ফেসবুক একটি আধুনিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। পৃথিবীর সবদেশেই ফেসবুক সমান জনপ্রিয়। ফেসবুকের জনপ্রিয়তার সবচেয়ে বড় কারণ- এর নানা ধরনের অ্যাপ্লিকেশনস যা অন্য কোনো সামাজিক সাইটে একত্রে পাওয়া যায় না। ব্যবহারবিধিও অপেক্ষাকৃত সহজ ও শৈল্পিক। বর্তমানে এটি প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তারুণ্যের নতুন জানালা এবং স্বাধীন মত প্রকাশের একটি প্রযুক্তি মাধ্যম। একটি সৃজনশীল মুক্তচিন্তা বিকাশের যোগসূত্রও বটে। এ সৃজনশীলতার পাশাপাশি আবার অনেক নোংরামি, অশ্লীলতা, ভাষার বিকৃতি, অপপ্রচার, সময় ও মেধার অপপ্রয়োগসহ বিভিন্ন পোস্ট, স্ট্যাটাস, মন্তব্য, টুইট, অসংলগ্ন আলাপ, বিকৃত ভাষার ব্যবহার; ব্যাংক, অনলাইন মিডিয়ায় আইডি হ্যাকসহ বন্ধুদের দীর্ঘ তালিকা তরুণীদের মূল্যবোধকে সহজেই পরাস্ত করে প্রতারণার সুযোগ গ্রহণ করছে বুঝে না বুঝে অনেক ব্যবহারকারী।
ফেসবুকের শুরুর কথা ফেসবুক পৃথিবীর জননন্দিত একটি নেটওয়ার্কিং ওয়েবসাইট। ২০০৪ সালের ৪ ফেব্র“য়ারিতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট্ট একটি রুমে ফেসবুকের কার্যক্রম শুরু হয়। সেখানকার শিক্ষার্র্থী মার্ক এলিয়ট জুকারবার্গ বন্ধুদের সঙ্গে মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমেটরিতে বসে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য একটি ওয়েবসাইট চালু করেন। তখন বিষয়টি কেবল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্যই সীমিত ছিল। ইন্টারনেটভিত্তিক এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি এত দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠে যে, চালু হওয়ার মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধেকের বেশি ছাত্র-ছাত্রী এর সদস্য হয়। পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে আশেপাশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষার্থীরাও সদস্য হতে শুরু করলে সদস্য সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যায়। এরপর শুধুমাত্র আমেরিকায় বসবাসরত ব্যবহারকারীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ২০০৬ সালে উন্মুক্ত করে দেয়া হয় সারা বিশ্বের জন্য। এভাবেই ইতি-নেতির ভাবনার ডানায় ফেসবুক দশদিগন্তে উড়াল দিতে সমর্থ হয়েছে।
ফেসবুকের অগ্রযাত্রা ও জয়জয়কার ফেসবুক ব্যবহার করে না এমন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখন নেই বললেই চলে। এমনকি এখন যারা ইন্টারনেট দুনিয়ার নতুন সদস্য হচ্ছেন, তাদের সূচনাই হচ্ছে ফেসবুক রেজিস্ট্রেশনের মধ্য নিয়ে। নচেৎ মাত্র ২০০৪ সালের ফেব্র“য়ারিতে যাত্রা শুরু করে ২০০৫ সালের ডিসেম্বরেই এর গ্রাহক সংখ্যা ৫৫ লাখে দাঁড়াত না। ২০০৬ সালে কৌশলগত কারণে ফেসবুকের সঙ্গে মাইক্রোসফট সম্পর্ক স্থাপন করার মাধ্যমে সারাবিশ্বের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ফলে এক লাফে গ্রাহকসংখ্যা দাঁড়ায় ১ কোটি ২০ লাখে। ২০০৭ সালে ভার্চুয়াল গিফট শপ চালুর সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহক সংখ্যা ২ কোটি এবং মাত্র একবছর পর ২০০৮ সালে ফেসবুকে জনপ্রিয় ‘চ্যাট’ সেবা চালু হয়। এ বছরই ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ কোটিতে। ২০০৯ সালে ফেসবুকে ‘লাইক’ সেবার পাশাপাশি এর গ্রাহক সংখ্যা উন্নীত হয় ১৫ কোটিতে। মাত্র এক বছর পর ২০১০ সালে ব্যবহারকারী দাঁড়ায় ৫০ কোটিতে। আর তাই প্রায় ৭০০ কোটি জনসংখ্যার এই বিশ্বে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কর ওয়েবসাইট ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০০ কোটির বেশি। এর মধ্যে প্রতিদিন ৬১ কোটি ৮০ লাখ ব্যবহারকারী দিনে অন্তত একবার ফেসবুকে লগইন করেন। মোবাইল ফোন থেকে প্রতিদিন লগইন করেন ১৫ কোটি ৭০ লাখ ব্যবহারকারী। বাংলাদেশে ৩০ লাখেরও বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারী রয়েছেন। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৭০টিরও বেশি ভাষায় ফেসবুক ব্যবহার করা হচ্ছে। তার উপর ফেসবুকে প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে প্রায় দুই লাখ নতুন ব্যবহারকারী। সম্মিলিতভাবে ব্যবহারকারীরা প্রতিমাসে ফেসবুকে সময় কাটান ৭০ হাজার কোটি মিনিট। এই অবস্থা চলতে থাকলে পৃথিবীর সব মানুষ খুব শিগগিরই হয়তো যুক্ত হয়ে যাবে ফেসবুকের রাজত্বে। মানুষের পরস্পরের সঙ্গে নানা বিষয়ে মতবিনিময় করার পাশাপাশি সমাজনীতি, রাজনীতির গণ্ডি পেরিয়ে এখন অর্থনীতির চূড়ায় আরোহন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে পৃথিবীর সবচে বড় এই সোস্যাল মিডিয়াটি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রকাশ্যেই এক সভায় বলেছিলেন, ফেসবুক আমেরিকার গর্ব। তিনি তার নির্বাচনী প্রচারণায়ও এর ব্যাপক ব্যবহারে উপকৃত হয়েছেন। এর আগে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন টাইম ম্যাগাজিন ২০১০ সালের জন্য বর্ষসেরা ব্যক্তিত্ব হিসেবে নির্বাচন করে জনপ্রিয় নেটওয়ার্কিং সাইট ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মার্ক এলিয়ট জুকারবার্গকে। ফেসবুকের বিপুল ব্যবহারের পাশাপাশি মানুষের জীবনে এবং বছরের ঘটনাপ্রবাহে এর প্রভাব বিবেচনা করে জুকারবার্গকে এ খেতাব দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় টাইম ম্যাগাজিন।
ফেসবুক নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন বয়সসীমা ১৩ বছর। সম্প্রতি বিবিসির এক খবরে জানা গেছে, ফেসবুক ব্যবহারকারীর জন্য আর কোনো নির্দিষ্ট বয়সসীমা থাকছে না। অর্থাৎ ১৩ বছরের কম বয়সী শিশু থেকে শুরু করে সবার জন্যই উন্মুক্ত হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিশ্বের বৃহত্তর নেটওয়ার্ক ফেসবুক। তবে এই কাজটি করতে তারা বিশেষ কিছু কাজ করছে। জানা গেছে, শিশুদের ফেসবুক প্রোফাইল তার মা-বাবার ফেসবুক প্রোফাইলের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। ফলে মা-বাবা শিশুদের ফেসবুক তত্ত্বাবধান করতে পারবেন। ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল এক খবরে জানিয়েছে, শিশুর ফেসবুক প্রোফাইলের লিংক যেন তার বাবা-মার ফেসবুক প্রোফাইলের সঙ্গে যুক্ত করা যায়, এমন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন ফেসবুক সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মার্ক জুকারবার্গ। যদি বিষয়টি সত্যিই ঘটে তাহলে বিষয়টা এমন দাঁড়াবে যে, পৃথিবীতে একজন নতুন শিশু জন্মগ্রহণ করেই ফেসবুক রেজিস্ট্রেশন করবে। এতে একসঙ্গে জন্ম সার্টিফিকেটের বিষয়টিও নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি দেশের সকল জনসংখ্যার নানা তথ্যও পাওয়া যাবে খুব সহজেই। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দারা তাদের দেশের জনগণের ওপর নজরদারি করতে ফেসবুকের সহযোগিতাও নিচ্ছে বলে খবরে প্রকাশ। এছাড়াও ২০১৩ সালে ফেসবুক গ্রাফ সার্চ চালুর ঘোষণা রয়েছে। চলতি বছরে ফেসবুকে ভিডিও বিজ্ঞাপন চালু হয়েছে। ফেসবুকের নিউজ ফিডে ব্যবহারকারী না চাইলেও দেখতেই হবে ১৫ সেকেন্ডের বাধ্যতামূলক বিজ্ঞাপন। এ রকম আরো অনেক নতুন সেবাই হয়তো আমরা দেখতে পাবো চলতি বছরে কিংবা অদূর ভবিষ্যতে।
ফেসবুকের নেতিবাচক দিক পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ফেসবুক-ভীতি তৈরি হয়েছে। মনে রাখতে হবে, ফেসবুক যতটা না সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে তারচেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে অশ্লীলতা চর্চার মাধ্যম হিসেবে। এতে করে অনেক পরিবার তাদের ছেলেমেয়েদের নেট ব্যবহারে নিরুৎসাহী দেখা যায়। তার পরেও সারাবিশ্বে ৫৬ লাখ শিশু তা ব্যবহার করছে। এদিকে বর্তমান যুগে অধিকাংশ মা-বাবাই তাদের সন্তানের ইন্টারনেট কার্যকলাপ নিয়ে চিন্তিত। সন্তানরা কি করছে সে বিষয়ে নজর রাখার জন্য প্রায় ৭২ শতাংশ অভিভাবকই তাদের টিনএজ ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ফেসবুকে ‘বন্ধু’ হিসেবে যুক্ত আছেন। এদের মধ্যে প্রতি ১০ জনের ছয়জনই স্বীকার করেছেন, তারা তাদের সন্তানের অজান্তেই তাদের কার্যকলাপের ওপর নজরদারি করেন। এভিজির তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২১ শতাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানের ফেসবুক প্রোফাইলে অবমাননাকর বার্তা বা অ্যাবিউজিভ মেসেজ পেয়েছেন। এসবই কিন্তু নেতিবাচক সংকেত। ইদানীং ফেসবুকে যে ভাষার আধিক্য দেখা যায়, তা অশ্লীলতাকেও হার মানায়। ফেসবুকে পরকীয়া সম্পর্কটি খুব সহজেই বেড়ে যাচ্ছে। এটা রীতিমতো ভয়ঙ্কর। যাকে বলা হয় ‘ফেসবুক অ্যাবিউস’। সেখানে নৈতিকতা ব্যাকরণে ধূলির আস্তরণ পড়ে অনৈতিক আর সস্তা শব্দ-সমন্ধ স্থান করে নিচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রুমানা মঞ্জুরকে তার স্বামী সাঈদ ফেসবুকের কারণেই মানসিক অশান্তিতে থেকে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছিল। রামুতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি ফেসবুকেরই উস্কানিতে সংঘটিত। আবার ফেসবুকের মাধ্যমে ভালোলাগা, ভালোবাসা, প্রেম, প্রেমের পর দেখা-সাক্ষাত, অতঃপর...। এখানে ‘অতঃপর’-এর পর এমনকিছু ঘটনা ঘটছেÑ যা খোলামেলা না বলাটা শালীনতার অন্তর্ভুক্ত। ভিন্নধারার অনুসন্ধানী ওয়েবসাইট উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যসেঞ্জ বলেছেন, ফেসবুক মানুষের ইতিহাসে গুপ্তচর বৃত্তির কাজে নিয়োজিত সবচেয়ে ঘৃণাব্যঞ্জক হাতিয়ার। যারাই নিজ বন্ধুদের নাম ও তাদের জীবনের নানা দিক বা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত তথ্য এই চ্যানেলকে সরবরাহ করছেন তাদের জানা উচিত যে, তারা আসলে বিনা অর্থে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। অন্য কথায় ফেসবুক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য তথ্যের বিশাল এক