এক. হাতে একটা ছেঁড়া পলিথিন। কাঁধে লাগোয়া আরও দুটো; যেনো ঝুলিকাঁথা। সঙ্গে থালা-বাসন কিচ্ছু নেই। তবু খেতে বসা। কখনও এদিক-সেদিক বসে কাটানো; আবার কখনও চলতিপথে ঝিমিয়ে-ঝিমিয়ে মাতালের মতো সময় পার করা এভাবেই যেনো দিনাতিপাত ওদের। রাতটা আর কোথায় কাটবে! ওই ফুটপাতের অন্তহীন জায়গাতেই। কেবল বুকে এতোটুকুন আশা খেয়ে-দেয়ে একটু বাঁচার কিংবা মাথা গোঁজার ঠাঁই। সঙ্গে কেউ নেই। কখনো বা এক বা একাধিকজন সঙ্গী; নিজেরই গোষ্ঠীর, আবার অন্য কেউ। ভালোবাসা, আদর-সোহাগ যেনো ওদের পোড়াকপালে নেই। কাকডাকা ভোর থেকে যেই জীবনের সূচনা ঘুরে ঘুরে, আবার সাঁঝের অন্তিমটাই যেনো কুঁড়িয়ে-টুকিয়ে সেই জীবনেরই ইতি। বিরাম নেই খানিকটা সময়ও এর মধ্যপথে। অভিমানকালে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ওদের কেউ মান ভাঙায় না কখনও। না চাইতেই কেউ দেয় না ওদের এক টুকরো রুটি কিংবা দুমুঠো খাবার। চলতিপথে সেদিন দেখা হয়ে গেলো নাম না জানা ওদের একজনের সঙ্গে। বাজারঘেঁষে মুখভার করে বসা দেখেই ইচ্ছে হলো কথা বলতে। ‘আজ সকালে খেয়েছো কিছু?’ নরমস্বরে জানতে চাইলাম। ‘খাইছি; কিন্তু প্যাট ভরে নাই’ গেঁয়ো ভাষায় জবাব দিলো পথশিশুটি। এই বয়সে ওর মাড়ানোর কথা ছিলো কোনো বিদ্যালয়ের চৌকাঠ। কিন্তু সহায়-সম্বলহীন হওয়ায় আজ এই দশা। কী আর করা! যে যার মতো চলে। তেমনি আমিও। হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়ালাম কমিউনিটি সেন্টারের ঠিক উল্টো পাশটায়। অতি দুর্গন্ধে বেশিক্ষণ আর দাঁড়ানো গেলো না জায়গাটাতে। আশপাশে নজর দিতেই চোখে ভাসলো করুণ দৃশ্যের একটি মুখচ্ছবিÑ দুজন টোকাই খাদ্যের অভাবে ডাস্টবিন থেকে খাবার কুড়িয়ে খাচ্ছিলো। পাশ দিয়ে অসংখ্য লোকের যাতায়াত। আনাগোনা আরও কতো সমাজসেবী নামধারী ভদ্রলোকদলের। কিন্তু কারোরই ওদিকটায় খেয়াল নেই। ব্যবস্থাপনাও নেই এদের এ পথ থেকে উত্তরণের। নেই কোনো উদ্যোগও। মায়া হলো চেহারাদুটো আবছা আবছা দেখেই। এগিয়ে গেলাম বেশ কাছে। ‘আমরা পেরায় আধা দিন ধইরা কিছুই খাই নাই। তাই প্যাটের দায়ে এইহানে আইসা খাইতা...।’ আর বলতে দিই না ওদের। বড় কষ্ট লাগে ওসব শুনতে। উপরন্তু ভয়ানক ঘৃণা জন্মে এই সমাজব্যবস্থার প্রতি। দুঃখ এবং চরম ক্ষোভ হয় কর্তাব্যক্তিদের ওপর। তবুও এগিয়ে চলে জীবন। আর এগিয়েও যেতে দিতে হয় প্রতিদিনই, প্রতিদিনকার কাছেই। ওই যে সেদিন; বাসা থেকে ফেরার পথে দেখা হলো এলাকার গণ্যমান্য নেতার সঙ্গে। সালাম-কালাম হলো সংক্ষিপ্তাকারে। রেললাইনের বস্তিতে সদ্য গড়ে ওঠা পথশিশুদের বিদ্যালয়ের জন্য অনুদানের বিষয়টি তুলে ধরলাম তার সামনে। স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, ‘ওসব আকাইম্যা কাজে আমি নাই।’ ‘তাহলে কারা আছে বা থাকবে?’ পাল্টা প্রশ্ন করতে বড্ডো ইচ্ছে হয়েছিলো। কিন্তু অন্যদের মতো আমিও কৃত্রিম সম্মানার্থে মুখ বুজে এড়িয়ে গেলাম তাকে।
দুই. বালকটির নাম আদিল। জন্ম শ্রীনগরে। জন্মের পরে ওর দেখা মেলেনি বাবার। মা চির-লাপাত্তা হয়েছেন কিনা, জানা নেই। হতে পারে অন্য কোথাও ঠাঁই নিয়েছেন; বাঁচার তাগিদে কিংবা অনন্ত সুখের মিথ্যে আশায়। পরিবারের আর সব কে কোথায়Ñ কে জানে! জানা নেই সবার মতো আদিলেরও। শুধু ওর চেনা শহরের এই অলিগলি; আর জানা খাবারের খোঁজে অসহায় সাজার ভান। রমজানের আগেই ও তৈরি। এবার ঈদে অনেক টাকা আয় করার কৌশল ইতোমধ্যেই এঁটেছে। নিজের গোছের অন্যসব অসহায় বালক ওর নিতসঙ্গী। ওরাও এক হয়েছে। হয়তো বা একই চুক্তিতে আবদ্ধ। কথা হলো ওদের ক’জনের সঙ্গে। শহরের চিরচেনা এক মোড়ের বাঁকে বসলাম আমি আর ওদের ক’জন। ‘তোমরা ঈদ কেমন করে কাটাও?’ কিছু না ভেবে শফিক নামের একজন বলে ফেললো, ‘মাইনষের বাসায় বাসায় যাইয়া খাবার চাই..।’ আরও কিছু বলতে চেয়েছিলো শফিক। কিন্তু পাশের আরেকজনের হাতের ইশারায় ওর মুখ আটকে গেলো। কারণ অসহায় হলেও তো চক্ষুলজ্জা আছে ওদের। ওরাও তো মানুষ। যদিও ধন-সম্পদ নেই এখন ওদের। ওটাতো কেবল ক্ষণস্থায়ী; আসা-যাওয়ার বস্তু। আজ একজন বিরাট বড় ধনী তো আগামীকাল ফকির। আবার একজন হতদরিদ্র তো কাল নামি-দামি সম্পদশালী। যাকগে ওসব। কথার রেশ ধরে একটা সময় বলে বসলাম, ‘এবার কিভাবে কাটাবে ভেবেছো?’ শফিক বলে ওঠলো, ‘ভাই, এইবার অনেক কিছু পেলান করছি আমরা। যদি সাকসেস হই, তাইলে আপনারে কইবো নে।’ ‘কি প্লান, বলো না!’ একটু আগ্রহ নিয়েই আমার জিজ্ঞেস করা। ‘এখন কওয়া যাবে না’ সাদেক নামে ওদের একজন বললো। ‘আচ্ছা, যখন বলবা না তো ঠিক আছে। কিন্তু তোমাদেরকে পরে আমি পাবো কই?’ সবার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম। ‘পাইবেন, পাইবেন’ ওদের সবার বড় স্বপন বললো। ‘না, পাবো না’ দেরি না করে এখনই জানার জন্য বললাম কথাটি। অমনিই পাশ থেকে হু হু করে কেঁদে ওঠলো আদিলটা। ‘কি হয়েছে তোমার?’ ভেতরে ভেতরে স্বঘোষিত মুরব্বি সেজেই জানতে চাইলাম। ‘আসলে সত্য কথা কইতে কি ভাই জানেন, আমি পোরতি বছরই ভাবি, এইবার ভালো কইরা ঈদ করবো। শহরের বাচ্চাগো মতোন আমারও নতুন নতুন জামা অইবো। কিন্তু কেডা জামা কিন্না দিবো? এইহানের গলিতে মাইনষের কাছে চাইয়া-চিন্তায় যা পাই, অ-তে তো আমাদের প্যাটই চলে না। আবার অন্য সবকিছুর কথা ভাববো কহন?’। খানিক সময় কথা বলে অবশেষে থামলো ওর কান্না। ওর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাঁদলো শফিকও, ‘আমার মা আমারে থুইয়া যাওনের পর থেইক্কা কোনোবারই ঈদ ভালোভাবে কাটে নাই। হেই সময় আমি মেলা ছোডো ছিলাম। বুঝতাম না অনেক কিছুই। এট্টু যহন বুঝতে হিগলাম, তহন থেইক্কাই মায়রে খুঁইজ্জা বেড়াইছি এদিক-ওদিক। কিন্তু তারে আর পাই নাই।’ কান্না থামিয়ে শফিক আমায় জিজ্ঞেস করে বসলো, ‘ভাই, আফনের কি মা বাইছা আছে?’ ‘আচমকা কেনো এই প্রশ্ন?’ মানে বুঝলাম না। তবু শান্ত স্বরে জবাব দিলাম, ‘আছে ভাইয়া!’ ‘তাইলে আফনে বুঝবেন ক্যামনে মায়ের যন্তোনা!’ বোঝা-না বোঝার দ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম ওর কথায়। আবার মূলপর্বে ফিরে এলাম, ‘তোমাদের ঈদ তাহলে এভাবেই কাটে প্রতি বছর?’ ‘এই রকমই ধরতে পারেন’ বললো আদিল। সন্ধ্যার আকাশে তখন আলো-আঁধারির খেলা চলছিলো। আর ভেতরে কেমন যেনো এক মায়াকান্না মনেরই অজান্তে গুমরে উঠছিলো আমার। কিন্তু বলার কাউকে পাচ্ছিলাম না পাশে। ছিলো না দেখারও কেউ। কেবল ওরা ক’জনই আমার সামনে হাফপ্যান্ট পরে বসা। রোজা শেষে আমাদের জীবনে আনন্দের এক অনাবিল ফোয়ারা নিয়ে হাজির হবে প্রতিবারের মতো এবারের ঈদুল ফিতরও। কিন্তু ওদের জীবনটাতে কি আসবে? থাকবে কি ওদের পরনে জামা-কাপড়? সবার মতো ওরাও কি হৈ-হুল্লোড়ে ভেসে বেড়াবে শাওয়ালের প্রথম রাতের বাঁকা চাঁদটি দেখে? এসব কেবল আমার নয়, অনেকেরই অজানা। কিন্তু সেটা আর কতোদিন! এভাবেই কি অনিশ্চিত গন্তব্যে ভেসে যাবে ওদের জীবন! ওদের মুখে কি হাসি ফুটবে না ঈদের খুশির, নাকি জীবনটা ওদের এমনই! এভাবেই কাটবে গন্তব্যহীন। না সবার জীবনে এলেও ওদের জীবনে আসে না ঈদ নামের কোনো আনন্দ কিংবা পরার কোনো বস্তু!
