বিজয়ের রমজান
শানিত হোক আমাদের প্রার্থনার ভাষা
মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন
জুলাই, আগস্ট'১৪
আজ রকমারি ইফতারির স্বাদে উতসবমুখর আমাদের রমজান। ইফতারের বর্ণিল আয়োজন আর ঈদের চঞ্চল স্বপ্নের দাপাদাপিতে আমরা ভুলেই গেছি এই রমজান ছিল একদা মুষ্ঠিবদ্ধ বিজয়ের প্রতীক। দুর্দণ্ড অসম শক্তিকে প্রবল দুঃসাহসে পরাজিত করে একদা বুক টান করে দাঁড়িয়েছিল ‘সত্য’। আর সময়টা ছিল রমজান মাস।
হিজরি দ্বিতীয় বছর। হযরত রাসুল সা. সংবাদ পেলেন প্রতিপক্ষ মক্কাবাসি মেরুদণ্ড শক্তিশালী করতে বড় ধরনের একটি সম্মিলিত বাণিজ্যিক দল পাঠিয়েছে সিরিয়ায়। হযরত রাসুল সা. গোয়েন্দা মারফত জানতে পারলেন ৪০ সদস্যের এই ব্যবসায়ী টিম সফল বাণিজ্যের পর এখন মক্কায় ফেরার পথে। এও জানতে পারলেন তারা অর্থনৈতিকভাবে শক্তি সঞ্চয় করছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের যুদ্ধের প্রস্তুতি স্বরূপ। শত্র“র পায়ের তলে মাটি জমতে দেয়া কোনো বিচক্ষণ প্রতিপক্ষের কাজ নয়। শত্র“ পক্ষকে ঘায়েল করার সহজ পন্থা হলো তাদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া। হযরত রাসুল সা. সমরনীতির এই পরীক্ষিত পথেই এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু করুণাময় আল্লাহ দয়া করে বেঈমানদের কোমরের জায়গায় তাদের মাথাগুলো বিছিয়ে দিলেন। ফলে ব্যবসায়ীকাফেলা কৌশলে পালিয়ে গেলেও হাতের মুঠোয় এসে ধরা দেয় আবু জাহালের নেতৃত্বে মক্কার সব রাঘববোয়াল। সমকালীন সর্বোচ্চ সমরাস্ত্রে সজ্জিত প্রায় ১০০০ বাহিনীর প্রতিপক্ষের সামনে মাত্র ৩১৩ জন মুসলমান। শত্র“পক্ষের হাতে ২০০ ঘোড়া। আর মুসলমানদের হাতে মাত্র দুটি ঘোড়া, ৭০ টি উট। শত্র“পক্ষের সঙ্গে আছে সমরসঙ্গীত গায়িকা নটিনীর দল। আছে দামামা বাদক। এই অসম যুদ্ধে জয় হয় মুসলমানদের। কোরআনের ভাষায়Ñ আর বদর যুদ্ধে যখন তোমরা হীনবল ছিলে, আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছিলেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারো।’ (আল-ইমরান : ১২৩)
বিজয়ের এই শুভ সময়টি ছিল পবিত্র রমজানের সতের তারিখ। আমরা স্মরণ করতে পারি আল্লাহ তায়ালা রমজানুল মুবারকের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেনÑ ‘রমজান মাস, যাতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে।’ (বাকারা : ১৮৫)
রমজানের রোজা ফরজ হয়েছে হিজরি ২য় সালে। এই মাসেরই শবেকদরে অবতীর্ণ হয়েছে পূর্ণ কোরআন। অবতীর্ণ হয়েছে সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। এবং শুধু যৌক্তিক ও বিশ্বাসিকভাবেই নয়, বাস্তবে সত্য ও মিথ্যার চূড়ান্ত পার্থক্য করে দেখিয়ে দিয়েছেন বদর ময়দানে। আমাদের ইতিহাসের এই শির উঁচু করা অধ্যায় নানা কারণে আজ স্ববিশেষ স্মরণীয়।
প্রথমত এই কারণে আজও আমরা পৃথিবীব্যাপী হতবল। আমাদের নিষ্পাপ শিশু, অসহায় নারী ও বৃদ্ধদের পবিত্র রক্তে প্রতিদিন মনের সুখে আলপনা আঁকছে বেঈমানরা। আর আবু জাহালদের মানসপুত্রেরা দিকে দিকে গাইছে সমরসঙ্গীত। জাতিসংঘের প্রশিক্ষিত কসাইবাহিনী অবিরাম বাজিয়ে চলেছে যুদ্ধের বন্য দামামা। জ্বলছে কাশ্মীর, সিরিয়া,্ আফগান, বসনিয়া, ইরাক আর প্রাণের ফিলিস্তিন। অভাগা মিয়ানমার তো জ্বলছেই। জ্বলছে মুসলিম ঐতিহ্যের দেশ মিশর। পুড়ে ছাই হয়েছে গাদ্দাফির লিবিয়া বেঈমানদের বিষ গণতন্ত্রের অনলে।
এই আগুনে প্রতিদিন ঢালা হচ্ছে নতুন ঘি। অনেক রক্ত দানের পর সেই ইরাকে মুসলমানরা একটু ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে, বীর সাদ্দামের ভূমি তিকরিতে স্বাধীনতার শ্লোগান শব্দময় হতে চলেছে, অমনি কসাই আমেরিকার রাজা ওবামা বাণী দিয়ে বলেছেনÑ ইরাকি জনগণকে জঙ্গিদের হাত থেকে রক্ষা করতে এবং আঞ্চলিক ও মার্কিন স্বার্থে দেশটির সরকারী বাহিনীকে সাহায্য করা হবে। (আমাদের সময় : ২১ জুন’১৪)
শুধু সাহায্য করবে বলেই বসে থাকেনি এই কসাই সম্্রাট। পত্রিকার ভাষ্যÑ ‘ইরাকে আরও সেনা পাঠাল যুক্তরাষ্ট্র’। ইরাকে আরও তিনশতাধিক সেনা পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরাকে আগে পাঠানো সেনাদের মতো নতুনরাও রাজধানী বাগদাদে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস ও দেশটিতে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বে থাকবে।
সুন্নি বিদ্রোহীদের হামলার পর দুই সপ্তাহ আগে ইরাকে পৌঁনে তিনশতাধিক সেনা পাঠিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ইরাকি সেনাদের যুদ্ধ পরিকল্পনায় সহায়তা করতে তিন’শ সামরিক বিশেষজ্ঞ পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র্। যাদের একটি অংশ এরই মধ্যে দেশটিতে পৌঁছে কাজ শুরু করে দিয়েছে। এ ছাড়াও জঙ্গিদের হামলা ঠেকাতে ও তাদের ওপর নজরদারী করতে অস্ত্রশজ্জিত ও গোয়েন্দাকাজে নিয়োজিত বেশ কিছু মার্কিন বিমান ও ড্রোন দেশটিতে কাজ করছে। (আমাদের সময় : ২ জুলাই’১৪)
কী মধুর বর্ণনা। স্বদেশে নির্যাতিত সুন্নি মুসলমানগণ যখনই স্বাধীনতার শ্লোগানে মুষ্ঠিবদ্ধ তখনই তারা হয়ে গেল জঙ্গি। আর বিদেশি বর্বর ড্রোনবাজরা এসেছে বাগদাদের স্বার্থ রক্ষা করতে সশস্ত্র বিমান নিয়ে। অধিকন্তু নির্লজ্জের মতো চলছে ‘মার্কিন স্বার্থ’ রক্ষার কথা। কথা হলো, যে বাগদাদের প্রতিষ্ঠাতা হযরত উমর, হযরত আলী যে বাগদাদের শাসক, যে ইরাকে আজও ঘুমিয়ে আছেন হযরত হুসাইন রাযি. এবং উম্মাহর শ্রেষ্ঠ ইমাম আবু হানিফা রহ.- সেখানে আবার বেঈমানদের স্বার্থ কী?
কথা কিন্তু এখানেই থেমে যায়নি। ইরাকের এই নতুন যুদ্ধে বেরিয়ে এসেছে গোপন বন্ধুত্বের তালিকা। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে ‘ইরাকে সুন্নি বিদ্রোহীদের রুখতে যুদ্ধবিমান সরবরাহ করছে ইরান। রাশিয়া থেকে যুদ্ধ বিমান ক্রয়ের কয়েকদিন পর ইরাকে ইরানের য্্ুদ্ধবিমান পৌঁছানোর শক্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে। উল্লেখ্য, এর আগে ইরাকি শিয়া সরকারকে সাহায্য করতে যুদ্ধবিমান ও ড্রোন মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ থেকে বোঝা যায় ইরাকের শিয়াপন্থি সরকারকে রক্ষা করতে দুই বিরোধপূর্ণ দেশ- যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান এক সঙ্গে কাজ করছে’। (আমাদের সময় : ৩ জুলাই’১৪)
আমাদের দুঃসময় হলেও শিয়াদের প্রকৃত মুখ মুখোশ ভেঙে বেরিয়ে এসেছে। মুখে যতই তারা নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করুক, তারা যে মুসলমানদের শত্র“Ñ যুক্তরাষ্ট্র খুব সরলভাবে তা প্রমাণ করে দিয়েছে।
এদিকে মিয়ানমারের মুসলমানরা তো প্রতিদিনই নির্যাতিত হচ্ছে। হচ্ছে আশ্রয় হারা। গতকালও (২.৭.১৪) মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালায় অবস্থিত মুসলিম দোকান ও মসজিদে হামলা চালিয়েছে কয়েক’শ বৌদ্ধ। ২০১২ সালের জুলাই থেকে শুরু হওয়া বৌদ্ধ-মুসলিমের এই দাঙ্গায় পত্রিকার ভাষ্যমতে ২০০ জনের বেশি নিহত হয়েছে। আর ঘর ছাড়া হয়েছে এক লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি মুসলমান।
আমাদের পহেলা কেবলা অবরুদ্ধ। ফিলিস্তিন ইহুদি নির্যাতনের যেন প্রশিক্ষণ মঞ্চ। এইতো একদিন আগেও তিন ইসরায়েলি কিশোরের লাশকে কেন্দ্র করে ইসরায়েল ৩০ দফা বিমান হামলা করেছে ফিলিস্তিনের ওপর। কী ভয়াবহ কথা!
ইরান, আমেরিকা, ইসরায়েল, মিয়ানমারসহ সব বেঈমান যখন একজোট আমাদের বিরুদ্ধে; আমাদের শিশু, বৃদ্ধ নারীদের নিষ্পাপ রক্তে যখন প্রতিদিন তৃপ্ত হচ্ছে বেঈমান পিশাচদের খুনি আত্মা তখনই আমাদের দুয়ারে উপস্থিত রমজান-বিজয়ের মহানায়ক। আজ বিশ্বমুসলিমের সামনে এ এক মহা প্রশ্ন। কিভাবে গ্রহণ করবো আমরা এই বিজয়ের বার্তাবাহক মাসকে।
রমজান। যেখানে খুলে যায় প্রভুর রহমতের সব কপাঠ। ক্ষমা ও মুক্তির আশিষে ছেয়ে যায় আমাদের আকাশ। লাখ লাখ হাফেজের কণ্ঠনিঃসৃত তেলাওয়াত আল্লাহর আরশকে বেঁধে দেয় মাটির পাটাতনের সঙ্গেÑ যে পাটাতনে আমাদের বাস। আমরা যখন ক্লান্ত, ক্ষুধার্তপ্রাণে ইফতারের পসরা সাজিয়ে বসি দস্তরখানে, আরশ তখন মুখিয়ে থাকে আমাদের প্রার্থনা শোনার জন্যে। ইফতারের শুভ মুহূর্তে এবং রাতের নিশুতিপ্রহরে আমাদেরই চোখে পানিতে রচিত আমাদের ভবিষ্যত ইতিহাস। এই ইতিহাস রচিত হয় খোদার আরশে। পৃথিবীর কোনো শক্তি যা কোনোদিন মিটাতে পারে না।
আজ প্রতিটি মুসলমানকে ভাবতে হবে পৃথিবীর সব মুসলমান একই পরিবারভুক্ত। এও ভাবতে হবে আমার ঘরে আমি নিরাপদ। আমার সন্তান নিরাপদ। অথচ আমার ভাই ও তার সন্ত্রানরা শত্র“র অস্ত্রের মুখে। এই নিরাপত্তায় আমরা নিজেদেরকে নিরাপদ ভাবতে পারি না। ভাইকে শত্র“র যুদ্ধবিমান আর ড্রোনের নিচে রেখে শান্তিতে ঘুমোতে পারে যে পাষাণÑ সে কী করে দাবি করবে আমি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সা. এর উম্মত। আমাদের ভুলে গেলে চলবে নাÑ রমজানের সাধনা শুধু উপোস করা নয়; এতো ঈমানকে শানিয়ে নেয়ার মওসুম। বস্তুর শক্তিকে উজিয়ে মহান মালিকের শক্তিকে উপলব্ধি করার মাস। নিরস্ত্রগণ যখন আল্লাহনাম ভরসা করে সত্য প্রতিষ্ঠার আহ্বানে ঝাপিয়ে পড়ে আল্লাহ তখন আকাশ থেকে ফেরেশতা পাঠিয়ে সাহায্য করেন। এ কেবল বদর যুদ্ধের কথাই নয়; এই সত্য সর্বকালের। তাই আমাদের প্রার্থনার ভাষা হোক ব্যাপক ও দিগন্তস্পর্শী। আমাদের ঈমান হোক আসমানি সাহায্যে নির্ভর এবং বিশ্বের সকল মুসলিম মজলুমানের বিজয় প্রত্যাশায় আকুল। আমাদের মন ও সামর্থ্য ছড়িয়ে পড়–ক আমাদের মজলুম ভাইদের মুক্তি আন্দোলনে। আমাদের কান্নায় ফিলিস্তিনের শহিদ শিশুদের রক্ত জেগে ওঠুক রাতের গভীরে। আমাদের ইফতার ও জুমার মোনাজাতে ভাষা পাক মজলুম ইরাক, কাশ্মীর, মিয়ানমার ও রক্তাক্ত সিরিয়া। মজলুম মুসলমানের প্রতি আমাদের আহত হৃদয় শক্তিমান বন্ধুরূপে জেগে ওঠুক। ইরান, আমেরিকা, ইসরায়েল, মিয়ানমারে জালেমদের প্রতি আমাদের আত্মায় পুষিত ঘৃণা লাভাময় হোক প্রতিটি মজলুম জনপদে। বিজয়ের মাসে বিজয় লেখা হোক আমাদের মজলুমান ভাইদের নসীবে।
অশ্রু ও রক্তের আগুনে জ্বলছে জনপদ
মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন
জুন'১৪
: ঝন্টু তুমি বলো!
