প্রিয় বন্ধুরা! দেখতে দেখতে আরও একটি বছর ফুরিয়ে গেল। বিদায় নিল ২০১৩ সাল। আমরা বরণ করলাম নতুন বছরÑ ২০১৪। নতুন বছর মানেই নতুন নতুন ভাবনা। নতুন কিছুর স্বপ্ন দেখা। সঙ্গে পুরনো দিনের হিসাব-নিকাশের খাতা মেলানো। ভুলগুলো চিহ্নিত করা। প্রভুর কাছে ভুলের ক্ষমা প্রার্থনা আর আগামী দিনের ভালো কাজের সাহায্য চাওয়া। তাই না বন্ধুরা! তাহলে আর বসে থাকার সুযোগ কই? আমাদের কাজে নামতে হবে। গত বছর আমরা কী কী করেছি, এর মধ্যে কয়টা ভালো কাজ আর কয়টা মন্দ, এসবের হিসাব কিন্তু করে ফেলতে হবে এখনই। সাথে সাথে নতুন বছরের পরিকল্পনা কী, তাও ঠিক করতে হবে দ্রুত। পুরনো ভুলগুলো যেন দ্বিতীয় বার না হয় সেদিকটায় মনযোগী হতে হবে একটু বেশি।
|
দিনলিপি
|
মনবাতায়ন
ওদের মুখে হাসি ফোটাবো
আবিদ আনাম
শীতের কুয়াশা, গ্রীষ্মের তাপ, বর্ষার বারিধারা, শরতের øিগ্ধতা, হেমন্তের মায়াবি হাতছানি, বসন্তে একরাশ ফুলের শোভা আর পাখিদের কিচির-মিচিরের মধ্য দিয়ে পার হয়ে যায় বছরের পর বছর। অনন্ত সময়। আবার এসে হাজির হয় নতুন বছর, নতুন দিন। নতুন বছরের সাথে কুয়াশা আচ্ছাদিত চাঁদর পরে হাজির হয় শীত, ঘন কুয়াশা।
ইংরেজি নববর্ষের নতুন দিনে আমরা সবাই শীতের তীব্রতা অনুভব করি। রঙ-বেরঙের তাপ দায়ক পোশাক পরে অতিবাহিত করি আমাদের সময়। কিন্তু আমাদের গরিব-দুঃখিদের কথা ভুলে গেলে চলবে না। আকাশ যাদের ছাদ। জমিন যাদের বিছানা। রাস্তার পাশেই যাদের জীবন-যাপন।
আমাদের দয়াল নবী মুহাম্মদ সা. আমাদের দয়া শিখিয়েছেন। মায়া-মমতা আর আদর শিখিয়েছেন। খোলা আকাশের
নিচে কিভাবে বসবাস করবে গরিব-দুঃখি! তাদের গায়ে শীতের আক্রমণ খুবই তীব্র হবে। কলাপাতার মতো শীতে কেঁপে উঠবে ওদের শরীর আর আমরা চেয়ে চেয়ে তামাশা দেখবো? দু’চারটি গরম কাপড় গায়ে দিয়ে বসে থাকবো? কখনো না। আমাদের এমন হলে চলবে না। আমাদের প্রত্যেকের গ্রামের বাড়িতে, শহরের অলিতে-গলিতে অসহায় গরিব মানুষ আছে, আমরা তাদের শীত বস্ত্র দেবো। শীতার্ত শিশুদের শীতের পোশাক পরিয়ে মুখে হাসি ফোটাবো। কনকনে শীতে বস্ত্রহীন কিংবা পোশাক ছাড়া কেমন কাটতো আামদের সকাল-সন্ধ্যা, সেকথা ভেবেই আমরা এগিয়ে যাবো দুঃখিদের কাছে। দাঁড়াবো তাদের পাশে আপন হয়ে। সব সময় খেয়াল রাখবো প্রিয় নবীর হাদিস। তিনি বলেছেন ‘যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহ তার প্রতি দয়া করবেন না।’ (মেশকাত শরিফ : ৪২১)
মাগো! তোমায় মনে পড়ে
আমার পরম শ্রদ্ধেয়া মা সর্ম্পকে কিছু লিখবার ইচ্ছা গত কয়েক দিন ধরে মনকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করছে। কোনোরূপ বাড়াবাড়ি না করে তার সম্পর্কে শতভাগ সত্য এবং বাস্তব বিষয়গুলোই লিখছি। আমার মা একজন অসাধারণ গুণবতী মহিলা। আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন বড় মনের মানুষ। বিচক্ষণ, আত্মবিশ্বাসী ও সদা কর্মচঞ্চল। আমরা ভাই-বোনেরা ভেবে অবাক হই, এ পড়ন্ত বয়সেও তার এমন অসাধারণ সংসার পরিচালনা, কোনো গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল বিষয়ে দ্রুত উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং অপূর্ব ধৈর্য্যশক্তি দেখে।
আমাদের সুন্দর ভবিষ্যত গড়ার জন্য কত কিছুই না তিনি করেছেন! উত্তরাধিকার সূত্রে নানাবাড়ি থেকে প্রাপ্ত বিশাল সম্পত্তির অনেকাংশ বিক্রি করে দেওয়া, নিজের আরাম-আয়েশের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা, সকাল-সন্ধ্যা অবিশ্রান্ত সাংসারিক কাজকর্ম সামলানো, পরীক্ষার সময় জায়নামাজে বসে কান্নায় বুক ভাসানো, সবই তিনি করে চলছেন আমাদের প্রতি আবেগ আর সীমাহীন øেহ-ভালোবাসা নিয়ে। এতে তার কোনো ক্লান্তি নেই। দুঃখ নেই। অনুযোগ নেই। নেই কোনো অভিযোগ। যেন এতেই তার যত আনন্দ আর প্রাপ্তি! পরের তরে এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে আম্মার উদাহরণ জগতে বহু আছে, কিন্তু নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার নমুনা খুব একটা নেই। এমন যারা হয় প্রকৃতপক্ষে তাদের অবদান কলমের দ্বারা ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। এ শুধু উপলব্ধি আর অনুভবের বিষয়। হৃদয়ের গভীরে পরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা পোষণের বিষয়। তাই কৃতজ্ঞচিত্তে তার স্মরণে গেয়ে উঠি এ নিশিতে আজি -‘যখন রাত্রি নিঝুম, নেই চোখে ঘুম, একলা শূন্য ঘরে, তোমায় মনে পড়ে মাগো! তোমায় মনে পড়ে...।