দাওরা ফারেগ নবীন আলেমদের জন্য একগুচ্ছ উপহার
মাওলানা মুফতি আশরাফুজ্জামান
জুন'১৪
কওমি মাদরাসার চলমান শিক্ষাবর্ষ সমাপ্তির পথে। দুয়ারে কড়া নাড়ছে সমাপনী পরীক্ষা। দীর্ঘ ১০-১২ বছর পর্যন্ত ছাত্রত্বের পরিচয়ে থাকা অনেক ছাত্রভাই পরীক্ষার পর আনুষ্ঠানিকভাবে মাওলানা উপাধি পেতে যাচ্ছেন। ব্যাপারটি শিক্ষা সমাপনী ছাত্রদের জন্য আবেগের- আর আমরা যারা শিক্ষকের দায়িত্বে আছি, আমাদের জন্য আনন্দের। কারণ, জাগতিক সব চাওয়া-পাওয়া উপেক্ষা করে আমরা যারা ছাত্রদের নিয়ে পড়ে থাকি; এসব ছাত্রদেরকে নিজেদের নাজাতের ওসিলা মনে করে আমরা আনন্দিত হই। উদ্বেলিত হই। মনে প্রশান্তি খোঁজে পাই। হাদিস শরিফে এসেছেÑ ওলামাগণ নবীজি সা. এর ওয়ারিস বা উত্তরাধিকারী। হাদিসটি একদিকে যেমন বিরাট ফজিলত এবং মর্যাদার জানান দেয়; অন্যদিকে সীমাহীন দায়িত্বের বার্তাও বহন করে। মহান আল্লাহ তায়ালা যাদের মঙ্গল কামনা করেন- একমাত্র তাদেরকেই দ্বীনি ইলম দান করেন। ইলমেদ্বীন খোদা প্রদত্ত এক অমূল্য নেয়ামত। এ নেয়ামতের হকদার কেবলমাত্র মহান মালিকের নির্বাচিত ব্যক্তিরাই হবে- তাতো খুবই স্বাভাবিক। অর্থকড়ি, বাহুবল, দৈহিক শক্তি দিয়ে তা হাসিল করা সম্ভব নয়। আল্লাহ পাক যাকে দেয়ার ইচ্ছা করেন একমাত্র সে-ই এ নেয়ামতে ধন্য হয়। অতএব, যাকে এ নেয়ামত দেয়া হবে তার জন্য নেয়ামতপ্রাপ্তির কৃতজ্ঞতা সর্বদাই অন্তরে লালন করতে হবে। সর্বদা সজাগ থাকতে হবে নেয়ামতের যেন না-শোকরি না হয়। এ নেয়ামতের দাবি পূরণে নিজেকে সঁপে দিতে হবে। ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার সামান্য ভোগ-বিলাসের বিনিময়ে তা বিলিয়ে দেয়া চলবে না। আলহামদুলিল্লাহ! বর্তমানে গোটা দুনিয়াতে সহিহভাবে দ্বীনি শিক্ষার সংরক্ষণ ও দ্বীনের প্রচার-প্রসারে আমাদের এই মাদরাসাগুলোকে আল্লাহ তায়ালা কবুল ও মঞ্জুর করেছেন। বিশ্বব্যাপী সহিহ-দ্বীনের মিশনগুলোর অধিকাংশই দারুল উলুম দেওবন্দের ফসল। এ সকল খেদমতের সাথে কওমি মাদরাসার সন্তানরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। অধিকাংশ খেদমতের সাথে তো প্রত্যক্ষভাবেই জড়িত। বাদ-বাকিগুলোর সাথে জড়িত পরোক্ষভাবে। তালিম-তরবিয়াত, তাযকিয়া, দাওয়াত ও তাবলিগ, ওয়াজ-নসিহত, মসজিদের ইমামত-খেতাবত, দরসে হাদিসের খেদমতসহ দ্বীন প্রচারের সকল শাখায় রয়েছে কওমি শিক্ষার্থীদের আধিপত্য। বাতিলের বিরুদ্ধে সঠিক বক্তব্য, শিরক-বিদআত ও নাস্তিকতা উৎখাত ও সমাজে শান্তি-শৃংখলা প্রতিষ্ঠায় তাদের ভূমিকা অপরিসীম।
যখন দেশের সর্বো"চ ব্যক্তি থেকে পিয়ন-চাপরাশি পর্যন্ত আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত, আমাদের মতো দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ, যেখানে শাষকগোষ্ঠীর সর্বো"চ ব্যক্তি থেকে সাধারণ জনগণ পর্যন্ত দুর্নীতিতে নিমোজ্জিত, মিথ্যা, গিবত-শেকায়েত, অপপ্রচার, হত্যা-লুণ্ঠণ, গুম-খুনসহ নানা অন্যায়-অত্যাচারে মানুষ যখন অভ্যস্থ, এরই মাঝে ন্যায়-নিষ্ঠা, সততা-সত্যবাদিতা, সুনীতি-সহমর্মিতার যে প্রদীপ নিভু নিভু করে জ্বলছে- তা কওমি মাদরাসা ফারেগ আলেম-ওলামাদের কুরবানির বদৌলতেই বলে আমি মনে করি। মিম্বার-মেহরাব থেকে উত্তপ্ত মাঠে-ময়দানে দ্বীনের জন্য বুকের তাজা রক্ত আজ তারাই ঢালছেন। শুধু দ্বীন রক্ষা ও প্রচারের কাজ নয়, সমাজে সুনাগরিক তৈরি ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার দায়িত্বও মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কওমি মাদরাসার সন্তানদের দিয়ে পালন করাচ্ছেন। খোদাভীরুতা ও তাকওয়া-পরহেজগারি ছাড়া কারো জন্য ন্যায়-নীতি ও সততার ওপর টিকে থাকা সম্ভব নয়। আর তাকওয়া পরহেজগারির যতটুকু অবশিষ্ট আছে তা কওমি অঙ্গনেই রয়েছে। অতএব, ওরাসাতুল আম্বিয়ার এক মহানদায়িত্ব আমাদের কাঁধে ন্যস্ত হয়েছে। এ দায়িত্ব পালন-ই আমাদের প্রথম ও প্রধানতম কাজ। এ কাজ ছেড়ে অন্য কোনো কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা সমীচীন হবে না। দুনিয়াবি চাকুরি-বাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্যকে মুখ্য উদ্দেশ্য বানালে সেটা রাজত্ব ছেড়ে রিকসা-ভ্যান চালানোর দায়িত্ব গ্রহণের মতো হবে। তাই আমাদের মূল কাজ হবে তালিম, তাবলিগ, তাযকিয়াসহ দ্বীনের প্রচার-প্রসারের প্রচলিত সকল মিশনগুলো সচল রাখতে নিজেদের যুক্ত রাখা। বিশ্বপরিস্থিতির আলোকে কর্মপন্থা নির্ধারণপূর্বক জীবন বাজি রেখে সে সব কর্মসূচি এগিয়ে নেয়া। দুনিয়াবি ভোগ-বিলাস বিসর্জন দিয়ে আল্লাহর দ্বীন আল্লাহর জমিনে কায়েমের জন্য নিজেকে সঁপে দেয়া। এই মূল মিশন বাস্তবায়নকল্পে কর্মজীবনে ফারেগিন ভায়েরা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে কাজ করতে পারেন। প্রথম স্তর : যারা শিক্ষা জীবনের প্রতিটি স্তরে বিরাট কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে সফতলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন। অর্থাৎ সকল স্তরে যারা ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছেন। নাহু, সরফ, আরবিসাহিত্যসহ সব বিষয়ে যথেষ্ট প্রজ্ঞা অর্জন করেছেন। তারা ফিকহ, তাফসির, উলুমুল হাদিসসহ উলুমে আলিয়া অর্জনে তাখাস্সুস করতে পারেন। এরপর কমপক্ষে এক বছর আমলি তাখাস্সুস করলে খুবই ভালো হয়। অর্থাৎ কোনো হাক্কানি পীরের দরবারে বা প্রচলিত তাবলিগের মেহনতের মাধ্যমে নিজের আমলি হালাত উন্নত করা। তারপর কোনো দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার দায়িত্ব গ্রহণ করা বা দ্বীনদরদি ভাইদের নিয়ে নতুন দ্বীনি প্রতিষ্ঠান কায়েম করা। এসকল ভাইদের পাঠ্য-কিতাবের পাশাপাশি যুগের চাহিদা পূরণে বিষয়ভিত্তিক গবেষণার কাজেও অংশগ্রহণ করতে হবে। লেখালেখি ও বিষয়ভিত্তিক গবেষণা বর্তমান সময়ের বিরাট দাবি এ কথাটি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। এই স্তরে উত্তীর্ণদের থেকে যাদের জেনারেল শিক্ষার প্রতি আগ্রহ রয়েছে, অথবা ইতোমধ্যে জেনারেল শিক্ষার কোনো সনদ অর্জন করেছেনÑ তাদের জন্য বলবো, আপনারা ওই লাইনে আরও উ"চশিক্ষা অর্জন করতে পারেন। এরপর কমপক্ষে এক বছর অবশ্যই আমলি তাখাস্সুস করবেন। অতঃপর, নিজ যোগ্যতানুযায়ী কোনো বৈধ কর্মক্ষেত্রে নিজেকে নিয়োজিত করবেন। পাশাপাশি স্বীয় আমল-আখলাক ও কর্মের মাধ্যমে দ্বীনি দাওয়াতের কাজও চালিয়ে যাবেন। যারা দুনিয়াবি কাজে নিয়োজিত হয়ে মহান প্রভুর গোলামি ভুলে গেছে- তাদেরকে আল্লাহর পথে ফিরিয়ে আনার মিশনে নিজেদের যুক্ত রাখবেন। তবে এ সব ভাইদের জন্য বিশেষ সতর্কবাণী হলো- পরিবেশ পাল্টাতে গিয়ে নিজেই যেন পাল্টে না যান। বরং নিজেকে সর্বদা কোনো শক্ত বন্ধনে বেঁধে রাখবেন, যাতে করে বাইরের প্রতিকূল পরিবেশ আপনাকে ঘায়েল করতে না পারে। দ্বিতীয় স্তর : আর শিক্ষাজীবনে যারা দ্বিতীয় স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং বাংলা সাহিত্য-সাংবাদিকতার প্রতি বিষেশ আগ্রহ রাখেন, তাদের জন্য পরামর্শ হলো, আপনারা বাংলা ভাষার ওপর বিভিন্ন কোর্সে অংশগ্রহণ করে পা-িত্ব অর্জন করবেন। এরপর এক বছর আমলি তাখাস্সুস করবেন। তারপর সাংবাদিকতার পেশা গ্রহণ করতে পারেন। পত্রপত্রিকায় স্বাধীনভাবে লেখালেখি করতে পারেন বা কোনো প্রিন্টমিডিয়ার সাথে যুক্ত হয়ে কলমযুদ্ধে ইসলামের পক্ষে ভূমিকা রাখতে পারেন। সম্ভব হলে নিজেই পত্র-পত্রিকা বের করতে পারেন। সাহিত্যাঙ্গনকে আগাছা-পরগাছামুক্ত করা আজ সময়ের বড় দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বাঘ শিকার করতে গিয়ে নিজেই বাঘের শিকারে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে ওই ময়দানে পা না বাড়ানোই উত্তম হবে। বর্তমানে আমাদের কিছু ভাইদের অবস্থা এমনটিই পরিলক্ষিত হচ্ছে। সাহিত্যাঙ্গনকে নাস্তিক-মুরতাদমুক্ত করতে গিয়ে নিজেরাই তাদের ইমাম বনে যাচ্ছে। ফলে তাদের দ্বারা দ্বীনের উপকারের বদলে বদনাম ও ক্ষতিটা হচ্ছে অনেক বেশি। তারা আল্লাহকে খুশি করতে গিয়ে শয়তানকেই খুশি করছে প্রতিনিয়ত। এ স্তরে উত্তীর্ণদের থেকে যারা সাবলীল ভাষায় দ্বীনি আলোচনা বা ওয়াজ-নসিহত করতে সক্ষম, তারা ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে মানুষের কাছে দ্বীন পৌঁছে দেয়ার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে ভূমিকা রাখতে পারেন। মসজিদে ইমামÑখতিবের দায়িত্ব নিয়ে ইসলামের সঠিক মেসেজ মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারেন। ধর্মীয় মাহফিলে আলোচনা করে পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিতে পারেন হিদায়াতের আলো। পাশাপাশি ভূমিকা রাখতে পারেন রাজপথে ইসলামি আন্দোলন সংগ্রামেও। সেক্ষেত্রে তাদের প্রধানতম কাজ হবে এ আন্দোলন জনসাধারণের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া এবং তাদেরকে এর সাথে যুক্ত করা। অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেন শিরক-বিদাআতসহ যাবতীয় অন্যায়ের মূলোৎপাটনের ক্ষেত্রেও। এই স্তর বা এর পরের স্তরে উত্তীর্ণদের থেকে যারা হাফেজে কুরআন হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, তারা তাহফিজুল কুরআন মাদরাসায় আর হাফেজ না হলে নুরানি বা নাদিয়া থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মক্তব বা নাজেরা বিভাগে সরাসরি কুরআনি খিদমতের মহান দায়িত্বে নিজেদের যুক্ত রাখতে পারেন। সামর্থ্য থাকলে নিজেই কুরআনি মক্তব প্রতিষ্ঠা করবেন। মুসলিম সন্তানদের মুখে জীবনের সূচনাতেই কুরআনের বাণী তুলে দেয়ার নবীওলা দায়িত্বকে কোনো ক্রমেই হালকা বা অবহেলার নজরে দেখা যাবে না। আমি আল্লাহর নামের শপথ করে বলতে পারি- এই কাজের গুরুত্ব ও ফজিলত উল্লিখিত সকল কাজের থেকে বেশি। এলাকার কোনো ছেলে-মেয়েই যেন কুরআনের শিক্ষা থেকে মাহরূম না হয় সে ব্যবস্থা সমাজের মানুষদের সঙ্গে নিয়ে ওলামায়ে কেরামকেই করতে হবে। এ স্তরের যারা লেখালেখি বা ওয়াজ-নসিহতে পারদর্শী তারা সেকাজেও যুক্ত হতে পারেন। যুক্ত হতে পারেন দ্বীন কায়েমে ইসলামি আন্দোলন-সংগ্রামেও। পরিশেষে বলবোÑ আমরা যে যেখানেই থাকি, যে অবস্থাতেই থাকি, আমাদের মূল কাজ কিন্তু দ্বীন পালন করা এবং অন্যকে দ্বীন পালনে সাহায্য করা। আর দ্বীনের প্রচার-প্রসার ও দ্বীন কায়েমের জন্য দ্বীনের মিশনগুলোর সাথে নিজেকে জড়িয়ে রাখা। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সর্বপ্রকার কুরবানি পেশ করতে নিজেকে প্রস্তুুত রাখা। আল্লাহর কাছে সে তাওফিকটুকুর ভিক্ষা চাই সব সময়। আল্লাহ আমাদের দ্বীনি কাজে যুক্ত রাখার-থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
বি. দ্র. লেখাটির ব্যাপারে কারও কোনো বক্তব্য বা পরামর্শ থাকলে লিখে বা ফোনে জানানোর অনুরোধ রইল।
লেখক : মুহাদ্দিস ও শিক্ষাসচিব জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া, ঢাকা
পেটে লাথি নয়,
মুখে খাবার দিতে হবে শ্রমিকদের
হাসনাইন হাফিজ
মে'১৪