: আমি পাইলট হবো স্যার!
: পাইলট কেন?
: বিনে পয়সায় দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে পারবো। আর কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়Ñ ‘জগতটাকে দেখবো আমি আপন হাতের মুঠোয় ভরে।’ মজা হবে না স্যার!
: অবশ্যই অবশ্যই...
: এবার মিন্টু বলো!
: আমি উকিল হবো স্যার!
: কেন বলো তো!
: স্যার বড় কাকু বলেছেন, উকিল-মুক্তাররা নাকি প্রতিদিন বেতন পানÑ তাই।
: অ আ"ছা!
: এবার সবুজ দাঁড়াও। বলো লেখাপড়া করে ভবিষ্যতে কী হতে চাও।
: স্যার আমি ডাক্তার হতে চাই।
: কিন্তু কেন?
: দুঃখী মানুষদের সেবা করবো। অসহায় মানুষদের দুঃখ মোচনের চেষ্টা করবো।
: সাবাশ বেটা সাবাশ। এই না আদর্শ ছাত্রের কথা। যে শিক্ষা জাতির মেরুদ- সে শিক্ষা গ্রহণ করেও যদি আমরণ জাতির কল্যাণের কথা না ভাবি, জাতির দুঃখ ঘুচাবার স্বপ্ন না দেখি তাহলে আমাদের এই শিক্ষা হবে অর্থহীন। অতঃপর ডাক্তার ও মানবসেবার মহিমা সম্পর্কে শিক্ষাগুরুর দীঘল ভাষণ!
যুগ যুগ ধরে গুরুগৃহে এভাবেই শিক্ষাগুরুগণ তাদের শিষ্যদের দীক্ষা দিয়ে এসেছেন। সামান্য ভাষার ব্যবধানসহ এখনও চালু আছে আদর্শের এই পাঠ। গুরুর বচনে ব্যত্যয় নেই কোনো
কালেই। অথচ আমরাই যখন এই মানবতার স্বপ্নে সমর্পিত সেই ডাক্তারের কাছে যাই তখন কী পাই! পত্রিকার ভাষায়Ñ ‘সড়ক দুর্ঘটনায় ডান পায়ের গোড়ালি বি"িছন্ন হয়ে
যায় জজ মিয়ার। চিকিৎসা নিতে আসেন রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে। নিচতলায় অপারেশন থিয়েটারে পাঠানো হয় তাকে। কর্তব্যরত চিকিৎসক দেখে বললেন, বি"িছন্ন পা জোড়া লাগানো সম্ভব নয়। কেটে ফেলতে হবে। কিন্তু জজ মিয়া কিছুতেই রাজি হ"িছলেন না। সার্জনও নাছোড়বান্দা। পা কাটবেনই। নিরুপায় জজ মিয়া এক আত্মীয়কে ধরে তৎকালীন স্বাস্থ্যপ্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব) মুজিবুর রহমান ফকিরকে দিয়ে তাৎক্ষণিক ফোন করান চিকিৎসকের কাছে। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশে পায়ের গোড়ালি জোড়া লাগিয়ে দিতে বাধ্য হন চিকিৎসক। জজ মিয়া সুস্থ হয়ে উঠেন। এখন হাঁটা-চলা করছেন। {আমাদের সময় : ২০ মে ‘১৪}
এটা উপমা। এমন ঘটনা এখন আর বিরল নয়। বরং নিত্যদিনের। আর এই যদি হয় দরদি চিকিৎসকদের চেহারা- তাহলে রাজনৈতিকদের মুখ কেমন হবে তাকি আর বলতে হয়? বিশেষ করে খুনের ঘটনার পর যদি নিহতের পরিবার নিরাপত্তাহীন আর খুনির দল সদর্পে চলাফেরা করার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে তখন আর খুন-হত্যার অভিশাপ থেকে মুক্তির আশা করা যায় না। তারপরও দেশে এখনও যারা রাজনীতিক নয়, দলের কর্মী নয়, শুধু ‘মানুষ’ তারা যেকোনো খুনের ঘটনায় আহত বোধ করেন। কাঁদেন এবং ইনসাফের আশায় বুক বাঁধেন।
দুই.
সমাজে মানুষ হওয়ার সমস্যা হলোÑ অন্যের যন্ত্রণায় পাষাণ হয়ে থাকা যায় না। কিছু করতে না পারলেও সঙ্গে কাঁদতে হয়, দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে হয়। সান্তনার কথা শোনাতে হয়Ñ ‘অপেক্ষা করো। আল্লাহ তো আছেন। বিচার একদিন হবেই।’
বেদনাবিধুর এমন ঘটনা তো প্রতিদিনই দেখছি, কাঁদছি, দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছি। আর না কেঁদে উপায় কি, যখন কোনো মা বুক চাপড়ে বলতে থাকেনÑ ‘ছেলেটা বিয়ের পিঁড়িতে বসার কথা ছিল। সে অনুযায়ী আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াতকার্ড দেয়া হয়েছিল। বিয়ের
আয়োজন ছিল চূড়ান্ত পর্যায়ের। বিয়ের ব্যয় ও পারিবারিক অন্যান্য কাজ করতে তিলে তিলে গড়া জমিও বিক্রি করি। কিন্তু জমি বিক্রির টাকাগুলো হাতে আসাতেই যত বিপত্তি। র্যাব-১১-এর মেজর আরিফ হোসেন তার অস্ত্রধারী র্যাব সদস্যদের দিয়ে চোখের সামনে ছেলেটিকে নারায়ণগঞ্জের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। তারপর ছেলেকে ফেরত দেয়ার শর্তে আমার কাছ থেকে ৪২ লাখ টাকাও নেয়। কিন্তু ১৬ দিন পর মেজর আরিফ আমার ছেলে শওকত আলী ইমনের লাশ ফেলে রেখে যায় কাঞ্চন ব্রিজের নিচে। {আমাদের সময় : ১৯.৫.১৪}
এ ছিল গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনা মিডিয়া কিংবা সরকারের এইটুকুও টনক নাড়াতে পারেনি। কারণ, ইমনরা বিশ্বজিতের মতোই এই সমাজের সাধারণ মানুষ। তবুও বিশ্বজিতের কপাল ভালো সামনে দাঁড়িয়ে ধারালো অস্ত্রের ক্রমাগত আঘাতে অসীম অসহায়ত্বে জীবন বিসর্জন দিতে পেরেছে বলেÑ অন্তত জাতির পক্ষ থেকে নগদ কিছু চোখের জল পেয়েছিল। কিন্তু ইমনদের মতো বরাবর যাদের ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়- অতঃপর সাত সকালে পথের ধারে পাওয়া যায় ক্ষত-বিক্ষত লাশ, তারা আমাদের এই চোখের জলটুকুও পায় না। দেশের সচেতন পাঠক মাত্রই জানেনÑ সাদা কিংবা কালো পোষাকে অস্ত্রধারী একটি দল সাদা মাইক্রোবাসে করে যাকে তাকে যখন তখন তুলে নিয়ে যা"েছÑ বিশেষ করে ব্যবসায়ী কিংবা বিরোধী রাজনীতিকদেরÑ এটা এখন যেন কোনো ঘটনাই নয়। অথচ এভাবে ধরে নিয়ে যাওয়া অতঃপর পথে কিংবা ডোবায় লাশ পড়ে থাকতে দেখা- সে তো মুক্তিযোদ্ধের সময়কার কাহিনী। বিদেশি হায়েনারা এভাবে এদেশের সূর্যসন্তানদের ধরে নিয়ে খুন করেছে। তখন আমরা ছিলাম পরাধীন। আর এখন? ‘কেতাবে’ আছে আমরা স্বাধীন! আসলেই কি আমরা স্বাধীন?
সুমনের বাবা আবদুল লতিফের কথা শুনুনÑ‘লাশ উদ্ধারের পর রূপগঞ্জ থানায় র্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করতে যাই। কিন্তু ওসি হুমকি দেন র্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না। করলে পুরো পরিবারকে ক্রসফায়ারের ভয় দেখায় আসলাম। এ কারণে এতদিন
মুখ বুঝে ছিলাম। কিন্তু মেজর আরিফ গ্রেপ্তার হওয়ায় এখন সাহস পেয়েছি। {প্রাগুক্ত}
কী ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বাস করছি আমরা। যেখানে আমার জন্ম, জন্ম
আমার বাবারÑ সেখানে আমার চোখের সামনে আমার সন্তানকে তুলে নিয়ে খুন করে ফেলছে। আমি খুুনিদের চিনি। কিন্তু তাদের নাম বলতে পারছি না। তাদের বিরুদ্ধে নালিশ করতে পারছি না। এরচে’ কঠিন জঘন্য এবং পাষাণ সময় আর কী হতে পারে? যারা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বদ্ধভূমির ফেরি করে খায়, তারা কি স্বীকার করবেনÑ এখন যে পুরোটা বাংলাদেশই বদ্ধভূমি!
তিন.
তারা স্বীকার করবেন না। ভাবখানা এমনÑ দেশ যে গুম খুন আর একদলীয় সন্ত্রাসের তা-বে ল-ভ-Ñ এ যেন জীবন চঞ্চলতার স্বাভাবিক দৃশ্যপট। এরই মধ্যে ঘটলো নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাত খুনের বাকরুদ্ধকর ঘটনা। দিনের বেলা
শাসকদলের নেতা- নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে তার নির্বাচন এরিয়া থেকে তুলে নিয়ে যা"েছ। এর সঙ্গে আরও চারজন সতীর্থ। এই দৃশ্য মোবাইল ফোনে ধারণ করতে গিয়ে অপহরণের শেকলে বাঁধা পড়েন আইনজীবী চঞ্চল ও তার ড্রাইভার ইবরাহীম। এই সাতজনকে খুন করে নদীতে ফেলার সময় দেখে ফেলার অপরাধে দুই মাঝি ও দুই জেলেকে খুন করা হয়। এবং তাদেরও ডুবিয়ে ফেলা হয় নদীর গহীনে। এই ঘটনার পর কে বলবেÑ এই দেশটা আমাদের। এই ঘটনার ভাঁজে ভাঁজে যে পাষ-তা ও নির্মমতা ছড়িয়ে আছে তার ব্যাখ্যা দেয়ার ভাষা কার আছে শুনি! অন্তত মাঝি ও জেলেদের কী অপরাধ ছিল এই ঘটনায়? তাদের বিধবা স্ত্রী এবং এতিম সন্তানদের ভাষা বুঝবার ক্ষমতা কি সত্যিই এই দেশ ও সরকারের আছে? আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কথায় কথায় বলেন- তিনি বাবাহারা সন্তানের কষ্ট বুঝেন। যদি তাই হতো তাহলে তিনি ছুটে যেতেন নিহত জেলে এবং মাঝির ঘরে। হাত রাখতেন তাদের এতিম সন্তানদের মাথায়!
রাজনীতিকরা যেমন পাষাণ এখনকার খেলাধুলাও পাষাণ। শোকে নৃশংসতায় মুহ্যমান নারায়ণগঞ্জের স্মৃতিতে যখন
ক্ষুব্ধ স্তব্ধ ও স্তম্ভিত সারা দেশ, তখনই একই আগুনে জ্বলে উঠলো ফেনী। পত্রিকার শিরোনাম- প্রকাশ্য বর্বরতা : উপজেলা চেয়ারম্যানকে রাজপথে হত্যা ॥ গাড়িসহ পুড়িয়ে ভস্ম!
আর কী বলার থাকে? তবু জঘন্যতার মাত্রা নির্ণয়ের জন্য বলি- নিহত ছাই ভস্ম একরামুল হক ছিলেন সদ্য নির্বাচিত ফেনী ফুলগাজীর উপজেলা চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি। তিনি খুন হয়েছেন সকাল ১০টায় ( ২২.৫.১৪) ফেনী শহরের একাডেমি এলাকার বিলাসী সিনেমা হলের সামনে। অর্থাৎ গোপনে নয়, রাতেও নয়। গুলি করে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে হত্যা করার এমন জঘন্য দৃশ্য কোনো সভ্য পৃথিবী কখনো দেখেছে? বিশেষ করে এমন কোনো নির্বিবাদ পরিবেশে!
