এক রাতুলের মন এত ভালো শেষ কবে ছিল মনে করতে পারছে না ও। ওর জীবনে বড় বড় আনন্দের প্রবেশাধিকার প্রায় নিষিদ্ধ। ছোট ছোট আনন্দ নিয়েই ওর বসবাস। এরপরও এই ক্ষুদে আনন্দগুলো যে অহরহ ওর জীবনে আসে তাও না। এজন্যই শেষ আনন্দের মুহূর্তটা মনে করতে গিয়ে মোটামুটি ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে ওকে। যতদূর মনে পড়ছে মাস কয়েক আগে যেদিন ফাইভ পাশ করে ক্লাস সিক্সে উঠল সেদিনও এরকমই আনন্দ হয়েছিল ওর। অনেক বড় মনে হয়েছিল নিজেকে। তবে এটাই একমাত্র কারণ ছিল না। রাতুল ধরেই নিয়েছিল, ফাইভ পাশ করার পর ওকেও ওর বেশিরভাগ বন্ধুর মতো হোটেলের বয় কিংবা টেম্পুর হেলপার হতে হবে। হোটেলের ওয়েটার বা লোকাল বাসের হেলপার হতে হলে আগে এসব করে করে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয় রাতুল জানে। ওর বন্ধুরা ওকে বলে। ও আরো জানে, ড্রাইভার কিংবা ওয়েটারদের ‘ওস্তাদ’ বলে ডাকতে হয়। হামিদ অবশ্য কিভাবে কিভাবে যেন প্রথমবারেই একটা লোকাল বাসের হেলপার হয়ে গেছে। বন্ধুদের কাছে ওর অন্যরকম একটা দাম আছে। ইনকামটাও ওর একটু বেশি। মাঝে মধ্যেই স্টার সিগারেট খাওয়ায় ওদের। রাতুল অবশ্য সিগারেট খায় না। ওর বন্ধুদের খেতে দেখে একদিন একটা টান দিয়েছিল। টান দেয়ার পরবর্তী কয়েকমিনিট ওর মাথা ঝিম ধরে থাকায় আর কখনো ও জিনিসে হাত দেয়নি। তবে হামিদ, শরীফ, বিকাশ, মোমেন ওরা দিব্যি টেনে যায়। সিগারেট খেলে নাকি ক্লান্তি দূর হয়, টেনশন থাকে না, আরো কী কী সব হাবিজাবি বলে ওরা। রাতুলের এসব বিশ্বাস হয় না। এই অভ্যেস আসলে বাইরে কাজ করতে গিয়ে হয়েছে ওদের। রাতুল যদি ওদের মত কাজ করত তাহলে হয়ত ওরও এমনটাই মনে হত। ‘ওস্তাদের’ দেখা দেখি সিগারেট টেনে যেত দ্বিধাহীন। কিন্তু এমনটা হয়নি। ওদের স্কুলে যেদিন ভর্তি শুরু হয় ও সেদিন ইচ্ছে করেই যায়নি ভর্তি হতে। রাতেরবেলা ওর বাবা রিকশা চালিয়ে এসে বলে, ‘কিরে, ইস্কুলে গেলি না কেন ভর্তি হইতে?’ রাতুল কথা না বলে মাথা নিচু করে রাখে। ‘পড়াশোনা না কইরা লায়েক হবি? এই সব টাল্টি বাল্টি চলব না। কাইল সকালেই ইস্কুলে যাবি। এরপর ওর মা’র দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সালেহা, ও জানি কাইল ইস্কুলে ভর্তি হয়-এইটা দেখার দায়িত্ব তুমার। আমরা গাধা হইছি দেইখা পোলাডাও গাধা হইব, এইডা তো কুনো কথা না...ওই হাসোছ কেন তুই?‘ ‘হাসি না তো আব্বা!’ বলতে বলতে ফিক করে হেসে ফেলে রাতুল। সেদিন যেমন আনন্দ হয়েছিল আজকের আনন্দটাও প্রায় ওই রকমই। একটু বেশিই বরং। কাল ঈদ। ওর বন্ধুরা বেশ প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে ঈদের। এক ধরনের সিগারেট নাকি আছে, যেটাতে দুর্গন্ধ নেই। টানলে কেমন যেন এলাচির সুবাস পাওয়া যায়। এক এক শলা পনেরো টাকা করে। ওর বন্ধুরা ঈদ উপলক্ষে ওরই এক প্যাকেট নিজেরা নিজেরা চাঁদা উঠিয়ে কিনেছে। ঈদের দিন রাতে খাওয়া হবে। এছাড়াও দিনের বেলা সবাই একসাথে পাঞ্জাবি পরে ঘুরতে বের হবে। পরিকল্পনা হয়েছে, সবার পাঞ্জাবি একই রকম হবে। সবার পাঞ্জাবি জোগাড়ও হয়ে গেছে, রাতুলেরটা ছাড়া। পাঞ্জাবিটা খুব বেশি দামি তা না, মাত্র চারশ টাকা। কিন্তু এই সামান্য টাকা রাতুলের রিকশাচালক বাবার জন্য অনেক বেশি কিছু। দিবো-দিচ্ছি করে করে পুরোটা রমজান চলে গেছে। পাঞ্জাবিটা আর পাওয়া হয়নি রাতুলের। তবে ওর বাবা কথা দিয়েছে ওর জন্য আজ পাঞ্জাবি অবশ্যই কেনা হবে। বাবা আজ রিকশা নিয়ে বের হয়েছে রাতুলের পাঞ্জাবির টাকা জোগাড় করতে। ওর কাছে কিছু টাকা আছে, সেটা দিয়ে কাল হাত খরচ চালিয়ে নিতে পারবে, এখন শুধু পাঞ্জাবির অপেক্ষা। রাতুল অনেক খুশি।
দুই ‘খচ্চরের গুষ্টি কুনহানকার! বলে একদলা থুথু সামনে দিয়ে পাই পাই করে ছুটে যাওয়া একটা অটো রিকশার গায়ে লাগাতে গিয়েও ব্যার্থ হল ফারুক মিয়া। বিড়বিড় করে চাইনিজদের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে লাগল সে। এই ‘খচ্চর’ জাতি এক ধরনের ব্যাটারি চালিত অটো রিকশা আবিস্কার করল, সেটা এ দেশে আমদানি হল আর রিকশাওয়ালাদের পেটে লাথি পড়ল। একটা অটো রিকশাতে গাদাগাদি করে মোটামুটি একটা মাইক্রোর চাইতে বেশি মানুষ নেয়া হয়! ভাড়া রিকশার চাইতে তিনগুন কম। গতিও বেশি। ক’জনের অমন তালুকদারি আছে অটো রিকশা রেখে তার রিকশাতে উঠবে? এবার রোজা ত্রিশটা হচ্ছে। কাল নিশ্চিত ঈদ। অথচ এখনো অনেক অনিশ্চয়তা ঘিরে রেখেছে ফারুক মিয়াকে। সারাটা রোজার মাস ধরে এই দিনটার জন্য অল্প অল্প করে টাকা জমিয়েছে ফারুক। সারা বছর আধপেটা খেয়ে থাকা হয়। ঈদের একটা দিন তো ভাল মন্দ কিছু খেতে ইচ্ছে হয়ই। এজন্য টাকা জমিয়েছে ফারুক। পোলাও, মুরগি আর সেমাই কেনা হবে এ টাকা দিয়ে। একেবারে হিসেব করা টাকা। এখান থেকে ছেলেটাকে চারশ টাকা দিয়ে পাঞ্জাবি কিনে দিলে কালকের দিনটাও প্রতিদিনের মতো কাটবে তাদের। আজ অনেক সকালে বের হয়েছে ফারুক। ভেবেছিল সারাদিন রিকশা চালালে রাতুলের পাঞ্জাবি কেনার টাকাটা জোগাড় হয়ে যাবে। ছেলেটা কখনো কিছু চায় না, এবার ঈদে একটা পাঞ্জাবিই শুধু চেয়েছে। কিন্তু মনে হচ্ছে না সেটা দিতে পারবে সে। মাত্র শ’দেড়েক টাকা সেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জোগাড় করতে পেরেছে। ঈদের আগে কেউ টাকা ধার দেবে এমন কোনো সম্ভাবনাও সে দেখতে পাচ্ছে না। ফারুক এইমাত্র সিদ্ধান্ত নিল বাজারের টাকা দিয়েই রাতুলের পাঞ্জাবি কিনে দেবে। ৩৬৪ দিন আধ পেটা খেয়ে থাকতে পারলে আর একটা দিনও পারবে। রাতুল যে পাঞ্জাবি চেয়েছে সেটাই কিনে দেবে সে। অন্তত এই একটা ক্ষেত্রে কোনো কৃপণতা নয়। সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষণ আগে। একটা মসজিদ থেকে ইফতারি করে নামাজ পড়ে বেরিয়েছে সে একটু আগেই। এতক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে রিকশা চালিয়ে একটা আবাসিক এলাকার মধ্যে ঢুকে পড়েছে ফারুক। পুরোপুরি উদ্দেশ্যহীনও বলা যাবে না। ঈদের আগের দিন এসব এলাকায় ভাড়া পাওয়ার সম্ভবনা আছে। হঠাৎ ফারুক খেয়াল করে দেখল, সে একটা নির্জন রাস্তায় এসে পড়েছে। যতদূর দেখতে পাচ্ছে রাস্তায় কোনো মানুষ নেই। যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। ফারুক রিকশা ঘুরিয়ে নিয়ে সামনে তাকাতেই বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল তার। রাস্তার পাশের অন্ধকার কোণ থেকে দুটো ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এসেছে। এখন দ্বিতীয়বারের মতো রিকশা ঘুরিয়ে নেয়ার উপায় নেই। ছায়ামূর্তি দুটো ধীর কিন্তু নিশ্চিত পদক্ষেপে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। বুক পকেটে রাখা টাকাগুলোর দিকে একবার তাকাল ফারুক মিয়া। রিকশার হ্যান্ডেলটা শক্ত করে চেপে ধরল।
তিন রাতুলের মন খারাপ। কান্না পাচ্ছে খুব, কিন্তু কাঁদতে পারছে না। এখন যথেষ্ট বড় হয়েছে ও, চাইলেও কাঁদা যায় না? তবে কতক্ষণ কান্না চেপে রাখতে পারবে ও জানে না। মা’ও বেশ কিছুক্ষণ ধরেই ছটফট করছে। রাত প্রায় বারটা বাজে। বাবা কখনোই এত রাত করে না। আজ তো আরও তাড়াতাড়ি চলে আসার কথা। ওদের বস্তিতে ঈদ শুরু হয়ে গেছে। কেউই বোধহয় ঘরে নেই। সবাই বাইরে এসে দল বেধে গল্প করছে। ছোটরা হই চই করছে। একটু পর পরই বেসুরো গলায় ‘রমজানের ওই রোজার শেষে’ গেয়ে উঠছে। অবশ্য কারো কাছেই এই মুহূর্তে গানটাকে ‘বেসুরো’ মনে হচ্ছে না। ব্যাতিক্রম শুধু সালেহা আর রাতুল। রাতুলের বন্ধুরা কয়েকবার করে ডেকে গেছে ওকে। ও যায়নি। ও মনে প্রাণে চাইছে মাথা থেকে খারাপ চিন্তাগুলোকে সরিয়ে রাখতে। নিজের মনেই আউড়ে যাচ্ছে ‘আমার বাবার কিচ্ছু হয়নি, ঠিক চলে আসবে।’ এরপরও যখনই বাইরে থেকে হই চই-এর আওয়াজ বেড়ে যায় সাথে সাথে রাতুলের বুকটাও চিলিক দিয়ে ওঠে অজানা শংকায়। ‘মা, আব্বা কখন আসবো?’ ‘আমি কী জানি।’ অকারণেই ঝাঁজিয়ে ওঠে সালেহা। রাতুল চুপ মেরে যায়। এখন আর রাতুলের পাঞ্জাবির একটুও দরকার নেই। ওর শুধু বাবাকে খুব প্রয়োজন। বাবা এলে ও মা’কে বলবে ওর পুরনো পাঞ্জাবিটা ভালো করে ধুয়ে দিতে। রাতের মধ্যেই শুকিয়ে যাবে। কাল সকালে লন্ড্রি থেকে ইস্ত্রি করিয়ে আনলে কেউ বুঝতেই পারবে না পাঞ্জাবিটা পুরনো। হাতার কাছে একটু ছেঁড়া আছে অবশ্য। হাতাটা গুটিয়ে নিলেই হবে। এক রকম পাঞ্জাবি না হওয়ায় ওর বন্ধুরা ওকে ঘুরতে না নিলেও সমস্যা নেই। ও বাসায় বসে থাকবে সারাদিন। এরপরও বাবাকে ভীষণ প্রয়োজন রাতুলের। ভী-ষ-ণ। সময় বয়ে যাচ্ছে। রাত গভীর হচ্ছে, আরো গভীর...।
উপসংহার কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল রাতুল। ঘুম যখন ভাঙ্গল তখন বাবার মুখটাকে চোখের সামনে ঝুঁকে থাকতে দেখা গেল। বাবাই ঘুম ভাঙিয়েছে ওর। রাতুল ধড়মড় করে উঠে বসল। ‘কী হইছিল আব্বা তোমার?‘ ‘আরে আর কইস না রে ব্যাটা। দুইটা পোলা ঈদের পরেরদিন কী অনুষ্ঠানের লিগা বন্ধু বান্ধবরে দাওয়াত দিব তাই আমারে ভাড়া করল। সেই সন্ধ্যা থিকা রাইত একটা পর্যন্ত দুনিয়া ঘুইরা বেড়াইলাম। ম্যালা ট্যাকা ভাড়া দিছে। বখশিশও পাইছি। এরপর বাজার সদাই কইরা আইতে আইতেই দেরি হইয়া গেল। এই যে নে তর পাঞ্জাবি।’ বলতে বলতে একটা প্যাকেট রাতুলের হাতে ধরিয়ে দেয় ফারুক। রাতুল কোনো কথা বলতে পারল না। বাবাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে।
এক ধরনের ছায়া পড়েছে রাতুলের দু’চোখে। রঙিন ছায়া।
জোনাকিরা আর আলো দেবে না
সাব্বির জাদিদ