শ্রম উন্নয়নের চাবিকাঠি। সমৃদ্ধ জীবনের পথ। পরিশ্রমী ব্যক্তি কখনোই ব্যর্থ হয় না। সফলতা তার পদচুম্বন করে। উৎপাদনের একটি মৌলিক উপাদান শ্রম। শ্রমের যথার্থ মূল্য দেয়া চাই। চাই শ্রমিক-মালিকের একটা নিবিড় সম্পর্ক। যে সম্পর্ক আন্তরিকতার। বিশ্বাস ও ভালোবাসার। শ্রমিকের প্রতি থাকা চাই অপরিসীম আস্থা, সহনশীলতা ও ক্ষমা প্রদর্শনের মানসিকতা। হোক না সেটি বাড়ির ছোট্ট একটি কাজের মেয়ে কিংবা কল-কারখানার শ্রমিক সম্প্রদায়। আজ মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক মারমুখি। অবিশ্বাস, অনাস্থা ও বিদ্বেষপূর্ণ। মধুর সম্পর্ক বিষাদে পরিণত। এর সিংহভাগই ঘটছে মালিকের পক্ষ থেকে। শ্রমিককে যথাযথ পারিশ্রমিক না দেয়া। পারিশ্রমিক দিতে বিলম্ব করা। বেশি খাটিয়ে কম পারিশ্রমিক। কাজের সুষ্ঠু পরিবেশের অভাব। জীবনের ঝুঁকি। কিংবা সার্বক্ষণিক চাপ প্রয়োগ ও অসন্তুষ্টি-মনোভাব প্রদর্শন করা। এ পরিস্থিতি বাড়ির কাজের বোয়া থেকে শুরু করে জাতীয়ভাবে সবক্ষেত্রেই লক্ষণীয়। বাসাবাড়িতে নির্যাতিত হচ্ছে আদুরীরা। কখনো অন্যায় আচরণ। দুর্ব্যবহার। একটু বয়স্ক মেয়েদের ক্ষেত্রে সাহেবের লোলুপ দৃষ্টি। যৌন নির্যাতন। ধর্ষণ ইত্যাদি। অতঃপর বেগমের সন্দেহ। মানসিক চাপ প্রয়োগ। শারীরিক নির্যাতন। হত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে। এসব ঘটনা আজকের সময়ে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। খুব স্বাভাবিক ও অবাধে চলছে এসব নির্বিচার নির্যাতনের মাত্রা। এমনি নির্যাতিত কয়েকজন শ্রমিকের সহজ স্বীকারোক্তিÑ হোসনা আক্তার। বয়স তের। ময়মনসিংহের সার্কিট হাউস সংলগ্ন একটি বাসায় কাজ করে। শোনা যাক তার মুখ থেকেইÑ ‘জন্মের আগেই বাবারে হারাই। জন্মের পর মারে। মামার বাড়িতে বড়ো অই। কিছুদিন ইস্কুলেও গেছিলাম। মামারা গরিব। তাই কইছইন, বাসায় কামে দ্যায়া দিবাইন। আমি রাজি অইয়া গেলাম। এইডা ছারা যে আমার আর কিছুই করার নাই। মামা শহরে পরিচিত একটা বাসায় কামের লাইগ্যা দিয়া আয়ে। মালিক ব্যপসা করে। অনেক বয়স তার। পরাই পঞ্চাশ। বাসায় আওয়ার পর থাইক্যাই তার যেন মাতা খারাপ। সে তার বউয়ের আড়ালে আমার লগে কথা কয়। আমার শরীলে হাত দিতে চায়। আরও অনেক কিছুর লাইগ্যা জোরাজুরি করত। আর কইত, আমার লগে খাতির রাহো বেতন বারায়া দেম। মাসে পনরশ টেহার জাগায় তিন হাজার টেহা দেম। তার কতা আমার বালা লাকত না। আমারে ছুইতে চাইলে চিৎকার দিতাম। এই জন্য তার বউয়ের লগে জগরা অইত। যার ফলে একদিন আমারে মাইরা কিছু টেহা পইশা না দিয়াই বাড়িতে পাডাইয়া দেয়।’ কথা হয় একজন মটর মিস্ত্রির সঙ্গে। নাম নজরুল। বয়স আঠার। তেজগাঁও ট্রাক স্টেশনে মিস্ত্রির কাজ করে সে। সে বলে, ‘এক সময় আমার ইনকাম ছিল খুবই কম। বলতে গেলে থাকা-খাওয়া। মালিক বলত, কাজ শিখলে বেতন হবে। পরে আস্তে আস্তে বাড়বে। এভাবেই চলে গেল পাঁচটি বছর। কাজেও দক্ষতা আসে। এবার বেতন হলো। পাঁচ হাজার টাকা। থাকা-খাওয়া নিজ দায়িত্বে। স্টেশনের গ্যারেজেই থাকি। ভাবলাম, খাবার ও অন্যান্য বাবদ তিন হাজার চলে গেলে বাকি টাকা জমাতে পারব। কিন্তু মালিক বলে, তুমি কোথায় জমাবি? এরচেয়ে এখানে থাকুক, মাসে দুই হাজার করে দুই বছর পর ৪৮ হাজার হবে। আমি তোমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে দেব। বিয়েটাও সেরে ফেলতে পারবি। কিন্তু হিতে বিপরীত হলো। দুই বছর পরে যখন টাকা চাইতে গেলাম মালিক বলে, ‘তুই আবার আমার কাছে কিসের টাকা পাস? টাকা পাইলে কি এতোদিন রেখে দেয়ার মানুষ তুই। তুই আমার কাছে যে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছিস অন্য জায়গায় গিয়ে দেখ্ পাশ কিনা? এতোদিন আমার গ্যারেজে ফ্রি থেকেছিস। আমার বিদ্যুৎ পুড়েছিস। গ্যাস ক্ষয়েছিস। পানি ব্যবহার করেছিস। মাঝে মধ্যে খাবার-দাবারও। অন্যান্য সব দ্রব্য-সামগ্রি অবাধে ব্যবহার করেছিস। এসবের মূল্য কোথায়?’ আরেকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয় বাসে। নাম সৈকত। নারায়ণগঞ্জের নিটওয়্যার ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। সে অনর্গল ওই ফ্যাক্টরির কথা বলছিল- ‘আমি কাজ করছি সাত বছর যাবৎ। অভাবের সংসার। ঘরে অসুস্থ বাবা-মা। প্রথম দু’বছর বাড়িতে এক টাকাও পাঠাতে পারিনি। যে টাকা পেতাম আমার খরচ বাবদ লেগে যেতো। মাঝে ২০০৫ সালে দুর্ঘটনার শিকার হয় ফ্যাক্টরিটি। সেদিন আমি প্রাণে বেঁচে যাই। শুরু হয় ট্রাজেডির জীবন। এরপর থেকে অনেকদিন পর্যন্ত বেতন তো বাড়েইনি, বরং ন্যায্য টাকা পেতেও সময় লেগে যেতো। মালিকপক্ষের এসব ভাওতাবাজির ফলে আন্দোলন গড়ে ওঠে। ওসব আন্দোলন-ফান্দোলনে যেতে মন চায় না। টাকা না পেলেও না। ভয় লাগে। কিন্তু বড় ভাইয়েরা যেতে বাধ্য করে। এমনি একটি আন্দোলনে পুলিশের একটা গুলি এসে লাগে আমার হাতে। মারাত্মক আহত হই। হাসপাতালে ভর্তি করে। অবশেষে ওই হাতটি কেটে ফেলতে হয়। আজ আমি পঙ্গু। এক হাত সুস্থ দেখা গেলেও তাতে কোনো শক্তি পাই না। গুরুতর শারীরিক ক্ষত না থাকায় ভিক্ষাও পাই না। কাজও পাই না। অনাহারে, অর্ধাহারে কাটছে আমার দিনগুলো। বড় কোনো অনুদানও পাইনি যে, কিছু একটা করে খাব। এখন কি যে করব বুঝতে পারছি না। কেউ শোনে না আমার কান্নার আওয়াজ।’ শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োজিত শ্রমিক-কর্মচারীদের সংখ্যা পৃথিবীর কোনো দেশেই কম নয়। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও কল্যাণের বিষয়টি বারবার উপেক্ষিত থেকেছে। বর্তমান সময়েও আইনে অনেক কিছু থাকলেও তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। তৈরি পোশাক শিল্প-কারখানার নিয়ন্ত্রক বিজিএমইএ-ও ব্যর্থ, নির্লিপ্ত। দেশে স্পেকট্রাম, স্মার্ট, তাজরিন ফ্যাশন, রানা প্ল¬াজার মতো পিলে চমকানো ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। এসবে ক্রমশই শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ছে। বাড়ছে দাবি-দাওয়া। শ্রমিকদের কোনো সুযোগ-সুবিধা, শ্রমিক অসন্তোষ অথবা কেন ঘটছে অপ্রীতিকর এসব দুর্ঘটনা? তাই জানতে চাই, সুপ্রিমকোর্ট বার কাউন্সিলের অন্যতম আনইজীবী এডভোকেট আবু হানিফের কাছেÑ তিনি বলেন, শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা এমনিতেই কম। যাও খাতা-কলমে আছে, কার্যত নেই। ‘১৯৬৫ সালের কারখানা আইনের ৪৪(১) ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক কারখানার প্রতিটি বিভাগে নিযুক্ত প্রতি দেড়শ শ্রমিকের জন্য নির্দিষ্ট সরঞ্জামাদিসহ প্রাথমিক চিকিৎসার বাক্স মজুদ রাখতে হবে। ৪৬(১) ধারায় আছে, সাধারণভাবে যে কারখানায় ১০০ জনের অধিক শ্রমিক রয়েছে, সেখানে শ্রমিকদের ব্যবহার উপযোগী বিশ্রামাগার বা আশ্রয় কক্ষ থাকবে। তাতে খাবার পানির ব্যবস্থাসহ একটি খাবার ঘর থাকবে। যাতে শ্রমিকরা তাদের সঙ্গে আনীত খাবার ওই ঘরে বসে খেতে পারে। কর্মক্ষেত্রে বসে খেতে না হয়। ৪৭(১-৩) ধারায় বলা হয়েছে, কারখানা চলাকালীন আগত নারী শ্রমিকের ছয় বছরের কম বয়সী শিশুদের দেখভালের দায়িত্ব কর্তৃপক্ষ নেবে। তাদের জন্য আলাদা কক্ষ দেবে। যেখানে স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের ব্যবস্থাসহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও বায়ু প্রবেশের অনুকূল পরিবেশ থাকবে। দুর্বল অবকাঠামো, অপরিকল্পিত কারখানা স্থাপন, ভবনের ত্র“টিপূর্ণ নকশা, নির্মাণ কাজ ও নির্মাণ সামগ্রী অস্বাভাবিক দুর্বল, নরম মাটির ওপর ভবন তৈরি, অবৈধ স্থাপনা, বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করা, বিকল্প রাস্তা না থাকা ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত গার্মেন্টস শিল্প। অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা আর সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর নজরদারির অভাবে এসব গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি পরিণত হয়েছে এক একটা মৃত্যুকূপে। শ্রম আইনে ওভারটাইম কাজের জন্য দ্বিগুণ মজুরি দেয়ার কথা। একজন গার্মেন্টস মালিকও এই আইনসঙ্গত মজুরি প্রদান করেন না। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকরা অনেকটা দাসের মতো কাজ করে। ফলে ঘটে নানা দুর্ঘটনা। ঢাকার ৫০ ভাগ ফ্যাক্টরিতে কোনো নিরাপত্তা নেই। অগ্নিনির্বাপক কোনো মেশিন নেই। বরং বিল্ডিং কোড না মেনে তিনতলার স্থলে ছয়তলা করে কার্য-উদ্ধার করছে। কারখানার গেটে তালা লাগানো কিংবা শ্রমিকদের আসা-যাওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ ধরনের অপরাধের শাস্তিটা একদমই লঘু হয়ে যাওয়ায় মালিকরা হরহামেশায়ই এ অপরাধ করে যাচ্ছে। ২০০২ সালে উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় অসংখ্য গার্মেন্টস কারখানার বিরুদ্ধে মামলা ও বহুসংখ্যক গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানকে কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে চিঠি দেয়া হয়। এসব কিছুকে তোয়াক্কা না করে বছরের পর বছর সস্তা দরে মানুষের শ্রম কিনে সম্পদের পাহাড় গড়েছে মালিকপক্ষ। ২০০৬ সালের স্মার্ট গার্মেন্টসে অগ্নিদগ্ধদের পরিবারের কান্না থামতে না থামতেই শুনতে হলো তাজরিন ফ্যাশনের শতাধিক অগ্নিদগ্ধের মুত্যুর খবর। ২০০৫ সালের স্পেকট্রাম গার্মেন্টেসের ভবন ভেঙ্গে নিহত পরিবারের এবং আহতদের ক্ষত শুকোতে না শুকোতেই রানা প্লাজার শহস্্রাধিক লাশের গন্ধে আকাশ বাতাস ভারী হয়েছে। এসব কী? এসব কি শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা? এসব অপরাধীদের চিহ্নিত করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জোর দাবি জানাচ্ছে লক্ষ্যাধিক গার্মেন্টস-শ্রমিকসহ দেশের আম জনতা। পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের এই শপথ হোকÑ ‘শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা ও অধিকার আদায়ে মালিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ’। কেননা এই মে দিবসের একটি তাৎপর্য আছে, আছে একটি ইতিহাস। ১৮৮৬ সালের ১ মে শিকাগোর রাস্তায় সংঘটিত ঘটনা ও পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে এ দিবসের উৎপত্তি। আট ঘণ্টার শ্রম দিবস, মজুরি বৃদ্ধি, কাজের উন্নতর পরিবেশ ইত্যাদি দাবিতে শ্রমিক সংগঠন শিল্প ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। বর্বর পন্থায় সে ধর্মঘট দমন করা হয়। ৩ মে তাদেরই এক প্রতিবাদী সভায় পুলিশের গুলিতে ৬ জন মারা যায়। এর প্রতিবাদে আরেকটি সমাবেশের আয়োজন করলে ওখানেও মালিকপক্ষের বর্বরোচিত বোমা হামলায় আরও ৩ জনের প্রাণহানি ঘটে। এভাবে বহু দমন-পীড়ন ও হানাহানির পর ১৮৮৯ সালে ১৪ জুলাই অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল সোশালিষ্ট কংগ্রেসে ১ মে শ্রমিক দিবস হিসাবে ঘোষিত হয়। তখন থেকেই পৃথিবীর বহু দেশে তা পালন হয়ে আসছে। এদিনে সরকারি ছুটি কিংবা কর্ম-বিরতি পালনে শ্রমিকের মর্যাদা ফিরে আসবে না। তাদের লক্ষ্য অর্জিত হওয়াও সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন ইসলামি নীতি অনুশীলন করা। মহানবীর (সা.) মালিক-শ্রমিকনীতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা। সেকালে দাসপ্রথার করুণ চিত্র ছিল লোমহর্ষক ও হৃদয়বিদারক। পণ্যদ্রব্যের মতো শ্রমিকদের হাট-বাজারে বিক্রি করা হতো। মানবতার নবী এ অবস্থা থেকে তাদেরকে ফিরিয়ে আনেন। তাদের সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করেন। ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের শ্রমের ওপর জীবিকা নির্বাহ করে তার চেয়ে উত্তম আহার আর কেউ গ্রহণ করে না। মনে রেখো, আল্লাহর নবী হজরত দাউদ (আ.) স্বীয় শ্রমলব্ধ উপার্জনে জীবিকা নির্বাহ করতেন।’ (বুখারি) খোদ মহানবীও (সা.) শ্রমিকদের সঙ্গে অত্যন্ত স্নেহঘন সম্পর্ক বজায় রাখতেন। তিনি তাদের মানসিক অবস্থার খেয়াল রাখতেন। তাদের দুঃখে দুঃখি হতেন, সমব্যথী হতেন, তাদের সান্ত্বনা দিতেন। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে তাদের ত্র“টি মাফ করে দিতেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা অধীনস্থদের সঙ্গে সদ্বব্যবহার করবে এবং তাদেরকে কোনো রকমের কষ্ট দেবে না। তোমরা কি জান না? তাদেরও তোমাদের মতো একটি মন আছে। ব্যথাদানে তারা দুঃখিত হয় এবং কষ্টবোধ করে। আরাম ও শান্তি প্রদান করলে সন্তুষ্ট হয়। তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা তাদের প্রতি আন্তরিকতা প্রদর্শন কর না?’ হজরত আনাস (রা.) বলেন, মহানবীর (সা.) খেদমতে আমি দশ বছর সময় অতিবাহিত করেছি, কিন্তু তিনি কোনো দিন আমাকে ধমক তো দূরে থাক, ভর্ৎসনাও করেননি। কোনোদিন বলেননি, এটা এভাবে কেন করেছ, ওটা ওভাবে কেন করনি। আজকের শ্রমিকের অবস্থা প্রাচীনকালের দাসদের চেয়েও হীন হয়ে পড়েছে। যদিও শ্রম একটি পছন্দনীয় আমল। মহানবী (সা.) নিজে কায়িক শ্রম ব্যয় করতেন। হজরত ওমর, আবু হুরায়রা, ইবনে মসউদ, বেলাল ও ইকরামা (রা.)-এর মতো সাহাবিগণ কেবল শ্রম পছন্দই করতেন না, নিজেও পরিশ্রম করতেন। হজরত আলী (রা.) অত্যধিক পরিশ্রমী ছিলেন। শুধু তাই নয়, মহানবী তার প্রাণাধিক মেয়ে হজরত ফাতেমাকে (রা.) হজরত আবু বকরের মতো ব্যবসায়ী প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও হজরত আলীর (রা.) মতো একজন শ্রমজীবীর হাতেই তুলে দিয়েছিলেন। যাকে ইহুদির ক্ষেতে মজুরি খাটতেও দেখা গেছে। শ্রমের তাকিদ দিয়ে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘আল্ল¬াহ তায়ালা ক্রয়-বিক্রয় (ব্যবসা) বৈধ করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন।’ (সূরা বাকারা : ২৭৫) ‘শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও’Ñ মহানবীর (সা.) এমন ঐতিহাসিক বাণীর অনুশীলন হলে বর্তমানেও মালিক-শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেবে না। শুধু একটি দিন ছুটি বা কর্ম-বিরতি দেয়ারও প্রয়োজন হবে না। প্রতিদিনই শ্রমিক পাবে মালিকের অসম আন্তরিকতা। মালিক ঘরে তুলবে শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল। উভয়পক্ষের সন্তুষ্টিতে দেশে বিরাজ করবে শান্তি-সুখের অনাবিল পরিবেশ।
এপ্রিল ফুলের অন্তরালে রক্তাক্ত ইতিহাস মাওলানা আতাউর রহমান আলমপুরী
এপ্রিল'১৪
পূর্বকথা সময়টা অষ্টম শতাব্দী। ইউরোপের বুকে ইসলামি সভ্যতার স্বর্ণযুগ। আলোকিত যুগ। ইউরোপীয় সভ্যতা তখন কেবল হামাগুড়ি দিচ্ছে। আর ইসলামি সভ্যতা প্রোজ্জ্বল তারুণ্যে। ইসলামি সভ্যতা এবং তাহজিব তামাদ্দুনের আলোক রশ্মি সাহারা মরুভূমি ছাড়িয়ে পৌঁছে যাচ্ছে আটলান্টিকের সলিল রেখায়। স্পর্শ করছে মহাচীনের প্রাচীর। পৃথিবী ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা উত্তম সময়টা পার করছে। ৭১১ খ্রীষ্টাব্দের ৯ জুলাই আফ্রিকার পশ্চিমাঞ্চল বিজয় শেষে উমাইয়া শাসনের শেষ সেনাপতি তারেক বিন যিয়াদ মরক্কোর উপকূল থেকে চারটি জাহাজে সাত হাজার সেনাবাহিনী নিয়ে পৌঁছে গেলেন স্পেনের সীমানায়। আল্লাহর পয়গাম সমুদ্রের ওপারে পৌঁছানোই লক্ষ্য। ইউরোপের বুকে ইসলামি তাহজিব তামাদ্দুনের বিজয় কেতন উড্ডীন করে সালতানাতে ইসলামিয়াকে বিস্তৃত করাই উদ্দেশ্যে। ভূমধ্যসাগরে জিব্রালটার প্রণালী নামে যে স্থানটি রয়েছে এটিই স্পেনের উপকূলীয় সেই পর্বতমালা, যেখানে তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনীর জাহাজ নোঙ্গর করেছিল। যার আরবি নাম ‘জাবাল আত তারিক’। সাতসমুদ্র পাড়ি দিয়ে মুসলিম সেনাপতি তারেক বিন যিয়াদ রহ. যেদিন অপিরিচিত দুশমনের মাটিতে পা রাখলেন ইতিহাস সেদিন এক অবিস্বরণীয় দৃশ্য দেখার সুযোগ পেয়েছিল। যে দৃশ্য আজও মুসলিম মিল্লাতকে বিজয়ের নেশায় সম্মুখ পানে এগিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করে। এবং মুসলিম উম্মাহকে নিজেদের হারানো গৌঁরব ফিরে পাওয়ার প্রেরণা দেয়। জিহাদের মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে সমস্ত মুসলিম ফৌজ যখন দুশমনের মাটিতে গিয়ে অবতরণ করল- সেনাপতি তারেক বিন যিয়াদ তখন সৈন্যদের এক জায়গায় জমা করে মাঝি মাল্লাদের নির্দেশ দিলেন ‘চারটি জাহাজেই আগুন লাগিয়ে দাও’। এই নির্দেশ পেয়ে সমস্ত মাল্লারা পেরেশান ও হতভম্ব হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল। এবং মনে মনে ভাবতে লাগল- এ নির্দেশ তো কেবল সেই সিপাহসালার দিতে পারে যার মস্তিস্কে বিকৃতি ঘটেছে। তারেক বিন যিয়াদ পুনরায় ফৌজদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, জাহাজগুলোতে অগ্নি সংযোগ করে দাও। আদেশমত সমস্ত নৌযানে অগ্নি সংযোগ করে দেওয়ার পর ইবনে যিয়াদ তার সৈন্য বাহিনীকে লক্ষ্য করে ভাষণ দিলেন- ‘হে আমার সহযোদ্ধারা! আমরা ইউরোপের বুক থেকে ফিরে যাওয়ার জন্য আসিনি, হয় খ্রিষ্টান রাজা রডারিক ও আধুনিক অস্ত্রে-সস্ত্রে সজ্জিত এক লক্ষেরও অধিক সৈন্য বাহিনীর সাথে জিহাদ করে এই ভূখণ্ডে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করব, আর না হয় জিহাদ করতে করতে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করে আমাদের পূর্বসূরিদের সাথে গিয়ে মিলিত হব। বিকল্প কোনো পথ আমাদের সামনে খোলা নেই! হে বাহাদুর যুবক ভাইয়েরা! এখন পিছু হটবার ও পলায়ন করার আর কোনো সুযোগ অবশিষ্ট নেই। পিছনে অপেক্ষমান উত্তাল সমুদ্র, সামনে দুর্ধর্ষ শত্র“ সৈন্যদল। সুতরাং এখন তোমাদেরকে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা অবলম্বন করে আহকামুল হাকেমিনের রহমতের দিকে তাকিয়ে ইসলামের বিজয় নিশানা উড্ডীন করার লক্ষে দুশমনের সাথে মোকাবিলা করতে হবে। এবং ইসলামি তাহজিব তামাদ্দুনকে ইউরোপের বুকে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষে সম্মুখ পানে এগিয়ে যেতে হবে শাহাদাতের তামান্নায়। হে আল্লাহর রাহের সৈনিকরা! অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস রাখ, আমি তোমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছি সে পথে, যে পথের যাত্রী সর্বপ্রথম আমিই হব। লড়াইয়ের মাঝে দুশমনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম আমার তলোয়ারই কোষমুক্ত হবে। আমি যদি জিহাদের ময়দানে শহীদ হয়ে যাই, তাহলে তোমরা ধীশক্তিসম্পন্ন বুদ্ধিমান অন্য কোনো যোগ্য ব্যক্তিকে তোমাদের সিপাহসালার বানিয়ে নেবে। কিন্তু আল্লাহর রাহে জীবন উতসর্গে বিমুখ হবে না। তবেই বিজয় তোমাদের পদচুম্বন করবে’। তার দীর্ঘ ও ঈমানদীপ্ত ভাষণ শেষে শুরু হলো মুসলিম বাহিনীর সাথে দুর্ধর্ষ খ্রিষ্টান রাজা রডারিক বাহিনীর যুদ্ধ। এরপর মহান রাব্বুল আলামিনের মদদে যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে মুসলিম বাহিনী গ্রানাডা, টলেডো, কর্ডোভাসহ একে একে পুরো স্পেন ও ফ্রান্সের বিশাল এলাকায় ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করে। শুরু হল স্পেনের বুকে ইসলামি শাসনের সোনালী অধ্যায়। একের পর এক নতুন নতুন শাসক আসেন আর গড়ে তোলেন আধুনিক স্পেন। যার আরবি নাম ‘আল আন্দুলুস’। টলেডো, কর্ডোভা, গ্রানাডা অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়। দীর্ঘ ৮শ বছরের শাসনামলে মুসলিম স্পেন পরিণত হয় বিশ্ব সভ্যতার তীর্থ কেন্দ্রে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হয়ে ওঠে স্পেন। জিহাদের বলে বলীয়ান একদল জানবাজ মুজাহিদের ঈমানদীপ্ত দাস্তানের বদৌলতে বিশ্ববরেণ্য মুহাদ্দিস ও ফকিহ্ আল্লামা আবু আব্দুল্লাহ আন্দুলুসী, আল্লামা কুরতুবী আন্দুলুসী, জগত বিখ্যাত দার্শনিক আল্লামা ইবনে রুশদ ও আল্লামা ইবনে হাইয়ান রহ.সহ অসংখ্য মুসলিম মনীষী জন্ম নিলেন ইউরোপের বুকে। পৃথিবীর সমস্ত ইতিহাসবিদ ও সমর বিশেষজ্ঞগণ এ কথায় ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিম সেনাপতি তারেক বিন যিয়াদ রহ. পিছু হটার বা পালিয়ে যাওয়ার সকল উপকরণ ধ্বংস করার মাধ্যমে ঈমান ও তাওয়াক্কুলের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, ইতিহাস আজও তার নজির স্থাপন করতে পারে নাই। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস- নিশ্চিন্ত নিরাপদ সুখি সমৃদ্ধ জাতির পরিণাম শেষ পর্যন্ত যা হয় মুসলিম স্পেনের পরের ইতিহাস তেমনই। কেবল ভোগ বিলাসিতা, হানাহানি-মারামারি আর অচেতন ক্ষমতাভোগের কারণে মুসলমানদের মাঝে আসে অনৈক্য ও চির দুশমন ইহুদি, খ্রিষ্টানদের ভয়াবহ গ্রাস। বিজয়ের পর আট শতাব্দী পর্যন্ত যে দেশকে মুসলমানরা শাসন ও সমৃদ্ধ করেছে, ষড়যন্ত্র ও প্রতারণার শিকার হয়ে সে ভূখণ্ড থেকে মুসলমানদের এতই অসহায় ও হৃদয়বিদারকভাবে বিদায় নিতে হয়েছিল যার উপমা ইতিহাসের কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। মানব ইতিহাসে এর চেয়ে ভয়াবহ নির্মম- নিষ্ঠুর নিয়তি আর হতে পারে না। এপ্রিলফুল কী? ফুল এটি ইংরেজি শব্দ যার অর্থ বোকা। এপ্রিলফুল অর্থ এপ্রিলের বোকা। এপ্রিল মাসের পয়লা তারিখে একজন অপরজনকে বোকা বানানোর উতসবে মেতে ওঠে। একে অপরকে বোকা বানানোর চেষ্টা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, ঘরের ডাইনিং রুম, রাস্তাঘাট ও বন্ধুদের আড্ডাতে বোকা বানানোর রকমারী খেলার আয়োজন করা হয়। আধুনিক যুগের তরুণ-তরুণী ও যুবক-যুবতি কিংবা পাশ্চাত্যের কুরুচিশীল অভিভাবকহীন ছাত্র-ছাত্রীরা এসব জায়গায় একজন অপরজনকে বোকা বানিয়ে অশ্লীল আনন্দ উল্লাস করে। যা বর্তমান ইউরোপ আমেরিকাসহ সমগ্র অমুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে প্রচলিত। এই কুরুচিপূর্ণ কাজটিকে তারা নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য মনে করে খুব আনন্দ সহকারে এ দিনটি উদযাপন করে। যার উতপত্তি হয়েছিল পঞ্চাদশ শতাব্দির শেষের দিকে খ্রিষ্টানদের প্রতারক ও গাদ্দার পূর্বসূরিদের প্রতারণা ও গাদ্দারির মাধ্যমে। এপ্রিল ফুলের উতপত্তি দুই খ্রিষ্টান মহাশক্তির মধ্যে পূর্ণতর ঐক্য রচিত হয় রাজা ফার্ডিন্যান্ডের সাথে রাণী ইসাবেলার বিয়ের মাধ্যমে। ইসাবেলা রাণী হয়েই মুসলমানদের স্থায়ীভাবে ততকালীন বিশ্ব সভ্যতা-সংস্কৃতি ও ইসলামি তাহজিব তামাদ্দুনের কেন্দ্রস্থল পৃথিবীর ভূস্বর্গ হিসেবে পরিচিত স্পেনের মাটি থেকে চিরতরে বিতাড়িত করার ব্যবস্থা করেন এবং বেছে নেন প্রতারণার এক অভিনব হৃদয়বিদারক পন্থা। জগত বিখ্যাত মুসলিম সেনাপতি তারেক বিন যিয়াদ দুর্ধর্ষ রডারিক বাহিনীর সাথে জীবন বাজি রেখে ইউরোপের যে ভূখণ্ডে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করেছিলেন, যে জমিনের পরতে পরতে গড়ে উঠেছিল শত শত মসজিদ মাদরাসা, যে ভুখণ্ডের প্রতি ইঞ্চি মাটি থেকে উচ্চারিত হত আজানের সুমধুর সুর। দীর্ঘ ৮০০ বছর শাসন ও বসবাসের পর ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয়ে গাদ্দার ও প্রতারক খ্রিষ্টানদের প্রতারণায় পড়ে ক্রুসেডের কাছে হার মেনে নিয়ে নিজেদের সোনালী অতীতকে পিছনে ফেলে সেই স্পেন থেকে মুসলমানদের করুণ ভাবে বিতাড়িত হতে হয়। রচিত হয় এক নতুন ইতিহাস। এক সময় যার কল্পনা করাও ছিল দুষ্কর! যেভাবে উতপত্তি স্পেনে মুসলমানদের সর্বশেষ শাসক ছিল আবুল হাসান। খ্রীষ্টানরা অনেক চেষ্টা করেও যখন আবুল হাসানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেনি তখন সাম্রাজ্যবাদী খ্রীষ্টান অপশক্তি নিজেদের ঐতিহ্য মোতাবেক আবুল হাসানকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষে এক গভীর ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিল। তারা আবুল হাসানের ছেলে আবু আবদুল্লাহকে প্রস্তাব দিল তুমি যদি তোমার পিতাকে বিদ্রোহের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করতে পার তাহলে আমরা তোমাকে