ইবনে আব্দুল মজিদ
সাতপাই, সদর নেত্রকোণা
হৃদয়ে ঢাকা ইজতেমা
১৩ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার। ঘড়ির কাটা দুইটা চল্লিশ মিনিট ছুঁই ছুঁই। তখন দুপুর। মাথার ওপর সূর্য। খাঁ খাঁ করছে রোদ। মিরপুর বেড়িবাঁধ রোডে আমাদের গাড়ি। ঢাকা জেলার ইজতেমার পথের যাত্রী আমরা। বেড়িবাঁধের দু’পাশে স্তুপ স্তুপ আবর্জনা। থেকে থেকে বিষাক্ত কালো পানির নালা। ঝাঝালো দুর্গন্ধে নাক বন্ধ হয়ে আসে। পেট মোচড় দিয়ে ওঠে। অসহ্য লাগে সে সব পরিবেশ। তবু ক্লান্তিহীন, বিরক্তিহীন আমাদের চোখ-মুখ। অজানা প্রশান্তি আর অপার্থিব আনন্দে যেন মোহাচ্ছন্ন সবার দেহমন।
বিকাল চারটা। টঙ্গী ব্রীজের খানিকটা দূরে আমাদের গাড়ি। ক্ষাণিকটা দূরেই ইজতেমার মাঠ। কাছাকাছি এসে জ্যামে পড়ে যাই। সামনে পিছনে বিশাল গাড়ির বহর। অগত্যা গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুটা হাঁটতেই মাঠ জুড়ে টানানো শামিয়ানা। আনন্দে নেচে উঠে দেহমন। নিমিশেই শূন্যে মিলে যায় সফরের যত ক্লান্তি। হাজারো মানুষের মিলনমেলা, সবুজাভ বিশাল মাঠ, সারি সারি শামিয়ানা। এ যেন অন্য এক ভূবন। ভাবতেই মনটা আনন্দে ভরে ওঠে।
মাঠে ঢুকেই আসরের নামাজ আদায় করলাম।। খোলা আকাশের নিচে নামাজ পড়ার মজাই আলাদা। পায়ের নিচে সবুজ ঘাস। দক্ষিণা মৃদু বাতাস। তুলতুলে নরম ঘাসকে খুব আপন মনে হয়। ইচ্ছে করে ছিড়ে ছিড়ে পকেটে ভরি ।
নামাজ শেষে তাবু টানালাম। রান্নাঘর বানালাম। মোটামুটি তিনদিনের সংসার যাকে বলে। সব ঝামেলা শেষে চুপচাপ বসে পড়লাম । স্থির মনে বয়ান শুনতে লাগলাম। বয়ান শেষে এশার নামাজ পড়লাম। রাত নয়টায় খাওয়া শেষে ঘুম। দিনের ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিতেই ঘুমে হাবুডুবু।
রাত চারটা। ঘুম ভাঙার পর ভীষণ ঠাণ্ডা অনুভব করলাম। মাথার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে হীম শীতল বায়ু। শামিয়ানা চুয়ে চুয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু শিশির। ভাবতেই হীম হয়ে আসে শরীর। অজানা শীত আতঙ্ক চেপে বসে ঘাড়ের ওপর। সাহস নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। নরম ঘাসের কোমল শিশির মাড়ালাম। ঠাণ্ডা পানিতে সিক্ত করলাম সারা দেহ। কাঁপতে লাগলাম এক পাশ হয়ে। শীতল øিগ্ধ পবিত্র অনুভূতি। আল্লাহর রাস্তায় প্রবল শীত উত্তাপে দাঁড়িয়ে কম্পমান দেহমন। এ যেন এক অপ্রার্থিব অনুভূতি। পৃথিবীর কোনো আনন্দই এই অনুভূতির সঙ্গে মিলে না।
মুহা. হুসাইন শহীদ
সাভার, ঢাকা
সদস্য নং৪৯৯৫
আমার আম্মু
আমার আম্মু অতি সাধারণ একজন মহিলা। নামের আগে হাফেজা, আলেমা বা এ জাতীয় অন্য কোন পদবি নেই। স্কুলে পড়ার দৌঁড়ও খুব বেশি না। মাত্র ক্লাস ফাইভ। কিন্তু মানুষের সঙ্গে মিশতে পারেন অতি সহজেই। আমল আখলাক ধৈর্য্য এবং ত্যাগ তিতিক্ষা দেখে মনে হয় না যে তার মধ্যে শিক্ষার কোনো অভাব আছে। বরং মানবিক গুণাবলী তার মধ্যে ষোলকলায় পূর্ণ। মায়া মমতা দিয়ে আমাদের জড়িয়ে রাখেন সবসময়। শুধু আমাদের নয়, বাড়ির পাশে বালিকা মাদরাসার ছাত্রীদেরও ভালোবাসেন মনে প্রাণে। ছাত্রীদের জ্বর হলে মাথায় পানি দেওয়া, কাশি হলে মধু গরম করে খাওয়ানো সব আম্মুই করেন।
মাদরাসার ছাত্রীরা আমার আম্মুকে মহব্বত করে ‘বড় আম্মু’ ডাকে। আমাদের বাড়িতে ছাত্রীদের অতি আনা গোনা দেখে মাঝে মধ্যে বিরক্তি লাগে। কিন্তু ছাত্রীদের প্রতি আম্মুর নিঃশ্বার্থ ভালোবাসা ও মায়া মমতা দেখে সত্যিই অবাক হতে হয়। একেক সময় মনে হয় আম্মু আলেমা হাফেজা না হওয়ায় মন্দ হয়নি। কারণ, অনেক সময় আলেমাÑহাফেজাদের মধ্যে একটা আলাদা ভাব লক্ষ করে থাকি।