একটা দুঃখের কথা বলি। এই দুঃখ চলতি বিশ্বের এবং বিশ্বমানবতার। আমেরিকানরা এই যে জাহাজ ভরে উড়ে এসে মুসলমান খুন করে যাচ্ছে।
ইরাকে আফগানিস্তানে কিংবা লিবিয়ায়- সেখানে কি শুধু মুসলমানই খুন হ"েছন না বেঈমানরাও ধ্বংস হ"েছ! কাউকে মারতে গেলে মরতেও হয়। মরছে আমেরিকানরাও। কিন্তু সাহস করে জরিপ প্রকাশ করতে পারছে না- ঠিক কতজন ধ্বংস হয়েছে এ পর্যন্ত আমাদের শহরে। আমরা তার হিসাব রাখি না। শৃগাল কুকুর কতটা বাঁচল আর কতটা মরল- সে হিসাব রাখবে কে? কিন্তু এ দেশে যারা স্বদলের মানিকদের হাতে জীবন দি"েছ- তাদের একটা হিসাব থাকা চাই। হিসাবটা এই কারণে চাই- ভবিষ্যত প্রজন্ম যেন এখান থেকে কিছু শিখতে পারে। করণ- এখন যে খুন হত্যা আর গুমের ধুম চলছে এ কিন্তু কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনা নয়। ইলিয়াস আলীর এতিম কন্যার চোখের পানি আর বিশ্বজিতের তাজা রক্ত থেকে উৎসারিত এই আগুন। যদি ইনসাফ ও সুবিচারের জলে নেভানো না হয় এই আগুন- তাহলে পূর্ব-পশ্চিম আর উত্তর-দক্ষিণের সকল জালেম জনপদ পুড়িয়ে ছাই করবে এই আগুন। নেতা-কর্মী কাউকেই ছাড়বে না।
ঢাকা
২৬.০৫.২০১৪
আজানের সুরে হারিয়ে যাবে
মোদিদের সকল জয়রাম
মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন
মে'১৪
প্রতিবেশী ভারত এখন নির্বাচনি উন্মাদনায় উত্তাল। তাদের সেই রাজনৈতিক উন্মদনা মাঝেমধ্যে এদেশের বাতাসকেও তাপিয়ে যাচ্ছে। এক চাওয়ালার মাতাল বক্তব্য রীতিমতো শংকিত করে তুলেছে বিশ্বসভ্যতাকে। বিশেষ করে ক্ষমতায় গেলে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে যে হিন্দুপক্ষ ভারতে রূপান্তরিত করবে সেই স্বপ্ন এখন আর হিন্দুবাদি বিজেপির কাছে কোনো গোপন টার্গেট নয়। এ সম্পর্কে প্রকম্পিত একটি রিপোর্ট লক্ষ করুনÑ ‘বিজেপির লিফলেটে আহ্বান ॥ বাংলাদেশি মুসলিমদের হত থেকে ভারতকে রক্ষা করুন।’ সাম্প্রদায়িক বিষ উপলব্ধির জন্য এই শিরোনামটিই যথেষ্ট। তারপরও কালের সাক্ষী হিসেবে পুরো রিপোর্টটিই বলে রাখ ‘ভারতে চলমান লোকসভা নির্বাচনকে ঘিরে উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল হিসেবে পরিচিত ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মুসলিমবিরোধী প্রচারণা অব্যাহত আছে। গতকাল এনডিটিভির খবরে উল্লেখ করা হয় রাতের অন্ধকারে চুপি চুপি মধ্যপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলের প্রতিটি বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে বিজেপির মুসলিমবিরোধী লিফলেট। এর মধ্যে কয়েকটি লিফলেটের শিরোনাম ‘বাংলাদেশ থেকে আসা তিন কোটি মুসলিমের হাত থেকে ভারতকে মুক্ত কর এবং বিশ্বাসঘতকদের হত থেকে কাশ্মিরকে মুক্ত কর’ ইত্যাদি। এসব লিফলেট পৌঁছে দিচ্ছে বিজেপির সহযোগী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসোক সংঘ (আরএসএস) ও বিশ্বহিন্দু পরিষদের (ভি এইচ পি) কর্মীরা। খবরে বলা হয়Ñ‘ লিফলেটগুলোতে কোনো দলের নাম বা প্রতীক না থাকলেও বিজেপির পক্ষে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্রমোদী এবং দলটির সভাপতি রাজনাথ সিংয়ের ছবি রয়েছে। লিফলেটে তাদের দুজনকে ভোটদানের প্রতিও আহ্বান জানানো হয়েছে। এবং বলা হয়েছে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার গঠনে এদের ভোট দেয়ার বিকল্প নেই। {আমাদের সময় : ২৪. ৪. ১৪}
রিপোর্টটি পড়ার সময় একটি গল্প মনে পড়ল। আমাদের এক অগ্রজপ্রতীম সুহৃদ। ঢাকার আরজাবাদ মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা তৈয়ব সাহেব। তার মসজিদ কমিটির একজন পদস্থ ব্যক্তি। রাজনীতির সুবাদে কওমি মাদরাসার প্রতি ঈষৎ এলার্জি আছে। একবার এসে শুকনো মুখে তাকে বললেন, হুজুর, সরকার তো কওমি মাদরাসা বন্ধ করে দিবে!
: তাই নাকি, খুব ভালো কথা এবং খুশির সংবাদ। তা কবে করবে?
: ভালো কথা মানে?
: মানে খুবই ভালো সিদ্ধান্ত। কবে করবে আর আমরা কিভাবে সহযোগিতা করতে পারি বলুন তো!
: আপনি কওমি মাদরাসায় পড়েননি?
: পড়েছি এবং এখনো পড়াচ্ছি!
তারপরও কওমি মাদরাসা বন্ধের সংবাদকে খুশির সংবাদ বলছেন। বলছেন সাহায্য করার কথা। বুঝলাম না!
: বুঝলেন না কেন? আপনিতো শিক্ষিত মানুষ। আপনার জানা থাকার কথাÑ আমাাদের মাদরাসা শিক্ষার প্রাচীন রূপ আজকের মতো বিশেষ স্থান ও ভবনকেন্দ্রীক ছিল না। প্রত্যেক বড় আলেম তার নিজ বাড়িতে কিংবা মহল্লার মসজিদে বসে দ্বীনিশিক্ষা দান করতেন। দেশ বিদেশের শিক্ষার্থীগণ তার সান্নিধ্যে এসে জ্ঞানতৃষ্ণা মেটাতো। ফলে মুসলমান সমাজের প্রত্যেক আলেমের বাড়িই ছিল একটি মাদরসা। পরবর্তীকালে মাদরাসাশিক্ষা নির্দিষ্ট স্থান ও ভবনকেন্দ্রীক হয়ে পড়ায় মাদরাসা সংখ্যা যেমন কমে গেছে তেমনি শিক্ষালাভের সুযোগও
সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। দয়া করে সরকার যদি প্রচলিত মাদরাসাগুলো বন্ধ করে দেয় ইসলামের অনেক বড় উপকার হবে। আবার আলেমদের ঘরে ঘরে মাদরাসা গড়ে ওঠবে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রেক্ষিতে তা খুবই জরুরি। এতে করে দীনিশিক্ষার পথ আরও সহজ ও সম্প্রসারিত হবে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবানে আমাদের সহযোগিত করা উচিত। মসজিদে আলোচনাসহ কী কী পন্থায় আমরা সরকারকে সহযোগিতা করতে পারি পরামর্শ দিন!
ততক্ষণে বেচারা পদস্থ ব্যক্তির গলা শুকিয়ে কাঠ!
মোদিদের লম্ফঝম্পের ব্যাপারটিও অনুরূপ। এরই মধ্যে নরেন্দ্র মোদি ও তার পার্টি বিজেপি ঘোষণা দিয়েছেÑ তারা ক্ষমতায় গেলে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের স্থানে রামমন্দির বানাবে। এদেশের মানুষ জানেÑ এই বিজেপির নেতৃত্বেই ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে ভারতের এই মসজিদটি শহিদ করা হয়েছিল। আমার সৌভাগ্য কি দুর্ভাগ্য জানি না যখন বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয় তখন আমি ভারতে ছিলাম। উত্তর প্রদেশের দারুল উলুম দেওবন্দে তখনও পড়াশোনা করছি। সেই উমা ভারতির হিংস্রভাষণ আজো ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক ভয়াবহ ক্ষত হয়ে আছে। উমা ভারতী করসেকদের ভেতর পশুত্বের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। তার কণ্ঠে উচ্চারিত ইতিহাসের জঘন্যতম শ্লোগান ‘এক ধাক্কা আওর দো/ বাবরি মসজিদ তোড় দো,
পাষান উন্মত্ততায় উন্মাদ শিবসেনার সদস্যরা ‘ভগবান রাম কি জয়’ বলে লাফিয়ে ওঠে খোদার ঘরে সুউচ্চ গম্বুজে। চরম পাশবিকতায় দুলে উঠে শাবল কুড়াল। শহিদ হয় আল্লাহর ঘর। উগ্র হিন্দুদের রক্তে ছড়িয়ে পড়ে বিজয়ের অট্রহাসি। ভারতে কোটি কোটি মুসলমান ভয়ে শংকায় কুঞ্চিত হয়ে পড়ে। নিরাপত্তার নামে চলে পুলিশি সন্ত্রাস।
কিন্তু সত্যিই কি ভারতে হেরে গেছে মুসলমানগণ? এই প্রশ্ন নানা কারণেই এখন অর্থবহ। ক্ষুদ্র একটি দিক বলি! বাবরি মসজিদের শিরে প্রথম যে আঘাত করেছিল তার নাম বলবীর সিং। তার সহযোদ্ধা বন্ধু ছিল এক জমিদার পুত্র যোগীন্দ্রপাল। বাবরি মসজিদ শহিদ করার পর কৃতিত্বের স্মৃতি সরূপ দুটি ইট সঙ্গে নিয়ে যায় এই দুই বীর শিবসেনা। অতঃপর জমিদারপুত্র যোগীন্দ্রপাল ধর্মবিদ্ধেষের উন্মাদনায় মসজিদের ইটে প্রস্রাবের আয়োজন কর। আল্লাহ যুলজালাল এর ক্রোধ আর কতটুকু সয়। যোগীন্দ্র প্রথমে পাগল হয়। তারপর হয় মুসলমান। তার দাওয়াতে ইসলাম কবুল করে তার বন্ধু বলবীরও। {সবিস্তারে পড়ুন ভারতীয় নওমুসলিমদের ঈমানজাগানিয়া সাক্ষাৎকার : ১/৭৩}
বলবীর মুসলমান হয়ে এখন মুহাম্মদ আমের। এইতো গত ২১.৪.১৪ সোমবার সরাসরি দেখা হলো এই আমের সাহেবের সঙ্গে। ঢাকায় এসেছিলেন তিনি অমুসলিমদের মাঝে দাওয়াতি প্রোগ্রাম নিয়ে। তার দেশে অমুসলিমÑ মানে হিন্দুদের দ্বীনি দাওয়াত যে ভীষণ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে সবিশেষ দলিতদের সামনে সামান্য ভালোবাসার দুটি বাক্য মুহূর্তে বদলে দিচ্ছে জীবন। চোখে দেখা অভিজ্ঞতার আলোকে বলে গেলেন সেসব কথা। বললেন ভারতে হিন্দুরা এখন ঝাঁকে ঝাঁকে মুসলমান হচ্ছে। বিশ্বাস করি মুসলমানগণ যদি সামান্য সচেতন হোন পৃথিবীব্যাপীই এক অভাবিত বিপ্লব হয়ে যাবে। কারণ সমকালীন পৃথিবীতে মানব মনে পূর্ণ স্বস্তি এবং আধুনিক মনের সকল প্রশ্নের উত্তর একমাত্র ইসলাম ছাড়া আর কোথাও নেই।
মুহাম্মদ আমেরকে বললাম ভারতে ব্যাপকভাবে হিন্দুরা মুসলমান হচ্ছে শুনেছি। কিন্তু সেখানকার সরকার তো বলছে এখনো মুসলমানসংখ্যা মাত্র পচিশ কোটি।। আসলে বিষয়টা কী? বলল, প্রতারণা! মিথ্যা জরিপ দিয়ে মুসলমানদেরকে হতবল করে রাখতে চাইছে। এখন ভারতে মুসলমানের সংখ্যা কোনো ভাবেই পয়ত্রিশ কোটির কম না। বললাম, পয়ত্রিশ থেকে পয়তাল্লিশ কোটির কথাও কেউ কেউ বলছেন। বললেন, হতে পারে। তবে এরই মধ্যে জমিয়তে উলামা এবং তাবলিগজামাত নিজেদের উদ্যোগে জরিপ করতে শুরু করেছে। বললাম, ওরা ভুল তথ্য দিচ্ছে কেন? বলল, ভয়ে!
তার সঙ্গে আর দীর্ঘ কথা হয়নি। রাত তখন অনেক হয়ে গেছে। তাছাড়া আমি তার ইসলামগ্রহণ সম্পর্কিত দীর্ঘ ইন্টারভিউটি আগেই পড়েছি। তিনি তার ইন্টারভিউতে বলেছেনÑ আমি ও আমার বন্ধু যোগীন্দ্রপাল (বর্তমান নাম মুহাম্মদ উমর) মিলে ঠিক করেছি আমরা বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রায়শ্চিত্র করবো। আমি অঙ্গীকার করেছি অন্তত একশ অনাবদ মসজিদ আবাদ করব। আর আমার বন্ধু উমর একশ নতুন মসজিদ তৈরি করবে। ২০০৯ সালের জুলাই পর্যন্ত তারা ৬৭ টি মসজিদ আবাদ করেছে। আর নতুন মসজিদ নির্মাণ করেছে ৩৭টি। সুতরাং বলতে হয় না ২০১৪ সালে তাদের অঙ্গীকার ষোলআনা পূর্ণ।
মাত্র দুইজন নওমুসলিম যদি এক বাবরি মসজিদ ভাঙার দায় থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্যে দুইশ মসজিদ উপহার দিতে পারেন তাহলে বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির উঠলে তার পরিণতি কি হবে? হয়তো বিষয়টি মোদিরাও জানে। জানে বলেই কখনো বলছে ‘বাংলাদেশি তিন কোটি মুসলমানের হাত থেকে ভারতকে রক্ষা করো’ আবার কেউ বা দাবি করছে বাংলাদেশের এক তৃতীয়াংশ ভুখণ্ড নাকি তাদের। প্রলাপ থেকেই অনুমান করা যায় মোদিদের মাথা কতটা খারাপ হয়েছে।
সত্যিকার অর্থে ভারতের মুসলমান সংখ্যা যদি চল্লিশ কোটিও হয় যেমন বলছেন ভারত জমিয়তে ইলামার প্রধান মাওলানা সায়্যিদ আরশাদ মাদানীÑ তাহলে বলতে হবে মুসলমানরাই এখন ভারতে সংখ্যাগুরু জাতি। ‘হিন্দুধর্ম’ নামে নানাধর্মের যে খিচুড়ি শতশত বছরর ধরে পরিবেশিত হচ্ছে তা এখন স্বরূপে প্রকাশিত হওয়ার সময়। ভগবান আলাদা, গ্রন্থ আলাদা, বিশ্বাস আলাদা। আবার ধর্ম এক। একি হয়? একটা মিথ্যা বিশ্বাস কতদিন চলতে পারে! সত্যিকথা কিÑ ওই যে আমাদের বন্ধু মাওলানা তৈয়ব সাহেব বলেছেন
সরকার যদি মাদরাসা বন্ধ করে দেয় উপকার হবে আমাদেরই। উলামায়ে কেরামের প্রতিটি ঘর হবে তখন একেকটি মাদরাসা। হয়তো মোদিদের আঘাতে ভারতের প্রতিটি মুসলমানের আত্মায় জন্ম নিবে দাওয়াতের বীজ। অতঃপর তাদের কান্না আর দীর্ঘশ্বাস থেকে বিরিয়ে আসবে .......... আর যোগীন্দরা আমের আর উমর হয়ে। আর তাদের হাতে নির্মিত হবে নতুন নতুন মসজিদ হিন্দুত্ববাদী ভারতের পাড়ায় পাড়ায়। ভারতের নানা প্রান্তে অবহেলায় অনাবাদ মসজিদগুলো আবার জেগে ওঠবে নামাজে তেলাওয়াতে জিকিরে দাওয়াতের সুমধুর গুঞ্জরনে। হয়তো সেদিন দূরে নয়Ñ যেদিন আজানের সুরে হারিয়ে যাবে মেদিদের সকল ‘জয়রাম’।
ঢাকা : ২৫. ৪. ২০১৪
দিন ফুরিয়ে এসেছে দাদা আমেরিকার
মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন
এপ্রিল'১৪
‘যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকায় শয়তান-উপাসকদের মন্দির’ সংবাদটি যারা পড়েননি তারাও বিশ্বাস করেন- যুক্তরাষ্ট্র আসলেও তাই। কেউ কেউ তো রসিকতা করে বলেন- পশ্চিমারা শয়তানের উপাসনা করবে কেন। শয়তানই ওদের উপাসক। এ সম্পর্কে পুরনো একটা কৌতুক আছে। এক শক্তিমান নারীবান্ধব রাজা। অবশ্য তাকে নারীকাতর বললেই বেশি ভালো হয়। তার হঠাত মনে হলো- মুসলমান খাতায় যখন নাম পড়েছে হজটাও করে নিই। পরপারে যাইহোক জনগণ তো বুঝবে আমি অন্তত অধার্মিক নই। যেই ভাবা সেই কাজ। প্রস্তুতি শুরু হলো হজের। সঙ্গে এক ঝাঁক তন্বী রূপসী। রাষ্ট্রীয় নিয়মের চাপে কতিপয় সাংবাদিকও। বেচারা রাজা রূপসীদের মন রক্ষা করলেও সাংবাদিকদের সময় দিতে পারলেন না। ফলে সাংবাদিকসমাজ সাংঘাতিকরকমের খেপে যায়। দেশে ফিরে গিয়ে এক সাংবাদিক তার পত্রিকায় ওই রাজামহোদয়কে নিয়ে একটি কার্টুন প্রকাশ করে। কার্টুনে দেখা যায়- শক্তিমান রাজা প্রবল উদ্দামে প্রতীকি শয়তান-স্তম্ভে পাথর ছুঁড়ছেন। আর পাথরের পেছনে সামান্য মাথা বের করে ক্ষেদিত আহত শয়তান বলছে-‘ওস্তাদ! তুমিও মারলা!’ সংক্ষেপে এই হলো পশ্চিমাবিশ্ব!