স্পেনের শাসক বানিয়ে দেব। লোভের বশীভূত হয়ে আবু আব্দুল্লাহ আপন পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসল, আর এদিকে আবুল হাসান ক্ষমতায় থাকার কোনো পথ না দেখে সর্বশেষ ১৪৯২ সালের ৩রা জানুয়ারি স্বদল বলে স্পেন ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। পরিশেষে খ্রীষ্টানরা আবু আব্দুল্লাহকে নাম মাত্র ক্ষমতাসীন করে স্পেনের পার্লামেন্ট ভবন আল হামরা প্রাসাদের চাবি নিজেদের হাতে নিয়ে নিল। বর্তমান দুনিয়াতে আমেরিকার কাছে হোয়াইট হাউজের যে মর্যাদা তখন স্পেনের কাছে আল হামরা প্রাসাদের ছিল সেই মর্যাদা। আল হামরা প্রাসাদের চাবি নিজেদের হাতে নিয়ে আবু আব্দুল্লাহকে খ্রীষ্টানরা প্রস্তাব দিল তোমরা এখন অল্প সংখ্যক মুসলমান স্পেনে অবশিষ্ট আছ সুতরাং যদি জীবন বাঁচাতে চাও তাহলে সবাই জাহাজে ওঠ তোমাদেরকে নিরাপদে মুসলিম দেশ মরোক্কোয় পৌঁছে দেব। স্পেন এখন আমাদের। এখানে কোনো মুসলমানের থাকার অধিকার নেই। যে আবু আব্দুল্লাহকে ক্ষমতায় বসানোর লোভ দেখিয়ে পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়েছিল উদ্দেশ্যে হাসিলের পর তাকে ছেঁড়া জুতার ন্যায় ছুড়ে ফেলে দিতে কুন্ঠাবোধ করেনি এই প্রতারক খ্রীষ্টানরা। অতঃপর প্রতারক খ্রীষ্টানরা স্পেনের মুসলমানদের নিরস্ত্র করে জাহাজে তুলে হুকুম করল তোমরা সুমদ্র পার হয়ে যাও। মুসলমানরা নিজেদের আটশত বতসরের ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে পিছনে রেখে নিরাপদে জীবন বাঁচানোর লক্ষে মরক্কোর উদ্দেশ্যে খ্রীষ্টান নাবিকদের জাহাজে করে যখন ভূমধ্যসাগরের মধ্যখানে পৌঁছল তখন গাদ্দার ও প্রতারক খ্রীষ্টানরা জাহাজগুলোকে ফুটো করে সমস্ত মুসলমানদেরকে সাগরে ডুবিয়ে দেয়। আর বাদ বাকি যে মুসলমানগণ স্পেনে রয়ে যায় তাদেরকে কর্ডোভার শাহী জামে মসজিদে সমবেত হলে প্রাণ ভিক্ষা দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। নিরস্ত্র নিরাপরাধ মুসলমানরা খ্রীষ্টানদের এই প্রতিশ্র“তিকে বিশ্বাস করে হাজার হাজার নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও নিরিহ মুসলিম নাগরিকরা যখন বাঁচার আশায় মসজিদে প্রবেশ করল তখন কাপুরুষ খ্রীষ্টান রাজা ফার্ডিন্যান্ড ও প্রতারক রাণি ইসাবেলা মসজিদের চতুর্পাশ্বে আগুন লাগিয়ে মুসলমানদেরকে শহীদ করে দিয়ে অশ্লীল আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠল এবং বলতে লাগল, হায় মুসলিম! তোমরা এতই বোকা! হায় মুসলিম তোমরা এতই বোকা! এভাবেই খ্রিষ্টানরা আটশত বছরের মুসলিম স্পেনকে ইতিহাসের পাতা থেকে নিশ্চিহ্ন করার হীন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। আর তখন থেকেই স্পেনের বুকে বন্ধ হয়ে যায় আজানের ধ্বনি, বন্ধ হয়ে যায় হাজার হাজার মসজিদ মাদরাসা ও ধর্মীয় শিক্ষালয়। পৃথিবী তখন থেকেই অদ্যবধি তার বুকে ধারন করে রাখল খ্রিষ্টানদের পৈশাচিক নির্মম ও জঘন্যতম এই ইতিহাস। হৃদয় বিদারক এই ঘটনাটি ঘটেছিল ১৪৯২ সালের ১লা এপ্রিল। তাই বর্তমান পুরো খ্রিষ্ট দুনিয়া মুসলমানদের সাথে তাদের পূর্বসূরিদের প্রতারণার এই ঘটানাটিকে স্বরণীয় করে রাখার জন্য ১লা এপ্রিল অশ্লীল আনন্দ উল্লাসের মাধ্যমে এপ্রিল ফুল পালন করে। এমনকি এই দিনটিকে তারা নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি মনে করে খুব আনন্দ সহকারে উদযাপন করে। প্রিয় পাঠক! ১লা এপ্রিল মুসলমানদের জন্য খেল-তামাশার দিন নয়, বরং কাঁদার দিন। শোক পালন করার দিন। শিক্ষা গ্রহণ করার দিন। খ্রিষ্টান হায়েনাদের থেকে আপন ভাইদের প্রতিশোধ নেয়ার প্রতিজ্ঞা করার দিন। যে দিনটিতে আমাদের নিরপরাধ, নিরস্ত্র, নিরীহ, অসহায় মুসলিম ভাইদেরকে আগুনে পুড়িয়ে এবং সাগরে ডুবিয়ে নির্মমভাবে শহীদ করা হয়েছিল, সে দিনটি কি আমাদের জন্য খুশির দিন হতে পারে? সেদিন খুশি হওয়া এবং খেল-তামাশা করা মানে আপন ভাইয়ের সেই করুণ পরিণতির প্রতি বিদ্রুপ করা। নিজেকে খ্রিষ্টান সমাজের দোসর হিসেবে আখ্যা দেয়া এবং নিজেকে বোকা বলা। কিন্তু এরপরও আজ মুসলমান সমাজ এপ্রিলফুলের দুর্গন্ধে সয়লাব। হায় আত্মমর্যাদাহীন মুসলমান! তোমার পূর্বসূরিদের সাথে যে দিনটিতে ইতিহাসের জঘন্যতম, মর্মান্তিক, নির্মম, বর্বরোচিত অমানবিক আচরণ করা হয়েছিল, সে দিনটিতে তুমি প্রতারক ও গাদ্দার ধোঁকাবাজ খ্রিষ্টানদের সাথে তাল মিলিয়ে এপ্রিল ফুলের আয়োজনে মহাব্যস্ত! হায় মুসলমান! তোমার আত্মমর্যাদা কখনো কি জাগ্রত হবে না? কখনো কি তুমি ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে না? তোমার ইতিহাস তো মহাকালের মহানায়ক গাজী সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ূবির ইতিহাস। যিনি ইসলামের অন্তিম এক মুহূর্তে শপথ নিয়ে ছিলেন- পবিত্র আরব ভূমি থেকে ইহুদি খ্রিষ্টানদের বিতাড়িত করে মক্কা মদিনার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মজবুত করার। মুসলমানদের প্রথম কেবলা বাইতুল মুকাদ্দাসকে খ্রিষ্টানদের গীর্জা থেকে মসজিদে আকসায় ফিরিয়ে আনার। যিনি শপথ নিয়েছিলেন ইসলামের অগ্রযাত্রাকে ইউরোপের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেয়ার। কিন্তু! আজ তারেক বিন যিয়াদ, মোহাম্মাদ বিন কাসিম ও গাজী সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবির উত্তরসূরিরা নিজকে বোকা আখ্যা দিয়ে এপ্রিল ফুল পালনে মহাব্যস্ত! হায় আফসোস! হায় ইতিহাস! ৫৮৩ হিজরীর ২৭ রজব মোতাবেক ১১৮৭ সালের ২ অক্টোবর শুক্রবার গাজী সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ূবি মুসলমানদের প্রথম কেবলা বাইতুল মোকাদ্দাসকে খ্রিষ্টানদের গীর্জা থেকে মসজিদে আকসায় রূপান্তরিত করেছিলেন দীর্ঘ সাড়ে আটশত বছর পর। সে বাইতুল মোকাদ্দাস আজ মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ। আজ মসজিদে আকসায় ধ্বনিত হয় না আজানের সুমধুর সুর। আজ মুসলমানদের প্রথম কেবলায় শোনা যায় না আল্লাহু আকবারের তাকবির ধ্বনী। মহানবী সা. এর মিরাজের স্থান থেকে আজ উচ্চারিত হয় না কোরআন তেলাওয়াতের সুর। কিন্তু আজ মুসলমান সমাজে পালিত হয় এপ্রিল ফুল। হায়! হায় মুসলমান! ৭১১ খ্রীষ্টাব্দে মুসলিম সেনাপতি তারেক বিন যিয়াদ ইউরোপের বুকে ইসলামের বিজয় কেতন উড্ডীন করার লক্ষে ততকালীন মহা ক্ষমতাধর রাজা রডারিকের এক লক্ষেরও অধিক সৈন্য বাহিনীর সাথে জিহাদ করে যে স্পেনকে বিশ্ব সভ্যতার পাঠ শিখিয়েছেন, সে স্পেন আজ ক্রুশের পদতলে পৃষ্ঠ হয়ে অপদস্ত হচ্ছে! অথচ মুসলিম সমাজ দিনের পর দিন এপ্রিলফুল পালনে বিভোর। হায় মুসলমান! আজ মুসলিম উম্মাহকে নিজেদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে হবে। মুসলমানদের আজ তাদের ইতিহাস জানতে হবে। আজ মসজিদে আকসাকে আবার পুনরুদ্ধার করতে হবে এবং মুসলমানদেরকে আবার কর্ডোভার শাহী জামে মসজিদে সমবেত হয়ে আল্লাহু আকবারের তাকবির ধ্বনিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তুলতে হবে। স্পেনের সেই হারানো ইতিহাস আজ মুসলমানদেরকে আবার ডাকছে। তাই মহাকালের মহানায়ক গাজী সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবি ও মুসলিম সেনাপতি তারেক বিন যিয়াদের মতো দুর্জয় নির্ভীক হয়ে সম্মুখপানে এগিয়ে যেতে হবে। অতএব ১লা এপ্রিল মুসলমানদের জন্য আনন্দ উতসবের দিন নয়, ইতিহাস স্মরণ করার দিন, খেল-তামাশার দিন নয়, আত্ম উতসর্গের দিন। পরস্পর প্রতিজ্ঞা করার দিন। খ্রীষ্টানদের প্রতারণার জাল ছিন্ন করে ইহুদিদের থেকে আমাদের প্রথম কেবলা মসজিদে আকসাকে পুনরুদ্ধার করার দিন। ইউরোপের বুকে আবার ইসলামের বিজয়কেতন উড্ডীন করার দিন। সেই প্রত্যাশায়...।
০০০০০০০০০০০
স্বাধীনতার মাস : হৃদয় ভরা স্বপ্ন এক মুঠো মানুষের বিনিময়ে এক আকাশ নিরাপত্তার অঙ্গীকার
শিব্বীর আহমদ
মার্চ'১৪ প্রস্তাবটি সহজ নয়। যথেষ্ট কঠিন এবং কেউ কেউ বলতে পারেন অসম্ভব ব্যাপার। তবু আমি সাহস করে এই স্বপ্নটি লালন করতে চাই। সাহসের উতসটি আগে বলে নিই- বছর তিনেক আগে দৈনিক কালেরকণ্ঠে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। রিপোর্টের ভাষ্য এমন দীর্ঘ প্রায় চার দশক প্রতীক্ষার পর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। অন্ধকার আকাশের বুক চিরে বজ্রপাতের সুতীব্র নীল আলো আছড়ে পড়ল হাতের উদ্যত মশালের ওপর। দূর থেকে মনে হচ্ছিল যেন নির্ভীক কোনো যুবার একরোখা হাতের তর্জনী থেকে সৃষ্টি হয়েছে বিদ্যুতের বাধাহীন প্রভা। ক্যামেরায় এ দৃশ্য ধারণ করতে এতটুকু দেরি করেননি জে ফাইন। এই মুহূর্তটির জন্যই তো তিনি অপেক্ষা করেছেন বছরের পর বছর। নিউইয়র্কের ফটোগ্রাফার জে ফাইনের মাথায় অল্প বয়সেই অদ্ভূত এক ছবি তোলার নেশা পেয়ে বসে। ১৮ বছর বয়সের সময় থেকে ঝড়ঝঞ্ঝা শুরু হলে তিনি ক্যামেরা নিয়ে ছুটে যেতেন হাডসন নদীর তীরে। এরপর সব বিপদ উপেক্ষা করে একটানা ছবি তুলতেন স্ট্যাচু অফ লিবার্টির। আকাশে বজ্রপাতের তীব্র আলো ঠিক যখন এ ভাস্কর্যের হাতের মশালের সমান্তরালে ঠিকরে পড়বে ঠিক সেই বিরল মুহূর্তের ছবি তোলার নেশা পেয়ে বসেছিল জে ফাইনকে। আর তাই খারাপ আবহাওয়ার খবর পেলে যেখানেই থাকুন না কেন, ক্যামেরা হাতে ঠিক পৌঁছে যেতেন হাডসনের তীরে। জে ফাইনের বয়স এখন ৫৮। গত প্রায় ৪০ বছরে ভাগ্য প্রসন্ন হয়নি তাঁর প্রতি। তবে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙেনি। আর তাই শেষ পর্যন্ত বহু কাক্সিক্ষত মুহূর্তটি ধরা দিল তাঁর ক্যামেরায়। গত ২২ সেপ্টেম্বর রাতের আবহাওয়া তেমন সুবিধার হবে না শুনেই তিনি ছুটে যান নদীর তীরে। সুবিধা মতো জায়গা বেছে নিয়ে সন্ধ্যা থেকে পোতাশ্রয়ের সেই বিখ্যাত স্ট্যাচুর ছবি তুলতে থাকেন একের পর এর। আকাশে চমকাচ্ছিল বিদ্যুত, কিন্তু কোনোটাই ঠিক জুতসই হচ্ছে না। অবশেষে রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে হঠাত তীব্র আলোর ঝলকানি যেন ছুঁয়ে গেল স্ট্যাচু অফ লিবার্টির হাতের মশাল। সেই দুর্লভ ছবি তুলে সাফল্যের হাসি হাসলেন জে ফাইন। এর আগের দুই ঘণ্টায় সব মিলিয়ে ৮১টি নিস্ফল ছবি তুলতে হয়েছে তাঁকে। সূত্র : ডেইলি মেইল অনলাইন। ঘটনাটি পড়ে আমার কাছে পবিত্র কুরআনের এই আয়াতটি নতুনভাবে উদ্ভাসিত হয়- ‘মানুষ যা চেষ্টা করে সে তা পাবেই’। এই হচ্ছে আমার ‘দুঃসাহসে’র উতস। এখন ২০১৪ সালের মার্চ। আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের ৪৩ বছর পূর্ণ হচ্ছে। সময়ের হিসেবে এই তেতাল্লিশ বছর তো কম সময় নয়। সাড়ে তিন যুগেরও বেশি। এই দীর্ঘ সময়ে আমাদের অর্জনও একেবারে কম নয়। একাত্তরে দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম হয়েছিল আমাদের এই বাংলাদেশের। এরপর থেকে অনেক কিছুই আমাদের অর্জনের ঝুলিতে যোগ হয়েছে যা জাতি হিসেবে আমাদেরকে পৃথিবীর বুকে সম্মানিত করেছে। এই সেদিনও সৌদি আরবের আন্তর্জাতিক হিফযুল কুরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করেছে আমাদের এই বাংলাদেশেরই এক কৃতি ছাত্র। এবং এটা এবারই প্রথম নয়। এ পর্যন্ত বহু বার বহু দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক হিফযুল কুরআন ও তাফসিরুল কুরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশি ছাত্ররা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। জাতি হিসেবে এ কৃতিত্ব খাট করে দেখার অবকাশ নেই। শিক্ষাঙ্গন খেলার মাঠ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রেই নানা ইস্যুতে বাংলাদেশ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা টিমের জন্যে তো আবারও সেনা চেয়ে রেখেছেন জাতিসংঘ-মহাসচিব বান কি মুন। সে টিমে বাংলাদেশের সেনারা খুবই চৌকস দৃষ্টি ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশি তরুণরা নানা সময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়াজাগানিয়া ভূমিকা পালন করছে। এই যদি হয় বাংলাদেশ, তাহলে এই দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে বাধা কোথায়? অর্জনের ফাঁকে ফাঁকে অবশ্য কিছু কিছু ব্যর্থতাও রয়েছে। ব্যর্থতাগুলো কখনো কখনো খুব বড় আকারে প্রকাশ পায়। সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার দিক আমাদের দুর্নীতি। এই দুর্নীতি আমাদের সব অর্জনকে মাঝে মাঝে একসঙ্গে গিলে ফেলতে চায়। দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তৃতির কারণেই এই দেশে ‘কিছু মানুষ আর নিরাপত্তা’র কামনাটি অবাস্তব মনে হতে পারে। রাষ্ট্রের যারা আইনপ্রণেতা-সংসদ সদস্য, যারা দেশের শাসক ও পরিচালক, যারা প্রশাসনযন্ত্রের অধিকারী, বরাবরই তাদের দুর্নীতির বিষয়টি আলোচিত হয়। যেকোনো সেক্টরের শিক্ষিত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা বরাবরই এ নিয়ে আলোচনায় থাকেন। প্রতিদিনের দৈনিক পত্রিকাগুলোর বেশির ভাগ সংবাদই যেন এখন পরিবেশিত হয় এই দুর্নীতিকে কেন্দ্র করে। উদাহরণস্বরূপ আজ ১৬.