পক্ষে টানার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে। এবং উভয় পরাশক্তি নিজের সমর্থন হারানোর ভয়ে ভীত থাকে। আর এ কারণেই দুর্বল দেশগুলো দেন-দরবার করার সুযোগ পায় এবং নিজেদের সুবিধাগুলো আদায় করে নিতে পারে। অনেকটা নির্বাচনের মতো। প্রতিযোগী প্রার্থীরা ভোটারদেরকে নিজের পক্ষে টানার জন্য তাদের দ্বারে দ্বারে যায়। পক্ষান্তরে কোনো প্রার্থীর যদি প্রতিদ্বন্দ্বীই না থাকে তাহলে তার তো আর ভোটারদের কাছে ধর্ণা দিতে হয় না। বরং সে-ই থাকে নির্বাচনের সর্বে সর্বা। আজকের বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমেরিকার অবস্থাও সেই সর্বে সর্বা। উনিশ শ আশির দশকের আগে পৃথিবী দুটি ব্লকে বিভক্ত ছিল। কম্যুনিজমের সাম্রাজ্যবাদী সোভিয়েত ইউনিয়ন আর ক্যাপিটালিজমের সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা। ওই সময়টাতে ক্যাপিটালিজমের চেয়ে কম্যুনিজমের প্রতি মুসলিম জাতির ক্ষোভ তুলনামূলক বেশি থাকায় মুসলিমবিশ্বের আনুকুল্য পায় আমেরিকা। আর এভাবেই মুসলিমবিশ্ব আর আমেরিকার অভিন্ন স্বার্থ মিলিত হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। সোভিয়েত বিরোধী এই অভিন্ন মনোভাব প্রতিফলনের জন্য প্লট হিসেবে ব্যবহার হয় আফগানিস্তানের উর্বর ইসলামি মাটি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মুসলিম মুজাহিদগণ আফগানিস্তানে আগমন করে। এবং আফগানিস্তানের মাটি ও মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। বিপুল সংখ্যক আরব ও অনারব মুজাহিদ তখন জিহাদে আত্মনিয়োগ করে। সোভিয়েত বিরোধী এই আফগান জিহাদকে প্রত্যক্ষ ভাবেই নেতৃত্ব দেয় পাকিস্তান। আর তাতে প্রচ্ছন্ন সহযোগিত করে আমেরিকা।
আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বদলে যায় পৃথিবীর দৃশ্যপট। একক শক্তিতে পরিণত হয় আমেরিকা। নিরঙ্কুশ এই একক ক্ষমতার আসন পাওয়ার পর আমেরিকার নজর চলে যায় দূর ভবিষ্যতের দিকে। কারা হতে পারে আমেরিকার পরবর্তী প্রতিদ্বন্দ্বী? আমেরিকার রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ মুসলিমউম্মাহকেই পশ্চিমা তথা আমেরিকার শক্তির সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে চিি ত করে। এক্ষেত্রে হান্টিংটনের তথ্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। শুরু হয় আমেরিকার নতুন মিশন। জাগরণোম্মুখ মুসলিম শক্তিকে নির্মূল করার এক ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামে আমেরিকা। আমেরিকান ইহুদিবাদী কূটকৌশল আর সেই সাথে আমেরিকার সেবাদাস পশ্চিমাবিশ্বের অন্ধ সহযোগীদের নিয়ে মুসলিম শক্তিকে দমন করতে মরিয়া আজ আমেরিকা। প্রযুক্তির উন্নতি আর গ্লোবালাইজেশনের বদৌলতে সারা পৃথিবী আজ দানবীয় এই অপশক্তির হাতের মুঠোয়। এমন এক শক্তিধর দানবের সাথে মুসলিমউম্মাহর দ্বন্দ্বকে এক অসম লড়াই বলাই যুক্তিযুক্ত। সারা পৃথিবী এবং পৃথিবীর সকল রাষ্ট্র যাদের হাতে জিম্মি, তাদের সাথে লড়াই চলছে এমন ক্ষুদ্র শক্তির, পৃথিবীর এক ইঞ্চি মাটির ওপর যাদের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রন নেই। কাজেই বাহ্যত এটাকে শুধু অসম বললে যথার্থ বলা হবে না বরং বলা যায় অবিশ্বাস্য এক যুদ্ধ। এই যুদ্ধের সৈনিকগণ আমেরিকার কাছে মোষ্ট ওয়ান্টেড। পাগলা কুকুরের মতো আমেরিকা ও তার মিত্ররা হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরছে এই সংগ্রামী মুজাহিদদের। প্রযুক্তিগত উন্নতিসহ আমেরিকা ও তার দোসরদের সামর্থ্য পৃথিবীর অতীত সকল পরাশক্তির রোকর্ড ভঙ্গ করেছে।
দুই.