এই পশ্চিমা বিশ্বের মন্ত্রপাড়া হলো আমেরিকা। জাতিসংঘ দপ্তর হলো তার মন্দিরসম। যারা শয়তান ও মানুষের গোড়ার দ্বন্দ্বটা জানেন তারা অবাক হন না যখন দেখেন-আমেরিকা সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে গিয়ে ইরাকে নির্বিচারে খুন করছে মানুষ। নারী শিশু আর অসহায় বৃদ্ধরাও রক্ষা পাচ্ছে না তাদের হাত থেকে। অধিকন্তু ওই খুনিদের মুখে ফেনায়িত গণতন্ত্র শব্দটাকে কেন প্রসব করেছে তাও বুঝতে অসুবিধা হয় না কোনো মানুষের।
আফগানিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ। এখানে আমেরিকা আসবে কেন? অথচ আমেরিকাই পর্বত আর সমতল জনপদ ভরে দিয়েছে মানুষের লাশে। সেই লাশ নারীর শিশুর এবং নিরস্ত্র নাগরিকদের। আর এই খুনের উতসবকে নাম দিয়েছে শান্তিমিশন। সচেতন বিশ্ববাসী নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে- আসলে শান্তি অর্থ কী? অন্তত শান্তি শব্দটা যখন আমেরিকা ব্যবহার করে। হয়তো ভবিষ্যতের মানব গোষ্ঠী তাদের অভিধানে এই নিরিখেই নির্ণয় করবে শব্দটির অর্থ।
চলতি বিশ্বের সকল অস্থিরতা বিশৃংখলা আর মানুষ হত্যার উতসভূমি যে আমেরিকা একথা হয়তো কোনো অন্ধও অস্বীকার করবে না। এই তো সেদিন আমেরিকার পা-চাটা সেবাদাস হামিদ কারজাইও বলল- ‘তালেবান আমার ভাই, মার্কিনরা শত্র“।’ হামিদ কারজাইর এই বাণী ‘আমেরিকা যার বন্ধু তার শত্র“র প্রয়োজন নেই’ বলে যে একটা প্রবাদ আছে সেটাকেই মনে করিয়ে দেয়। কারজাই খেদের সঙ্গে বলেছেন- ‘যুক্তরাষ্ট্র তার কোনো উপকার করেনি। বরং তার বিরুদ্ধে কাজ করছে। তার শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র ৬৪৮ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে আফগাস্তিানে। তবে যে অর্থ তার দেশের পুলিশের পেছনে খরচ করার কথা ছিল, তা না করে যুক্তরাষ্ট্র বেসরকারি মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে তোলার পেছনে খরচ করেছে। এতে দেশে আরও আইনবর্হিভূত কর্মকাণ্ড ও মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনা বেড়েছে। আফগানিস্তানের অর্থ কিছু ব্যক্তির পকেটে কেন্দ্রীভূত করেছে যুক্তরাষ্ট্র্র। এতে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বৈষম্য বেড়েছে এবং একই কারণে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। {আমাদের সময়: ৮.২.১৪}
অর্থাত শুধু মানুষ মেরে ক্ষান্ত হয়নি বুশেরা। দুর্নীতি ও ডাকাতিকে একটা প্রাতিষ্ঠানিকতায় পৌঁছে দিয়েছে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। আর ছড়িয়ে দিয়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে চলে আসা সরল সহজ আফগানরা পরস্পর বিরোধ-সংঘাত ও শ্রেণিবৈষম্যের পাক থেকে বেরিয়ে আসতে না পারে সেজন্য শোষণ ও নিষ্পেষণের কী ভয়াবহ ফাঁদ! আমেরিকা মুসলিম বিশ্বের সবচে পাষাণ ও জঘন্য যে ক্ষতিটা করেছে তাহলো- আরব বসন্তের নামে অসীম নৈরাজ্যের বমন। মানুষ মারার অভিশপ্ত মন্ত্র গণতন্ত্রের বাদ্যবাজিয়ে যেভাবে চলছে খুনের উতসব তা কোনো সভ্যসমাজ মেনে নিতে পারে না। রক্তে ভাসছে ঐতিহ্যের দেশ মিসর। মাঝে মধ্যে দমকা হাওয়ার পাগলা থাবা কম্পিত করে যাচ্ছে সৌদিআরবসহ শান্তিসমাহিত অনেক আরব দেশকে। ছুতো সেই গণতন্ত্র এবং মতের স্বাধীনতা। কোন দেশ কোন তন্ত্রে চলবে সেটা ঠিক করবে সে দেশের জনগণ ও তাদের যাপিত বিশ্বাস। মানবাধিকারের এই চিরন্তন ধারাকে মাঝে মধ্যেই গলা চেপে ধরছে দজ্জাল আমেরিকা। বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানবসমাজ এই উন্মত্ত দানবের ভয়ে চিরন্তর মানবাধিকারের এই শাশ্বত দাবিটুকু উচ্চারণ করতে পারছে না। কী পাথরসময় যাচ্ছে পৃথিবীর। ঠিক এই ভয়-কম্পিত সময়েই এলো একটি মধুর সংবাদ। আমেরিকার ঘরে ভাঙনের কলরব। পঞ্চাশটি অঙ্গরাজ্য নিয়ে সগর্বে প্রতিষ্ঠিত দাদা আমেরিকার ২৯টি অঙ্গরাজ্য স্বাধীনতা চায়। দর্পে দাপটে খুনে সন্ত্রাসে পৃথিবীর রাজ-সংসার থেকে আলাদা হয়ে আসার স্বপ্নে দুলে ওঠেছে এই ২৯টি অঙ্গরাজ্য। তাদের একটাই আকুতি-আমরা যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকার সঙ্গে থাকতে চাই না। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আলাদা হয়ে থাকতে চাই। মিশে যেতে চাই মানুষের পৃথিবীর সঙ্গে।
পত্রিকার ভাষায়- যুক্তরাষ্ট্রের ২৯টি অঙ্গরাজ্যের তিন লাখের বেশি নাগরিক দেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার দাবি নিয়ে আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করেছে। এই আবেদনপত্রে মার্কিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে যেখানে এ অঙ্গরাজ্যেকে অন্যের সাথে আবদ্ধ রাখার রাজনৈতিক বন্ধনকে জনগণের নিরাপত্তা ও শান্তি নিশ্চিত করতে ছিন্ন করা যেতে পারে। আবেদনকারীরা শান্তিপূর্ণভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অধিকার বা গণভোট অনুষ্ঠানের সুযোগ দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। আবেদনে স্বাক্ষরকারীরা মনে করেনÑ প্রেসিডেন্ট ওবামার অর্থনৈতিক সংস্কার অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া মার্কিন গত দুই বছর ধরে নাগরিকদের স্বাধীনতার অধিকার খর্ব করে চলেছে।
যুক্তরাষ্ট্র সবচে অর্থনৈতিক সচ্চল অঙ্গরাজ্য টেক্সাস সর্বপ্রথম যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আন্দোলন শুরু করে। গত সোমবার (১৭.৩.১৪) পর্যন্ত প্রায় ৭০ হাজার টেক্সাসবাসী হোয়াইট হাউজের ওয়েবসাইটে তাদের দাবি জানিয়ে স্বাক্ষর করেছে। তারা চায়, প্রেসিডেন্ট ওবামা তাদের শান্তিপূর্ণভাবে বেরিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেবেন বা এ ব্যাপারে গণভোট অনুষ্ঠানের সুযোগ করে দিবেন। তারা প্রেসিডেন্টের কাছে তাদের দাবির স্বপক্ষে ব্যাখ্যায় বলেছেন- ফেডারেল কর্তৃপক্ষের ভুলনীতি, দুর্বল অর্থনৈতিক সংস্কার ও মার্কিনিদের অধিকার ভূলুণ্ঠিত করার কারণে তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে যেতে চায়। ২৯টি অঙ্গরাজ্যের স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে উদারপন্থী ও রিপাবলিকান দলের সমর্থক- উভয় শ্রেণির মানুষ রয়েছে বলে যানা গেছে। (নয়াদিগন্ত: ২২.৩.১৪)
এই সংবাদটির শক্তি উপলব্ধির জন্য মনে রাখতে হবে- পঞ্চাশটি অঙ্গরাজ্য নিয়ে গঠিত এই বিশাল আমেরিকার মোট জনসংখ্যা তিরিশ কোটির উপরে মাত্র। সেই বিচারে তিন লাখের অধিক নাগরিকের এই ওয়েবসাইট আবেদন সাধারণ কথা নয়। তাও পঞ্চাশটির মধ্যে ২৯টি চাচ্ছে এই স্বাধীনতা। আর তার কারণ হিসেবে দেখিয়েছে প্রধানত তিনটি বিষয়।
এক. কর্তৃপক্ষের ভুলনীতি বা প্রশাসনিক ব্যর্থতা। দুই. অথনৈতিক সংস্কারে দুর্বলতা। তিন. মার্কিনিদের অধিকার পদদলিত করা।
যারা পৃথিবীতে নাগরিক অধিকার, মতের স্বাধীনতা আর পবিত্র (?) গণতন্ত্রে ফেরি করে বেড়ায় এই অভিযোগ সোজা তাদের বিরুদ্ধে। অভিযোগও কল্পিত নয়। ২০০৯ সালের একটি সংবাদ শিরোনাম ছিল এমন- ‘যুক্তরাষ্ট্রে ১৬ বছরের মধ্যে সর্বাধিক বেকারত্ব: ২৬ লাখ লোক চাকরিচ্যুত: বেকার ৭.২ শতাংশ।’ (ইনকিলাব: ১১.১.২০০৯)
অর্থাত যে অর্থের বলে বিশ্বব্যাপী মোড়লপনা সেই অর্থের ভগ্নদশা যে কাটিয়ে উঠতে পারেনি মার্কিন প্রশাসন সর্বশেষ স্বাধীনতার দাবিই তার উজ্জ্বল প্রমাণ। কিন্তু তাদের অধিকার কিভাবে ভুলণ্ঠিত হয় সংবাদে তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ব্যাখ্যা নেই- ‘মার্কিন সরকার গত দুই বছর ধরে নাগরিকদের স্বাধীনতার অধিকার খর্ব করে চলেছে’ কথাটিরও।
তবে আমরা এতটুকু অনুমান করতে পারি- স্বাধীনতা ও অধিকারের বিষয়টি তুচ্ছ পানবিড়ির অধিকার নয়। দেশের তিন লাখের বেশি শিক্ষিত নাগরিক বিড়িটানের স্বাধীনতার জন্যে দেশ ভেঙে দেয়ার আবদার জানাতে পারে না।
কারো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। জল্লাদ বুশ যখন ইরাক আক্রমণ করে তখন মার্কিনিদের বোমা হামলায় শুধু ইরাকিরাই মরেনি। তারা মেরেছেও প্রচুর। মরুসাহারায় ধুলোর ঝড়ে কত মার্কিনি হায়েনা মারা পড়েছে তার সংখ্যা কি কোনো সংস্থা আজো প্রকাশ করেছে? আর আফগানিদের তারাবোরা পাহাড়ের গহীনে হারানো মার্কিনিদের সংখ্যা তো আরো ভয়াবহ।
এরা সবাই যুক্তরাষ্ট্রের সন্তান। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে বাঁধনহারা পশুসভ্যতায় উন্মাদ মাকির্নিদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার মাত্র ০.৯%! যৌন ও প্রজনন ক্ষমতার সবটাই বান্ধবীদের গিফট-পথে খরচ হয়ে যায়। ফলে সন্তান জন্মের হার প্রায় শূন্যের কোঠায়। এই শূন্যের ফাঁক গলিয়ে যাই দু‘চারটা আসছে তাও হারিয়ে যাচ্ছে পরের দেশে মাস্তানি করতে গিয়ে। স্বাধীনতার অধিকার খর্ব করার অভিযোগ ইঙ্গিত করে- পরের দেশে শুধুই মাস্তানি করা এবং মানুষ খুন করতে যাওয়ার প্রতি হয়তো মার্কিনিদের ইচ্ছার বাইরে বাধ্য করা হয়। সহজ কথা-জীবনের মায়া তো নির্বোধ কুকুরেরও আছে। পরের দেশে মরতে যেতে কোনো মস্তান সখের বশে রাজি হলেও তার মা বাবা তো বাধা দেয়ার কথা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন তাদের বাধ্য করছে যুদ্ধে যেতে- মানুষ মারতে, নিজে মরতে, এরই প্রেক্ষিতে প্রতিবাদ ওঠেছে স্বাধীনতার নামে।