০২.২০১৪ তারিখের দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকাটির কথা বলি। প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠার কয়েকটি সংবাদ শিরোনাম এরকম- এবার তেলের পরিমাণ বাড়িয়ে নিচ্ছেন রেন্টাল ব্যবসায়ীরা; সওজ অধিদপ্তর : তাঁরা স্বপ্ন দেখছেন ২৮ বছর ধরে; হান্টারের একচেটিয়া বাণিজ্য আইনবিরোধী; ১ টাকায় হাজার টন কাগজ পরিবহন: দরপত্র বাতিল করে বিআরটিসিকে কাজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত; সুপারিশেই দায়িত্ব শেষ ‘মোড়ল’ ইউজিসির! (এতে লেখা হয়েছে- বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উন্নয়নে বছরে ২৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করেও কাজকর্মে গা-ছাড়া ভাব; জালিয়াতের ওপর টেক্কা (এতে আলোচিত হয়েছে বিখ্যাত হলমার্ক-কেলেঙ্কারির কথা)। একই পত্রিকার দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় প্রধান শিরোনাম করা হয়েছে হয়রানির ভয়ে আদালতে যায় না অধিকাংশ মানুষ। সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় দুইটি সম্পাদকীয়-লেখার শিরোনাম- ‘অনিয়মই যেখানে নিয়ম : স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে দুষ্টচক্র ভাঙতে হবে’ এবং ‘প্রতিবাদী কিশোর উন্নয়নকেন্দ্রের উন্নয়ন জরুরি’ (এতে টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের অনিয়ম আলোচিত হয়েছে)। উপসম্পাদকীয়তে প্রধান লেখাটি সাবেক উপদেষ্টা এ এম এম শওকত আলীর। তার লেখার শিরোনাম- ৪০ শতাংশ সারই ভেজাল। আর গাঁ শিউরে ওঠার মতো একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে পত্রিকাটির তৃতীয় পৃষ্ঠায়- অপহরণচক্রের সদস্য পুলিশের এএসআইসহ ছয়জন গ্রেপ্তার। এই হচ্ছে সংক্ষেপে আমাদের একটি পত্রিকায় প্রকাশিত একদিনের কতিপয় দুর্নীতির চিত্র। এবং শুধু আজকের চিত্রই এমন নয়, বরং প্রতিদিনের সংবাদপত্রগুলোরই এখন একই দৃশ্য। এখানে বিষয়টি স্পষ্ট- এ দুর্নীতিগুলোর কোনোটির সাথেই গ্রামের অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত কিংবা সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত ও প্রসিদ্ধ কোনো ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা নেই। বরং যাদের কল্যাণে বিষয়গুলো পত্রিকার পাতার শিরোনাম হলো তারা সবাই আমাদের সমাজের সুশীল শিক্ষিত ভদ্র সমাজের সদস্য। বাস্তবতা যখন এই, তাহলে নতুন করে ভাবতে হবে- কীসের অভাবে আমাদের সমাজ আজ দুর্নীতির নগ্ন শিকারে পরিণত? খুঁজে বের করতে হবে- ‘শিক্ষাই আলো শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’ হিসেবে তো সমাজের এই শিক্ষিত সদস্যদের দুর্নীতিমুক্ত অন্ধকারশূন্য আলোর পথে হাঁটার কথা ছিল। তারা এখন উল্টো পথে হাঁটছেন কেন? যদি কেউ এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন, তাহলে তাকে স্বীকার করতেই হবে- আদর্শ ও নীতি-নৈতিকতাহীন কেবল পুঁথিগত শিক্ষা দিয়ে জাতিকে আলোর পথে উঠিয়ে আনা যায় না। এ শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড হতে পারে না। শিক্ষার উপর ভর করে যদি কোনো জাতিকে সোজা দাঁড় করাতে হয়, তাহলে সে শিক্ষা অবশ্যই হতে হবে নৈতিকতাযুক্ত। সাহিত্য বিজ্ঞান দর্শন সমাজ ভাষা ইত্যাদি যে যাই শিখুক না কেন, নৈতিকতার পাঠ তাকে গ্রহণ করতেই হবে। নীতি ও আদর্শের ছাত্র হতে হবে। শিক্ষা তখনই আলোর পথ দেখাবে। সমাজের অন্ধকার দূর করবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- দুর্নীতির ঘুণে যখন সমাজের প্রতিটি স্তম্ভ আক্রান্ত, তখন কী করে সম্ভব এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা? যারা নৈতিকতা শেখাবেন, আদর্শ ও নীতির সবক দেবেন, তারাই তো বরং নীতিহীনতায় আক্রান্ত! তাহলে? এ প্রশ্নের উত্তরে তো এ কথা স্বীকার করতে হবে- কাজটি সহজ নয়। কঠিন এবং খুবই কঠিন। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যখন দুর্নীতি ঢুকে পড়েছে, তখন দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজ গড়া অবশ্যই কঠিন। কিন্তু সাথে সাথে এও মনে রাখতে হবে- কাজটি কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। উপমা হিসেবে তো আমরা সহজেই উপস্থাপন করতে পারি আইয়ামে জাহেলিয়াতের কথা। হযরত রাসুল সা. এর নবুওয়ত প্রাপ্তির পূর্বে ততকালীন আরব সমাজ যে বর্বরতা ও অজ্ঞতার অন্ধকারে আচ্ছাদিত ছিল, সেই অবস্থা কি এখন আমাদের এই সমাজেও কল্পনা করতে পারি? মেয়ে হওয়ার অপরাধে বাবা তার নিজ সন্তানকে নিজ হাতে জীবিত দাফন করে ফেলবে- এমনটা কি আমরা এখন ভাবতে পারি? না, পারি না। অথচ সেই কঠিন অন্ধকারকেই দূর করে সমাজে এমন আলো তিনি জ্বেলে দিলেন, যে আলোয় আলোকিত হয়ে গড়ে উঠল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানবকাফেলা। সাহাবায়ে কেরামের জামাত। কবি নজরুল ইসলাম তো তাই বলেছেন- ‘ইসলাম সে তো পরশমানিক কে তারে পেয়েছে খুঁজি পরশে তাহার সোনা হলো যারা তাদেরই মোরা বুঝি’ কুরআন-হাদিসের যেই দীপ্তি সেকালে নবুওয়তপূর্ব অন্ধকারকে দূর করে দিয়েছিল, সেই দীপ্তি তো এখনো দূর করতে সক্ষম সমাজের সব অন্ধকার। প্রয়োজন শুধু সেই বাতিটি একটু জ্বালিয়ে দেওয়ার। দুর্নীতিতে আক্রান্ত জাতিকে উদ্ধার করার জন্যে এমন এক মুঠো মানুষই দরকার, যারা এই বাতিটি জ্বালাবেন। যারা সমাজে কুরআন-হাদিসের শিক্ষা ছড়িয়ে দেবেন। ছড়িয়ে দেবেন ইসলামের সুমহান আদর্শ। স্বীকার করি- এ কাজ একদিন বা একমাস কিংবা একবছরেও সম্ভব নয়। হয়তো পুরোপুরি সম্ভব হবে না এক দশক বা এক যুগেও। এ টার্গেট সামনে নিয়ে আমাদেরকে কাজ করে যেতে হবে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। সামান্য একটি ছবি তোলার শখ যদি জে ফাইনকে চল্লিশ বছর পর্যন্ত সাধনায় ডুবিয়ে রাখতে পারে, তাহলে এ বিশাল কর্ম সম্পাদনে আমাদেরকে কত কাল লেগে থাকতে হবে তা বিবেকই বলে দেবে। কুরআন-হাদিসের আলোয় আমরা যারা আলোকিত হচ্ছি, যদি সেই আলোটি সমাজের সাধারণের মাঝেও জ্বালিয়ে দিতে পারি, যদি পারি সেই আদর্শকে বুকে ধারণ করে আরো সমাজঘনিষ্ঠ হতে, তাহলে আমরা জাতি হিসেবে এগিয়ে যাব আরও অনেক অনেক দূর। আমাদের আকাশে তখন নিরাপত্তা ডানা মেলে উড়ে বেড়াবে। স্বাধীনতার এই মাসে আমরা এমনই এক মুঠো মানুষের স্বপ্ন দেখি। যাদের জ্বেলে দেওয়া আলোতে আলোকিত হবে আমাদের নিরাপত্তার আকাশ।
প্রতি বছরের মতো এবারো চাঁদপুর উজানীতে ঐতিহাসিক বাৎসরিক মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এবারের তারিখ ছিলো ১৫ ও ১৬ জানুয়ারি। আমাদের জামিয়া রাহমানিয়ার আশপাশে পোস্টার দেখেছি অনেক আগেই। এ বছর অংশগ্রহণের তেমন ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু মাহফিল এলাকার এক ছাত্রের অসম্ভব রকম পীড়াপীড়ি আর তার মায়ের ফোনের সামনে না যাওয়ার ইচ্ছা ক্রমেই দুর্বল হতে লাগলো। উজানির মাহফিল ওই এলাকার লোকদের জন্য ঈদ সমতুল্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি আনন্দের। নিজেদের আত্মীয়সহ পরিচিত সকলকে দাওয়াত দেয়া, তাদের জন্য খাবার ও থাকার আয়োজন করা, মাহফিলে আগন্তুক আশেকিন-জাকেরিনদের আদর আপ্যায়ন করা যেন তাদের নেশায় পরিণত হয়েছে। সবাই নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী এ খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে যুগ যুগ ধরে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম। কোনো ক্লান্তি নেই, বিরক্তি নেই। আল্লাহর ওলি হযরত ক্বারি ইব্রাহিম রহ. এর মেহমানদারির ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে তারা। আল্লাহর ওলিদের সাহচর্য, তাদের রুহানি ফয়েজ এভাবেই পরিবর্তন ঘটায় ব্যক্তি ও সমাজের। কত কঠিন দিলের মানুষ ওলিদের সুহবতে গিয়ে মুহূর্তেই পরিবর্তন হয়ে যায়। অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে তার। ওলিদের তাকওয়া পরহেজগারির তাসিরে এলাকায় হেদায়েতের নূর ছড়িয়ে পড়ে এমন নজির অনেক। উজানি এলাকা এরই দৃষ্টান্ত বহন করে। অবশেষে মাহফিলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। মেজবান ছাড়া আরও দুই ছাত্র পিছু ধরলো। সফরসঙ্গী হলো তারাও। মোট চারজন। মেজবানকে রাহবার, ছাত্রদের মধ্যে একজনকে আমির বানিয়ে আমি মামুর হিসেবে রওয়ানা হলাম। মুহাম্মদপুর থেকে গুলিস্তান। গুলিস্তান থেকে উজানির গাড়ির টিকেট গ্রহণ করবো এরইমধ্যে আমাদের পাশ দিয়ে একটি কালো পাজারো গাড়ি শাঁ করে চলে গেল। সফরসঙ্গী একজন জানালো, ওই গাড়িতে করে নাকি প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যাচ্ছেন। হালকাভাবে তাকিয়ে দেখলাম। খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে হলো না। কোনো হক্কানী আলেমকে মহব্বত নিয়ে দেখলে সওয়াবের ঘোষণা আছে কিন্তু এদের বেলায় এমন কোনো সুসংবাদ শুনিনি। তাই তেমন গুরুত্ব দিয়ে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করিনি। তাছাড়া যে মন্ত্রী টুপি-দাড়ি ওয়ালাদের ধাক্কায় রানাপ্লাজার মতো বিশাল টাওয়ার ধ্বসে যাওয়ার দাবী করতে পারেন, সেতো কোনো আলেমের দৃষ্টিকে পেট্রোল বোমা বলেও আখ্যায়িত করতে পারেন। এ অভিযোগের ভিত্তিতে যাবজ্জীবন বা ফাঁসির হুকুম-টুকুমও হতে পারে। অযথা ঝামেলায় জড়িয়ে লাভ কী? কিছুক্ষণের মধ্যে উজানির পথে চলতে শুরু করলো আমাদের গাড়ি। ঢাকা থেকে মাধাইয়া, অতঃপর সরু রাস্তা দিয়ে উজানি। গন্তব্যে পৌঁছতে সময় লেগে গেল অনেক। জোহরের জামাত ধরা সম্ভব হলো না। এলাকার এক মসজিদে নামাজ পড়ে মেজবানের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার পালা। এলাকার ঐতিহ্য অনুযায়ী রকমারি খাবারের আয়োজন। ছাত্রের বাবাও খবর পেয়ে মাহফিল থেকে চলে আসলেন বাড়িতে। আমার শত বাধা সত্ত্বেও নিজ হাতে খাবার এনে নিজেই পরিবেশন করলেন। মাহফিলে পেঁৗঁছে আসর নামাজ পড়তে হবে তাই তাড়াহুড়া করে বের হলাম। আগেই ওজু করে নেয়ায় কোনো রকম আসরের জামাতে অংশগ্রহণ করতে পারলাম। তবে মূল পেন্ডেলে ঢোকা সম্ভব হলো না। পেন্ডেলের উত্তর পার্শ্বে মাদরাসার গেইটের সাথেই মেহমানদের গাড়ি রাখার স্থান। স্বেচ্ছাসেবক ভায়েরা সেখানে