নিজাম সাহেব অন্ধকার বারান্দায় বসে আছেন। প্রতিদিন এই সময় তিনি দোতলার বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে থাকেন। অন্যদিন বারান্দায় আলো জ্বলে। আজ জ্বলছে না। কারণ তিনি ভয়ানক অস্থিরতা বোধ করছেন। একটু পরপর তোয়ালে দিয়ে কপালের ঘাম মুচ্ছেন। সকালে মুুষলধারে বৃষ্টি হয়েছিল। এখন প্রচণ্ড গরম পড়েছে। নিজাম সাহেব চাচ্ছেন না তার অস্থিতরা অন্য কারো নজরে পড়–ক। সেই জন্য বারান্দায় অন্ধকার। নিজাম সাহেব ফুলকিকে ডাক দিলেন। ফুলকি, এই ফুলকি! এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি আনতো। নিজাম সাহেবের ধারণা ফুলকি নামের মেয়েরা খুব ফাঁকিবাজ হয়। ফুলকি তার ধারণার থেকেও বেশি ফাঁকিবাজ। ফুলকির বাড়ি বরিশাল। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে দিনাজপুর। এই মিথ্যাটা সে কেন বলে কে জানে। ফুলকির খুব পানের নেশা। সে সব সময় পানের বাটা আর সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কোনো কাজে ডাকলে সহজে সায় দেয় না। কিন্তু আজ সাথে সাথেই পানির গ্লাস নিয়ে হাজির। নিজাম সাহেব আজ অস্থির- এটা কি সে টের পেয়েছে? পেতে পারে। ফুলকি কাজের মেয়ে হলেও তার হুশবুদ্ধি টনটনে। পানির গ্লাস নিজাম সাহেবের হাতে দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে রইল ফুলকি। নিজাম সাহেব এক ঢোক পান করে গ্লাস ফিরিয়ে দিলেন। ফুলকি অবাক গলায় বলল, খালুজানের কি শরীর খারাপ? নিজাম সাহেব ফুলকির কথায় না ঢুকে বললেন, লামিয়া কি ঘুমিয়ে পড়েছে? -না খালুজান, ঘুমায়নি। আপামনি জোনাকি নিয়ে খেলতাছে। -রাত সাড়ে বারটা বাজে এখনও জোনাকি নিয়ে খেলছে? ওর মা কোথায়? -খালাম্মাতো ঘুমে। খালুজান আপনে যদি পারমিশন দেন আমি আপামনির গালে একটা থাপ্পর দিয়ে আসি। অনেক দিন কাউকে থাপ্পর দিই না। নিজাম সাহেব গরম চোখে ফুলকির দিকে তাকালেন। কিন্তু অন্ধকারে ফুলকি কিছুই টের পেল না। সে আগের মতোই বলল, না থাক, মাঝ রাইতে থাপ্পর দিলে বেশি ব্যথা পাইব। আপনে বললে আপামনির জোনাকির বয়াম এক আছাড় দিয়ে ভেঙে আসি। নিজাম সাহেব এবার আর গরম চোখে তাকালেন না। তোয়ালে দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে লাগলেন। লামিয়া নিজাম সাহেবের একমাত্র মেয়ে। এবার ক্লাস ফাইভে। নিজাম সাহেবের বয়সের দিকে তাকালে যে কেউ ভাববে লামিয়া তার নাতনি। আসলে নিজাম সাহেব দীর্ঘদিন নিঃসন্তান ছিলেন। ডাক্তার, কবিরাজ, মাজার অনেক জায়গায় ধরন দিয়েছেন। কাজ হয়নি। শেষমেশ মান্নত করেন- সন্তান হলে হাফেজ বানাবেন। এর দুই সপ্তাহ পরেই নিজাম সাহেবের স্ত্রী লামিয়াকে পেটে ধরেন। লামিয়া একই সাথে ইস্কুলে পড়ছে এবং হাফেজ হচ্ছে। নিজাম সাহেবের পাশেই একটা বড় মাদরাসা আছে। মাদরাসার নাম তিনি মনে রাখতে পারেন না। শুধু ‘জামেয়া’ শব্দটা মনে আছে। এই মাদরাসার এক হাফেজ ছেলেকে তিনি মেয়ের পড়ানোর জন্য ঠিক করেছেন। ছেলেটার নাম লাবিব। সে প্রতিদিন বিকেলে এসে লামিয়াকে সবক দিয়ে যায়। ভোরে এসে শোনে। লামিয়ার এগারো পারা চলছে। লামিয়ার মাথা খুব ভালো। ভালো মাথার মেয়েরা আবার হুজুগে হয়। উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে। কয়েকদিন আগে সে একটা স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে সে জোনাকির মালা গেথে গলায় পরে আছে। সুতোয় গাথা জোনাকিরা জ্বলছে আর নিভছে। স্বপ্নে সব কিছু সুন্দর হয়। লামিয়া একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেল। ঘুম ভেঙেই সে জোনাকির বায়না ধরলো। জোনাকির মালা গেথে গলায় পরবে। রাতে অন্ধকার বারান্দায় হেঁটে বেড়াবে। তার গলা ভর্তি জোনাকি জ্বলবে আর নিভবে। মেয়ের বায়না শুনে চিন্তায় পড়ে গেলেন নিজাম সাহেব। ঢাকা শহরে তিনি জোনাকি পাবেন কোথায়? ঢাকা শহর স্বার্থপর জায়গা। জোনাকি স্বার্থহীন পোকা। এরা নিঃস্বার্থে আলো জ্বেলে রাখে। এদের স্বার্থপর শহরে বাস করার কথা না। পড়াতে এসে লামিয়ার বায়নার কথা শুনল লাবিব। লাবিবের বাড়ি কুষ্টিয়া ছুটিপুরে। সেখানে প্রতি সন্ধ্যায় জোনাকির মেলা বসে। সে ছুটিতে বাড়ি গিয়ে কাচের বয়ামে অনেক জোনাকি ধরল। ঢাকায় ফিরে এক সন্ধ্যায় জোনাকির বয়াম নিয়ে হাজির হলো লামিয়াদের বাসায়। বয়ামভর্তি জোনাকি দেখে লামিয়ার জ্ঞান হারানোর অবস্থা। সে বয়ামটা কেড়ে নিয়ে লাফাতে লাফাতে বলল, হুজুর ভাইয়া! কোত্থেকে জোনাকি আনলেন? লাবিব বলল, আমাদের গ্রাম থেকে। -আপনাদের গ্রামে বুঝি অনেক জোনাকি? -হুম। -আমি আপনাদের গ্রামে যাবো জোনাকি ধরতে। -অবশ্যই যাবে লামিয়া। -আমি এখন জোনাকি দিয়ে মালা গাথব। -মালা গাথলে তো ওরা মারা যাবে। -কেন মারা যাবে? ওদের পেটের ভেতর সুই ঢোকালে তো বাঁচবে না। -তাহলে মালা গাথব না। বয়ামে রেখে খেলব। এরপর থেকে প্রতিদিন শোয়ার আগে লামিয়া জোনাকি নিয়ে খেলা করে। নিজাম সাহেব আরেক গ্লাস পানি চাইলেন। ফুলকি আরেক গ্লাস পানি দে তো। আগের পানি বদলে দে। ফুলকি আগের পানি বেসিনে ফেলে নতুন করে পানি এনে দিল। নিজাম সাহেব এক ঢোক খেয়ে আবার ফেরত দিলেন। একটু পর হয়তো আবার পানি চাইবেন। ঢাকা শহরে এমনিতে খাবার পানির সংকট। নিজাম সাহেব এটা বুঝতে পারছেন না। শিল্পপতিদের এসব বোঝার কথাও না। মাথায় বালতি তুলে দিয়ে বস্তিবাসীর সাথে লাইনে দাঁড় করিয়ে দিলে বুঝতে পারতেন ঠেলা। -লামিয়াকে ঘুমিয়ে পড়তে বল। -খালুজান লামিয়া আমার কথা শোনে না। আমি চাকরানি মানুষ। -বল অনেক রাত হয়েছে। কাল খেলা যাবে। -বলতাছি খালুজান -নিজাম সাহেব পায়চারি করতে লাগলেন। তিনি দারোয়ানকে কঠিনভাবে হুশিয়ারে করে দিয়েছেন। আজ রাতে কেউ যেন বাড়িতে না ঢোকে। এই রাতে কারো বাড়ি ঢোকা মানে বিরাট ঝামেলা। নিজাম সাহেব আবার ফুলকি ফুলকি করতে লাগলেন। তার তেষ্টা পেয়েছে। নিজাম সাহেবের অস্থিরতার প্রসঙ্গে বলা যাক। আজ রাতে হেফাজতে ইসলাম মতিঝিলে অবস্থান নিয়েছে। হেফাজত নিয়ে তার তেমন মাথা ব্যথা নেই। মাথা ব্যথা অন্য জায়গায়। মতিঝিলে তার আটতলা বিল্ডিং আছে। নিলুফা টাওয়ার। সেকেন্ড ফ্লোর ছাড়া পুরো বিল্ডিং ভাড়া দেয়া। নিলুফা টাওয়ারে দুটো বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়। সেকেন্ড ফ্লোরে প্রাইভেট ফার্মের অফিস। শোনা যাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম অনেক স্থাপনায় আগুন দিয়েছে। আল্লাহ না করুক নিলুফা টাওয়ারে আগুন দিলে তার মহাসর্বনাশ হয়ে যাবে। অবশ্য হেফাজতকর্মীদের আগুন দেয়ার ঘটনা তার কাছে ধোয়াশাপূর্ণ মনে হচ্ছে। লাবিবকে তিনি দেড় বছর ধরে দেখছেন। এরাই তো হেফাজতের আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। এদের মতো নরম শান্ত ছেলেদের হাতে আগুন জ্বালাটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। এর ভেতর রহস্য আছে নিশ্চয়। পরে জানা যাবে। নিজাম সাহেব টিভি চালু করলেন। দিগন্ত আর ইসলামিক টিভি মতিঝিলের দৃশ্য সরাসরি দেখাচ্ছে। তিনি বত্রিশে গেলেন। বত্রিশে দিগন্ত টিভি। কিন্তু দিগন্ত টিভিটা কোথায় গেল? হিন্দি চ্যানেলে নাচ হচ্ছে। তিনি তেইশে গেলেন। ইসলামিক টিভিও উধাও। তিনি এক থেকে বিরানব্বই পর্যন্ত সবগুলো চ্যানেল ঘটালেন। সব আছে। ওই দুটো নেই। কিসের ভেতর কি হচ্ছে তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি আবার চেয়ারে গিয়ে বসলেন, তার বাড়িটা মগবাজারে। দোতলা বাড়ি। উপর নিচে খালি পড়ে থাকে। সংসারে তারা তিনটা মাত্র প্রাণী। আর আছে ড্রাইভার। কাজের মেয়ে আর দারোয়ান। ড্রাইভার ছুটিতে আছে। গাড়ি নষ্ট হয়ে গ্যারেজে পড়ে আছে। এই সুযোগে ড্রাইভার ছুটি নিয়েছে। বাড়ির চার পাশ উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বাড়ির সামনে এক টুকরো খোলা জায়গা। কয়েকটা গোলাপ গাছ। নিজাম সাহেব কান খাড়া করলেন। মগবাজার থেকে মতিঝিল বেশ দূর। তবুও রাতের নীরবতার সুযোগে গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। নিজাম সাহেব এমনিতেই ভীত মানুষ। গুলির শব্দে তিনি অল্প অল্প কাঁপতে লাগলেন। একবার মনে হলো নিলুফাকে ডেকে পাশে বসিয়ে রাখেন। ভয়ের সময় বউ পাশে থাকলে সাহস আসে। কিন্তু নিলুফা ঘুমাচ্ছে। ঘুমের সময় তাকে ডাকা যাবে না। নিজাম সাহেব কতক্ষণ চেয়ারে বসে আছেন বুঝতে পারেননি। হঠাৎ খেয়াল করলেন পাঁচিলের ওপর থেকে ঝুপ করে কী যেন নিচে পড়লো। তিনি হায়দার হায়দার বলে চিৎকার করে উঠলেন। হায়দার আলী নিজাম সাহেবের দারোয়ান। সে নিশ্চিন্তে চেয়ারে বসে ঘুমুচ্ছিল। হঠাৎ ডাক শোনে ঘুমের ঘোরে গেটের দিকে দৌড় দিল। লোহার গেটের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে চিত হয়ে পড়ল। পরক্ষণে সামলে নিয়ে নিজাম সাহেবের কাছে ছুটে এলো। নিজাম সাহেব অস্থির গলায় বললেন, দেখতো দেয়ালের পাশে কী যেন নড়ছে! হায়দার আলী টর্চের আলো ফেলল। সাদা টাইপের কী যেন নড়ছে। হায়দার আলী ভয়ে ভয়ে কাছে এগিয়ে গেল। এবং চিৎকার করে বলল, স্যার খুন! নিজাম সাহেব দ্রুত দোতলা থেকে নামলেন। চিৎকার চেচামেচিতে নিলুফারও ঘুম ভেঙে গেছে। তিনিও নিজাম সাহেবের পেছন পেছন নিচে নেমে এলেন। কাছে গিয়ে দেখা গেল সাদা পাঞ্জাবি পড়া একটা ছেলে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। কাঁধ ভেসে যাচ্ছে রক্তে। নিজাম সাহেব কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, কে কে কে এখানে? মানুষের সাড়া পেয়ে সাদা পাঞ্জাবি ক্লান্ত শরীর টেনে পেছন ফিরে তাকালো। নিজাম সাহেব আর্তনাদ করে উঠলেন, হায় আল্লাহ! লাবিব তুমি! লাবিবকে ধরা ধরি করে দোতলায় আনা হলো। তার কাঁধে গুলি লেগেছে। অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। সারা শরীর রক্তে ভেজা। লাবিব ডান কাঁধে শুয়ে আছে। তার