দ্বিতীয় যে বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে তা হলো, মৃত্যুঞ্জয়ী ক্ষুদ্র একটি মুজাহিদ গোষ্ঠীই আজ আমেরিকার নেতৃত্বাধীন দানবীয় ও দাজ্জালী শক্তির কাছ থেকে সমীহ আদায় করতে পেরেছে। আমেরিকা আজ এই ক্ষুদ্র গেরিলা মুজাহিদ বাহিনীর কারণে সারা পৃথিবী জুড়েই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগছে। সারা দুনিয়াতে মুজাহিদরাই আজকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সবচে বড় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আমেরিকার নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের প্রধান টার্গেট হলো এই শক্তিকে নিঃশেস করা। এই শক্তিকে নিঃশেস করতে তারা নানা রকম কূট-কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। শক্তিশালি গোয়েন্দা কার্যক্রম চালাচ্ছে। সুনিপুনভাবে তাদের নিয়জিত এজেন্টরা মুজাহিদ সেজে কিংবা জিহাদি কার্যক্রমের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে মুজাহিদদের মাঝে ঢুকে পড়ছে। এমন এমন কার্যক্রম চালাচ্ছে যাতে আবেগি ও চেতনাজাগ্রত মুসলিম তরুণপ্রজন্ম তাদের বাহারি জিহাদের শ্লোগানে প্রলুব্ধ হয়ে তাদের ডাকে সাড়া দেয়। আর এভাবেই মুজাহিদদের নেটওয়ার্ক ধ্বংস করার ফাঁদ পাতছে। মুসলমানদের মধ্যে কারা কারা জিহাদের আহ্বানে সাড়া দেয়ার মানসিকতা সম্পন্ন তাদেরকে চিি ত করে সময়ের অপেক্ষায় থাকছে। এবং সময় মতো সাড়াষি অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করছে। সারকথা হলো, এক দিকে জিহাদের চলমান তপরতা মুসলিম মিল্লাতের জন্য উতসাহ ব্যঞ্জক, ঠিক অপর দিকে খুব স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণও বটে। ঝুঁকিপূর্ণ বলতে শুধু ব্যক্তি বিশেষের জীবনের ঝুঁকিকে বুঝানো হচ্ছে না বরং জিহাদের কার্যক্রম ও মুজাহিদ নেটওয়ার্কের অস্তিত্বের জন্যও।
তিন.
জিহাদের গুরুত্ব ইসলামি শরিয়তে অপরিসীম। একথা যেমন অস্বীকার করার উপায় নেই। তেমনি একথাও অনস্বীকার্য যে, জিহাদই ইসলামের একমাত্র বিধান নয়। জিহাদ হলো ইসলামের সেই সকল বিধানের অর্ন্তভুক্ত যেগুলোকে ‘হাসান লিগাইরিহি’ বা ‘মাকসুদ বিলগায়ের’ বলা হয়। অর্থাত ইসলামি শরিয়তের বিধান মৌলিকভাবে দুই প্রকার। প্রথম প্রকার হলো ওই সকল বিধান যেগুলো মানব জীবনের মূল লক্ষ্য। যেগুলো পালন করার জন্যই মানুষের সৃষ্টি। যেমন নামাজ কায়েম করা। আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করা। এগুলোকে ‘ইবাদাতে মাকছুদাহ’ বা ‘হাসান লিজাতিহী’ বলা হয়। আর কিছু বিধান আছে যেগুলো মূলত এই জন্য দেয়া হয়েছে যে এগুলো প্রথম প্রকারের বিধান বাস্তবায়নের জন্য সহায়ক। যেমন জিহাদ, ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। জিহাদ করা, ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এজন্যই অপরিহার্য যে তা ছাড়া আল্লাহর ইবাদত যথাযথভাবে কায়েম করা সম্ভব নয়। এক বিবেচনায় জিহাদ হলো ‘আহাম্মুল ফারায়েজ’ তথা সকল ফরজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফরজ। কেননা জিহাদ ছাড়া ইসলামের অন্যান্য ইবাদত সঠিকভাবে পালিত হতে পারে না। কিন্তু আরেক বিবেচনায় অন্যান্য ইবাদতের সহায়ক ইবাদত, মৌলিক ইবাদত নয়। এজন্যই আল্লাহ তায়ালা জিহাদের বিধানের মধ্যে চারটি ধাপ বা স্তর রেখেছেন। যার সারকথা হলো, জিহাদ এমনভাবে, এমন সময় করতে হবে যেন তা আল্লাহর ইবাদত ও ইসলামের অন্যান্য বিধান কায়েমে সহায়ক হয়। ইসলামি ইতিহাসের নিরবিচ্ছিন্ন পাঠকের কাছে এটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, নববী যুগ থেকে ইতিহাসের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে মুসলমানগণ অনেক সময় জিহাদের ময়দান থেকে সাময়িকভাবে পিছুটান দিয়েছে। কিন্তু সেটা কখনোই জিহাদ থেকে পলায়নের জন্য নয়। বরং রণকৌশলের অংশ হিসেবে। মূতার জিহাদ সম্পর্কে এমন তথ্য সহিহ হাদিসের মধ্যেই বর্ণিত হয়েছে। হোদায়বিয়ার ময়দানেও বাহ্যিকভাবে জিহাদ থেকে সরে আসার কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল। মূলত আরও শক্তিশালিভাবে জিহাদের ময়দানে ফিরে আসার লক্ষে। ভারত উপমহাদেশে শামেলীর জিহাদ ও সিপাহী বিদ্রোহের পর জিহাদের নেতৃবৃন্দ সাময়িকভাবে জিহাদের কার্যক্রম স্থগিত করে দারুল উলুম দেওবন্দ কায়েমে ততপর হয়েছেন। এটা ছিল তাদের নিখুঁত কর্মকৌশল। যা পরবর্তী জিহাদে মুসলমানদের সফলতা দিয়েছে।
চার.