এটা জানা কথা- মার্কিনিরা পৃথিবীর অন্যতম সচেতন জাতি। তারা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার মাত্র ০.৯%। তার উপর আছে- ‘যুক্তরাষ্ট্র ২ বছরে গুলিতে নিহত ৩০ হাজার’ -এর মতো। তথ্য- (আমাদের সময়: ১২.১১.১৪) আবার যদি যুদ্ধে জীবন দেয় সমাজের হৃদয়ের স্পন্দন যুবকেরা তাহলে অদূর ভবিষ্যতে পুরো মার্কিন মুল্লুক যাবে অভিবাসীদের দখলে। গণতন্ত্রের অংকে স্বদেশে মার্কিনিরা হবে সংখ্যালঘু। আর যেভাবে অভিবাসী ও সামান্য সংখ্যক মুসলমানরা বিয়ের উষ্ণ পথে সন্তান দান করে যাচ্ছেন তাতে ওই সংখ্যালঘু হওয়ার তত্ত্বটাকে কাল্পনিক বলে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। একথা হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের সবচে ধনী অঙ্গরাজ্য টেক্সাসও বুঝেছে। তাই ওই স্বাধীনতার আবদার। আমরা জানি, স্বাধীনতার বিদ্যুত যদি একবার যুবকের রক্তে ছড়িয়ে পড়ে- নতুন পতাকা উড়িয়েই কেবল শান্ত হয় সেই রক্তেপোড়া উত্তাল অঙ্গীকার। সুতরাং প্রস্তুত হও হে দানব আমেরিকা ভেঙে খান খান হওয়ার জন্য। হে নির্যাতিত মানুষের পৃথিবী শক্ত হও ঘুরে দাঁড়াবার অঙ্গীকারে। তোমাদের ভোর এখন শুধুই সময়ের ব্যাপার।
ঢাকা- ২৩.৩.২০১৪
০০০০০০০০০০০০
বাঁধনহারা এই মাতাল সময়ে স্বপ্ন ও সভ্যতার নির্ভয় আশ্রয়
মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন
মাচ'১৪ একটি মজার ঘটনা দিয়ে শুরু করি। নাম খাওয়াত। বাবার নাম জুবাইর। তার উর্ধ্বতন চতুর্থ পুরুষ কবিসম্রাট ইমরুল কায়েস। খাওয়াত ছিলেন একজন আনসারি সাহাবি। বদর ও ওহুদসহ বড় বড় অনেক যুদ্ধ নবীজি সা. এর সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছেন। ঘটনাটা তাঁর।
তখনো মুসলমান হননি। হাঁটতে গিয়ে দেখলেন ক’জন আরব্য রমনী। মন ‘সন’ হয়ে উঠল। রমনীরূপ তাকে টেনে ধরেছে। ভাবলেন কিভাবে গল্প পাতা যায় এদের সঙ্গে। পথ একটা পেলেন সঙ্গে সঙ্গে। কাছে গিয়ে বললেন, আমার উটটি পালিয়ে গেছে। বাঁধব। রশি দরকার। তোমরা আমাকে সামান্য রশি পাকিয়ে দিবে? তারপর রশির ছুতো ধরে বসে পড়লেন রমনীরসঙ্গে।
ঘটনাক্রমে একটু পরেই সে পথে যাচ্ছিলেন নবীজি সা.। মেয়েদের সঙ্গে খাওয়াতকে দেখে বিষয়টি আঁচ করলেন। কিছুই বললেন না। চলে গেলেন। তারপর যখন হযরত খাওয়াত রা. মুসলমান হলেন নবীজি মুচকি হেসে বললেন- ‘তোমার পলাতক উটের খবর কী?’ ইঙ্গিত বুঝে ফেললেন খাওয়াত। বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! ইসলাম ওটাকে বেঁধে ফেলেছে।’ [ইসাবা-তরজমা :২৪৪৩, সিরাতে হালবিয়া ২/১৪৭ এর সূত্রে দরসে মাকামাত : ২৬৮]
কথা হলো বাঁধন, এই বাঁধনের শক্তিতেই ইসলাম পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক সৌন্দর্যবিকশিত ধর্ম। এই বাঁধনে বিকশিত সৃংখলাশক্তিই একদা এই পৃথিবীকে দান করেছিল এক অবাক করা সমাজচিত্র। অভাবিক শান্তি সমাহিত এই সমাজের যারা প্রতিষ্ঠাতা তাদের সম্পর্কে কোরআন বলেছে ‘মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল, তাঁর সঙ্গিীগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল; আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে রুকু ও সেজদায় অবনত দেখতে পাবে। তাদের দৃষ্টান্ত একটি চারাগাছ। যা থেকে নির্গত হয় কিশলয়, অতঃপর তা শক্ত ও পুষ্ট হয় এবং পরে কাণ্ডের উপর দাঁড়ায় দৃঢ়ভাবে। যা চাষীর জন্যে আনন্দদায়ক।’ [ ফাতাহ:২৯]
ইসলাম একটি বাঁধন, একটি স্বভাবজাত যুক্তিগ্রাহ্য নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। এই নিয়ন্ত্রণ মানবজীবনের ইচ্ছা-স্বপ্ন-সখকে গলাটিপে হত্যা করে না। বরং সুনিয়ন্ত্রিতভাবে বিকশিত করে, করে অর্থময়। এই বাঁধনের শক্তিতেই যূথবদ্ধ বিকাশে পৃথিবীকে একদা প্রকম্পিত, শিহরিত ও ভাবান্তরিত করেছিল। ফলে সমকালীন পৃথিবীর অভিধানে ইসলামের বিজয় এবং ইসলাম আর সম্মান সমার্থক হয়ে উঠেছিল। এই বাঁধনশক্তিকে উপেক্ষা করে যখনই আমরা স্বাধীন হতে চেয়েছি, তখনই পতিত হয়েছি, হয়েছি সমকালীন পশুসভ্যতার খেলার পুতুল। এই বাঁধনহীনতার বন্য উপমার এখন অভাব নেই। দুটি জঘন্য উপমার কথা বলি। এক. ধর্মের নামে চালিত কথিত গায়রে মুকাল্লিদ সম্প্রদায়। এরা নিজেদেরকে ‘আহলে হাদিস’ কখনো বা ‘সাল্ফি’ নামে পরিচয় দিয়ে বেড়ায়। কথায় কথায় হাদিস ও বুখারি শরিফ বলে। কিন্তু হাদিস ও বুখারি শরিফ যাদের নিয়মিত পাঠের বিষয়- আলেম সমাজ তাঁদের সঙ্গে এরা বসতে নারাজ। বরং আজান শুনলে যেমন শয়তান পালায় আলেম দেখলেও তারা সেভাবেই পালায়। আর যারা হাদিস বুঝে না, বুঝে না বুখারি শরিফ আর মোহাম্মদী পঞ্জিকার পার্থক্য, তাদেরকে গিয়ে হাদিস বুঝায়। যে নামাজ পড়ে না তাকে জীবনেও নামাজের দাওয়াত দেয় না। যে মসজিদে গিয়ে নিয়মিত নামাজ পড়ে তাকে বলবে এখানে বেঁধেছো? তোমার নামাজই হয়নি। যে কোরআন পড়তে পারে না, তাকে কোরআন শিখাবে। কোরআন শুদ্ধ পড়তে না পারলে নামাজ হয় না। সে কথা বলবে না। বললে যদি বলা হয়- তাহলে তুমি আমাকে শুদ্ধ করে পড়িয়ে দাও। বরং বলবে- ফাতেহা না পড়লে নামাজ হয় না। যদি বলা হয়, তাহলে শুদ্ধ করে ফাতেহাটা শিখিয়ে দাও। সঙ্গে সঙ্গে সটকে পড়বে আলোর আগমনে ভূতের পলায়নের মতো। কেন? ওদের আসল উদ্দেশ্য- মুসলমানদের মাঝে এটা হয়, ওটা হয় না বলে হতাশা সৃষ্টি করা। এবং বিশেষ করে মুসলমান সমাজের শেকড় আলেম সমাজ থেকে সাধারণ মানুষকে ছিন্ন করে ফেলা। যেন শেকড়ছেড়া এই সমাজকে যে কেউ যে কোনো নামে একটানে ইসলাম থেকে আলাদা করে ফেলতে পারে।
দুই.
আমাদের এই আশঙ্কা যে অমূলক নয় তারও অনেক দৃষ্টান্ত আছে। এরই মধ্যে আমরা পত্রপত্রিকায় দেখেছি- আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড কৃষকরা তাদের রক্ত ও ঘামে উতপাদিত আলু পথে ফেলে তার উপর শুইয়ে পড়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। পত্রিকায় এসেছে কোথাও কোথাও আলুর কেজি শুধু পঁচাত্তুর পয়সা। অথচ এরই পাশে এক আগুনধরা সংবাদ শিরোনাম ‘বসন্তউতসব ও ভালোবাসা দিবসে যশোর থেকেই গেছে পাঁচ কোটি টাকার ফুল।’ অতঃপর সংবাদে বলা হয়েছে- বাঙালি বসন্তবরণ ও বিশ্বভালোবাসা দিবসের আগেই দুই দিনে যশোরের গদখালির পাইকারি ফুলের বাজার থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে অন্তত পাঁচ কোটি টাকার ফুল গেছে। আর পয়লা বসন্তে গতকাল ১৩.০২.১৪ বৃহস্পতিবারও প্রায় ২০ লাখ টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যশোর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে এ বছর যশোর জেলায় ৫৯৩ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের ফুলের চাষ হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে মোট নয় হাজার ২০ জন কৃষক। [ প্রথম আলো:১৪.০২.১৪]
বলতে দ্বিধা নেই এই যে আলু টনে টনে পঁচছে, মরছে আলুচাষী কৃষক আর ফুল বিক্রি হচ্ছে কোটি কোটি টাকার, হাসছে ফুলচাষী এই হাসিকান্না আলু ও ফুলের নয়। জীবন ও বসন্তের কিংবা জীবন ও প্রেমের। সন্দেহ নেই- কবিতার জন্যে এ এক অনুপম অপূর্ব শুভসংবাদ। আমাদের এই দেশে এখন তুচ্ছ আলুর চাইতে ফুলের কদর বেশি। মানে এখানে বেঁচে থাকার চাইতে ভালোবাসার মূল্য অনেক বেশি। অতঃপর সেই প্রেম ও বসন্তের একটি আধুনিকতম টাটকা সংবাদ দিই ‘বসন্ত উতসবে বয়ফ্রেন্ড ভাড়া’ সংবাদ শিরোনাম। অতঃপর সংবাদ ভাষ্য বসন্তে সঙ্গীর অভাব ও একাকীত্ব দূর করতেই চীনে গড়ে উঠেছে বয়ফ্রেন্ড ভাড়া দেওয়া প্রতিষ্ঠান। এবারেে বসন্তেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। চীনাদের সবচেয়ে বড় বসন্তবরণ উতসব গত শুক্রবার [৭.২.১৪] থেকে শুরু হয়েছে। এ উতসবকে অবিবাহিত, বয়ফ্রেন্ডহীন তরুণীদের জন্য অশুভ বলে ধারণা করা হয়। এ কারণেই বহু পরিবার তাদের অবিবাহিত মেয়েদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকে। তাই এ ব্যবস্থা। চীনের অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান টোওযোয়ারে বয়ফ্রেন্ড ভাড়া নেয়ার জন্য একটি বিভাগ আছে। সেখানে রেটও নির্ধারিত করা আছে। এ রেট বয়ফ্রেন্ডের ধরন অনুসারে বিভিন্ন রকমের। তবে প্রতিদিনের জন্যে ন্যূনতম ৮২ ডলারে যে কেউ বয়ফ্রেন্ড ভাড়া নিতে পারেন। এ রেট বয়ফ্রেন্ডের ধরন অনুসারে বাড়বে। সর্বোচ্চ মানের কোনো বয়ফ্রেন্ড পেতে তরুণীকে খরচ করতে হবে ১ হাজার ৩২১ ডলার। এ প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত মুক্ত আলিঙ্গন, হাত ধরে হাঁটা ও বিদায়ী চুমু। এর বেশি কিছু চাইলে তরুণীকে আলাদা অর্থ গুণতে হবে। [আমাদের সময় : ১৩.২.১৪]
এখানে দীর্ঘ ব্যাখ্যাার প্রয়োজন নেই। আলু পঁচছে আর ফুল হাসছে। এর ভেতর দিয়ে আমরা বাধঁনহারা যে প্রেম ও বসন্তের দিকে যাচ্ছি তার এক জীবন্ত ছবি এই সংবাদটি।
চীনের মতো হয়তো বয়ফ্রেন্ড দেয়ার মতো সংগঠনের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হচ্ছে না আমাদের দেশে, কিন্তু বয়ফ্রেন্ড আর গার্লফ্রেন্ড বিনিময়ের বাজার যে চাঙ্গাভাবেই চলছে সে কথা বলে দিচ্ছে ফুলের বাজার। তারই পথে পাল্লা দিয়ে সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে বিয়ে বিচ্ছেদ আর প্রেমজনিত খুনের ঘটনা। তরুণ-তরুণীদেও অবাধ উচ্ছ্বাসে কলকল করা সরকারি ও প্রাইভেট ইউনির্ভাসিটিগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় নির্ণয় করা কঠিন এদের এই বিদ্যালয় কি প্রেমের তীর্থভূমি না বিদ্যানিকেতন। এ কোন সভ্যতার দিকে যাচ্ছি আমরা!