গুলি লেগেছে বাম কাঁধে। ফুলকি আইসব্যাগ দিয়ে তার কাঁধ চেপে ধরে আছে। ফুলকির হাতে রক্ত লেগে যাচ্ছে। গুলিবিদ্ধ মানুষের কাঁধে আইসব্যাগ ধরে রাখা খুব সহজ নয়। কিন্তু ফুলকি খুব আনন্দ নিয়েই কাজটা করছে। তার মুখে পানের খিলি দেখে বুঝা যাচ্ছে সে বেশ আনন্দিত। লাবিবের জ্ঞান আছে কি না বুঝা যাচ্ছে না। সে চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে। মাঝে মাঝে ঠোঁট নড়ছে। নিজাম সাহেব অস্থির গলায় বললেন, একে হসপিটালে নিতে হবে। এক্ষণি। হায়দার আলী বলল, স্যার সকাল হোক। এখন ওকে নিয়ে বের হওয়া ঠিক হবে না। সকাল হতে তো বেশ দেরি। নিলুফা দেখোতো কয়টা বাজে। নিলুফা ঘড়ি দেখে বললেন, চারটা সতের। এখনও এক ঘণ্টার মতো বাকি। ছেলেটার এই অবস্থা। হায় আল্লাহ! কী যে করি। গাড়িটা বাড়ি থাকলেও হতো। লামিয়ার ঘুম ভেঙে গেছে। সে কয়েক বার আম্মু আম্মু করে ডাকল। সাড়া না পেয়ে ড্রইংরুমে আসল। সে অবাক হয়ে দেখল আব্বু আম্মু দুজনই জাগা। দুজনেরই থমথমে মুখ। একটা ছেলে উল্টোমুখে কাত হয়ে শুয়ে আছে। ছেলেটার গায়ে রক্ত। ফুলকি আইসব্যাগ ছেলেটার কাঁধে চেপে ধরে আছে। লামিয়া অবাক গলায় বলল, আম্মু এখানে কী হচ্ছে। নিলুফা মেয়েকে নিজের কাছে টেনে নিলেন। বললেন, তোমার হুজুর ভাইয়ার গুলি লেগেছে। দোয়া করো মণি। লামিয়া ভয় পাওয়া গলায় বলল, হুজুর ভাইয়ার গুলি লেগেছে! লামিয়া দৌড়ে লাবিবের কাছে গেল। মুখ নামিয়ে ভাইয়া ভাইয়া বলে ডাকতে লাগল। লাবিব অস্ফুট স্বরে বলল, পানি খাবো। লামিয়া বলল, আম্মু, ভাইয়া পানি খাবে। নিজাম সাহেব বললেন, নিলুফা পানিতে গ্লুকোজ মিশিয়ে ওকে একটু খাওয়াও। দেখ জ্ঞান আসে কি না। নিলুফা গ্লুকোজ গোলাতে লাগলেন। একটু পর চা-চামচে লাবিবের মুখে গ্লুকোজ পানি দিতে লাগলেন। লামিয়া চিন্তিত মুখে আম্মুর পাশে বসে রইল। বেশ কিছুক্ষণ পর লাবিব চোখ মেলল। শোনা যায় না এমন স্বরে বলল, আমি কোথায়? লামিয়া মুখের উপর ঝুকে পড়ে বলল, হুজুর ভাইয়া কী বলছেন? লাবিব আবার বলল, আমি কোথায়? লামিয়া বলল, আমি লামিয়া। আপনি আমাদের বাসায়। পাশে আব্বু আম্মু বসে আছেন। আমাকে চিনতে পারছেন? -চিনতে পারছি। তুমি লামিয়া না? -জ্বি ভাইয়া। আমি লামিয়া। নিলুফা বললেন, তোমার কেমন লাগছে বাবা? -খুব ব্যথা। কাঁধ ছিড়ে যাচ্ছে ব্যথায়। আচ্ছা এখন দিন না রাত। -রাত বাবা। একটু পরেই ভোর হবে। তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো। -চাচিজান, সকাল পর্যন্ত আমি বাঁচবো না। আমি সবুজ গাছপালা আর সুন্দর পাখি দেখতে পাচ্ছি। লাবিবের কথায় নিজাম সাহেব ও নিলুফা বেগম ভয় পেয়ে গেলেন। দুজন নিঃশব্দে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলেন। একটু পর নিলুফা বললেন, বাবা আরেকটু পানি খাবে? লাবিব বলল, খাবো। আজ খুব তেষ্টা পাচ্ছে। নিলুফা চামচে করে পানি খাওয়াতে লাগলেন। -মায়ের সঙ্গে কথা বলবে বাবা? -মা চিন্তা করবেন। থাক বলার দরকার নেই। -নিজাম সাহেব বললেন তোমার এই অবস্থা কী করে হলো? -মতিঝিল থেকে চলে আসছিলাম। খুব গোলাগুলি হচ্ছিল। পথে গুন্ডারা আমাকে ধাওয়া করে। পালাতে গেলে গুলি করে পেছন থেকে। আর কিছু মনে নেই। -তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে বাবা? -হচ্ছে চাচাজান। মনে হচ্ছে শরীর থেকে আমার কাঁধ আলাদা হয়ে যাচ্ছে। -সব ঠিক হয়ে যাবে বাবা। একটু ধৈর্য ধরো। নিজাম সাহেব এক পাশে সরে গিয়ে চোখ মুছতে লাগলেন। লাবিব আবার জ্ঞান হারালো। লামিয়া লাবিবের হাত ধরে বসে রইল। নিলুফা লাবিবের কপালে জলপট্টি দিতে লাগল। নিজাম সাহেব দেয়াল ঘড়ির সামনে অস্থির হাঁটাহাঁটি করতে লাগলেন। মহা আনন্দ নিয়ে ফুলকি লাবিবের কাঁধে আইসব্যাগ ধরে রাখল। নতুন পান মুখে দিতে পারছে না বলে সে মোটেও বিরক্ত নয়। ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল। মতিঝিলে গুলির আওয়াজ আর শোনা যাচ্ছে না। হায়দার আলী গাড়ির খোঁজে বাইরে গেছে। লাবিব একবার চোখ মেলে তাকাল। লামিয়া মুখের ওপর ঝুকে অস্থির কণ্ঠে বলল, হুজুর ভাইয়া! লাবিব টেনে টেনে বলল, লামিয়া তোমার সেই জোনাকিরা কোথায়? ওরা এখনও আলো দেয়। লামিয়া দৌড়ে ঘরে গেল জোনাকি আনতে। অবাক হয়ে দেখল, সবগুলো জোনাকি মরে গেছে। ওরা আর আলো দিচ্ছে না। সে জোনাকির বয়াম লাবিবের কাছে এনে বলল, ভাইয়া জোনাকিরা আর আলো দিচ্ছে না। কিন্তু লাবিব এই কথা শোনতে পেল না। তার আগেই ওর জীবনের আলো নিভে গেছে। হায়দার আলী ফিরে এসে জানালো গেটে গাড়ি প্রস্তুত।
চেয়ারম্যানের নাতনী
মোস্তাকিম আমীর
জুন'১৪ অনেক মানুষের কথাবার্তা আর চেচামেচির আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলো তয়বার। এটা কিসের আওয়াজ, কোত্থেকে আসছেÑ একটু বুঝার চেষ্টা করলো সে। চেষ্টা তার সফল হয়েছে। বুঝতে পারলো- এটা মানুষের আওয়াজ, অনেক মানুষের কথাবার্তার আওয়াজ। কিন্তু এই রাত দুপুরে কেন এতো মানুষ? কেন এতো আওয়াজ? কেন এতো চেচামেচি? তা বুঝতে পারলো না। তাই সে তার খালামণিকে ডাক দেয়ার জন্য হাত রাখলো তার পাশে শুয়ে থাকা খালামণির গায়ে। কিন্তু তয়বার হাত খালামণিকে খুঁজে পেলো না। তার হাত গিয়ে পড়লো শূন্য বিছানায়। বুঝতে পারলো খালামণি পাশে নেই। খালামণিও হয়তোবা চেচামেচির আওয়াজ পেয়ে আগেই উঠে বাইরে গেছে। তয়বা শোয়া থেকে উঠে বসলো বিছানায়। হাত বাড়িয়ে বেড সুইচটি অন করলো। ত্রিশ ওয়াটের এনার্জি বাল্প জ্বলে উঠলো। রুমের নিকষ কালো আঁধার তড়িৎ গতিতে পালিয়ে গেলো। রুমটিতে আলোর বন্যা বয়ে গেলো। ফকফকা হয়ে উঠলো পুরো রুম। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো তয়বাÑ রাত ২ টা ৫৫ মিনিট। তিনটা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। রুম থেকে বাইরে যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়ালো তয়বা। তয়বা এগার বছরের চঞ্চল মনা এক দুরন্ত কিশোরী। বাবা-মার সাথে ঢাকায় থাকে। বাবা বারডেম হাসপাতালের অধ্যাপক। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী সে। সমাপনী পরীক্ষা শেষে গত পরশু বড় মামার সাথে এসেছে নানু বাড়ি বেড়াতে। গ্রাম দেখতে। গ্রামের মানুষ দেখতে। দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ দেখতে। কৃষকদের দেখতে। যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শহরের মানুষদের জন্য চিকন চাল পাঠায়, ডাল পাঠায়, সবজি পাঠায়...। তাইতো সে আজ সকালেই তার খালামণিকে সঙ্গে নিয়ে পুরো গ্রাম চষে বেড়িয়েছে। গ্রাম দেখেছে। গ্রামের মানুষ দেখেছে। গ্রামের ঘর বাড়ি, মাঠ, ঘাট, স্কুল, গাছ পালা, সবই দেখেছে। মেঠোপথ আর আল দিয়ে দীর্ঘক্ষণ হেঁটেছে । দীর্ঘক্ষণ পুকুরের পাড়েও বসেছে। সব কিছু সে প্রাণ ভরে উপভোগ করেছে । সব কিছুই তার ভালো লেগেছে। তবে সবচেয়ে ভালো লেগেছে পুকরের পাড়ে বসে কচুরি ফুল দেখতে। এর আগে কখনো সে কচ্ুিরপানা দেখেনি। কচুরি ফুল দেখেনি। পুকুরের দিকে তাকাতেই তার মনে হয়েছে যেন পুকুরে শতোশতো ঝাড়বাতি জ্বলছে। টলমল করছে জল; মাঝখানে একঝাঁক কচুরিপানা। ফুটেছে কচুরি ফুল। শাহবাগে ফুলের দোকানে নানান রঙের, বিচিত্র নামের, ভিন্ন ভিন্ন ঘ্রাণের অনেক রকম ফুল দেখেছে; কিন্তু এতো সুন্দর ফুল আগে কখনো দেখেনি সে। কচুরির ফুল যেনো ঝাড়বাতি। তবে তা ঝুলন্ত নয়; মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে আর ডাকে। একটি বড়ো ডগাকে ঘিরে ঝলমল করে অনেকগুলো বোঁটা। প্রত্যেক বোঁটায় পাঁচটি করে পাপড়ি। পাপড়িগুলো যেন সিল্কে তৈরি। পুকুরের এই অপরূপ দৃশ্য তার কচি মনটাকে দারুণভাবে কেড়ে নেয়। মন তার বার বার ছুটে যায় পুকুরে। পুকুরের কচুরি ফুলগুলোয়। খালামণি গ্রামের অনেকের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তার খালামণি তার থেকে তিন বছরের বড়ো। এলাকার চেয়ারম্যানের ছোট মেয়ে হওয়ায় সবাই তাকে চেনে এবং ¯েœহ করে। আর তয়বা, তয়বা তো চেয়ারম্যানের নাতনী; ঢাকার রাণী। তাই গ্রামের সবাই তাকে আদর করে, ¯েœহ করে। ঘরে নিয়ে গিয়ে গল্প করে। তার সাথে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করে। অনেকে শুদ্ধভাবে কথা বলতে পারে, অনেকে পারে না। তাকে পেয়ে গ্রামের সবাই খুশি। তয়বা বাইরে বেরোনোর আগেই ঘরে ঢুকলো তার খালামণি। তার ভাগনীকে বললো, আম্মু চোর দেখবে, চোর? মুরগি চোর? মুরগি চোর ধরা পরেছে। তাকে বেঁধে আমাদের উঠোনের আম গাছটির ডালে ঝুলিয়ে পেটানো হচ্ছে। এক নিশ্বাসে কথাগুলো বললো খালামণি। খালামণির কণ্ঠে উচ্ছ্বাস, আনন্দ। তয়বা কোনো দিন চোর দেখেনি। চোরের কথা সে শুধু বইয়ে পড়েছে। আজকে সে চোর দেখবে! ভাবতেই তার তনুমন আনন্দে নেচে উঠলো। তয়বা খালামণির হাত ধরে বাইরে এলো। দেখলো, এই রাত দুপুরে গ্রামের নারী পুরুষ সকলেই চোরকে দেখার জন্য গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। চেয়ারম্যানের বাড়ির উঠোনে জমায়েত হয়েছে। মানুষের ভিড় ঠেলে এগুলো তয়বা। দেখলো, একটি লোককে হাতে রশি বেঁধে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখেছে। দুটি মানুষ লোকটিকে পেটাচ্ছে। লোকটি মারের চোটে ‘বাবারে মারে’ বলে চিৎকার করছে। আর গ্রামের লোকগুলো বিভিন্ন কথা বলে বলে আরো পেটানোর জন্য উৎসাহিত করছে। তার নানু ভাই চেয়ারে বসে আছেন। তার পাশে আরো নেতা গোছের দুটি লোক বসে আছে। মনে হয় মেম্বার। লোকটিকে এভাবে পেটানো জন্য তারাই মনে হয় হুকুম দিয়েছে। ভাবছে তয়বা- একি হচ্ছে! দেখতে এলাম চোর; দেখছি মানুষ। এই লোকটিও তো আমাদের মতোই একটি মানুষ। তাহলে চোর হবে কেন? একটি ‘মানুষ’কে মানুষেরা কেন ‘চোর’ বলছে? এত নিষ্ঠুর-নির্মমভাবে কেন তাকে পেটানো হচ্ছে...? এরকম হাজারো প্রশ্ন এসে তার কচি বিবেককে প্রচ-ভাবে আঘাত করছে। ব্যথায় যেন তার কচি হৃদয়টা টনটন করে উঠলো। দু’চোখের কোণা ভিজে এলো। ইতোমধ্যে দেখলো, তার মতো একটি কিশোরী এসে চিৎকার দিতে দিতে বলছে, ‘তোমরা মোর বাপকে মেরো না। মোর বাপ চোর না। মোর বাপকে এভাবে মারলে মোর বাপ মরে যাবে...।’ এবার আর নীরব থাকতে পারলো না তয়বা। সাহসীনী নারীর মতো গর্জে উঠলো, ‘থামুন আপনারা। এভাবে একটি মানুষকে ঝুলিয়ে পেটানো হচ্ছে কেন? পেটানো বন্ধ করুন। তাকে গাছ থেকে নামিয়ে হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিন।’ তার গর্জনে মুহূর্তের মধ্যে সকলেই নীরব হয়ে গেলো। যে দু’জন চকিদার তাকে পেটাচ্ছিলো তারাও পেটানো বন্ধ করলো। চেয়ারম্যান সাহেব নির্দেশ দিলেন চোরকে গাছ থেকে নামানোর জন্য। তাকে নামানো হলো। হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দেয়া হলো। মেয়েটি এসে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলো। তয়বা লোকটির কাছে এগিয়ে গেলো। মাথায় হাত রেখে বললো, আংকেল! কাঁদবেন না। মানুষেরা আপনাকে চোর বলছে। কিন্তু আপনি তো মানুষ! আপনি চোর হবেন কেন? মানুষেরা আপনাকে ‘চোর’ বলছে- এটা ঠিক না। এবার লোকটি তয়বাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বললো, মা তুমি ঠিকই বলেছো। আমি চোর না। কিন্তু আজকে আমি চুরি করতে গিয়েছিলাম। চুরি করতে পারিনি; তার আগেই ধরা খেয়েছি- বলে আরো ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলো লোকটি। কিন্তু আংকেল আপনি আজকে চুরি করতে গেলেন কেন? জিজ্ঞেস করলো তয়বা। তয়বার কথা শুনে নীরব থাকলো লোকটি। কোনো কিছুই বললো না। তয়বা বুঝতে পারলো কোনো এক অব্যক্ত বেদনা লোকটিকে অক্টোপাশের মতো বেস্টন করে রেখেছে। এর কবল থেকে সে কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছে না। তাই সে বললো, আংকেল আপনি চুপ করে থাকবেন না। কেন আপনি চুরি করতে গেলেন আমাকে বলুন। আপনি চুপ করে থাকবেন না। এবার নীরবতা ভাংলো লোকটি। তার মেয়েটিকে দেখিয়ে বললে, আমি বাস স্টেশনে কুলির কাজ করি। এক সপ্তাহ ধরে হরতাল থাকায় কোনো কাজ করতে পারিনি। বাড়িতে খাবার যা ছিলো দু’দিন আগে সব শেষ হয়ে গেছে, দু’দিন ধরে আমরা না খেয়ে আছি। আমার ছোট ছোট মেয়ে দুটি শুধু পানি খেয়ে আছে। কোনো কিছুই তুলে দিতে পারিনি মেয়ে দু’টির মুখে। বলেই লোকটি এবং তার মেয়ে মীম এক সাথে ডুকরে কেঁদে উঠলো। এবার তয়বা আর অশ্রু ধরে রাখতে পারলো না। তার কচি দু’গাল বেয়ে বেড়িয়ে আসতে লাগলো অশ্রু, হাতের আঙ্গুল দ্বারা অশ্রু মুছলো তয়বা। এবার সে এগিয়ে গেলো তার নানু ভাইয়ের কাছে। নানু ভাইকে বললো, নানু ভাই! তুমি কি খলিফা উমরের নাম শুনেছো? আব্বু আমাকে তাঁর দেশ পরিচালনার কাহিনী শুনিয়েছে। তিনি ছিলেন অর্ধেক পৃথিবীর শাসক। তারপরও রাত্রে তিনি ঘুমোতেন না। ঘুরে ঘুরে তিনি দেশের মানুষের খোঁজ-খবর নিতেন। কে না-খেয়ে রাত কাটাচ্ছে তার খবর নিতেন। নিজের কাঁধে করে তাদের ঘরে আটার বস্তা নিয়ে যেতেন। আর বলতেন, ‘আমার রাজ্যে যদি একটি কুকুরও না-খেয়ে মারা যায় তাহলেও এর জবাবদিহি এই উমরকে করতে হবে।’ নানু ভাই! তুমি তো অর্ধ পৃথিবীর রাজা নও, একটি দেশের রাজা নও, একটি জেলার দায়িত্বও তোমার নেই, একটি থানারও নেই; বরং তুমি একটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাত্র। তুমি কি এই একটি ইউনিয়নকে খলিফা উমরের মতো করে শাসন করতে পারো না? তুমি কি এই একটি ইউনিয়নের মানুষের খোঁজ-খবর নিতে পারো না? তুমি কি পারো না রাত্রি বেলা না হোক; অন্তত দিনের বেলা মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের খোঁজ-খবর নিতে? যারা উপোস থাকে, যারা না-খেয়ে রাত কাটায়, তাদের সেই ক্ষুধার্ত মুখে দু’মুঠো খাবার তুলে দিতে? যারা অসুস্থ, কিন্তু চিকিৎসা করানোর মতো টাকা নেই, ওষুধ কেনার মতো টাকা নেই, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে? নানু ভাই! তুমি যদি এসব করতে না পারো তাহলে কেনো তুমি এদের দায়িত্ব নিতে গেলে? কেনো তুমি চেয়ারম্যান হতে গেলে? বলো নানু ভাই, বলো? চুপ করে থেকো না। থামলো তয়বা। নীরব, নিস্তব্ধ হয়ে গেলো পুরো মসলিস। কেউ কোনো কথা বলছে না। তয়বার কথাগুলো উপস্থিত সকলের বিবেককে যেনো হাতুড়ি দিয়ে পেটাতে লাগলো। বিশেষ করে তয়বার নানুভাই চেয়ারম্যানের বিবেককে। তার মাথা নিচু, অবনত। তিনি তার ভুল বুঝতে পেরেছেন। তাই তিনি আস্তে আস্তে মাথা তুললেন। চোখে তার অশ্রু। এ অশ্রু বেদনার নয়; আনন্দের, গর্বের। চেয়ারম্যান তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট করলেন তার নাতনীকে। তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। কপালে ¯েœহের চুম্বন এঁকে দিয়ে বললেন, আপু! আমি আমার দায়িত্ব ভুলে গিয়েছিলাম, আমি ভুলের মধ্যে ছিলাম। তুমি আমার দায়িত্ব স্মরণ করে দিয়েছো, আমার ভুল সুধরে দিয়েছো। আমি অন্ধকারে ছিলাম। তুমি আলো জ্বেলেছো। আলোর পথ দেখিয়েছো। তোমাকে ধন্যবাদ। তোমাকে আবারো স্যালুট করছি- বলে চেয়ারম্যান সাহেব তয়বাকে ছেড়ে দিয়ে আবারো তাকে স্যালুট করলেন। সাথে সাথে উপস্থিত সকলেই তয়বাকে স্যালুট করলো। এবার চেয়ারম্যান সাহেব উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘ভাইসব! আমি আপনাদের সাথে অনেক সময় অনেক দুর্ব্যবহার করেছি। আজ আমি আপনাদের নিকট ক্ষমা চাচ্ছি। আপনারা আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। ইনশাআল্লাহ আমি কথা দিচ্ছি, আমাদের এই ইউনিয়নকে খলিফা উমরের মতো করে পরিচালনা করবো। আমার নাতনীর জন্য দোয়া করবেন।’ এ সময় লোকটির (চোর) মেয়েটি চিৎকার করে বলে ওঠলোÑ ‘চেয়ারম্যানের নাতনী’ সকলেই সমস্বরে বলে ওঠলো ‘জিন্দাবাদ জিন্দবাদ’।
সাব্বির জাদিদ
চশমা
মনির কারওয়ান বাজার থেকে রিকশা নিল। সে যাবে মালবাগে। মালিবাগ রেলক্রসিং পার হয়ে তার বাসা। সে তিতাসের মধ্যম সারির কর্মকর্তা। প্রতিদিন এই সাঝ বিকেলে সে রিকশা যোগে অফিস থেকে বাসায় যায়। কারওয়ান বাজার টু মালিবাগ বাস আছে। মনির ঘামে দুর্গন্ধ গাদাগাদি বাসে উঠে না। নোংরা ঢাকা শহরে এখনো যে জিনিসটা তাকে টানে তা হলো, একাকী রিকশা ভ্রমণ। রিকশা চলছে। মনির গা ছেড়ে দিয়ে আয়েশ করে বসে আছে। তার ঘুম ঘুম লাগছে। রিকশায় উঠলে তার ঘুম পায়। রিকশায় বসে ঘুমানোর মানুষ সহজে চোখে পড়ে না। মনির মাঝে মাঝে রিকশাযাত্রীদের কৌতূহলী চোখে পর্যবেক্ষণ করে। না, ঘুমে ঢুলুঢুলু কোনো রিকশাযাত্রী আজ পর্যন্ত তার নজরে পড়েনি। তবে কি ঢাকা শহরে মনিরই একমাত্র ব্যক্তি, যে রিকশায় বসে ঘুমায়? রিকশাওয়ালা মাঝ বয়সি। নিখুঁতভাবে মাপজোখ করলে মনির থেকে আড়াই পোনে তিন বছরের বড় হবে। প্যাঁকাটি শরীর। ছোট ছোট চোখ। গুনগুন করে গান গাচ্ছে। মনিরের কান পর্যন্ত গুনগুনানি আসছে না। এইমাত্র অফিস ভেঙেছে। প্রাইভেটকার, টাউন সার্ভিস বাস, হল্লা করতে করতে ছুটছে। বাসের হল্লার সামনে গুনগুনানি দাঁড়াতে পারছে না। মনির ঢুলুঢুলু অবস্থায় ঈর্ষা ঈর্ষা চোখে প্রাইভেট গাড়িগুলোর দিকে তাকাচ্ছে। মনিরের চাকরির বয়স পাঁচ বছর। আর পাঁচ বছরের মধ্যে সেও নির্ঘাত এমন কোনো ঝকঝকে প্রাইভেট কারের মালিক হয়ে যাবে। তার উপরি কামাই ভালো। গাড়ি করতে কতক্ষণ! গাড়ির ভাবনা ভাবতে ভাবতে মনির রিকশার পা দানিতে কিছু একটার অস্তিত্ব টের পেল। একটু আগে একটা মিনিবাস কর্কশ শব্দে হর্ণ বাজিয়ে মনিরের ঘুম ভেঙে দিয়ে গেছে। সে বিরক্ত হয়ে পা দানির দিকে তাকাল। একটা চশমা। পুরু কাচের মুরুব্বি চশমা। এক ডাঁটি আছে। এক ডাঁটি নেই। নাইলনের সুতোয় বাঁধা। মনির কি ভেবে চশমাটা তুলল। পকেট থেকে টিস্যু বের করে ধূলোবালি মুছল। তারপর চোখের সামনে মেলে ধরল। হঠাৎ এই একই রকম একটা চশমা ঝাপসা হয়ে তার দৃষ্টির সীমায় ভেসে ওঠল। এমনই একটা ডাঁটি ভাঙা ভারী পাওয়ারের চশমা তার বাবা পরতেন। বাবা মানুষটা একটু বোকা ধরনের ছিলেন। বোকা নাকি সৎ? সেই আমলের ইস্কুল মাষ্টার। সারাদিন ই¯ু‹লের বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে হই চই করে সন্ধ্যেবেলা মনিরকে নিয়ে পড়তে বসতেন। হারিকেনের হলুদ আলোয় সেই ডাঁটিভাঙা চশমা লুঙ্গির কোণায় মুছতেন। তারপর আদর্শ লিপি খুলতেন। মনির বাবার সঙ্গে গলা মেলাতÑ ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি।’ আদর্শলিপি শেষ হলে মা ডাকতেন খাবার পাটিতে। বাবা ছেলে এক সঙ্গে বসে যেত। মা বেড়ে বেড়ে খাওয়াতেন। একটা ব্যাপার মনিরকে মাঝে মাঝেই খুব ভাবাত। বাবা দিনে দিনে যেন শুধু বুড়িয়েই যাচ্ছেন। আর মার বয়স কমছে। আসলে বাবার বিয়ে করতে বেশ দেরি হয়ে যায়। পঁয়তাল্লিশের পরে এক অষ্টাদশীকে তিনি বিয়ে করেন। এসব মনিরের জানার কথা নয়। যা হোক রাতের খাবার খেয়ে বাবা পান চিবোতে বসতেন। তারপর পুরনো কাঠের আলমারি থেকে বের করতেন বিখ্যাত ‘নীতিবাক্য সংকলন’। বাবা খুব আগ্রহ নিয়ে উচ্চারণ করে করে বইটি পাঠ করতেন। যে বইয়ে এক হাজার একটি নীতি বাক্য গ্রন্থিত হয়েছে। মনিরের আজও কিছু কিছু মনে পড়ে। বাবার ভরাট কণ্ঠস্বর তার কানের কাছে দোলা দিয়ে যায়। ‘অসৎ সঙ্গ ত্যাগ কর।’ ‘পরোপকার মহৎ ধর্ম।’ ‘কখনো মিথ্যা বলিও না।’ এসব রসহীন কথাবার্তা শুনতে শুনতে মনির প্রায় দিন ঘুমিয়ে পড়ত। মনিরের কাছে বাবা বরাবরই এক রহস্যময় চরিত্র। আর দশটা বাবার চেয়ে অনেকখানি আলাদা। বাবার এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা হতো না। প্রায় রাতে তাহাজ্জুদ পড়তেন। সংসারে চরম কষাকষি অথচ ফকির এলে দেদারছে দান করতেন। একদিনের ছবি আজও মনিরের মনে গেঁথে আছে। বাড়িতে সকালে রুটি তৈরি হতো। গমের ময়দার মোটা রুটি। সেদিন সকালে ময়দা ছিল দু’মুঠো। দুটো রুটি হলো। একটা খাবে মনির। অন্যটায় ভাগ বসাবে বাবা এবং মা। খাওয়া দাওয়া মাত্র শুরু হয়েছে। দরজায় করাঘাত পড়ল। এক ভিক্ষুক খাবার চায়। বাবা সেই অর্ধেক খাওয়া রুটিতে আলুভাজি মুড়িয়ে ফকিরকে দিয়ে আসলেন। ফিরে এসে ঢকঢক করে দুই গ্লাস পানি পান করলেন। মা একটুও অনুযোগ করলেন না। উল্টো চোখে মুগ্ধতার আবির মেখে বাবাকে দেখতে লাগলেন। এমনই ছিলেন বাবা এবং মা। বাবা মনিরকে নিজের মতো করে গড়তে চেয়েছিলেন। সৎ নির্লোভ, পরোপকারী। বাবা সময় পেলেন না। তাকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে হলো। মনিরের মানস গঠন যখন শুরু হয়েছে ঠিক সেই সময়। পৃথিবীর নিয়মটাই বোধহয় এমন। ভালো মানুষকে সে বেশিদিন লালন করে না। বাবা মারা গেলেন। স্বাভাবিক মৃত্যু না। খুন হলেন। অনেক দিন থেকেই এলাকার প্রভাবশালী চেয়ারম্যান বাবাকে চাকরি থেকে অপসারণ করার চেষ্টা করছিল। অভিযোগÑ বাবার বয়স হয়েছে। তিনি ছেলেদের ঠিক মতো পড়াতে পারেন না। এখন তার বিশ্রামে যাওয়া উচিত। এলাকাবাসী ফুঁসে উঠল। চেয়ারম্যানের চক্রান্তের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। বাবার পাশে থাকা মানুষের বাঁধার মুখে চেয়ারম্যান হার মানল। এর কিছু দিন পরেই বাবা খুন হলেন। ইশার নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরছিলেন। পথিমধ্যে ঘটল ঘটনা। এবং এর পর পরই বাবার শূন্য পদে চেয়ারম্যানের দূর সম্পর্কের ভাগ্নে নতুন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেল। মা একেবারে ভেঙে পড়লেন। নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিলেন। অবশ্য মনির বেশ স্বাভাবিক। বাবা চলে যাওয়া যে বিরাট ঘটনা সে তখনো বোঝে না। বোঝে না বলেই সে আগের মতো হেসে খেলে বেড়াতে লাগল। মা মনিরকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে এলেন। মা তখনো যথেষ্ঠ সুন্দরী। শরীরের গাঁথুনী এখনো ভাঙেনি। মামারা এক প্রকার জোর করেই এক পৌঢ়ের সঙ্গে মায়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন। মনির থেকে গেল মামাদের কাছে। মা মনিরকে সঙ্গে রাখার জিদ ধরেছিলেন। কিন্তু মায়ের নতুন সংসারে সুখের কথা চিন্তা করে মামারা মনিরকে ছাড়ল না। মনির মামাদের কাছে বড় হতে লাগল। লেখাপড়া শিখল। মামাদের বিশাল একান্নবর্তী সংসার। মোটামুটি স্বচ্ছল। একটা বাড়তি ছেলেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স করিয়ে বের করে আনতে তেমন কষ্ট হলো না। তবে অন্য এক ব্যাপার হলো। মনির যত বড় হতে লাগল বাবার শেখানো নীতি থেকে তত দূরে সরতে লাগল। তার সততার শরীরে মরচে জমতে লাগল। সততা জিনিসটা বায়বীয়। চোখে দেখা যায় না। অথচ শিশুবৃক্ষের মতো পরিচর্যা করতে হয়। পরিচর্যা না করলে সততার গোড়ায় আগাছা জন্মে। ধীরে ধীরে আগাছা সততাকে অপুষ্ট করে ফেলে। মনিরের অবস্থা তাই। তার সততা আগাছায় খেয়ে ফেলেছে। চশমাটা মনির কী করবে বুঝতে পারছে না। রিকশাওয়ালার সঙ্গে ব্যাপারটা শেয়ার করা যায়। কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। রিকশাওয়ালা গুরুত্ব দেবে না। সে পথের মানুষ। পথে পড়ে থাকা জিনিস তাদের স্পর্শ করে না। মনির হঠাৎ খেয়াল করল তার বা চোখের কোণ ভেজা। সে তাড়াতাড়ি চোখ মুছে ফেলল। চোখে পানি আসা সংবেদনশীল মানুষের স্বভাব। মনির মোটেও সংবেদনশীল নয়। সংবেদনশীলতা সেই কবেই ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। এখন সে যান্ত্রিক মানুষ। তার অন্তরে বাস করে শুধুই যান্ত্রিকতা। এই যান্ত্রিকতা একদিনে আসেনি। দিনে দিনে দেখতে দেখতে এসেছে। এই ছোটখাটো জীবনে সে কতকিছু দেখল! বাবা মানুষটা অসম্ভব সৎ ছিলেন। অথচ সততা তাকে বাঁচাতে পারেনি। মা-ও এক সময় তাকে ভুলে গেলেন বেমালুম। অথচ এই মায়ের জন্য সে কতরাত নির্ঘুম বালিশে ভিজিয়েছে। মনির এখন সুখী। চার বছরের দাম্পত্য জীবনে এক ছেলের বাবা। সুন্দরী বউ ঘরে। মানসম্মত চাকরি। যদিও চাকরিটার জন্য অনেক কাঠ-খড়ি পোড়াতে হয়েছে। নগদ পাঁচ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। আজকাল পাঁচ লাখ টাকা হাতের ময়লা। সেটা অবশ্য সবার জন্য না। বিশেষ করে মনিরের মতো বাপ-মা মরা এতিমের জন্য পাঁচ লাখ টাকা বেঁচে থাকার নিঃশ্বাসের মতো। এত টাকা সে কোথায় পায়? মামীদের প্ররোচণায় মামারা দিতে রাজি নয়। মনির অঙ্গীকার নামায় স্বাক্ষর করলÑ তিন বছরের মধ্যে সে শোধ করে দিবে। মনির তার কথা রেখেছে। মামাদের টাকা শোধ করেছে। সেটা অবশ্যই বৈধ পথে নয়। চশমার দিকে তাকিয়ে মনির দ্বিতীয়বার চোখ মুছল। অনেক দিন হলো সে কান্না ব্যাপারটা ভুলে গেছে। কান্না বলতে জগতে কিছু আছে বলে তার মনেই পড়ে না। আজ হঠাৎ তার কী হলো কে জানে। ডাঁটি ভাঙা চশমাটা দেখে তার ভেতরটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বাবার দুঃখি মুখটা বারবার সামনে চলে আসছে। এই চশমাটার মালিকও কি বাবার মতোই একজন দুঃখি ইস্কুল মাস্টার! মনির নরম গলায় রিকশাওয়ালাকে বলল, আচ্ছা ভাই! আমার আগে রিকশায় কে উঠেছিল? মনির সাধারণত রিকশাওয়ালাদের সাথে তুমি সম্বোধনে কথা বলে। মেজাজ খারাপ থাকলে তুই তোকারিতে নেমে যায়। কয়েকবার রিকশাওয়ালাদের গালে থাপ্পর পর্যন্ত মেরেছে। আজ সে ‘ভাই’ ডাকল। রিকশাওয়ালা প্যাডেল থামিয়ে একবার পেছন তাকাল। তারপর চাঁছাছোলা গলায় বলল, হেইডা শুইন্যা কাম কী? মনির বলল, এই দেখেন চশমা ফেলে গেছে। রিকশাওয়ালা দ্বিতীয় বার পেছন ফিরে তাকাল। চশমাটা দেখে নিয়ে কিছুটা বিরক্তি গলায় বলল, ফালায় রাইখ্যা গেছে তো আপনে হাতে নিয়ে বইস্য আছেন ক্যান? আপনেও ফালায় দ্যান। মনিরের এতক্ষণে মেজাজ গরম হওয়া উচিত ছিলো। হলো না। সে আগের মতোই বলল, চশমা তো দরকারি জিনিস। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক পাওয়ার। লোকটা চশমা হারিয়ে নিশ্চয় খুব বিপদে পড়েছে। চোখে কিছু দেখতে পারছে না। আচ্ছা লোকটা নেমেছে কোথায় বলতে পারেন? - কোন লোকটা? - এই যে চশমাওয়ালা লোকটা। যে আমার আগে আপনার রিকশায় উঠেছিল। - হেই মহাখালী নামছে। মনির অস্ফুটস্বরে মহাখালী শব্দটা কয়েকবার উচ্চারণ করল। তারপর কি ভেবে বলল, আমাকে মহাখালী নিয়ে চলেন। রিকশাওয়ালা অবাক গলায় বলল, মহাখালী যাবেন ক্যান? হেই সময় না বললেন মালিবাগ যাবেন? -মালিবাগ পরে যাবো। মহাখালী থেকে ঘুরে তারপর। রিকশাওয়ালা রিকশা ঘুরাল। মুখে বলল ভাড়া কিন্তু বেশি লাগব। মনির ভাড়ার প্রশ্নে না গিয়ে বলল, লোকটা দেখতে কেমন? সঙ্গে আর কেউ ছিল? -এক্কেরে বুুইড়্যা। চুল দাড়ি পাকা। সঙ্গে একটা পোলা আছিল। মনে কয় নাতি টাতি হইব। -আপনার সঙ্গে তার কথা হয়নি? -হয় নাইক্যা। তয় পাগলের মতো নিজে নিজে বক বক করতে ছিল। হেই আইছে দ্যাশ থেইক্যা পোলার খোঁজে। পোলা ঢাকায় আইয়্যা আকাম কুকাম কইরা বেড়াইতেছে। ম্যালা দুঃখ করল পোলার লাইগ্যা। - লোকটার গায়ে কী ছিল? - খেয়াল করি নাইক্যা। তয় সবুজ রঙের একটা পুটলা আছিল সাথে। আপনে হের এতকিছু জিগাইতেছেন ক্যান? আপনার কিছু লাগে নাকি? মনির কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। তাড়াতাড়ি বলল, না, আমার কিছু হয় না। মনির মহাখালী রিকশা ছেড়ে দিল। এখন সন্ধ্যার মুমূর্ষু অবস্থা চলছে। এক্ষণি রাত নেমে আসবে। মহাখালী ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত এলাকা। অসংখ্য বাস, সিএনজি চলছে। হেডলাইটের তীব্র আলোয় চোখ ঝলসে যাচ্ছে। অজস্র মানুষের ভিড়ে মনির একটা সবুজ পোটলা খুঁজতে লাগল। কয়েকটা পেলও বটে। কিন্তু পোটলার মালিক কেউ বৃদ্ধা নয়। যাদের চোখে এই ডাঁটি ভাঙা চশমা মানায়। অনেক খোঁজাখুঁজি শেষে মনির হতাশ হয়ে পড়ল। সে বুঝতেই পারছে না হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে এক অপরিচিত বৃদ্ধাকে খুঁজে পাওয়া কীভাবে সম্ভব। সে চায়ের দোকান থেকে দুই গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খেল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখল সতেরটা মিসকল। অহনা দিয়েছে। গাড়ির শব্দে কিংবা অন্যমনস্কতার কারণে রিংটিউন কানে ঢোকেনি। সে মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে ক্লান্ত পা টেনে ফ্লাইওভারে উঠে এল। ফ্লাইওভারেও মানুষ। তবে কম। বেশির ভাগ তরুণ। সময় কাটাতে এসেছে। মনির খুটে খুটে সবগুলো মানুষকে দেখতে লাগল। এবার অদ্ভত ঘটনা ঘটল। সে যার দিকে তাকাচ্ছে বাবার চেহারা দেখছে। একরাতে হঠাৎ সবাই যেন তার বাবা হয়ে গেছে। একজন বুড়িয়ে যাওয়া ইস্কুল মাষ্টার। সৎ অথচ দুঃখি। নাকের ওপর ঝুলছে ডাঁটি ভাঙা চশমা। কপালের ওপর কাচা পাকা পাতলা চুল। হাতে ‘নীতিবাক্য সংকলন।’ ফ্লাইওভারের নিচে হুইসেল বাজিয়ে সাদা রঙের ট্রেন চলে গেল। হুইসেলের মাঝে মনির বাবার ভরাট কণ্ঠস্বর শুনতে পেলÑ ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।’ ভয়ে পেয়ে মনির চশমাটা শক্ত করে ধরে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করল। রাত গভীর হচ্ছে। রাস্তার যানবাহনের সংখ্যা কমছে। বাসাবাড়ির জানালার বাতি নিভছে। আরও একটি গভীর রাত নামছে শহরে। এই রাতের শেষেই আরেকটা আলো ঝলমল দিন। মনির সেই আলো ঝলমল দিনের দিকে হাঁটছে।
যেখানে দিগন্ত নামে ইলিয়াস হাসান