আমাদের পাড়ায় অসহায় এক বৃদ্ধ মহিলা আছে। যার আপনজনরা তার সেবা যতেœ অবহেলা করে, আমার আম্মু তার মাথার উকুন আনা থেকে শুরু করে পায়ের নখ কাটা পর্যন্ত করে দেন। এই সে দিনের ঘটনা, মহিলাটির হাত পায়ের নখ কেটে দেওয়ার পর, সে আম্মুর পা ছুঁয়ে বুকে কপালে লাগিয়ে বললো, ‘তোরা মসজিদে থাকছ, হাদিস কোরান পরছ আর তুই আমার নাহাল (মতো) মানুষের ঠাং ছুইছছ, এটা ঠিক হয় নাই। আল্ল¬ায় আমারে পাপ দিবো, তাই তোর পাও ছুইলাম।’
আমার দাদী আমার জন্মের দুই বছর আগে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন ওপারে । তাকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে তার দ্বীনদারী, নম্র, শান্ত স্বভাব ও দানশীলতার কথা অনেক শুনেছি। পাড়ার মহিলা থেকে শুরু করে অনেক ভিখারি পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে এসে আমার দাদীর মায়ায় কাঁদে। সবার মুখে আমার দাদীর বর্ণনা শুনে মনে হয় আমার আম্মু যেন দাদীরই প্রতিচ্ছবি।
আম্মু যে শুধু আদরই করেন তা কিন্তু নয়। শাসনও করেন। আমাদের কোনো ভুল হলে প্রথমে বকাঝকা করলেও পরে মমতার সাথে সংশোধন করে দেন
আমার এ গুণকীর্তন দেখে কেউ হয়তো ভাবতে পারেন মায়ের নামে এতো কিছু বলার কী আছে? আসল কথা হলো, আমার এ লেখা আম্মুর প্রশংসা বা গুণ বর্ণনার জন্য নয়। বরং পাঠকদের এই মেসেজ দেওয়ার জন্য যে, কেউ একজন আলেমা, হাফেজা না হয়েও মহৎ প্রাণ যে হতে পারেন তার একটি নজির পেশ করা।
তাহমিনা জামান
আল-ইহসান বালিকা মাদরাসা
দেওহাটা, মির্জাপুর, টাঙ্গাইল
সদস্য নং৪৯৯৭
অপেক্ষায় ছিলাম
অনেক দিন থেকে মন ভালো নেই। নতুন মাদরাসায় এলাম। পরিবেশ প্রকৃতি সব অপরিচিত। মাঝে মধ্যে কেন যেন দু’চোখ বেয়ে পানি ঝরতো। কেউ কিছু জানতে চাইলে লুকিয়ে ফেলতাম। ইনিয়ে বিনিয়ে অন্যটা বলে দিতাম। আমার ভেতরটা কাউকে বুঝতে দিতাম না। একদিন বটতলী মাদরসার শিক্ষাসচিব মাও: আব্দুস সাত্তার খানÑ মামুন, মাকছুদ ও ভোলার মুনিরকে কি যেন ইঙ্গিত করলেন। এরপর তারা আমাকে হাওয়ার রাজ্যে নিয়ে যায়। জায়গাটা মাদরাসার একটু পূর্ব দিকে। নাম পূর্বকড়ইতলা। দুদিকে সবুজের মধুমাখা হাতছানি। কাঁশফুল আর সারিবদ্ধ গাছগাছালির নির্মল ছোঁয়া। বিস্তীর্ণ ছায়া ঘেরা পথ। হালকা বাতাসে নতুন আমেজ। এ মুহূর্তটা আমার জীবনের স্মরণীয় একটা সময়। যে দিকেই চোখ মেলি সে দিকেই সবুজের মনোরম ছবি। যেন শিল্পীর তুলি আপন পরশ মেখে দিয়েছে। কিচির মিচির শব্দে বিরাজ করছে ঝংকার। দূর্বাঘাসের সবুজ গালিচায় মুক্ত পায়ে দাঁড়ানোর মজাই আলাদা। কল্মীফুলের পত্র-পল্লব আর বাতাসের অবাধ বিচরণ। ঘাসফড়িংয়ের উড়াউড়ি আমাকে শৈশবে নিয়ে যায়। এগুলো দেখে যে কেউ পাল্টে যাবে। জেগে উঠবে ছন্দময় ভাবনা। আমারও সে রকমই হয়েছে। এতোদিন এমন একটি øিগ্ধ বিকেলের অপেক্ষায় ছিলাম।
মিযানুর রহমান জামীল
চাটখিল, নোয়াখালী
এগিয়ে যাওয়ার সম্বল
হাফেজ ইয়াকুব সাহেব রহ.। আপন মহলে ‘বড় হুজুর’ নামেই অধিক পরিচিত। নিজেকে তিলে তিলে ক্ষয় করে গড়ে তুলেছেন। লাকসাম উত্তর বাজার হাফিজিয়া মাদরাসা। আমরণ এ প্রতিষ্ঠানের হাল ধরে রেখেছিলেন তিনি। তবে সহজে নয়। অনেক ঝড়-তুফান বয়ে গেছে তার ওপর দিয়ে। তবু তিনি ছিলেন অটল অবিচল। আমি যখন সেখানে পড়তে যাই তখন প্রতিষ্ঠানের ২২ বছর অতিক্রম হয়ে গেছে। এটা ২০০১ সালের কথা। দু’বছর পড়েছি সে মাদরাসায়। লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে চেষ্টা করতাম সকল উস্তাদের খেদমত করতে। পেরেছিলাম কিনা বলতে পারবো না। তবে উস্তাদগণ আমাকে খুব আদর-øেহ করতেন, দোয়া দিতেন। বড় হুজুর একটু বেশি আদর করতেন। সব সময় বাবা বলে ডাকতেন। অসুস্থ হলে ডাক্তার দেখাতেন। আমিও চেষ্টা করেছি সে আদরের কদর করতে। আমার যতদূর মনে পড়ে দুবছরে কোনো কাজ আদেশ দিয়ে করাতে হয়নি। কাপড় কাচা, কাপড় আয়রণ করা, খাবার রেডি করাসহ সব কাজই বলার আগে প্রস্তুত রাখার চেষ্টা করতাম। এ ভাবে দেখতে দেখতে দু’বছর কেটে গেল। কমপ্লিট হয়ে গেল আমার হিফজ পড়াও। রোজার ঈদের পর বিদায় নিয়ে চলে আসবো। বড় ভাইয়া গেলেন আমার সাথে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া একজন স্টুডেন্ট। যেখানে ছাত্র-শিক্ষকের নির্মল মায়ার বন্ধন বড় দুর্লভ। সে দিন এমন একটি সুখ-সুন্দর বিদায় দৃশ্য দেখবেন স্বাভাবিক ভাবেই এটা তার কল্পনায় ছিলো না। তিনি খুব প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং বাড়ি এসে সবার কাছে ঘটা করে বলেছিলেন। তার মতে সেটা ছিলো পিতা-পুত্রের বিদায়-বিচ্ছেদের করুণ দৃশ। যখন আমি বড় হুজুরের সঙ্গে বিদায় মুসাফাহা করতে হাত বাড়ালাম, তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললেন। কিছু সময় বুকে জড়িয়ে বেদনার নোনা অশ্র“ ঝরালেন। আমার চোখেও অশ্র“ এসেছিলো। কষ্ট উপলব্ধি হয়েছিলো হৃদয়ে। সেই দৃশ্য আজও আমাকে পুলকিত, আলোড়িত, অনুপ্রাণিত করে। করে সাহসী। স্বপ্ন দেখায় সামনে এগিয়ে যাওয়ার। আবদুল্ল¬াহ আল মুনীর