জীবনের সকল ক্ষেত্রেই চলছে এখন এই বাঁধন ছেঁড়ার যুদ্ধ। বাঁধনহারা গার্মেন্টসশিল্পীদের ফুঁসে ওঠা বিপ্লবে দেশের একমাত্র উতপাদনক্ষেত্র এখন মরি মরি করছে। বাঁধনহারা ছাত্রলীগের ধ্বংসলীলায় স্তম্ভিত বাংলাদেশ এখন ছাত্ররাজনীতির নাম শুনলেই বলে ওঠছে আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজিম। বাঁধনহারা মন্ত্রী-এমপিদের অর্থকেলেঙ্কারী রাজনীতিকে করেছে ছি ছি কলঙ্কের পথ। ভবিষ্যতে হয়তো সভ্য মানুষের জন্যে মন্ত্রী এমপি কথাটা একটা গালি হয়ে দাঁড়াবে। বাঁধনহারা পোশাকে উন্মাদ তরুণীদের মাতাল উপস্থিতি একুশে মেলাকে করেছে টানটান তরুণীর হাট। বইয়ের স্টলে তরুণী বই দেখে, না বইবিক্রেতা দেখে তরুণীর মুক্ত গতর কে করবে পার্র্থক্য। উন্মাদ তরুণ সারাদিন ঘুরছে বইমেলায়। কিন্তু কিসের নেশায়? বই না অন্য কিছু এসবই বাঁধনহারা পশ্চিমা সভ্যতার কলঙ্ক। ভয় ও কলঙ্কের কথা হলো, আমাদের মাতাল কবি সাহিত্যিকরা উত্তাল এই উন্মাদনাকেই গ্রহণ করছে তাদের রচনার বিষয় হিসেবে। ফলে ভাড়াটে বয়ফ্রেন্ড জাতীয় প্রেমের উতকট গন্ধে মেলার কাছে ভিড়তে পারছে না সমাজের সভ্য মানুষরা। এই পতনের শেষ কোথায়?
কালের এই ক্রান্তিকালে সব স্বপ্ন এসে আছড়ে পড়ে একটি জায়গায় কওমি মাদরাসা। এখনো বাঁধনে অটুট এই শিক্ষাশিবিরই জ্ঞান চিন্তা স্বপ্ন ও সভ্যতার নির্ভয় আশ্রয়। আর বাধঁনটাই এদের সবচে বড় হাতিয়ার। বাঁধনহারা পৃথিবীর উন্মাদ পথচলা দেখে দৃঢ় হোক এই শিবিরের বাঁধনপ্রীতি। ভেঙে পড়া সভ্যতা, কলঙ্কিত মানবপ্রেম আর পুড়ে যাওয়া সংস্কৃতি আবারো জেগে ওঠুক নতুন আশ্বাসে, নতুন সজীবতায় আর মহতি বিশ্বাসের দোলায় স্বপ্নে সংগ্রামে এবং নির্মাণের সকল প্রাঙ্গনে।
ঢাকা ২৪.০২.২০১৪
সংখ্যালঘু নির্যাতন আ.লীগের রাজনীতি
এবং আমরা যে কারণে আতঙ্কিত
মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন
ফেব্রুয়ারি'১৪
সংখ্যালঘু নির্যাতন একটি বিষব্যাধি। জালেম ও বজ্জাত ইংরেজরা একদা এই জঘন্যতাকে ক্লাসিক মর্যাদা দিয়েছিলো। পরে মহাভারতের হিংস্র হিন্দুরা সেটাকে এক ভয়ঙ্কর শিল্পের রূপ দিয়েছে। ফলে এখন সংখ্যালঘু নির্যাতন কথাটা উচ্চারিত হতেই এই উপমহাদেশীয় একজন নাগরিকের চিত্তে যে ছবি ভেসে উঠে তা হলো- ‘গুজরাটের শরণার্থী শিবির। সায়রা বানুও এই শিবিরের বাসিন্দা। তার বাড়ি নরোদাপাতিয়ার হোসেনপুর গ্রামে। তিন সন্তান নিয়ে তিনি ত্রানশিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। তথ্যানুসন্ধানী দলের সঙ্গে আলাপ কালে তিনি জানালেনÑ আমি মেয়েদের আর্তনাদ শুনতে পেলাম। পঁচিশজন লোক একটি উলঙ্গ মেয়েকে ধাওয়া করছে। সায়রা বানু আরও জানানÑ পুলিশের গুলিতে আমি আমার স্বামীকে মারা যেতে দেখলাম। আরও দেখলাম মিষ্টি দোকানের মালিক দাঙ্গাকারীদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করছে। মুসলমানদের বাড়িঘর, দোকান-পাট, হোটেল, কাপড়ের কল, বাস-প্রাইভেট, মটরগাড়ি, বহু মসজিদ-দরগাহ কোনো কিছুই রক্ষা পায়নি। পুড়ে যাওয়া ঘরের দেয়ালে লেখা ছিলো ‘ইয়ে অন্দর কি বাত হ্যায়, পুলিশ হামারা সাত হ্যায়।’ অর্থ্যাৎ ভেতরের কথা হলো পুলিশ আমাদের সঙ্গে রয়েছে। আরেক জায়গায় লেখা ছিলো ‘মুসলমানদের কিভাবে পুড়িয়ে মারতে হয় তা আমাদের থেকে শিখে নাও।’
ভারতের আই এস আই অফিসার হর্ষ সান্দার। তিনি পূর্বে ইন্দোরে সহকারী কালেক্টরের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। গুজরাটে ২৯ টি ত্রানশিবিরে আশ্রয় নেয়া ৫৩ হাজার মৃত্যুতাড়িত নর-নারীদের পরিদর্শন করে এসে এক নিবন্ধে লিখেছেন- ‘দাঙ্গাবাজরা আট মাসের গর্ভবতী মায়ের পেট চিরে ভ্রƒন বের করে এনে শত আর্তনাদ সত্ত্বেও তার চোখের সামনে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে। ২৯ জন সদস্যের একটি পরিবারকে তাদের ওই ঘরের উঠানে অবরুদ্ধ হোস পাইপের তীব্র স্রোত ধারায় হাঁটু অব্দি ডুবানো হয়। তারপর হাই টেনশন বিদ্যুৎ প্রবাহ চালিয়ে সেই অবরুদ্ধ জলরাশির মধ্যে দণ্ডায়মান অজানা আতঙ্কের ভয়ঙ্কর আঘাতে প্রস্তরবত নারী শিশুসহ ২৯ জনকে হত্যা করা হয়। গুজরাট যা প্রত্যক্ষ করেছে তা কেবল দাঙ্গা ছিলো না। ছিলো সন্ত্রাসী আক্রমণ, পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ ও নারকীয় হত্যাকাণ্ড। (কলকাতা থেকে প্রকাশিত সানন্দা : ২০০২)
প্রিয় পাঠক! চোখের পানি ধরে রাখা যায়? আরো কান্না আছে! পড়–নÑ ‘ষোড়শী মেহেরুন্নেসাকে ওরা নগ্ন করলো আমার সামনেই এবং ওরা তার ওপর ঝাপিয়ে পড়লো হায়েনার মতোই। মেয়েদের ওরা ধর্ষণ করলো প্রকাশ্যে রাস্তায়। দেখলাম ধর্ষণ শেষে একটি মেয়ের যৌনাঙ্গ ওরা ফালি ফালি করে কাটলো। এবং তারপর তার শরীরে ধরিয়ে দিল আগুন।’ আরও পড়–ন একজন আবুল উসমানের কথাÑ ‘তারা আমার ২২ বছরের মেয়েসহ এলাকার মা-বোনদের নগ্ন করলো এবং শুরু করলো গণধর্ষণ। আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। আমার স্ত্রীসহ আমার পরিবারের ৭ সদস্যকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। এদের মধ্যে আমার ৭, ১৪ ও ১৮ বছরের ছেলে এবং ২, ৪, ও ২২ বছরের মেয়ে রয়েছে।’
পৃথিবীর কোনো পিতা কি পারবে এই ঘটনা পড়ে চোখের পানি আটকে রাখতে? ২০০২ সালের গুজরাট সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে পাষাণ ছবি এই পৃথিবীকে দান করেছে তাকি কোনো দিন এই পৃথিবী মুছতে পারবে? এই কলঙ্ক মুছা যায় না। (বিস্তারিত দেখুন উবায়দুর রহমান খান নদভী সম্পাদিত রক্তভেজা গুজরাট)
সংখ্যালঘু নির্যাতনের এই চিত্র মিয়ানমারেও কম দগদগে নয়। গত ১৯ জানুয়ারির পত্রিকা জানাচ্ছেÑ মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ও বৌদ্ধরা চলতি সপ্তাহে প্রায় ৬০ জন রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করেছে। নিহতদের মধ্যে বরাবরের মতো ছিলো নারী ও শিশু। ভয়ের কথা হলো, মুসলমান প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে যে রাখাইন রাজ্যে সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক সাহায্যসংস্থার সদস্যদের সরকার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে বলে প্রকৃত অবস্থা জানার কোনো উপায় নেই। (নয়াদিগন্ত)
এই হলো সংখ্যালঘু মুসলমান নির্যাতনের ভয়ঙ্কর চিত্র। যখন আমরা পত্রিকায় দেখি বাংলাদেশেও নির্যাতিত হচ্ছে সংখ্যালঘুরাÑ তখন আমাদের বুক কেঁপে ওঠে ভয়ানক আতঙ্কে। আমাদের এই আতঙ্কের অনেক কারণ আছে। যথাÑ
এক. আমাদের আত্মার আত্মীয় ভারত ও মিয়ানমারের মুসলমানগণ সংখ্যায় কম বলে প্রতিনিয়ত হিন্দু ও বৌদ্ধদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে। সেই নির্যাতনের দুএকটি চিত্র আমরা ওপরে উল্লেখ করেছি। সুতরাং সংখ্যায় কম বলে মনভাঙা মানুষগুলো নির্যাতনের শিকার হয় তাদের সেই শরীর ও মনের বেদনা আমরা উপলব্ধি করতে পারি গুজরাট ও বাবরিমসজিদের অভিজ্ঞতা থেকে। তাই আমরা এধরনের ঘটনার সঙ্গে যেকোনোভাবে জড়িতদের মানুষ বলে মনে করি না। মনে করি তারা মানুষসমাজের জঘন্য কলঙ্ক!
দুই. আমরা এ কারণেও আতঙ্কিতÑ এপারের এই নির্যাতনের খবর যখন ওপারে ছড়াবে তখন দাঙ্গাবিলাসী হিন্দু ও বৌদ্ধরা সরকারি রামবাহিনীকে সঙ্গে করে নামবে খুনের মহড়ায়। খুন ধর্ষণ আর শিশু হত্যার উৎসব গিয়ে পূর্ণতা লাভ করবে মসজিদ আর মাদরাসা পোড়ানোর ভেতর দিয়ে। বিনিময়ে মোদিরা পাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ আর ‘অহিংস’ অতঃপর সাধু হিন্দুদের উষ্ণ সমর্থন। তারপর প্রধানমন্ত্রিত্ব। আমরা আমাদের ভাইবোন আর অসহায় শিশুদের করুণ আর্তনাদ শুনতে চাই না।
তিন. এই কারণেও আমরা আতঙ্কিত- ঘোলাজলে আজন্ম বিলাসী আওয়ামীলীগ এখন ক্ষমতায়। সংখ্যালঘু দাবাখেলায় এই দলের দক্ষতা এবং খ্যাতি সবটাই সুবিদিত। ফলে দেশের শান্তিপ্রিয় নাগরিকরা আস্থা রাখতে পারছে না- আওয়ামীলীগ সংখ্যালঘু নিয়ে রাজনীতি করবে না।
জনগণের এই ভয় ও আস্থাহীনতার কারণও আছে। সবচে বড় কারণ হলো জনগণ বিচ্ছিন্ন আওয়ামীলীগ এখন টিকে আছে দুই শক্তিতে। ১. গোলামমিডিয়া নির্ভর রাজনীতির ভেলকিবাজি ২. দাদাদের দয়া, স্নেহ-মমতা, আশীর্বাদ ও সাগর সাগর আশ্বাস। সুতরাং দাদাদের এত্তসব দানের বিনিময়ে অন্তত তাদের প্রিয় একটি আইটেম ‘সংখ্যালঘু ইস্যু’ দিয়ে হালকা একটু কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন তো করতেই হয়।
চার. আওয়ামীলীগ এসব ঘটনাকে উপলক্ষ করে উগ্রমৌলবাদের ধুম সৃষ্টি করতে পারে। আর এই কাজে বিবেক শক্তি সবকিছু বিসর্জন দিয়ে সার্বিক সহযোগিতার জন্যে আছে তাদের গৃহপালিত নানা প্রজাতির গোলামসমাজ। যেমন ঘাদানিক গণজাগরণ মঞ্চ আর বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বুদ্ধিজীবীর পাল। সংখ্যালঘুর কাহিনী সৃষ্টি থেকে প্রিন্টআউট পর্যন্ত যে কোনো ‘কাম’ করার জন্য এরা হরদম প্রস্তুত। বিশেষ করে হেফাজতের আন্দোলনে নাপিতের ঘরে আশ্রয় লওয়া, মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানিদের মুরগি সাপ্লাই দিয়ে যিনি মুরগি শাহরিয়ার হয়ে ছিলেন আর ২০০১ সালে যিনি সংখ্যালঘু কাহিনী সাপ্লাই করতে গিয়ে ধরা খেয়ে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় পড়ে কুখ্যাত হয়েছিলেন তিনি ও তার সহচর আগাচৌরা তো একপায়ে খাঁড়া। কাজেই যথেষ্ট আশঙ্কা আছে, ২০০১ সালের মতো সংখ্যালঘু ধুম সৃষ্টি করে আওয়ামীলীগ এই গোলাম সমাজের দ্বারা ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থান দেখিয়ে ‘একমাত্র’ ইসলাম ধর্মীয় রাজনীতি ও সাংগঠনিক সকল কর্মকাণ্ডের গলা চেপে ধরতে পারে। বিষিয়ে তুলতে পারে এদেশের সকল মুসলমানের ধর্মজীবন। এতে- ‘আগে আওয়ামীলীগ পরে মানুষ’- জাতীয় গোষ্ঠী ছাড়া কেউ হয়তো নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পাবে না।
পাঁচ. এতে পদে পদে বাধা, আঘাত, আক্রমণে অতিষ্ট হয়ে এদেশের মাটি মানচিত্র ও ধর্মের বান্ধবরা হয়তো একদা ফুঁসে উঠবে। আর তখনই আওয়মীলীগ পেয়ে যাবে তাদের সর্বোচ্চ প্রার্থনার মানিক- জঙ্গিবাদ জঙ্গিবাদ জঙ্গিবাদ...। অতঃপর জঙ্গিবাদ দমনের জন্য চাই বিশ্বজিৎ মারা হাতিয়ার। দেশি-বিদেশি অস্ত্রে প্রশিক্ষিত সাহসী, সব বয়েসী সৈন্যে বলিয়ান আওয়ামীলীগ। এই যুক্তিকে ‘ভোটশূন্য’ নির্বাচনে ‘গোস্সাকরা’ আমেরিকাও হয়তো উড়িয়ে দিবে না। সুতরাং পাকা হয়ে যাবে রাজকুরসি!