৩১ ডিসেম্বর বিকেল থেকে আমাদের সবার মন চনমনে। কখন আমরা কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে রওয়ানা দিব। সন্ধ্যায় সবাই ড্রাইভার নাসির ভাইয়ের বাসায় খেয়ে ঢাকা থেকে আমাদের অফিসের গাড়িযোগে রওয়ানা দিলাম। আমাদের আনন্দ তখন আর যেন ধরে না। গাড়ির মধ্যে অনেক আনন্দ করলাম। কুমিল্লা একটি সিএনজি স্ট্যান্ডে গাড়ি রেখে রাতে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। সকাল হলে নাশতা সারলাম একটা হোটেলে। এরপর গাড়ি আবার ছুটে চললো। শীতের কুয়াশা ভেদ করে এগিয়ে চলছে আমাদের গাড়ি। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে যেতেই শুরু হলো রাস্তার বামদিক দিয়ে দূরে কালো মেঘের মতো দীর্ঘ পাহাড়ের সারি। দূর থেকে ওগুলোকে কেউ মেঘ বলে ভুল করবে। মনে হবে কালো মেঘ যেন দিগন্ত ছুঁয়েছে। আমরা যতোই দেখছি ততোই অবাক হচ্ছি। আরও অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে, এর পেছনেই তো আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত। এ সফরে ছিলাম শুধুমাত্র আমরা কলরবের বন্ধুরাই। ছিলেন কলরবের সিনিয়র শিল্পী সাঈদ আহমাদ, আবু সুফিয়ান, বদরুজ্জামান, ইকবাল মাহমূদ, আমি এবং শিশু-কিশোরশিল্পী তাওহীদুল ইসলাম, মাহফুজুল আলম, রাশেদ এমদাদুল্লাহ। কক্সবাজার পৌঁছতে পৌঁছতে পরদিন দুপুর হয়ে গেল। বীচে একটা হোটেল উদ্ভোধন হবে, সেখানে আমাদের কলরবের শিল্পীদেরকে সঙ্গীত পরিবেশন করার জন্য দাওয়াত করা হয়েছিল। আমরা সুগন্ধা বীচের কাছে একটা মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করে উক্ত উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলাম। অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখি স্থানীয় পর্যায়ের অনেক শীর্ষস্থানীয় লোকজন উপস্থিত রয়েছেন। কলরবের শিল্পীরা অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করে সবার মন কেড়ে নিলো। ওই দিনই ইনানী বীচে কলরবের শিল্পীদের নিয়ে স্থানীয়রা অনেক বড় ধরনের ইসলামিক কনসার্টের আয়োজন করলো। সন্ধ্যার পর থেকে সেখানে গাইতে হবে। সুতরাং হাতে আমাদের এখনো অনেক সময় রয়েছে। তাই হোটেলের ডাইরেক্টরগণ আমাদেরকে একরকম জোর করে নিয়ে গেলেন সুগন্ধা বীচে, যেখানে তাদের মেহেদী উৎসব ও মেলা চলছিল। সেখানে গিয়ে দেখি আমাদেরই কলরবের গান বাজছে মেলার সাউন্ড সিস্টেমে। একদিক সমুদ্রের গর্জন, অন্যদিকে জানুয়ারি শুরু হওয়ায় বীচে প্রচুর মানুষের সমাগম। তারমধ্যে কলরবের মিষ্টি সুরেলা সঙ্গীত পুরো পরিবেশ জুড়ে ভিন্ন এক আবহ সৃষ্টি করেছিল। যা দেখে আমাদের অনেক ভালো লেগেছে। সত্যিই যেন আনন্দ ধরে রাখার মতো অবস্থা তখন ছিল না। আমরা যেতেই মেহেদী উৎসবে অংশগ্রহণকারী মেয়েগুলো একপাশে সরে গিয়ে আমাদেরকে জায়গা করে দিলো। সাউন্ড সিস্টেমে বাজা সিডি প্লেয়ার বন্ধ করে দিয়ে আমাদের জন্য সাউন্ড ওকে করা হলো। কারণ, যে মিষ্টি সুরেলা গানগুলো সেখানে বাজছিল, সে গানের শিল্পীরা যেখানে সরাসরি উপস্থিত, সেখানে কি আর সিডি প্লেয়ারের সুযোগ আছে? সবাই তো চাইবেই লাইভ প্রোগ্রামের মাধ্যমে শিল্পীদের গান উপভোগ করতে। উপস্থাপক হিসেবে আমি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে মিনি কনসার্টের ঘোষণা দিলাম। মুহূর্তের মধ্যে প্রচুর লোকের সমাগম হলো আমাদের চারপাশ ঘিরে। পড়ন্ত বিকেলে সূর্যের আলো যখন খেলা করছিল সমুদ্রের বিশাল জলরাশির সঙ্গে, ঠিক সেই মুহূর্তে কলরব শিল্পীদের মিষ্টি গানের ঝংকারে মুখরিত হয়ে উঠেছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজারের সুগন্ধা বীচ। অসংখ্য ক্যামেরা শিল্পীদের ধরে রাখতে ব্যস্ত ছিলো। এভাবে এক এক করে আমরা অনেকগুলি সংগীত পরিবেশন শেষ করে ইনানী বীচের দিকে গাড়ি নিয়ে ছুটলাম। সন্ধ্যার পরে সেখানেও এক জমজমাট সংগীতানুষ্ঠান সম্পন্ন হলো। রাতে কলরবের এক হিতাকাক্সিক্ষ ও স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি জনাব মোহাম্মাদ আলী ভাইয়ের বাসায় অবস্থান করি। তিনি আমাদেরকে সুস্বাদু অনেক আইটেমের খানা পরিবেশন করেন। সকালে সেখান থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে রওয়ানা করি। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ যাওয়ার মধ্যপথে আমাদের গাড়িটি নষ্ট হয়ে যায়। তারপর অনেক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে অবশেষে টেকনাফ থেকে বিশাল জাহাজে চড়ে আমরা সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে রওয়ানা হই। বিশ্বের সেরা দ্বীপগুলোর মধ্যে সেন্টমার্টিন অন্যতম। এখানে বছর জুড়ে নানা দেশের বহু মানুষের ভিড় লেগে থাকে। তারা দেখতে আসে দ্বীপের মানুষের জীবন, এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমুদ্রের সঙ্গে মানুষের চমৎকার মিতালি। সেন্টমার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত একটি প্রবাল দ্বীপ। এটি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মিয়ানমার উপকূল হতে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত। প্রচুর নারিকেল পাওয়া যায় এখানে। তাই স্থানীয়ভাবে একে নারিকেল জিঞ্জিরাও বলা হয়ে থাকে। সেন্টমার্টিনের প্রাচীন নাম ছিল জাজিরা। স্থানীয় লোকদের মতে, আরব বণিকেরা দিয়েছিল এই নাম। পরবর্তীকালে জাজিরা স্থানীয় লোকদের মাধ্যমে নারিকেল জিঞ্জিরা বলে খ্যাত হয়ে ওঠে। কিন্তু পরে ইংরেজরা একে সেন্টমার্টিন নামে অভিহিত করে বলে জানা যায়। সেন্টমার্টিন দ্বীপের আয়তন প্রায় ৮ বর্গকিলোমিটার। এ দ্বীপের তিন দিকের ভিত শীলা, যা জোয়ারে তলিয়ে যায় এবং ভাটার সময় জেগে ওঠে। এগুলোকে ধরলে এর আয়তন হবে প্রায় ১০-১৫ বর্গকিলোমিটার। দ্বীপটি উত্তর ও দক্ষিণে প্রায় ৫.৬৩ কিলোমিটার লম্বা। দ্বীপের প্রস্থ কোথাও ৭০০ মিটার আবার কোথাও ২০০ মিটার। দ্বীপটির পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে সাগরের অনেক দূর পর্যন্ত অগণিত শিলাস্তুপ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের গড় উচ্চতা ৩.৬ মিটার। সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১৫৩ প্রজাতির শামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, ২৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রজাতির মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ১২০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। স্থানীয়ভাবে পেজালা নামে পরিচিত ঝবধ বিবফং বা অ্যালগি (অষমধব) নামের এক ধরনের সামুদ্রিক শৈবাল সেন্টমার্টিনে প্রচুর পাওয়া যায়। এগুলো বিভিন্ন প্রজাতির হয়ে থাকে। তবে লাল অ্যালগি (জবফ অষমধব) বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয়। এ ছাড়াও রয়েছে ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে স্পঞ্জ, শিল কাঁকড়া ও লবস্টার ইত্যাদি। মাছের মধ্যে রয়েছে পরী, প্রজাপতি, বোল, কোরাল, রাঙ্গাকই, সুঁই, লাল ও উড়ক্কু মাছ ইত্যাদি। দ্বীপে কেওড়া বন ছাড়া প্রাকৃতিক বন বলতে যা বোঝায় তা নেই। তবে দ্বীপের দক্ষিণ দিকে প্রচুর পরিমাণে কেওড়া ঝোঁপ-ঝাড় আছে। দক্ষিণ দিকে কিছু ম্যানগ্রোভ গাছ আছে। অন্যান্য উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে কেওড়া, শেওড়া, সাগরলতা ও বাইন ইত্যাদি। প্রায় শত বছর আগে এখানে লোকবসতি শুরু হয়। বর্তমানে এখানে সাত হাজারেরও বেশি মানুষ বসবাস করে। দ্বীপের লোকসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানকার বাসিন্দাদের প্রধান পেশা মাছ ধরা। পর্যটক ও হোটেল ব্যবসায়ীরাই প্রধানত তাদের কাছ থেকে মাছ কেনেন। ছোট মাছ পাটিতে বিছিয়ে, পিটকালা মাছ বালুতে বিছিয়ে এবং বড় জাতের মাছ পেট বরাবর ফেড়ে মাচায় শুকানো হয়। এছাড়াও কিছু মানুষ দোকানের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। ছোট ছোট শিশুরা দ্বীপ থেকে সংগৃহীত শৈবাল পর্যটকদের কাছে বিক্রি করে থাকে। সম্পূর্ণ সেন্টমার্টিন দ্বীপেই প্রচুর নারিকেল এবং ডাব বিক্রি হয়। মিয়ানমারের আরাকান থেকে বাংলাভাষী রোহিঙ্গাদের দ্বীপ অঞ্চলে প্রায়শই দেখা যায়। মায়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে বিভাজনকারী নাফ নদীর প্রান্ত হতে আমাদের জাহাজ ছুটে চলে সেন্টমার্টিনের দিকে। নাফ নদী পেরিয়ে এক সময় আমাদের বহন করা জাহাজটি বিশাল সমুদ্রের জলরাশিকে স্পর্শ করে। তখন যেন ভিন্ন এক অনুভূতিতে ডুবে যাই আমরা। আমাদের হৃদয়গুলো মহান স্রষ্টা আল্লাহ্পাক রাব্বুল আলামিনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। মনে মনে ভাবি, এই বিশাল সাগর ও এর সীমাহীন সৌন্দর্য যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি না জানি কতো মহান! তিন ঘণ্টা সাগর পাড়ি দিয়ে আমরা দূর থেকে দেখতে পাই আমাদের কাক্সিক্ষত সেন্টমার্টিন দ্বীপ। মনে মনে ভীষণ পুলক জাগে। দ্বীপে নেমে পুরো সাগর পাড় ঘুরে আসি। এরপর স্থানীয়রা আমাদেরকে নিয়ে এখানেও একটি মিনি কনসার্টের আয়োজন করে। সেখানেও কলরব শিল্পীরা গান পরিবশন করে সবার নজর কাড়ে। গানে মুগ্ধ হয়ে অনেকে তখন কলরবের কন্টাক্ট নাম্বার সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