মাদরাসা দারুর রাশাদ, মিরপুর পল্লবী, ঢাকা
যে কথা বলতে চাই
২০০০ সালের কথা। তখন আমার বয়স ১১ বা ১২ হবে। সে সময় আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন আমার প্রাণপ্রিয় মুরুব্বী মাওলানা মুহা. সালমান সাহেব দা. বা.। ভর্তি করেন দারুর রাশাদ মাদরাসার মক্তব বিভাগে। মক্তব বিভাগ শেষ করে হুজুরের পরামর্শক্রমে ভর্তি হই জামেউল উলুম মাদরাসার হেফজ বিভাগে। হেফজ সমাপ্ত করে সেখানেই কিতাব বিভাগে পড়তে শুরু করি। সে দিনের কথা আজও মনে পড়ে। তখন বুক ভরা আশা ছিলো, মনে ছিলো আনন্দ। এক উদ্যমী স্পৃহা আমার অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলছিলো। যা আমাকে আজ এ পর্যন্ত লেখাপড়ার প্রতি উৎসাহ দিচ্ছে। সেখানে আমার লেখাপড়া চলতে থাকে হেদায়া পর্যন্ত। এতোদিনে ছাত্রÑউস্তাদদের সাথে ভালো সর্ম্পক গড়ে ওঠে। উস্তাদগণ আমাকে মহব্বত করতেন। আমিও উস্তাদদের শ্রদ্ধা করতাম। ছাত্ররা একে অপরের সাথে ভ্রাতৃত্বসূলভ আচরণ করতো। একে অন্যকে সহযোগিতা করতো। কেউ অসুস্থ হলে সবাই তার সেবা করতো। আহ! কী সুন্দর ব্যবহার। তখন আমার নিজের দায়িত্বের মাঝে অনুভূতি আসতে থাকে।
আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান সর্ম্পকে জানতে আগ্রহি হই। পুনরায় ফিরে আসি আমার লেখাপড়ার সূতিকাগার ব্যতিক্রমধর্মী বিদ্যাপিঠ মাদরাসা দারুর রাশাদে। ভর্তি হই মেশকাত জামাতে। এখানে আমার কাটে দুবছর। এ সময়ে বড়-বড় লেখকÑসাহিত্যকদের দেখতে পাই। তাদের দেখে আমার মাঝেও স্বপ্ন জাগে লেখক হতে। তার জন্য আমি মাদরাসা দারুর রাশাদকে নির্বাচন করি। সফলতার স্বাক্ষর নিয়ে জাতিকে কিছু না দিতে পারলেও যেন খালি হাতে না ফিরি।
মুহা. আতাউল্লাহ
মাদরাসা দারুর রাশাদ, মিরপুর পল্লবী, ঢাকা
পাহাড়ের রঙিন আনন্দ
জীবনে স্মরণ রাখার মতো অনেকগুলো দিন এসেছে। কালের আবর্তে তা তলিয়েও গেছে। আজ পেছনে ফিরে তাকালে মনের কোণে সেসব দিনের স্মৃতি এসে ভীড় করে। সেসব স্মৃতিতে আনন্দের পরশ আছে। বেদনার ছোঁয়া আছে। কিন্তু সব বেদনার সুর চাপিয়ে যে দিনটি আমার সবচেয়ে বেশি আনন্দময়, সবচেয়ে বেশি স্মরণীয়, তাহলো একটি ছুটির দিন। সেদিন ছিলো বিজয় দিবস। আমি তখন হাটহাজারী মাদরাসায় পড়ি। কয়েকজন বন্ধু মিলে ঠিক করেছিলাম, বিজয় দিবসে আমরা বাংলাদেশের কোনো এক পর্যটন কেন্দ্রে যাব। আনন্দ উল্লাস করবো। পার্বত্য জেলা রাঙামাটি ছিলো আমাদের প্রথম টার্গেট। সেখানে গেলে প্রাকৃতিক কিছু সৌন্দর্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটবে। এই আনন্দে উচ্ছ্বাসিত হয়ে অনেক আগ থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখি। অবশেষে ছুটির দিনটি এলো। আমরা ফজর পড়ে বের হলাম গন্তব্যের উদ্দেশে। বাসে দেড় ঘণ্টার পথ। আমরা যখন রাঙামাটি পৌঁছি তখন বেলা সাতটা। আমাদের সঙ্গে কিছু খাবার ছিলো। সারা দিন চলাফেরার মাঝে ক্ষুধা দূর করবে এই খাবার।
সময়ের সল্পতায় পর্যটন কেন্দ্রগুলো নদীপথে দেখার সিদ্ধান্ত নিই। ঘাট থেকে একটি বোট ভাড়া করে ঘুরতে শুরু করি। একে একে দেখতে থাকি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য জেলা রাঙামাটি। সেখানকার সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা সৌন্দর্য আমাদের আকৃষ্ট করে। মুগ্ধ করে। এভাবে ঘুরে ঘুরে পর্যটন কেন্দ্রগুলো দেখি। সুবলং ঝর্ণা, ঝুলন্ত ব্রীজসহ দেখি দৃষ্টিনন্দন সব দৃশ্যাবলী। পুরো দিনটি জুড়ে আমরা মুখরিত ছিলাম। এরই মাঝে জোহরের নামাজ আদায় করে সঙ্গে আনা খাবার খাই। একটু বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় আবার ঘুরা শুরু করি। সেদিন প্রচণ্ড রোদ থাকায় কিছুটা কষ্ট হয়েছে। অবশ্য কষ্টের মাঝেই যে আনন্দ হয়েছে তার মূল্য অনেক বেশি।