খড় বিছিয়ে দিচ্ছে। মুসল্লিরা সেখানেই দাঁড়াচ্ছে। আমরাও তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেলাম। নামাজ শেষে মধুর সুরে তেলাওয়াত শুরু হলো। সেখানে দাঁড়িয়েই তেলাওয়াত শুনছিলাম। তেলাওয়াতের মাধুর্যতায় গোটা ময়দান নীরব নিস্তব্ধ। ঐশীবাণীর আকর্ষণে অনেক আশেকিন অনিচ্ছায় চিল্লা চিল্লি-লাফা লাফি করতে লাগলো। আবার অনেকে মহান মালিকের বাণী শ্রবণে মহব্বতের অশ্র“ ঝরাতে শুরু করলো। ইতোমধ্যে আমাদের পাশ ঘেঁষে সেই মেহমান স্টেজে উঠলেন যাকে গুলিস্তানে কালো জিপে হালকাভাবে দেখেছিলাম। শুনলাম তার বাড়ি এ এলাকাতে। তিনি এ আসনের এমপি। নিজ এলাকায় এতো বড় মাহফিল হচ্ছে সেখানে তার উপস্থিত না হওয়ার সুযোগ নেই। বিশেষত উজানি মাদরাসার এ জনপ্রিয় ঐতিহাসিক মাহফিলে উপস্থিত না হলে এলাকার লোকজন খুবই খারাপভাবে দেখবে। তাছাড়া সদ্য অনুষ্ঠিত ১০ম সংসদ নির্বাচনেও তিনি নতুন এমপি হয়েছেন। জনগণের সঙ্গে সাক্ষাত ও দোয়া নেয়ার মোক্ষম সুযোগ। এসুযোগ হাতছাড়া করতে চাননি তিনি। স্টেজে তেলাওয়াত চলছে, পাশেই আদবের সাথে বসলেন। মেহমানের আগমনে পরিচালক ও আয়োজকরা আনন্দিত হয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু শ্রোতাদের মধ্যে এক ভয়াবহ ক্ষোভ লক্ষ করা গেল। মনে হচ্ছে কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিষ্ফোরণ ঘটবে। হলোও তাই। তেলাওয়াতের শীতল ছায়ায় কিছুক্ষণ বসে থাকার সুযোগ পেলেও তেলাওয়াত শেষ হতে না হতেই ঘটে গেল এক অকল্পনীয়, অবিশ্বাস্য ঘটনা। গোটা ময়দানের সাধারণ জনতা দাঁড়িয়ে গেল এবং এ ধর্মীয় মাহফিলে নাস্তিক ঘেঁষা এমপির উপস্থিতির কড়া প্রতিবাদ শুরু করে দিলো। ভোট চোর, নাস্তিকসহ বিভিন্ন গালাগালি দিতে লাগলো। প্রতিবাদ শুধু শ্লোগাণেই সীমাবদ্ধ থাকল না, রূপান্তর হলো আক্রমণে। মুষলধারে বৃষ্টির মতো জুতা, পানির বোতলসহ যার হাতে যা ছিল তাই নিক্ষেপ করতে লাগলো সাধারণ জনতা। মাহফিল আয়োজকদের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সব চেষ্টাই বৃথা গেল। সাধারণ মানুষ তাদের মনের ভাষা প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো পূর্বাপর ভাবে না। কোনো স্বার্থের বেড়াজালে তারা আটকে যায় না। আমজনতার পদক্ষেপ হয় পাপমুক্ত-স্বার্থমুক্ত মোহ ও লোভমুক্ত স্বত:সিদ্ধ। কোনো বাধাই তাদের প্রতিরোধ করতে পারে না। তাই আয়োজকদের শান্ত হওয়ার আহ্বান উপেক্ষা করে তারা প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে লাগলো। পরিস্থিতি একেবারেই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেল। এমপির লোকজন, পুলিশ ও মাহফিল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় তাকে স্টেজ থেকে সরিয়ে নেয়া হলো। তাতেও পরিবেশ শান্ত হলো না। অগত্যা এমপির বিচক্ষণ সহচরবৃন্দ মান-সম্মানের চেয়ে প্রাণ রক্ষার বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে হেলমেট পরিয়ে জনতার ক্ষোভের বৃষ্টি থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল। দ্রুত কালো পাজারো গাড়িতে উঠিয়ে দিলো। প্রাণ রক্ষার ব্যবস্থা হলেও গাড়িতে জুতার বৃষ্টি পড়তে লাগল চারপাশ থেকে। জনস্রোতে যেন ভেসে যাবে সবকিছু। কেন এই স্রোত? কেন এই প্রতিবাদ? কেন এই জুতা বৃষ্টি। প্রাণ বাঁচাতে মন্ত্রীকেও হেলমেট পরতে হয়? প্রশ্নগুলোর উত্তর পাঠকের কাছে দেয়া নি®প্রয়োজন।
একুশে বই মেলা প্রেক্ষিত ইসলামি প্রকাশনা
শামস আরেফিনবই জীবনের পাথেয়। রাতের তারার মতো পথ নির্দেশকারী। সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। বছরের একটি মাসকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে বইপ্রকাশের উৎসবের সূচনা; সে ফেব্র“য়ারির গুরুত্বও অনেক। কারণ ফেব্র“য়ারি একুশে বইমেলা মানে নতুন মলাটের বই। নতুন সাহিত্যের হাতছানি। হাজারও মানুষের আনন্দ ও বেদনার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া বইয়ের পাতায়। বই প্রকাশের ধুমও পড়ে তখন। বেচাকেনাও যে খুব কম হয়Ñ তা বলা যাবে না। এই মেলাকে কেন্দ্র করেই মূলত বাংলাদেশের প্রকাশকদের বইকেন্দ্রিক ব্যবসা বেঁচে থাকে। এ সব কিছু সীমাবদ্ধ এখন জাগতিক বিষয়ে। আত্মার তৃপ্তি বা পরিশুদ্ধি, সুফিবাদ, বা আধ্যাত্মিক প্রশান্তির যে সুযোগ তৈরি হয়েছিল ইসলামি প্রকাশনা সংস্থাগুলো বইমেলায় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েÑ তা ২০১০ সালে ইতি টানে প্রিয় বাংলা একাডেমি। বাংলাদেশে ১৯৭২-এর ফেব্র“য়ারিতে বাংলা একাডেমির মাঠে চট বিছিয়ে মুক্তধারা প্রকাশনীর উদ্যোগের মধ্যে দিয়ে যাত্রা শুরু হয় একুশে বই মেলার। মুক্তধারা প্রকাশনীর তৎকালীন স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহার উদ্যোগে শুরু হয়েছিল এই বইমেলা। অসংখ্য প্রকাশকের এ যুগে সহজেই লেখক বই প্রকাশ করতে পারে। তাই সাহিত্যমানের তুলনায় প্রকাশিত বইয়ের গুণগত মান বর্তমানে মুখ্য। প্রকাশকরা অনেক বেশি প্রকাশনার আগমনে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতার সম্মুখীন। তারা নতুন লেখকের বই লেখক খরচে প্রকাশ করেন, কিন্তু প্রতিষ্ঠিত লেখকের বই প্রকাশ করে খুব কমই ব্যবসার আশা করেন। এ সব কিছুই কিন্তু গুণগত সাহিত্য যেমনÑ কবিতা ও সাহিত্যসমালোচনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অবশ্য গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি বিক্রি কিন্তু একেবারে কম হয় না। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে বেশি বিক্রি হয়Ñউপন্যাস। ২০১০ সালের পূর্বে ধর্মীয় বইপুস্তক প্রকাশকদেরও বইমেলা স্টল নেয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু ২০১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে মেলায় কোন কোন প্রকাশনা সংস্থার স্টল স্থান পাবে, কেমন স্টল করতে পারবে, তার জন্য বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে আলাদা কমিটি গঠিত হয়। এতে স্টল বরাদ্দ প্রক্রিয়া কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। প্রকাশিত বইয়ের কপি জাতীয় আর্কাইভ ও জাতীয় গণগ্রন্থাগারে জমা দেয়া হয়েছে কি না, কর-নির্দেশক-নম্বর ঠিক আছে কি না, ইসলামি বইয়ের শুধু প্রকাশক কি না ইত্যাদি যাচাই করার পাশাপাশি প্রকাশিত নতুন বইয়ের কপি বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রে জমা দেওয়ার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়Ñ ধর্মীয় পুস্তক প্রকাশনীর বিক্রির বই তুলনামূলক অন্যান্য প্রকাশনীর চেয়ে বেশি। তারপর থেকে নিয়ন্ত্রণের খড়গ নেমে আসে এই ইসলামি প্রকাশনাগুলোর ওপর। ব্যাবসায়ীক লাভ-ক্ষতিই ইসলামিক পুস্তক স্টল বরাদ্দে বাধা সৃষ্টি করার মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখন প্রশ্নÑ আমাদের প্রাপ্তি বা প্রত্যাশা কী হতে পারে বইমেলা উপলক্ষে। কারণ সাহিত্য হচ্ছে মানুষের ভাবের বাহক। এই ভাব প্রকাশের মাধ্যমে মানুষ খুব সহজেই তার চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস ও আদর্শ অন্যের নিকট পৌঁছে দিতে পারে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়Ñ সাহিত্য প্রকৃত ইসলামের ধারক-বাহক হতে পারে, হতে পারে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধের হাতিয়ার। কিন্তু সে সাহিত্যের জগতে যদি ধর্মকে প্রবেশ করতে না দেয়া হয়, তবে একটি জাতি ধর্মীয় মূল্যবোধহীন পশু হতে পারে। ব্যক্তি ধর্মকে মনে করতে পারে অতিরিক্ত বিধিনিষেধ আরোপের হাতিয়ার। যা শুধু ব্যক্তি স্বাধীনতাকে হরণ করে না; বরং ব্যক্তি স্বাতন্ত্র ও সৃষ্টিশীলতাকে বাধা ধরার নিয়মে ফেলে খুন করে। এ কারণে মার্কস ইসলামের সাম্যবাদ দ্বারা প্রভাবিত হলেও- মুক্তমনারা স্বীকার করতে চান না ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। সম্পদের বৈষম্য দূর করার প্রক্রিয়াÑ ধর্ম হিসেব ইসলাম প্রতিষ্ঠা করলেও তারাই শুধু মার্কসকে শ্রেণিবৈষম্যহীন একমাত্র চিন্তাধারা বলে প্রমাণ করতে চান। তারা মার্কসকে উদ্ধৃত করেন একটি মাত্র বাক্যে , ‘জবষরমরড়হ রং ঃযব ড়ঢ়রঁস ভড়ৎ পড়সসড়হ ঢ়বড়ঢ়ষব’ অর্থাৎ ধর্ম সাধারণ জনতার মাঝে আফিমের মতো কাজ করে। অথচ এ উক্তি করা হয়েছিল ইউরোপের সামন্তবাদের শ্রেণিশোষণের বাস্তবতার আলোকে। যেখানে গীর্জা বা পাদ্রী সাধারণ জনতাকে বোঝাতÑ ইহকালে দারিদ্র্য পরকালে পুরস্কৃত হওয়ার কারণ। অথচ পাদ্রী বা গীর্জাকেন্দ্রিক সামন্তদের সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠত। যেখানে রাষ্ট্র ও তার সকল অঙ্গসংগঠনকে ব্যবহার করা হত শুধুমাত্র উচ্চবিত্তদের নিরাপত্তার জন্য। এভাবেই মূলত উপমহাদেশ ও বিশ্বে প্রকৃত দার্শনিকদের ইসলাম বিদ্বেষী রূপে তুলে ধরা হয়। অথচ স্বয়ং দার্শনিক বেঁচে থাকলে হয়তো এই প্রতারণার প্রতিবাদ করতেন। আর যেহেতু দার্শনিক বেঁচে নেই, এ ক্ষেত্রে ইসলামি চিন্তাধারা লালনকারীদের এ দায়িত্ব হাতে নিতে হবে। লিখতে হবে বই, রচনা করতে হবে দার্শনিক তত্ত্বের বাস্তব ব্যাখ্যা, প্রবেশ করতে হবে সাহিত্যে, নিজস্ব অবস্থান তৈরি করে নিতে হবে কবিতা, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে বা সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রে। অবস্থান নিতে হবে বইমেলায়। একুশে বইমেলার মতো বাংলাসাহিত্যের একটি মূলমঞ্চে যেনো তাদের প্রবেশ রোধ করা যায়, মূলত এ কারণেই নানা আইনকানুনের সূচনা করেছে স্বয়ং বাংলা একাডেমি। যাদের নিজেদের বানানটি পর্যন্ত শুদ্ধ করে লেখার সৎসাহস নেই। আর এই বাধাকে ডিঙিয়ে যাওয়ার নামই মূলতÑ তাবলিগে ইসলাম। কেননা রাসুল সা. নিজেও মক্কায় ইসলাম প্রচারের সময় নানা বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। এই বাধাকে ডিঙিয়ে যেতে অবশ্যই ইসলামি প্রকাশনা সংস্থাগুলোকে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে হবে। ধর্মীয় বইয়ের পাশাপাশি যদি এই প্রকাশনা সংস্থাগুলো কিছু সাহিত্যের বই প্রকাশ করতে পারেন বইমেলা উপলক্ষে; যাতে জাতীয় আর্কাইভে জমা দেয়া বইগুলো অন্তত শুধু ধর্মীয় বিষয়ের উপর সীমাবদ্ধ না থাকে। কারণ এর উপর নির্ভর করে বইমেলায় স্টল বরাদ্দ। মাকতাবাতুল আশরাফ, মাকতাবাতুল আখতার ইত্যাদি প্রকাশনা সংস্থাগুলো বইমেলাকে কেন্দ্র করে সাহিত্যের আলাদা একটি প্রকাশনা করতে পারে। আরবি নাম ব্যবহার না করে, আধুনিক বাংলা নাম দিয়ে বাংলা একাডেমিকে বুঝাতে পারেÑ তারাও মূলধারার সাহিত্যসেবী প্রকাশক। যেমন; সেবা প্রকাশনী নিজেদের অঙ্গসংস্থা প্রজাপতি প্রকাশনী দিয়ে দেদারছে মেলায় বই বিক্রি করছে। তার মানে প্রকাশনা সংস্থার অংশগ্রহণ জরুরি। আর চাই তা বাংলা নামের প্রকাশনা তৈরি করে হোক বা অঙ্গসংস্থার আদলে হোক। কারণ বইমেলায় প্রকাশক শুধু নিজের প্রকাশনীর বই বিক্রি করতে বাধ্য। আর তখন সাহিত্যের বইয়ের সাথে সাথে যদি কিছু ইসলামি বইও বিক্রি করা হয়, তবে বাংলা একাডেমি তা বাধা দিতে পারে না। যেমন সিদ্দিকীয়া পাবলিকেশন্স, সোলেমানিয়া বুক হাউজ কিছু প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক ও সাহিত্য সম্পাদকদের বই প্রকাশ করে নিজেদের মূলধারার সাহিত্য প্রকাশক হিসেবে প্রমাণ করতে পেরেছেন। নিয়মিত বইমেলায় স্টলও পেয়ে যাচ্ছেন। অথচ তারাও এক কালে শুধু ইসলামি বই প্রকাশ করত। তারা বাংলা একাডেমির পরিচালক, সহকারি পরিচালকসহ বাংলা একাডেমির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বই প্রকাশ করে; স্বয়ং বাংলা একাডেমিকে প্রভাবিত