আমাদের এই সব আশঙ্কও আতঙ্কের অনেক কারণ আছে। প্রথম কারণ হলো- সংখ্যালঘু নির্যাতনটা আসলে কী? এর উত্তর আমরা ভারত ও মিয়ানমার থেকে শিখতে পারি। সেখানে মুসলমান নারী শিশুদেরকে পর্যন্ত খুন করা হচ্ছে উৎসব করে। উদ্দেশ্য, দেশকে মুসলমান মুক্ত করতে হবে। অথচ আমাদের দেশে কি এমনটি ঘটছে? এখন চলছে দেশে রাজনৈতিকভাবে এক অপূর্ব অস্থির কাল। গত একবছরে দেশের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আগুনে পুড়ে মারা গেছে ৪৬৬ জন। তাছাড়া কর্মক্ষেত্রের দুর্ঘটানা ও সহিংসতাসহ ধরলে এ মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২১২৮ জন। (প্রথম আলো : ২৭.১২.১৩)
লক্ষ্য করার বিষয় হলো এই রাজনৈতিক খুনের ৪৬৬ জনের মধ্যে নির্বাচনের তাফসিল ঘোষণার পর থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত মারা গেছে ১২০ জন। তাও মাত্র ৩০ দিনে। আর শুধু ভোটের দিন (৫ জানুয়ারি ২০১৪) এগারো জেলায় খুন হয়েছে ১৯জন। এদের মধ্যে ১৫ জনকেই খুন করেছে পুলিশ এবং সরাসরি গুলি করে। তাছাড়া এরা সবাই বিএনপি ও জামাতের কর্মী কিংবা সমর্থক। নির্বাচন ঠেকাও আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে দুইশরও বেশি ভোটকেন্দ্র। আর তারই ধারাবাহিকতায় নির্বাচন পরবর্তীতে চলেছে হামলা প্রতি হামলা, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। এই ধাওয়া হামলার ঝড়ে পড়ে নাকাল এদেশের সর্বস্তরের জনগণ। সেখানে কে মুসলমান, কে খ্রিষ্টান, কে হিন্দু, আর কে বৌদ্ধ সেই ভাগাভাগিটা আসছে কেন? ভাগাভাগি যদি হয়ে থাকে সেতো নির্বাচনের পক্ষ বিপক্ষ কিংবা ১৪ দল আর ১৮ দল। কোথাও নির্যাতিত হয়েছে ১৮ দলের পক্ষ এবং সংখ্যায় তারাই বেশি। আবার কোথাও ১৪ দলের। এমনকি চাপাতিলীগের স্পাততরুণরাও ধৃত প্রহৃত আক্রান্ত হয়েছে। এখানে শুধুই কপাল এবং শক্তির খেলা। লঘু আর গুরু যদি হয় সেটা শুধুই ১৮ দল আর ১৪ দলের বিচারেÑ ধর্মের বিচারে নয়। কারণ-এদেশের হিন্দু প্রজারা যেমন আওয়ামীলীগ করে তেমনি বিএনপিও করে। তবে যেভাবে আওয়ামীলীগ দ্বারা প্রতারিত হয় তেমনি বিএনপি বা অন্য কোনো দল দ্বারা প্রতারিত হয় না-এই যা পার্থক্য।
সংখ্যালঘুদের শুকিয়ে যাওয়া কম্পিত মুখ, পুড়ে যাওয়া ছাই আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক পথচলার সবচেয়ে মূল্যবান পাথেয়। প্রমাণ দিই। খাঁটি আওয়ামীলীগ ঘরানার কাগজ দৈনিক আমাদের সময়ের ভাষ্যÑ ‘জামাত শিবিরের উপর দোষ চাপাতে নিজের স্কুলে নিজেই আগুন দিয়ে স্থানীয়দের হাতে ধরা পড়েছেন স্থানীয় আওয়ামীলীগ সমর্থক ও বগুড়ার সুজাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মান্নান । এ সময় বিক্ষুব্ধরা তাকে গণধোলাই দিয়ে আটকে রাখে। (৮.১.১২)
খুঁজলে দেখা যাবে পত্রিকায় প্রকাশিত সংখ্যালঘু সব ঘটনার পিছনেই কোনো না কোনো আওয়ামী মানিকের কারিগরি আছে। অথচ সেটা শুধুই ১৮ দল আর ১৪ দলের লড়াই। প্রচার করা হচ্ছে সংখ্যালঘু শিরোনামে। সকালে বাড়ি ছাড়া আবার সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা নিয়ে এতবড় কারবালা মাতম অথচ রাজনীতির সহিংস থাবা যে ৪৬৬ জন বাংলাদেশিকে খুন করলো এই নিয়ে কোনো কান্না নেই। আছে শুধু শীতল দোষাদুষি আর গরম প্রতিশোধের হুংকার।
সংখ্যালঘু প্রসঙ্গে আমরা ভুলে যেতে পারি না আওয়ামীলীগের পুরনো পটিয়সী চরিত্রকে। ভারতীয় আদলে সংখ্যালঘু নিযার্তনের একখানা নাটক নির্মাণে হাত দিয়েছিল সিরাজগঞ্জ জেলা শাখার ঘাদানিক সভাপতি সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জের রহমান পিপি, সাবেক এমপি লতিফ মির্জা ও শাহরিয়ারের হাতে নির্মিত সেই নাটকের নাম দিলো ‘পূর্ণিমা ধর্ষণলীলা’ কিন্তু পরে দেখা গেল, সেখানে ধর্ষণও ছিল না, সংখ্যালঘুও ছিল না। ছিল জমি জিরাতের বিরোধ ও সামান্য হাতাহাতি। (দৈনিক মানবজমিন: ১৫.১২.২০০১)
সরেজমিন ঘুরে দীর্ঘ রিপোর্ট তখন জানিয়েছিল-শাহরিয়াররা কতটা মিথ্যা বলতে পারে এবং আওয়ামীলীগ কত জঘন্য খেলোয়ার।
তাছাড়া আওয়ামীলীগ যে অসত্য কথনে কতটা শিল্প মানে উর্ত্তীণ তার নমুনা তো সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন। বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নেই। কত সুন্দর নিখুঁত উজ্জ্বল হলো তার বিবরণ দেয়ার শক্তি সাহস কোনোটাই আমাদের নেই। সংক্ষেপে আওয়ামী ঘরানার বিখ্যাত কাগজ দৈনিক আমাদের সময়ের নির্বাচনের পরের দিনের শিরোনামগুলো তুলে দিচ্ছি। প্রধান সংবাদ ॥ ভোটারের মূল্যহ্রাস ॥ নি¯প্রাণ ভোট কেন্দ্র বিশ্রামে পুলিশ ॥ ভোটই পড়েনি ৩৪ কেন্দ্রে ॥ স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রির ছেলের নেতৃত্বে ভোট ছিনতাইয়ের অভিযোগ ॥ বস্তিবাসিকে জোর করে ভোটকেন্দ্রে আনা হয় ॥ সময় নেই, ব্যালটের মুড়ি আমাদের কাছে দেন ॥ আওয়ামীলীগের খোড়া যুক্তিÑ শীত কুয়াশায় ভোট কমেছে ॥ নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের-মন্তব্য ১০ শতাংশের কম ভোট পড়েছে ॥ আপা এসেছেন, লাইনে দাঁড়ান ॥ বিদেশি পর্যবেক্ষকদের চোখে নির্বাচনÑ সহিংস নিরুত্তাপ ও ভোটার বিহীন ॥ সংবাদ সম্মেলনে সিইসিÑ কিছু দল অংশ না নেয়ায় ভোটার উপস্থিতি কম। বিদেশি পর্যবেক্ষকদেও কাছে গণতন্ত্র শিখতে হবে নাÑ ইনু ॥ এর ওপর আছেÑ (৬.১.১৪) প্রথম আলোর প্রথম সংবাদ শিরোনামÑ ‘জাল ভোট, কলঙ্কিত নির্বাচন।’ দুটি বড় ছবি একটি ঢাকা ১৭ আসনের বনানী বিদ্যানিকেতন ভোট কেন্দ্রের সহকারি প্রিজাইডিং কর্মকর্তার ব্যালট পেপারে সিল মারা এবং সাংবাদিক দেখে সব কিছু ফেলে চোরের মত দাঁড়িয়ে থাকার ছবি। দ্বিতীয়টিতে ঢাকা ৬ আসনের টিকাটুলি কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে নির্বাচনী কর্মকর্তার কাছ থেকে ব্যালট পেপার নিয়ে তার সামনেই জাল সিল মারার ছবি। এসব কিছু ছাড়িয়ে আছেÑ নৌকার আরেক কাণ্ডারি নজিবুল বশর মাইজভান্ডারির জনতার সামনে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার ছবি। আর এ জাল জঘন্য কলঙ্কভরা নির্বাচনকে শেখ হাসিনার ছেলে জয় বললোÑ নির্বাচনে কোনো অনিয়ম হয়নি। (আমাদের সময়: ৭.১.১৪)এমনকি ভোট গণনার আগেই রাতের বিবিসি সাক্ষাৎকারে তোফায়েল বললেন ৪০ শতাংশেরও বেশি ভোট পড়েছে। দেখা গেল ইসিও একদিন পর (৪০.৫৬) তাই বললো। খেলা এখানেই শেষ নয়Ñ জামাত থেকে আসা আওয়ামী প্রার্থী আবু রেজা নদভী আমাদের সময়ের ভাষায়Ñ ‘এতবেশি ভোট পেয়ে প্রার্থীই বিস্মিত।’ বিস্মিত কেন, উচিত ছিল আশ্চর্য হয়ে অন্তত হার্টফেল করা। স্বাধীনতার পর এই সাতকানিয়া-লোহাগাড়া (চট্টগ্রাম-১৫) আসনে আওয়ামীলীগ কোনো সময় পাশ করেনি। এমনকি একবার সর্বোচ্চ ৫০ হাজার ভোট পেয়েছিল আর একবার দ্বিতীয় হয়েছিল। আর এবারের নির্বাচনের দৃশ্যছিলÑ একটি কেন্দ্রে ভোট সংখ্যা ২০৯৫টি। ভোট পড়েছে মাত্র ৯টি। আরেকটিতে ভোট সংখ্যা ৮৪৩টি। ভোট পড়েছে ১টি। সেখানে মি.আবু রেজা নদভী পেয়েছেন এক লাখ এক হাজার ৮৬৬টি ভোট।
(আমাদের সময়: ৭.১.১৪)
কথা হলো, এই নির্বাচনকে যারা ৪০শতাংশ ভোটের নির্বাচন বলতে পারে, বলতে পারে ভোটে কোনো অনিয়ম হয়নি তাদের যখন যা প্রয়োজন তা বলতে করতে ও প্রতিষ্ঠিত করতে কি কোনো সমস্য হবে? হতে পারে? তবুও সংখ্যালঘু খেলায় তারা যে পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছে তাতে তাদের কোনো জুড়ি নেই। তাদের ওই লাল নাটকের আত্মার ধ্বনি ভালো বুঝবে ভারত। ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার একটি সংবাদের মাধ্যমে আজকের লেখার ইতি টানছি-‘এটা ছিল (২০০০) ১অক্টোবরের ভোটের পর থেকেই বিভিন্ন জেলায় আওয়ামীলীগের স্থানীয় কর্মকর্তা ও নেতাদের ওপর হামলা হয়েছে। কিন্তু সেই সব হামলার খতিয়ান থেকেই স্পষ্ট, নেতা ও কর্তার ওপরে যারা ক্ষমতায় থাকার সুবাধে বিরোধীদলের কর্মী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো, মাস্তান বাহিনী দিয়ে বিরোধী কর্মীদের এলাকা ছাড়া করা এবং প্রশাসনের প্রভাব খটিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অগণিত মামলা রুজু করা ছিলো নিত্যদিনের ব্যাপার। ভোটে লীগের শোচনীয় বিপর্যয়ের পরে অত্যাচারের বদলা নিতে অন্যদলের কর্মীরা যখন লীগের সেই সব নেতার ওপর হামলা শুরু করে তখন তারা মুসলমান হিন্দু বাচ-বিচার করেনি। মেয়েরা ধর্ষিত হয়েছে। বাড়িঘর লুট হয়েছে, সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে ওই সব পরিবারই। কিছুদিন আগেও লীগের বলিষ্ট নেতা ছিলেন এবং বর্তমানে একটি সংবাদ পত্রের সঙ্গে যুক্ত, এমন একজনের মতে দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যÑ যা ঘটেছে তা রাজনৈতিক সন্ত্রাসের পাল্টা সন্ত্রাস। এতে রাজনীতি আছে, কিন্তু যেভাবে শুধুই সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর আক্রমণের কথা বলা হচ্ছে তা ঠিক নয়।
(মানবজমিন:৭.১১.০১)
আমরা দেখছি আওয়ামীলীগ সেই পুরোনো পথেই হাঁটছে। এই পথ আওয়ামীলীগের জন্য লাভজনক হলেও বাংলাদেশের জন্য কলঙ্কজনক। এদেশের সুস্থ, সচেতন সকল নাগরিককে ঘৃণার সঙ্গে এই কলঙ্ক রুখে দাঁড়াতে হবে।
ঢাকা-২৫.০১.২০১৪
.....................................................................................................
..................................................