ভাণ্ডার। মার্কিন গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো তথ্যের এইসব ভাণ্ডার বা উৎস ব্যবহার করছে। তথ্য পাচারের অভিযোগ ছাড়াও অতিমাত্রায় ফেসবুক ব্যবহারের ফলে নানা ধরনের সামাজিক সমস্যাও দেখা দিচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের একদল আইনজীবী জানিয়েছেন, দেশটির শতকরা ২৫ ভাগ তালাকের ঘটনা বা মোট তালাকের এক পঞ্চমাংশের জন্য দায়ী ফেসবুক। বাংলাদেশেও ফেসবুক প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে প্রতারণার আওয়াজ আসছে চারিদিক থেকে। সম্প্রতি ব্যাংক জব্দ, আইডি হ্যাকসহ নানা ক্ষতিকর সাইড প্রত্যক্ষিত। ফেসবুক নিয়ে বিপাকে পড়েছেন দেশের স্বনামধন্য তারকা শিল্পী-অভিনেত্রীরা। কে বা কারা তাদের ছবি ব্যবহার করে ফেসবুকে একাধিক অ্যাকাউন্ট খুলে রেখেছে। শুধু তাই নয়, ওগুলোর বরাত দিয়ে অশ্লীলতার সয়লাব বয়ে দিচ্ছে। ফাসিয়ে দিচ্ছে ভদ্র মহাজনকেও। এমন ঘটনা খুব সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে আজ। অহিও স্টেট ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক জানান, যারা নিয়মিত ফেসবুক ব্যবহার করে তারা পরীক্ষায় খারাপ করে। এটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের জন্য করা হলেও স্কুল-মাদরাসার জন্যও তা প্রযোজ্য। ওই সংস্থার একজন গবেষক আরিন বলেছেন, প্রতিটি প্রজন্মেই থাকে ধ্বংসাত্মক একটি কালযন্ত্র। বর্তমান সময়ে ফেসবুক নামে এসেছে সে ধ্বংসাত্মক যন্ত্রটি।
ফেসবুকের ইতিবাচক দিক প্রত্যেকটি জিনিসই তৈরি হয় ইতিবাচক চিন্তা থেকে। ফেসবুকও সে চিন্তারই ফসল। কেউ যদি ফেসবুকের অপব্যবহার করে তবে সে-ই তার প্রায়শ্চিত্য করবে। তাছাড়া ফেসবুকে সবাই অশ্লীলতা, অপরের ইজ্জত হনন, অর্থনৈতিক ধ্বংস সাধন ও বন্ধুত্বের পরিচর্চাতেই ব্যস্ত নয়। ইদানীং ফেসবুকে একে অপরের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগির পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য চর্চা, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে নেয়া মহতী উদ্যোগও চলছে। ফেসবুকের হরেক স্ট্যাটাস আপডেটের মাধ্যমে নিজের প্রতি মুহূর্তের হাল জানিয়ে দিচ্ছে সবাইকে। কেবল কি তাই! যেই বন্ধু এই স্ট্যাটাসে লাইক কিংবা কমেন্ট করছেন তার বন্ধুদের টিকারে ভেসে উঠছে আপনার মনের কথা! ‘টিকার’ ফেসবুকের মোটামুটি নতুন সংযোজিত অংশ। অনেকেই সোশ্যাল অ্যাওয়ার্নেস কথা, সুসংবাদ, কোনোও দুর্লভ ছবি, গান, মজার কিংবা সাম্প্রতিক ঘটনা বন্ধুকে ট্যাগ করে দেয়া যায়, যা খুব সহজেই তার নজরে আসে এবং তার মতামত পাওয়া যায়। ইদানীং ফেসবুকের পাতায় পাতায় বাজারের দেখা মিলে, কাপড়, গহনা, আসবাব, বই নানা যন্ত্রপাতিসহ অন্যসব পণ্যের সমাহার ছাড়াও ঈদ, বিয়ে, সভা-সেমিনার, মাহফিল, দলীয় কর্মকাণ্ডসহ নানা দুর্লভ তথ্য পাওয়া যায়। যা এত সহজেই পাব বলে ধারণাও করা যেত না। বিশ্বব্যাপী ফেসবুকের মতো মাধ্যমগুলোকে রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করছেন। ফেসবুক-জাতীয় ওয়েবসাইটগুলোকে কল্যাণকর কাজেই বেশি ব্যবহার করা সম্ভব। যেমন, আরব বিশ্বে স্বৈরশাসন বিরোধী ইসলামি গণজাগরণে জনগণ ও বিশেষ করে যুবসমাজ ফেসবুকে প্রতিবাদ ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছে। এমনকি বৃটেনসহ ইউরোপের কোনো কোনো দেশেও সরকার-বিরোধী গণপ্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করতে ফেসবুক-এর মতো চ্যানেলগুলো ব্যবহৃত হয়েছে। এ ফেসবুকে অনেক সৃজনশীল পোস্ট দেখে অভিভূত হতে হয়। কি অসাধারণ সংগ্রহ এবং আইডিয়া তাদের! মুহূর্তে যেন ফিরে যাই দুরন্ত শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের অলিগলিতে। আমাদের বোধ এবং ভাবনার দরজায় যেন কড়া নাড়ে একেকটি ছবি। কখনও একটি ছোট্ট কথা অনেক কথার মালা হয়ে অনেক চেনা বিষয়কে নতুন করে চিনিয়ে দেয়। যেমন এক বন্ধু লেখেছিলেন, ‘মা তখনও কাঁদে যখন সন্তান খাবার খায় না। আবার মা তখনও কাঁদে যখন সন্তান খাবার দেয় না’। আরেকটি স্ট্যাটাস, ‘এক বছরে একটি গাছ আমাদের জন্য কত উপকার করে জানেন? শুনুন, ৭৫০ গ্যালন বৃষ্টির পানি শোষণ করে। ১০টি এয়ার কন্ডিশনারের সমপরিমাণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ করে। ৬০ পাউন্ডের বেশি ক্ষতিকারক গ্যাস বাতাস থেকে শুষে নেয়। এবার আপনিই ঠিক করুন কেন গাছ কাটবেন এবং কেন গাছ লাগাবেন না।’ এসব স্ট্যাটাস মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টিতে অতুলনীয়। আমাদের বোধের শেকড়ে নাড়া দেয়ার জন্য এমন পোস্ট মাইলফলক ভূমিকা রাখবে।
ভালো-মন্দের দোলাচলে ফেসবুক আজকের সময়ে ফেসবুকে ভালো-মন্দ নিয়ে জানার আগ্রহ প্রায় সবার। তাই বিষয়টি আরো ভালো করে জানার জন্য বিভিন্ন শ্রেণির ফেসবুক ব্যবহারকারীর দ্বারস্ত হতে হয়েছে আমাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্টবিজ্ঞানের ছাত্র আনোয়ার হোসেন সাগর বলেন, ফেসবুক বর্তমান সময়ে যাদুকরী একটি প্রযুক্তি। ফেসবুকের কল্যাণে আমাদের জীবন অনেক সহজ হয়ে গেছে। অবশ্য একটি শ্রেণি এর অপব্যবহারও করছে, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। অনুরূপ বক্তব্য ইডেনের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী নাসরিন সুলতানারও। তবে নাসরিন আরেকটু বাড়িয়ে বলে যে, যদি ফেসবুক নিয়ে কর্তৃপক্ষের আরেকটু সচেতন ও সতর্ক দৃষ্টি থাকত তবে অনেক ভালো হত। তিতুমীর সরকারী কলেজের মেথম্যাটিক্সের ছাত্র জাহাঙ্গীর আলম জানান, ফেসবুকের কল্যাণে লাভবান হওয়ার চেয়ে ক্ষতি হয়েছে বেশি। যে সময় ফেসবুক ছিল না, সে সময় আমরা ফেসবুকের ঘাটতিও উপলব্ধি করিনি। আজ ফেসবুকের কারণে বহুলাংশে মানুষ প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে। অনেকে একাধিক অ্যাকাউন্ট খুলে একেকটিতে একেক রকম মুখোশ উন্মোচন করছে। কাওরান বাজারের ভেতরে একটি গোদামে ব্যবসায়ী আব্দুল হাশিমকে দেখলাম কম্পিউটারে ফেসবুক খুলে টিপাটিপি করতে। কেন ফেসবুক ব্যবহার করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যবসায়িক কাজে ফেসবুকের প্রয়োজন হয়। এই যেমন আমার দোকানের বিভিন্ন পণ্যের এ্যাড দিয়ে দিতে পারছি। আমাদের ঘরানার সবাই বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারছে। অনেকেই ফেসবুকে দেখে এসে পণ্য চাচ্ছে। ফেসবুকে খারাপ কী আছে জানতে চাইলে তিনি সাফ বলে ফেললেন, একটা অপরাধ অবশ্য করি তাহলো, একাধিক অ্যাকাউন্ট খুলে বা বন্ধু-বান্ধবদের বলে নিজেদের পণ্যের বিজ্ঞাপনে ‘লাইক’ মেরে অনেক সময় ভূয়া জনপ্রিয়তা বাড়াতে হয়। এতে একটি বিজ্ঞাপন হয়ে যায়। এ ছাড়াও খারাপ আছে বলে শুনে থাকলেও ব্যবসায়িক চাপে সেদিকে নজর দেয়ার সময় থাকে না। জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া যাত্রাবাড়ীর আদবের ছাত্র মুহাম্মদ মোবারক হোসাইন জানান, আমরা ফেসবুকের অপব্যবহার করি না। আমরা জানি, ফেসবুকে অনেক জরুরি খবর খুব স্বল্প সময়ে শেয়ার করা যায়। ফেসবুকের কল্যাণে ইসলামের বহু নিদর্শন তথা কুরআন-সুন্নাহ ও শরিয়তের মাসলা-মাসায়েল বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা সহজ হয়। অনেকে নিজের প্রকাশিত বই বা অন্য যে কোনো পণ্যের খুব সহজেই বিজ্ঞাপন দিতে পারে। তবে মাঝে-মধ্যে কিছুসংখ্যক আননোন ফ্রেন্ডের কারণে কিছু বিপত্তিকর পোস্টের ঝামেলাও পোহাতে হয়।
হায়দার আলীর মাজারে তেলেসমাতি সমাজপতিদের ভাবতে হবে এখনই
আমিন ইকবাল
জুন'১৪
তখনও সন্ধ্যা নামেনি। বিকেল গড়িয়েছে মাত্র। মোহাম্মদপুর ঈদগাহ মাঠে ঢুকতেই নজরে পড়ে মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণে ৩০/৩৫ জন নারী-পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। কৌতুহল নিয়ে এগিয়ে যাই। দেখি- সবাই মুনাজাতে ব্যস্ত। এদের মধ্যে মহিলার সংখ্যাই বেশি। যুবতি মেয়েও আছে সাত-আটজন। ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছে তারা। সবাই বাবার ভক্ত। বাবা সামনে শুয়ে আছেন। বাবার শরীর জুড়ে ফুলের তোড়া। মাথা বরাবর একটা শেরওয়ানি পাগড়ি। ডানে-বামে জ্বলন্ত মোমবাতি। আশপাশে ছড়িয়ে আছে আগরবাতির কাঁচা গন্ধ। মাঝে মধ্যে ছিটানো হচ্ছে গোলাপ জল। ওপরে উড়ছে সালু কাপড়। লাল সালু কাপড়। ভক্তরা বাবার কাছে নিজেদের আরজি পেশ করছে। আশার কথা, হতাশার কথা, সুখের কথা, দুখের কথা বলছে। তাদের বিশ্বাসÑ বাবা মরেনি। দেহটা মাটির নিচে দেয়া হয়েছে মাত্র। তিনি জীবিত। ঠিক আগের মতোই; যেমন ছিলেন মরার আগে। তিনি সবাইকে দেখছেন। সব কিছু শুনছেন। পূরণ করছেন ভক্তদের সব চাওয়া-পাওয়া। কেউ বিপদে পড়লে বাবা পার করে দিবেন। বিদেশে যেতে না পারলে বাবা ব্যবস্থা করে দিবেন। আরও যতসব শিরিকি-কুফুরি বিশ্বাস নিয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কথিত এ মাজারে প্রতিদিন ভিড় করছে অসংখ্য নারী-পুরুষ। এদের বড় একটা অংশ বিহারি হলেও না বুঝে আসছে কিছু বাঙালি মুসলমানও। বিহারিদের পাল্লায় পড়ে এদের সংখ্যাটা দিন দিন বেড়েই চলছে। আর এ সুযোগে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী হাতিয়ে নিচ্ছে খসখসে টাকা। ঝকঝকে পয়সা। গড়ে তুলছে সম্পদের পাহাড়। মুনাজাত শেষ হলে এক মহিলার সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করি। কয়েকটি প্রশ্ন করতেই মহিলাটি চলে যায়। হয়তো বুঝতে পারেÑ আমি তাদের দলের কেউ না। বাবার ভক্ত না। পত্রিকায় কিছু লিখতে পারি। আমার লেবাস-পোশাক দেখে এমনটা ভাবাই স্বাভাবিক। একটু পরে অন্য মহিলার কাছে যাই। নাম জিজ্ঞাসা করে দু’একটি বিষয় জানতে চাই। সেও কিছু না বলে দূরে সরে যায়। চিন্তা করি, এভাবে হবে না। এদের থেকে কথা নিতে হলে ভাব ধরতে হবে। ওদের বেশে নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে। তাই গেইটের বাইরে গিয়ে একটি মোমবাতি কিনি। ভাবটা ধরি- মোমবাতিটা বাবার মাজারে দিবো। এরই ফাঁকে কথা বলে নিই দোকানির সঙ্গে। মাজার হওয়ার পর থেকে সে এ ব্যবসা দিয়েছে। দৈনিক ভালো ইনকাম হচ্ছে। বিকালের দিকে বেচা-কেনা বেশি হয়। ইত্যাদি কথা জানতে না জানতেই জুলেখা নামে এক বয়স্ক মহিলা আসেন মোমবাতি, আগরবাতি কিনতে। কথা শুরু করি তার সঙ্গে। সালাম দিয়ে জিজ্ঞাসা করিÑ -চাচী কি মাজারে এসেছেন? -হ বাবা। -কোথা থেকে এসেছেন? -বেড়িবাঁধ মোড় থেইক্যা। অইখানেই আমার বাসা। -কী করেন? -বাসায় কাম করি। -মাজারে নিয়মিত আসেন? -পাঁচদিন ধইরা আইতাছি। ৪০ দিন পর্যন্ত আমু। -৪০ দিন আসবেন কেন? -আমার একটা কামে। ৪০ দিন আইলে কামডা হইবো। - কী কাজ, যে ৪০ দিন আসতে হবে? -আমারে একটা লোকে মিছা মামলা দিয়া হয়রানি করতাছে। আমি চাই ওই লোকের কোনো একটা ক্ষতি হইক। বাবার মাজারে ৪০ দিন মোমবাতি, আগরবাতি দিলে ওই লোকের ক্ষতি হইবো। হেইল্যাইগা আমি আই। -এ কথা আপনাকে কে বলেছে যে- মাজারে ৪০ দিন এগুলো দিলে ওই লোকের কোনো একটা ক্ষতি হবে? -এক মহিলা কইছে। -তার কথা আপনি বিশ্বাস করেন? -অনেকের নাকি এমন হইছে। তাই করি। -কার কার হয়েছে। এমন সুনির্দিষ্ট কারও কথা বলতে পারবেন? জুলেখা চাচি এবার চুপ। কিছু বলতে পারেন না। তারপর অনেকটা সময় নিয়ে তাকে বুঝালাম। তিনি বুঝলেন। শেষে সদ্য কেনা মোমবাতি, আগরবাতি আর গোলাপজলটি দেখিয়ে বললেন, বাবা! তাইলে এইগুলা কি করমু। আমি তাকে সেগুলোর মূল্য দিয়ে বললাম, মসজিদে দিয়ে দেন। মহিলাটি চলে গেলেন। বললেন, ‘মাজারে আর আইমু না। যা চাইমু, সব আল্লার কাছেই চাইমু।’ যাকে ঘিরে মাজার যাকে ঘিরে এ মাজারের জন্ম তার নাম হায়দার আলী। পুরো নাম জুলফিকার হায়দার আলী। ‘হাঁটাবাবা’ নামেও তিনি পরিচিত। প্রচুর পরিমাণ হাঁটতেন বলেই ‘হাঁটাবাবা’ নামটি প্রসিদ্ধি পায়। তার হাঁটার চিত্রটা ছিল এমনÑ ২০/২৫ জন লোক রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। সবার সামনে নুয়ে পড়া একজন বৃদ্ধ। লোকটির চুল, গোঁফ, দাড়ি মিলে একাকার। সঙ্গে চলা বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ ভক্তকুল সবাই নীরবে হাঁটছে। কোনো রা-শব্দ নেই। হৈ হুল্লোড় নেই। লোকগুলো হেঁটেই চলছে। আনমনে। শোনা যায় পুরো ঢাকা শহরে তিনি হেঁটে বেড়াতেন। আজ এখানে তো কাল ওখানে। দুপুর বারটায় মোহাম্মদপুর, একটায় বাংলামটর বা শাহবাগে। মাঝে মধ্যে একটা ভ্যানও চলতো তার পিছনে পিছনে। ভ্যানে বড় বড় ডেগ। ডেগে ভক্তদের জন্য তবারক। হায়দার আলী কোথাও বসলে ভক্তদের মাঝে তখন তবারক বিতরণ করা হতো। তবারকের লোভে অনেক টোকাইও তার পিছনে হাঁটতো। হায়দারের আসল পরিচয় হায়দার আলী মূলত একজন বিহারি। ভারতের বিহার রাজ্যে তার জন্ম। হায়দারের এক ভাই ও এক বোন বর্তমানে পাকিস্তানের অধিবাসী। তিনি উ"চশিক্ষিত ছিলেন। পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানের হাবিব ব্যাংকে চাকরি করতেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের পক্ষ নিয়ে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নির্মম অত্যাচার-নির্যাতন করেছে আজকের হায়দার বাবা। হায়দার আলী তখন সন্ত্রাসী হায়দার নামে পরিচিত ছিল। বুদ্ধিজীবী কবি মেহেরুন্নেসার জীবনীগ্রন্থ থেকে এসব তথ্য জানা যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জেনেভা কনভেনশন অনুসারে অনেক বিহারি পাকিস্তান চলে যায়। তবে হায়দার আলীসহ অনেকে তখন যেতে পারেনি। তারা বাংলাদেশেই আত্মগোপনে থাকে। ১৯৭৫-৭৬ সালে আবার মিরপুর-মোহাম্মদপুরে জনসম্মুখে আসে তারা। কিন্তু আগের পরিচয়ে নয়। আসে নতুন নামে। নতুন পরিচয়ে। হায়দার আলী ১৯৭৭-৭৮ সালের দিকে মিরপুর কবরস্থানে একাকী বসে থাকতেন। তেমন কথা-বার্তা বলতেন না। এর কিছুদিন পর মোহাম্মদপুরে তাকে দেখা যায়। তখন সে রহস্যজনক জীবন কাটাতে শুরু করে। তার এ রহস্যঘেরা জীবনকে সাধারণ মানুষ কারামতি মনে করে। লোকমুখে শোনা যায় দীর্ঘ ৩০ বছর তাকে কেউ অজু-গোসল করতে দেখেনি। কোনোদিন নামাজও পড়তে দেখা যায়নি। এটাই তার বড় কারামত (?)। কথিত খাদেম আব্দুল খালেক বলেন, বাবাকে নামাজের কথা জিজ্ঞাসা করা হলে বাবা বলতেন, ‘আমি আধ্যাত্মিকভাবে নামাজ পড়ি। সেগুলো তোরা বুঝবি না।’ এক সময় মোহাম্মদপুরে তার দুইটি খানকাহ গড়ে ওঠে। একটি নূরজাহান রোডে। অন্যটি তাজমহল রোডে। খানকাহ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে ভক্তসংখ্যা। এলাকার অসাধু ব্যবসায়ীরা আস্তানা গাড়ে হায়দার আলীর খানকায়। খানকার নামে চলে মদ, গাঁজা আর হিরোইনের আড্ডা। অনেক মহিলাও আসে বাবার খানকায়। বাবার বরকত পাওয়ার আশায় পড়ে থাকে রাত-বিরাতে। রাত গভীর হলে সে বরকতের ঝলক মিলে। খানকা জুড়ে চলে রাতভর মাতলামি। একসময় অচেতন হয়ে গায়ের উপর গা রেখে শুয়ে পড়ে কথিত বাবাভক্ত নারী-পুরুষ। খানকাকে কেন্দ্র করে চলতে থাকে অনৈতিক ব্যবসা-বাণিজ্যও। এসবের জন্য কয়েকটি সিন্ডিকেট খাসভক্ত সেজে কাজ করে। তারাই এখন ‘হাঁটাবাবা’র মাজারের খাদেম। মাজারের চিত্র হায়দার ওরফে হাঁটাবাবা গত ১৩ মার্চ বার্ধক্যজনিত কারণে মিরপুরের গ্যালাক্সি হাসপাতালে মারা যান। তাকে দাফন করা হয় ঢাকার মোহাম্মদপুর কবরস্থানে। দাফন করার পর রাতারাতি হায়দারের কবর রূপ নেয় মাজারে। কবরস্থানের উত্তর-পূর্ব কোণে নীরবে কেটে ফেলা হয় অনেকগুলো ফলজগাছ। ঈদগাহ মাঠের দেয়াল ভেঙে বানানো হয় মাজার গেট। গেটের বাইরে ফুটপাতে বসে মোমবাতি-আগরবাতির পসরা। টানানো হয় লাল সালু। দখল করে নেয়া হয় ঈদগাহ মাঠের একাংশ। রাতজুড়ে কবরস্থানে চলে মাতলামি। হাঁটাবাবার নারী-পুরুষ সব ভক্ত মিলে একাকার হয়ে শুয়ে থাকে মাজার ঘেঁষে। রাতের আঁধারে চলে অসাধু ব্যবসা। টাকা পয়সা যায় কই! মাজারে প্রতিদিন আসা ভক্তরা নিয়ে আসেন অনেক তবারক। মান্নত করা জিনিস আসে বেশি। খসখসে টাকা পয়সাও পড়ে প্রচুর। মিষ্টি-পোলাও মাজারে বিতরণ করা হলেও ভক্তদের দেয়া টাকা পয়সা কই যায়, জানতে মুখোমুখি হই মাজারের খাদেমদের। খাদেমরা তখন নানা তথ্য দেন। রাব্বি নামে এক খাদেম বলেনÑ মাজারে উরস হলে এসব টাকা ব্যয় করা হবে। সালাহউদ্দিন নামে অন্য খাদেম বলেনÑ এখানে যারা থাকে এবং মাজারের কিছু কাজ-কাম করে, খরচের জন্য তাদেরকে একশ-দুইশ করে টাকা দিয়ে দেয়া হয়। সিনিয়র খাদেম আব্দুল মালেক দেন ভিন্ন তথ্য। তিনি বলেনÑ আমরা খরচের জন্য কিছু টাকা নিই। বাকি টাকা পাঠিয়ে দিতে হয় কমিটির লোকদের কাছে। কমিটির লোক কারা? এমন প্রশ্নের জবাবে কথিত খাদেম আবদুল খালেক জানান, যারা বাবার নূরজাহান রোডের খানকাটি কিনে দিয়েছিলেন তারাই এ মাজারের কমিটি। তাদের তত্ত্বাবধানেই চলে এর সবকিছু। সামাজিক ও ধর্মীয় সমস্যা ভ- হায়দার আলীর কথিত মাজারের কারণে সামাজিক এবং ধর্মীয় অনেক সমস্যা দেখা দিচ্ছে মোহাম্মদপুর কবরস্থানে। মাজারকে কেন্দ্র করে কবরস্থানে রাত-দিন জ্বালিয়ে রাখা হচ্ছে মোমবাতি-আগরবাতি। কবরে বাতি জ্বালাতে স্পষ্ট নিষেধ করে রাসুল সা. বলেছেনÑ যেসকল নারীগণ মাজারে গমন করে এবং যারা মাজারকে মসজিদ তথা ইবাদতখানা বানায় এবং মাজারে বাতি জ্বালায় তাদের প্রতি আল্লাহ অভিশাপ বর্ষণ করেন। (সুনানে আবু দাউদ : ৩/১৭৯) মাজারে গোলাপজল ছিটানো, সামিয়ানা টানানো, ফুলের তোড়া দেয়াসহ ইত্যাদি বিষয়েও কোরআন হাদিসে স্পষ্ট নিষেধ রয়েছে। (এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে দেখুন, মাসিক রাহমানী পয়গামের মে ‘১৪ এর ‘কোরআন ও হাদিসের আলোকে মাজারের বিধি-বিধান’ শিরোনামের লেখাটি।) মাজারের কারণে সমস্যা হয় ঈদগাহ মাঠে খেলতে আসা ছেলেদেরও। ক্ষোভ প্রকাশ করে এমনটাই জানালেন ক্লাস নাইনে পড়–য়া ছাত্র মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, আমরা প্রতিদিন আসরের পর এখানে খেলতে আসি। মাজার হওয়ার পর থেকে লোকজন আসায় আমাদের খেলায় বাধা পড়ে। ওরা একটা অংশ দখল করে নেয়ায় আমাদের সমস্যা হয়। অসুবিধা হয় সন্ধ্যার পর মাঠে হাঁটতে আসা বয়স্ক নারী পুরুষদেরও। মাজারের গেটে মোমবাতি-আগরবাতির পসরা বসায় বাধা পড়ে ফুটপাত ধরে হেঁটে চলা সাধারণ লোকদেরও। অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে না মটরযান-অটোরিক্সা। এনিয়ে অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় জনসাধারণের। মাজারের পেছনে যাদের হাত মাজারকে কেন্দ্র করে ঈদগাহ মাঠ দখল, কবরস্থানের পবিত্রতা নষ্ট, ফুটপাত দখলসহ সমাজ বিরোধি এসব অপকর্ম আর তেলেসমাতি চললেও চুপ থাকছেন স্থানীয় সমাজপতিরা। উল্টো রাজনৈতিক ফায়দা নিতে নীরবে সাপোর্ট দিচ্ছেন ভ- হায়দারের ভক্তদের। খোঁজ নিয়ে জানা যায় স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ স্থানীয় অনেক আ. লীগ নেতা ভ- হায়দারের জানাজায় শরিক হয়ে মাজারের জন্য ৪/৫ শতক জায়গা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। নির্বাচনে বিহারিদের ভোট পেতে জানাজায় উপস্থিত হয়েছেন বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন আলালও। এনিয়ে কথা বলছেন না মোহাম্মদপুর ঈদগাহ মাঠের দায়িত্বশীল কমিটিও। আর এ সবের সুযোগ নিয়েই বিহারিরা একের পর এক করে যাচ্ছে সমাজ ও শরিয়তবিরোধি সব কর্মকা-। অবশ্য শুরু থেকেই এর পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ করে আসছেন মোহাম্মদপুরের আলেমসমাজ ও ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা। এনিয়ে হায়দারের ভক্তদের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী জামেয়া ইসলামিয়া ওয়াহিদিয়া মাদরাসার ছাত্রদের কয়েকদফা সংঘর্ষও হয়েছে। বিশিষ্টজনদের বক্তব্য বিষয়টি নিয়ে কথা বলি মোহাম্মদপুর থানার প্রাক্তন কমান্ডার, অধ্যাপক, কবি, মুক্তিযোদ্ধা মো. আ. খালেক (আলো) এর সঙ্গে। উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন- ‘আমরাও এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত, উদ্বিগ্ন। তারা যেভাবে কবরস্থানকে মাজারে পরিণত করছে, ঈদগাহের মাঠ দখল করছে, এতে তো আমাদেরই বিশাল সমস্যা। তারা মাজারে মদ-গাঁজা খেয়ে কবরস্থানের পবিত্রতা নষ্ট করছে। এলাকার পরিবেশ নষ্ট করছে। আমি মনে করি, এবিষয়টি নিয়ে সমাজের বিশিষ্টজনদের ভাবা উচিত। প্রশাসনের লোক এটা নিয়ে রাজনৈতিক খেলা খেলতে চাইবে। কিন্তু জনগণের স্বার্থে এ মাজার এখনই উচ্ছেদ করা দরকার। মনে রাখতে হবে, আমরা মুসলমান। আমাদের ইসলামি শরিয়া মোতাবেক চলতে হবে। আমি যতটুকু জানি, হায়দার আলী অজু-গোসল করতেন না। পাক পবিত্র হয়ে নামাজ-কালাম পড়তেন না। নামাজই যদি না পড়ে, তাহলে এমন ব্যক্তি পীর হয় কী করে? তাই আমি বলবো, এমন পীরের নামে মাজার দিয়ে ভ-ামি আমাদের সমাজ থেকে দূর করতে হবে। কথিত মাজার উচ্ছেদ করে ঈদগাহ এবং কবরস্থানের পবিত্রতা ফিরিয়ে আনতে হবে। সেজন্য সবাইকে একজোট হয়ে কাজ করতে হবে।’ কথা হয় মোহাম্মদপুর কওমি মাদরসাগুলো নিয়ে গঠিত শিক্ষাবোর্ডের সভাপতি, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া’র প্রিন্সিপাল মাওলানা মুফতি মাহফুজুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ভ- হায়দারের কথিত মাজার নিয়ে আমরা ভাবছি। প্রশাসনের কিছু লোক ভোট বাণিজ্যের কারণে ভ-দের সাপোর্ট দেয়ায় আমরা হুট করে কিছু করতে পারছি না। তবে আমাদের ভাবনায় আছে। আমরা মোহাম্মদপুরের শান্তিপ্রিয় তৌহিদি জনতাকে সঙ্গে নিয়েই মদ-গাঁজার এ আখড়া উচ্ছেদ করবো ইনশাআল্লাহ।’ ভ- হায়দারের এই মাজার যেভাবে ডাল পালা ছড়াচ্ছে, তা যদি এখনই উচ্ছেদ না করা হয়- তাহলে কিছুদিন পর তা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। কবরস্থানের পবিত্রতা বলতে কিছু থাকবে না। ঈদগাহের মাঠে বসবে মদ জুয়ার আড্ডা। মোহাম্মদপুরের আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াবে কুফুর-শিরিকির জয়ধ্বনী। তাই, ভাবতে হবে এখনই। লেখক : নবীন আলেম ও গদ্য লেখক
প্রেম না পেয়ে প্রাণ নিচ্ছে রায়হানরা : উত্তরণের একমাত্র পথ নৈতিক শিক্ষা ইলিয়াস হাসান
মে'১৪
সমাজে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটতে ঘটতে তা এখন আমাদের কাছে যেন পানিভাত হয়ে গেছে। বড় বড় সব দুর্ঘটনা ঘটে গেলেও তা আমাদের অনুভূতিতে তেমন একটা নাড়া দেয় না। আগে একটা সময় এমন ছিলো, বড় সব দুর্ঘটনা তেমন একটা ঘটতো না। অথবা দেশের যে কোনো প্রান্তে দু-একটি অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটলেও তার রেশ মানুষের মনে থেকে যেত অনেক দিন। ছোটবেলার একটা ঘটনা আজও মনে পড়ে। মুনীর-খুকুর অবৈধ প্রেম এবং মুনীরের স্ত্রী রীমাকে খুনের সেই লোমহর্ষক ঘটনা মানুষের মনে অনেকদিন থেকে গিয়েছিল। অথচ আজ তার সম্পূর্ণ উল্টো। নির্মম একটি ঘটনার রেশ মুছতে না মুছতেই আরো অসংখ্য সব ঘটনার জন্ম দেয় আমাদের এই ঘুনে ধরা সমাজ। কোথাও যেন নৈতিকতার বালাই নেই। নীতিহীনতার কালিমায় আচ্ছন্ন এই সমাজ লাগামহীন ছুটছে অনবরত। কোথায় শেষ এই ছুটে চলার? দুই. চট্টগ্রাম সিডিএ এলাকার ব্যবসায়ী রেজাউল করিমের একমাত্র কন্যা আগ্রাবাদ সিডিএ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী সায়মা নাজনীন। বয়স ষোলো। পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিমতে দেখতে শুনতে মেয়েটি বেশ সুন্দরি। দিনের বেলায় কমান্ডো স্টাইলে এই নাজনীনকে হত্যা করে বখাটে আবু রায়হান ও তার সহযোগী শহীদ। আর মেয়ের খুন হতে দেখে এগিয়ে এসে খুন হন নাজনীনের মা রেজিয়া খাতুন। পুলিশকে দেয়া খুনি আবু রায়হানের জবানবন্দী অনুযায়ী খুনের ঘটনা ছিলো এরকম-সেদিন ছিলো সোমবার। সকালে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী খুলশীর ক্রাউন রেসিডেন্স রেস্টহাউজে গিয়ে তার সহযোগী শহীদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে কীভাবে নাজনীনকে হত্যা করা যায়। পরামর্শ শেষে সেখান থেকে একটি অটোরিকশা নিয়ে তারা দু’জন আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকায় যায়। সকাল সাড়ে আটটা থেকে নাজনীনদের বাড়ির পেছনে স্কুলের কাছে ওঁৎ পেতে থাকে তারা দুজন। নাজনীনের বাবা রেজাউল করিম এবং ভাই সাইফ রেজা বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর তারা ওই বাড়িতে প্রবেশ করে। প্রথমে তারা সরাসরি ওই ভবনের চারতলায় নাজনীনদের বাসার সামনে চলে যায়। রায়হান আড়ালে থাকে আর দরজায় কড়া নাড়ে শহীদ। ভেতর থেকে পরিচয় জানতে চায় নাজনীন। জবাবে শহীদ বলে, আমি তোমার স্কুল থেকে এসেছি, দরজা খোলো। দরজা খুলতেই শহীদ ঝাঁপটে ধরে নাজনীনকে। এ দৃশ্য দেখে পেছন থেকে ছুটে আসেন নাজনীনের মা রেজিয়া খাতুন। তখন আড়াল থেকে বের হয়ে তাকে ঝাঁপটে ধরে আবু রায়হান। রেজিয়া খাতুন ধস্তাধস্তি করতেই তাকে এলোপাতাড়ি কোপাতে শুরু করে আবু রায়হান। একই সময়ে নাজনীনকে ফ্লোরে ফেলে তার পেটে ছুরি চালিয়ে দেয় শহীদ। এরপর মা-মেয়ে দুজনকে উপর্যপুরি কুপিয়ে এবং হাতে পায়ের রগ কেটে দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে রায়হান ও শহীদ। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা দুজনকে খুন করে। এ সময়ে শহীদের প্যান্ট রক্তে মাখামাখি হয়ে যায়। শহীদ দ্রুত প্যান্টটি খুলে পাশের কক্ষে খাটের উপর পড়ে থাকা নাজনীনের বড় ভাই সাইফ রেজার লুঙ্গিটি পরে নেয়। ওই অবস্থায় তারা দুজন বাসা থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা অটোরিকশা করে ফয়েস’ লেক এলাকায় চলে যায়। ইউএসটিসির সামনে থেকে ঢাকামুখী একটি বাসে উঠে পড়ে আবু রায়হান। শহীদ চলে যায় তার রেস্ট হাউসে। রেস্ট হাউস থেকে গোসল করে নাজনীনের বড় ভাইয়ের লুঙ্গিটি ছিড়ে কয়েক টুকরো করে ইউএসটিসির একটি নালায় ফেলে দেয় শহীদ। আবু রায়হান ঢাকায় গিয়ে প্রথমে আঁচড় নামে একটি হোটেলে ওঠে। ওইদিন সেখানে থেকে পরের দিন সকালে ওঠে ফকিরাপুলের হোটেল মুনস্টারে। ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’ কথাটি যেন অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণিত হলো। এক বাকপ্রতিবন্ধীর বর্ণনা অনুযায়ী পুলিশ হোটেল মুনস্টার থেকে গ্রেফতার করে খুনি আবু রায়হানকে। খুনি আবু রায়হানের সংক্ষিপ্ত পরিচয় হলো, পুলিশের একজন সামান্য হাবিলদারের পুত্র হয়েও রাজকীয় জীবন যাপন করতো সে। দুহাতে টাকা উড়াতো। চাল-চলন আর বেশভূষায় মনে হতো সে কোটিপতির ছেলে। তার প্রধান টার্গেট ছিলো মেয়েদের পটানো। এবং এরপর সেই মেয়েদের সর্বনাশ করে ছেড়ে দেয়া। তার বন্ধু শহীদের ভাষ্যমতে, রায়হান নিয়মিত মেয়েদের নিয়ে খুলশীর ওই রেস্ট হাউসে আসতো। বড় বড় শিল্পপতিদের মতোই সে আচরণ করতো। অনেক কিশোরীকে সে এই রেস্ট হাউসে নিয়ে আসে। একবার সে নাজনীনকেও সেখানে নিয়ে যায়। রেস্ট হাউসে এসে রেস্ট হাউসের কর্মচারীদের সঙ্গে রায়হানের সম্পর্ক দেখে নাজনীন নিশ্চিত হয়ে যায় যে, রায়হান এখানে নিয়মিত আসে। আর এটা বুঝতে পেরেই রায়হানের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিন্ন করে নাজনীন। অবশ্য নাজনীন প্রথমে কোনো কিছু না বুঝেই তার প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। কিন্তু পরে যখন সে রায়হানের আসল রূপ দেখতে পায় তখন সে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। আর রায়হানের দাবি হলো, নাজনীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। সম্প্রতি নাজনীন তাকে এড়িয়ে চলছিল। নাজনীন প্রথমে রায়হানকে বড়লোকের ছেলে মনে করে তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। কিন্তু কিছুদিন পর সে যখন জানতে পারে, রায়হান পুলিশের সামান্য এক হাবিলদারের ছেলে, তখন থেকে নাজনীন তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। আর এজন্যই প্রতিশোধ নিতে তাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করে রায়হান। পুলিশের ছেলে হওয়ায় রায়হান ছিলো বেপরোয়া। পড়ালেখায় তেমন ভালো না হলেও আড্ডাবাজি আর মাস্তানিতে তার জুড়ি ছিল না। একজন মাত্র সহযোগী নিয়ে মা-মেয়ে দুজনকে হত্যার ঘটনা প্রমাণ করে সে কতটা বেপরোয়া। তিন. রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক চলমান অস্থিরতা, সমাজে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, আকাশ সংস্কৃতির নামে বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ, পারিবারিক ও নৈতিক এবং ধর্মীয় শিক্ষার অভাব, পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে পড়াসহ নানা কারণে এমন সব ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করছেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। অশ্লীলতা-বেহায়াপনার প্রসার এবং তরুণ-তরুণীদের অবাধ মেলামেশার অবারিত সুযোগ তরুণ-তরুণীদের বিপদগামী করে তুলছে। এ অবস্থাকে আশঙ্কাজনক উল্লে¬খ করে এর বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলারও পরামর্শ দিয়েছেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতিরোধে প্রয়োজন সকলের সচেতনতা এবং সামাজিক প্রতিরোধ। অধিকাংশ খুনের পেছনে অনৈতিক সম্পর্কের কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। এ প্রবন্ধ যেদিন লিখছি, ঠিক সেদিনেরই খবর মিরপুরে প্রেম সংক্রান্ত কারণে জোড়া খুন। উঠতি বয়সের তরুণ কিশোররাও নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ ধরনের নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। একটি পরিবারের মা-বাবা যদি সচেতন থাকেন, তারা যদি সন্তানদের কাছে যেতে পারেন, তাদের সন্তানরা কার সঙ্গে মিশছে, অবসর সময়ে কী করছে তার খোঁজ-খবর রাখেন, তাহলে সন্তানদের বিপদগামী হওয়া থেকে রক্ষা করা সহজ। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক শিথিল। সন্তানের বাইরের জগত সম্পর্কে অভিভাবকরা কিছুই জানেন না। বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. গাজী সালেহ উদ্দিন বলেন, বর্তমানে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে অসম প্রতিযোগিতা চলছে তার নেতিবাচক প্রভাব হিসেবে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। পারিবারিক ও ধর্মীয় শিক্ষা এবং নৈতিক মূল্যবোধের অভাবে কিশোর এবং উঠতি বয়সের যুবকেরা ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। সমাজে অসম প্রতিযোগিতা, অস্থিরতা আর বৈষম্য এতটাই প্রকট আকার ধারণ করেছে যে, স্বার্থের দ্বন্দ্বে মানুষ হত্যা করাকেও তারা অপরাধ মনে করছে না। আবার বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণেও অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। এই ভয়ঙ্কর প্রবণতা রোধে নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। অনৈতিক পথে গেলে কী পরিণতি হতে পারে, সে সম্পর্কেও শিক্ষার্থীদের সচেতন করা উচিত। নৈতিক শিক্ষা বলতে প্রকৃতপক্ষে ইসলামি শিক্ষাকেই বুঝায়। প্রচলিত ধারার দুনিয়াবী যে শিক্ষাব্যবস্থা, তাতে বড় ডক্টর হওয়া যায়, আর্কিটেক্ট হওয়া যায়, দুনিয়া জুড়ে নাম কুড়ানো বিজ্ঞানী হওয়া যায়, কিন্তু প্রকৃত মানুষ হওয়া যায় না। প্রকৃত মানুষ হওয়ার কোনো কিছু এ শিক্ষাব্যবস্থায় নেই। অপরপক্ষে ইসলামি শিক্ষার প্রতিটি ধাপেই রয়েছে একজন মানুষ কিভাবে প্রকৃত মানুষ হতে পারবে। ভালো আর মন্দগুলোর মধ্যে দেখানো হয়েছে সুস্পষ্ট ব্যবধান। ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থায় আরো রয়েছে মন্দকাজের পরিণতি এবং ভালোকাজের পুরস্কার সম্বন্ধে বিশেষ ধারণা। এ কারণেই এখন পর্যন্ত দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিতদের মাধ্যমে সমাজে উল্লেখযোগ্য কোনো অপরাধে লিপ্ত হওয়া চোখে পড়ে না। অপরদিকে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার কোনো বালাই নেই। শুধু বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করার কথাই সেখানে আছে, নেই শুধু একজন মানুষ কিভাবে প্রকৃত মানুষ হতে পারবে সেই শিক্ষা। সন্তানদের ইসলামি মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা সব অভিভাবকের দায়িত্ব। ইসলাম ধর্মে নৈতিক শিক্ষার ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ইসলামের বিধি-বিধানের অনুসরণ করা হলে সমাজে এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হতো না। তাই সমাজকে বাঁচাতে হলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে অবশ্যই নৈতিক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটাতে হবে।
কথিত আধুনিকতা ও প্রগতি ওয়েস্টার্ন কালচার আমদানী করছে ইলিয়াস হাসান
এপ্রিল'১৪
মিরপুর-১০ থেকে বাসে উঠেছি। পল্টনে যাবো। আমার পাশের সিটটি তখনো খালি। একটু পরে একটি মেয়ে উঠলো বাসে। মেয়ে তো নয়...। আসলে তার জন্য সঠিক কোন শব্দ ব্যবহার করবো জানা নেই। এলোমেলো শ্যাম্পু করা সিল্কি চুল। পরনে টাইট-ফিট জিন্সের প্যান্ট। গায়ে শর্ট ফতুয়া। ওড়না কেনার পয়সা হয়তো হয়নি। ওড়না নেই গলায়। পিঠের বড় অংশ খোলা। আর বুকের কথা কী বলবো? বলতে লজ্জা হচ্ছে। স্পর্শকাতর ও প্রধান আকর্ষণীয় অংশটুকু চরমভাবে উন্মুক্ত। বাসের যাত্রীগুলোর দৃষ্টি যেন এক সঙ্গে মেয়েটির ওপর গিয়ে আবদ্ধ হলো। দৃষ্টিগুলো যেন মেয়েটিকে গিলে খাচ্ছে। আমার পাশের সিটটি ছাড়া আর কোনো সিট খালি ছিল না। মেয়েটি ইতিউতি তাকিয়ে আমার পাশের খালি সিটেই বসে পড়লো। অনেক দিন বাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছি, কিন্তু এরকম কোনো মেয়ে তো দূরের কথা; সাধারণ কোনো মেয়ের পাশের সিটেও বসিনি। আর আজকে আমার বসতে হলো না, আমার পাশেই কোনো এক মেয়ে বসেছে। তার পোশাকের এই চরম উদারতা আমাকে এতোটা অস্বস্তির মধ্যে ফেললো যে, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। কখন মেয়েটি নামবে বা আমি আমার গন্তব্যে এসে পৌঁছবো, মনে মনে তীব্রভাবে সেই অপেক্ষাই করছিলাম। সাধারণ কোনো যুবক হলে বিষয়টি হয়তো এনজয় হিসেবে দেখতো। এমনকি ‘ওভার স্মার্টনেস’ দেখানোর বৃথা চেষ্টা করতো। কিন্তু আমাদের মতো ইসলামি পোশাকধারি মানুষগুলোর বেলায় হয় যতো সব ঝামেলা। এমন সব পরিস্থিতি আমাদের জন্য অস্বস্তি ও বিব্রতকর অভিজ্ঞতারই জন্ম দেয়। তখন মনে হয় ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। আগে যেসব পোশাক-আশাক পরে মেয়েরা নিজেদের ঘরে আপনজনদের মধ্যে চলাফেরা করতেও দ্বিধাবোধ করতো, আজকাল তার চেয়েও বেশি খোলামেলা পোশাক পরে মেয়েরা রাস্তা-ঘাট, বাজার, শপিংমল ও বিভিন্ন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করছে। বেডরুমের পোশাক পরেও বাইরে বের হতে বুঝি আজ মেয়েদের লজ্জাবোধ হচ্ছে না। দুই. আমার বাসা থেকে বের হয়ে গলির পরে যে মেইন রাস্তা, তার দু’পাশে দুটি নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। একটা হলো স্কলাস্টিকা আরেকটি হারম্যান মেইনার কলেজ। এখানে আগত ছাত্র-ছাত্রীদের এমন কিছু মহিলা অভিভাবক আসেন, যাদের চাল-চলন দেখলে ভাবতে বাধ্য হই যে, এসব কথিত আধুনিকাদের সন্তানরা আরো কতোটা আধুনিক হবে ভবিষ্যতে? মধ্যবয়সী একেকজন মহিলার সাজগোজ দেখলে হাসি পায়। যে সব সাজগোজ তাদের বয়সের সঙ্গে মানায় না, সেসব সাজগোজই তারা করে থাকেন নিজেদের বয়সের ভারত্বকে আড়াল করার জন্য। তাদের এই জোর করে ইয়াং সাজতে যাওয়া রুচিহীনতারই পরিচয় প্রদান করে। শুধু এখানেই নয়, বরং প্রত্যেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই সন্তানদের সঙ্গে আসা অভিভাবক মহিলাদের চালচলন বেশ দৃষ্টিকটু। এছাড়া এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রীরা ক্লাসের দিনগুলি ছাড়া অনুষ্ঠানের দিনে এমন সব পোশাক পরে আসে এবং কনসার্টের নামে উন্মাদ হয়ে যায়, তা যে কোনো রুচিশীল মানুষের কাছে নিশ্চয় পরিহার্য। সন্ধ্যার পর গলি থেকে বের হয়ে যখন একটু রাস্তার দিকে আসি, তখন যে কমন চিত্রটি চোখে পড়ে তাহলো, রাস্তার দু’পাশে দু’টি চটপটি ও ফুসকার দোকান, তাতে আধুনিকা নারীদের পা ঝুলিয়ে বসে বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে চটপটি বা ফুসকা খাওয়ার দৃশ্য। উগ্রপোশাকে এসব মেয়েদের খোলামেলা জায়গায় বসে চটপটি বা ফুসকা খাওয়ার দৃশ্য দেখে অবশেষে আমার মতো ‘আনকালচার্ড’ (তাদের ভাষায়) মানুষের লজ্জায় পড়তে হয়। এসব খাবার কিন্তু তারা বাসায় বসে তৈরি করেও খেতে পারে। কিন্তু এই খোলামেলো পরিবেশে এসে বয়ফ্রেন্ডকে সঙ্গে নিয়ে না খেলে হয়তো তাদের কথিত আধুনিকতা ও প্রগতি ঠিক থাকে না। এছাড়া হোটেল, রেস্তোঁরা ও ফার্ষ্টফুডে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আজকালের ছেলেমেয়েরা তো নষ্ট করছেই। দু’একটি খাবারের অর্ডার দিয়ে সেই খাবারের পে¬টে চামচ বাড়ি দিতে দিতে পার করে দিচ্ছে অনেক সময়। সেই অনেকটা সময়ও তখন তাদের কাছে নিতান্তই কম সময় মনে হয়। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বা কোচিং-এর কথা বলে ছেলেমেয়েরা দেদারসে নষ্ট করছে সময়। আর দ্রুত বখে যাচ্ছে এসব ছেলেমেয়ে। অভিভাবকরা কেউ হয়তো জানেন, আবার কেউ হয়তো খবরও রাখছেন না যে, তাদের ছেলেমেয়েরা কোথায় যায়, কী করে, কার সঙ্গে মেশে! আর এর পরিণাম তো প্রতিনিয়তই আমাদের সমাজ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। পত্রিকার হেডলাইনের জন্ম দিচ্ছে তারা। তিন. তুলির বান্ধবি ইতি। তুলির বাবা সকালে অফিসে চলে যান, ছোট ভাই ক্লাস নাইনে পড়ে। তুলি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার্থী। একদিনের ঘটনা, তুলির মা তুলির ছোট ভাইয়ের সঙ্গে তার স্কুলের একটা প্রোগ্রামে গিয়েছেন। বাসায় একা তুলি। ইতিকে ফোন করেছে, ইতি আসবে। সঙ্গে আসবে ইতির বয়ফ্রেন্ড। বাসায় লোকজন চলে আসার আগ পর্যন্ত ইতি তার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে তুলির বাসায় থাকবে। কথামতো ইতি তার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে আসার পর তুলি ওদের জন্য আলাদা একটা রুমের ব্যবস্থা করে দিলো। ওরা রুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে নিজেদের মতো করে সময়টা উপভোগ করতে লাগলো। আর এদিকে ইতি ওদের জন্য দুপুরের রান্নার আয়োজন করলো। রান্নার পর ওদের দরজায় নক করে ওদেরকে নিয়ে এসে একসঙ্গে তিনজনে দুপুরের খাবার খেলো। খাওয়ার পর আবার ইতি তার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে রুমে চলে গেল। শুধু এই একদিনই নয়, এরকম সুযোগ ইতি প্রায় সময়ই তার বান্ধবিকে করে দেয়। আশা করি এই বর্ণনায় আর কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন রাখে না। স্পষ্টতই বোঝা যায় রুমের মধ্যে তারা পারষ্পারিক ‘শারিরিক পরিচয়’ লাভ করছে। আরো অবাক করার মতো কথা হলো, এটা নাকি তাদের কাছে কোনো ব্যাপারই না। সচারচার এসবে তারা অভ্যস্ত। বিবাহ বহির্ভূত এসব শারীরিক লেনদেনকে তারা কোনো অপরাধের চোখে দেখছে না বা কখনো তাদের বিবেকবোধে নাড়া দেয় না। আগে শুনেছি এসব কৃষ্টি কালচার নাকি শুধু ইউরোপ আমেরিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এখন মনে হয় আমাদের সমাজ কতোটা উন্নত (?) হয়েছে। আমাদের সমাজের ছেলেমেয়েরাও ইউরোপ আমেরিকার মতো ফ্রি সেক্স কালচার রপ্ত করতে সক্ষম হয়েছে। চার. ক্ষয়িষ্ণু সমাজের যে অবক্ষয়ের চিত্র উপরে তুলে ধরলাম তা হয়তো অনেকেই জানেন। অনেকেরই চোখের সামনে ঘটছে এসব ঘটনা। জানেন ঠিকই, কিন্তু আপনি গভীরভাবে ভাবছেন না। বিবেকের দরজা খুলে আপনি উপলব্ধি করছেন না। আসলে একটি সমাজ অবক্ষয়ের দিকে দ্রুত ধাবিত হয় তখনই, যখন সমাজের মানুষগুলোর বিবেকের সামনে পর্দা পড়ে যায়। অথবা বিবেকবান মানুষগুলো বিবেকহীনতার পরিচয় দেয়। এই সমাজ ও এই প্রজন্ম তো আপনারই। এই নোংরামি ও কদর্যতার সয়লাবে যখন সমাজ পুরোপুরি প্লাবিত হবে, তখন ভবিষ্যত প্রজন্মকে আপনি কী দিয়ে গেলেন? নষ্ট কিছু সময় তাদের জন্য রেখে যাওয়া ছাড়া তাদেরকে তো কিছুই দিয়ে যেতে পারলেন না। সুতরাং বিবেকের দুর্বলতা থেকে বেরিয়ে এসে পঙ্কিলমুক্ত একটি সমাজ ও প্রজন্ম কি আমরা উপহার দিতে পারি না? সালাহউদ্দিন আইয়ুবী বলেছিলেন, ‘কোনো দেশকে যদি ধ্বংস করতে হয় তাহলে সেদেশের যুবক-যুবতিদের মধ্যে অশ্ল¬ীলতা ও নোংরামি ছড়িয়ে দিলেই যথেষ্ট।’ তাঁর এ কথার যথার্থতা আজ আমরা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছি। আমাদের সমাজ শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত হলেও নৈতিকতার দিক দিয়ে চরমভাবে ধ্বংসের মুখে। বিভিন্ন দিবসে, অনুষ্ঠানে, কনসার্টে ও বিশেষ করে ক্রিকেট ম্যাচে যুবক-যুবতিদের নির্লজ্জ উন্মাদনা ও বেহায়াপনা আমাদের দেশীয় কৃষ্টি-কালচারকে চরমভাবে ক্ষুন্ন করছে। তারা নিজেরা হচ্ছে বিপদগামি, সমাজ ও নতুন প্রজন্মকে করছে বিভ্রান্ত, সর্বোপরি ধর্মীয় বিধানকে লঙ্ঘন করে করছে চরম নাফরমানি। এই উন্মাদনা, অশ্ল¬ীলতা ও নোংরামি কেন? যুবক-যুবতিদের কেনই বা এই উচ্ছনে যাওয়া? উত্তর একেবারেই পরিষ্কার। যে জাতি ধর্ম থেকে যতো দূরে থাকবে বা ধর্মকে একেবারেই পাশ কাটিয়ে চলার চেষ্টা করবে এবং অহেতুক কথিত আধুনিকতার দোহাই দিয়ে ধর্মীয় জীবনযাপনকে তুচ্ছ ও সেকেলে বলে জানবে, সে জাতির এভাবে নৈতিক পদস্খলন, সর্বশেষে জাতীয় পদস্খলন অনিবার্য। ইউরোপ আমেরিকা এ বিষফল ভোগ করতে শুরু করেছে অনেক আগে থেকেই। সেখানে এখন পারিবারিক বন্ধন নেই। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নেই বিশ্বাস ও আস্থা। পিতামাতা সন্তানকে এবং সন্তানও পিতামাতাকে বিশ্বাস করে না। পবিত্র কুরআনের সুরা নূরের ৩০-৩১ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে নবী, আপনি মুমিন পুরুষগণকে বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনমিত রাখে এবং যৌন পবিত্রতা রক্ষা করে চলে। এটাই তাদের জন্য পবিত্রতম পন্থা। নিশ্চয়ই তারা যা কিছু করে, আল্ল¬াহ তা জানেন। তেমনিভাবে মুমিন নারীগণকে বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনমিত রাখে এবং নিজেদের যৌন পবিত্রতা রক্ষা করে চলে। তারা যেন স্বীয় সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে, শুধু ঐ সৌন্দর্য ব্যতীত, যা সাধারণত প্রকাশিত হয়ে পড়ে এবং তারা যেন স্বীয় বুকের উপরে আবরণ বা চাদর টেনে দেয়।’ শান্তি-সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক অস্থিরতা দূর করতে হলে যে যতো কথাই বলুক, যতো পথ ও পদ্ধতি আবিষ্কার হোক, যতো আইন ও বিধান জারি হোক, ইসলাম যে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ অনেক আগেই আবিষ্কার করেছে, তার কোনো বিকল্প নেই। নির্দ্বিধায় বলতে পারি, সঠিক পর্দাপালনের মাধ্যমে যুবক-যুবতি ও নারী-পুরুষের এই উন্মাদনা দূর হতে পারে। সামাজিক অস্থিরতা দূর হয়ে সমাজে আসতে পারে শান্তি ও পবিত্রতা। প্রতিষ্ঠিত হতে পারে একটি আদর্শ সমাজ।
অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া মিতার গল্প এবং
সমাজের কাছে আমার কিছু আবদার
ইলিয়াস হাসান
মার্চ'১৪ রাত তখন ১২টা। ১৪ ফেব্র“য়ারি। বালিশের পাশে রাখা মিতার মোবাইলে এসএমএস টোন বেজে ওঠে। আধোঘুম মাখা চোখ খুলে মিতা মোবাইল হাতে নেয়। মেসেজটি ওপেন করে। শুভর মেসেজ। লিখেছে ‘হ্যাপী ভ্যালেনটাইন ডে...’। মেসেজ দেখে মিতার চোখের ঘুম চলে যায়। মিতা কল ব্যাক করে শুভর নাম্বারে। শুভ রিসিভ করে। একই সঙ্গে দুজনেই ‘হ্যাপী ভ্যালেন্টাইন’ বলে ওঠে। কাল ভালোবাসা দিবসে মিতা আর শুভ কোথায় কোথায় যাবে, কী করবে, সব প্লান করে। মিতা আর শুভর সম্পর্কটা প্রায় ছয়মাস ধরে। তাদের মধ্যে প্রথম পরিচয় হয়েছিল সিনেপ্লেক্সে নতুন একটা সিনেমা দেখতে গিয়ে। মিতা সেদিন তার দুই বান্ধবীর সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। ভিড় ঠেলে টিকেট সংগ্রহ করতে কষ্ট হচ্ছিল। অদূরে দাঁড়ানো বেশ স্মার্ট একটা ছেলেকে বলতেই ছেলেটি ভিড়ের সঙ্গে লড়াই করে তাদেরকে টিকেট এনে দেয়। সেই থেকে পরিচয়। পরিচয় থেকে প্রণয়। সকালে টিএসসি চত্বরে মিতা অপেক্ষা করতে থাকে। হাতে এক স্টিক ফুল। এখানে এসে মিতা প্রথমেই ফুলের দোকানে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে ফুল সংগ্রহ করতে পেরেছে। ১৩ ফেব্র“য়ারি রাতের মধ্যেই সব দোকানের ফুল যেন উধাও হয়ে গেছে। মিতা অনেক কষ্টে কিছু ফুল সংগ্রহ করতে পেরেছে। ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে সে দু’চোখের পাতায় কতো স্বপ্ন আঁকছে! সেই স্বপ্নগুলো শুধুই শুভকে নিয়ে। এই ফুলের মতোই নিজের সবটুকু ভালোবাসা সাজিয়ে রেখেছে শুভর জন্য। শুভকে নিয়েই তার ভবিষ্যতের সব ভাবনা। মিতার কল্পনার জগতে ছেদ টেনে দিয়ে শুভ এসে সামনে দাঁড়ায়। দুজনের হাতের ফুলগুলো দুজনে বিনিময় করে। আজকের দিনটা ফাগুনের দ্বিতীয় দিন। প্রকৃতির মধ্যে অসাধারণ একটা কোমলতা ও সৌন্দর্য আছে। গাছে গাছে কোকিলের ডাক। ফাগুনের আগুন লাগা প্রকৃতি! শুষ্ক আবহাওয়া। ভালোবাসার জুটিগুলো আকর্ষণীয় সাজে সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাস্তবে সবাই যেন লজ্জার মাথা খেয়েছে। গাছের গোড়ায়, পার্কের বেঞ্চে, এখানে সেখানে জোড়ায় জোড়ায় তথাকথিত ভালোবাসার জুটিরা। মিতাকে নিয়ে শুভ প্রথমে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। মিতার অনেক ভালো লাগে ‘ভালোবাসার দিনে’ ভালোবাসার মানুষটির হাত ধরে ঘুরে বেড়াতে। মিতার অসম্ভব আবেগ উচ্ছ্বাস যেন উপচে পড়ে। আশুলিয়ার খোলা প্রকৃতির নির্জন কোনো এক স্থানে বসে কথা বলে দুজনে। ভবিষ্যতের স্বপ্ন সাজায়। শুভর সব কথা মিতা বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করবেই না কেন? শুভর মধ্যে কথা বলার এবং মানুষকে কাছে টানার অসম্ভর এক শক্তি আছে। শুভ যখন কথা বলে, মিতা তখন তার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকে। তার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দকে গিলে খাওয়ার চেষ্টা করে। চোখেমুখে ভীষণ কৌতুহল মেখে শুভকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করে। কিন্তু আবিষ্কার করতে পারে না। মিতার কাছে মনে হয়, শুভ যেন এক স্রোতস্বিনী গভীর নদী। কুলহীন, কিনারাহীন, তলাহীন যে নদী। যার গভীরতা আবিষ্কার করা অসম্ভব। মিতার এই সীমাহীন বিমুগ্ধতার পরিধি বুঝতে পারে শুভ। তার শ্যাম্পু করা এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দেয় সে। মিতা না করে না। সে মনে করে শুধু চুলে একটু হাত বুলানো মাত্র। আর কিছু তো না! ভালোবাসার মানুষটির এমন ছোট্ট মধুর স্পর্শ থাকতেই পারে। ছোট ছোট চাওয়া থাকতে পারে। আর আজকের দিনটা তো ভালোবাসারই দিন! মিতাকে নিয়ে এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে শুভ। বন্ধুর সঙ্গে মিতাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কথা বলে। মিতা রাজি হয়। মিরপুরে পাঁচতলা একটি বাড়ির তিনতলায় বন্ধুদের ফ্ল্যাট। মিতাকে নিয়ে শুভ সেখানে যায়। শুভর বন্ধু ওদেরকে কথা বলতে দিয়ে বাইরে চলে যায়। বাসায় তখন থাকে শুধু মিতা আর শুভ। মিতা একটু অবাক হয়। বাসার আর সদস্যরা কোথায়? আর শুভর বন্ধু এভাবে তাদেরকে একা রেখে চলে গেল কেন? এক সময় মিতার সব ভুল ভাঙে। শুভকে নিয়ে সে বিশ্বাস ও ভালোবাসার যে সুউচ্চ পিরামিড তৈরি করেছিল, শুভ তা জোর করে ভেঙে দেয়। শুভর প্রতি তার যে মোহ ছিল সেই মোহ কেটে যায়। মুগ্ধতাগুলো মুহূর্তের মধ্যে উবে যায়। মিতার আত্মরক্ষার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। একটি মরা লাশের মতো নিজেকে শুভর কাছে তুলে দিতে বাধ্য হয়। শুভর কথাবার্তা, আচার-আচরণ ও অন্যান্য বিষয়গুলো ভালোভাবে পরখ করে মিতা বুঝতে পারে, শুভর সব ভালোমানুষী ছিল কেবলমাত্র এই সামান্য সময়কে জয় করার জন্য। আর শুভ তাতে জয়ী হয়েছে। কিন্তু মিতা? মিতা হেরে গেছে জীবনের সঙ্গে। সে যে এক মিথ্যা বালুর বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল, তা সে এখন বুঝতে পেরেছে। কিন্তু ততোক্ষণে সব শেষ। একটি মেয়ের আজন্ম লালিত যে স্বপ্ন, যে সম্পদ, সব শুভ ধুলিস্যাত করে দিয়েছে। মিতা আরো বুঝতে পারে, শুভ এভাবে শুধু এক মিতার স্বপ্নকেই ধুলিস্যাত করেনি, অসংখ্য মিতাকে সে এভাবে তার ভালোমানুষী দিয়ে জয় করেছে। ভালোবাসা দিবসকে অবলম্বন করে অসংখ্য মিতার স্বপ্নকে হত্যা করেছে। এরপর থেকে মিতা নির্বাক হয়ে যায়। কারো সঙ্গে তেমন একটা কথা বলে না। স্বপ্ন ও বিশ্বাস ভঙ্গের কষ্ট কতো যে গভীর, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানে। মিতার চারপাশটা যেন সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ে। তার পৃথিবীটা ছোট হয়ে যায়। সে নিজেকে আস্তে আস্তে অবরুদ্ধ করে ফেলে অন্ধকারে। অন্ধকারই যেন তার কাছে প্রিয় হতে শুরু করে। সেই সঙ্গে যোগ হয় ড্রাগস। ড্রাগসের মাধ্যমে অল্প সময়ের জন্য হলেও মিতা চেষ্টা করে অবিশ্বাসের এই দুনিয়া থেকে একটু হলেও আড়ালে থাকতে। হাসি-খুশি চঞ্চল মেয়েটা পৃথিবীর সব স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে সরে পড়ে। আর মিতার বাবা-মা? প্রিয় সন্তানের অনিশ্চিত ও অন্ধকার পথের যাত্রায় ব্যাকুল হয়ে পড়েন। মিতা এখন ধানমন্ডির একটি মানসিক ক্লিনিকে চিকিৎসারত। সেই চঞ্চল মিতা আবারো স্বাভাবিক জীবন নিয়ে বাবা-মায়ের কোলে ফিরে আসবে তো?