অবশেষে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। আমাদের ফিরে আসার সময় হয়। এক সময় ফিরেও আসি। তবে আজও স্মৃতিতে থেকে যায় সেদিনের ভ্রমণ।
ইমামুদ্দীন সুলতান
মাদরাসা দারুর রাশাদ, মিরপুর পল্ল¬বী, ঢাকা
ওদের মুখে হাসি ফোটাবো
আবিদ আনাম
শীতের কুয়াশা, গ্রীষ্মের তাপ, বর্ষার বারিধারা, শরতের øিগ্ধতা, হেমন্তের মায়াবি হাতছানি, বসন্তে একরাশ ফুলের শোভা আর পাখিদের কিচির-মিচিরের মধ্য দিয়ে পার হয়ে যায় বছরের পর বছর। অনন্ত সময়। আবার এসে হাজির হয় নতুন বছর, নতুন দিন। নতুন বছরের সাথে কুয়াশা আচ্ছাদিত চাঁদর পরে হাজির হয় শীত, ঘন কুয়াশা।
ইংরেজি নববর্ষের নতুন দিনে আমরা সবাই শীতের তীব্রতা অনুভব করি। রঙ-বেরঙের তাপ দায়ক পোশাক পরে অতিবাহিত করি আমাদের সময়। কিন্তু আমাদের গরিব-দুঃখিদের কথা ভুলে গেলে চলবে না। আকাশ যাদের ছাদ। জমিন যাদের বিছানা। রাস্তার পাশেই যাদের জীবন-যাপন।
আমাদের দয়াল নবী মুহাম্মদ সা. আমাদের দয়া শিখিয়েছেন। মায়া-মমতা আর আদর শিখিয়েছেন। খোলা আকাশের
নিচে কিভাবে বসবাস করবে গরিব-দুঃখি! তাদের গায়ে শীতের আক্রমণ খুবই তীব্র হবে। কলাপাতার মতো শীতে কেঁপে উঠবে ওদের শরীর আর আমরা চেয়ে চেয়ে তামাশা দেখবো? দু’চারটি গরম কাপড় গায়ে দিয়ে বসে থাকবো? কখনো না। আমাদের এমন হলে চলবে না। আমাদের প্রত্যেকের গ্রামের বাড়িতে, শহরের অলিতে-গলিতে অসহায় গরিব মানুষ আছে, আমরা তাদের শীত বস্ত্র দেবো। শীতার্ত শিশুদের শীতের পোশাক পরিয়ে মুখে হাসি ফোটাবো। কনকনে শীতে বস্ত্রহীন কিংবা পোশাক ছাড়া কেমন কাটতো আামদের সকাল-সন্ধ্যা, সেকথা ভেবেই আমরা এগিয়ে যাবো দুঃখিদের কাছে। দাঁড়াবো তাদের পাশে আপন হয়ে। সব সময় খেয়াল রাখবো প্রিয় নবীর হাদিস। তিনি বলেছেন ‘যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহ তার প্রতি দয়া করবেন না।’ (মেশকাত শরিফ : ৪২১)
মাগো! তোমায় মনে পড়ে
আমার পরম শ্রদ্ধেয়া মা সর্ম্পকে কিছু লিখবার ইচ্ছা গত কয়েক দিন ধরে মনকে প্রবলভাবে আন্দোলিত করছে। কোনোরূপ বাড়াবাড়ি না করে তার সম্পর্কে শতভাগ সত্য এবং বাস্তব বিষয়গুলোই লিখছি। আমার মা একজন অসাধারণ গুণবতী মহিলা। আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন বড় মনের মানুষ। বিচক্ষণ, আত্মবিশ্বাসী ও সদা কর্মচঞ্চল। আমরা ভাই-বোনেরা ভেবে অবাক হই, এ পড়ন্ত বয়সেও তার এমন অসাধারণ সংসার পরিচালনা, কোনো গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল বিষয়ে দ্রুত উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং অপূর্ব ধৈর্য্যশক্তি দেখে।
আমাদের সুন্দর ভবিষ্যত গড়ার জন্য কত কিছুই না তিনি করেছেন! উত্তরাধিকার সূত্রে নানাবাড়ি থেকে প্রাপ্ত বিশাল সম্পত্তির অনেকাংশ বিক্রি করে দেওয়া, নিজের আরাম-আয়েশের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করা, সকাল-সন্ধ্যা অবিশ্রান্ত সাংসারিক কাজকর্ম সামলানো, পরীক্ষার সময় জায়নামাজে বসে কান্নায় বুক ভাসানো, সবই তিনি করে চলছেন আমাদের প্রতি আবেগ আর সীমাহীন øেহ-ভালোবাসা নিয়ে। এতে তার কোনো ক্লান্তি নেই। দুঃখ নেই। অনুযোগ নেই। নেই কোনো অভিযোগ। যেন এতেই তার যত আনন্দ আর প্রাপ্তি! পরের তরে এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে আম্মার উদাহরণ জগতে বহু আছে, কিন্তু নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার নমুনা খুব একটা নেই। এমন যারা হয় প্রকৃতপক্ষে তাদের অবদান কলমের দ্বারা ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। এ শুধু উপলব্ধি আর অনুভবের বিষয়। হৃদয়ের গভীরে পরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা পোষণের বিষয়। তাই কৃতজ্ঞচিত্তে তার স্মরণে গেয়ে উঠি এ নিশিতে আজি -‘যখন রাত্রি নিঝুম, নেই চোখে ঘুম, একলা শূন্য ঘরে, তোমায় মনে পড়ে মাগো! তোমায় মনে পড়ে...।
ইবনে আব্দুল মজিদ
সাতপাই, সদর নেত্রকোণা
হৃদয়ে ঢাকা ইজতেমা