চলবে...।
বিশ্বজিত॥ একটি লাল বিলবোর্ড
এবং একখানা জরুরি বিজ্ঞপ্তির আবেদন মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন নানা কারণে বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড ছিল গত হাসিনাসরকারের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ছাত্রলীগ আর কোনো ঘটনার ভেতর দিয়ে নিজেদেরকে এতটা মেলে ধরতে পারেনি বিশ্বজিতের খুনের ঘটনার মধ্য দিয়ে যতটা পেরেছে। ছাত্রলীগের এই বিকশিতরূপ সারা পৃথিবীর সামনে বাংলাদেশকে নতুন মাত্রা দান করেছে। এর জন্যে কেউ স্বীকার করুক আর নাই করুকÑ ছাত্রলীগ ও তার কর্তা অবিভাবকদের কাছে বাংলাদেশ চিরদিন ঋণী হয়ে থাকবে। কারণ, এর আগ পর্যন্ত নানা রকমের কল্পিত সন্ত্রাসের গল্প ফেঁদে জগতের সামনে বাংলাদেশকে জঙ্গিরাষ্ট্র বানাবার অফুরন্ত মেহনত করেছেন এদেশের মেধাবী, বুদ্ধিজীবী আর স্বাধীনতার একমাত্র ঠিকাদার রাজনীতিকরা। কোথাও রাস্তায় ফাটল ধরলে, পূজো উপলক্ষে ছেলে পুলেরা বাজি ফুটালে কিংবা বাথরুমে পা ফসকে কোনো বিশেষ মহলের রাজনীতিকের ঠ্যাং ভাঙলে ‘নিশ্চয় এর সঙ্গে কোনো জঙ্গির সম্পৃক্ততা রয়েছে।’ অত:পর তদন্ত কমিটি এবং কবিতা রচনার মতো টাটকা তদন্ত রচনার কৃতিত্ব। দিনের পর দিন এই একই ধারার তদন্ত-গল্প পড়ে মানুষ যখন ক্লান্ত, বিরক্ত তখনই ছাত্রলীগ এই বাঙালি জাতিকে একটি অরিজিনাল খাঁটি টাটকা জঙ্গিগল্প উপহার দিয়েছে। এই অবদান অনবদ্য। কিন্তু বাংলাদেশের বেরসিক মিডিয়া তা বুঝলো না। ভয়জাগানিয়া এই ঘটনার অনুপুঙ্খ বিবরণ তুলে ধরলো জাতির সামনে। স্থির চিত্র ভিডিও ফুটেজসহ নানা উপায়ে ধরে রাখলো সংখ্যালঘুর রক্তে লেখা এই পাষাণ কাহিনী। দেশ বিদেশে আওয়াজ উঠলো- বিচার চাই, বিচার চাই! চোখ পাকালো নাড়ির সুহৃদ ভারত। রাম রাম বলে ফুঁসে উঠলো আজন্ম আপন হিন্দুসমাজ। এর সঙ্গে মুখ ব্যাদান করে সামনে এসে দাঁড়ালো সবগুলো মানবাধিকার সংগঠন। অবশেষে পাততে হলো বিচারের চৌকি। আদালত ঘোষণা করলোÑ বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার রায়, ছাত্রলীগের আট কর্মীর ফাঁসি। পৃথিবী অন্তত এইটুকু সান্ত্বনা পেলÑ আওয়ামীলীগ অন্তত ভারতের মন বুঝে। দেশ ইলিয়াস আলীর মতো নেতা হারালো তার জন্য একটি মানবিক বাক্যদান সম্ভব হলো না আর আপন ঘরের আট সন্তানের ফাঁসি। শুধু আটই নয়; এই আটের সঙ্গে আছে আরও তের আসামীর যাবজ্জীবন। ওরাও একই পরিবারের। মানে পুরো এই একুশ রতœই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কর্মী। (প্রথম আলো : ১৯.১২.১৩) নাতিদীর্ঘ কাহিনী। বিশ্বজিৎ দাস খুন হয়েছে ৯ ডিসেম্বর ২০১২। ২০১৩ এর ৫ই মার্চ দাখিল করা হলো অভিযোগ পত্র। ২ জুন অভিযোগ গঠন। ১৮ জুন জনগুরুত্ব বিবেচনায় মামলাটি দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর প্রজ্ঞাপন। ২৭ নভেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু। ১ ডিসেম্বর যুক্তি উপস্থাপন শেষ। মামলার রায় ১৮ ডিসেম্বর ২০১৩। বলা যায় ইতিহাসের এক স্মারকসিদ্ধান্ত! এখন এই রায় কার্যকর হবে কি না, সেজন্যে কিছু কাল অপেক্ষা করতে হবে। তবে এই রায় অন্তত এইটুকু প্রমাণ করেছেÑ এদেশের সবগুলো মিডিয়া এক সাথে মিথ্যা বলে না। আদালতের এই রায় এইটুকু জানিয়ে দিয়েছেÑ বিশ্বজিতের খুনিরা ছাত্রলীগেরই গর্বিত সম্পদ! এক বছর অনেক বেশি সময় নয়। তাই ভুলে যাওয়ার কথা নয়Ñ ২০১২ এর ৯ ডিসেম্বর বিশ্বজিৎ খুন হওয়ার পর পর যখন এই নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয় তখন আওয়ামীলীগের মাননীয় নেতাগন বেশ কিছু অমৃত বাণীতে ধন্য করেছিলেন অস্থির বিচলিত আতঙ্কিত জাতিকে। ভুলে যাওয়ার কথা নয়। তবু আরেক বার স্মরণ করিয়ে দিই। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের পর এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ শাখার সভাপতি এ এফ এম শরিফুল ইসলাম বলেছিলেনÑ যারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তারা ছাত্রলীগের কেউ নয়। অথচ তখন এই খুনিদের ছবিÑরাজনৈতিক পরিচয় মানুষের মুখে মুখে। একইভাবে ছাত্রলীগ নেতাদের এই সব জঘন্য কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন করা হলে আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছিলেন, যারা খুনের সঙ্গে জড়িত তারা কেউ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। এরা ছাত্রদল-শিবিরের এজেন্ট। অন্যদিকে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছিলেনÑ শিবিরÑছাত্রদল থেকে অনুপ্রবেশকারীরা পরিকল্পিতভাবে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। মূলত সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্যে এ কাজ করা হয়েছে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ এক প্রেস নোটে বলেছিলেনÑ এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ছাত্রলীগের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। খুনের সঙ্গে জড়িতরা বিএনপি-জামাতের সঙ্গে জড়িত ছিলো। |
আর হরতালকারীদের হাতের ছোঁয়ায় রানা প্লাজার ধ্বস ঘটিয়ে সারা পৃথিবী কাঁপিয়ে ছিলেন যে মখা আলমগীর, তিনি বলেছিলেনÑ বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ছাত্রলীগ কোনো ভাবেই জড়িত নয়। (সাপ্তাহিক ২০০০, বর্ষ ১৫, সংখ্যা ৩১)
বিশ্বজিৎ দাসের মামলার রায় সম্পর্কে যে কথাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ তাহলোÑ দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪ এর বিচারক এ বি এম নিজামুল হক আদালতের পর্যবেক্ষনে আসামীপক্ষের আইনজীবীদের সম্পর্কে বলেছেন ‘অপ্রিয় হলেও সত্য, মামলাটির বিচারকালে আসামীপক্ষের আইনজীবীদের কেউ কেউ মূল আসামীদের আড়াল করে যেনতেনভাবে তাদের বাঁচাতে চেষ্টা করেছেন। আসামীদের বাঁচাতে আইনজীবীরা অযৌক্তিক ও অপ্রাসঙ্গিক তথ্য উপস্থাপনও করেছেন। যা শ্র“তিকটু ও অসত্যে ভরা ছিল।’ (প্রথম আলো: ১৯.১২.১৩) এ হলো বিশ্বজিৎ দাসের মামলার রায় ঘোষণাকারী বিচারকের পর্যবেক্ষন- খুনিদের আইনজীবীদের প্রসঙ্গে। আমাদের কথা হলোÑ যারা আইনের ফাঁক-ফোকর গলিয়ে চার পয়সার ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করেন, তাদের মিথ্যায় ভরা অযৌক্তিক ও অপ্রাসঙ্গিক বক্তৃতা সম্পর্কে তো বিচারক বলেছেন এবং যথার্থই বলেছেন। কিন্তু আমাদের এই মান্যবর রাজনীতিকদের অকাট্য মিথ্যা ও জঘন্য কুৎসিৎ দলবাজি প্রসঙ্গে বলবে কে? এই যে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব থেকে শুরু করে মখা আলমগীর পর্যন্ত সকলেই চোখ বন্ধ করে নির্মম সুরে বলে গেলেনÑ খুনিরা কেউ ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত নয়। এমন কি আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিস্টার হানিফ এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ তো সেই পুরনো জাতআওয়ামী স্টাইলে বলে দিয়েছেনÑ খুনিরা ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের এজেন্ট! মানে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামীলীগের মানিকরা কখনও খুনের মতো ঘটনা ঘটাতে পারে না। এরা হলো এই সমাজের মুনি ঋসি। বিশেষ করে ঘটনা ঘটার পর কোনো ধরনের তদন্ত ও অনুসন্ধান ছাড়াই কী করে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বলা যায় খুনের সঙ্গে জড়িতরা বিএনপি জামাতের সঙ্গে জড়িত ছিলো? অনেকেই বলছেনÑ ‘ইহাই আওয়ামী লীগ এবং ইহাই আওয়ামীচরিত্র।’ কেউ কেউ বলছেনÑ আদালতের এই রায় আওয়ামীলীগের গালে একটি শক্ত চপেটাঘাত। আবার অনেকেই বলছেনÑ মখা সাহেবদের কি এই চপেটাঘাত উপলব্ধি করার ক্ষমতা আছে? বিশেষ করে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি আর নিরীহ জনতার রক্তে মানচিত্রকে নাইয়ে দেওয়ার পরও যখন বনমন্ত্রী বলেন, সরকারের ‘ভাবমূর্তি’ নষ্ট করার জন্যে এ কাজ করা হয়েছেÑ তখন কি বিশ্বাস করা যায় সরকারের এই ‘পাথর ভাবমূর্তি’ কে এই সামান্য চপেটাঘাত নাড়া দিতে পারবে! জানি নাÑ বাংলাদেশের মাটি মানুষ ও মানচিত্রের জন্যে এই দলকানা ও দলবধিরদের চেয়ে বড় কলঙ্কের আর কিছু আছে কি না? তাছাড়া এই দলদাসদের জন্যে আছে এঁটোজীবী জ্ঞানপামর। টেরাদৃষ্টি বুদ্ধিজীবীর দল! অনেকেই এই বুদ্ধিশ্রমিক কলমসন্ত্রাসীদের তুলনা করেন বড় লোকের বাড়ির পাহারাদার কুকুরের সঙ্গে। আমরা জানি না, এদের কর্ম ও চরিত্রকে বর্ণনা করার মতো কোনো ভাষা আসলেই আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন কি না। আমাদের সমাজে অবাঞ্ছিত কোনো দুর্ঘটনা ঘটামাত্র এই বুদ্ধিজীবীরা মাটিখুঁড়ে জঙ্গিবাদ বের করে আনে। একই দলের একুশ জন খুনি একজন সংখ্যালঘু হিন্দু নাগরিককে খুন করলো অথচ এই খুনিদের সম্পর্কে, খুনিদের সংগঠন সম্পর্কে, খুনিদের পৃষ্টপোষক মন্ত্রীদের সম্পর্কে কোনো রা নেই। এমন একটি খুনি সংগঠন কী করে চলতে পারে, কিভাবে খোলামেলা এই খুনিদের পক্ষে কথা বলে গাড়িতে রাষ্ট্রের পতাকা উড়াতে পারে এই নিয়ে আমাদের অন্ধ আঁতুর বুদ্ধিশ্রমিকদের একবিন্দু নড়াচড়া নেই, সাড়াশব্দ নেই। কী ভয়াবহ জঘন্য কাল অতিক্রম করছি আমরা! আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই আমাদের মিডিয়াকে। বিশেষ করে প্রিন্ট মিডিয়াকে, মিডিয়া সযতনে ছবি ভিডিও ও কলম চালু রেখেছিল বলেই মন্ত্রীদের বন্য চাতুর্য আর নির্লজ্জ দলবাজি খুনিদের আড়াল করে রাখতে পারেনি। রাখতে পারেনি তাদের দলীয় পরিচয়কে গোপন করে। মিডিয়ার অবদান অসামান্য। এতবড় অবদান যারা রাখতে পারে তাদের কাছে স্বভাবতই জাতির প্রত্যাশা অনেক বেড়ে যায়। সেই প্রত্যাশার প্রান্ত থেকে আমরা ক্ষুদ্র দুটি দাবি করছি। খুবই ক্ষুদ্র। এক. তারা যদি বিশ্বজিৎ দাসের মতো আরও যারা খুন হচ্ছেনÑ বিশেষ করে রাজনীতির মাঠে তাদের খুন হওয়ার ঘটনাকে ক্যামেরা বন্দি করেন অত:পর তা যথাযথ চেষ্টায় দলীয় পরিচয়সহ তুলে ধরেনÑ তাহলে বিশ্বজিতের ঘটনার মাধ্যমে যেমন পৃথিবী জেনেছে, জেনেছে ভারতওÑ আওয়ামী লীগ যতই নিজেদেরে হিন্দু দরদি বলে প্রচার করুক ওটা শুধুই রাজনীতি। হিন্দিুদের জঘন্য প্রকাশ্য খুনি আওয়ামীলীগ। একইভাবে পৃথিবী জানবার সুযোগ পাবে এদেশে সর্ববৃহৎ জঙ্গি সন্ত্রাসী দল কোনটি। দুই. এই আবদারটি খুবই ক্ষুদ্র। পত্রিকায় একখানা ক্ষুদ্র বিজ্ঞাপন প্রকাশের আবদার। কোনো দীর্ঘ বয়ান ও বিবৃতি নয়। এই যারা চোখের সামনের জঘন্যতা দেখেন না, কিংবা বিশেষ কোনো দলের সহিংসতা যাদের নজরে পড়ে না, অথবা খুন সন্ত্রাস শোনা মাত্রই মন ছুটে যায় যাদের দূর কল্পলোকেÑ এই জাতীয় বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বুদ্ধিজীবী আর টেরাচোখ কলম মজুরদের চোখের ও মস্তিস্কের চিকিৎসক চেয়ে ক্ষুদ্র একটি বিজ্ঞাপন। দুই ইঞ্চি হলেও আপত্তি নেই। এক রঙা হলেও দুঃখ নেই। তবে জায়গাটা যেন চোখে পড়ার মতো হয়। আমাদের বিশাল মিডিয়া এতটুকু আবদার রক্ষা করবে কি? ঢাকা, ২৪.১২.১৩ |