দুই. নব্বই দশকে সাদা চুলধারী এক বুদ্ধিজীবী বিদেশ থেকে ধার করে এনে এদেশে ‘ভালোবাসা দিবসের’ প্রচলন ঘটান। তিনি অবশ্য শুরুতে সন্দিহান ছিলেন যে, তার এই ধার করা সংস্কৃতি এদেশের মানুষ কতোটা গ্রহণ করবে! এবং তিনি এতে সমালোচনার শিকার হবেন কি না! কিন্তু বাংলাদেশ বলে কথা, এদেশের মানুষের সঙ্গে ‘হুজুগে বাঙালি’ বলে একটা তকমা জুড়ে দেয়া আছে। যাচাই-বাছাই না করেই আমরা বাঙালি জাতি যে কোনো কিছু গ্রহণ করে নিতে প্রস্তুত থাকি। কিন্তু এটা আমাদের সমাজের জন্য, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কতোটা ক্ষতিকারক তা একবারও ভেবে দেখি না। ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ বা ভালোবাসা দিবসের বিদেশ থেকে আমদানিকারক মি. শফিক রেহমান সাহেব শুধু আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি বিকৃত করতেই পটু নন, তিনি নিজের নামেরও বড় ধরনের বিকৃত করে সুখানন্দই পেয়েছেন। তার মূল নাম শফিক রহমান এর ‘রহমান’ আল্লাহপাকের একটি গুণবাচক নাম। এটিকে বিকৃত করে তিনি ‘রেহমান’ বানিয়েছেন। তিনি তার সম্পাদিত মৌচাকে ঢিল ম্যাগাজিনে ভালোবাসা সংখ্যায় এমন নোংরা সব বিষয়ে মূল প্রতিবেদন ছাপেন, যাতে একটি ভদ্র ফ্যমিলেতে ম্যাগাজিনটি রাখা দায় হয়ে পড়ে। তার ওইসব প্রতিবেদন দেখে মনে হয়, এই বয়সেও বুড়োর ‘ভিমরতি’ ধরেছে। তথাকথিত এসব ভালোবাসাবাসির মুখে সর্বজনীন ভালোবাসার কথা থাকলেও আসলে তা এককেন্দ্রিক ভালোবাসা। যুবক-যুবতিদের জন্যই যেন ভালোবাসা দিবসের জন্ম। এই দিনে অবাধ অশ্লীলতা ও বেলেল্লাপনার সুযোগ পায় তারা। সর্বজনীন ভালোবাসাই যদি দিবসটির উদ্দেশ্য হয়ে থাকতো, তাহলে এই দিবসে গরিব-দুঃখি অসহায়দের পাশে কেন আয়োজন করে দাঁড়ানো হয় না? কেন রাস্তার পাশে এখনো ক্ষুধার্ত মানব সন্তান ছিন্নমূল অবস্থায় পড়ে থাকে? কেন শীতে জর্জরিত মানুষগুলো গায়ে জড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত কাপড় পায় না? আসলে সবই ধোঁকা। সর্বজনীন ভালোবাসার কথা বলে যুবক-যুবতিদের মধ্যে ব্যাপক অশালীন কর্মকাণ্ড প্রসার করাই উদ্দেশ্য। এটা মোটেও আমাদের সংস্কৃতি হতে পারে না। এই সংস্কৃতি আমাদের মাটি, মানুষ ও মানুষের অনুভূতির সঙ্গে যায় না। এটা সম্পূর্ণ পশ্চিমা সংস্কৃতি। সেখানে অবাধ যৌনতা কোনো অপরাধ নয়। দুজনের সম্মতি হলেই হলো। পারস্পারিক সম্মতিভিত্তিক যৌনসম্পর্ক সে দেশে পাপের মধ্যে পড়ে না। যে কারণে কুমারি মাতার সংখ্যাও সেসব দেশে নিয়মিতই বেড়ে চলেছে। ওরা চায় এমন কিছু সংস্কৃতি থাকবে, যে গুলোকে অনুসরণ করে মুসলিম দেশের মানুষগুলোও ওদের মতোই কুত্তা-শুয়োরে রূপান্তরিত হবে। অবশ্য ওইসব নোংরা সংস্কৃতিতে সভ্য সব শব্দের মোড়কে পেচিয়ে আমাদেরকে খাওয়ানো হচ্ছে। যেন সভ্য শব্দের মোড়ক দেখেই আমরা গলে যাই। আর হচ্ছেও তো তা-ই। সর্বজনীন ভালোবাসার কথা বলে ভালোবাসা দিবস নামের নোংরা সংস্কৃতির প্রসার ওরা আমাদের মধ্যে খুব সহজেই ঘটাতে পেরেছে। মুসলিম দেশগুলোর যুবক-যুবতিদের নৈতিকভাবে কদর্যপূর্ণ করার এটা নিশ্চয় একটা উত্তম হাতিয়ার। আর পশ্চিমা বিশ্বের এসব নোংরা সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসারে আমাদের দেশীয় এজেন্ট এবং মিডিয়াগুলো তো রয়েছে-ই! আদরের মেয়ে ঐশী জন্মদাতা বাবা-মাকে নিজ হাতে ছুরি চালিয়ে হত্যা করেছে। সেই ক্ষত এখনো শুকায়নি। সেই নির্মম গল্প মানুষ এখনো ভোলেনি। কেন সমাজে এই ঐশীরা তৈরি হয়? কেন মিতারা অন্ধকারে হারিয়ে যায়? এখনো কি সমাজের বিবেকবানরা তা ভাববে না? ভালোবাসা দিবসের মতো নোংরা বিজাতীয় সংস্কৃতি, ডিজে পার্টি, অশ্লীল নৃত্যানুষ্ঠান, কনসার্টের নামে নারী-পুরুষের উন্মত্ততা ও অধিকাংশ সিনেমা-নাটকের অসামাজিক গল্প আমাদের সমাজে ঐশীদের তৈরি করছে। মিতাদেরকে ভুল পথে পরিচালিত করছে। সর্বোপরি কথা হলো, প্রকৃত ভালোবাসার কোনো দিন-ক্ষণ বা তারিখ নেই। সারা বছরই সর্বজনীন ভালোবাসার জন্য। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা, বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের ভালোবাসা, প্রতিবেশীর জন্য প্রতিবেশীর ভালোবাসা, বাড়ির পাশের না খাওয়া ছিন্নমূল শিশুটির জন্য ভালোবাসা, মোটকথা মানুষের জন্য মানুষের ভালোবাসার নির্দিষ্ট কোনো দিন-ক্ষণ লাগে না। সর্বজনীন ভালোবাসার নামে পশ্চিমা সর্বনাশা এই নোংরা সংস্কৃতি আমরা চাই না। এখনই এর লাগাম টেনে ধরা সমাজের প্রত্যেক বিবেকবানের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য।
খানজাহান আলীর দরবারে ফজলুদ্দিন শিবলী
কথায় বলে মক্কার মানুষ হজ পায় না। আসলেই কী তাই। হজ পায় না, নাকি সুযোগ হয় না। কারণ মক্কার মানুষ যদি প্রতি বছরই হজ করে তাহলে বিশ্বের অন্যান্যদেশের মানুষের চান্স থাকবে কী? এজন্য বেছে বেছে কোটা নির্ধারণ করে মক্কার মানুষদের হজ করতে দেয়া হয়। যা হোক আলোচনা মাজারের। প্রবাদে মক্কা টেনে ভুল করলাম নাতো? সুধী পাঠক! বোধহয় ভুল করিনি। কারণ দক্ষিণ বাংলার প্রবাদপ্রতীম জিন্দাপীর নামে খ্যাত খানে আজম হযরত খানজাহান আলী রহ. এর খুব একটা দূরে নয় অধমের বাড়ি। বাগেরহাট খুলনা মহাসড়কের কুল ঘেঁষেই এই মহামানবের তীর্থস্থান ও দরগাহ। শৈশব-কৈশোরের সময় অসংখ্য বার এই স্থানে যাতায়ত করলেও একটি বারের জন্যও এখানটা জিয়ারত করার সৌভাগ্য হয়নি। একেই বুঝিয়েছি মক্কার মানুষের হজ না পাবার উপমায়। জী হ্যাঁ, অবশেষে মাঝ বয়সে এসে একবার প্রতিজ্ঞাই করেছিলামÑ মাজার এবার দেখবোই। যে কথা সেই কাজ। ঢাকা থেকে বাড়ি যাবার পথে মাজারে গিয়ে নামলাম। পুলকজাগা মনে কম্পিত হৃদয়ে বিনম্রশ্রদ্ধাপূর্ণ চিত্তে বাস থেকে নেমে মহাসড়ক থেকে অল্প দূরে মাজারের কাছে এগিয়ে গেলাম। মাজারটি প্রাচীন ঐতিহ্য বহন করে। পুরানো ইট, অশ্বত্থ বৃক্ষ দেখে শিহরিত হই। মাজারের চারপাশ দিয়ে বোধকরি ৮ফুট প্রস্থ রাস্তা রয়েছে। মাজারের বাইরে কিছু খোলা জায়গা আছে। দক্ষিণমুখো গেট দিয়ে মূল মাজারে গেলাম। বিশাল কালো গেলাফে ঢাকা মাজার। সালাম দিয়ে জিয়ারত করলাম। অনেককে দেখলাম মাজারের গেলাফ ধরে কি যেন বিড়বিড় করছে। বুঝা গেল মাজার ওয়ালার কাছে তারা কিছু চাইছে। কিন্তু মাজারে শায়িত ভদ্রলোক তাদের আদৌ কিছু দিতে পারবে কি না সে বিষয়ে নিশ্চয়-ই তারা জ্ঞাত নয়। মহিলাদের অবস্থা খুবই করুণ! এক মহিলাকে পেট বের করে মাজারের দেয়ালে ঘঁষতে দেখে একজনকে বললাম, ভাই ব্যাপার কী? উত্তর এলো, নি:সন্তার নারীর সন্তানবর্তী হওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টা। জানি না ওই মহিলা তার প্রচেষ্টায় সফল হয়েছিলো কি না। জেয়ারত শেষে দীঘিতে এলাম। বিশাল দীঘিতে বড় ঘাটলা। মানুষজন সেখানে স্লান করছে ভক্তি নিয়ে। পাঠকদের স্বার্থে এক্ষণে খানজাহান আলী রহ. এর সামান্য ইতিহাস তুলে ধরছি। বাগেরহাটের স্রষ্টা খানজাহান আলী খানজাহান আলীর বাগেরহাট আর বাগেরহাটের খানজাহান আলী -এই দুটো কথা একই সূত্রে গাঁথা। তিনি ছিলেন বাগেরহাটের স্রষ্টা শিল্পী, বাগেরহাটের প্রতিটি ধূলোকণায় মিশে আছে তাঁর পুণ্য স্মৃতি। যশোর খুলনায় তিনি খাঞ্জেলি নামেই সুপরিচিত। এই দু’জিলার গ্রামে প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে, খাঞ্জেলির দীঘি, পুকুর, রাস্তাঘাট, খাঞ্জেলির প্রাসাদ, অস্ত্রাগার, কিল্লা ও সরাইখানা ইত্যাদির ধ্বংসাবশেষ। জনশ্র“তি আছে যে তিনি সেকালে এই এলাকার লবণাক্ত পানির পরিবর্তে সুপেয় পানির বন্দোবস্ত করণার্থে ৩৬০টি দীঘিÑপুকুর খনন করিয়েছিলেন। আর নির্মাণ করেছিলেন ৩৬০ টি মসজিদ। জনবসতিহীন এই এলাকাকে বসতি স্থাপনকারীদের নিকট আকর্ষণীয় করার জন্য তিনি অনাবাদী জমিতে লুকিয়ে রাখতেন স্বর্ণ রৌপ্য- যাতে নতুন বসতি স্থাপনকারীরা জমি আবাদকালে ঐ লুকানো সম্পদ পেয়ে বসতি স্থাপন করতে আরও বেশি আগ্রহী হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, মানবপ্রেমিক খানজাহান আলীর পরিচয় আজো তিমিরাচ্ছন্ন। তাঁর পরিচয় নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদের অন্ত নেই। বিভিন্ন মত থেকে এখানে দু’জন পণ্ডিতের মত উদ্ধৃত করা হল। খ্যাতনামা ঐতিহাসিক ডক্টর আবদুল করিম এম.এ, পি.এইচ.ডি সাহেব বলেন, খানজাহান আলী ছিলেন গৌড়ের সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহের (১৪৩৬-১৪৫৯ খৃস্টাব্দ) কর্মচারী। সুলতান তাঁকে সুন্দরবন এলাকার শাসকরূপে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি বরাবর বঙ্গদেশে ছিলেন, দিল্লী থেকে আগত নন। বাংলার ইতিহাসের দু’শ বছর স্বাধীন সুলতানী আমলের লেখক ঐতিহাসিক সুখময় মুখার্জিও এই মত সমর্থন করেন। আর সুন্দরবনের ইতিহাস লেখক এ.এফ.এম আবদুল জলিল এম.এ.বি.এল বলেন, ‘তিনি ছিলেন দিল্লীর সুলতান ফিরোজ শাহ তোঘলোকের তুর্কি উলুখ বংশীয় মন্ত্রী খানজাহান মকবুলের পৌত্র। ফিরোজ শাহ তুঘলক তাঁর এই প্রিয় মন্ত্রীকে বংশানুক্রমিক খানজাহান উপাধী প্রদান করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর তৎপুত্র জুনা শাহ খানজাহান উপাধী গ্রহণ করে মন্ত্রীরূপে পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। এই দ্বিতীয় খানজাহান স্বীয় প্রতিভা বলে রাজ্যের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন, এই সময় দিল্লীর সিংহাসন নিয়ে তুঘলক পরিবারে আরম্ভ হয় দ্বন্দ্ব, রাজধানীতে শুরু হয় বিদ্রোহ, অরাজকতা। ১৩৮৯ খৃস্টাব্দে এক ষড়যন্ত্রের দ্বায়ে দ্বিতীয় খান জাহানকে প্রাণদণ্ড দেয়া হয়। রাজধানীর অরাজকতার সুযোগে তাঁর পুত্র দুপুরুষের সজ্জিত ধনরতœ ও বহু সংখ্যক অনুগত সৈন্য নিয়ে বঙ্গদেশে আগমন করেন। তখন তিনি নিজকে পারিবারিক উপাধি উলুখ খানজাহান নামে পরিচিত করেন। তাঁর সমাধির শিলালিপীতে এই নাম উৎকীর্ণ থাকলেও তিনি খানজাহান আলী নামে বাংলাদেশে সুপরিচিত। তিনি গৌড়ের সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহের (১৪৩৬-১৪৫৯) আনুগত্য স্বীকার ও তাঁর সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন এবং সুন্দরবন এলাকার শাসনকর্তারূপে স্বীকৃতি লাভ করেন। তিনি বাগেরহাটে সর্বপ্রথম যে দীঘিটি খনন করান তাঁর নাম ঘোড়া দীঘি। এর দৈর্ঘ্য ৫শ গজ প্রস্ত ৩শ গজ। প্রকাশ থাকে যে, খানজাহান আলীর ঘোড়া এক দৌঁড়ে যদ্দুর গিয়েছিল, তদ্দুর এই দীঘির পূর্ব পশ্চিম লম্বা। এই দীঘির পানি আজো সুপেয়। বাগেরহাট শহরের পানীয় জল এই দীঘি থেকে সরবরাহ করা হয়। খানজাহান আলী যখন বাগেরহাট এলাকায় আগমন করেন তখন এই এলাকাটি ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। তিনি এই স্থানটি আবাদ করে বসতি স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রস্তরহীন সুন্দরবন এলাকায় ঘোড়াদীঘির পূর্বপাড়ে প্রস্তর নির্মিত ষাটগম্বুজ মসজিদ নির্মাণ করাই হলো খানজাহান আলীর জীবনের শ্রেষ্ঠতম কীর্তি। এই প্রস্তর আনায়ন করা হয়েছিল চট্টগ্রাম ও রাজমহল থেকে। ষাটগম্বুজ মসজিদ দৈর্ঘ্যে ১৬র্০ ফুট, প্রস্তে ১০র্৮ ফুট। এর অভ্যন্তরে গম্বুজের উচ্চতা ২২ ফুট। এই সুবিশাল ভবনের সামনের দিকের মধ্যস্থলে একটি সুবৃহৎ খিলানের দু’পাশে পাঁচটি করে ছোট ছোট ১০টি খিলান আছে। দেওয়াল প্রস্তে র্৯ ফুট। গম্বুজের অভ্যন্তরে ও বাইরের দিকে ত্রিভুজ আকার অংশে পোড়া মাটির লতাপাতার কারুকার্যে সজ্জিত। দেওয়ালে পদ্ম ফুলের কাজও দেখা যায়। মধ্যে মধ্যে মিনাকরা টালির ব্যবহার করা হয়েছে। ৬০টি প্রস্তর নির্মিত