করেছেন। যে আইন বাংলা একাডেমি তৈরি করেছে; তার মধ্যে থেকেই বইমেলায় অংশগ্রহণ করতে হবে। আইনের ফাঁক-ফোকর বের করে; নিশ্চিত করতে হবে সুযোগের সদ্ব্যবহার। নিশ্চিত করতে হবে ইসলামের প্রতিনিধিত্ব। বইমেলার মাঠে না থেকে, সাহিত্যের যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান না করে, শুধুমাত্র সমালোচনা করাÑ কোনো বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না, হতে পারে না ইসলামের খেদমত। যদি প্রকৃতপক্ষে প্রমাণ করতে হয় ‘আলউলামাউ ওরাসাতুল আম্বিয়া’ তবে সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সবক্ষেত্রেই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শুধু ব্যক্তিগত ইবাদত করে, সামাজিক দায়িত্ব পালন না করে, কওমের খেদমত না করে, একজন আলেম তার পরিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। তাই একুশে বইমেলার প্রত্যাশা হতে পারে মেলায় ইসলামের প্রতিনিধিত্ব তৈরি করা। মানুষকে ইসলাম জানার সুযোগ করে দেয়া। চাই তা উপন্যাস লিখে হোক, চাই তা নবীজীবন লিখে হোক, চাই তা কবিতা বা ছড়ায় নবী জীবন তুলে ধরে হোক। প্রয়োজনে ইসলাম প্রচারের মাধ্যম পরিবর্তন করতে হবে, আধুনিক প্রচার মাধ্যমকে ব্যবহার করতে হবে। ইসলাম হচ্ছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আধুনিক ধর্ম। আর তাই তার প্রচার ও তাবলিগও নিশ্চই আধুনিক হওয়া অত্যাবশ্যক। এ বাস্তবতা বুঝেই মাসিক মঈনুল ইসলাম হাটহাজারির অনলাইন পত্রিকার উদ্ভোধন করেছেন শ্রদ্ধেয় আহমদ শফী দা. বা.। সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব ছাড়া কোনো সমাজের পট পরিবর্তন করা যায় না। আর সাহিত্য সংস্কৃতির একটি বিশাল অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে। একারণে জাতিসংঘ সংস্কৃতি বা কালচারকে টেকসই উন্নয়নের পরিমাপক বলে। আর সংস্কৃতিকে সজ্ঞায়িত করে তারা এভাবে, ‘ঈঁষঃঁৎব রং ধ সবধহং ঃড় ধপযরবাব ধ সড়ৎব ংধঃরংভধপঃড়ৎু রহঃবষষবপঃঁধষ, বসড়ঃরড়হধষ, সড়ৎধষ, ধহফ ংঢ়রৎরঃঁধষ বীরংঃবহপব’ অর্থাৎ সংস্কৃতি হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক, আবেগ, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য বিষয়। আর সেই সংস্কৃতি যদি হয় ধর্মহীন, তবে তার করুণ পরিণতি বরণ করতে হবে পুরো সমাজকে। আর তাই লিটলম্যাগ চত্বরেও তৈরি করতে হবে নিজেদের প্রতিনিধিত্ব। স্বাধীন লিটলম্যাগ কর্মী হিসেবে মেলায় তরুণ কবিরা লিটলম্যাগ স্তর বরাদ্দ নিতে পারে। যেমন প্রতি বইমেলায় লিটলম্যাগ চত্বরে দেখা যায়Ñ অরবাক, শালুক, লোক, দৃষ্টি, ময়ূখ, রচয়িতাসহ বিভিন্ন নাম না জানা বা সম্পাদক সর্বস্ব পত্রিকার উপস্থিতি ও তাদের ছোট্ট লিটলম্যাগ স্টল। যা মেলার বাড়তি সৌন্দর্য বললে ভুল হবে না। কিন্তু কওমি জগতের আজ পর্যন্ত কোনো লিটলম্যাগ প্রতিনিধিত্বের ভূমিকা পালন করতে পারেনি। তবু কওমি জগতে লিটলম্যাগ হচ্ছে। সাহিত্য চর্চার আন্দোলন বিলম্বে হলেও শুরু হয়েছে। বাংলার প্রতি ছাত্রদের দেখা যাচ্ছে বিস্তর আগ্রহ। এই আগ্রহ হয়তো তাদের সকল বাধা কাটিয়ে আগামীর সূর্যোদয়ের পাথেয় হতে সাহায্য করবে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত কাশফুল, আনতারা, আস-সালাম, বাতিঘর, তারাফুল, ঘরকুটুম, সাহিত্য কানন, সেঁজুতি, মৌমাছি, শৈবালসহ অন্যান্য পত্রিকার লিটলম্যাগ কর্মীরা নিজেদের সাহিত্যের মূল স্রোতের সাথে পরিচয় না করাতে পারবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের সত্য ও সুন্দরের বাস্তবতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। আর তখনই ধীরেÑধীরে বাংলাসাহিত্যের নেতৃত্বে স্থান দখল করবে ইসলাম। এই প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির জন্য বড় উদ্যোগের প্রয়োজন। ব্যক্তি থেকেই সমাজ, সমাজ থেকেই জাতি যদি গঠিত হয়; তবে আজকের তরুণদের পথচলা থেকে শুরু হবে প্রত্যাশার আগামীকে ছিনিয়ে আনার পদক্ষেপ। বর্তমানের ইসলামিপাতা কেন্দ্রিক এক ঝাঁক তরুণের সাহিত্যচর্চা সূচনা সত্যি সাধুবাদ পাওয়ার মতো। তবে শুধু ইসলামি পাতায় সীমাবদ্ধ না থেকে, সাহিত্যের মূল স্রোত দৈনিকের সাহিত্যপাতায় তরুণদের উপস্থিতি থাকতে হবে। কারণ ইসলামি পাতা অন্যান্য ফিচার পাতা খেলা, বিনোদন, ক্যাম্পাস ইত্যাদির মতোই ফিচার। এটি কখনো বাংলাসাহিতের মূল স্রোতের অংশ নয়। দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত কবি-সাহিত্যিকদের লেখার গুণগত মান আলাদা। অবশ্য কবিতার ক্ষেত্রে পরাবাস্তব বা উত্তরাধুনিকতার হুজুগ বাদ দিলে গদ্যের মান নির্ণয়েÑ তা শতভাগ সত্য। এতে দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ নেই। তাছাড়া সাহিত্য পাতায় নিয়মিত লেখার মাধ্যমে কওমি মাদরাসা কেন্দ্রিক লেখকদের সাথে গড়ে উঠতে পারে প্রকাশকদের পরিচয়। এতে করে প্রকাশকরা নতুন লেখক সম্পর্কে জানতে পারবে। আগ্রহ নিয়ে তাদের বইও প্রকাশ করতে পারবে। তখন যদি একুশে বইমেলায় ইসলামি কোনো প্রকাশনা না থাকে, তবে তা কোনো সমস্যা তৈরি করবে না। কারণ ইসলামের আদর্শ ছড়িয়ে দেয়ার মতো লেখকের উপস্থিতি তো মেলায় হলো। লেখক পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব বা প্রকাশক পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব তৈরি নিশ্চিত হলেই একুশে বইমেলা কওমি মাদরাসাকেন্দ্রিক সাহিত্য চর্চার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি সুনিশ্চিত করতে পারবেÑ আশা করা যায়। ইসলামি জগত ও সাধারণ সাহিত্যের জগতের মাঝে যে ফারাক, বাংলা সাহিত্যে দৃঢ় অবস্থান তৈরি করে তা মুছে ফেলতে হবে। তারপর প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির অংক কষতে হবে আমাদের।
সময়ের প্রয়োজনে প্রযুক্তি ব্যবহারে কওমি ছাত্রসমাজ আমিন ইকবাল
কওমি মাদরাসা। ইসলামি শিক্ষার নিবিড় পাঠশালা। কোরআন হাদিসের মৌলিক জ্ঞান আহরণই এ মাদরাসার প্রধান টার্গেট। নববি ইলম অর্জনে সদামগ্ন এখানকার ছাত্ররা। পিছিয়ে নেই যুগ সচেতনতা অর্জনেও। আধুনিক যুগের চাহিদা বুঝে তথ্য-প্রযুক্তিতে দখল নিচ্ছে কওমি ছাত্রসমাজ। ভার্চুয়াল জগতে এখন তাদের বিচরণ যথেষ্ট পরিলক্ষিত হয়। কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, ইন্টারনেট ব্যবহার, ব্লগিং, ফেসবুক, নিজস্ব ওয়েবসাইট পরিচালনা- সব ক্ষেত্রেই তাদের পদচারনা। তারা এগিয়ে যাচ্ছে যুগ চাহিদার সঙ্গে পাল্ল¬া দিয়ে। কোনো এক সন্ধ্যায় এ বিষয়ে কথা হয় জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার প্রধান মুফতি, মুফতি হিফজুর রহমান এর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘তথ্য-প্রযুক্তিতে মাদরাসার ছেলেরা এগিয়ে আসছে এটি ভালো সংবাদ। এখন প্রযুক্তির যুগ। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারাই প্রকৃত জ্ঞানীর পরিচয়। আল্ল¬ামা শামি রহ. বলেছেনÑ ‘যে ব্যক্তি তার যুগ সম্পর্কে সচেতন নয়, সে মূর্খ।’ তাই, আমাদের আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। জনসাধারণের সাথে মিশতে হবে। সেজন্য প্রযুক্তি ব্যবহারের বিকল্প নেই। কারণ, বর্তমানে পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য মানুষ প্রযুক্তিনির্ভর। তাদের মধ্যে শিক্ষিতের সংখ্যাই বেশি। তারা সেখানে নিজেদের চিন্তা-চেতনা ছড়িয়ে দিচ্ছে। আদর্শের প্রচার-প্রসার করছে। তাই, হকের ধারক কওমি মাদরাসার ছাত্রদের উপস্থিতিও সেখানে থাকতে হবে। দ্বীনের দাওয়াত দিতে হবে। অন্যথায় ওই মহলে ইসলামের সঠিক কথাগুলে পৌঁছবে কী করে?’ তবে, ছাত্রদের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার উপকারী মনে হলেও অনেক সময় এটাই ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এর পেছনে পড়ে প্রচুর সময় নষ্ট হয়। অনেকে জড়িয়ে পড়ে অনৈতিক কাজে। হারিয়ে যায় রঙিন জগতে। তাদের জন্য করণীয় কী, জানতে চাইলে মাদরাসা দারুর রাশাদ মিরপুর এর প্রিন্সিপাল মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান জানান, ‘সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট একটা সময় ঠিক করে দিতে হবে। এ সময়ের বাইরে ইন্টারনেট বা ফেসবুক ব্যবহার করা যাবে না। আর নৈতিক-অনৈতিকের ব্যাপারটা একান্ত নিজের। খোদাভীতি থাকলে কেউ অনৈতিক কাজে জড়াবে না। এক্ষেত্রে উস্তাদগণও ছাত্রদের মাঝে খোদাভীতির ব্যাপারে বেশি বেশি আলোচনা করতে পারেন। তাদেরকে অনৈতিক কাজের ভয়াবহ পরিণামের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে পারেন। ছাত্রদের মাঝে যখন সময়ের গুরুত্ব এবং খোদাভীতি কাজ করবে তখন এরকম সমস্যা হবে না ইনশাআল্লাহ।’ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ছাত্রদের প্রযুক্তি ব্যবহার সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘যুগচাহিদার ভিত্তিতে প্রতিটি কওমি মাদরাসায় কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, আমাদের ছাত্ররা চব্বিশ ঘণ্টা মাদরাসার চার দেয়ালের ভেতরে থাকে। ফলে বাইরে বা বাসা থেকে এর প্রশিক্ষণ নেওয়া, প্রয়োজনীয় কাজে ইন্টারনেট ব্যবহার করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। তাই প্রতিটি কওমি মাদরাসাতেই কম্পিউটার ল্যাব, প্রশিক্ষণ কর্মশালা এবং ক্লাসে প্রজেক্টরের ব্যবস্থা থাকা উচিত বলে আমি মনে করি। আল্লাহর রহমতে আজ থেকে দশ বছর আগে আমাদের মাদরাসায় কম্পিউটার ল্যাব চালু হয়েছে। দশটি কম্পিউটারের মাধ্যমে ছাত্রদের কম্পিউটার শিক্ষা দেওয়া হয়। তাকমিল জামাতের ওপরের ছাত্রদের জন্য কম্পিউটার শেখা বাধ্যতামূলক। অন্যান্য ছাত্রদের পাঠ্যপড়ায় বেশি চাপ থাকায় বাধ্য করা হয় না, বাকি কেউ শিখতে চাইলে তার জন্য ব্যবস্থা রয়েছে।’ জামিয়া কুরআনিয়া লালবাগ মাদরাসার ইফতা পড়–য়া ছাত্র আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি তাদের আগ্রহ-উদ্দীপনা, ইন্টারনেটের উপকার-অপকারের নানা কথা। আলতাফ মাহমুদ বলেন, আমরা যারা কওমি মাদরাসায় পড়াশোনা করি, একটা সময় ছিল আমরা ক্লাসের পড়ার বাইরে অন্য কিছু করার চিন্তাই করতাম না। ফলে আধুনিক বিশ্ব থেকে আমরা কিছুটা আলাদা। কিন্তু যখন অনুভব হয়েছে যুগ চাহিদার ভিত্তিতে তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে ধারণা রাখা এবং এপথে আমাদের সরব পদচারনা খুব দরকার, তখন আমরাও কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, ইন্টারনেটের সাহায্যে তথ্য আদান-প্রদান, ব্লগিং ইত্যাদিতে যুক্ত হয়েছি। আমরা এখন অনলাইনে কিতাব মুতালাআ করি। দ্বীনের দাওয়াত দিই। ফেসবুকে বন্ধুরা মিলে বিনির্মাণ, কওমি ছাত্রসমাজ, আলোর কাফেলা ইত্যাদি নামে অনেকগুলো গ্র“প চালু করেছি। ব্ল¬গ চালু করেছি। পরিচালনা করছি নিজস্ব ওয়েবসাইটও। আলহামদুলিল্ল¬াহ! এর মাধ্যমে ইসলামের জন্যও করতে পারছি অনেক কিছু। কওমি ছাত্রদের যুগ সচেতনতা এবং তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারে সরব ভূমিকার মূল্যায়ন করতে গিয়ে জামিয়া ইমদাদিয়া ঢাকার প্রিন্সিপাল আবু তাহের জিহাদি বলেন, যুগ সচেতনতা সময়ের অপরিহার্য দাবি। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ সচেতনতা আশানুরূপ বাড়ছে। প্রযুক্তি ব্যবহারে অনেক মাদরাসাই এখন মডেল। এ ক্ষেত্রে ছাত্রদের মেধা বিকাশে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে। ছাত্রদের অদম্য আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে তাদের তৈরি করতে হবে আগামীর জন্য। তারাই তো নেতৃত্ব দেবে সময়ের।