১৩ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার। ঘড়ির কাটা দুইটা চল্লিশ মিনিট ছুঁই ছুঁই। তখন দুপুর। মাথার ওপর সূর্য। খাঁ খাঁ করছে রোদ। মিরপুর বেড়িবাঁধ রোডে আমাদের গাড়ি। ঢাকা জেলার ইজতেমার পথের যাত্রী আমরা। বেড়িবাঁধের দু’পাশে স্তুপ স্তুপ আবর্জনা। থেকে থেকে বিষাক্ত কালো পানির নালা। ঝাঝালো দুর্গন্ধে নাক বন্ধ হয়ে আসে। পেট মোচড় দিয়ে ওঠে। অসহ্য লাগে সে সব পরিবেশ। তবু ক্লান্তিহীন, বিরক্তিহীন আমাদের চোখ-মুখ। অজানা প্রশান্তি আর অপার্থিব আনন্দে যেন মোহাচ্ছন্ন সবার দেহমন।
বিকাল চারটা। টঙ্গী ব্রীজের খানিকটা দূরে আমাদের গাড়ি। ক্ষাণিকটা দূরেই ইজতেমার মাঠ। কাছাকাছি এসে জ্যামে পড়ে যাই। সামনে পিছনে বিশাল গাড়ির বহর। অগত্যা গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুটা হাঁটতেই মাঠ জুড়ে টানানো শামিয়ানা। আনন্দে নেচে উঠে দেহমন। নিমিশেই শূন্যে মিলে যায় সফরের যত ক্লান্তি। হাজারো মানুষের মিলনমেলা, সবুজাভ বিশাল মাঠ, সারি সারি শামিয়ানা। এ যেন অন্য এক ভূবন। ভাবতেই মনটা আনন্দে ভরে ওঠে।
মাঠে ঢুকেই আসরের নামাজ আদায় করলাম।। খোলা আকাশের নিচে নামাজ পড়ার মজাই আলাদা। পায়ের নিচে সবুজ ঘাস। দক্ষিণা মৃদু বাতাস। তুলতুলে নরম ঘাসকে খুব আপন মনে হয়। ইচ্ছে করে ছিড়ে ছিড়ে পকেটে ভরি ।
নামাজ শেষে তাবু টানালাম। রান্নাঘর বানালাম। মোটামুটি তিনদিনের সংসার যাকে বলে। সব ঝামেলা শেষে চুপচাপ বসে পড়লাম । স্থির মনে বয়ান শুনতে লাগলাম। বয়ান শেষে এশার নামাজ পড়লাম। রাত নয়টায় খাওয়া শেষে ঘুম। দিনের ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিতেই ঘুমে হাবুডুবু।
রাত চারটা। ঘুম ভাঙার পর ভীষণ ঠাণ্ডা অনুভব করলাম। মাথার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে হীম শীতল বায়ু। শামিয়ানা চুয়ে চুয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু শিশির। ভাবতেই হীম হয়ে আসে শরীর। অজানা শীত আতঙ্ক চেপে বসে ঘাড়ের ওপর। সাহস নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। নরম ঘাসের কোমল শিশির মাড়ালাম। ঠাণ্ডা পানিতে সিক্ত করলাম সারা দেহ। কাঁপতে লাগলাম এক পাশ হয়ে। শীতল øিগ্ধ পবিত্র অনুভূতি। আল্লাহর রাস্তায় প্রবল শীত উত্তাপে দাঁড়িয়ে কম্পমান দেহমন। এ যেন এক অপ্রার্থিব অনুভূতি। পৃথিবীর কোনো আনন্দই এই অনুভূতির সঙ্গে মিলে না।
মুহা. হুসাইন শহীদ
সাভার, ঢাকা
সদস্য নং৪৯৯৫
আমার আম্মু
আমার আম্মু অতি সাধারণ একজন মহিলা। নামের আগে হাফেজা, আলেমা বা এ জাতীয় অন্য কোন পদবি নেই। স্কুলে পড়ার দৌঁড়ও খুব বেশি না। মাত্র ক্লাস ফাইভ। কিন্তু মানুষের সঙ্গে মিশতে পারেন অতি সহজেই। আমল আখলাক ধৈর্য্য এবং ত্যাগ তিতিক্ষা দেখে মনে হয় না যে তার মধ্যে শিক্ষার কোনো অভাব আছে। বরং মানবিক গুণাবলী তার মধ্যে ষোলকলায় পূর্ণ। মায়া মমতা দিয়ে আমাদের জড়িয়ে রাখেন সবসময়। শুধু আমাদের নয়, বাড়ির পাশে বালিকা মাদরাসার ছাত্রীদেরও ভালোবাসেন মনে প্রাণে। ছাত্রীদের জ্বর হলে মাথায় পানি দেওয়া, কাশি হলে মধু গরম করে খাওয়ানো সব আম্মুই করেন।
মাদরাসার ছাত্রীরা আমার আম্মুকে মহব্বত করে ‘বড় আম্মু’ ডাকে। আমাদের বাড়িতে ছাত্রীদের অতি আনা গোনা দেখে মাঝে মধ্যে বিরক্তি লাগে। কিন্তু ছাত্রীদের প্রতি আম্মুর নিঃশ্বার্থ ভালোবাসা ও মায়া মমতা দেখে সত্যিই অবাক হতে হয়। একেক সময় মনে হয় আম্মু আলেমা হাফেজা না হওয়ায় মন্দ হয়নি। কারণ, অনেক সময় আলেমাÑহাফেজাদের মধ্যে একটা আলাদা ভাব লক্ষ করে থাকি।
আমাদের পাড়ায় অসহায় এক বৃদ্ধ মহিলা আছে। যার আপনজনরা তার সেবা যতেœ অবহেলা করে, আমার আম্মু তার মাথার উকুন আনা থেকে শুরু করে পায়ের নখ কাটা পর্যন্ত করে দেন। এই সে দিনের ঘটনা, মহিলাটির হাত পায়ের নখ কেটে দেওয়ার পর, সে আম্মুর পা ছুঁয়ে বুকে কপালে লাগিয়ে বললো, ‘তোরা মসজিদে থাকছ, হাদিস কোরান পরছ আর তুই আমার নাহাল (মতো) মানুষের ঠাং ছুইছছ, এটা ঠিক হয় নাই। আল্ল¬ায় আমারে পাপ দিবো, তাই তোর পাও ছুইলাম।’