জিহাদের আমলের সময় একথা লক্ষ রাখা অপরিহার্য যে, জিহাদের প্রেক্ষিতে মুসলিম জনপদগুলোর ওপর এর কী প্রতিক্রিয়া হবে। অর্থাত শুধু মুজাহিদদের টিকতে পারা বা না পারার হিসাব করাই যথেষ্ট নয়; বরং জনপদের অন্যান্য মুসলিম নারী শিশু বৃদ্ধ ও দুর্বল মুসলমানদের জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টিকেও এক্ষেত্রে অতি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় আনতে হবে। হোদায়বিয়ার যুদ্ধে মুসলমানদের আধিপত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল। বিজয়ের জোরালো সম্ভাবনাও ছিল। তবুও আল্লাহ ও তার রাসুল সা. এক্ষেত্রে জিহাদ না করারই পক্ষপাতি ছিলেন। তার অন্যতম একটি কারণ হিসেবে সাধারণ ও দুর্বল মুসলমানদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে চিি ত করেছেন স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামিন। ইরশাদ হয়েছে ‘তিনি মক্কা উপত্যকায় তাদের হাত তোমাদের থেকে, আর তোমাদের হাত তাদের থেকে নিবারিত করেছেন। (যুদ্ধ বন্ধ করে দিয়েছেন)। তাদের ওপর তোমাদের শক্তি প্রতিষ্ঠিত করার পরও... (তোমাদেরকে জিহাদের আদেশ দেয়া হত ) যদি না থাকত এমন কিছু মুমিন নর-নারী, যাদেরকে তোমরা জান না। (যুদ্ধ হলে) তাদেরকে তোমরা অজ্ঞাতসারে পদদলিত করতে। ফলে তাদের কারণে তোমরা (মনে কষ্ট পেয়ে) ক্ষতিগ্রস্ত হতে। (সুরা ফাতাহ : ২৪-২৫)
বর্ণিত চারটি বিষয়ের প্রতি গভীর মনোযোগ ও যথাযথ দায়িত্বের সাথে লক্ষ্য রেখে বর্তমান জাতিয় ও আর্ন্তজাতিক পরিস্থিতির মোকাবিলায় জিহাদী কার্যক্রম চালাতে হবে। এসকল বিষয় বিবেচনায় না এনে ভাসা ভাসা কিছু আবেগি দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করে জিহাদের মতো ইসলামের সর্বোচ্চ চূড়ার গুরুত্বপূর্ণ কাজে সফলতা পাওয়া কঠিন। এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ের কিছু কার্যক্রমের পর্যালোচনা পূর্বক বর্তমান প্রেক্ষিত বিবেচনায় জিহাদের কাজ চালানোর জন্য কিছু দৃষ্টিভঙ্গি এখানে তুলে ধরতে পারি যে, আজকের এই বিশ্বব্যবস্থায় কী হতে পারে জিহাদের রূপরেখা। চলমান...
তাবলিগ আন্দোলন জিহাদ
মুহাম্মদ মামুনুল হক
দ্বিতীয় পর্ব
ফেব্রুয়ারি'১৪
তাবলিগ, ইসলামি (রাজনৈতিক) আন্দোলন ও জিহাদের মধ্যে সমন্বয়ের লক্ষ্যে বিগত সংখ্যায় আলোচনার সূত্রপাত হয়। তাতে ভূমিকা স্বরূপ দুটি বিষয়ের আলোচনা করা হয়। এক. জিহাদের মৌলিক উদ্দেশ্য হলো দুটি, ইসলামের গৌরব প্রতিষ্ঠা ও কুফরির আধিপত্য খর্ব করা।
দুই. জিহাদের বিধান মুসলমানদের ওপর চারধাপে ফরজ হয়েছে। প্রথম ধাপে জিহাদের অনুমতি ছিল না, দ্বিতীয় ধাপে জিহাদের অনুমতি দেয়া হয়েছে। বাধ্যতামূলক করা হয়নি। তৃতীয় ধাপে আক্রান্ত হলে প্রতিরোধমূলক জিহাদ ফরজ তথা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আর চতুর্থ ও চূড়ান্ত ধাপে সারা দুনিয়াতে ইসলাম কায়েম না হওয়া পর্যন্ত জিহাদ ফরজ করা হয়েছে।
চলমান সংখ্যার আলোচনা
জিহাদ যে চার ধাপে ফরজ হয়েছে, অনেক পূর্বসূরি সালাফের বক্তব্য থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ইমাম শাফেয়ি রহ. এর বক্তব্য- ‘রাসুল সা. যখন মুশরিকদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন তখন তাকে শান্ত্বনা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ করলেন- ‘আর আমি জানি মুশরিকদের কথায় আপনার মন বিষিয়ে ওঠে, তাই আপনি আপনার রবের প্রশংসার সাথে পবিত্রতা এবং সেজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত থাকুন। রবের ইবাদত করুন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। (সূরা হিজর-৯৭-৯৯) এখানে আল্লাহ তায়ালা মুশরিকদের নিকট দাওয়াত পৌঁছানোর এবং আল্লাহর ইবাদত করাকে জরুরি সাব্যস্ত করেছেন, কিন্তু মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে জরুরি সাব্যস্ত করেননি। কুরআনের একাধিক আয়াতের দ্বারা বিষয়টির স্পষ্ট বর্ণনা দেয়া হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জিহাদের অনুমতি দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন- ‘যারা আক্রান্ত হয় তাদেরকে (জিহাদের) অনুমতি দেয়া হলো।’ অতঃপর নবী করিম সা. এর হিজরতের পর একটি উল্লেখযোগ্য সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেল। যে সময়টার মধ্যে আল্লাহর মেহেরবানিতে অনুসারীদের বিরাট দল তৈরি হয়ে গেল। আল্লাহর সাহায্যে শক্তিও সংগৃহীত হলো, ইতোপূর্বে যে জিহাদ ফরজ ছিল না, ছিল শুধু অনুমতি, আল্লাহ তায়ালা সেই জিহাদের বিধানকে বাধ্যতামূলক করে দিলেন। কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ করলেন- তোমাদের ওপর যুদ্ধ ফরজ করা হয়েছে।