এক. গত তিনদিন ধরে উজিরে আজম একটা আশ্চর্য কিসিমের স্বপ্ন দেখছেন। ‘তিনি একটা সিংহাসনে বসে আছেন। সামনে বসে আছে মন্ত্রীসভার সদস্যরা। তিনি সবাইকে আদেশ করছেন তাকে সিজদা করতে। সবাই হাসি মুখে নির্দেশ পালন করছে।’ আরেকটা আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, স্বপ্নে তিনি তিনবার করে সিজদা করতে আদেশ করছেন। তিনবারই সিজদা করছে সব মন্ত্রী। প্রত্যেক রাতেই তিনবার করে ঘটছে ঘটনাটা। এর কোনো বেশ কম হচ্ছে না। স্বপ্ন দেখে একবার ঘুম ভেঙে গেলে তিনি আর ঘুমাতে পারেন না। সারারাত অস্থিরতার মধ্যে কেটে যায়। আজকেও তাই হয়েছে। তিনি বিছানা থেকে ওঠে লাইব্রেরি রুমে একটি বই খুঁজছেন। পাচ্ছেন না। দরকারের সময় এমনই হয়। কোনো কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। পরে হয়তো দেখা যাবে বইটা একেবারে সামনের তাকটাতেই ছিলো। তিনি দেখতে পাননি। তবে আজকে যে বইটা খুঁজছেন সেটা নাও থাকতে পারে। কারণ, তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা সম্পর্কে কোনো বই আছে কি না সেটা খুঁজছেন। মনে হয় নেই। কারণ, তার লাইব্রেরিতে ধর্মীয় বইয়ের সংখ্যা একেবারেই কম। নেই বললেই চলে। তার জানা মতে নেয়ামতে কোরআন আর মোকছুদুল মোমেনিন এই দুইটা বই লাইব্রেরিতে আছে। ধর্মীয় বই বলতে এদুটোই। এগুলোর সাথে স্বপ্নের ব্যাখ্যা সম্পর্কিত কোনো বই পাওয়া গেল না।
হঠাৎ তার মনে হলোÑ আরে তিনি ধর্মীয় বইয়ের মাঝে স্বপ্নের বই কেন খোঁজ করছেন। ‘স্বপ্নের ব্যাখ্যা’ এটা কি ধর্মীয় কোনো বিষয়? কি জানি, তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না। ধর্ম সম্পর্কে তার জ্ঞান খুবই সীমিত। মূর্খ মানুষের কাছাকাছি। যে কটা ধর্মীয় বই সংগ্রহ শালায় আছে তাও তিনি নিজে কেনেননি। তার ব্যক্তিগত সহকারী আব্দুল মুকুদ্দুস দুঃখজনক একটা ঘটনার সময় কিনে দিয়েছিলো। তিনি অনাকাক্সিক্ষত ভাবে একটা জায়গায় কিছুদিন অবরুদ্ধ ছিলেন। তার দৈনন্দিনজীবন সম্পর্কে জানতে মানুষ তখন খুবই আগ্রহি ছিলো। প্রতিদিনই সাংবাদিকরা ভিড় করতো সেখানে। আব্দুল মুকুদ্দুস তখন এই বইগুলো কিনে আনে। সেগুলো হাতে থাকা অবস্থায় সাংবাদিকরা তার ছবি তুলে। সাধারণ মানুষ যেন বুঝতে পারে, তিনি এখন ধর্মে কর্মে মনযোগ দিয়েছেন। এটা ভালো কথা। উজিরে আজমের মেজাজ হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়। তিনি এসব কী ভাবছেন! বইয়ের কথা ভাবতে গিয়ে চলে গেছেন খারাপ একটা অতীতে। ওই সময়টার কথা তিনি কখনই ভাবতে চান না। এখন আর সেই সময় নেই। এখন তিনি সবার উজিরে আজম। বিশাল ক্ষমতার অধিকারী। আচ্ছা, প্রধান শব্দটার অর্থ যেন কী? সম্ভবত বড়। তিনি এই দেশের সবার বড়। যখন যা বলবেন তাই হবে, ভাবতে ভালোই লাগে। আব্দুল মুকুদ্দুসকে বললে সূর্য উঠার আগেই স্বপ্নের ব্যাখ্যার যতো বই বেরিয়েছে সব উপস্থিত করবে। কিন্তু উজিরে আজম তার স্বপ্নের ব্যাপারটা আপাতত কাউকে জানাতে চাচ্ছেন না। জানতে পারলেই শুরু হবে হাজার রকম ব্যাখ্যা। কিন্তু তাহলে তিনি কিভাবে এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা বের করবেন। এতো হাজার হাজার বইয়ের মধ্যে আদৌ এই বই আছে কি না তিনি জানেন না। থাকলেও সেটা বের করা তার কাছে কাদার মধ্যে ছোটমাছ খোঁজার মতো মনে হচ্ছে। তিনি নিজে স্বপ্ন বিশারদ হলেও হতো। বই খোঁজাখুঁজির মধ্যে যেতে হতো না। কিন্তু তিনি তো স্বপ্ন বিশারদ নন। তিনি রাজনীতি বিশারদ। স্বপ্ন বিশারদ শব্দটা মনে হতেই উজিরে আজমের মাথায় চমৎকার একটা বুদ্ধি চলে এলো। তাইতো, একজন স্বপ্ন বিশারদকে ডেকে এনে জিজ্ঞাসা করলেই তো হয়। তার বাসভবন মসজিদের ইমাম সাহেবইতো স্বপ্নের ব্যাখ্যা করেন। চিন্তাটা মাথায় আসতেই একটা স্বস্তি অনুভব করেন তিনি। সেই সাথে প্রচণ্ড তৃষ্ণা। আসলে অনেক আগেই পিপাসা পেয়েছিলো। টেনশনের কারণে মনে পড়েনি। জগ থেকে পানি ঢেলে গ্লাসে নিয়ে সোফায় বসলেন উজিরে আজম। পানি পান করতে শুরু করলেন। কিন্তু গ্লাসের পানিটার দিকে তাকাতেই কেন যেন পান করতে মনে চাইলো না। ভয় ভয় লাগছে। ব্যাপারটা কী? তার তো পিপাসা লেগেছে। পান করতে মনে চাইছে না কেন? জলাতঙ্ক রোগির না এমন হয়। পিপাসা থাকলেও পানি দেখলে ভয় লাগে। তারও কি জলাতঙ্ক হয়েছে নাকি? নাহ! ইমাম সহেবকে ডেকে স্বপ্নের ব্যাখ্যাটা জানতেই হবে। স্বপ্নটা দেখার পর থেকেই সবকিছুতে গোল মাল লেগে যাচ্ছে। দুই. ফজরের নামাজ শেষ করে মুসল্লিদের দিকে ফিরে বসেছেন ইমাম তায়েবুদ্দিন সাহেব। প্রতিদিন এই সময়ে তিনি আয়াতুল কুরসি এবং সুরা হাশরের শেষ তিন আয়াত উচ্চ আওয়াজে তেলাওয়াত করেন। তারপর সবাইকে নিয়ে দোয়া করেন। আজও তাই করবেন তিনি। কিন্তু তেলাওয়াত শুরু করার আগেই নজরে পড়লো দরজা দিয়ে উজিরে আজমর ব্যক্তিগত সহকারি আব্দুল মুকুদ্দুস প্রবেশ করছে। এই সময় তার আগমন! কারণটা আন্দাজ করতে পারলেন না তিনি। দোয়া শেষ করার পর ইমাম সাহেবের কাছে এলো আব্দুল মুকুদ্দুস। বললো, উজিরে আজম আপনাকে ডাকছেন। উনার কিছু ধর্মীয় কথা জানা দরকার। তায়েবুদ্দিন সাহেব বিস্মিত হলেন। বিস্মিত তো হবেনই। তার ইমামতি জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা আজ ঘটেছে। উজিরে আজম তাকে ডেকেছেন ধর্মীয় কথা শোনার জন্য। উজিরে আজমের বাসভবনে তিনি ইমাম হিসেবে আছেন প্রায় এগারো বছর। এই এগারো বছরের জীবনে উজিরে আজম অসংখ্যবার তাকে ডেকেছেন বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য। ধর্মীয় কথা শোনার আগ্রহ তার আছে এমন কখনও মনে হয়নি তায়েবুদ্দিন সাহেবের। উজিরে আজমের সাক্ষাৎ কক্ষে বসে আছেন ইমাম সাহেব। নাস্তা দেওয়া হয়েছে। তিনি খেতে পারছেন না। ফজরের নামাজের পর সাথে সাথে তিনি নাস্তা করতে পারেন না । এই সময়টা হলো কোরআন তেলাওয়াতের সময়। এখন নাস্তা করা যায় নাকি! কক্ষে প্রবেশ করলেন উজিরে আজম। ইমাম সাহেবকে বললেন, মাওলানা সাব! তিনদিন ধরে একটা স্বপ্ন দেখছি। কোনো মানে বুঝতে পারছি না। আপনি কি একটু বলবেন। তায়েবুদ্দিন সাহেব মনে মনে বললেন, ‘ও তাহলে এটাই হলো ধর্মীয় ব্যাপার। ঠিক আছে তাহলে স্বপ্নটা কী শোনা যাক।’ ইমাম সাহেব মাথা নিচু করে পুরো স্বপ্নটা শোনলেন। স্বপ্নটার ব্যাখ্যা মনে হয় তার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে একটু একটু করে। তার কাছে মনে হচ্ছে সিজদার আদেশ মানে হচ্ছে- উজিরে আজম নিজেকে ফেরাউনের মতো নিজেকে সর্ব ক্ষমতার অধিকারী মনে করবে। তিনবার করে আদেশ করার অর্থ হলো- সে তিন বেলা অর্থ্যাৎ সারাদিনই সবাইকে তার হুকুম তামিল করার জন্য ব্যস্ত রাখবে। আর মোট তিনদিন স্বপ্নটা দেখার মানে হলো- তার এই ক্ষমতার দাপটটা অস্থায়ী হবে। এবং বর্তমানে উজিরে আজমের জলাতঙ্কের কারণটা তো খুবই স্পষ্ট। অত্যাচারী ফেরাউনকে যে পানিতে ডুবিয়ে মারা হয়েছিলো তাতো কারও অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু এই সব ব্যাখ্যা কি তাকে বলা যাবে? সেতো উল্টা পাল্টা একটা কিছু করেও বসতে পারে। মৌলভি কিসিমের কথা পছন্দ না হলে উজিরে আজম জঘন্য আচরণও করতে পারে। এঅভ্যাস তার আছে। তায়েবুদ্দিন সাহেব বুঝে ওঠতে পারছেন না কী বলবেন। চাকরির মায়া তার নেই। তবে জীবনের মায়া আছে। এই রকম খারাপ একটা ব্যাখ্যা দিলে নিশ্চিতভাবে তার জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে। উজিরে আজমের ওপর বিশ্বাস নেই। ইমাম সাহেবের চোখের সামনে মেয়ে এবং ছেলেটার মুখ ভেসে ওঠলো। মেয়েটাকে তিনি বেশি ভালোবাসেন। সব বাবাই নাকি তাই করে। কিন্তু তার ভালোবাসার পেছনে অন্য একটা কারণ আছে। নুসরাত জন্ম নিয়েছে অন্ধ হিসেবে। অন্ধ সন্তানকে নিশ্চয় বেশি ভালোবাসা উচিত। তাইবুদ্দিন সাহেব উজিরে আজমকে বললেন, স্বপ্নটা একটু ঘোলাটে। ভাবতে কিছু সময় লাগবে। তিনি অসত্য বলেননি। পাশ কাটিয়ে এসেছেন। তাছাড়া সব স্বপ্নই ঘোলাটে হয়। ঘুমের মধ্যে পরিস্কার কিছু দেখা সম্ভব নয়। তিন. উজিরে আজম তার বিশ্রাম কক্ষে শুয়ে আছেন। বড় একটা টিভি চলছে। টিভিতে সংবাদ হচ্ছে। তিনি সংবাদ খুব একটা দেখেন না। হিন্দি সিরিয়াল বা ইংলিশ ফাইট মুভি দেখেই তার সময় কাটে। তবে আজকের কথা ভিন্ন। লাখ লাখ লোক রাজপথে নেমে এসেছে। সবার পরনে সাদা পোশাক। ওদের বক্তব্য সরাসরি প্রচার হচ্ছে টিভিতে। উজিরে আজম তাই শোনছেন। কিন্তু বেশির ভাগ দাবি তার বোধগম্য হচ্ছে না। স্বপ্নটা দেখার পর থেকে অনেক কথাই তার বুঝে আসে না। কানটা কেমন ঝিমঝিম করে। উজিরে আজমের কানটা এখনও ঝিমঝিম করছে। ঝিমধরা কানে সব কথা ভালো শোনা যায় না। তবু তিনি স্পষ্ট শুনলেন বিক্ষোভকারী বক্তারা বলছে, -উজিরে আজম, আপনি যদি বেশি ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেন তাহলে আপনাকে ফেরাউনের পরিণাম বরণ করতে হবে। কত বড় সাহস! উজিরে আজমের রাগ সপ্তমে উঠে গেল। তাকে ফেরাউন বলে গালি দেওয়া হচ্ছে তারই সীমানায়। নাকের ডগায় বসে। ও না, উজিরে আজম নিজেকে শুধরে নেন। বসে না বক্তব্য তো দেওয়া হচ্ছে দাঁড়িয়ে। স্টেজে বসার ব্যবস্থা নেই। যাই হোক বসে গালি দিক আর দাঁড়িয়ে দিক। উজিরে আজমকে ফেরাউন বলে গালি দেওয়া অমার্জনীয় অপরাধ। এদেরকে কিছুতেই ক্ষমা করা যাবে না। উজিরে আজম লাল সুইচে টিপ দিয়ে দিলেন। লাল সুইচে টিপ দেওয়ার মানে হলো ‘জরুরি বৈঠক’ আছে। সবাইকে একত্র হতে হবে। মন্ত্রীদের পরামর্শ সভা বসলো। পরামর্শ সভা না বলে নির্দেশ সভা বলাই ভালো। বৈঠকে উজিরে আজম সবাইকে শুধু নির্দেশটা শুনিয়ে দিলেন। এখনই এ্যাকশনে যেতে হবে। তিনি বেঁচে থাকতে উজিরে আজম নামের অপমান! হতেই পারে না! নির্দেশ দেওয়ার পর থেকে তিনি অপেক্ষা করছেন পরবর্তী অবস্থা জানার জন্য। মাত্র দু’ঘণ্টা পরই সংবাদ এলো। শুভসংবাদ। অনেক মানুষকে লাল রঙ মাখিয়ে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এ রঙটা একটু বেশিই খাঁটি ছিলো। তিনি উজিরে আজম, নকল রঙ লাগানোর কথা তিনি বলতে পারেন না। খাঁটি রঙ গায়ে লাগলে কিছুক্ষণের মধ্যে জমাট বেঁধে যায়। তাই হয়েছে। তবে কিছু রঙ রাস্তাতেও জমাট বেঁধে গিয়েছিলো। উজিরে আজম আদেশ করেছেন ফায়ার সার্ভিসের লোকদেরকে সে গুলো ধুয়ে ফেলতে। বিক্ষোভের স্থানের কাছে ছোট একটা পুকুর ছিলো। গ্রাম বাংলার পুকুরগুলো মতো। শান্ত টলমলে পানি। মাঝে ফুটন্ত শাপলা। সেই পুকুরের পানিও রঙ মেশার কারণে লাল হয়ে গিয়েছিলো। তিনি আদেশ করেছেন পুকুরের পানি বদলে ফেলতে। তাই করা হয়েছে। উজিরে আজমের আদেশে সবই সম্ভব। মোট কতজন লোককে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে তা উজিরে আজম জানেন না। কেউ বলছে দশ হাজার, কেউ এক হাজার আবার কেউ বলছে একশো। আসল সংখ্যা জানার কোনো আগ্রহ অনুভব করছেন না। কী দরকার আছে জানার। প্রতিদিন তার আদেশে কতো জনকেই তো চিরদিনের জন্য ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। চার. তাইবুদ্দিন সাহেবকে আবার ডাকা হয়েছে। স্বপ্ন সংক্রান্ত জিজ্ঞাসা। উজিরে আজম নাকি আবারও একই স্বপ্ন দেখেছেন। আগের মতো মোট তিনদিন। তাইবুদ্দিন সাহেবের কাছে ব্যাখ্যাটা আগের মতোই মনে হচ্ছে। আজকে অতিরিক্ত শুধু এটাই মনে হচ্ছে যে কিছু দিন গ্যাপ দিয়ে আবার স্বপ্ন দেখার অর্থ হলো উজিরে আজমকে সতর্ক করা হচ্ছে। গতবার তিনি সময় চেয়ে নিয়ে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। স্ত্রী-সন্তানের মায়া বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। কিন্তু আজ তার মনে হচ্ছে তার ব্যাখ্যা শুনে উজিরে আজম যদি সতর্ক হয় মন্দ কী? মানুষের মৃত্যুতো অবধারিত। তার নিজেরটাও সময় মতো হবে। উজিরে আজমকে আজ একটু রাগি রাগি লাগছে। লোকে বলে তিনি রাগ করলে নাকি মনে হয় তার ওপর প্রেতাত্মা ভর করেছে। তাইবুদ্দিন সাহেব তেমন কিছু বুঝতে পারছেন না। তবে উজিরে আজমকে কিছুটা ভয়ঙ্করতো অবশ্যই দেখাচ্ছে। এই ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়েই রাগি গলায় তিনি বললেন, মাওলানা সাব, আপনিতো আর স্বপ্নটার ব্যাখ্যা দিলেন না। ব্যাপারটাতো আবার আমাকে সমস্যায় ফেলেছে। ইমাম সাহেব গলাটা একটু কাশি দিয়ে পরিস্কার করে নিলেন। যা বলার স্পষ্ট করেই বলতে চান। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে তিনি ব্যাখ্যাটা ধারাবাহিকভাবে বলতে শুরু করলেন। ব্যাখ্যার শুরুতেই চমকে উঠলেন উজিরে আজম। মাঝে মাঝে তার নিজেকে সর্বক্ষমতার অধিকারী মনে হয়। কিন্তু ফেরাউন যে এমন দাবি করেছিলো তাতো তিনি জানতেন না। আসলে ধর্মের ইতিহাস সম্পর্কে এতোটা অজ্ঞ থাকা ঠিক হয়নি। তাহলে তিনি কমপক্ষে ফেরাউনের কর্মপদ্ধতিটা ভালো ভাবে জেনে নিতে পারতেন। তিনি শক্ত গলায় বললেনÑ মাওলানা সাব, আপনি কাউকে এই স্বপ্নের কথা বলেছেন? জ্বি না বলেনি। আপনি কি জানেন আমাকে কিছু লোক ফেরাউন বলে গালি দিয়েছিলো? জানি। আমি তখন ফেরাউনের পুরো মানেটা বুঝতাম না। শুধু বুঝতাম এটা একটা গালি। তাতেই তাদের অবস্থা কী করেছি দেখেছেন? জ্বি হ্যাঁ, দেখেছি। আপনার কী ধারণা, আমার ক্ষমতা ফেরাউনের মতো হোক আর যার মতোই হোক এটা কি ক্ষণস্থায়ী? কিছু দিনের মধ্যে চলে যাবে? তাইবুুুদ্দিন সাহেব উজিরে আজমর শেষ প্রশ্নটার উত্তর দিলেন না। উজিরে আজম যা বোঝার বুঝে নিক। ব্যাখ্যা যা দেওয়ার বলা হয়ে গেছে। উজিরে আজম সঠিক উত্তরটাই বুঝতে পারলেন। মাওলানা সাব তার ক্ষমতাকে ক্ষণস্থায়ী মনে করছেন। অথচ তিনি চাইছেন জিনিসটাকে পাকাপাকি করে নিতে। তাইবুদ্দিন সাহেবকে তিনি কারাগারে পাঠিয়ে দিলেন। এই রকম লোকেরা বহুত খতরনাক হয়। বিষধর সাপকে আটকে রাখাই ভালো। যে কোনো সময় দংশন করতে পারে। সুযোগ মতো মেরে ফেললেই হবে। পাঁচ. উজিরে আজম তার ক্ষমতার বিষয়টা মোটামুটি পাকাপাকি করে ফেলেছেন। বিদ্রোহীদের কিভাবে শায়েস্তা করতে হয় এই বিদ্যাটা তার ভালোই জানা আছে। তার ব্যক্তিগত একটা বাংলা অভিধান আছে। সেখান থেকে তিনি আটক, খুন, ঘুম, নিখোঁজ, ক্রসফায়ার প্রভৃতি শব্দ খুব বেশি ব্যবহার করেন। আরেকটা কাজ তিনি শুরু করেছেন। কারও ব্যাপারে যদি বিন্দুমাত্র সন্দেহ হয় যেÑ সে আগামীতে কখনও তার পথের কাঁটা হতে পারে। তাহলে তার ব্যাপারেও তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। মন্ত্রী পরিষদকেও তিনি সাজিয়েছেন খুব সুন্দর করে। একেবারে মনের মতো। উজিরে আজমের প্রত্যেকটা কাজে তাদের আনুগত্য অবাক করার মতো। কেনা গোলাম থেকেও কেউ এতোটা আশা করতে পারে না। ইদানীং তিনি বুঝতে পারছেন, সবসময় তিনি অশরীরি একটা শক্তি অনুভব করছেন। শক্তিটা তাকে দুঃসাধ্য কাজগুলো খুবই সহজ করে দিচ্ছে। যেমন তিনি চাইলেন কিছু মানুষকে তার গুরুর নামে বলি দিতে হবে। ব্যবস্থা হয়ে গেল। এই পৃথিবীতে উজিরে আজমের ক্ষমতার পেছনে যে মানুষটার সবচে বেশি অবদান তার নামে বলি দিতে লোক পাওয়া যাবে না এটা একটা কথা হলো! প্রয়োজনে বিভিন্ন দেশ থেকে খুঁজে খুঁেজ আনা হবে। আরেকবার তিনি চাইলেন স্বস্তিতে ঘুমাতে হলে বিশেষ কিছু মানুষের গলা চেপে ধরা দরকার। চুপ করানোই সর্বশেষ চিকিৎসা। তার নির্দেশ মোতাবেক তাদেরকে চুপ করানো হলো। সমস্ত প্রজারা বিপক্ষে গেলেও কোনো লাভ হলো না। চেঁচামিচি তার খুব নাপছন্দ। গলা চেপে ধরার পর তিনি স্বস্তিতে ঘুমাতে গেলেন। এখন ওই স্বপ্নটা ছাড়া তাকে আর কিছুই ডিস্টার্ব করে না। স্বপ্নটার ওপর তার কোনো ক্ষমতা খাটছে না। কাউকে বলতেও পারছেন না। শেষে সাংবাদিকরা জেনে ফেলে। এদেশের সাংবাদিকরা তিলকে তাল বানাতে ওস্তাদ। না না, ভুল হলো। শূন্য থেকে হিমালয় বানাতে পারে। তাই সাংবাদিকদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা তার ক্ষমতার জন্য বিশেষ প্রয়োজন। ছয়. জেলখানায় তাইবুদ্দিন সাহেবের সময় কাটছে অনেকটা আধো জাগরণ আধো স্বপ্নের মধ্যে। তার সাথে কেউ দেখা করতে পারবে না। এমন কি জেল কর্তৃপক্ষকেও নিষেধ করা হয়েছে তার সাথে কথা বলতে। তাইবুদ্দিন সাহেব যেন উজিরে আজমের স্বপ্নের কথা কাউকে বলতে না পারেন সে জন্যই এ ব্যবস্থা। তাইবুদ্দিন সাহেবের জন্য তিনবেলা ছোট একটা জানালা দিয়ে খাবার আসছে। তিনি সেগুলো ছুঁয়েও দেখছেন না। কারা কর্তৃপক্ষ নিষেধ থাকার কারণে কিছু জিজ্ঞাসাও করতে পারছেন না। খাওয়া দাওয়া না করার পিছনে কারণ আছে। খেতে গেলেই তার চোখে ভেসে উঠছে নুসরাতের মুখ। তার মেয়ে। চোখের আলোর চেয়ে যার অন্তরের আলো বেশি। তিনি যখন বাড়ি যেতেন, পৌঁছবার অনেক আগেই নাকি মেয়েটা বলতো, মা! বাবা আসছেন। তার মেয়েটা কি এখন বুঝতে পারছে তার বাবা এখন কোথায়? তার স্ত্রী মায়াবী কি ছেলে ফরহাদকে নিয়ে খুব আনন্দ করছে! ফরহাদ কি মায়ের কাতুকুতু খেয়ে হেসে হেসে চোখে পানি এনে ফেলছে! তার স্ত্রীকে মায়াবী নামটাতো তিনি আদর করে দিয়েছিলেন। আসল নামটা যে কী? মনে পড়ছে না। তাইবুদ্দিন সাহেব নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করেন। জালিম শাসকের সামনে সত্য কথা বলে তিনি এখানে এসেছেন। তার এতো ভেঙে পড়া চলে না। তিনি অতীতের জালেম শাসকদের ইতিহাস জানেন। ফেরাউনের পরিণামও তার জানা আছে। তবে এগুলো সব তিনি পড়েছেন অথবা শুনেছেন। দেখেননি। তার খুব ইচ্ছা, এই শাসকের পরিণাম নিজ চোখে দেখার। তিনি নিশ্চিত পরিণাম খুব ভয়ঙ্কর হবে। সাত. উজিরে আজম সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছেন আজ তিন দিন হতে চললো। এই তিন দিনে কোনো সমস্যা পোহাতে হয়নি তাকে। তবে রাতে একটু সমস্যা হয়েছে স্বপ্নটার কারণে। কিন্তু ইদানীং তিনি ব্যাপারটাকে পাত্তা দিচ্ছেন না। আজ তৃতীয় রাত। তিনি একটু আগেই ঘুমাতে গিয়েছেন। ঘুমানোর পর যথারীতি স্বপ্নটা দেখাও শুরু করেছেন। সবকিছু আগের মতোই হচ্ছে। তিনি আদেশ করছেন, সবাই লুটিয়ে পড়ছে। এইটুকুতো আগের মতোই ঘটলো। এরপর থেকে স্বপ্নটা ভিন্নরকম দেখতে শুরু করছেন। আজ মন্ত্রীরা কেউ মাটি থেকে মাথা তুলছে না। কী ব্যাপার সব মারা গেল নাকি? হঠাৎ উজিরে আজম লক্ষ করলেন, অদৃশ্য থেকে কেউ যেন তাকে ছোট একটা পুকুরে নামিয়ে দিচ্ছে। উজিরে আজম অবাক হন। এরকম বিদঘুটে স্বপ্ন। এরচেয়ে আগের স্বপ্নইতো অনেক ভালো ছিলো। কিন্তু না এটাকে তো স্বপ্ন মনে হচ্ছে না। তিনি শুনেছেন, স্বপ্নে মানুষের চামড়ার কোনো অনুভূতি থাকে না। এজন্যই অনেকে গায়ে চিমটি কেটে দেখে সে স্বপ্নে আছে কি না? অথচ এখন তার চামড়ায় অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। তার প্রচুর শীত লাগছে। গায়ে কাঁপুনি চলে এসেছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, তিনি শ্বাস নিতে পারছেন না। কারণ পুকুরের পানিতে তাকে চেপে ধরা হয়েছে। তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না, মন্ত্রী পরিষদ, প্রাসাদ, লোকলস্কর সবকিছুর মাঝখান থেকে কিভাবে তাকে এখানে আনা হয়েছে! তাও আবার পানির মধ্যে। উজিরে আজমের স্পষ্ট মনে পড়ছে, মাওলানা সাহেব তাকে বলেছিলেন, ফেরাউনও নাকি পানিতে ডুবেই অক্কা পেয়েছিলো। একারণেই নাকি স্বপ্নটা দেখা শুরু করার পর থেকে তার নিজেরও জলাতঙ্ক শুরু হয়েছিলো। মাওলানা সাহেবের কথা তার ভালো লাগেনি। তাই তাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন গারদে। আজ ছোট্ট পুকুরটাতে হাবুডুবু খেতে খেতে মাওলানা সাহেবের কথাগুলো তার কানে বাজছে। তার মনে হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত কি তাকে ফেরাউনের পরিণামই বরণ করতে হচ্ছে! এক সময় তার শ্বাসনালি পানিতে ডুবে গেল। অক্সিজেনের অভাবে তিনি কাটা মুরগির মতো তড়পাতে লাগলেন। চোখটা শেষ বারের মতো বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে তিনি বুঝতে পারলেন, আরে! এইতো সেই পুকুর, যেই পুকুরের পাশেই তার নির্দেশে অসংখ্য লোককে খুন করা হয়েছে। পুকুরটার পানি আজও টকটকে লাল। মাঝে ফুটন্ত শাপলা।