আমার দাদী আমার জন্মের দুই বছর আগে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন ওপারে । তাকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে তার দ্বীনদারী, নম্র, শান্ত স্বভাব ও দানশীলতার কথা অনেক শুনেছি। পাড়ার মহিলা থেকে শুরু করে অনেক ভিখারি পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে এসে আমার দাদীর মায়ায় কাঁদে। সবার মুখে আমার দাদীর বর্ণনা শুনে মনে হয় আমার আম্মু যেন দাদীরই প্রতিচ্ছবি।
আম্মু যে শুধু আদরই করেন তা কিন্তু নয়। শাসনও করেন। আমাদের কোনো ভুল হলে প্রথমে বকাঝকা করলেও পরে মমতার সাথে সংশোধন করে দেন
আমার এ গুণকীর্তন দেখে কেউ হয়তো ভাবতে পারেন মায়ের নামে এতো কিছু বলার কী আছে? আসল কথা হলো, আমার এ লেখা আম্মুর প্রশংসা বা গুণ বর্ণনার জন্য নয়। বরং পাঠকদের এই মেসেজ দেওয়ার জন্য যে, কেউ একজন আলেমা, হাফেজা না হয়েও মহৎ প্রাণ যে হতে পারেন তার একটি নজির পেশ করা।
তাহমিনা জামান
আল-ইহসান বালিকা মাদরাসা
দেওহাটা, মির্জাপুর, টাঙ্গাইল
সদস্য নং৪৯৯৭
অপেক্ষায় ছিলাম
অনেক দিন থেকে মন ভালো নেই। নতুন মাদরাসায় এলাম। পরিবেশ প্রকৃতি সব অপরিচিত। মাঝে মধ্যে কেন যেন দু’চোখ বেয়ে পানি ঝরতো। কেউ কিছু জানতে চাইলে লুকিয়ে ফেলতাম। ইনিয়ে বিনিয়ে অন্যটা বলে দিতাম। আমার ভেতরটা কাউকে বুঝতে দিতাম না। একদিন বটতলী মাদরসার শিক্ষাসচিব মাও: আব্দুস সাত্তার খানÑ মামুন, মাকছুদ ও ভোলার মুনিরকে কি যেন ইঙ্গিত করলেন। এরপর তারা আমাকে হাওয়ার রাজ্যে নিয়ে যায়। জায়গাটা মাদরাসার একটু পূর্ব দিকে। নাম পূর্বকড়ইতলা। দুদিকে সবুজের মধুমাখা হাতছানি। কাঁশফুল আর সারিবদ্ধ গাছগাছালির নির্মল ছোঁয়া। বিস্তীর্ণ ছায়া ঘেরা পথ। হালকা বাতাসে নতুন আমেজ। এ মুহূর্তটা আমার জীবনের স্মরণীয় একটা সময়। যে দিকেই চোখ মেলি সে দিকেই সবুজের মনোরম ছবি। যেন শিল্পীর তুলি আপন পরশ মেখে দিয়েছে। কিচির মিচির শব্দে বিরাজ করছে ঝংকার। দূর্বাঘাসের সবুজ গালিচায় মুক্ত পায়ে দাঁড়ানোর মজাই আলাদা। কল্মীফুলের পত্র-পল্লব আর বাতাসের অবাধ বিচরণ। ঘাসফড়িংয়ের উড়াউড়ি আমাকে শৈশবে নিয়ে যায়। এগুলো দেখে যে কেউ পাল্টে যাবে। জেগে উঠবে ছন্দময় ভাবনা। আমারও সে রকমই হয়েছে। এতোদিন এমন একটি øিগ্ধ বিকেলের অপেক্ষায় ছিলাম।
মিযানুর রহমান জামীল
চাটখিল, নোয়াখালী
এগিয়ে যাওয়ার সম্বল
হাফেজ ইয়াকুব সাহেব রহ.। আপন মহলে ‘বড় হুজুর’ নামেই অধিক পরিচিত। নিজেকে তিলে তিলে ক্ষয় করে গড়ে তুলেছেন। লাকসাম উত্তর বাজার হাফিজিয়া মাদরাসা। আমরণ এ প্রতিষ্ঠানের হাল ধরে রেখেছিলেন তিনি। তবে সহজে নয়। অনেক ঝড়-তুফান বয়ে গেছে তার ওপর দিয়ে। তবু তিনি ছিলেন অটল অবিচল। আমি যখন সেখানে পড়তে যাই তখন প্রতিষ্ঠানের ২২ বছর অতিক্রম হয়ে গেছে। এটা ২০০১ সালের কথা। দু’বছর পড়েছি সে মাদরাসায়। লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে চেষ্টা করতাম সকল উস্তাদের খেদমত করতে। পেরেছিলাম কিনা বলতে পারবো না। তবে উস্তাদগণ আমাকে খুব আদর-øেহ করতেন, দোয়া দিতেন। বড় হুজুর একটু বেশি আদর করতেন। সব সময় বাবা বলে ডাকতেন। অসুস্থ হলে ডাক্তার দেখাতেন। আমিও চেষ্টা করেছি সে আদরের কদর করতে। আমার যতদূর মনে পড়ে দুবছরে কোনো কাজ আদেশ দিয়ে করাতে হয়নি। কাপড় কাচা, কাপড় আয়রণ করা, খাবার রেডি করাসহ সব কাজই বলার আগে প্রস্তুত রাখার চেষ্টা করতাম। এ ভাবে দেখতে দেখতে দু’বছর কেটে গেল। কমপ্লিট হয়ে গেল আমার হিফজ পড়াও। রোজার ঈদের পর বিদায় নিয়ে চলে আসবো। বড় ভাইয়া গেলেন আমার সাথে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া একজন স্টুডেন্ট। যেখানে ছাত্র-শিক্ষকের নির্মল মায়ার বন্ধন বড় দুর্লভ। সে দিন এমন একটি সুখ-সুন্দর বিদায় দৃশ্য দেখবেন স্বাভাবিক ভাবেই এটা তার কল্পনায় ছিলো না। তিনি খুব প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং বাড়ি এসে সবার কাছে ঘটা করে বলেছিলেন। তার মতে সেটা ছিলো পিতা-পুত্রের বিদায়-বিচ্ছেদের করুণ দৃশ। যখন আমি বড় হুজুরের সঙ্গে বিদায় মুসাফাহা করতে হাত বাড়ালাম, তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললেন। কিছু সময় বুকে জড়িয়ে বেদনার নোনা অশ্র“ ঝরালেন। আমার চোখেও অশ্র“ এসেছিলো। কষ্ট উপলব্ধি হয়েছিলো হৃদয়ে। সেই দৃশ্য আজও আমাকে পুলকিত, আলোড়িত, অনুপ্রাণিত করে। করে সাহসী। স্বপ্ন দেখায় সামনে এগিয়ে যাওয়ার। আবদুল্ল¬াহ আল মুনীর