(দেখুন আহকামুল কুরআন-ইমাম শাফেয়ি রহ.-তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম সূত্রে)
শামসুল আইম্মা সারাখসি রহ. মাবসূতে লিখেছেন- ‘আর রাসুল সা. শুরুতে মুশরিকদের ক্ষমা এবং এড়িয়ে চলতে আদিষ্ট ছিলেন, আল্লাহ বলেছেন- ‘আপনি সুন্দরভাবে তাদেরকে ক্ষমা করুন, আরও বলেছেন, আর আপনি এড়িয়ে চলুন। অতঃপর কাফের-মুশরিকদের পক্ষ থেকে আক্রমণ হলে জিহাদের আদেশ এসেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে (যুদ্ধের) অনুমতি দেয়া হলো। কেননা তারা জুলুমের শিকার হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিরোধের অনুমতি দেয়া হলো। আল্লাহ আরও বলেছেন- যদি তারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে, তাহলে তোমারাও তাদের সাথে যুদ্ধ কর। আরও বলেছেন, ‘তারা যদি শান্তির প্রতি উদ্বুদ্ধ হয় তাহলে আপনিও হন।’ অতঃপর আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে আক্রমণ শুরু করার নির্দেশ এলো। আল্লাহ বললেন, ‘আর তোমরা তাদের সাথে লড়াই কর যতক্ষণ না ফিতনা নির্মূল হয়।’ আল্লাহ আরও বললেন ‘মুশরিকদেরকে যেখানে পাবে যুদ্ধ করবে’ রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘আমি আদিষ্ট হয়েছি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু না বলা পর্যন্ত মানুষের সাথে যুদ্ধ করতে। যখন তা বলবে, মানুষ স্বীয় জীবন ও সম্পদকে আমার আক্রমণ থেকে নিরাপদ করে নিবে। তবে ইসলামের কোনো বিধানের আবশ্যকতার কারণে যদি নিরাপত্তা না থাকে সেটা ভিন্ন কথা। আর মানুষের মনের হিসাব আল্লাহর নিকট। মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদের আবশ্যকতার বিধানই বলবৎ আছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত এ ভাবেই বলবৎ থাকবে।
ইবনে তাইমিয়া রহ. এর বক্তব্য
‘নবী করিম সা. শুরুতে কাফেরদের বিরুদ্ধে মুখের কথার দ্বারা কার্যক্রম পরিচালনায় আদিষ্ট ছিলেন। হাতের দ্বারা লাড়াইয়ের নয়। তিনি তাদেরকে দাওয়াত দিবেন, নসিহত করবেন এবং ভালো যুক্তি দিয়ে তাদেরকে বুঝিয়ে দিবেন। আর নিজের অক্ষমতা ও মুসলমানদের দুর্বলতার কারণে শত্র“দের সাথে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতে আদিষ্ট ছিলেন। অতঃপর যখন মদিনায় হিজরত করলেন আর সেখানে অনেক সহায়তাকারী তৈরি হয়ে গেল, তখন তাকে জিহাদ পরিচালনার অনুমতি দেয়া হলো। এরপর যখন তারা শক্তিশালী হয়ে উঠলেন তাদের ওপর জিহাদ ফরজ করা হলো। তবে যারা তাদের সাথে শান্তি বজায় রাখে সেই কাফেরদের সাথে যুদ্ধ ফরজ করা হলো না। কেননা মুসলমানগণ সকল কাফেরদের সাথে যুদ্ধ করার ক্ষমতা রাখতো না। অতঃপর আল্লাহ যখন মক্কা বিজয় দিলেন কোরাইশ ও আরব শাসকদের সাথে যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল, আর সারা আরব থেকে দলে দলে মানুষ ইসলামের দিকে ধাবিত হলো। তখন আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় নবীকে সকল কাফেরদের সাথে যুদ্ধের হুকুম দিলেন। শুধু যাদের সাথে নির্দিষ্ট মিয়াদে চুক্তি ছিলো তারা বাদে। ইবনে রুশদ ও ইবনুল কায়্যিমসহ আরও অনেক ওলামায়ে সালাফ ধাপে ধাপে জিহাদ ফরজ হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। (তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম : ৩/৮)
জিহাদের প্রথম তিনধাপ রহিত না বলবৎ