স্তম্ভের উপর প্রতি সারিতে ৭টি করে ১১ সারিতে মোট ৭৭টি গম্বুজে ভবনটি আচ্ছাদিত। তন্মধ্যে ৭০টি গম্বুজের উপরিভাগ গোলাকার। মধ্যের সারির ৭টি গম্বুজের উপরিভাগ চৌকানো বিশিষ্ট, গ্রাম বাংলার ছনের ছাউনি চৌচালা ঘরের আকৃতিতে নির্মিত। ষাট গম্বুজ মসজিদের পূর্বদিকে আছে ২৫ খানি দরজা আর পশ্চিম দিকে আছে ছোট একখানা বিশেষ দরজা। এটা মসজিদ ও খানজাহান আলীর দরবার গৃহরূপে ব্যবহার করা হত। নামাজ বা দরবারের সময় ষাট গম্বুজ লোকে পরিপূর্ণ হয়ে গেলে পশ্চিম দিকের ছোট দরজা দিয়ে তিনি ও পাত্র মিত্রেরা এখানে প্রবেশ করতেন। এর চারকোণে চারটি উচ্চ মিনার আছে। পূর্ব পার্শে¦র মিনার দুটিতে ষাট গম্বুজের ছাদে উঠবার দুখানি ঘুরানো সিঁড়ি আছে। একটি আঁধার কোটা অপরটি রওশন কোটা নামে খ্যাত। এটাকে ষাট গম্বুজ বলা হলেও মিনারের গম্বুজ চারটিসহ এর মোট গম্বুজ সংখ্যা ৮১টি। এর গম্বুজ গুলো ৬০টি স্তম্ভের উপর স্থাপিত বলে সম্ভবত: এর নাম ষাট গম্বুজ হয়ে থাকবে। বাগেরহাট শহরের চার মাইল দূরে ষাট গম্বুজ অবস্থিত। খানজাহান আলী বাগের হাটে নানা সৌধাবলী নির্মাণের পর এর নামকরণ করেন খলিফাতে আবাদ বা প্রতিনিধির শহর। সেকালে ৭ মাইলব্যাপী এলাকা নিয়ে এই শহর প্রতিষ্ঠিত ছিল। খলিফাতে আবাদ ছিল খানজাহান আলী শাসিত সুন্দরবন সুবার রাজধানী। তিনি এখানে তাঁর জীবনের শেষ ৪০ বৎসর অতিবাহিত করেন। তিনি মৃত্যুর ১০ বছর পূর্বে বাগেরহাটের ঘাডেলের দীঘিটি খনন করান। এই দীঘিটি দৈর্ঘ্যে প্রস্তে সমান সাড়ে পাঁচশ গজ, এই দীঘির চার পাড়ে ৬০ ফুট দীর্ঘ ২৮ ধাপ বিশিষ্ট চারখানা ঘাট ছিল। এই দীঘির উত্তর পাড়ে খানজাহান আলীর শেষ নিবাস সমাধি ভবন অবস্থিত। এই দরগাহ ভবন এক গম্বুজ বিশিষ্ট। এর ভিত্তি প্রস্তরে নির্মিত। অভ্যন্তরে গম্বুজটির উচ্চতা ২৪ ফুট। ভিতরে লতাপাতার কারুকার্য খচিত দরবারের প্রবেশ পথে একটি বিরাট তোরণ আছে। খানজাহান আলীর দু’জন পতœী ছিলেন। কিন্তু তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। ১৪৫৯ খৃস্টাব্দের ২৩ অক্টোবর তারিখে তিনি পরলোকগমন করেন। তাঁর দরগায় প্রতি বৎসর চৈত্রমাসের পূর্ণিমায় খাতেলী মেলা নামে ৩ দিন স্থায়ী একটি বিরাট জাকজমকপূর্ণ মেলা বসে। আর ২৫ অগ্রহায়ণ তারিখে তাঁর মৃত্যুদিবস উপলক্ষে মিলাদ কোরানখানি প্রভৃতি ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি হয়। প্রতিমাসে পূর্ণিমার দিন ছোট মেলা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। তাছাড়া যশোর খুলনার নানা স্থানে তার স্মৃতিতে বহু বাঙালি মেলা বসে থাকে। ২৩ অক্টোবর তারিখে মানব প্রেমিক খানজাহান আলীর মৃত্যুর ৫১৫তম বছর পূর্ণ হয়। পরিশেষে একটি কথা উল্লেখ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। আর তাহলো উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারকদের একটি বড় অংশ ছিলেন দূর দেশ থেকে আগত পীরÑমাশায়েখ ও আওলিয়ায়ে কেরাম। স্বভাবতই তাদের প্রতি আমাদের ভক্তিÑশ্রদ্ধা অপরিসীম। কিন্তু তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন যেন তাদেরই প্রচারিত আদর্শের বিপরীত না হয় সেদিকে কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাই ঘটছে যা ঘটার ছিলো না। উপরের আলোচনাতেই আমরা জানতে পারলাম, তিনি নি:সন্তান ছিলেন, আথচ কী আশ্চর্য় ব্যাপার! তার মাজারের দেয়ালে নি:সন্তান নারীদের পেট ঘষাঘষি করতে দেখা যায়। এ দ্বারাই প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের দেশে মাজারগুলো নিয়ে কী পরিমাণ বাড়াবাড়ি হচ্ছে। আল্লাহ আমাদের সকল প্রকার বিদাত ও কুসংস্কার থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
খাজাবাবা ফরিদপুরির নামটা কিন্তু বলা হয়নি গত সংখ্যায়। কৌতুহলি পাঠকদের অনেকেই জানতে চেয়েছেন তার নাম ও তিনি কোন পীরের মুরিদ সে স¤পর্কে। বলাবাহুল্য খাজাবাবাদের নাকি নাম নিতে নেই। ওলি আওলিয়ার নাম নিলে নাকি অশুচি হয়। নেকি কাটা যায়। এই অপবিশ্বাসে বিশ্বাসী অনেক পীরের মুরিদরা। খাজাবাবার মুরিদরাও এর ব্যতিক্রম নন। এজন্য কোথাও কেউ তার নাম নেয় না। কোথাও তার নাম লেখাও নেই। তবে আমরা জনৈক মুরিদের সাথে কথা বলে জানলাম, তার নাম হাশমতুল্লাহ। অবশ্য এই হাশমতুল্লাহ এখন নেই। হজ না করে (শক্তি থাকা সত্ত্বেও) এই খাজা ওপারে চলে গেছেন। বর্তমান খাজা তারই পুত্র (বাপের বেটা বটে) মাহফুজ ওরফে মিয়া ভাইজান। তার নামও নেওয়া নিষেধ। আর তার পরবর্তী ক্রাউন পীর খাজাবাবা দাড়িচাঁছা পীরজাদা (ক্লীন শোভড) মেঝো ভাইজান। অবশ্য গোলাপ ফুলের রাজনীতি করার কারণে সকলেই তার নাম জানে বিধায় সে নামটি নেওয়ার দরকার নাই। খাজা বাবা পরিদপুরির পীর কে? এ প্রশ্ন অনেকের। এখন আমরা পাঠককে সেদিকেই নিয়ে যেতে চাই। খাজাবাবা ফরিদপুরি সিরাজগঞ্জের বেলকুচির খাজা ইউনুসের মুরিদ। চলুন এনায়েত পুরে যাই। সন তারিখ বলতে পারবো না। তবে সিরাজগঞ্জে বন্যা হয়েছিলো সে সময়। সময়টি সিডরের আগে। ঢাকা থেকে খোকসাবাড়িতে আমরা ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিলাম। সাথে ছিলো আমাদের সহকর্মী ও ছাত্রদের অনেকে। ত্রাণ দিয়ে ফেরার পথে আমাদের বসকে বললাম, এসেছি যখন সিরাজগঞ্জÑ তখন খাজা এনায়েতপুরির দরবার, এশিয়ার শ্রেষ্ঠ হার্ড মেডিকেল হাসপাতাল, পানিতোয়ার কালো জাম, ও বেলকুচি, শাহজাদপুরের লুঙ্গি না নিয়ে গেলে কেমন দেখায়। যে কথা সেই কাজ। যমুনা ব্রিজের পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে বেলকুচির রাস্তায় ঢুকতে হয়। বোধ করি পনের-ষোল মাইলতো হবেই। এক সময় গাড়িবহর নিয়ে আমরা খাজা এনায়েতপুরির মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল দেখলাম। বিশাল জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠেছে এই মেডিকেল। এশিয়া মহাদেশে এরচে বড় হাসপাতাল আর আছে কি না জানি না। এই হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ড. আমজাদ। এই হাসপাতালের পাশেই খাজা এনায়েতপুরির দরবার। সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার তথ্য মতে খাজা ইউনুস আলী আঠারোশ ছিয়াশি সালে বেলকুচি থানার এনায়েতপুরে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা শাহসূফি মৌলানা আব্দুল করীম। তিনি এলাকার খাজাপীর বলে বেশি পরিচিত। ১৯৫২ সালে তার মৃত্যু হয়। এখানকার লোকদের বিশ্বাসÑ তিনি নাকি আখেরি জামানার মুজাদ্দিদ। আমরা খানকা এলাকায় প্রবেশ করলাম। বেশ বড়সড় একটা মসজিদ। পাশে বিশাল কিছু পাকা কবর। তন্মধ্যে একটা কবর ঢাউস সাইজের। ওই সময়কার ডিউটিরত খাদেম আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। ভদ্র লোকের মাথায় টুপি থাকলেও মুখে বোধ হয় দাড়ি রাখতে এদের নিষেধ আছে। তিনি আমাদের ঘুরে ঘুরে খানকা দেখালেন। আমরা কবর জিয়ারত করলাম। তার থেকে শুনলাম আটরশির খাজাবাবা তার মুুরিদ। খাজা ইউনুস আলীই তাকে ফরিদপুরে আধ্যাত্মসাধন করতে বলেন। হাশমতুল্লাহ তার পীরের নির্দেশ মোতাবেক আটরশিতে আস্তানা গাড়েন। ইউনুস আলীর মাজার জিয়ারত কালে আমরা তার মাজারটি পেছনে রেখে দোয়ার জন্য হাত উঠাই। খাদেম বাবা আমাদের নিষেধ করেন। বলেন, বাবাকে পিছনে রেখে জিয়ারত করা কি ঠিক হচ্ছে? আমি বললাম, দোয়া কি বাবার কাছে, নাকি আল্লাহর কাছে? কেবলা কি বাবা, না কাবা শরিফ? যদি আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হয় তাহলে করতে হবে কেবলামুখি হয়ে, তাহলে মাঝখানে আর কেউ থাকতে আছে কি? নাকি দোয়া আল্লাহর পাশাপাশি বাবারাও কবুল করেন? খাদেম নিরুত্তর। কারণ, এধরনের পরিস্থিতি বোধহয় খাদেমের জীবনে এই প্রথম। যা হোক আমরা আমাদের জ্ঞান ও নবীজির সুন্নত মোতাবেক জিয়ারত করলাম। খাজা এনায়েতপুরি কি আখেরি মুজাদ্দেদ। প্রশ্নটি সকলের মাঝে ঘুুুুুরপাক খায়। জনৈক সহকর্মী বললো, আখেরি তো অনেক দূর। তিনি মোজাদ্দিদই কিনা দেখ। মোজাদ্দেদ হওযার জন্য যে শর্তÑশারায়েত আছে তার কোনোটি কি আছে এই ভদ্র লোকের মাঝে। মোজাদ্দিদ নিয়ে একটি সহিহ হাদিস পাই। হাদিসটি আবু দাউদ ও সহিহুল জামে ও মাকাসেদে হাসানায় বিদ্যমান। হাদিসটি এমন- ‘আল্লাহ পাক এই উম্মতের জন্য প্রতি শতাব্দিতে মোজাদ্দিদ নিয়োগ দেন। যারা উম্মতের দ্বীনের মাঝে সংস্কার করেন।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৪২৯১, মু’জামুল আওসাত, তাবরানী: হাদিস নং ৬৫২৭) মোজাদ্দিদের যে সব শর্ত হাদিসের ব্যাখ্যাকারগণ লিখেছেন তার কোনোটি কি খাজা এনায়েতপুরির মাঝে ছিলো? মোজাদ্দিদের শর্ত : ১. তার মিশন, ভিশন সকলের সামনে স্পষ্ট হতে হবে। ২. সংস্কারের বিষয়ে তার উদ্যোগ হতে হবে পরিপক্ক। ৩. সংস্কারটি নিজে মুরিদদের মাঝে আমলের মাধম্যে বিকাশ ঘটাতে হবে। ৪. দ্বীনের মাঝে সংস্কার করতে হবে। এর মানে এই নয় যে দ্বীন বদলে দিতে হবে। ৫. যুগের সংস্কার করতে হবে। কারণ, যুগ অনেক কিছু দ্বীন থেকে বদলে দেয়। ৬.অগণিত পুস্তক প্রণয়ন করতে হবে। এর একটিও কি খাজা এনায়েতপুরির মাঝে ছিলো। আমরা এর উত্তর খুঁজি। আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা কেবল আত্মজিজ্ঞাসাই থেকে যায়। খাজা মরহুমের মুরিদদের মাঝে সংস্কার হয়েছে, তবে তা দাড়ির মাঝে। চেঞ্জ এসেছে বাড়ি গাড়িতে। তাজদিদ হয়েছে কবর পাকা করার মাঝে। সবচে বড় কথা হলো এই খাজা থেকেই হয়েছেন ফরিদপুরের খাজাবাবা। বাঁশের গোড়া থেকে বাঁশ গজায়। হাশমতুল্লাহর আয়নায় আমরা ইউনুস আলীকে আবিস্কার করতে পারি। কবর পাকা করার নাম যদি মোজাদ্দিদি হয় তাহলে সে মোজাদ্দেদ এনায়েতপুরি। ডিজিটাল জিকির করার নাম যদি মোজাদ্দিদি হয় তাহলে সে মোজাদ্দিদ এনায়েতপুরি। সুন্নাহ বাদ দিয়ে বেদআদ প্রতিষ্ঠা করার নাম যদি মোজাদ্দিদি হয় তাহলে সে মোজাদ্দিদ এনায়েতপুরি। ভারতের জি টিভিতে প্রত্যহ সকাল বেলায় স্বর্ণমন্দিরে শিখদের এবাদত টেলিকাস্ট করা হয়। সেই ছবির সাথে এনায়েতপুরিরা নিজেদের মিলালে ওদের সাথে নিজেদের খুব একটা পার্থক্য দেখবেন বলে মনে হয় না। এনায়েতপুর পেছনে ফেলে এলাম। মন বললো আত্মার খোরাক এখানে নেই। এখানে খোরাক দিয়ে আসা যায়, কিন্তু নিয়ে আসা যায় না।