মাদরাসা দারুর রাশাদ, মিরপুর পল্লবী, ঢাকা
যে কথা বলতে চাই
২০০০ সালের কথা। তখন আমার বয়স ১১ বা ১২ হবে। সে সময় আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন আমার প্রাণপ্রিয় মুরুব্বী মাওলানা মুহা. সালমান সাহেব দা. বা.। ভর্তি করেন দারুর রাশাদ মাদরাসার মক্তব বিভাগে। মক্তব বিভাগ শেষ করে হুজুরের পরামর্শক্রমে ভর্তি হই জামেউল উলুম মাদরাসার হেফজ বিভাগে। হেফজ সমাপ্ত করে সেখানেই কিতাব বিভাগে পড়তে শুরু করি। সে দিনের কথা আজও মনে পড়ে। তখন বুক ভরা আশা ছিলো, মনে ছিলো আনন্দ। এক উদ্যমী স্পৃহা আমার অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলছিলো। যা আমাকে আজ এ পর্যন্ত লেখাপড়ার প্রতি উৎসাহ দিচ্ছে। সেখানে আমার লেখাপড়া চলতে থাকে হেদায়া পর্যন্ত। এতোদিনে ছাত্রÑউস্তাদদের সাথে ভালো সর্ম্পক গড়ে ওঠে। উস্তাদগণ আমাকে মহব্বত করতেন। আমিও উস্তাদদের শ্রদ্ধা করতাম। ছাত্ররা একে অপরের সাথে ভ্রাতৃত্বসূলভ আচরণ করতো। একে অন্যকে সহযোগিতা করতো। কেউ অসুস্থ হলে সবাই তার সেবা করতো। আহ! কী সুন্দর ব্যবহার। তখন আমার নিজের দায়িত্বের মাঝে অনুভূতি আসতে থাকে।
আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান সর্ম্পকে জানতে আগ্রহি হই। পুনরায় ফিরে আসি আমার লেখাপড়ার সূতিকাগার ব্যতিক্রমধর্মী বিদ্যাপিঠ মাদরাসা দারুর রাশাদে। ভর্তি হই মেশকাত জামাতে। এখানে আমার কাটে দুবছর। এ সময়ে বড়-বড় লেখকÑসাহিত্যকদের দেখতে পাই। তাদের দেখে আমার মাঝেও স্বপ্ন জাগে লেখক হতে। তার জন্য আমি মাদরাসা দারুর রাশাদকে নির্বাচন করি। সফলতার স্বাক্ষর নিয়ে জাতিকে কিছু না দিতে পারলেও যেন খালি হাতে না ফিরি।
মুহা. আতাউল্লাহ
মাদরাসা দারুর রাশাদ, মিরপুর পল্লবী, ঢাকা
পাহাড়ের রঙিন আনন্দ
জীবনে স্মরণ রাখার মতো অনেকগুলো দিন এসেছে। কালের আবর্তে তা তলিয়েও গেছে। আজ পেছনে ফিরে তাকালে মনের কোণে সেসব দিনের স্মৃতি এসে ভীড় করে। সেসব স্মৃতিতে আনন্দের পরশ আছে। বেদনার ছোঁয়া আছে। কিন্তু সব বেদনার সুর চাপিয়ে যে দিনটি আমার সবচেয়ে বেশি আনন্দময়, সবচেয়ে বেশি স্মরণীয়, তাহলো একটি ছুটির দিন। সেদিন ছিলো বিজয় দিবস। আমি তখন হাটহাজারী মাদরাসায় পড়ি। কয়েকজন বন্ধু মিলে ঠিক করেছিলাম, বিজয় দিবসে আমরা বাংলাদেশের কোনো এক পর্যটন কেন্দ্রে যাব। আনন্দ উল্লাস করবো। পার্বত্য জেলা রাঙামাটি ছিলো আমাদের প্রথম টার্গেট। সেখানে গেলে প্রাকৃতিক কিছু সৌন্দর্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটবে। এই আনন্দে উচ্ছ্বাসিত হয়ে অনেক আগ থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখি। অবশেষে ছুটির দিনটি এলো। আমরা ফজর পড়ে বের হলাম গন্তব্যের উদ্দেশে। বাসে দেড় ঘণ্টার পথ। আমরা যখন রাঙামাটি পৌঁছি তখন বেলা সাতটা। আমাদের সঙ্গে কিছু খাবার ছিলো। সারা দিন চলাফেরার মাঝে ক্ষুধা দূর করবে এই খাবার।
সময়ের সল্পতায় পর্যটন কেন্দ্রগুলো নদীপথে দেখার সিদ্ধান্ত নিই। ঘাট থেকে একটি বোট ভাড়া করে ঘুরতে শুরু করি। একে একে দেখতে থাকি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য জেলা রাঙামাটি। সেখানকার সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা সৌন্দর্য আমাদের আকৃষ্ট করে। মুগ্ধ করে। এভাবে ঘুরে ঘুরে পর্যটন কেন্দ্রগুলো দেখি। সুবলং ঝর্ণা, ঝুলন্ত ব্রীজসহ দেখি দৃষ্টিনন্দন সব দৃশ্যাবলী। পুরো দিনটি জুড়ে আমরা মুখরিত ছিলাম। এরই মাঝে জোহরের নামাজ আদায় করে সঙ্গে আনা খাবার খাই। একটু বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় আবার ঘুরা শুরু করি। সেদিন প্রচণ্ড রোদ থাকায় কিছুটা কষ্ট হয়েছে। অবশ্য কষ্টের মাঝেই যে আনন্দ হয়েছে তার মূল্য অনেক বেশি।
অবশেষে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। আমাদের ফিরে আসার সময় হয়। এক সময় ফিরেও আসি। তবে আজও স্মৃতিতে থেকে যায় সেদিনের ভ্রমণ।
ইমামুদ্দীন সুলতান
মাদরাসা দারুর রাশাদ, মিরপুর পল্ল¬বী, ঢাকা