আমাদের বক্ষমান আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, যে চারটি ধাপে জিহাদের বিধান ইসলামি শরিয়তে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং সে সংক্রান্ত কোরআনের আয়াতগুলো বিদ্যমান আছে, হাদিসেও তার বিবরণ রয়েছে। তার সবগুলো ধাপ ও তার বিধান বলবৎ আছে না পূর্বের ধাপ ও পর্যায়গুলো রহিত হয়ে কেবল মাত্র চূড়ান্ত ধাপের বিধানটি বলবৎ আছে? এ প্রশ্নের সমাধানে ওলামায়ে উম্মতের বক্তব্য নানা রকম। কারও কারও বক্তব্য হলো, যখন জিহাদের বিধান ধাপে ধাপে নাজিল হয়েছে, তখন প্রতিটি ধাপের বিধানকে রহিত করেই পরবর্তী ধাপের বিধান নাজিল হয়েছে। যখন জিহাদের অনুমতি এসেছে তখন জিহাদ করতে নিষেধের বিধান রহিত হয়ে গেছে। এরপর আবার যখন আক্রান্ত হলে জিহাদ করাকে ফরজ করা হয়েছে তখন জিহাদ ঐচ্ছিক থাকার বিধান রহিত হয়ে গেছে। এরপর যখন শুধু আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে নয় বরং সারা দুনিয়াতে দ্বীন কায়েম না হওয়া পর্যন্ত জিহাদ করাকে ফরজ করা হয়েছে তখন পূর্বের বিধান রহিত হয়ে গেছে। কাজেই এখন জিহাদ হলো ফরজ। সারা দুনিয়াতে আল্লাহর দ্বীন কায়েম এবং যাবতীয় ফেতনা নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত জিহাদের আমল অব্যাহত রাখা উম্মতের ওপর ফরজ। তবে জুমহুর তথা অধিকাংশ ওলামায়ে কেরামের মতে জিহাদ করার মতো শক্তি সামর্থ থাকলে এটা ফরজে কেফায়া। ফরজে কেফায়া অর্থ হলো কিছু সংখক মুসলমান যদি জিহাদ চালিয়ে যায়Ñ তবে ফরজ আদায় হয়ে যাবে। আবার অনেক ওলামায়ে কেরামের মতে জিহাদরে চার ধাপের কোনোটিই রহিত নয়। বরং সবকটি ধাপই বলবৎ। আর প্রতিটি ধাপই উপযুক্ত পরিবেশের ওপর নিভর্রশীল। মুসলিম উম্মাহর যে অংশের ওপর যখন যে পরিবেশ বিরাজমান থাকবে সেই আলোকেই তাদের ওপর জিহাদের বিধান আরোপিত হবে। কোথাও যদি মুসলমানদের অবস্থা মক্কি জিন্দেগির মুসলমানদের মতো হয় তবে সেই দুর্বল অবস্থায় মুসলমানদের জন্য ধৈর্যধারণ করা জরুরি। জিহাদ করা চলবে না। জিহাদ করতে গিয়ে মুসলিম নারী পুরুষ শিশুদের ওপর বিপদ ডেকে আনা যাবে না। যদি মুসলমানদের অবস্থা আরেকটু উন্নত হয়; শত্র“র মোকাবেলা করে ময়দানে টিকে থাকা যাবে বলে আশা করা যায় এবং মুসলমানদের তেমন হিম্মত হয় তবে জিহাদ করার অনুমতি থাকবে। আরও ভালো অবস্থা থাকলে আত্মরক্ষামূলক জিহাদ করা ফরজ হবে। শত্র“রা মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করলে যদি আশা করা যায় যে শত্র“দেরকে প্রতিহত করা সম্ভব তবে তখন মুসলমানদের জন্য আত্মরক্ষামূলক জিহাদ ফরজ হবে। আর যদি মুসলিম উম্মাহর অবস্থা আরও সমৃদ্ধ হয় তারা যদি আরও শক্তিশালী হয় এবং অগ্রসর হয়ে নিজেরা যুদ্ধ করলেও শত্র“পক্ষ মুসলমানদের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারবে না বলে আশা করা যায়, তাহলে এমন পরিস্থিতিতেই সারা দুনিয়ায় দ্বীন কায়েমের লক্ষে নিজেদের অগ্রসর হয়ে শত্র“র সাথে লড়তে হবে।
(আলবুরহান ফি উলুমিল কোরআন-যারকাশি রহ.-তাকমিলা সূত্রে)
উপরোক্ত আলোচনায় জিহাদের কার্যক্রম পরিচালনার বাধ্যবাধকতা বিষয়ে ওলামায়ে উম্মতের দুুটি মত লক্ষ করা গেল। প্রথম পক্ষের মত হলো সারা পৃথিবী থেকে ফিতনা নির্মূল হয়ে আল্লাহর দ্বীন কায়েম না হওয়া পর্যন্ত জিহাদ করা ফরজে কেফায়া। তবে হ্যাঁ, শর্ত হলো শত্র“র সঙ্গে যুদ্ধ করার সামর্থ থাকতে হবে। যে ক্ষেত্রে সামর্থ থাকবে না সে ক্ষেত্রে জিহাদ ফরজ হবে না। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেনÑ আল্লাহ তায়ালা মানুষের ওপর তার সামর্থ্যরে মধ্যেই বাধ্যবাধকতা আরোপ করে থাকেন। (সুরা বাকারা)
দ্বিতীয় পক্ষের মত হলো, সবার জন্য সব ক্ষেত্রে জিহাদ ফরজ নয়। বরং পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর সেটা নির্ভরশীল। কোনো ক্ষেত্রে অস্ত্র ধারণপূর্বক শত্র“র বিরুদ্ধে জিহাদ করা নিষিদ্ধ হবে। কোনো ক্ষেত্রে শুধু অনুমতি থাকবে। কোনো ক্ষেত্রে আত্মরক্ষামূলক জিহাদ ফরজ হবে। আবার কোনো ক্ষেত্রে আক্রমণাত্মক জিহাদও ফরজ হবে।
এতোক্ষণ পর্যন্ত আমরা জিহাদরে শরয়ি বিধান ও এতদাসংক্রান্ত ওলামায়ে উম্মতের মতামত নিয়ে আলোচনা করলাম। এখন আমরা উপরোক্ত আলোচনার আলোকে বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দাওয়াত, তাবলিগ, ইসলামি আন্দোলন ও জিহাদের মধ্যে সমন্বয়ের ওপর কিছু আলোকপাত করবো। সেই সাথে বর্তমান এই অবস্থায় দাওয়াত ও তাবলিগের কার্যক্রম, ইসলামি আন্দোলনের হালচাল নিয়ে কিছু মতামত তুলে ধরবো। জিহাদরে জন্য অত্যন্ত প্রতিকূল বিশ্বপরিস্থিতিতে জিহাদরে আমল অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে কী কৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে এবং কোন কর্মপদ্ধতি অবলম্বন করা অধিকতর কার্যক্রর হতে পারে- প্রভৃতি বিষয়গুলোর ওপর খোলামেলা কিছু মতামত ব্যক্ত করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
চলবে...
তাবলিগ আন্দোলন জিহাদ
মুহাম্মদ মামুনুল হক
প্রথম পর্ব...
জানুয়ারি'১৪
সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামি মহলে একটি বিষয় নিয়ে খুব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও বিতর্ক লক্ষ করছি। বিষয়টি অনেক স্পর্শকাতরও বটে। দীর্ঘদিন ধরে দুচার কলম লিখবো- ভাবছিলাম। সময় সুযোগ হয়ে উঠছিলো না। অবশেষে সংক্ষিপ্ত পরিসরেই কিছু আলোকপাত করার উদ্দেশ্যে বক্ষমান লেখাটিতে হাত দিলাম। বর্র্তমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে মুসলিম জাতির জন্য জিহাদের বিধান কোন পর্যায়ে পড়ে? অথবা জিহাদের প্রক্রিয়া কী হওয়া বাঞ্ছনীয়? সংশ্লিষ্ট বিষয়ে খোদ আলেম সমাজের মধ্যেই নানা মত ও বিভিন্ন বক্তব্য লক্ষ করা যায়।
নামকা ওয়াস্তের মুসলমানদের বাদ দিলেও যে সকল মুসলমান নিজেদের জীবনে আল্লাহর হুকুম মেনে চলার আবশ্যকতা অনুভব করে তারা মূলত তিনটি ধারায় বিভক্ত বা বিন্যস্ত হয়ে কাজ করছে।
১ম ধারা: একটি ব্যাপক জনগোষ্ঠী সারা মুসলিম বিশ্বেই এমন আছে যারা সকল বিরোধ ও সংঘাতমূলক পথ পরিহার করে শুধু নম্রÑকোমল ভাবে ইসলামের দাওয়াতি কাজে মনোনিবেশ করার পক্ষপাতি। ইতিবাচক ধারায় মানুষের ব্যক্তি সংশোধনের মাধ্যমে ইসলামের মিশনকে অগ্রসর করার চিন্তাই লালন করে এই ধারার মুসলমানগণ।
২য় ধারা: ইতিবাচক ধারায় দাওয়াতি কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলামের বিজয় প্রতিষ্ঠাকামী এরা। মুসলিম অধ্যুষিত জনপদগুলোতে ব্যাপক গণমানুষের সম্পৃক্ততায় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অন্যায়Ñঅবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তুলে ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে এরা। তবে সশস্ত্র জিহাদের পথে পা বাড়ায় না।
৩য় ধারা: তারা বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটেও জিহাদের কোনো বিকল্প পথে চলতে প্রস্তুত নয়। মুসলিম দেশ অমুসলিম দেশ নির্বিশেষে সকল স্থানেই যাবতীয় সমস্যার সমাধান জিহাদের পথেই আছে বলে তাদের বিশ্বাস। জিহাদ ছাড়া অন্য কোনো পথে মুসলমানদের বিজয় আসতে পারে নাÑ এমন চিন্তার বলিষ্ঠ ধারকÑবাহক এই মহলটি।
প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত তিনটি ধারার মধ্যে মূলত কোনো বিরোধ নেই। বরং সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার করলে উত্তম সমন্বয় সাধন সম্ভব। আজকের প্রেক্ষিতে এই সমন্বয়ের প্রয়োজনও অত্যধিক। সমন্বয়হীন প্রান্তিক চিন্তা জাতিয় জীবনে মুসলিম জাতির জন্য অনেক বিপর্যয় ডেকে আনছে। এই সেদিন ৫-৬ মে’ ১৩ ঢাকার শাপলা চত্বরে যে নতুন বালাকোট রচিত হলোÑ তা নিয়ে খোদ ইসলাম পন্থীদের মধ্যে নানা রকম মত ও দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করেছি। কাউকে বলতে শুনেছি এই ধরনের কর্মসূচির কী দরকার ছিলো? এগুলো রাজনীতি। যারা আল্লাহর পথে চলে, এই ধরনের কাজে তাদের সম্পৃক্ত হওয়া উচিত নয়। আবার বিপরীতমুখি মনোভাবও দেখেছি। অনেকে বলছে সেদিন যদি কিছু মানুষ সশস্ত্র প্রস্তুতি নিয়ে শাপলা চত্বরে থাকতো, তাহলে একতরফা ভাবে মুসলমানদেরকে এভাবে হত্যা করতে পারতো না যৌথবাহিনী। কাজেই তাদের বক্তব্য হলোÑ আগামীতে মাঠে নামতে হলে অস্ত্র নিয়েই নামতে হবে। অস্ত্র ছাড়া নামলে শুধু মার খেতে হবে। আল্লাহর নবীর সৈনিকদেরকে এভাবে হত্যা করার পর জিহাদে ঝাপিয়ে পড়া মুসলমানদের জন্য ফরজ হয়ে গেছে। এমন নানা ভাবনার মধ্য দিয়ে আসলে সঠিক চিন্তা কোনটি তা নির্ধারণ করা সাধারণ মানুষের পক্ষে বড়ই দুস্কর। আর তাই সম্পূর্ণ বিষয়টির ওপর ইসলামের মূলনীতির আলোকে একটা ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি লালন করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিষয়টির পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণের সুবিধার্থে প্রথমে জিহাদ সংক্রান্ত দুটি আলোচনা প্রয়োজন। জিহাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও ধাপে ধাপে জিহাদ ফরজ হওয়ার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট।
জিহাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ও প্রাসঙ্গিকতাসহ জিহাদের উদ্দেশ্য আলোচনা করলে জিহাদের উদ্দেশ্যের একটি দীর্ঘ তালিকা প্রণীত হতে পারে। তবে কোরআন ও হাদিস পর্যালোচনা করে মৌলিকভাবে জিহাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসাবে দুটি বিষয়কে নির্ধারণ করা যায়।
এক. আল্লাহর বিধান তথা ইসলামের গৌরব ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা।
দুই. কুফুর তথা খোদাদ্রহের প্রাবল্য খর্ব করা।
ইসলামি শরিয়তে জিহাদের মতো লড়াই সংঘাতের বিধান অন্তর্ভুক্ত থাকায় ইসলামের স্বভাবজাত দুশমনেরা বেশ সমালোচনামুখর হয়েছে। এবং ইসলামের মধ্যে সম্ভবত জিহাদ নিয়েই তাদের সমালোচনার মাত্রা সবচে বেশি। তাদের সমালোচনার মূল লক্ষ্যই হলো জিহাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে জিহাদের পবিত্র বিধানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা।
ইসলাম খুব সরল ও অকৃত্রিমভাবে মানুষকে বিশ্বাস শিক্ষা দিয়েছে যে, পৃথিবীটা হলো স্রষ্টার। পৃথিবীতে মানুষসহ যা কিছু আছে সবই সৃষ্টিকর্তার এখতিয়ারভুক্ত। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই জগতের শান্তি শৃঙ্খলার জন্য বিধান-ব্যবস্থা দিয়েছেন। যুগের বিবর্তনে স্রষ্টার দেওয়া সর্বশেষ ও চূড়ান্ত ব্যবস্থার নামই হলো ইসলাম। সুতরাং একটা রাষ্ট্রের মধ্যে যেরূপ রাষ্ট্রপ্রণীত বিধিÑবিধানের গৌরব রক্ষা হওয়া এবং রাষ্ট্রদ্রোহ দমন হওয়া যৌক্তিক ও কল্যাণকর পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হয়, তদ্রুপ সৃষ্টি জগতে স্রষ্টার মর্যাদা রক্ষা পাওয়া ও খোদাদ্রোহ নির্মূল হওয়ার ব্যবস্থাও প্রশংসিত হতে বাধ্য। খোদাদ্রোহী কুফরি ব্যবস্থা প্রাবল্য নিয়ে অধিষ্টিত থাকলে মানুষসহ সারা সৃষ্টিজগত তাদের স্রষ্টা প্রদত্ত মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। আর তাই খোদার এই জগতে খোদাদ্রোহের আধিপত্য ও প্রাবল্য মেনে নেওয়া যায় না। সুতরাং স্রষ্টার বিধানের মর্যাদা রক্ষা করা ও খোদাদ্রোহের অধিপত্য খর্ব করা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত উদ্দেশ্য। আর এই সুমহান উদ্দেশ্য অর্জনের জন্যই জিহাদের বিধান দেওয়া হয়েছে। কাজেই ইসলামের জিহাদ অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত ও সুমহান একটি বিধান।
জিহাদ ধাপে ধাপে ফরজ হয়েছে
জিহাদের হাকীকত উপলদ্ধি করতে চাইলে এবং জিহাদ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিতর্কের মীমাংসায় পৌঁছতে চাইলে ইসলামি শরিয়তে জিহাদের বিধান অর্ন্তভুক্ত হওয়ার প্রেক্ষাপট ও প্রেক্ষিত নিয়ে আলোচনা জরুরি। জিহাদের প্রেক্ষিত নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে প্রথমেই জানতে হবে যেÑ সকল তাগুত ও কুফুরের বিরুদ্ধে জিহাদের বিধান মহান আল্লাহ তায়ালা সূচনাতেই দেননি। বরং ধাপে ধাপে দিয়েছেন। ধাপগুলো নিুরূপ।
প্রথম ধাপ: জিহাদের বিধানের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনায় দেখা যায়, শুরুতে ইসলামি শরিয়তে জিহাদের অনুমতি ছিলো না। বরং নির্দেশ ছিলো শত্র“দের জুলুম নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করা আর ধৈর্য্য ধারণ করার। কোনোরূপ পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি ছিলো না। আল্লাহর নবী সা. মক্কায় থাকাকালীন তের বছর জুড়েই এমন বিধান বলবৎ ছিলো। এই সময়ে আল্লাহর হুকুম ছিলো ‘আপনাকে যে আদেশ দেওয়া হয় তা আপনি প্রকাশ্যে প্রচার করুন। আর মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহকে এড়িয়ে চলুন।’ (সুরা হিজর : ৯৪) ‘আপনি ক্ষমার নীতি অবলম্বন করুন। সৎ কাজের আদেশ দিন আর মুর্খ লোকদের এড়িয়ে চলুন।’ (সুরা আরাফ : ১৯৯)
মক্কি জিন্দেগিতে নবীজি সা. তার প্রিয় সাহাবিদের বলতেন ‘আমাকে ক্ষমা করতে বলা হয়েছে। সুতরাং তোমরা যুদ্ধে লিপ্ত হয়ো না। (নাসায়ি-বাইহাকি)
ইমাম কুরতুবি রহ. লিখেছেন ‘আল্লাহর নবীকে মক্কায় থাকাকালীন জিহাদের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
দ্বিতীয় ধাপ: সুদীর্ঘ তের বছর একতরফা ভাবে জালেম কাফের গোষ্ঠীর সবধরনের নির্যাতন ও নিগ্রহের শিকার হয়ে নবীজি সা. মদিনায় হিজরত করলেন। মুসলমানদের জন্য নিরাপদ একটা আশ্রয়ের ব্যবস্থা হলো। কিছু শক্তিও সঞ্চিত হলো। তখন মহান আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের জিহাদের অনুমতি দিলেন। জিহাদ করতে বাধ্য করলেন না। বরং জিহাদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে শুধু অনুমতি দিলেন। যারা স্বেচ্ছায় জিহাদ করতে আগ্রহী কেবলমাত্র তারাই জিহাদ করবে। এমন বিধান সম্বলিত আয়াত অবতীর্ণ হলো। ‘যারা আক্রান্ত হয় তাদেরকে (পাল্টা আক্রমণ তথা জিহাদের) অনুমতি দেওয়া হলো। যেহেতু তারা অত্যাচারিত। নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম।’ (সুরা হজ : ৩৯)
সুরা হজের এই আয়াতের অনুকূলে ইমাদুদ্দিন ইবনে কাসির রহ. লিখেছেন ‘অনেক পূর্বসূরীদের মতে এটিই হলো জিহাদের স্বপক্ষে অবতীর্ণ প্রথম আয়াত।
এভাবেই দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ থাকার পর প্রথমেই সীমিত পর্যায়ে অর্থাৎ কাফেরদের দ্বারা মুসলমানগণ আক্রান্ত ও নির্যাতিত হওয়ার প্রেক্ষিতে স্বেচ্ছায় জিহাদ করেত ইচ্ছুকদেরকে জিহাদের অনুমতি প্রদান করা হলো।
তৃতীয় ধাপ: তৃতীয় ধাপে শুধু ঐচ্ছিক পর্যায়ের অনুমতি নয়। বরং কাফের জালেমদের দ্বারা মুসলিম জনপদ বা জনগোষ্ঠী আক্রান্ত হলে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অব্যশ্যকীয় বিধান দেওয়া হলো। অর্থাৎ এখন আর জিহাদ ঐচ্ছিক বিধান রইল না। বরং আক্রান্ত হলে পাল্টা আক্রমন ও রুখে দেওয়ার নিমিত্তে জিহাদ করা ফরজ হয়ে গেল। এই পর্যায়ে পবিত্র কোরআন পাকের আয়াত অবতীর্ণ হলো। ‘যারা তোমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। আর সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা বাকারা : ১৯০)
চতুর্থ ধাপ: শুধু আক্রান্ত হওয়ার পরই নয় বরং আল্লাহর বিধানের বিজয় ও খোদাদ্রোহী শক্তির আধিপত্য ও প্রাবল্য খর্ব করার লক্ষে যেখানেই ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো আদর্শের বিজয় প্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহ তায়ালার সেই জমিনকে সেই হানাদারের কবল থেকে মুক্ত করে সেখানে জিহাদ করাকে ফরজ করা হলো। জিহাদের মাধ্যমে খোদাদ্রোহী শক্তি অধ্যুষিত সকল ভূখণ্ডকে মুক্ত স্বাধীন করতে মুসলমানদের ওপর অবশ্যিক বিধান জারি করা হলো। সুরা তওবায় আল্লাহ তায়ালা বিস্তারিত হুকুম ঘোষণা করলেন। ৯ম হিজরি সনের হজ্বের প্রাক্কালে অবতীর্ন আল্লাহর এই হুকুম আল্লাহ ও তার নবী সা. এর পক্ষ থেকে আবু বকর সিদ্দিক রাযি. এর নেতৃত্বে আলী রাযি. হজ্বের সময় ঘেষণা করে শুনালেন।
‘সম্মানিত মাসগুলো (জিলকদ, জিলহজ্ব ও মুহাররম) শেষ হওয়ার পর খোদাদ্রোহী মুশরিকদেরকে যেখানে পাবে হত্যা করবে। তাদেরকে পাকড়াও করবে, আবদ্ধ করবে আর ওঁৎপেতে থাকবে তাদের জন্য প্রতিটি ঘাটিতে।’ (সুরা তওবা:৫)
একই সুরায় আল্লাহ তায়ালা বলেছেন ‘আহলে কিতাবদের মধ্য থেকে যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে না এবং আল্লাহ ও তার রাসুল সা. যা কিছু হারাম করেছেন সেগুলোকে হারাম মানে না এবং সত্য দ্বীন অনুসরণ করে না, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর যে পযর্ন্ত না তারা নত হয়ে জিযইয়া (কর) আদায় করে। (সুরা তওবা : ২৯)
আর সুরা আনফালের বক্তব্য তো আরও দ্বার্থহীন ‘আর তোমরা কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর যতক্ষন না ফিতনা নির্মূল হয়। এবং সম্পূর্ণ আল্লাহর আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। (সুরা আনফাল:৩৯)
ফিতনা অর্থ আল্লাহর বিধান পালনে প্রতিবন্ধকতা থাকা। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর যত বিধান আছে এই বিধান শতভাগ বাস্তবায়িত করার পথে সকল বাধাÑপ্রতিবন্ধকতা যতদিন সম্পূর্ণরূপে উৎখাত না হবে ততদিন এ কথা বলা যাবে না যে, ফিতনা নির্মূল হয়েছে। আর এটা সম্ভব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের মাধ্যমে। তাই সুরা আনফালের এই আয়াত দ্ব্যর্থহীনভাবে সারা পৃথিবীতে ইসলাম কায়েম না হওয়া পযর্ন্ত জিহাদ করাকে মুসলমানদের ওপর ফরজ করে দিয়েছে।